এভাবেই তিনি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে যে বলিষ্ঠ হাল তুলে দিয়ে গেলেন, সেই হাল ধরেই পালে বাতাস লাগিয়ে নবীন লেখকদের এগিয়ে যেতে আর বাধা রইল না।
প্রগতিশীল আন্দোলন উর্দু সাহিত্যে একঝাক মেধাবী লেখকের জন্ম দিয়েছিল। বয়সের দিক থেকে দু-এক বছর ছোট-বড় হলেও এরা সবাই মোটামুটি সমসাময়িক ছিলেন : কৃষণ চন্দর, রাজেন্দ্র সিংহ বেদী, ইসমত চুগতাই, সাদত হাসান মান্টো, খাজা আহমদ আব্বাস, কুররাতুল আইন হায়দার, কুদরতুল্লা শাহাব, গোলাম আব্বাস প্রমুখ। এদের অন্যতম। আজকের উর্দু কথাসাহিত্যের ভেতরে যে বৈচিত্র্যের বিবিধ আস্বাদ আমরা সাগ্রহে গ্রহণ করি তা এদেরই দান।
এই নবীন গোষ্ঠীর মধ্যে আবার কৃষণ চন্দর-এর নামটি নানা কারণে অধিক উচ্চারিত। তাঁর রচনার নৈপুণ্য, সহজ স্বচ্ছন্দ গতি, চিন্তার স্বচ্ছতা ও ক্ষিপ্রতা, বিষয়মাহাত্ম্য ও বাস্তবতা সহজেই সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ৪৭-এর দেশভাগ, দাঙ্গা, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে লাঞ্ছিত-বঞ্চিতরাই তার লেখার একটি অতি প্রিয় বিষয়। পেশাদার লেখক ছিলেন বলেই যদিও বিস্তর লিখতে হয়েছে তাঁকে, তবু তেলেঙ্গানার পটভূমিতে লেখা কৃষক আন্দোলনের কাহিনী যব ক্ষেত জাগে দেশভাগের পটভূমিকার ‘গাদ্দার’ উপন্যাস, একই বিষয়ে লেখা ছোটগল্প ‘পেশোয়ার এক্সপ্রেস’ পাঠকের মনে স্থায়ী দাগ। কেটে যায়। কৃষণ চন্দরের রাজনৈতিক চেতনা এবং ইতিহাসবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর, শানানো। নির্বাচিত অন্য দুটি গল্প ‘জঞ্জালবুড়ো’ এবং ‘জামগাছ’-এ কৃষণ চন্দরের সেই চেতনা ও বোধেরই পরিচয় মেলে।
রাজেন্দ্র সিংহ বেদীকে বলা হয় উর্দু সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক ধারার প্রবর্তক। তাঁর গল্পের স্বর গাঢ় এবং গম্ভীর। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন, সেখানে বর্ণহীন বাস্তবতার প্রক্ষেপ আর মনস্তত্ত্বের চাপ সব মিলিয়ে যেখানে একটি সাধারণ মানুষ হয়ে ওঠে অচেনা মানুষ, সহজ সম্পর্ক হয়ে ওঠে অজানা সম্পর্ক… সেই জটিল ও অজানা-অচেনা মানুষজন রাজেন্দ্র সিংহ বেদীর প্রিয় বিষয়-আশয়।
উর্দু সাহিত্যে বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত লেখক হিসেবে সাদত হাসান মান্টোর খ্যাতি রয়েছে। হয়তো এই ব্যাপক পরিচিতির পেছনে আছে মান্টোর বিরুদ্ধে সেন্সরশিপের বারংবার মামলা দায়ের-এর ঘটনা। আশ্চর্য এই যে মান্টোর অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ লেখাগুলোই সেন্সরশিপের কোপানলে পড়েছিল। ‘ধোয়া’, ‘খুলে দাও’, ‘ঠাণ্ডা গোশত’, ‘গন্ধ’, এগুলো সবই অশ্লীলতার অভিযোগে অভিযুক্ত। এমনিতেও মান্টো সমাজের নিঃস্ব, রিক্ত, পতিতদের নিয়েই কাজ করতেন, অন্ধগলির পতিতাদের চরিত্র প্রকাশ্য আলোয় তুলে ধরতেন–যা কর্তাদের কর্তব্যনিষ্ঠ চোখে প্রায়ই দৃষ্টিকটু ঠেকত। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে মান্টো মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে মারা যান।
