শরণার্থীরা ও সৈন্যরা পাঠান নারী-পুরুষদের মৃতদেহ বহন করে ফিরে এল। আবার কয়েক মাইল আসার পরে একটা খাল পাওয়া গেল, এখানে আমাকে আবার থামানো হল। এই খালে শবদেহগুলোকে জড় করে ফেলা হল, এবং তারপর আমি আবার এগোলাম। যাত্রীরা সকলেই এখন ভীষণ খুশি! রক্ত ও ঘৃণার স্বাদ তারা পেয়েছে, এবং এখন দেশি মদের বোতল খুলে তারা ফুর্তি করতে লাগল।
আবার আমরা থামলাম লুধিয়ানায়। এখানে লুটেরারা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ল ও মুসলমান মহল্লা ও দোকানগুলোকে আক্রমণ করল। ঘণ্টাদুয়েক বাদে তারা স্টেশনে ফিরে এল। সমস্ত পথ জুড়ে তাদের এই হত্যা ও লুঠ চলতেই থাকল। এবং এতক্ষণে আমার আত্মায় এত ক্ষত জমেছে এবং আমার কাঠের শরীরে রক্তের দাগে এত ময়লা পড়েছে। যে, আমার ভীষণ রকমভাবে স্নানের দরকার, কিন্তু আমি জানি যে, পথের মধ্যে আমাকে সে-সুযোগ দেবে না!
অনেক রাত্রে আমি আম্বালা পৌঁছলাম। এখানে একজন মুসলমান ডেপুটি কমিশনার, তাঁর স্ত্রী ও বাচ্চাদের সেনাবাহিনীর প্রহরায় এনে আমার একটা প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে তুলে দেয়া হল। সৈন্যদের ওপর কঠোর আদেশ রইল এই মুসলমান কর্মচারীর জীবন ও সম্পত্তি সুরক্ষিত রাখবার।
রাত্রি দুটোয় আম্বালা ছাড়লাম। মাইলদশেকও বোধহয় আমি আসতে পারিনি এমন সময় কেউ আমার চেন টানল। মুসলমান কর্মচারী যে প্রথম শ্রেণীর গাড়িতে যাচ্ছিলেন তার দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। কাজেই তারা জানলার কাঁচ ভাঙল। এখানে তারা ঐ মুসলমান ডেপুটি কমিশনার, তার স্ত্রী ও তিনটি ছোট বাচ্চাকে খুন করল। ডেপুটি কমিশনারের একটি অল্পবয়সী মেয়ে ছিল। সে খুবই সুন্দরী; তাই তারা ওকে বাঁচিয়ে রাখবার সিদ্ধান্ত নিল। ওরা মেয়েটিকে নিল, গয়নাগাটি ও ক্যাশবাক্স নিল, তারপর গাড়ি থেকে নেমে গেল জঙ্গলের দিকে। মেয়েটির হাতে একখানা বই ছিল।
জঙ্গলে গিয়ে ওরা অধিবেশনে বসল। মেয়েটিকে নিয়ে কী করা হবে? ওকে খুন করা হবে, না বাঁচিয়ে রাখা হবে? মেয়েটি বলল, আমাকে খুন করবার দরকার কী? আমাকে তোমাদের ধর্মে বদল করে নাও। আমি তোমাদের একজনকে বিয়ে করব।
তাই তো, ঠিক কথা,’ একজন তরুণ বলল, আমার মনে হয় ওকে আমাদের…’
আর-একজন তরুণ তাকে বাধা দিয়ে মেয়েটির পেটে একটা ছোরা বসিয়ে বলল, ‘আমার মনে হয় ওকে এখানেই খতম করে দেয়া উচিত। চল, ফেরা যাক। এ-সব গোলটেবিল বৈঠক ঢের হয়েছে।’
মেয়েটি মরে গেল, জঙ্গলের শুকনো ঘাসের উপরে আর ওর হাতের বইখানা ওরই রক্তের দাগে নোংরা হল। বইটা ছিল সমাজতন্ত্রের ওপর। হয়তো ও ছিল খুব বুদ্ধিমতী। মেয়ে, হয়তো দেশের ও জাতির সেবায় কাজ করবার এক জ্বলন্ত বাসনা ওর ছিল। হয়তো ভালোবাসার জন্য ওর আত্মা যন্ত্রণায় দীর্ণ ছিল, হয়তো কারো ভালোবাসা পাবার জন্যও, আদরের আলিঙ্গনে মিলিত হবার জন্য, নিজের সন্তানকে চুমো দেবার জন্য। ও তো ছিল মেয়ে, কারো প্রিয়তমা, কারো জননী, সৃষ্টির অজানা রহস্য; আর এখন এই জঙ্গলে ও মরে পড়ে রইল, শেয়ালে ও শকুনে ওর শব খেয়ে যাবে। সমাজতন্ত্র, তত্ত্ব ও প্রয়োগ…জন্তুরা এখন ওসব খেয়ে ফেলছে।
রাত্রির হতাশ অন্ধকারের মধ্যে আমি এগিয়ে চললাম, দেশি মদে মাতাল কিছু লোককে আমার গাড়ির মধ্যে বয়ে নিয়ে; তাদের গলায় চিৎকার, মহাত্মা গান্ধী কি জয়!’
