লাখ লাখ, কোটি কোটি সৈন্য নিজ নিজ স্ত্রী, বাগদত্তা বা প্রেয়সীর কাছ থেকে বহুদূরে অথচ মৃত্যুর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, এরই মাঝখানে পরম কমনীয় নারী।
নারী! পৃথিবীর সবচাইতে বড় লালসা। এই লালসার জালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সৈন্য আর বিভিন্ন দেশের নারী পরস্পরের সাথে একাত্ম হয়ে গেঁথে রয়েছে যেন।
বক্ষে নারী থাকলে পুরুষ মৃত্যুকেও ভয় করে না, তাই তো হংকংয়ে হাজার হাজার সৈন্যের বুকে বসে হাজার হাজার নারী তাদের সাহস আর শক্তি দিচ্ছে। সৈন্য দ্বারা যুদ্ধ জয় করা যায়, আর যুদ্ধ দ্বারা পৃথিবীতে বিচ্ছেদ ছড়িয়ে পড়ে। তবুও সূর্যাস্তের সাথে সাথেই নারী উদিত হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধই হংকংকে রাত্রির শহরে রূপান্তরিত করেছে।
কুইন্স রোডের উপর দিয়ে বিভিন্ন দেশীয় রাত চলাফেরা করে। কিন্তু মজিদ খান ঠাহর করতে পারে না কোন রাত সুন্দরী। চীনা রাত, জাপানি রাত, মালয়ী রাত, ফিলিপাইনি রাত, শ্যামি রাত, বার্মি রাত, ইংরেজ রাত, অ্যামেরিকান রাত!
কুইন্স রোডের উপর যেসব পুরুষ ঘোরাফেরা করছে মজিদ খানের কাছে সবাইকে অচেনা বলে মনে হয়; কিন্তু কোনো নারীই অচেনা নয়। সে কোনো নারীকেই জানে না, তথাপি ওরা যেন কেউ অচেনা নয়। বিদেশে যত দূরেরই হোক-না কেন পুরুষ প্রথমে নারীকেই চিনে ফেলে। আদম থেকে শুরু করে এই মজিদ খান পর্যন্ত সবারই এক অবস্থা। পৃথিবীতে কোনো পুরুষ কোনো নারীর অচেনা নয়। শুধু তার নাম, জাতিত্ব আর সম্প্রদায় অচেনা হতে পারে।
অতএব ল্যাম্পপোস্টের সাথে মূর্তির মতো দণ্ডায়মান ক্ষীণদেহী একটি নারীও তাকে দেখে চিনে ফেলল, আর মুখ টিপে হেসে কাছে ডাকল। মেয়েটির চেহারা ছোট্ট আর গোলগাল। মজিদ খান নিজের অজ্ঞাতেই যেন অনেকটা মেয়েটির ডাকে আকৃষ্ট হয়ে যন্ত্রচালিতের মতো তার দিকে পা বাড়ায়। কাছে গিয়ে পৌঁছুলে মেয়েটি অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে বলে– টুয়েনটি ডলার্স।
মজিদ খান ইংরেজিতে জবাব দিল– ডলার যা চাও পাবে সে চিন্তা করো না,– কিন্তু—-।
মেয়েটি তাকে মাঝপথে থামিয়ে বলল– নো ইংলিশ, জাপানিজ।
মজিদ খান জাপানি ভাষা জানে না। আর মেয়েটি ইংরেজি ভাষা জানে না। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই আছে, কিন্তু দোকানের ঠিকানা নেই।
সম্ভবত মেয়েটি জাপানি ভাষায় বোঝাতে চাইছে আমি তোমার হোটেলে যাব না। আর মজিদ খান চাইছে তার সাথে মেয়েটিকে হোটেলে যেতে হবে– অথবা সে হোটেলে যেতেই রাজি আছে; মজিদ খান ঠিক বুঝে উঠতে পারে না কী মেয়েটি বলতে চায়। মজিদ খান আক্ষেপ করে– মানুষ পরস্পরের নিকটে থাকলেও নিষ্ঠুর ভাষা তাদের কত দূরে সরিয়ে রাখে।
মেয়েটি বলল– নো টক– টুয়েন্টি ডলার্স– টু আওয়ারস।
