মালি দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেল।
তৃতীয় দিন হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্ট খুব কড়া এবং ব্যঙ্গপূর্ণ জবাব দিল।
হার্টিকালচার ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি সাহিত্যদরদী বলে পরিচিত ছিলেন। তিনি সাহিত্যিক ভাষায় লিখলেন, খুব আশ্চর্যের কথা যখন সমগ্র দেশে আমরা বৃক্ষ রোপণ করছি, তখনই আমাদের দেশে এমনকি সরকারি আইন আছে যার বলে বৃক্ষ কাটা যায়! বিশেষ করে এমন এক বৃক্ষ–যা ফল দেয়। আর এই বৃক্ষ হচ্ছে একটি জাম বৃক্ষ, যার ফল সবাই আনন্দের সঙ্গে আস্বাদন করে। আমাদের বিভাগ কোননামতেই এই ধরনের এক ফলদার বৃক্ষকে কাটার অনুমতি দিতে পারে না।
একজন রসিক মানুষ আপসোস করে বলল, এখন তবে কী করা যায়? যদি গাছ কাটা না যায় তবে মানুষটিকেই কেটে বের করা হোক।’ সে সবাইকে তার প্রস্তাব বুঝিয়ে দিল, ‘দেখুন, যদি মানুষটিকে এখান থেকে কাটা যায় তবে অর্ধেক মানুষ এদিকে বেরিয়ে আসবে, অর্ধেক ঐদিকে। আর গাছটিও যেমনকার তেমন থাকবে।’
চাপা-পড়া মানুষটি তার কথার প্রতিবাদ করে উঠল, কিন্তু আমি যে মারা যাব।’ একজন ক্লার্ক বলল, ‘হাঁ, একথাও ঠিক।
মানুষটিকে কাটার জন্য যিনি নিপুণ যুক্তি হাজির করছিলেন, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, আপনি জানেন না, আজকাল প্লাস্টিক সার্জারি কত উন্নতি সাধন করেছে। একে যদি দুখণ্ড করে কেটে বের করা যায় তবে প্লাস্টিক সার্জারি করে আবার জোড়া লাগানো যাবে।’
এইবার ফাইল মেডিকেল ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হল। মেডিক্যাল ডিপার্টমেন্ট এ্যাকশন নিল সঙ্গে-সঙ্গে। যেদিন তাদের ডিপার্টমেন্টে ফাইল পৌঁছল তার পরদিনই তারা ঐ ডিপার্টমেন্টের যোগ্যতম প্লাস্টিক সার্জনের কাছে পাঠিয়ে দিল। সার্জেন খুঁটিয়ে চাপাপড়া মানুষটির স্বাস্থ্য, রক্তচাপ, নাড়ির গতি, হার্ট এবং মাংস পরীক্ষা করে এক রিপোর্ট লিখলেন : হাঁ, প্লাস্টিক অপারেশন হতে পারে এবং অপারেশন সফলও হবে, তবে মানুষটি মারা যাবে।
সুতরাং এই ফয়সালাও আর গ্রহণ করা হল না। রাত্রে মালি চাপাপড়া মানুষটিকে খিচুড়ি খাওয়াতে-খাওয়াতে বলল, তোমার ব্যাপারটি ওপর মহলে গেছে। শুনেছি কালকে সেক্রেটারিয়েটের সমস্ত সেক্রেটারিদের মিটিং হবে। ঐ মিটিং-এ রাখা হবে তোমার কেস। মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে যাবে।
চাপাপড়া মানুষটি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে ধীরে বলল,
‘জানি আমাকে হয়তো অস্বীকার করবে না।
কিন্তু তোমার কাছে যখন খবর আসবে
তখন আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাব।’
মালি আচমকা তার ঠোঁটে আঙুল রেখে আশ্চর্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি…তুমি কবি?
