সূর্যাস্তের পর বিদেশি পুরুষ অ্যামেরিকান, ইংরেজ বা জার্মান-পাকিস্তানি কিছুই থাকে না। সবাই শুধুই পুরুষ। নেহায়েতই দেহলিপ্সু দানব। কিন্তু এটা কেমনতরো কথা যে, বৃহৎ জাতি আর ক্ষুদ্র জাতির প্রশ্ন শুধু ইউনাইটেড নেশন্সেই নয়, বেশ্যালয়েও এসে পড়বে? মজিদ খান হতাশাভারাক্রান্ত মন নিয়ে ধীরে ধীরে সামনের দিকে পা বাড়ায়। একখানা উড়োজাহাজ কোম্পানির বড় বোর্ডের বিজ্ঞাপনের নিচে একটি ধবধবে সাদা রঙের মেয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। মজিদ খান তার পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু মেয়েটি অন্যদিকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। মজিদ খান অত্যন্ত সাহস ভরে তার পাশে এসে দাঁড়ায় আর ইংরেজিতে বলে– রাত ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তৈরি হয়নি।
মেয়েটি ভ্রুকুঞ্চিত করে জবাব দেয়– ইউ আর ব্ল্যাক, অ্যান্ড আই ডোন্ট লাইক ব্ল্যাক পিপল। একথা বলেই মেয়েটি হন হন করে প্রস্থান করে।
মজিদ খান বড় দুঃখের সাথে ভাবে পাপের ভেতরও রাজনীতি ঢুকছে। ভারি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা জীবনের!
রাত প্রায় অর্ধেক হয়ে এল। মজিদ খানের মনে হয় হোটেলে গিয়ে গভীর অন্ধকারকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়াই বরং আফজল হবে।
কিন্তু হংকং হোটেলের নিকট অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ ভেসে আসে। মনে হয় যেন কেউ নিঃশব্দে শিস দিচ্ছে। মজিদ খান ঘাড় ফিরিয়ে দেখে। একখানা বদ্ধ দোকানের শোকেসের আড়ালে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। চেহারা-সুরতে চীনা বলেই মনে হয়। মজিদ খান তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তার আর রাতের প্রয়োজন নেই, সে শুধু অন্ধকারই এখন চায়। তাই মজিদ ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তার সামনে দাঁড়ায় আর নিষ্কৃতি পাওয়ার উদ্দেশ্যেই বলে– আই ডোন্ট ওয়ান্ট ইউ।
মেয়েটি বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করে– হোয়াই? মজিদ খান বলল– কারণ আমি যা বলতে চাইব তা তুমি বুঝবে না।
মেয়েটি অত্যন্ত দ্রুত ইংরেজিতে বলে– আমি ইংরেজি খুব ভালো জানি। গত যুদ্ধের আগে আমার প্রেমিক ছিল একজন ইংরেজ। সে আমায় লন্ডন নিয়ে গেছিল। আমি তো সেক্সপিয়রের নাটকও পড়তে পারি।
সেক্সপিয়রের ইংরেজি! হায়রে! ইংরেজি কোথা হতে কোথা গিয়ে পৌঁছেছে। বাকিংহাম প্যালেস আর হোয়াইট হাউস হতে শুরু করে পৃথিবীর প্রত্যেকটি গণিকালয় পর্যন্ত শুধু ইংরেজি ভাষাই লেনদেনের একমাত্র মাধ্যম। ইংরেজি ভাষা প্রতিটি মুহূর্তেই আশীর্বাদস্বরূপ। যদিও ইংরাজ-সূর্য শুধুমাত্র টেস্ নদীতে অস্ত যায় তথাপিও ইংরেজি ভাষা পৃথিবীর সর্বত্রই সচল। ইংরাজি না-হলে বিদেশে মানুষ বোবার শামিল।
