- বইয়ের নামঃ শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প
- লেখকের নামঃ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
শ্রেষ্ঠ উর্দু গল্প
০. ভূমিকা – শহিদুল আলম
ভূমিকা
উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা যার উৎপত্তি গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে–দিল্লির আশপাশে। মোঘল রাজত্বকালেই উর্দুকে একটি পৃথক সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রয়াস লক্ষ করা গিয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে ১৯৪৭-এর দেশভাগের আগ পর্যন্ত উত্তর ভারতের কতিপয় অঞ্চলে উর্দু আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে হিন্দির পাশাপাশি ব্যবহৃত হত। বিভাগের পর উর্দুভাষী এক বিপুল জনগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমায়, থেকেও যায় কিছু ভারতে। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত কলিয়ার’স এনসাইক্লোপেডিয়ার তথ্যানুযায়ী সমগ্র পাকিস্তানে উর্দুভাষী জনসংখ্যা প্রায় তিন লাখের মতো। আর ভারতে রয়েছে প্রায় আড়াই লাখের কাছাকাছি। এই সংখ্যা নিশ্চিত এখন বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের অন্যান্য প্রধান ভাষাগুলোর মধ্যে রয়েছে পাঞ্জাবি বেলুচি, সিন্ধি, পশতু ইত্যাদি।
তাহলে বলা যায়, বাংলাসাহিত্য বলতে যেমন আমাদের মনে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের মিশ্র একটি চেহারা ভেসে ওঠে, উর্দু সাহিত্যের বেলায়ও ঠিক তাই। অর্থাৎ উর্দু ভাষায় শিল্পজ উল্কর্ষ ঘটেছে উভয় অঞ্চল–পাকিস্তান এবং উত্তর ভারতে। যে কারণে এই ভাষার সাহিত্যে আমরা পাই উভয় দেশের রাষ্ট্রীয় সীমারেখাকে উতরানো। বিচিত্র স্থান-কাল-পাত্রের বিচিত্রতর সমাবেশ।
মোটামুটিভাবে উর্দু সাহিত্যে আধুনিকতার উদ্ভব-পর্ব থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত প্রধান লেখক হিসেবে যারা নিজেদের ভাষা-বৃত্ত ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন আমরা তাদেরকেই এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করেছি। নির্বাচিত গল্পগুলোও সিংহভাগ ক্ষেত্রে যাতে লেখকদের প্রতিনিধিত্বকারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের শ্রেষ্ঠ রচনা হয় সেদিকে সম্ভাব্য সতর্ক দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। ফলত এটিকে উর্দু কথাসাহিত্যের একটি প্রামাণ্য বাংলা অনুবাদ সংকলন বললে অত্যুক্তি হবে না। বিব্রতকর ঠেকলেও এ-কথা সত্যি যে ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে যথার্থ অর্থে উর্দু-গদ্য সাহিত্যে কোনো কাজ হয়নি। এর প্রধান উৎকর্ষ ঘটে বিংশ শতাব্দীর জাতীয়তাবাদ, ইসলামি জাগরণ এবং সমাজতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে। এই অনুভূতি ও বোধগুলোই এক পর্যায়ে উর্দু সাহিত্যের প্রগতিশীল আন্দোলনে রূপ নেয়। জনৈক উর্দু সাহিত্য সমালোচকের তথ্যানুযায়ী, এই আন্দোলন সোচ্চার হয়ে ওঠে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে অর্থাৎ যে বছর মুন্সী প্রেমচন্দের মৃত্যু হয় সেই থেকে এবং তুঙ্গে ওঠে ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ অবধি। এই সময় পর্যায়ে উর্দু সাহিত্যজগতে অনেক সমৃদ্ধ উপলব্ধির জন্ম হয়। এরপরে আন্দোলনের রূপ আর প্রকৃতির মধ্যে বিরোধ ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমের দরজা দিয়ে আরো কিছু নতুন উপাদান এসে এখানকার লেখকদের আলোড়িত করে।
এই তথ্য থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে, প্রেমচন্দ উর্দু সাহিত্যের বিরানভূমিতে। একা একা যে স্বর্ণোদ্যান রচনা করেছিলেন (বিশেষ করে উর্দু গল্প ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে), উর্দু সাহিত্যের আধুনিক লেখকরা তাকেই ভিত্তিভূমি ধরে নিয়ে সেখান থেকেই। তাদের যাত্রা শুরু করেছেন। এই ব্যাপারটা আরেকটু বিস্তৃত ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
প্রেমচন্দের নামোল্লেখের আগে-পিছে কিছু বিশেষণ যুক্ত করা হয় কেন? উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকায় মানুষের মাতৃভাষা (হিন্দি) উর্দু। বিশ শতকের গোড়াতেও এই ভাষার সাহিত্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি, গল্প-উপন্যাসের পটভূমিতে যুক্ত হয়নি সমকাল, না-মাটি না-মানুষ কোনো কিছুরই পরিচয় মেলেনি এখানকার সাহিত্যকর্মে। অতীতের অবক্ষয়ী রোমান্টিকতার অলীক অন্ধকারে ডুবে ছিল যেন সবাই, জীবনের সবটুকুকে আড়ালে রেখে এই সমাজের সাহিত্যিক ধারা যেন জীর্ণতায় ধুকপুক করছিল। প্রেমচন্দের আবির্ভাব এরই মধ্যে। বারাণসীর এক অখ্যাত গাঁয়ের নিম্ন-মধ্যবিত্ত কায়স্থ পরিবারে জন্মে, পঁচিশ টাকা বেতনের কেরানির চাকরি করতে করতে প্রেমচন্দ উর্দু সাহিত্যকে আধুনিক সাহিত্যের উপযোগী করে গড়ে তুললেন। সমকালীন মানুষগুলো, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশের আটপৌরে কৃষক উর্দু সাহিত্যে এই প্রথমবারের মতো উঠে এল তাদের ভাবনা-বেদনা, সুখ, ভালোলাগা, মন্দলাগা, দোষ-গুণের সামগ্রিক পরিচয় নিয়ে–জীবনের অনাবিল প্রসন্ন স্রোতধারায় উর্দু সাহিত্যের নবজন্ম ঘটল। কথাটি হিন্দি সাহিত্যের বেলাতেও। প্রযোজ্য; কেননা এই পথিকৃৎ লেখক দুটো ভাষাতেই অবিরল লিখে গেছেন। তাই প্রেমচন্দ আধুনিক উর্দু (সঙ্গে সঙ্গে হিন্দি) সাহিত্যের ‘পিতৃস্থানীয়’। এই কাজগুলো তিনি সম্পাদন করেছিলেন ‘কফন’, ‘সদগতি’, ‘পৌষের রাত’-এর মতো বিস্ময়কর গল্প এবং ‘সেবাসদন’, কিংবা ‘গোদান’-এর মতো কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে। প্রবহমান তরল রোমান্টিক সেন্টিমেন্টের বিপরীতে তিনি রূঢ়, বর্ণহীন, কঠোর সামাজিক জীবনের প্রকৃত রূপকে মুখোমুখি দাঁড় করালেন পাঠকের। সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করলেন মানুষের ওপর এক গভীরতম আস্থা : মানুষ মূলত ভালো, মূলত মহৎ, সে দৃঢ়পণ চেষ্টায় নিজেকে সকল সামাজিক পাপ-পঙ্কিলতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে সার্থক হয়ে উঠতে পারে…।