এবং সে অস্থির হয়ে উঠল যখন ভাবল– ‘আমি মেয়েটাকে খাঁটি প্রাণেই চেয়েছি। সবদিকেই তাকে খুশি করার চেষ্টা করেছি। তার এমন কী আকাঙ্ক্ষা ছিল যা আমি পূরণ করিনি? আর এই কি তার প্রতিদান– যে কাউকে কিছু না বলে, ছোট এক টুকরো কাগজও লিখে না-রেখে চোরের মতো চুপে চুপে পালিয়ে গেল।
ভাবনাটা তাকে পাগল করে তুলল। আর সাথে সাথেই সে ভবিষ্যতের নিঃসঙ্গতার কথা চিন্তা করতে থাকল। এবং তার মন বারবার কেঁপে উঠল।
যৌবনের প্রথম থেকেই সে নিঃসঙ্গতার সাথে পরিচিত। গরিব মা-বাবার সন্তান সে। তারা নিজেদের প্রয়োজনমতো সামান্য লেখাপড়া শিখিয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিল। দারিদ্র্য, অসহায়তার দরুন কারো সাথে মেলামেশা করার সুযোগ হয়নি তার। নিঃসঙ্গই থেকেছে সে যৌবনের প্রারম্ভ থেকে, নিঃসঙ্গতাকেই সে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে মেনে নিয়েছিল। যৌবনের অনেক অংশ জীবিকার সাথে যুদ্ধ করতে করতেই শেষ হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত যখন তার অবস্থার পরিবর্তন হল এবং জনসমক্ষে তাকেও একটা মূল্যবান হিসেবে প্রতীয়মান হতে লাগল– তখন সে নিজের নিঃসঙ্গ জীবনের সাথে এমনভাবে অভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল যে, তার আর যে-কোনো বিপুল মূল্যের বিনিময়েও ছাড়ার জন্য প্রস্তুত নয় সে। তা অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে তার আত্মীয়স্বজনদের উদ্ভব হতে লাগল এবং তার নিঃসঙ্গতার মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে লাগল।
‘ভাই, তুমি কি আজীবন কুমার থেকে যাবে!’ তারা প্রায় সময় এসে তাকে বলত– ‘তুমি মানো বা না-মানো আমরা কিন্তু চাঁদের মতো বউ একটা ঘরে তুলবই।’
এক শ্রদ্ধেয়– যে আত্মীয়তার অনেক দূর দিয়ে তার মামা হয়– বলত– দূরে যাব কেন, খান্দানের মধ্যেও মাশাল্লা কত সুন্দরী মেয়ে আছে।’
প্রত্যেকবারই তার অস্বীকৃতি হালকা হতে থাকল। এবং শেষ পর্যন্ত একদিন তার আত্মীয়ের মধ্যেই সামান্য লেখাপড়া জানা একটি মেয়ের সাথে তাকে বিয়ে দেয়া হল।
পাঠ্যাবস্থায় তার ভ্রমণের শখ ছিল। প্রায়শ সঙ্গীদের সাথে তিন-চার দলে ভাগ হয়ে তারা চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ত বিভিন্ন গ্রাম-শহরের দিকে। সে কিন্তু সঙ্গীদের কাছ থেকে সবসময় দূরে দূরে থাকত এবং মনেপ্রাণে তাদের ঘৃণা করত। বন্ধু-বান্ধবীরা তার সাথে মেলামেশা করত না। কিন্তু এখন সে বিভিন্ন যুবতীর সংস্রবে এসে ভাবল– এরও একটা আনন্দ আছে এবং এই প্রথমবারের মতো সে অনুভব করল কত নিষ্ফল, কত অর্থহীন জীবনই-না যাপন করে আসছে সে এতদিন ধরে।
