তখন ইন্দু তার মুখ সরিয়ে নিল। যেন সে মুখ দেখার অনুমতি দিয়েছিল তবে এতক্ষণ ধরে নয়। আর লজ্জার তো কোনো সীমা নেই। মদন কিছুটা শক্ত হাতেই হু-হুঁ করতে থাকা নববধূর মুখ ফের ওপরে তুলে মাতালের মতো গদৃগ কণ্ঠে বলল–’ইন্দু!’
ইন্দু কিছুটা ভয় পেয়েছিল। জীবনে এই প্রথমবার কোনো অপরিচিত পুরুষ এইভাবে তার নাম ধরে ডাকল আর সেই অপরিচিত পুরুষের দৈবী অধিকারের দাবিতে রাতের আঁধারে ধীরে-ধীরে একাকী বন্ধুহীন অসহায় নারীর আপন মানুষ হয়ে যাচ্ছিল সে। ইন্দু এই প্রথমবার একনজর ওপর দিকে তাকিয়ে, তারপর চোখ বন্ধ করে কেবল এটুকু বলেছিল– ‘জি।’…তার আপন কণ্ঠস্বর পাতাল থেকে উঠে আসা শব্দের মতো শুনিয়েছিল।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কাটল। তারপর ধীরে-ধীরে কথাবার্তা হতে লাগল। এখন যে কথা চালানো সম্ভব তাই চলছিল। ইন্দু থামছিলই না। ইন্দুর বাবা, ইন্দুর মা, ইন্দুর ভাই, মদনের ভাই-বোন-বাপ, তার রেলের চাকরি, তার মেজাজ, জামা-কাপড়ের পছন্দ, খাওয়ার অভ্যাস–সব কিছুরই হিসাব নিচ্ছিল সে। মাঝে-মাঝে মদন ইন্দুর কথা থামিয়ে দিয়ে অন্য কিছু বলতে চাইলে ইন্দু এড়িয়ে যাচ্ছিল সীমাহীন অসহায় অবস্থায় মদন তার মায়ের কথা তুলল। মা তার সাত বছর বয়সে তাকে ছেড়ে খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। যতদিন পর্যন্ত বেচারি মা বেঁচেছিলেন’, মদন বলল–ততদিন বাবুজির হাতে ওষুধের শিশিই দেখতাম, আমি হাসপাতালের সিঁড়ির উপর আর পাশের ছোট ঘরে পিপড়ার সারির উপর শুয়ে থাকতাম, আর শেষে একদিন–২৮ মার্চের সন্ধেবেলায়…’ বলতে বলতে মদন চুপ করে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ক্রন্দন তার গলা ভরে যাওয়ায় এ-ধারে-ওধারে পৌঁছে গেল। ইন্দু ঘাবড়ে গিয়ে মদনের মাথা টেনে নিল নিজের বুকে। তার ক্রন্দনের মুহূর্ত-অবসরে ইন্দু নিজের এ-ধারে আর ও-ধারে ছড়িয়ে গেল (দূরের মানুষ কাছে হল)। মদন ইন্দুর সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাইলে ইন্দু তার হাত চেপে ধরে বলল–’আমি তো লেখাপড়া জানি না। জীবনে আমি দেখেছি মা আর বাবা, ভাই আর ভাই-বউ, আরো অনেক লোক দেখেছি, এ-কারণে আমি কিছু-কিছু বুঝি! আমি এখন তোমার। নিজের বদলে তোমার কাছে একটা জিনিস চাইছি…’।
কাঁদতে-কাঁদতে কান্নার নেশা ধরে যায়। মদন কিছুটা অধীরতা আর কিছুটা উদারতা মিলিয়ে বলল
কী চাইছ? তুমি যা চাইবে আমি তাই দেব।’
‘পাকা কথা?’ ইন্দু বলল।
মদন কিছুটা ব্যাকুল হয়ে বলল–
হ্যাঁ, হ্যাঁ, যা বলেছি তা পাকা কথা।’
কিন্তু এর মধ্যেই মদনের মনে এক ভাব এল। আমার কারবার আগের থেকেই মন্দা চলছে; যদি ইনু এমন কিছু জিনিস চায় যা আমার সামর্থ্যের বাইরে তা হলে কী হবে? কিন্তু ইন্দু মদনের শক্ত আর প্রসারিত হাত আপন নরম হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে তার গালে আপন গাল রেখে বলল–
‘তোমার দুঃখ আমাকে দিয়ে দাও।
মদন খুব হতাশ হয়ে গেল। সেইসঙ্গে তার ঘাড় থেকে এক বোঝা নেমে গেল বলে অনুভব করল। সে ফের চাঁদের আলোয় ইন্দুর মুখ দেখার চেষ্টা করল কিন্তু কিছু বুঝতে পারল না। মদন ভাবল মা অথবা কোনো সখির কাছে শেখা মুখস্থ প্রবাদ ইন্দু তাকে বলেছে। আর তখনি এক তপ্ত অশ্রুবিন্দু মদনের হাতের কবজির উপর পড়ল। সে ইন্দুকে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে নিতে বলল–’দিলাম।’ এই-সব কথাবার্তা মদনকে অনেকটা স্বাভাবিক সহজ করে তুলল।