মজিদ খান বলল— এগ্রিড।
ঠিক সে-সময় একখানা ট্যাক্সি এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। ড্রাইভার অদ্ভুত ভঙ্গিতে মজিদ খানের ওপর দৃষ্টি রেখে তাদের কাছে আসে আর বো করতে থাকে। মজিদ খান শুধু একটি শব্দ বুঝতে পারে- অ্যামেরিকান।
মজিদ খান ট্যাক্সির দিকে চায়। একটি অ্যামেরিকান অতিরিক্ত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পেছনের সিটে বসে আছে। মেয়েটি ট্যাক্সির দিকে চায়; আর অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে বলে- অ্যা, আমেরিকান? মেয়েটি মজিদ খানের দিকে আর ফিরেও তাকায় না। পাকাপাকি কথারও তোয়াক্কা না করে সে ট্যাক্সির দিকে ছুটে যায়। দরজা খুলে মাতাল অ্যামেরিকানটির পাশে বসে পড়েই তার মাথার চুল ধরে তাকে প্রকৃতিস্থ করতে চেষ্টা করে। মজিদ খান রেগে-মেগে ট্যাক্সির দিকে ছোটে কিন্তু ইতোমধ্যেই ট্যাক্সি একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।
মজিদ খান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে আজ প্রথমবারের মতো অনুভব করে অ্যামেরিকার তুলনায় পাকিস্তান কত দুর্বল রাষ্ট্র। তার মনের তীব্র অনুভূতি বাঙ্ময় হয়ে বারবার তার সত্তাকে ধিক্কার দেয়– যদি মেয়েটি ইংরেজি জানত তাহলে তাকে বুঝিয়ে দিতে পারত যে, সে জাপানের ইজ্জত তথা এশিয়ার ইজ্জত অ্যামেরিকার কাছে বিক্রি করছে।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর থেকে এ মনোভাবের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উত্থিত হয়। এ কেমনতরো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আসলে তো এটা ঈর্ষা! তা না-হলে সে তো ভাবতে পারত যে, অ্যামেরিকানটি তো তারই মতো বিদেশি। সে এশিয়ার অধিবাসী হয়েও এশিয়ার ইজ্জত ক্রয় করতে চাইছে না? সে নিজেও কি জাপানের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে তয়ের হয়ে যায়নি?
কিন্তু — সত্যি কি ওই মেয়েটি জাপান বা এশিয়ার ইজ্জতে সওয়াল? যে-নারী নিজের সতীত্বকে অর্থের বিনিময়ে বিলিয়ে দিতে পারে, তার আবার সম্প্রদায় আর জাতিত্ব! যে-নারী নিজের পবিত্রতা নষ্ট করতে পারে, সে তার জাতীয়তাবোধ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে। একটি শুধুমাত্র দৈহিক কারবার। আর দৈহিক ব্যাপারে পৃথিবীর সব জাতই সমান
জাপানের ইজ্জত! জাপানের ইজ্জত তো এখন টোকিও, নাগাসাকি, হিরোসিমার গৃহে গৃহে নিজ নিজ স্বামীর গভীর আলিঙ্গনে সংরক্ষিত আছে। অতএব এ কী করে এশিয়ার আব্রুর সওয়াল হতে পারে! মজিদ খান হঠাৎ অ্যামেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু অসতী নারীর যেমন কোনোপ্রকার জাতীয়তাবোধ আর সাম্প্রদায়িক চেতনা থাকে না তেমনি সূর্যাস্তের পর বিদেশে পুরুষের কোনো আতা-পাতা থাকে না।