সাদত হাসান মান্টোর নামের সঙ্গে সঙ্গে অবধারিতভাবেই উচ্চারিত হয় আরেকটি নাম–তিনি ইসমত চুগতাই। উর্দু সাহিত্যে দুজনের আগমন প্রায় এক সঙ্গে এবং আবির্ভাবের শুরুতে দুজনেই হুলুস্থুল তুলেছিলেন উর্দু সাহিত্যে। মান্টোর মতো ইসমত চুগতাই-কেও একাধিকবার অশ্লীলতার দায়ে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। দুজনের মামলা চেলেছে প্রায় একই সঙ্গে। ৩০-৪০-এর দশকে দুজনেই একসঙ্গে বোম্বাই সিনেমার গল্প লিখেছেন।
যাই হোক, ইসমত চুগতাই-এর মৌলিক হাত মূলত ছোটগল্পে। তার বিষয়বস্তু প্রত্যক্ষ-বাস্তবতা, লেখার ভঙ্গি নিরুচ্ছাস অথচ সংবেদনশীলতাই তাঁর গল্পকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। উত্তর ভারতের মুসলমান সম্প্রদায়ের মেয়েদের অবস্থা এমন ব্যাপক ও স্পর্শকাতরভাবে ফুটিয়ে তুলতে খুব কম লেখকই পেরেছেন। এখানে তাঁর নির্বাচিত ‘দুই হাত’ গল্পটি ছাড়াও গুডডির নানী’ একটি উৎকৃষ্ট লেখা।
খাজা আহমদ আব্বাস (১৪ই জুন, ১৯১৪)-এর জন্ম ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের পানিপথে। ভাষার ব্যবহারে ইনি অত্যন্ত সহজ, সাদামাটা। শতাধিক ছোটগল্প লিখেছেন। ‘ইনকেলাব’ তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। বিশিষ্ট উর্দু লেখিকা কুররাতুল আইন হায়দারকে তিনি বিয়ে করেছিলেন যদিও তা দীর্ঘদিন টেকেনি। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি গল্প লেখার চাইতে চলচ্চিত্রের কাহিনী ও সংলাপ রচনা, চিত্র পরিচালনা ও চিত্র প্রযোজনায় মনোনিবেশ করেন।
উর্দু কথাসাহিত্যে আমরা উপরে আলোচিত লেখকদের সঙ্গে যেভাবে পরিচিত, কুররাতুল আইন হায়দার, কুদরতুল্লা শাহাব কিংবা গোলাম আব্বাস-এর সঙ্গে ঠিক সেভাবে পরিচিত নই। যদিও এই সংকলনভুক্ত তাঁদের গল্পগুলো স্ব-উজ্জ্বলতায় ভাস্বর এবং উর্দু গল্পের ধারাবাহিক আলোচনায় এরা এসে পড়েন অনিবার্যভাবেই।
এখানে একটি কথা উল্লেখ প্রয়োজন যে উর্দু সাহিত্যের এক ব্যাপক অংশ বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখক অনুবাদ করেছেন। অথচ এই সংকলনের জন্য নির্বাচনকালে যখন অনুবাদ গ্রন্থগুলোর মুখোমুখি হলাম, আমরা দেখলাম অধিকাংশ অনুবাদকই ন্যূনতম কোনো শৃঙ্খলা মেনে চলেননি। ফলে ঘটনা ঘটেছে এরকম যে, পাঠক একজন উর্দু গল্পকারের অনেক গল্প পড়ছেন ঠিকই কিন্তু তার পাঠ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে সেরা গল্পগুলো। দ্বিতীয়ত, রূপান্তরিত গল্পগুলোর কিছু কিছু জায়গায় আড়ষ্টতাও ধরা পড়েছে। তবু অনুবাদকদের মিলিত চেষ্টায় উর্দু ভাষার একটা ঐশ্বর্যময় সম্ভার বাংলা ভাষায় অনূদিত ছিল বলেই দুই খণ্ডে উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ গল্প বের করা সম্ভব ছিল। অনুবাদকদের কাছে আমাদের। ঋণ তাই অপরিশোধ্য। ভবিষ্যতে নতুন অনুবাদের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্পকে সম্পন্নতর করে তোলার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।