চাপাপড়া মানুষটি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।
পরের দিন মালি চাপরাসিকে বলল, চাপরাসি বলল ক্লার্ককে, ক্লার্ক হেডক্লার্ককে, কিছুক্ষণের মধ্যে সারা সেক্রেটারিয়েটে খবর রটে গেল চাপাপড়া মানুষটি একজন কবি। আর দেখতে দেখতে কবিকে দেখার জন্য লোক ভেঙে পড়ল। এই খবর শহরেও পৌঁছে গেল। আর সন্ধ্যার মধ্যে শহরের অলিগলিতে যত কবি আছেন তারা এসে জমা হলেন। সেক্রেটারিয়েটের লন কবি, কবি আর কবিতে ভরে উঠল। চাপাপড়া মানুষটির চারদিকে কবি সম্মেলনের এক সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল। সেক্রেটারিয়েটের কয়েকজন ক্লার্ক এবং আন্ডার সেক্রেটারি–যারা সাহিত্য এবং কবিতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারাও থেমে গেলেন এখানে। কয়েকজন কবি চাপাপড়া মানুষটিকে তাদের কবিতা এবং দোহা শোনাতে শুরু করলেন। আর কয়েকজন ক্লার্ক তাকে তার নিজস্ব কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে বললেন।
চাপাপড়া মানুষটি যে একজন কবি, এই খবর যখন সেক্রেটারিয়েটের সাব কমিটিতে পৌঁছুল, তখন তারা রায় দিলেন : চাপাপড়া মানুষটি একজন কবি, সুতরাং তার ব্যাপার ফয়সালা করতে হার্টিকালচার বা এগ্রিকালচার দপ্তর পারে না। এ সম্পূর্ণভাবে কালচারাল বিভাগের ব্যাপার। কালচারাল বিভাগকে অনুরোধ করা হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হতভাগ্য
কবিকে চাপাপড়া ফলদার গাছ থেকে মুক্ত করা হোক।
ফাইল কালচারাল ডিপার্টমেন্টের এক বিভাগ থেকে আরেক বিভাগ ঘুরতে-ঘুরতে সাহিত্য একাডেমির সেক্রেটারির হাতে এল। বেচারা সেক্রেটারি ঠিক ঐ সময়েই গাড়িতে করে সেক্রেটারিয়েট এসে চাপাপড়া মানুষটির ইন্টারভিউ নিতে শুরু করলেন।
–তুমি কবি?
সে জবাব দিল, ‘আজ্ঞে হাঁ।’
–কোন নামে তুমি পরিচিত?
–ওস।
ওস? সেক্রেটারি বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলেন। ‘তুমি সেই ওস–যার পদ্য সংগ্রহ ‘ওসের ফুল’ নামে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে?’
চাপাপড়া মানুষটি রুক্ষ কণ্ঠে বলল, হাঁ।
সেক্রেটারি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাদের একাডেমির মেম্বার?
–না।
সেক্রেটারি বললেন, আশ্চর্যের কথা। এত বড় কবি–’ওসের ফুলে’র লেখক আমাদের একাডেমির সদস্য নয়! আহা কী ভুল হয়ে গেছে আমার, কত বড় কবি, অথচ কী অন্ধকারের নিচে নাম চাপা পড়ে আছে!
–আজ্ঞে, নাম চাপা পড়ে নেই, আমি স্বয়ং এক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছি। দয়া করে আমাকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি মুক্ত করুন।
‘এক্ষুণি করছি’ বলে সেক্রেটারি তখনই নিজের দপ্তরে রিপোর্ট করলেন।
পরের দিন সেক্রেটারি ছুটতে-ছুটতে কবির কাছে এলেন। বললেন, ‘নমস্কার, মিষ্টি খাওয়াও। আমাদের সাহিত্য একাডেমি তোমাকে কেন্দ্রীয় শাখার সদস্য করে নিয়েছে। এই নাও তোমার সদস্যপত্র।’