তারা আরো কুড়িজনকে মেরে ফেলল।
এই গ্রামগুলোতেই একদিন বুদ্ধের সেই মহান সংগীতের গুঞ্জন শোনা যেত। ভিক্ষুরা এখানেই ভেবেছিলেন প্রেমের আর সত্যের আর সৌন্দর্যের কথা আর এক নতুন ধাচের জীবনের কথা।
এবং এখন সেই দুশো জনের শেষ কয়েকজন মাত্র তাদের অন্তিম লগ্নের জন্য অপেক্ষা করেছে।
ইসলামের বাঁকা চাঁদ প্রথম এখানকার দিগন্তেই তার আলো দিয়েছিল, সাম্যের, ভ্রাতৃত্বের ও মানবিকতার প্রতীক…
সবাই এখন মৃত। আল্লা-হুঁ-আকবর!
প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে গেল, এবং এত কাণ্ডের পরে যখন আমি আবার রওনা দিলাম আমার মনে হল যে, এমনকি আমার নিচেকার লোহার চাকাগুলো পর্যন্ত যেন পিছলে-পিছলে যাচ্ছে।
মৃত্যু স্পর্শ করেছে আমার সবকটা গাড়িকেই। মৃতদের শোয়ানো হয়েছিল মাঝখানে, আর চারপাশ ঘিরে জীবন্ত মৃতেরা। কোথাও একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল; কোনো-এক কোণে কারো মা ফোঁপাতে লাগলেন; এক স্ত্রী তার মৃত স্বামীর দেহ আঁকড়ে ছিল। আমি দৌড় লাগালাম ভয়ে আর ত্রাসে এবং রাওয়ালপিণ্ডি স্টেশনে এসে পৌঁছলাম।
এখানে আমাদের জন্য কোনো শরণার্থী অপেক্ষা করছিল না। কেবল জনাকুড়ি পর্দানশীন মহিলাকে সঙ্গে করে নিয়ে কয়েকজন মুসলমান যুবক আমার একটা গাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। যুবকদের সঙ্গে ছিল রাইফেল, তারা সঙ্গে করে অনেক বাক্স গোলাবারুদও এনেছিল। তারা আমাকে ঝিলম ও গুজর খার মাঝখানে থামিয়ে নিজেরা। নামতে লাগল। হঠাৎ সঙ্গের মহিলারা তাদের পর্দা ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করতে আরম্ভ করল, ‘আমরা হিন্দু, আমরা শিখ, ওরা জোর করে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে।’ যুবকেরা হেসে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওদের আরামের ঘর থেকে জোর করেই ওদের এনেছি’, যুবকেরা বলল। ওরা তো আমাদের লুঠের ধন। সে রকমই সদ্ব্যবহার করা হবে এদের। কে বাধা দেয় দেখি?
দুজন হিন্দু পাঠান ওদের উদ্ধারের জন্য লাফ দিল। বালুচি সৈন্যরা ঠাণ্ডা মাথায় ওদের শেষ করে দিল। তবু আরো কয়েকজন চেষ্টা করল। তাদেরও কয়েক মিনিটের মধ্যে খতম করা হল। তারপর ঐ তরুণী মেয়েদের টানতে-টানতে কাছে এক বনের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল, আর আমি কালো ধোঁয়ায় নিজের মুখ আড়াল করলাম এবং দৌড়ে পালিয়ে গেলাম ঐ জায়গা থেকে। মনে হল আমার লোহার ফুসফুস বোধহয় ফেটে যাবে, আর আমার মধ্যেকার লাল গনগনে আগুনের শিখা যেন গিলে ফেলবে এই বিরাট ঘন। অরণ্যকে, যা আমাদের লজ্জার সাক্ষী হয়ে রইল।