চীনা মেয়েটি সত্যি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ইংরেজি বলতে পারে। সে একজন ইংরেজের হাতে বিধ্বস্ত, অথচ আজ ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে সে প্রতিরাতে অসংখ্য প্রেমিক খুঁজে বার করছে। মেয়েটি শুধু দশ ডলার দাবি করল। মজিদ খান তার দিকে বিশ ডলার বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু মেয়েটিকে সে ব্যবহার করতে চায় না। বলল– আমি এশিয়াকে বেশ্যা হিসেবে দেখতে চাই না।
মেয়েটি অত্যন্ত আত্মম্ভরিতার সাথে জবাব দেয়– কিন্তু আমি এশিয়াকে ভিখিরি হিসেবে দেখতে চাই না।
মজিদ খান সামনের দিকে পা বাড়ায়। মেয়েটি সম্ভবত ইউরোপ বা অ্যামেরিকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।
মজিদ খান কাওলন হোটেলে উঠেছে। এই হোটেল চীনের মূল ভূমিতে অবস্থিত। মূল চীন আর হংকংয়ের মাঝে প্রবাহিত নদী পার হবার শেষ লঞ্চ একটায় ছেড়ে যায়। আর তখন প্রায় দুটো বেজে যাচ্ছে।
একটা তীব্র হতাশা মজিদ খানকে ঘিরে বসে। এবার কী হবে? এত রাত, বিদেশ-বিভুঁই, যাবে কোনদিকে, থাকবেই-বা কোথায়?
একটা ট্যাক্সি ড্রাইভার তার সামনে এসে দাঁড়ায়। ড্রাইভার চীনা কি জাপানি ঠিক বুঝতে পারে না মজিদ খান। তবে তাদেরই মতো ক্ষুদ্রাকৃতি, চক্ষু দুটি কটা, এবড়ো-থেবড়ো চেহারা, সে-ও চমৎকার ইংরেজি বলতে পারে।
ইংরেজি শিখবার এবং জানবার জন্য যেমন উপাদেয় তেমনি বিভিন্ন কাজের ধান্দার জন্যও মূল্যবান।
মজিদ খান কোনো কথা বলার আগেই ড্রাইভারটি বলে ওঠে– বাকি রাত শেষ করতে চাও, এই তো?
মজিদ খান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। ড্রাইভার ট্যাক্সির দরজা খুলে দেয়।
ট্যাক্সি উল্কার মতো ছুটে চলে। ট্যাক্সির গতির সাথে ড্রাইভারের মুখেও খই ফুটতে থাকে। সে অত্যন্ত উৎসাহের সাথে হংকংয়ের নারীদের সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে থাকে। পরিশেষে তাকে প্রশ্ন করে বসে, কোন দেশীয় নারী তার পছন্দসই?
মজিদ খান অত্যন্ত সংক্ষেপে তার মনোভাব ব্যক্ত করে। ট্যাক্সি ড্রাইভার পাকা সমঝদারের মতো আধুনিক যুগের এইসব কাণ্ডকীর্তনে আক্ষেপ করতে থাকে আর নিজ মনে বিড়বিড় করে বলে– ফ্রি ওয়ার্লড, ফ্রি ওয়ার্লড– ডেমোক্র্যাসি– ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট– বিগ ফোর– ইউ এন ও– স্মল নেশন্স্– মেগাটন বম!
কীসব যে বকে যাচ্ছে হয়তো-বা তা সে নিজেও জানে না। মজিদ খানের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় চিৎকার দিয়ে তাকে এসব বকাঝকা বন্ধ করতে বলে। কোথায় ‘ফ্রি ওয়ার্লড’! পাপের সমুদ্রে ডুবতে ডুবতেও মানুষ ভুলতে পারেনি রঙ, আভিজাত্য, জাতীয়তাবোধ আর বড়-ছোট’র মধ্যে পার্থক্য। পাপের বন্ধনের সাথে এসব চিন্তাধারাও মানুষকে দিন দিন বিচ্ছিন্ন আর বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে। এসময় তুমি কি ‘ফ্রি ওয়ার্লড’ ‘ফ্রি ওয়ার্লড’ বলে চিৎকার দিচ্ছ?