মদন তার বাবাকে খুবই ভালোবাসত। সংসারে মায়ের মৃত্যুর পর মদনের বড় হবার পেছনে সবচেয়ে বেশি কার্যকর প্রভাব তারই ছিল। সে-কথা মদন ভালো রকমই জানে। মায়ের রোগের শুরু থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত সবকিছু যখনি মদনের মনে পড়ে যেত তখনি সে চোখ বুজে প্রার্থনা শুরু করে দিত–’ওম্ নম ভগবতে বাসুদেবায়, ওম্ নম…।’ এখন সে চাইছিল না বাপের ছত্রছায়া তার মাথার ওপর থেকে সরে যায়। বিশেষত এই কারণে যে সে এখন পর্যন্ত তার কারবার জমাতে পারেনি। সে অবিশ্বাসের কণ্ঠে ইন্দুকে কেবল এ-কথাই বলেছিল—’এখন বাবুজিকে ওখানেই থাকতে দাও। বিয়ের পর এই প্রথম আমরা দুজনে খুশিমতো এক সঙ্গে মিলতে পেরেছি।’
তৃতীয়-চতুর্থ দিনে বাবুজির অশ্রুসিক্ত চিঠি এল। আমার স্নেহের ‘মদন’ সম্বোধনে ‘আমার স্নেহের’ শব্দ চোখের জলে ধুয়ে গেছে। তিনি লিখেছেন—’বউমা এখানে থাকায় আমার পুরনো দিনগুলো ফিরে এসেছিল–তোমার মায়ের দিন, যখন আমাদের নতুন বিয়ে হয়েছিল তখন সে-ও ওই রকম বেপরোয়া ছিল। এইভাবেই ছেড়ে-ফেলা কাপড় এদিকে-ওদিকে ফেলে দিত আর আমার পিতাজি তা গুছিয়ে তুলতেন। সেই তো মদনের সিন্দুক, সেই তো হাজার শান্তি…আমি বাজারে যাই, কিছু নয় তো দইবড়া আর রাবড়ি কিনে নিয়ে আসি। এখন ঘরে কেউ নেই। যেখানে চন্দনকাঠের সিন্দুক ছিল সে জায়গা খালি পড়ে আছে…।’ তারপর এক-আধ ছত্র ফের ধুয়ে গেছে। শেষে লিখেছেন–’দফতর থেকে এখানকার বড়-বড় আঁধার কামরায় ফিরে এলে আমার মনের মধ্যে বমির মতো ভাব ওঠে…আর–বৌমার যত্ন কর। তাকে কোনো যে-সে দাইয়ের হাতে সঁপে দিও না।‘
ইন্দু দুই হাতে চিঠি টেনে নিল। দম নিয়ে চোখ টান করে, লজ্জায় গলে যেতে-যেতে বলল–’আমি মরে গেলাম। বাবুজি কী করে বুঝতে পারলেন?’
মদন চিঠিটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল—’বাবুজি কি বাচ্চা ছেলে? দুনিয়া দেখেছেন, আমাদের জন্ম দিয়েছেন…’
‘হ্যাঁ।’ ইন্দু বলল—’এখন কত দিনই-বা হল?’
তারপর সে পেটের ওপর তীক্ষ্ণভাবে নজর দেয়। এখনো বাড়তে শুরুই করেনি, কিন্তু এর মধ্যেই বাবুজি আর কোনো-কোনো মানুষ তা দেখতে পেয়েছে। সে তার শাড়ির আঁচল পেটের ওপর টেনে নিয়ে কিছু ভাবতে থাকে। তার দেহে এক চমক, সে বলে– ‘তোমার শ্বশুরবাড়ি থেকে রনি আসবে।’
‘আমার শ্বশুরবাড়ি?…ও হ্যাঁ।’ মদন পথ খুঁজে পেয়ে বলল–কী লজ্জার কথা! এই ছ-আট মাস মাত্র বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যেই চলে এল’–আর হেসে ইন্দুর পেটের দিকে ইশারা করল।
চলে এসেছে, না তুমি নিয়ে এসেছ?
‘তুমি…সব অপরাধ তোমার। কিছু কিছু মেয়েছেলে এরকমই হয়ে থাকে…।’
‘তোমার পছন্দ নয়? ‘একেবারে নয়। ‘কেন?’
‘জীবনের কয়েক দিন তো মজা করে নেয়া যাক।
‘কেন এ বুঝি জীবনের মজা নয়। ইন্দু দুঃখভরা কণ্ঠে বলল–’পুরুষমানুষ বিয়ে করে কিসের জন্যে? ভগবানের কাছে বিনা প্রার্থনায় তিনি দিয়েছেন বলেই তোমার বুঝি পছন্দ হচ্ছে না? যার ছেলেপুলে হয় না তাকে শুধাও। সে কী না করে? পীর-ফকিরের কাছে যায়। সমাধি, মাজারের ওপর পিপড়া খাওয়ায়, লজ্জা-হায়া ছেড়ে, নদীর তীরে উলঙ্গ হয়ে শরভঁটা কাটে, শ্মশানে মশান জাগায়…’
‘আচ্ছা, আচ্ছা।’ মদন বলল–’তুমি তো ব্যাখ্যা শুরু করে দিলে…জীবন কি কেবল বাচ্চার জন্যই?
‘ও যখন আসবে,’ ইন্দু বিষণ্ণভাবে আঙুল তুলে বলল–তখন তুমি তাকে ঘেঁবে না। সে তোমার নয়, আমার হবে। তোমার তাকে দরকার নেই, কিন্তু তার ঠাকুরদাদার খুব দরকার আছে। এ-কথা আমি জানি…।’
আবার কিছুটা শান্ত, কিছুটা দুঃখিত হয়ে ইন্দু দুই হাতে তার মুখ ঢাকল। সে ভাবছিল। যে, তার পেটের মধ্যে এই ছোট্ট প্রাণটিকে পালনের ব্যাপারে তার আপন লোক কেউ থাকলে কিছুটা দরদের সঙ্গে তাকে দেখবে। কিন্তু মদন বসেছিল চুপচাপ। তার মুখ থেকে একটি শব্দও বেরল না। ইন্দু মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মদনের দিকে তাকিয়ে দেখল আর ভাবী প্রথম সন্তানবতীর ঢঙে বলল–’যা-কিছু বলেছি তা তো পরে হবে, তার আগে দেখ, আমি তো আর বাঁচব না…ছোটবেলা থেকেই এ-কথা আমার মনে হয়…’
মদন ভয় পেয়ে গেল। এই সুন্দর চিজ’ গর্ভবতী হবার পর আরো সুন্দর হয়েছে–এ মরে যাবে? সে পিছন দিক থেকে ইন্দুকে ধরে নিজের দু হাতের মধ্যে নিয়ে এসে বলল– ‘তোমার কিছু হবে না ইন্দু…তোমাকে আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আসব…এখন সাবিত্রী নয়…সত্যবানেরই সাধনা’
মদনের সঙ্গে মিশে গিয়ে ইন্দু ভুলে গেল তার নিজের কোনো দুঃখ আছে…
তারপরে বাবুজি আর কোনো চিঠি লেখেননি। হঠাৎ সাহারানপুর থেকে এক সর্টার এল। সে কেবল এ কথাই জানাল যে, বাবুজির ফের হার্ট-অ্যাটাক হয়েছে। এক আক্রমণে তিনি প্রায় মরেই যাচ্ছিলেন। মদন ভয় পেয়ে গেল। কাঁদতে লাগল ইন্দু। সর্টার চলে যাবার পরে কিছুক্ষণ পরপরই মদন চোখ বুজে মনে-মনে পড়তে থাকে–’ওম নম ভগবতে…’ পরের দিন মদন বাপকে চিঠি লিখল–বাবুজি চলে আসুন। বাচ্চারা আপনার কথা খুব মনে করে, আপনার বৌমাও–’, কিন্তু চাকরি তো আছে। আসাটা কি নিজের আয়ত্তে ছিল তার? ধনীরামের পত্র অনুসারে সে ছুটির বন্দোবস্ত করছিল। তার ব্যাপারে মদনের অপরাধবোধ বাড়তে শুরু করল। আমি যদি ইন্দুকে থাকতে দিতাম তা হলে আমার কী ক্ষতি হত?
বিজয়া দশমীর আগের রাতে মদন ছটফট করতে-করতে মাঝের কামরার বাইরে বারান্দায় টহল দিচ্ছিল। তখনি ভিতর থেকে কান্নার আওয়াজ এল আর সে চমকে উঠে দরজার দিকে দৌড়াল। বেগম দাই বাইরে এসে বলল–