মজিদ খান বলল– আমি মিথ্যা বলি না– আমি মুসলমান।
একথাটা যেন স্ত্রীলোকটির সমগ্র সত্তায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সে তড়াক করে উঠে পড়ে আর বলে– আমি মুসলমানকে ঘৃণা করি। তুমি এখনি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যাও। আহত নাগিনীর ন্যায় একটি অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে ওঠে সে।
মজিদ খান প্রত্যুত্তরে শান্ত স্বরে বলল– তুমি বললে অবশ্যই চলে যাব। তুমি জান আমি মিথ্যা কথা বলি না। অতএব তুমি আমার ওপর আস্থা রাখতে পার যে, আমি তোমার ‘দেহের’ জন্য এখানে আসিনি, শুধু বিছানার জন্য এসেছি। আচ্ছা তাহলে উঠি 1
মজিদ খান সোফা ছেড়ে উঠে পড়ে। স্ত্রীলোকটি মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে– দেহের জন্য নয়, বিছানার জন্য এসেছি!
মজিদ খান তার পাশে গিয়ে বলে– তোমার কাছে হয়তো-বা একথা নতুন ঠেকতে পারে কিন্তু পুরুষ আর নারীর মাঝখানে যদি গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি থাকতে পারে তো বিছানা আর দেহের মধ্যে কিছু ফারাক থাকে বইকি!
মেয়েটি একথা বুঝতে পারে না। মজিদ খান দরজার দিকে পা বাড়ায়। মেয়েটি বিস্মিত দৃষ্টিতে দরজার দিকে চেয়ে থাকে। কে জানে কেন! হয়তো-বা আজ সে প্রথমবারের মতোই বুঝতে পারছে তার দেহ আর যাই হোক-না কেন কোনো বিছানা নয়। তার মন ভেতরে ভেতরে একটা অব্যক্ত বেদনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতে চাইছে। তার চক্ষু দুটি হঠাৎ কেন জানি সজল হয়ে ওঠে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে মজিদ খানের অপসৃয়মাণ মূর্তির দিকে চেয়ে থাকে।
মজিদ খান প্রায় দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ রমণীটি করুণ স্বরে ডাকল– শোন।
মজিদ খান থমকে দাঁড়ায়। শুধু মুখ ফিরিয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে, কিছু বলে না।
মেয়েলোকটি ধীরে ধীরে তার কাছে এসে দাঁড়ায়। ছলছল নেত্রে তার দিকে চেয়ে আর্দ্রকণ্ঠে বললে– এখন তুমি কোথায় যাবে?
মজিদ খান বলল– জানি না কোথায় যাব। সম্পূর্ণ অপরিচিত বিদেশি আমি। তিন-চার দিন হংকংয়ে থেকে করাচি চলে যাব ভেবেছি।
মেয়েলোকটি হঠাৎ চিৎকার করে বলল– কী বললে! করাচি? সে নিজের অজ্ঞাতে শক্ত করে মজিদ খানের কাঁধে হাত রেখে একটা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে খুশিতে চিৎকার দিয়ে ওঠে– করাচি, করাচি– করাচি।
সে অত্যন্ত জোরে শব্দ করে বলে ওঠে– তুমি করাচি থেকে এসেছ একথা প্রথমে বললে না কেন? আমি সত্যি লজ্জিত, তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। এস ভেতরে এস, এস এস। স্ত্রীলোকটি আনন্দে আত্মহারা হয়ে তাকে হাত ধরে টেনে-হিঁচড়ে ভেতরে এনে সোফার গায়ে নিক্ষেপ করে। এবার সে একেবারে শান্ত দুটি চোখ জানালার বাইরে দূর নীলিমায় তুলে ধরে। তার দৃষ্টি দূরে বহুদূরে হয়তো-বা করাচি পর্যন্ত অবলোকন করছে। সে নিজ মনে বলে চলে– গঙ্গারাম বিল্ডিং– বন্দর রোড– স্বামী নারায়ণের মন্দির– ডেঙ্গু হল– লক্ষ্মী বিল্ডিং– গোবর্ধন দাস মার্কেট।
মজিদ খান মুখে দুষ্টুমিভরা হাসি টেনে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে বলল– লক্ষ্মী বিল্ডিং আর গোবর্ধন মার্কেটের মধ্যবর্তী নিউ মেমন মসজিদের কথা বাদ দিলে কেন?
