কালাকেষ্টার জীবন বেত্তান্ত

ঘোড়াটা হেলেদুলে হাঁটছে। তার পিঠে ছালার গদির ওপর একদিকেই দুপা ঝুলিয়ে বসেছে কালাকেষ্টা। বসে আরামসে বিড়ি টানছে। আজ ম্যালা খাটনি গেছে। বিয়ান রাতে ওঠে ঘোড়া নিয়ে বেরিয়েছে। গেছে পাঁচ মাইল দূরে, দিঘলীর হাটে। এখন ধান মৌসুম। পৌষের মাঝামাঝি সময়। হাটে হাটে খেপ দিয়ে বেড়ায় কালাকেষ্টা। ঘোড়ার পিঠে মহাজনের ধান সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি টেনে তবে খালাস। আজ টেনেছে জলিল ভেণ্ডারের ধান। দিঘলীর খালে কাল রাতে গিয়ে লেগেছে ভেণ্ডারের নাও দুখান। আজ বিয়ান রাতে ওঠে ঘোড়া নিয়ে সোজা দিঘলীর গেছে কালাকেষ্টা। কাল সন্ধ্যায় ভেণ্ডারের ভাইগ্না দুলাল মিয়ার সঙ্গে দেখা। বলল, কেষ্টা, মামায় কইছে কাইল সারাদিন দিঘলীর আডে থাকতে। নাও থিকা ধান টাইন্না দিবি।

কেষ্টা তো রাজিই। এটা হচ্ছে গিয়ে কাজের সময়। এখন কাজ কাম না করলে সারা বচ্ছর খাইব কী কেষ্টা! ঘোড়ারে খাওয়াইব কী!

দুলাল মিয়ার কাছ থেকে একটা বিড়ি চেয়ে খেয়েছে কেষ্টা। দুলাল মিয়া গ্রামের মাতব্বর গোছের পোলা। বয়স অল্প। হলে হবে কী, লোকে বড় মান্যিগণ্যি করে তাকে। দুলালরে খেপাইলে রক্ষা নাই। জান কবজ কইরা ফালাইব। রাইতে গিয়া বসতভিটায় আগুন দিব। গরু কোরবানি দেওয়ার চকচকে লম্বা ছুরি হাতে গিয়া খাড়াইব একলাই।

সাহস বটে মানুষটার। পেট ভরা কলিজাখান। গেলবার নয়াকান্দার ওফা মোল্লার ডাগর ডোগর মাইয়াখান তুইল্লা নিয়া গেল রাইতে। পিরীতিটিরীতি আছিল না। তাতে কী। দুলাল মিয়ার চোখে লাগছে। সারাদিন ঘুরঘুর করত মোল্লাবাড়ির চারদিকে। মাইয়াখান বড় সুন্দর মোল্লার। বড় সোন্দর শরীলটা, য্যান নতুন জোয়াইরা পানি, টলমল করে। চোখ দুইখান শাপলা ফুলের মতন। মুখখান নতুন বরজের পানপাতা। দুলাল মিয়ার চোখে লাগছিল।

মোল্লা বাড়ির লগেই নিখিল সার বাড়ি। নিখিল সা হিন্দুস্তান চইলা গেছে রায়টের সময়। বাড়িখান এখন ছাড়া। দুলাল মিয়ারা দখল নিছে। একখান ভাংগাচুরা দালান আছে বাড়িটায়, আর দেদার গাছপালা। দুলালমিয়া সারাদিন বইসা থাকত হেই বাড়িতে। মোল্লার মাইয়া ঘাটে আইলে আওয়াজ দিত। সতী মাইয়া। ভয়ে ভয়ে বাপের কাছে কইয়া দিল। মোল্লা নালিশ জানাইল ভেণ্ডারের কাছে। আহা কী কামডা করল মোল্লায়। দুলাল মিয়ারে ঘাটাইল। বুঝল না, দুলাল মিয়ার চোখ পড়ছে। এই চোখ ফিরব না।

নালিশ শুইনা ভেণ্ডারে তো ভাইগ্নারে বকল। দুলাল মিয়ার গেল মাথায় রক্ত উইঠা। গরু কোরবানি দেওনের ছুরি লইয়া রাইতে গিয়া খাড়াইল মোল্লার ঘরের সামনে। একলা মাইয়াডারে তুইল্লা আনল। এখন সেই মাইয়া দুলাল মিয়ার ঘর করে।

বিড়ি টানতে টানতে কেষ্টা গতকাল সাহস করে দুলাল মিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল, বিবির খবর কী মিয়া? ভালো নি?

দুলাল মিয়া বলল, পোলা অইব।

অ্যাঁ!