আমি লালা মুসার কাছাকাছি আসতে-আসতে মৃতদেহের দুর্গন্ধ এতটাই বাড়তে থাকল যে, বালুচি সৈন্যরা সিদ্ধান্ত নিল, ওগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হবে। ফেলে দেবার পদ্ধতিটাও চটপট বানিয়ে ফেলল তারা। যাদের মুখটা দেখতে ওদের পছন্দ হচ্ছে না এ-রকম একজনকে আদেশ করা হবে একটা মৃতদেহ গাড়ির দরজার কাছে আনতে, আর তারপরে সে দরজার কাছে এলে মৃতদেহসুদ্ধ তাকে ফেলে দেয়া হবে।
লালা মুসা থেকে আমি এলাম ওয়াজিরাবাদে। ওয়াজিরাবাদ হল পাঞ্জাবের এক অতি পরিচিত শহর। সারা ভারতের হিন্দুরা ও মুসলমানেরা যে ছুরি-ছোরা দিয়ে পরস্পরকে হত্যা করে তা এই ওয়াজিরাবাদ থেকেই রপ্তানি করা হয়। ওয়াজিরাবাদ অবশ্য খুব বড় বৈশাখী উৎসবের জন্যও বিখ্যাত। এই বৈশাখীতে হিন্দু-মুসলমানেরা নবান্নের উৎসবে মিলিত হন। তবে, আমি যখন ওয়াজিরাবাদে পৌঁছলাম তখন সেখানে দেখলাম শুধু শবদেহের মেলা। অনেক দূরে, ধোয়ার এক ঘন আস্তরণ শহরের উপরে ছেয়ে ছিল আর স্টেশনের কাছে শোনা যাচ্ছিল কাঁসর ঘন্টার ধ্বনি, উচ্চকিত হাসির রোল আর মত্ত জনতার উদ্দাম করতালি। এ নিশ্চয়ই বৈশাখী উৎসব। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে জনতার ভিড় প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে এল, একদল উলঙ্গ স্ত্রীলোককে ঘিরে নাচতে-নাচতে ও গান গাইতে গাইতে। হ্যাঁ, তারা সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তাদের মধ্যে ছিল বৃদ্ধা ও তরুণী, ছিল বাচ্চারা, নগ্নতা নিয়ে যাদের কোনো ভয় নেই। ছিলেন দিদিমা ও নাতনি, ছিলেন মায়েরা ও বোনেরা আর মেয়েরা ও স্ত্রীরা, এবং কুমারীরা; এবং ওঁদের চারপাশ ঘিরে ঐ পুরুষেরা নাচছে ও গাইছে। মেয়েরা সব হিন্দু শিখ আর পুরুষেরা মুসলমান এবং তিন সম্প্রদায় মিলেই যেন এক বিচিত্র বৈশাখী উৎসব পালনের জন্য তারা মিলিত হয়েছে। মেয়েরা সোজা হয়ে হেঁটে চলল। তাদের চুল অবিন্যস্ত, শরীর বেইজ্জতে উলঙ্গ, কিন্তু তবুও তারা সোজা হয়ে সগর্বে হেঁটে চলল যেন হাজার শাড়িতে তাদের শরীর জড়ানো, যেন কালো করুণামেদুর মৃত্যুর ঘন ছায়ায় তাদের আত্মা আবৃত। তাদের চোখে নেই কোনো ঘৃণার প্রকাশ। লক্ষ-লক্ষ সীতার অকলঙ্ক অহংকারে তাদের চোখ জ্বলছে।
তাদের চারপাশ ঘিরে ঐ জনতার ঢেউয়ের চিৎকার ধ্বনি, পাকিস্তান জিন্দাবাদ! ইসলাম জিন্দাবাদ!! কয়েদ-ই-আজম মুহম্মদ আলি জিন্না জিন্দাবাদ!!!
নাচ-গানের এই হল্লা ছাপিয়ে বিচিত্র শোভাযাত্রা এখন সরাসরি গাড়ির মধ্যে জড়ো করা ঐ শরণার্থীদের ঠিক চোখের সামনে। মেয়েরা নিচু হয়ে আঁচলে তাদের মুখ লুকাল আর পুরুষেরা গাড়ির জানালা বন্ধ করতে লাগল।
‘জানালা বন্ধ কর না!’ বালুচিরা গর্জে উঠল। টাটকা হাওয়া ঢুকতে দাও।
কিন্তু ওরা গ্রাহ্য করল না। জানালাগুলো ওরা বন্ধ করে চলল।
সৈন্যরা গুলি চালাল। কয়েকজন শরণার্থী মরে পড়ে গেল; অন্যেরা তাদের জায়গা নিল এবং অল্পক্ষণের মধ্যে আর কোনো জানালাই বন্ধ রইল না।