একদিন সে অফিস থেকে বাসায় প্রত্যাবর্তন করছিল। পথে তার শৈশবকালের সেই হাস্যরসিক বন্ধু– যে একদা সুখ আর আনন্দ দানে উৎসাহ প্রদান করত– তাকে আসতে দেখা গেল। সে অন্য পথে মোড় নেয়ার কথা ভাবল একমুহূর্ত। কিন্তু বন্ধু তাকে দেখে ফেলেছিল। নিরুপায় হয়ে তাকেও থামতে হল। তার স্ত্রীর অন্তর্ধানের খবর বন্ধু জানত না। বন্ধু পুরনো অভ্যেস মাফিক ঈষৎ হেসে বলতে লাগল, ‘আজ ভাবী যা ইচ্ছে বলুক, তোমাকে কিন্তু সাথে না-নিয়ে আজ কিছুতেই ছাড়ব না।’
বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থেকে তার চেহারা দেখতে থাকল সে। পরে একটা পবিত্র হাসি এসে তার ক্রোধকে দূর করে দিল। এবং সে বলে উঠল– ‘বেশ চল; কিন্তু কোথায় যাবে?’
বন্ধু আশ্চর্য হয়ে গেল।
তখনো রাতের অন্ধকার ভালো করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েনি। তারা সময় কাটাবার জন্য এদিক-সেদিক ঘুরতে লাগল। যখন রাত আর তার অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠল বন্ধু তাকে নিয়ে এক রূপোপজীবিনীর প্রকোষ্ঠে গিয়ে হাজির হল। জীবনের এটাই তার প্রথম অভিজ্ঞতা। সুতরাং ভয়, লজ্জা, সঙ্কোচ আর অনুতাপের মর্মপীড়ায় সে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কারণ যে জীবন থেকে সে আজ পর্যন্ত পূত পবিত্র ছিল– এখন সে পূত পবিত্রতার ওপর কালো দাগ পড়ে যাবে। আর এ কালো দাগ নিছক সেই অকৃতজ্ঞ মেয়েটার বদৌলতেই। কিন্তু এ মর্মপীড়া আর দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হল না। মদ্যপান করার সাথে সাথেই লজ্জার যে একটা ক্ষীণ অংশ বাকি ছিল তা-ও এক নিমিষে উড়ে গেল। এবং সেই রূপোপজীবিনীর হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আর নৃত্যে বিভোর হয়ে থাকল সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
এরপরই তার জীবনযাপন প্রণালির আর-একটা নতুন দিক শুরু হল। প্রথম প্রথম সে তার সেই আকাঙ্ক্ষিত স্থানে যাবার জন্য বন্ধুর সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত। কিন্তু পরে মনে হতে লাগল যেন বন্ধু তার জন্য একটা বাধা স্বরূপ। এবং সে একা একাই যাওয়া-আসা শুরু করল।
প্রথমে সারা মেন্ডি শহর ঘুরে-ফিরে বাজার যাচাই করত, মালামাল পরীক্ষা করত– পরে নিজের পছন্দ করা জিনিস শৌখিন মেজাজের কোনো ধনীপুত্রের মতো খরিদ করে নিত।
আনন্দোল্লাস তাকে এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে, অফিস থেকে বেরিয়ে সে খুব কম দিনই ঘরে ফিরে যেত। আজ এ-কোঠা তো কাল ও-অট্টালিকা, এবং সমস্ত অট্টালিকাময় হন্যে হয়ে ঘুরত। মিথ্যা প্রেম দেখানো এবং নিজেও সে প্রেম থেকে স্বাদ গ্রহণ করা– এই ছিল তার কাজ।
এসব কথা আগে তার কাছে স্বপ্ন বলে মনে হত। নতুন রাত আসত এবং নতুন করে রূপ আর প্রেমের পৃথিবী গড়ে তোলার ধ্যানে নিমগ্ন থাকত। সে মনে মনে এই নীতি পোষণ করত যে, মেয়েদের সাথে নিছক সময় আর লেনদেনের সম্পর্ক থাকা চাই এবং অন্যান্য জিনিসের মতো এদের ব্যাপারেও সবরকমের ছলনা বৈধ।
