ঐ উলঙ্গ স্ত্রীলোকদের বলা হল আমার ভেতরে উঠতে আর শরণার্থীদের মধ্যে বসে পড়তে, আর তারপর তারা ইসলাম জিন্দাবাদ’, ও ‘কয়েদ-ই-আজম মুহম্মদ আলি জিন্না জিন্দাবাদ’ চারপাশের এইসব মত্ত ধ্বনির মধ্যে আমাকে সহৃদয় বিদায় জানাল।
রোগা টিংটিঙে একটা ছোট বাচ্চা আস্তে-আস্তে একজন বৃদ্ধা নগ্ন স্ত্রীলোকের দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, তুমি কি এইমাত্র স্নান করেছ?
হ্যাঁ, বাবা, আজ আমার দেশের ছেলেরা, আমার নিজের ভাইয়েরা আমাকে স্নান করিয়েছে।’
তাহলে, তোমার জামা-কাপড় কই, মা?’
‘আমার বৈধব্যের রক্তে ওই কাপড়ে দাগ লেগেছিল, বাবা! তাই আমার ভাইয়েরা সে-কাপড় নিয়ে নিয়েছে।’
আমি যখন দৌড়চ্ছি তখন দুই উলঙ্গ তরুণী আমার গাড়ির দরজা দিয়ে লাফ দিল, ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম আমি এবং রাত্রির মধ্যে দৌড়ে পালাতে লাগলাম যতক্ষণ-না লাহোর পৌঁছাই।
লাহোরে আমি এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে থামলাম। আমার ঠিক উল্টোদিকে দু-নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল অমৃতসর থেকে আসা একটা ট্রেন, পূর্ব পাঞ্জাব থেকে মুসলমান শরণার্থীদের বয়ে এনেছে সেটা। কিছুক্ষণের মধ্যে মুসলমান রক্ষীরা আমার গাড়িগুলোর শরণার্থীদের মধ্যে তল্লাশ চালাল। সমস্ত টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি ও অন্যান্য মূল্যবান যা-কিছু ছিল তারা সব নিয়ে গেল। তারপর ওরা চারশ শরণার্থীকে নির্বাচন করল বদলা হত্যার জন্য। ব্যাপারটা দাঁড়াল এই রকম : মুসলমান শরণার্থী বয়ে-আনা ঐ অমৃতসরের ট্রেনটাকে পথে আক্রমণ করা হয়েছিল এবং চারশ মুসলমান খুন ও পঞ্চাশজন স্ত্রীলোক লুট করা হয়েছিল। কাজেই এটাই তো উচিত যে ঠিক চারশ হিন্দু ও শিখ শরণার্থীকে হত্যা করতে হবে এবং পঞ্চাশজন হিন্দু ও শিখ রমণীর ইজ্জত নষ্ট করা হবে, যাতে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের মধ্যে সমতা বজায় থাকে।
মোগলপুরাতে রক্ষী বদল হল। বালুচিরা বদলে গিয়ে তাদের জায়গাতে এল শিখ, রাজপুত ও ডোগরারা। আতারি থেকে সমস্ত আবহাওয়াটা বদলে গেল। হিন্দু ও শিখ শরণার্থীরা মুসলমান শরণার্থীদের এত মৃতদেহ এখন দেখতে পাচ্ছে যে, সন্দেহ নেই, তারা স্বাধীন ভারতের সীমান্তের খুব কাছে এসে গেছে।
অমৃতসর থেকে চারজন ব্রাহ্মণ আমার মধ্যে উঠল। হরিদ্বারে যাচ্ছিল তারা। তাদের মাথা পরিষ্কার করে কামানো, ঠিক মাঝখানে লম্বা শিখা। কপালে তাদের তিলক কাটা, রামনাম ছাপা ধুতি পরে তারা তীর্থে বেরিয়েছে। অমৃতসর থেকে বন্দুক, বর্শা ও কৃপাণ হাতে দলে-দলে হিন্দু শিখেরা পূর্ব পাঞ্জাবে যাওয়া সমস্ত ট্রেনে চড়ে বসল। এরা বেরিয়েছে ‘শিকার’-এর খোঁজে। ঐ ব্রাহ্মণদের দেখে ঐ শিকারিদের একজনের সন্দেহ হল। সে জিজ্ঞেস করল, ব্রাহ্মণ দেব, যাওয়া হচ্ছে কোথায়?
‘হরিদ্বারে।
‘হরিদ্বারে, না পাকিস্তানে?’ সে মশকরার সুরে জিজ্ঞেস করল।
‘আল্লার নামে শপথ করে বলছি, আমরা হরিদ্বারে যাচ্ছি!