বিয়ের পর স্বামী হিসেবে তার করণীয় কর্তব্যের ব্যাপারে সে পূর্ণ সজাগ ছিল। স্ত্রীর ভালোবাসা তাকে এমনভাবে প্রভাবান্বিত করে ফেলেছিল যে, সে অন্যান্য ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন হয়ে গেছিল। সে স্ত্রী ছাড়া কোনো পার্টি-নিমন্ত্রণে যেত না। একাকী কারো সাথে সাক্ষাত্ত করত না। স্ত্রীসঙ্গ ছাড়া থাকা তার পক্ষে এত কঠিন ছিল যে, অফিসের সময় কাটানোও তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ত। বারবার ঘড়ির দিকে তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ত– কখন সময় শেষ হবে, কখন ঘরের দিকে পা বাড়াবে।
অফিস থেকে ফেরার পথে কখনো যদি হঠাৎ কোনো পুরনো কালের হাস্যরসিক বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ হয়ে যায় এবং সে-বন্ধু যদি ক্ষণিক আনন্দ করার জন্য কোথাও যেতে আমন্ত্রণ জানায় তাহলে সে বড় নিষ্প্রাণ কণ্ঠে জবাব দিত, ‘না সাহেব, আমাকে ক্ষমা করতে হয়। এ সময়টার মালিক আমার স্ত্রী– যে সারাদিন আমার আশায় একাকী ঘরে বসে আছে।’
আবার কখনো বলত– ‘আমি এরকম কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারি না, যেখানে আমার স্ত্রী যেতে অসমর্থ।’
‘এবং এসব সেই অকৃতজ্ঞ মেয়েটার জন্য’ সে উভয় হাতের মধ্যখানে মাথা রাখতে রাখতে বিড়বিড় করে বলল– ‘যার প্রেম নিছক একটা ধোঁকা।’
হঠাৎ তার স্ত্রীর ওপর রাগে, ঘৃণায় মন ভরে উঠল। তার নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত বইতে শুরু করল। সে কল্পনায় দেখল, নিজের শক্ত হাত দিয়ে স্ত্রীর গলা টিপে ধরেছে, তার ভীতিগ্রস্ত চক্ষুযুগল করুণা আর ক্ষমা প্রত্যাশী। কিন্তু এ অকৃতজ্ঞ মেয়েটার জন্য তার প্রাণে কোনো দয়ামায়া নেই, কোনো ক্ষমা নেই, সে তার গলা টিপেই ধরে আছে। জোরে, আরো জোরে– এমনকি তার গৌরবর্ণের চেহারা কালচে হয়ে গেছে এবং তার বড় বড় সুন্দর চক্ষুযুগল দুটি রক্তের মাংসপিণ্ড হয়ে বেরিয়ে এসেছে… আর সে তার মৃতদেহকে মাটিতে ফেলে দিল।
কিন্তু যতই দিন অতিবাহিত হতে লাগল– প্রতিশোধের দৃঢ় সংকল্প, উন্মাদের প্রলাপ ধিমা হয়ে যেতে যেতে একটা উপহাসে পরিণত হয়ে যেতে থাকল। এমনকি তার কাছে নিজের প্রেম, তার চেয়ে উত্তম স্ত্রীর অকৃতজ্ঞতা এবং তার ওপর নিজের রাগ-ক্রোধকেও কেমন যেন হাস্যাস্পদ মনে হতে লাগল এবং একদিন তার কাছে নিজের এ অবস্থার জন্য হাসি পেল।
সে মনে মনে বলল– ‘আমি কী ধরনের বোকা যে, একটা মেয়েকে এরকম গুরুত্ব দিচ্ছি। মেয়েদের ব্যাপারে গুরুত্বসহকারে চিন্তা করাটাই বোকামি। তাদের দৃষ্টান্ত অনেকটা ছোট ছেলেদের মতো। খেলনা দিয়ে যতক্ষণ ভুলানো যায় ভোলাও! কিন্তু যখন আর খেলনায় কাজ দেবে না– কান্না জুড়ে দেবে, দুষ্টুমি শুরু করে দেবে– তখন সব চাইতে উত্তম পন্থা হবে কারো হাতে সোপর্দ করে দেয়া। প্রেম আর-কৃতজ্ঞতা, এসব ব্যাপার তো এদের জন্যে প্রতারণা মাত্র।’