সে অফিস থেকে যা বেতন পায় তাতে একটি ছোট পরিবার স্বচ্ছন্দে সম্মানের সাথে কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাতে আজেবাজে খরচ করার কোনো অবকাশ থাকে না। বিয়ের আগে তার খরচ হত নেহাত নামমাত্র,… তাই এ থেকে সে বেশ একটা মোটা অঙ্ক জমিয়ে রেখেছিল। বিয়ের পর স্ত্রীর জন্য কিছু মূল্যবান উপহারাদি খরিদ করার পরও জমা টাকা তেমন কমেনি। কিন্তু এখন দিন দিন যেভাবে মোটা মোটা অঙ্ক খরচ হতে লাগল তাতে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এ দেউলিয়াত্বে জন্য সে চিন্তান্বিত হল। পাছে আবার একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায়। তাহলে তো সেই রূপো-জীবিনীর কাছেও যেতে পারব না।
পরপর রাত জাগার দরুন স্বাস্থ্য তার ভেঙে গেছে, ফলে তার যাতায়াতও অনেক কমে গেছে। আগে যেখানে মাসের মধ্যে বড়জোর দু’চার দিন অনুপস্থিত হত সেখানে এখন সপ্তাহের মধ্যে তিন-চার দিন অনুপস্থিত থাকতে লাগল।
একদিন সকালে সে অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হঠাৎ কে যেন তার কামরার
দরজায় করাঘাত করল আস্তে করে।
‘কে?’
কোনো উত্তর না-পেয়ে সে উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলে সে চমকে উঠে স্তব্ধ হয়ে গেল– তার পলায়িতা স্ত্রী পাগলের বেশে মাথা ঝুঁকিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। তার কাপড়ে-চোপড়ে একরাশ ময়লা, উস্কো-খুস্কো চুল। চেহারা রোদে পোড়া তামাটে এবং কোটরাগত চোখ। তাকে এ অবস্থায় দেখেই হঠাৎ তার মনে হল যেন একটা কুকুরি একরাশ নরম কাদার ভেতর আরেকটা কুকুরের সাথে আলিঙ্গন করে এইমাত্র উঠে এসেছে।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে নিশ্চুপ থাকল। পরে হঠাৎ তার পায়ের নিচে উপুড় হয়ে পড়ল এবং পা-জোড়া গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকল।
তার পা-জোড়া ছাড়িয়ে নেয়ার একটুও চেষ্টা করল না সে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। ‘ক্ষমা কর, আমাকে ক্ষমা কর।’ তার স্ত্রী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে লাগল– ‘আমি জানি তুমি এখন আমাকে ঘৃণা করবে। আমার চেহারা দেখার মতো উদারতাও তুমি দেখাবে না। কিন্তু তোমার কাছ থেকে আমি ভালোবাসা চাইছি না। সে আশা আমি করতে পারি না। আর আমি ভালোবাসার উপযুক্তও নই। শুধু তোমার দয়া চাই। আমার প্রতি শুধু একটু অনুগ্রহ কর। তোমার ঘরে একটু আশ্রয় দাও। এর বেশি আমি আর কিছু চাই না। আহ্, আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা কর। তোমার সাথে সাংঘাতিক প্রতারণা করে গেছি…।’
স্ত্রীর বিরুদ্ধে ক্রোধ আর ঘৃণার যে অগ্নি প্রথম প্রথম তার হৃদয়ে ধিকি ধিকি করে জ্বলেছিল তার কিছুটা দীর্ঘ সময় এবং কিছুটা নিজের কৃতকর্মে ঠাণ্ডা করে দিয়েছিল। এবং কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাগ যা-ও অবশিষ্ট ছিল– এখন তার এই বিপদগ্রস্ত অবস্থা দেখে তা-ও চলে গেছে। অবশ্য তার এ অবস্থা দেখে তার মনে দয়ার উদ্রেক করছে না, বরং তার কাছে বিরক্ত লাগছে।