ঐ জাঠ হেসে উঠল, আল্লার নামে, বেশ! তাহলে এবার কোতল করে ফেলা যাক। সে তখন চিৎকার করে ডাকল, নাথা সিং, এদিকে এস, বড়ো শিকার মিলেছে! ওরা একজনকে হত্যা করল। অন্য তিনজন ব্রাহ্মণ’ পালাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তাদের ধরে ফেলা হল। তোমরা তাহলে হরিদ্বারে যাচ্ছ’, নাথা সিং চিৎকার করে উঠল, এস, হরিদ্বারে যাবার আগে তোমাদের ডাক্তারি পরীক্ষা হবে।’
‘ডাক্তারি পরীক্ষায় ধরা পড়ল ওরা ঠিক যা আশা করেছিল তা-ই–সুন্নত।
ডাক্তারি পরীক্ষার পরে হত্যা করা হল তিনজন ব্রাহ্মণকেও।
হঠাৎ এক ঘন অরণ্যের ধারে থামানো হল আমাকে। সেখানে দু-এক মুহূর্তের মধ্যে আমি চিৎকার-ধ্বনি শুনলাম ‘সৎ শ্ৰী আকাল’ ও ‘হর-হর মহাদেও আর দেখতে পেলাম সৈন্যরা ও শিখ এবং হিন্দু শরণার্থীরা আমাকে ছেড়ে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম ওরা পালিয়ে যাচ্ছে মুসলমান দস্যুর ভয়ে। পরে দেখলাম সে আমার ভুল। ওরা দৌড়চ্ছিল–নিজেদের বাঁচাতে নয়,–কয়েকশ গরিব মুসলমান চাষিকে হত্যা করতে, যারা তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে এ জঙ্গলে লুকিয়েছিল। আধ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব শেষ। পরম আনন্দে বিজেতারা ফিরে আসছে। একজন জাঠ তার বর্শার ডগায় এক মুসলমান শিশুর শব দোলাতে-দোলাতে গান গাইছিল, ‘আল বৈশাখী, এই বৈশাখী, হো হো!’
জলন্ধরের কাছে পাঠান বসতির একটা গ্রাম ছিল। এখানে আবার আমাকে চেন টেনে থামানো হল, আর সবাই নেমে আবার ধাওয়া করল ঐ গ্রামটার দিকে। পাঠানরা খুব সাহসের সঙ্গে প্রতিরোধ করেছিল বটে, তবে আক্রমণকারীরা অস্ত্রশস্ত্রে ও সংখ্যায় অনেক বেশি জোরালো ছিল। গ্রামের পুরুষেরা সব এই যুদ্ধে প্রাণ দিল। তারপরে এল। স্ত্রীলোকদের পালা। এখানে এই বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে, পিপলু, শীষম ও সারিনগাছের তলায়, কেড়ে নেয়া হল তাদের ইজ্জত। এই হল পাঞ্জাবের সেইসব মাঠ যেখানে চাষিরা–হিন্দু, মুসলমান ও শিখ চাষিরা–একসঙ্গে মিলে সোনার শস্য ফলিয়েছে; যেখানে সরষের সবুজ পাতায় ও হলুদ ফুলে সমস্ত গ্রামাঞ্চল এক স্বপ্নের রাজ্যে পরিণত হত। এইসব পিপলু, শীষম ও সারিনগাছের নিচেই সারাদিনের কঠিন পরিশ্রমের পর স্বামীরা অপেক্ষা করত কখন তাদের প্রিয়তমা স্ত্রীরা লস্যি নিয়ে আসবে। ঐ তো, ঐ মাঠের পার দিয়ে, তারা লম্বা। সার বেঁধে আসছে, হাতের ঘড়ার মধ্যে লস্যি আর বয়ে আনছে মধু, মাখন আর সোনালি গমের চাপাটি। কী সতৃষ্ণ চোখে কিষাণেরা চেয়ে থাকত কিষাণী বধূর দিকে, আর ঐ চোখের চাহনিতে বউরাও কেঁপে-কেঁপে উঠত নরম পাতার মতো। এই তো পাঞ্জাবের বুকের কলজে। এখানেই জন্মেছিল সোনি আর মাহিওয়াল, হীর ও রঞ্জা! আর এখন! পঞ্চাশটা নেকড়ে, পঞ্চাশজন সোনি আর পাঁচশো মাহিওয়াল। এ-পৃথিবী আর-কখনোই আগের মতো হবে না। চেনাব আর কখনো তেমন তিরতির করে বয়ে যাবে না। হীর, রঞ্জা, সোনি, মাহিওয়াল ও মীর্জা সাহেবানের গান আর কখনো এই বুকে ঠিক তেমন করে। গুঞ্জন তুলবে না। লক্ষ-লক্ষ অভিশাপ নেমে আসুক সেইসব নেতাদের মাথায় আর তাদের সাত-সাতে উনপঞ্চাশ পুরুষের মাথায় যারা এই সৌন্দর্য, বীরধর্ম ও মর্যাদাময় ভূখশুকে অসম্মান, প্রতারণা ও হত্যার ছেঁড়াখোঁড়া টুকরোয় দাঁড় করিয়েছে, যারা এর আত্মায় সিফিলিসের বিষ ঢুকিয়েছে আর এর শরীরে ভরে দিয়েছে হত্যা, লুঠতরাজ ও ধর্ষণের জীবাণু। পাঞ্জাব আজ মরে গেছে। এর সংস্কৃতি মরে গেছে। এর ভাষা মরে গেছে। মরে গেছে এর সংগীত। এর সাহসী, সদাচারী, নিষ্পাপ প্রাণ মরে গেছে। আমার যদিও চোখ ও কান কিছুই নেই, তবু আমি এই মৃত্যু দেখতেও পেলাম, শুনতেও পেলাম।