অনেকদিন পরে আমি বোম্বাইতে এসেছি। এখানে ওরা আমাকে পরিষ্কার করেছে, ধুয়েছে এবং শেডের মধ্যে রেখেছে। আমার শরীরে এখন আর কোনো রক্তের দাগ নেই। খুনেদের রক্ত-জল-করা হাসির হুল্লোড় আর নেই। কিন্তু রাত্রে যখন আমি একলা থাকি, ভূতেরা সব জেগে ওঠে, মৃত আত্মারা যেন আবার প্রাণ ফিরে পায়, আহতরা জোরে চিৎকার করে, নারীরা ও শিশুরা ভয়ে ঝাঁকিয়ে ওঠে, আর আমি মনে-মনে কামনা করি ঐ ভয়ানক যাত্রায় আর যেন কেউ আমাকে নিয়ে না-যায়। ঐ ভয়ংকর যাত্রার জন্য আমি এই শেড আর কখনো ছাড়ব না। কিন্তু আমি অবশ্যই এই শেড ছেড়ে যাব দীর্ঘ ও সুন্দর যাত্রায় গাঁ-গঞ্জের মধ্য দিয়ে, যখন পাঞ্জাবের মাঠ আবার সোনার শস্যে ভরে উঠবে, যখন সরষে ফুল দেখে মনে হবে হীর ও রঙা অনন্ত প্রেমের গান গাইছে, যখন চাষিরা, হিন্দু-মুসলমান ও শিখ, সবাই আবার একসঙ্গে চাষ করবে, বীজ বুনবে ও ফসল তুলবে, এবং যখন তাদের হৃদয় আবার কানায়-কানায় ভরে উঠবে প্রেমে ও পূজায় ও নারীর প্রতি সম্মানে।
আমি সামান্য একটা কাঠের ট্রেন, কিন্তু প্রতিশোধ ও ঘৃণার ঐরকম ভারি বোঝা কেউ আমার ঘাড়ে আবার চাপিয়ে দিক এ আর আমি কোনোমতে চাই না! দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে আমাকে দিয়ে খাদ্য বওয়ানো হোক। শিল্পাঞ্চলের জন্য আমাকে দিয়ে কয়লা, লোহা ও তেল বওয়ানো হোক। গ্রামে আমাদের চাষিদের জন্য আমাকে দিয়ে সার ও ট্রাক্টর আনানো হোক। যেখানেই যাই-না কেন, সেখানে যেন আমাকে দিয়ে মৃত্যু ও ধ্বংস আর নিয়ে যাওয়া না-হয়। আমি চাই আমার গাড়ির খোপে-খোপে থাকুক সম্পন্ন চাষি ও শ্রমিকের দল ও তাদের সুখী বউ-বাচ্চারা, খুশিতে ভরপুর, পদ্মফুলের মতো হাসি তাদের মুখে; এইসব বাচ্চারাই তো এক নতুন জীবনের ধারা গড়ে তুলবে–যেখানে মানুষ হিন্দুও হবে না, মুসলমানও হবে না, হবে শুধু সেই আশ্চর্য সত্তা–মানুষ!!