মজিদ খানের একথায় রমণীটি চমকে ওঠে। সে করাচি থেকে আবার হংকং ফিরে আসে। ফিক্ করে হেসে বলে সে– আচ্ছা ওখানে আসানমল ওঝা রোড, গঙ্গারাম বিল্ডিং আজো আছে?
মজিদ খান বলল– সব আজো আছে, শুধু তুমি নেই।
এবার স্ত্রীলোকটি একটু লজ্জিত হয়। হঠাৎ তড়াক করে উঠে সে তীব্রবেগে কক্ষান্তরে প্রবেশ করে। খানিক পরে সে ফিরে আসে। তার মাথায় তখন একখণ্ড উত্তরীয় শোভা পাচ্ছে আর হাতে একমুঠো চামেলি ফুল।
মজিদ খানের সামনে এসে তার পায়ের কাছে বসে পড়ে সে, আর সবকয়টি ফুল তার পায়ে ছড়িয়ে দেয়।
মজিদ খান তাড়াতাড়ি নিজের পা গুটিয়ে নিতে নিতে বলে– তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি মুসলমান।
কিন্তু রমণীটি শক্ত করে মজিদ খানের পা জড়িয়ে ধরে বলে– তুমি মুসলমান নও, তুমি করাচি। করাচি– যেখানে গঙ্গারাম বিল্ডিং অবস্থিত; গঙ্গারাম বিল্ডিং যেখানে ত্রিশ বছর আগে কমলাজ্ঞান চন্দনি জন্মগ্রহণ করেছিল, যে কমলাজ্ঞান চন্দনি হংকং এসে আত্মহত্যা করেছে। একথা বলে সে তার মাথা মজিদ খানের হাঁটুর উপরে ঝুলিয়ে রাখে।
মজিদ খান অত্যন্ত আদরের সাথে দু’হাত দিয়ে কমলাজ্ঞান চন্দনির মুখ উপরের দিকে তুলে ধরে। তার দু’চোখ বন্ধ। কিন্তু মজিদ খানের মনে হয়– করাচির বিস্তৃত বক্ষে এসে কমলাজ্ঞান চন্দনি পুনর্জন্ম লাভ করেছে।
অনুবাদ : আখতার-উন-নবী
পলাতকা – গোলাম আব্বাস
প্রথম প্রথম তার বিশ্বাসই হল না, সে অনুভবই করতে পারল না যে তার স্ত্রী পালিয়ে গেছে। কিন্তু যখনি সে অনুভব করল তার স্ত্রী সত্যি পালিয়ে গেছে, তখন সে একরাশ চিন্তার সাগরে ডুবে গেল। তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। কী আশ্চর্য, বিয়ের প্রথম বছরেই এ ব্যাপার! মন যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। কিন্তু বারবার যখন দেখল স্ত্রীর সব জিনিসপত্র উধাও, এমনকি তার ছোটকালের ছবিটা যেটায় একটা সাদা কবুতরকে নিজের ছোট ছোট হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাসছিল। সে ছবিটাও নেই। নিয়ে গেছে, অতএব তার আর সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকল না। সত্যি তার স্ত্রী পালিয়ে গেছে।
কয়েকদিন নীরব নিস্তব্ধতার মাঝে কাটিয়ে দিল সে। না কোথাও গেল, না চাকরটাকেও জানার সুযোগ দিল। পরে আস্তে আস্তে যখন সব বদনামির ভয় তার মন থেকে মুছে যেতে লাগল এবং তার ফিরে আসার ক্ষীণতম আশাও মন থেকে উঠে গেল, তখন সে স্থির মস্তিষ্কে ব্যাপারটা পর্যবেক্ষণ করার দিকে মনোনিবেশ করল। একটা ভাবনা বারবার তার মনে এসে তাকে বড় বিব্রত করে তুলল।