হ। সাত মাস চলছে।

শুনে দাঁত কেলিয়ে হেসেছে কেষ্টা। দুলাল মিয়া টানতে টানতে এক হাতে বাবুর হাটের লুঙ্গি বাঁ হাটুর ওপর তুলে কালির খিলের বিশাল মাঠ ভেঙে মিলিয়ে গিয়েছিল।

কেষ্টার তখন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল। বয়স হইল দুই কুড়ির ওপর। এখনও ঘর হইল না কেষ্টার, সংসার হইল না। হইব হইব কইরা ভাইংগা গেল।

তারপর বৈচির কথা মনে পড়েছে কেষ্টার। কানা বেলদারের মাইয়া। বেলদার পাড়ার। সর্দার আছিল কানা। বাঁও চক্ষুটা নাই কানার। পদ্মার চর দখল লইতে গিয়া খোয়াইছিল। ডাকাইত একখান। বুড়া বয়সেও তাগদ কী শইল্লে! মাথায় গোল টুপি। লাগাইয়া কানা এখন হাটেবাজারে যায়। কেষ্টার লগে দেখাসাক্ষাৎ হয়। মানুষটারে দেখলে শইলটা কাপে কেষ্টার। বুকের মইধ্যে বাজাইরা খোদাই ষাড় গোঁত্তা দিয়া ওঠে। হইলে অইব কী, মাইনষেরে কিছু কইতে পারে না কেষ্টা। মনের রাগটা মনেই রাখে। জগৎসংসারে একলা মনুষ কেষ্টা। ভাইবেরাদর কেউ নেই। মাইনষের লগে শত্রুতা কইরা ফায়দা কী কেষ্টার! রাইতের আন্ধারে আইসা কেষ্টার কল্লা কাইট্টা থুইয়া গেলে দেখব কেডা! কেষ্টারে বাঁচাইব কেডা!

কানা বেলদার সর্দার মানুষ। ম্যালা জোতজমিনের মালিক। সাতখান আছে কেরাইয়া নাও। এক কুড়ির ওপরে ঘোড়া। খরালিকালে ঘোড়ার কারবার একচেটিয়া কানার। বাইষ্যাকালে কেরাইয়া নাওয়ের কারবার। নাইওর আনে, নাইওর নেয়। পয়সা, খালি পয়সা। কয় বচ্ছর আগে সাতঘইরার গাঙ্গে চর জাগল। কানা বেলদার লাইঠাল লইয়া হেই চরের দখল লইল। বেলদার পাড়াটা তারবাদে উইঠা গেল সাতঘইরার হেই চরে। বেলদাররা এখন কানার পোরজা। কানা হইল চরের মালিক। রাজা মানুষ।

পাড়ার বেবাক বেলদাররা ঐ কানার কথায় পুরানা পাড়া ছাইড়া সাতঘইরার চরে চইলা গেছে। যায় নাই কেবল কেষ্টা। কানা কইছিল, আইয়া পর কেষ্টা। কালীর খিলে বেলদাররা কেওই নাই, তুই একলা পইড়া থাকবি কেন? আয়, আমি তরে জমিন দিমু। বিয়া করাইয়া দিমু। বউবেটি লইয়া সুখে-শান্তিতে থাকবি।

কেষ্টা গেল না। বাপের ভিটা ছাইড়া যাইতে কষ্ট হয়।

ভিটা বলতে ভিটা। দশ কদম মতো জায়গা। একখান খাজুর আর কয়খান বিচ্চাকেলার গাছ। মধ্যিখানে একখান ছাপড়া ঘর। একখান ঘোড়া আর কেষ্টা। এই তো সংসার। হইলে হইব কী, কেষ্টা এসব ছাড়তে রাজি না। তাছাড়া কেষ্টার মনে ভেতর লুকিয়ে। আছে আর এক দুঃখ। কানা বেলদারের ওপর আছে বিশাল এক ক্রোধ। কেষ্টার সেই দুঃখটা বৈচি। কানা বেলদারের মাইয়া।

কানা বেলদারের নাম আছিল রহমত। রহমত বেলদার চর দখল লইতে যাইয়া সরকির পার খাইল চোক্ষে। চক্ষু একখান গেল। সেই থেকে নাম পড়ল কানা বেলদার। দিনে দিনে রহমতের নাম ভুইলা গেল মাইনষে। রহমত বেলদার হইল কানা বেলদার।

কেষ্টা ভোলে নাই। কেষ্টা কিচ্ছু ভোলে নাই। কেষ্টার মনে আছে সব। রহমত বেলদারের কথা, বৈচির কথা।

মনটা বড় নরম আছিল বৈচির। কথায় কথায় কানত। রহমত বেলদারের ঘরে অমুন। মাইয়া! চিনতা করণ যায় না।

ভাবলে কেষ্টার বড় অবাক লাগে। কানা বেলদারের মতন অমুন একখান জালেমের ঘরে বৈচির লাহান মুলাম, চরের নতুন মাটির লাহান মাইয়াখান হইল কেমনে! বৈচি কি হাচাই কানার মাইয়া আছিল না অন্য কেওইর?

