রাজার ঘুম ভাঙে একটু বেলাবেলি। আজ বহুকাল পর তার ঘুম ভেঙেছে সকাল সকাল। ঘুম ভাঙার পরই রাজার আজ মনে পড়েছে প্রাতঃকালীন পৃথিবী খুব সুন্দর। এই রোদ এই হাওয়া বহুকাল তিনি দেখেননি।
রাজা যখন এসব ভাবছেন ঠিক তখুনি তার জানালায় উড়ে এসে বসে অচেনা সোনালি বর্ণের এক পাখি। ছোট্ট ভারী সুন্দর পাখি। কী যে মিষ্টি সুরে ডেকে যায় পাখিটি। সেই ডাকে রাজার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে। মনে পড়ে বহুকাল রাজ্য চালিয়ে তিনি ক্লান্ত। চারপাশের সুন্দর পৃথিবী কতকাল তার দেখা হয়নি। কতোকাল তিনি ভেতরে ভেতরে উতলা হয়েছিলেন। এরকম একটা পাখির সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা ছিল। রাজ্য চালাতে চালাতে রাজা সব ভুলে গিয়েছিলেন।
রাজা তারপর তাকিয়ে তাকিয়ে পাখিটা দেখেন। ছোট্ট সোনালি বর্ণের পাখি মিষ্টি সুরে ডাকে, ডেকে যায়। সেই ডাকে রাজা ভুলে যান এক্ষুনি তার বিচারকক্ষে যাওয়ার কথা। প্রজারা সব উন্মুখ হয়ে আছে। দর্শনপ্রার্থীরা আছে প্রাসাদের বাইরে। বহু দূরদূরান্ত থেকে আসে লোক। সাহায্য চাইতে, রাজাকে দুচোখ ভরে দেখতে। আজ সকালে রাজার ওসব মনে থাকে না। বিভোর হয়ে তিনি সোনালি বর্ণের সেই পাখির সঙ্গে কথা বলেন, ও পাখি তুই কেমন আছিস, ভালো তো?
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাখিটা হঠাৎ করে উড়াল দেয়। দেখে রাজা পাগলের মতো ছুটে যান জানালায়। কী হল, পাখিটা উড়ে গেল কেন? তা হলে কি আমার রাজ্যে প্রজারা সুখে নেই। পাখিটা আমাকে সেই খবর দিতে এসেছিল?
কথাটা ভেবে রাজা ভেতরে ভেতরে উতলা হয়ে পড়েন। প্রজারা তো কেউ আমাকে কখনো তাদের অভাব অভিযোগের কথা বলেনি। দুঃখকষ্টের কথা বলেনি। আমি আমার কর্তব্যে অবহেলা করেছি। মন্ত্রিপরিষদ আমার চারপাশ ঘিরে রেখেছে। প্রাসাদের বাইরে আমাকে কখনো নিয়ে যায়নি। তাহলে কি ওরা জানে আমার রাজ্যের কোথাও চলছে দুর্দিন, কোথাও খরা, অনাবৃষ্টি! শস্যচারা পুড়ে গেছে! অনাহারে দিন কাটাচ্ছে প্রজারা! আমাকে জানতে দেয়া হয়নি।
এসব ভাবতে ভাবতে রাজা দেখেন ছোট্ট সেই পাখি নগর পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে নদীর দিকে। নদী পেরিয়ে কোন দূরে যাবে পাখি! রাজা মনে মনে বললেন, আমিও যাব, আমিও যাব।
তারপর তিনি হেঁকে উঠেন, কে আছিস?