এক-এক করে সব অতিথি বিদায় নিল। চকলি বউদি দুই বাচ্চাকে দু হাত ধরে সিঁড়ির উঁচু-নিচু ধাপে নিজেকে সামলে চলে গেল। দরিয়াবাদী পিসি তার ন লাখ টাকার হার হারিয়ে গেছে বলে হৈ-চৈ লাগিয়ে দিয়েছিল। হাঙ্গামা করতে-করতে বেহুশ হয়ে গিয়েছিল; সেই হার পাওয়া গেল স্নানের ঘরে। যৌতুক থেকে তার প্রাপ্য তিনখানা শাড়ি নিয়ে পিসি চলে গেল। তারপর গেলেন খুড়োমশায়–জে. পি. হবার খবর মদনের মারফত পেয়ে এমনই কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন যে মদনের বদলে তিনি নববধূর মুখচুম্বন করতে যাচ্ছিলেন।
বাড়িতে থাকল কেবল বুড়ো বাপ আর ছোট ভাইবোন। ছোট্ট দুলারি তো সব-সময় বউদির গায়ে লেপটে থাকে। গুলি-মহল্লার কোনো বউ নববধূকে তাকিয়ে দেখে অথবা না-দেখে, যদি দেখে তো কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে, এই সব তার এখতিয়ারের মধ্যে ছিল। শেষ পর্যন্ত এই সবও মিটে গেলে ইন্দু ধীরে-ধীরে পুরনো হতে লাগল। কিন্তু কালকাজির। এই নয়া বসতিতে আজ পর্যন্ত লোক আসতে-যেতে মদনের বাড়ির সামনে থমকে যায় আর কোনো অছিলায় অন্দরে চলে আসে। ইন্দু তাদের দেখামাত্রই ঘোমটা টেনে দিত। কিন্তু ওই সামান্য অন্তরাল থেকেই যেটুকু দেখা যেত তা বিনা-ঘোমটায় দেখা যেতে পারত না।
মদনের কারবার ছিল দুর্গন্ধ বিরোজার। কোনো বড় সরবরাহকারীর দু-তিনটি জঙ্গলে চীড় আর দেবদারু গাছের জঙ্গলে আগুন ধরে যায় আর দাউদাউ করে জ্বলতে-জ্বলতে কালি হয়ে যায়। মহীশূর আর আসাম থেকে আনানো বিরোজার দাম বেশি পড়ে যেত। কিন্তু লোকে বেশি দামে তা কিনতে রাজি নয়। একে তো আমদানি কমে গিয়েছিল তার ওপর মদন তাড়াতাড়ি দোকান আর সংলগ্ন দফতর বন্ধ করে ঘরে চলে আসতঘরে পৌঁছে তার একমাত্র প্রয়াস ছিল যে, সকলে খাওয়া-দাওয়া করে যেন তাড়াতাড়ি আপন-আপন বিছানায় শুয়ে পড়ে। খাবার সময় সে নিজেই থালা তুলে বাপ আর বোনের সামনে রাখত আর তাদের খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো বাসন সব গুছিয়ে নিয়ে কলের নিচে রেখে দিত। সবাই ভাবত, বধূ মদনের কানে যে কোনো মন্ত্র পড়ে দেওয়াতেই সে ঘরের কাজেকর্মে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। মদন ছিল সকলের চেয়ে বড়। কুন্দন তার ছোট, পাশী সবচেয়ে ছোট। যখন কুন্দন বউদির সঙ্গে একসঙ্গে বসে খাবার জেদ ধরত তখন বাপ ধনীরাম তাকে বকে দিতেন–’তুমি খাও’–বলতেন, বউ পরে খেয়ে নেবে। ধনীরাম রান্নাঘরের এদিক-ওদিক দেখতেন, আর যখন বউ খাওয়া-দাওয়া থেকে ছুটি পেত আর বাসনকোসনের প্রতি মনোযোগ দিত তখন বাবু ধনীরাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতেন–রেখে দাও বউমা, বাসনকোসন সকালে ধোয়া যাবে। ইন্দু বলত, না বাবুজি, আমি এখনি ধুয়ে দিচ্ছি।’ বাবু ধনীরাম কম্পিত কণ্ঠস্বরে বলতেন–মদনের মা যদি আজ থাকত বউমা, তা হলে সে কি তোমায় এসব করতে দিত?’ তখন ইন্দু একেবারে হাত গুটিয়ে নিত।