কেষ্টা ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। মাথার মইধ্যে পদ্মার পানি ঢুইকা যায়। ঘোলা হইয়া যায় চিন্তাভাবনা।

মাওয়ার বাজারের কাছে আসতে সাঁঝ বইসা যায়। কেষ্টার খুব খিদে পেয়েছে। দুপুরবেলা দুমঠো চিড়া আর দিঘলীর খালের পানি খাইছে। পেটে থাকে কতক্ষণ। খিদের চোটে কেষ্টার এখন শীত করছে। পৌষের মাঝামাঝি সময়। শীতকাল। শীত তো করবই। কিন্তু কেষ্টার শীতগরম নাই। দিব্বি খালি গায়ে থাকতে পারে কেষ্টা। খরালিকালেও মোটা একখানা কোট গায়ে দিয়ে ঘুইরা বেড়ায়। পেট ভরা থাকলে শীত গরম নাই কেষ্টার। এখন শীতটা করছে খিদের ঠেলায়।

ঘোড়ার পাছায় সিটকির বাড়ি মারে কেষ্টা। আট বেডা হালা, পাও চালাইয়া আট। তাড়াতাড়ি বাইতে গেলে দুইজনেই খাওন।

ঘোড়াটা বুইড়া হইয়া গেছে। মায় মইরা যাওনের লগে লগে বাজানের আমলের ঘোড়া দুইখানও গেল। ঘোড়ার ব্যারাম অইছিল হেইবার। বেলদার পাড়ার বারো আনি ঘোড়া মরল ব্যারামে। কেষ্টার দুইখানও। কেষ্টা তহন পথের ফকির। ভাতপানি জোটে না। বাইষ্যাকাল। কেরাই নাও বাইব, পাইব কই? কেষ্টারে নাও দিব কেডা? ঘরের লগে, ছাইছের দিকে চাইর গণ্ডা জমিন আছিল। হেই জমিন বেচল ওফাজদ্দির কাছে। বাপের কাইল্লা জমিন কেষ্টার। হেই জমিনে ওফাজদ্দি অহন মুলা ক্ষেতি করে। বাগুন ক্ষেতি করে। গোপনে কেষ্টার সালুনের কামডা চইলা যায়।

ওফাজদ্দি যে টের পায় না তা নয়। কিছু যে কয় না তা নয়। হাসতে হাসতে কয়। কম কম খাইছ কেষ্টা। আমারেও দুই চাইর ওরা নিতে দিছ। এতডি দিয়া কিনলাম জাগাড়া। হাচাই। কম টেকা দেয় নাই ওফাজদ্দি।

বাইষ্যা কালডা পুরা বইসা খাইল কেষ্টা। আগন মাসে কিনল ঘোড়াখান। এখন দিন যায় ভালোয় ভালোয়। মৌসুমে নগদ পয়সা-কড়ি কিছু জমে। খরালিকালটা কাটে ভালো। ধানের মৌসুম শেষ হইলেও দুই একখান খেপ পাওয়া যায়। খরালিকালে ঘোড়াটার খাইখরচাও কম। ঘাসবিচালি লাগে না। যেদিন আজাইর থাকে ঘাসি জমিনে গোছর দিয়া রাখলেই হয়। তয় ঘোড়ার আসল খাওন হয় রাইতে। ছাইড়া দিলে দূরে বিলে চইলা যায়। রাইত ভর চইরা বিয়ানে ফিরা আসে। তারপর সারাদিন খাটাও কত খাটাইবা। বোজা বাওয়াও কত বাওয়াইবা।

তয় মইধ্যে কয়দিন ঝামেলা হইছে। মেদিনী মণ্ডলের পোলাপানরা রাইতে ঘোড়া ধরতে যাইত বিলে। একখান কায়দা কইরা ধরতে পারলেই হইছে। সারা রাইত ছয় সাতজনে মিল্লা হেই ঘোড়া দৌড়াইত। বিয়ানে ছাইড়া দিয়া বাইত যাইত। কেষ্টার ঘোড়াডারে ধরছিল একদিন। হায় হায়রে! পুরাডা দিন বোজা টানছে ঘোড়াডা। রাইতে ছাইড়া দিছিল কেষ্টা। হেইডারে রাইতভর দৌড়াইল। কয়জনে দৌড়াইছে কে জানে! বিয়ানে ঘোড়াডা মরো মরো। সারাটা দিন আর কামে গেল না কেষ্টা। ঘোড়াডারে সেবা করল। ঘোড়াডার লেইগা বড় কষ্ট পাইছিল কেষ্টা সেদিন। বৈচির কথা মনে পড়েছিল। সারাদিন আনচান করেছে বুকটা।

যে কোনও কারণে দুঃখ পাইলেই বৈচির কথা মনে পড়ে কেষ্টার। মানুষ আছিল একখান। বৈচি। মনখান চরের নতুন মাটির লাহান। ইট্টু কিছু অইলেই কানত। বড় মায়া করত কেষ্টারে। বড় মহব্বত করত। কেন যে তার জইন্যে এত টান আছিল মাইয়াডার, বুঝতে পারে না কেষ্টা। মাতায় বুদ্দিসুদ্দি ইট্টু কম কেষ্টার। মায় কইত, কেষ্টা আমার বলদা পোলা। কেষ্টারে বড় চোখে চোখে রাখত মায়। আগলে আগলে রাখত। দুদিকে বিশাল ডানা ছড়িয়ে বুড়ো শকুন যেমন ছানাদের আগলায় তেমন করে কেষ্টাকে আগলে রাখত তার মা।

মায় মইরা যাওনের পর আছিল বৈচি। চোক্ষে চোক্ষে রাখত কেষ্টারে। আগলে আগলে রাখত। হেই বৈচির গেল বিয়া অইয়া। তারপর থেকে কেষ্টার কাছে মাইয়া দিবে কে। বিবিরে খাওয়াইব কী কেষ্টা! খরালিকালটা ভালো যায়। বাইষ্যাকালে অনটন। এক ওক্ত খাওন, তিন ওক্ত উপোস। পয়সাকড়ি যা থাকে ঘোড়ার খাওন জোটাইতে খরচ হইয়া যায়। নিজে না খাইয়া মরুক, ঘোরাডারে মারলে চলব কেমনে! দিনে দিনে বিয়ার বয়স পার হইয়া গেল কেষ্টার। বাজারের কাছে আসতে আসতে কেষ্টার আর একবার বৈচির কথা মনে পড়ে। বুকের মইধ্যে আনচান করে ওঠে। একটা ডাউক বুকের মইধ্যে বইসা দুই তিনবার ডাক দেয়। বুক কাঁপাইয়া দীর্ঘশ্বাস পড়ে কেষ্টার। বৈচিরে বিয়া করতে পারলে জীবনডা ধানের মৌসুম অইয়া যাইত। হায়রে পোড়া কপাল, বৈচির জন্যে ধানের মৌসুম হল না জীবন।

বাজারটা পেরিয়ে যেতে কেষ্টার মনে পড়ে বিড়ি নাই। একখান ম্যাচও লাগব। বাইত গিয়া অহনেই আবার রানতে বইব কেষ্টা। এক থাল ভাত আর কাঁচা মুলা। ওফাজদ্দির ক্ষেত থিকা তুইলা আনলে অইব। খাইয়াদাইয়া ঘুম। কাইল গোয়ালীমান্দ্রা যাইতে অইব। ভেণ্ডারে কইছে কলে ধান ভাঙ্গাইব। টানো হারাদিন।

ঘোড়ার পাছায় ছিটকি মাইরা বাজারের দিকে যায় কেষ্টা। একখান আণ্ডাও কিন্না লইব। ভাতের লগে সিদ্ধ করলে খাইতে আরাম হইব।

বাজারের মুখেই করিমের ডাক্তারখানা। ভদ্রলোকের বাড়ির বাংলাঘরের লাহান ডাক্তারখানাডা। চৌচালা পাটাতন ঘর। ঢেউ টিনের বেড়া দেওয়া। ডাক্তারখানা বন্ধ কইরা করিম বিয়ালে বাড়িত চইলা গেছে। বাড়ি হইল দোগাছি। বিয়ানে আইসা আবার দোকান খুলবে। চুরিডাকাতির ডর নাই। চকিদার হারা রাইত পাহারা দেয় বাজার। আর চুরিডাকাতি আইজকাল হয়ও না। কাউল্লা চোরা মইরা যাওনের পর থিকা দেশগেরাম ঠাণ্ডা। চোরডাকাইত নাই।

তয় চোর আছিল একখান কাউল্লা। পুলিশের লগে দুস্তি আছিল তার। হেগ কাছ থনে বিড়ি চাইয়া খাইত। পিডে রুলের পয়লা বাড়ি পড়লে বিসমিল্লা কইত।

হেই কাউল্লারে মারল দশ গেরামের পোলাপানে। তখন জয় বাংলার দিন। চক্ষু বাইন্দা কালীর খিলের মাঠ দিয়া কাউল্লারে আড়াইয়া নিল দুলাল মিয়ার দল। দুইফর বেলা। লইয়া গেল গাংপার। তারবাদে ছুরি দিয়া পাড়াইয়া পাড়াইয়া মারল। চক্ষু দুইখান উড়াইয়া চিলেরে খাওয়াইল। তারবাদে লাশখান দিল পদ্মার পানিতে ভাসাইয়া। দেশগেরাম ঠাণ্ডা। অহন আর চুরিডাকাতি নাই। দুয়ার খুইলা সুখে নিদ্রা যায় দেশ গেরামের মাইনষে।

কাউল্লা চোরার কথা চিন্তা করতে করতে বাজারের মইধ্যে দিয়া ঘোড়া খানরে হাঁটায় কেষ্টা। সাঝ রাইতেই নিটাল হইয়া গেছে বাজারটা। পৌষ মাইসা শীত। মাইনষে খাইয়ালইয়া কাথার নিচে ঢুইকা গেছে। দোকানিরা দোকানপাট বন্ধ কইরা হুইয়া পড়ছে। খালি মাছ বাজারের চালাখানের পুব ধারে রমেশের মনোহারি দোকানটা খোলা। মাথার ওপর হারিকেন লটকাইয়া ছিটকি ঝোপের লাহান বইসা রইছে রমেশ। গায়ে পুরান একখান চাইদ্দর। বইসা বইসা বিড়ি টানতাছে। আর দোকানের সামনে মাটিতে জুবুথুবু হইয়া বইসা রইছে মুচিপাড়ার নেপলা।

জয় বাংলার কালে মেলিটারিরা মুচিপাড়ায় আগুন দিছিল। নেপলার গুষ্টি-গেয়াতি খতম। পাঁচ ছয় বছরের নেপলা বাইচ্চা গেল। অহনে বাজারে থাকে। ভিক মাইগা খায়। দোকানিগো ফুটফরমাইশ খাটে। ভাও বুইজ্জা চুরি চামারি করে। দিন চইল্লা যায়।

ঘোড়াখানরে মাছচালার মইধ্যে খাড়া করাইয়া লাফাইয়া নামে কেষ্টা। শীতে হি হি করতে করতে রমেশের দোকানের সামনে গিয়া খাড়ায়। এক পেক বিড়ি দেও দাদা, এককান মেচ আর একখান আসের আণ্ডা। রমেশ বুইড়া হইয়া গেছে। চিনতে পারে না, কেডা? গলা লম্বা কইরা জিগায়, কেডারে?

নেপলা কয়, কেষ্টা দাদায়।

রমেশ বলল, এত রাইতে কই থিকা আইলি কেষ্টা?

কেষ্টা হি হি করতে করতে কয়, দিগলি গেছিলাম। ভেণ্ডারের ধান টানছি।

রমেশ হারিকেনের আলোয় আস্তে আস্তে সদাই দেয়। খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া পয়সার হিসাব করে।

কেষ্টা জিগায়, বেচাকিনা কেমুন দাদা?

রমেশ কথা কওনের আগেই আগ বাড়াইয়া কথা কয় নেপলা, ভালোই।

শুনে শিয়ালের লাহান খেকায় রমেশ, তুই কতা কইছ না মুচির পো। যা অহনে।

কই যামু। আমার গুম আইতাছে।

যেহেনে ইচ্ছা যা। আমার ঘরে থাকতে পারবি না।

তয় থাকুম কই?

হেইডা আমি জানি? আমি তর কেরে?

গামছায় সদাই বানতে বানতে কেষ্টা কয়, কিরে নেপলা থাকনের জাগা নাই?

না দাদা।

ল আমার লগে।

লন।

নেপলা ভাউয়া ব্যাঙের লাহান একখান লাফ দেয়। আপনের ঘোড়াখান কো?

আছে। ল।

ঘোড়াখান খাড়াইয়া আছিল আন্ধারে। সামনে গিয়ে নেপলারে পয়লা ঘোড়ার পিঠে বসায় কেষ্টা। তার বাদে নিজে ওঠে। আন্ধার ভাইংগা হাঁটে ঘোড়াখান। পুব আসমানে ক্ষয়া চান্দখান উইঠা আসে তখনই।

.

বাড়িত আইয়া ঘোড়াখানরে ছাইড়া দেয় কেষ্টা। যা, খাইয়া আয়। ঘোড়াখান কেষ্টার সব কথা বোঝে। ছাইড়া দিতেই বিলের দিকে চইলা যায়। চিহি শব্দে আল্লাদের একখান ডাক দেয়। শুইনা নেপলা বড় খুশি। কেষ্টারে কয়, তোমার ঘোড়াডা বড় ভালা দাদা।

কেষ্টা ঘরের ঝাঁপ খোলে। কয়, হরে বড় ভালা ঘোড়াখান। আমারে বাচাইয়া রাখছে। ঘোড়াডা না থাকলে কবে না খাইয়া মইরা যাইতাম আমি।

নেপলা আর কোনও কথা কয় না। লম্বা কোটের জেবে দুই হাত ভইরা বাড়ির মইদ্দে চক্কর খায়।

কেষ্টা এখন ঘরের ভেতর। চাউল বাইর করতাছে। রানতে বইব। উঠানের কোণায় একখান চুলা। কয় থাবা নাড়া পইড়া রইছে। কেষ্টা মাইট্টা পাইল্লায় চাউল লইয়া বাইর অয়। মেচখান দেয় নেপলারে। চুলায় আগুন দে নেপলা। ভাত রান্দি, খাইছনে।

শুনে নেপলা বেজায় খুশি। চুলার ভেতরে নাড়া ভইরা ম্যাচ জ্বালায়। কেষ্টা যায় খালের দিকে। চাইল ধুইবে।

ওস পইড়া নাড়াগুলি বেবাক ওদাইয়া রইছে। ফুঁ দিয়া আগুন জ্বালায় নেপলা। তার বাদে চুলার ওপরে নিজের হাত দুইখান ছেকে। বেজায় আরাম লাগতাছে। রাইতখান বড় ভালা কাটব আইজ। খালপাড় থিকা উইঠা আসতে আসতে কেষ্টা যায় ওফাজউদ্দির মুলা ক্ষেতে। দুই তিনখান মুলা উঠাইব। গরম গরম ভাতের লগে কচচাইন্না মুলা, বড় স্বাদের। রসে মুখ ভইরা যায়।

মুলা ক্ষেতের কাছে শিয়ালের আওয়াজ পাওয়া যায়। শিয়ালের আওয়াজ পাইয়া কেষ্টা দুবার হুরো দেয়। তার বাদে নিজের কামে যায়।

ফিরা দেখে চুলায় আগুন জ্বালাইছে নেপলা। দেইখা কেষ্টা বড় খুশি। কামের আছে ছেমড়াডা। মাইট্টা হাড়িখান চুলায় দেয় কেষ্টা। তার বাদে নাড়ার ওপরে বইসা নতুন প্যাক খুইলা একখান বিড়ি ধরায়। নেপলা তখন কাঁচা মুলা খাইতাছে। কচকচাইয়া মুলা খায় আর হাসে। বড় স্বাদের মুলা কেষ্টা দাদা। খাইয়া দেহ।

কেষ্টা বিড়ি টানতে টানতে কয়, তুই খা। আমি নিত্যি খাই।

নেপলা মুলা খায়, আর কথা কয়। তুমি একখান বিয়া কর কেষ্টা দাদা।

শুনে কেষ্টা একটা নিয়াস ছাড়ে। না বাই, বিয়া আমি করুম না।

ক্যা?

আমারে মাইয়া দিব কেডা?

ক্যা, বেলদারগ মাইয়া নাই?

আছিল একখান। কানা বেলদারের মাইয়া। বৈচি। বিয়া অইয়া গেছে এক যুগ, বারো বচ্ছর।

হের লগে বিয়া অওনের কতা আছিল নি তোমার?

হ।

অইল না ক্যা?

কথা কইতে বড় আমুদ পায় নেপলা। মুলা খাইতে খাইতে খুঁটাইয়া খুঁটাইয়া কেষ্টারে বৈচির কথা জিগায়। পাইলায় ভাত ফুটতাছে। আসমান থিকা পৌষ মাইসা শীত নামতাছে। চানখানও ওঠছে আইজ। ফটফইটা চান্নি। খুয়াও পড়ছে। হইলে হইব কী, চান্নিতে দুনিয়া ভাইসা যাইতাছে। খুয়া দেহা যায় না। কেষ্টার খাজুর গাছটায় একখান বাদুড় বহে। আবার উড়াল দেয়। এই সব দেইখা কেষ্টার নিজের জীবনডার কথা মনে অয়। বুকটা আনচান করে।

বৈচির বিয়া অইয়া যাওনের পর থিকা কেষ্টার আর আপন কেওই নাই। ভাই বেরাদর কেওই না। অনেককাল বাদে নেপলারে পাইল আইজ।

বড় আপন লাগে নেপলারে। কত কথা যে কইতে ইচ্ছা করে।

মুলা খাওন শেষ কইরা বিড়ি চায় নেপলা। একখান দেও কেষ্টা দাদা।

নেপলার বিড়ি খাওয়া দেখতে পারে না কেষ্টা। পোলাপান মাইনষে বিড়ি খাইব ক্যা! কিন্তু অহন আর ঐসব মনে হইতাছে না। চাইতেই পেক খুইলা একখান বিড়ি দিল নেপলারে।

বিড়ি পেয়ে নেপলা বড় খুশি। একখান পুরা বিড়ি। নেপলা আমোদে বাঁচে না। চুলার ভিতরে মুখ দিয়া বিড়ি জ্বালায়। টানতে টানতে কয়, কও কেষ্টা দাদা, তোমার বিয়ার কথা কও। কানা বেলদারের মাইয়ার কথা কও।

কেষ্টা আবার একটা নিয়াস ছাড়ে। আর একখান বিড়ি জ্বালায়। তারপর দুঃখী গলায়। কয়, বৈচি আমারে ভাত রাইন্দা খাওয়াইত। কইত আমার লেইগা বড় মায়া লাগে। পালাইয়া পালাইয়া আইত আমার কাছে। আমি কত বকছি বৈচিরে। কত কান্দান কান্দাইছি। হইলে হইব কী, ফাঁক পাইলেই আমার কাছে আইত বৈচি। আমার লেইগা বড় মায়া আছিল মাইয়াডার। কানা বেলদার অর বিয়া ঠিক করল। রাইতে বৈচি পালাইয়া আইল আমার কাছে। কয়, লও আমরা মাতবরের চরে পলাইয়া যাই। গিয়া বিয়াশাদি করি। ঘর বান্দি। আমার সাওস অইল না। কইলাম তর বাপের কাছে আমি যামু। কমু, বৈচিরে আমার লগে বিয়া দিতে অইব। বৈচি কইল, বাজানে তোমার কথা হুনব না। আমি কইলাম, হুনব। গেলাম কানার কাছে। কানা আমারে বাঁশ লইয়া আইল পিডাইতে। বৈচিরে রাখল পাহারায়। তিন দিনের দিন বৈচির বিয়া অইয়া গেল। আমার লগে আর দেহা অইল না। বারো বছর কাইটা গেল। অহন ভিন গায়ে থাকে। পোলাপানের মা অইছে। আমার কথা আর মনে নাই বৈচির।

এই অবদি কইয়া কেষ্টার গলা ভাইঙ্গা আসে। মুখ নিচা কইরা বইসা থাকে কেষ্টা। তার বাদে হাউমাউ কইরা কাইন্দা ওঠে। নেপলারে দুইন্নাইতে আমার কেওই নাই। বাপ আছিল, বাপ গেল। মায় আছিল, মায় গেল। তারবাদে এক বৈচি আছিল বৈচিও গেল। আমি বড় একলারে, এত বড় দুইন্নাইতে আমি বড় একলা।

কিরমান ডাকাতের প্রথম ও দ্বিতীয় জীবন

সড়কে ওঠে জগু বলল, একখান বিড়ি দেও গুরু।

কিরমান তার খোঁড়া পাটা টেনে হাঁটছিলো। বয়েস হল তিন কুড়ির ওপর। গতরে আগের তাকত নেই। কামকাজ ছেড়ে দিয়েছে মেলা দিন। তবুও চারপাঁচ দিন ধরে জগুর ঘ্যানঘ্যানানি, খোঁচাখুচি তাকে আজ বাড়ি থেকে বের করেছে।

কাল সন্ধ্যায় জগু এসে বলল, কাইলই তো আডের দিন। যুদি যাইতে চাও তাহলে আমারে কইয়া দেও। তুমি গেলে যাইবা নইলে সাফ কথা কইয়া দিবা। আমি পুব পাড়ার আমিনদ্দিরে লইয়া যামু।

শুনে কিরমান উদাস গলায় বলেছিল, হ, হেইডাই কর জউগ্যা। আমার ম্যালা বয়স অইছে। তগ লাহান জুয়ানকি নাই শইল্লে। কাম কাইজ ছাইড়া দিছি। আমারে লইয়া গেলে তর সুবিদা অইব না।

