‘তা হলে তুমি এসে গেছ।’
‘হ্যাঁ।’
‘খুকি শুয়েছে, না মরেই গেল?
ইন্দু ঝুঁকে-পড়া অবস্থা থেকে একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। হায় রাম!’ নাকের উপর আঙুল রেখে সে বলল–
‘কী কথা বলছ? বেচারি মরবে কেন–মা-বাপের একমাত্র মেয়ে–’
‘হ্যাঁ’, মদন বলল–বউদির একমাত্র ননদ।’ তারপরই হুকুম দেয়ার স্বর আয়ত্ত করে বলল–’ওটাকে বেশি মাথায় তুল না।’
‘তাতে কোনো পাপ হবে?’
‘পাপ হবে, মদন রেগে গিয়ে বলল–’তোমার পিছু ছাড়ে না। যখনি দেখি জোকের মতো লেগে আছে। আমি তো কোনো সুযোগই পাই না …’
‘হায়। ইন্দু মদনের চারপাইয়ের উপর বসতে-বসতে বলল–’বোনদের আর মেয়েদের এভাবে দূর-দূর করা ঠিক নয়। বেচারি দু দিনের অতিথি। আজ নয়ত কাল, কাল নয় পরশু একদিন তো চলে যাবে …’ এ-বিষয়ে ইন্দু কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু সে চুপ করে গেল। মনশ্চক্ষুতে ইন্দু নিজের মা, বাপ, ভাই, বোন, খুড়ো, জেঠা, জেঠিমা সকলেই দেখা দিয়ে গেল একবার করে। কোনো একদিন সে তাদের আদরের পুতুল ছিল, চোখের পলকে সে তাদের থেকে স্বতন্ত্র হয়ে গেল, এখন দিনরাত তার বেরিয়ে যাওয়ার কথা হচ্ছে, যেন ঘরে কোনো বুড়ি শাশুড়ি আছে। কোনো ঘরে যদি সাপ থাকে, তা হলে যতক্ষণ পর্যন্ত-না ওই সাপকে তার গর্তে ধোয়া দিয়ে মেরে ফেলা যায় ততক্ষণ ঘরের লোক নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে না। দূর-দূরান্ত থেকে সাপকে খুঁটিগাড়ার, দড়ি দিয়ে বাঁধার, বিষদাত ভেঙে দেয়ার মাদারিদের ডেকে আনা হয়। বড় বড় ধন্বন্তরী আর মোতিসাগররা আসে–শেষে একদিন উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে লাল আঁধি এসে যায়। তা সাফ হয়ে যাবার পর একটি লরি এসে দাঁড়ায়–তাতে সলমা-চুমকিওয়ালা শাড়িতে জড়িয়ে থাকা এক নববধূ বসে থাকে। পিছনের ঘরে এক সুর বাজতে থাকে, সানাই-এর আওয়াজ শোনা যায়। তারপর এক ধাক্কায় লরি চলতে থাকে।
মদন কিছুটা রাগের সঙ্গে বলল—
‘তোমরা মেয়েছেলেরা খুব চালাক। গতকালই এ বাড়িতে এসেছ আর আজ এখানকার সব লোকের প্রতি আমার চেয়ে তোমার বেশি ভালোবাসা জন্মেছে?’
হ্যাঁ।’ ইন্দু বিশ্বাসের সঙ্গে বলল।
‘এ সব মিথ্যা। এ হতে পারে না।’
‘তোমার মতলব আমি…’
‘এ-সব শুধু লোক দেখানো…হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা জি। ইন্দুর চোখে জল এসে যায়, সে বলে–এ সব কিছুই আমার দেখানেনা?’ ইন্দু উঠে গিয়ে নিজের বিছানায় চলে যায় আর শিয়রের দিকে মুখ লুকিয়ে ফোঁপাতে থাকে। মদন তার অভিমান ভাঙাতে চায়, কিন্তু ইন্দু নিজেই উঠে মদনের কাছে আসে আর শক্ত করে তার হাত ধরে বলে–
‘তুমি সব সময় বিধিয়ে-বিধিয়ে কথা বলছ, তোমার হয়েছে কী?’