সেই হাঁক রাজপ্রাসাদের ধ্বনি প্রতিধ্বনি তোলে। সঙ্গে সঙ্গে দোরগোড়ায় কুর্নিশ করে দাঁড়ায় নফর।
রাজা বলেন, আমি একজন নগণ্য রাজকর্মচারীর বেশে রাজ্য দেখতে বেরুব। কেউ আমাকে দেখে যেন বুঝতে না পারে স্বয়ং রাজাই বেরিয়েছেন রাজ্য দেখতে। ব্যবস্থা কর।
জো হুকুম, বলে নফর প্রস্থান করে।
রাজা রাজ্য দেখতে বেরুবেন এ কথা মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় রাজমহলে। খবর পেয়ে ছুটে আসে মন্ত্রিপরিষদ। আসেন রাণী, ছোট রাজকুমার।
মহারাজ। মন্ত্রীরা উন্মুখ হয়ে রাজার মুখপানে তাকায়।
রাজা ততক্ষণে রাজকীয় পোশাক পাল্টে নিয়েছেন। পরিধান করেছেন একজন নগণ্য রাজকর্মচারীর পোশাক। মুখমণ্ডলে জড়িয়ে নিয়েছেন শ্বেতশুভ্র একখণ্ড বস্ত্র। রাজাকে আর রাজা বলে চেনা যায় না।
রাজা বললেন, আপনারাও চলুন। কিন্তু প্রত্যেকেই সাধারণ রাজকর্মচারীর বেশে। আপনাদের দেখে প্রজাকুল যেন বুঝতে না পারে, চিনতে না পারে।
মন্ত্রিপরিষদ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। রাণী বললেন, একি কথা মহারাজ?
রাজার কোনওদিকে খেয়াল নেই। জানালার পথে বাইরের পৃথিবী দেখছিলেন তিনি। গম্ভীর গলায় বললেন, প্রিয়তমা, আমি আর কতকাল অন্ধ হয়ে থাকব?
ছোটকুমার এসে রাজার হাত ধরেন, পিতা আমিও যাব।
রাজা মুখ ঘুরিয়ে পুত্রের দিকে তাকান, দক্ষিণহস্ত রাখেন পুত্রের মাথায়, সে বড় দুঃখের পথ পুত্র, সে বড় দূরের পথ। তোমাকে আমি কোথায় নিয়ে যাব?
বালক কুমার দুহাতে অশ্রুমোচন করে।
প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে রাজা টের পান প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। গ্রামপ্রান্তর থেকে রোদের হলকা আসছে নগরের দিকে। হাওয়ায় বেড়ালের লোমের মতো উষ্ণতা। চারদিকে অচেনা এক রুক্ষতা খানিক হাঁটার পরই টের পেতে থাকেন রাজা। বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কাপে। রাজধানীর ভেতরেই কোথায় যেন সংগোপনে ঘটছে এক ধরনের হাহাকার। মানুষ কাঁদছে।
রাজা কোনো বাহন নেননি। মন্ত্রিপরিষদ চলেছে তার সঙ্গে। প্রত্যেকেরই খুব সাধারণ বেশ। নগণ্য রাজকর্মচারী বৈ আর কিছুই মনে হয় না তাদের। মুখমণ্ডলে প্রত্যেকেরই ফিনফিনে শ্বেতশুভ্র বসন। রাজা ছাড়া অন্য সবাই কিঞ্চিৎ বিরক্ত। পায়ে হাঁটার অভ্যেস নেই কারও। চলাচলের জন্য রয়েছে বাহন। অশ্ব। কিছুই সঙ্গে নেননি রাজা। পায়ে হেঁটে রাজ্য দেখবেন।
নগরের মাঝামাঝি এসে রাজা দেখেন পথের দুপাশে সার বেঁধে বসে আছে ভিখারি। পুরুষ রমণী বালক বৃদ্ধা। পাংশুটে অনাহার চেহারা। কতোকাল পেটপুরে খাওয়া হয়নি। তাদের। দেখে রাজার বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। আমার রাজ্যে লোকে ভিক্ষে করছে, অনাহারে আছে। আর আমি প্রাসাদে বসে রাজকীয় খাবার গ্রহণ করছি। এ দৃশ্য দেখার আগে আমার মৃত্যু হয়নি কেন?
মন্ত্রিপরিষদের দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, আমার রাজ্যে প্রজারা ভিক্ষে করছে, অনাহারে আছে, একথা আমাকে জানানো হয়নি কেন?
মন্ত্রিপরিষদ পরস্পর পরস্পরের মুখপানে তাকায়। তারপর প্রধান ব্যক্তিটি বলে, মহারাজ এরা অন্য রাজ্যের লোক। সেখানে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। খাদ্যের আশায় এরা আমাদের। রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে।