চাপাপড়া মানুষটি বেশ কঠোরতার সঙ্গে তাকে বলল, আমাকে তো আগে এই গাছের নিচ থেকে বের করুন। খুব ধীরে ধীরে তার নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস বইছিল। তার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন খুব কঠিন অসুখ আর দুঃখের মধ্যে পড়েছে।
সেক্রেটারি বললেন, এ ব্যাপারে আমার করার কিছুই নেই। আমি যা করতে পারি তা তা করে দিয়েছি। তুমি যদি মারা যাও তবে তোমার স্ত্রীকে পেনসন দিতে পারি।’
কবি থেমে-থেমে বলল, ‘আমি বেঁচে আছি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন।
সরকারের সাহিত্য একাডেমির সেক্রেটারি হাত কচলাতে-কচলাতে বললেন, ‘মুশকিল কী জান, আমার দপ্তর শুধুমাত্র কালচারের সঙ্গে যুক্ত। গাছ কাটাকাটির ব্যাপার তো আর দোয়াতকলমে হয় না–কুড়াল-কাটারির সঙ্গেই এর গভীর সম্পর্ক। আমি ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে আর্জেন্ট লিখে দিয়েছি।’
সন্ধ্যার সময় মালি এসে চাপা-পড়া মানুষটিকে বলল, ‘কাল ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোক এসে গাছে কেটে দেবে, আর তুমিও বেঁচে যাবে!
মালি খুব খুশি। চাপাপড়া মানুষটির শরীরে আর কুলাচ্ছিল না। বাঁচার জন্যে সে যুঝে চলেছিল আপ্রাণ। কাল পর্যন্ত…কাল ভোর পর্যন্ত…যে কোনোভাবেই হোক কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে।
পরের দিন ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের মানুষজন যখন কুড়াল-কাটারি নিয়ে গাছ কাটতে হাজির হল, তখন বৈদেশিক দপ্তর থেকে খবর এল, গাছ কাটা বন্ধ রাখ। কারণ দশ বছর আগে পিটোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী সেক্রেটারিয়েটের লনে এই গাছ লাগিয়েছিলেন। এখন যদি এই গাছ কাটা হয় তবে পিটোনিয়া সরকার অসন্তুষ্ট হতে পারেন।
একজন ক্লার্ক চিৎকার করে বলল, কিন্তু একজন মানুষের জীবনের প্রশ্ন যে জড়িত।’
আর একজন ক্লার্ক অন্য ক্লার্কটিকে বলল, আরে এ যে দু-দেশের সম্পর্কের প্রশ্ন। তুমি কি জান না পিটোনিয়া সরকার আমাদের দেশকে কীভাবে সহযোগিতা করছে। আমরা কি বন্ধুত্বের জন্য একজন মানুষের জীবন উৎসর্গ করতে পারি না!
–কবির মরে যাওয়া উচিত।
–নিশ্চয়ই।
আন্ডার সেক্রেটারি সুপারিনটেনডেন্টকে বললেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী সফর শেষ করে ফিরছেন। বিকেল চারটায় বৈদেশিক দপ্তর এই গাছ সম্পর্কিত ফাইল তাঁর কাছে পেশ করবেন। উনি যা বলবেন তাই-ই হবে।’
বিকেল পাঁচটায় সেক্রেটারি স্বয়ং ফাইল নিয়ে হাজির হলেন। এই যে শুনছ। খুশিতে গদগদ তিনি ফাইল দোলাতে-দোলাতে বললেন, এই গাছ কাটার হুকুম দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সমস্ত আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কালই এই গাছ কাটা হবে। আর তুমিও বেঁচে যাবে এই সমস্যা থেকে। আরে শুনছ কি! আজ তোমার ফাইল পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।’
কিন্তু কবির হাত তখন বরফের মতো ঠাণ্ডা। চোখের তারা স্থির। একসার পিঁপড়ে তার মুখের ভিতর ঢুকছিল।
তার জীবনের ফাইলও পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।
তোমার দুঃখ আমাকে দাও – রাজেন্দ্র সিংহ বেদী
মদন যেমন ভেবেছিল বিয়ের রাত ঠিক তেমনটি হয়নি।
চকলি বউদি মদনকে ফুসলিয়ে ঠেলে দিয়েছিল মাঝখানের ঘরে। ইন্দু সামনের শালুতে নিজেকে জড়িয়ে আঁধারেরই অংশ হয়ে বসেছিল। বাইরে চকলি বউদি, দরিয়াবাদী পিসি আর সব মহিলাদের হাসি রাতের শান্ত জলে মিছরির মতো ধীরে-ধীরে গলে যাচ্ছিল। মহিলারা বুঝেছিলেন যে, এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও মদন কিচ্ছু জানে না, কারণ যখন তাকে মাঝরাতের ঘুম থেকে জাগানো হল তখন সে হড়বড় করে বলেছিল– ‘আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’
এই মহিলাদের দিন চলে গেছে। বিয়ের পহেলা রাতে তারা তাদের স্বামীদের যে-সব কথা বলেছিল আর শুনেছিল তার প্রতিধ্বনি আজ তাদের স্মৃতিতে নেই। তারা কেবল সংসার করেছে আর এখন নিজের অন্য এক বোনকে সংসারের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। ধরিত্রীর এই মেয়েরা এ-কথাই বুঝেছিল যে, পুরুষরা হল মেঘখণ্ড–তাদের প্রতিটি বর্ষণের জন্য মুখ তুলে তাকিয়ে থাকতে হয়। যদি না-বর্ষে তো প্রার্থনা করতে হয়, পূজা দিতে হয়, জাদুমন্ত্র পড়তে হয়। যদিও কালকাজির এই নয়া বসতিতে মদন ঘরের সামনে খোলা উঠানে শুয়েছিল, তবু তারই জন্য অপেক্ষায় ছিল ওরা। এক অশুভ লক্ষণের মতো পড়শি সিবতের মোষটা মদনের খাটের কাছে বাঁধা ছিল। মোষটা বারবার ফু-ফু করে মদনকে শুকছিল আর মদন চেষ্টা করছিল হাত তুলে তাকে দূরে রাখার–এই অবস্থায় ঘুমোনোর সুযোগ কোথায়?
সাগরের তরঙ্গে দোলা আর মেয়েদের রক্তে ঢেউ-ভোলায় পারঙ্গম চাঁদ এক জানালা পথে অন্দরে চলে এসে দেখছিল, দরজার অন্য দিকে দাঁড়িয়ে মদন পরবর্তী পদক্ষেপ কোন দিকে ফেলে। মদনের নিজের ভিতরে মেঘ গর্জন করছিল। বিজলি-বাতির থামে কান পাতলে যেমন তার ভিভরে শনশন্ শব্দ শোনা যায় তেমনি শব্দ তার নিজেই ভিতরে শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর মদন এগিয়ে গিয়ে পালঙ্ক টেনে চাঁদের আলোয় নিয়ে এল যাতে করে নববধূর মুখ দেখা যায়। কিন্তু সে থমকে দাঁড়াল। সে তখনি ভাবল ইন্দু আমার বউ, পরস্ত্রী তো নয়, পরস্ত্রীকে স্পর্শ না-করার শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই সে পেয়ে এসেছে। শালুর মধ্যে সেঁধিয়ে-থাকা নববধূকে দেখতে-দেখতে মদন সিদ্ধান্তে এল যে, এইখানে ইন্দুর মুখ লুকিয়ে আছে। ভাবনামতো পাশে পড়ে থাকা গাটরিটা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখল, সেখানেই ইন্দুর মুখ। মদন ভেবে ছিল যে, ইন্দু সহজে নিজে থেকে তার মুখ দেখতে দেবে না। কিন্তু ইন্দু এরকম কিছু করেনি। কেননা, কয়েকবছর আগে থেকে সে-ও এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিল, অন্যদিকে কোনো কাল্পনিক মোষের শুঁকতে থাকার ফলে তারও ঘুম আসছিল না। চলে-যাওয়া ঘুম আর বন্ধ-করা চোখের বেদনা সমেত আঁধার ছাড়াও সামনে ধড়ফড়-করা কিছু একটা নজরে এল মদনের। চিবুক পর্যন্ত পৌঁছতে-পৌঁছতে মুখ সাধারণত লম্বা হয়ে যায় কিন্তু এখানে। সব কিছুই গোল দেখাচ্ছিল। চাঁদের আলোয় গাল আর ঠোঁটের মাঝে এক ছায়াদার টোল তৈরি হয়েছিল–যেমন সবুজ ক্ষেত আর সুন্দর টিলার মাঝখানে হয়ে থাকে। কপালটি তার ছোট, কিন্তু তার ওপর হঠাৎ গজিয়ে-ওঠা কুঞ্চিত কেশরাশি—