স্বামীর মতো রোয়াব দেখাবার সুযোগ মদন পেয়ে যায়–’যাও …যাও…শুয়ে পড়ো। গে’, মদন বলে–’তোমার কাছে আমার কিছুই নেওয়ার নেই…’
‘তোমার কিছু নেওয়ার নেই তো আমার নেওয়ার আছে, ইন্দু বলল–’সারা জীবন নেওয়ার আছে। সে মদনের সঙ্গে হাত কাড়াকাড়ি করতে থাকে। মদন তাকে ধু-ধুৎ করে আর সে মদনের গায়ে পড়ে মিশে যেতে চায়। সে ছিল সেই মাছের মতো যে স্রোতের সঙ্গে বহে যাবার বদলে ঝরনা খরস্রোতের বিপরীতে সাঁতরে উপরে পৌঁছতে চায়। সে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করল, হাত ধরল, কেঁদে-হেসে বলল–
‘ফের আমাকে একেবারে কুটনি বলবে?
সব মেয়েছেলেই তো তাই।
‘থাম…তোমার তো…’ মনে হল যেন ইন্দু কোনো গালি দিচ্ছে আর মুখে কী একটা গুনগুন করেছে। মদন দুরে বসে বলল–কী বললে? আর ইন্দু শোনবার মতো আওয়াজ করে ফের বলল সে-কথা। মদন খিলখিল করে হাসতে লাগল। পরক্ষণেই ইন্দু মদনের পাশে শুয়ে পড়ে বলছিল—
‘তোমরা পুরুষরা কী জান?–যার সঙ্গে ভালোবাসা হয় তার সব ছোটবড় আত্মীয়ের। সঙ্গেই ভালোবাসা হয়। কি বাপ, কি ভাই, আর কি বোন–’হঠাৎ দূরের দিকে তাকিয়ে ইন্দু বলে–
‘আমি দুলারি-খুকির বিয়ে দেব।
‘চূড়ান্ত হয়ে গেল, মদন বলল–’এখনো সে এক হাত লম্বা হয়নি, এখনি তার বিয়ের কথা ভাবছ…’
‘তুমি তো এক হাত দেখছ’, বলে ইন্দু নিজের দুহাত মদনের চোখের উপর রেখে বলতে থাকে একটু সময় চোখ বন্ধ করে আবার খোল’– মদন সত্যি-সত্যি চোখ বন্ধ করল, কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ খোলে না দেখে ইন্দু বলল–এখন তো খোল, এতক্ষণের মধ্যে আমি বুড়ি হয়ে যাব’–শুনে চোখ খুলল মদন। মুহূর্তের জন্য মদনের মনে হয়। সামনে ইন্দু নয়, আর কেউ বসে আছে। সে যেন হারিয়ে গেছে।
‘আমি তো এখন থেকেই চার স্যুট আর কিছু বাসনপত্র ওর জন্যে আলাদা করে। রেখেছি’, ইন্দু বলল। মদন কোনো জবাব দিল না দেখে আঁকি দিয়ে আবার বলল–তুমি কি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছ? নিজের ছেলেবেলার কথা মনে নেই?–তুমি তোমার দুঃখ আমাকে দিয়ে দিয়েছ…?
‘অ্যা!’ মদন চমকে উঠে বসল আর নিশ্চিত হয়ে গেল, কিন্তু সে যখন ইন্দুকে নিজের। সঙ্গে সাপটে মিশিয়ে নিল তখন সে আর একটি শরীর রইল না–সঙ্গে-সঙ্গে এক আত্মাও তার আত্মার সঙ্গে মিলে গেল।
মদনের কাছে ইন্দু হল আত্মার আত্মা। ইন্দুর ছিল সুন্দর শরীর কিন্তু হামেশা কোনো-না-কোনো কারণে সে মদনের আড়ালে থাকে। একটা পর্দার আড়ালে। স্বপ্নের সুতোয় বোনা, নিঃশ্বাসের ধোয়ায় রঙিন। উচ্চ হাসির সোনালি কিরণে উজ্জ্বল আলো ইন্দুকে ঢেকে রাখত। মদনের নজর আর তার হাতের দুঃশাসন বহু শতাব্দী ধরে ওই। দ্রৌপদীর–যাকে সাধারণত বউ বলা হয়–বস্ত্রহরণ করতে থাকে। কিন্তু হামেশা আসমান থেকে থানের পর থান, গজের পর গজ কাপড় তার উলঙ্গতা ঢাকবার জন্য নেমে আসে। দুঃশাসন শ্রান্ত হয়ে কোনো একখানে ঢলে পড়ে কিন্তু দ্রৌপদী সেখানেই দাঁড়িয়ে। থাকে। ইজ্জত আর শুচিতার শাদা শাড়ি-পরিহিতা সে নারী দেবীর মতো দেখায় আর–