কিন্তু মজিদ খানকে একটা তীব্র হতাশা ঘিরে ফেলে। সে কিছু বলে না, শুধু গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করে– আর কদ্দুর নিয়ে যাবে আমায়?
ট্যাক্সি ড্রাইভার অত্যন্ত অভিজ্ঞ দোকানির মতো বলে– তুমি বোধহয় খুব অস্বস্তি বোধ করছ। যাও, সে জায়গাটাও এসে পড়েছে। তোমায় এমন জায়গায় নিয়ে এসেছি যে, বুঝে উঠতে পারবে না তুমি ভারতে না আর কোথাও আছ। হি হি হি। আমি প্রথমেই বুঝেছিলাম তুমি ভারতে যেতে চাও– হি হি হি।
সে মজিদ খানকে ভারতীয় মনে করেছে। মজিদ খানও তাকে বোঝাতে চায় না যে, সে ভারতীয় নয়। একটা ছোট্ট গলির ভেতরে গিয়ে ট্যাক্সি থেমে যায়। সম্মুখে সমুদ্রের জলকল্লোল স্থানটিতে মুখরিত করে তুলেছে।
একখানা তিনতলা দালান। দালানের দ্বিতলের একখানা ফ্ল্যাট হতে উজ্জ্বল আলো জানালা দিয়ে ঠিকরে বাইরের দিকে বেরিয়ে আসছে। বাকি অট্টালিকা গভীর রাতের অন্ধকারে প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে আছে।
ট্যাক্সি ড্রাইভার উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল– আমার পিছু পিছু এস।
মজিদ খান তার পিছু পিছু সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উজ্জ্বল ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছয়। উজ্জ্বল আলোতে মনে হয় ভেতরে হয়তো-বা কোনো নারী জেগে আছে।
ড্রাইভার দরজায় মৃদু করাঘাত করে। অল্পক্ষণ পর দরজা খুলে যায়। একটি বর্মি বা মালয়ি বৃদ্ধা দরজা থেকে তাদের অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে যায়।
ছোট্ট একখানা কক্ষ। এটাকে বরং ড্রয়িংরুমই বলা সমীচীন! ভেতরে ছোট এক সেট সোফা। কোণের দিকে একটা রেডিও সেটের উপর মহাত্মা গৌতম বুদ্ধের কালো কাষ্ঠনির্মিত প্রতিমূর্তি। দেওয়ালে খান কতেক অর্ধ-উলঙ্গ ছবি ছাড়াও গান্ধীজির একখানা বড় ছবি টাঙানো। ড্রাইভার মজিদ খানকে সোফার উপর বসিয়ে পাশের কক্ষে ঢোকে। খানিক পর মুখ টিপে হেসে বেরিয়ে আসতে আসতে বলে– অলরাইট, আমি এবার আসি। মজিদ খান পকেট থেকে বিশ ডলার বের করে তার হাতে দিয়ে জিগ্যেস করে– এনাফ?
ড্রাইভার দাঁত বের করে হেসে ওঠে আর বলে– ওহ্ টুমাচ, টুমাচ, থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ অ্যান্ড গুডনাইট। সে তিন বার মস্তকভঙ্গি করে বেরিয়ে যায়।
বৃদ্ধাটিও ভেতর চলে যায়। মজিদ খান গভীর মনোনিবেশ সহকারে গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি দেখে। কপিলাবস্তু থেকে কলম্বো, রেঙ্গুন, ব্যাঙ্কক আর হংকং পর্যন্ত প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে প্রতিটি স্থানে গৌতম বুদ্ধের প্রতিকৃতি দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু বুদ্ধের জীবন-দর্শন আজ কোথাও নেই। শুধু পাথরের বা কাঠের মূর্তি।
খানিক পরে তার মনে হয় যেন কক্ষে প্যারিসের সন্ধ্যা ভেসে বেড়াচ্ছে হালকা বাতাসে ভর দিয়ে। সে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে। সোফার পাশে একটি যুবতী রমণী দাঁড়িয়ে। তার নিটোল, সুশ্রী আর সুঠাম দেহে যেন যৌবনের হিল্লোল প্রবাহিত হচ্ছে। পরনে সেলোয়ার আর কামিজ। কিন্তু তার গলায় বা মাথায় কোনো কাপড় নেই। অবশ্য ওটার তার দরকারই-বা কী! মেয়েদের মাথায় উত্তরীয় তখনি দরকার হয় যখন তার জীবনে একটিমাত্র পুরুষের আবির্ভাব ঘটে।
যুবতীটি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। মনে হয় যেন সে এই প্রথম কোনো ভারতীয়কে দেখল বা অনেকদিন পর নিজের রঙের সাথে সুসামঞ্জস্য নিজের মাটির মানুষ দেখল। একটা তীব্র উত্তেজনার ছাপ তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে। কিন্তু সে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে রীতিমতো ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে বলল– ড্রাইভারকে আমি ত্রিশ ডলারের কথা বলেছি।
মজিদ খান একথার কোনো জবাব দেয় না। পকেট থেকে ত্রিশ ডলার বের করে তার দিকে এগিয়ে দেয়। স্ত্রীলোকটি মুচকি হেসে ত্রিশ ডলারের নোট তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গ্রহণ করে বলে– কিছু পান করবে?
মজিদ খান উত্তর দিল– না, পানের অভ্যেস নেই।
মেয়েলোকটি প্রশ্ন করে– হিন্দু না মুসলমান?
একথা মজিদ খানের অন্তরে তীব্র এক ধাক্কা মারে– গণিকালয়েও সাম্প্রদায়িক বিষ ঢুকে গেছে! সে বলল– হিন্দুও না মুসলমানও না। মানুষ যখন পাপের পথে পা বাড়ায় তখন ধর্ম তাকে চরম ঘৃণাভরে পদদলিত করে পালিয়ে যায়।
একথায় রমণীটির মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সে লজ্জিত হয়ে পড়ে আর বিস্মিতভাবে মজিদ খানকে নিরিখ করতে থাকে। মেয়েলোকটি সম্পর্কে একটু বিভ্রান্তি বোধ করে মজিদ খান। সে জিজ্ঞেস করে– তুমি কে?
মজিদ খানের অনুমানই সত্য। রমণীটি তাকে ভারতীয় হিন্দু মনে করছে। সে বলল– মুসলমান, আমার নাম কুলসুম।
কুলসুমের নাম শুনে মজিদ খানের চমকে ওঠার কথা কিন্তু সে অত্যন্ত অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বুদ্ধের প্রতিকৃতি আর গান্ধীর ছবির দিকে চেয়ে বলল– খুব দূরদর্শী দোকানি তো তুমি। তুমি এটাও জান যে, শত্রুর মেয়ে দেখলে পাপীর রসনা ক্ষুধার্ত শকুনির মতো লক্ লক্ করে ওঠে। কিন্তু আমিও যাগু গ্রাহক। কোনো দোকানদার আজো আমায় ঠকাতে পারেনি, অতএব তুমিও নিজেকে মুসলমান-কুলসুম যাই বল-না কেন আমায় ধোঁকা দিতে পারবে না।
মেয়েলোকটি একথায় থতমত খেয়ে যায়। মিথ্যাবাদীর মিথ্যা কথা ধরে ফেলার ফলে মানুষের যে-করুণ অবস্থা দাঁড়ায় তারও তাই হয়। সে অত্যন্ত অপ্রসন্ন স্বরে অস্ফুটে উচ্চারণ করল– ভারি অদ্ভুত মানুষ তো! পরিশেষে নিজের অবগতির জন্য সে মজিদ খানের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে– তুমি কে?