জগু বলল, সুবিদা অসুবিদার কিছু নাই। তুমার কোনও কাম করন লাগব না। তুমি খালি আমার লগে লগে থাকবা। তুমার যা একখান চেহারা, হেইডা দেকলে মানুষে বাবাগো কইরা চিইক্কাইর দিব। তুমার চাওনও লাগব না, লগে যা আছে বাজান কইয়া দিয়া দিব। লুঙ্গির কোচড় থেকে বিড়ি বের করেছিল কিরমান। তারপর ধরিয়ে প্রথম টানের সঙ্গে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। চেহারাখান কি আর এই রকম বদখত আছিল রে! তুই তো পোলাপান মানুষ! বয়েসকালের চেহারাখান দেহচ নাই আমার। রাজা বাদশার লাহান চেহারা আছিল। শইলের রংখান আছিল কালাই। তয় চেহারাখান আছিল! মাইয়া মাইনষে একপলক দেইক্কাই মইজ্জা যাইত। তর ভাউজরে আনছিলাম ডাকাতি কইরা। নশংকরের মাইয়া। আমার দলে তখন সতরজন মানুষ। তর ভাউজ আছিল বহুৎ বড় গেরস্ত ঘরের মাইয়া। বচ্ছরেরডা খাইয়া থুইয়া হাজার দুই হাজার মোণ ধান বেচত। পাট কাউন বেচত হের বাপচাচারা। দিঘিরপাড়ের আডে একবার আষ্টশ মোন ধান বেচছে হেরা। আমার কাছে খবর আইল বিয়ালে। বাইট্টা জহা আছিল আমার খবরদার। জহারে তুই দেহচ নাই। কলেরা অইয়া মরছে হালায়। তয় জহার কাছে খবর পাইয়াই বেবাকতেরে ডাইকা আনাইলাম। নগদ টেকা আছে নশংকরের গেরস্তবাড়ি। ল যাই। গেলাম। বুজলী। সতরজনে মিল্লা গেলাম। পরনে লুঙ্গি। খালি শইল্লে চপচপা কইরা কইরা তেল মাখাইলাম। জাইপটা যুদি কেউ ধইরা হালায় পিচলাইয়া যাওন যাইব। লুঙ্গির উপরে মাজায় লাল একখান কইরা গামছা গিট্ট দিয়া বান্দা। মুখে বান্দা কালো একখান কইরা কাঁপোড়। হাজার চাইয়া দেখলেও চিনোন যাইব না।

ডাকাতি তো করলাম। বাড়ির বেবাক মরদরে চৌচালা ঘরের খামের লগে বাইন্দা, কাডের সিদুক ভাইঙ্গা টেকা-পয়সা লইলাম। মাইয়ামানুষের গতর থিকা খুইল্লা লইলাম সোনার চুরি হার অনন্ত দুল বেবাক। একটা যুবতি মাইয়া আছিল বাইত। গলায় হার, কানে দুল, বাজুতে কঙ্কন। না চাইতে বেবাক খুল্লা দিল। মাইয়াখান এত সোন্দর, দেইক্কা আমার চোক্কে পলক পড়ে না। চাইয়া থাকতে থাকতে দেহি, হের মাজায় মোড়া একখান বিছা। দশ বার ভরির কম সোনা অইব না। দেইক্কা মাইয়াডার চেহারাসুরৎ ভুইল্লা আমি হের মাজায় আত দিতে গেছি, ফাল দিয়া উটল। খবরদার শইল্লে আত। দিবা না। হুইন্না আমি টাসকা লাইগা গেলাম। অই ছেমড়ি কচ কী! আ! শইল খান কি সোনা দিয়া বানদাইছ? আইচ্ছা আত দিমু না। বিছাখান দিয়া দে।

হেয় কয় কী, না দিমু না। কাইটা হালাইলেও দিমু না। এইডা আমার মার মরণের সুময় আমারে দিয়া গেছে। নিতে অইলে আমারে মাইরা হের বাদে নেও।

হুইন্না আমার মাথাডা দুইখান পাক খাইল। কুন কথা না কইয়া হের আত দরলাম। তর বিছা নেওনের কাম নাই আমার। তুইই তাহলে ল আমার লগে। তার বাদে বুজলি জউগ্যা, আত দইরা টাইন্না দুই আড়াই মাইল রাস্তা, হেঁচড়াইয়া লইয়াইলাম এই বাইত। মাইয়া খান কেমুন দেক, এতাহানি রাস্তা আমি টাইন্না হেচড়াইয়া লইয়াইলাম, একবারও আওয়াজ দিল না। ইট্টুও কানল না। ল এক খান বিড়ি খা জউগ্যা, বলে কেঁচড় থেকে আবার বিড়ি বের করছিল কিরমান। নিজে ধরিয়েছিল, জগুকে দিয়েছিল।

জগুর তখন এসব কথা শোনার সময় নেই। চার পাঁচদিন ধরে সে লেগে আছে কিরমানের পেছনে। কিরমানকে নিয়ে হাটের দিন কাজে যাবে। কিন্তু রাজি হচ্ছে না লোকটা। সারাজীবন মানুষের গলা কেটেছে, সিন্দুক ভেঙেছে, আর এই শেষ বয়সে এসে সাধু সেজেছে কিরমান। কথাটা ভেবে চারপাঁচ দিনের মধ্যে এই প্রথম ভেতরে ভেতরে খুব রেগে যাচ্ছিল জগু। আজই শেষ। কাল দিঘিরপাড়ের হাট। শালা রাজি হবে। নয়ত পুব পাড়ার আমিনুদ্দিনকে দলে নেবে জগু। আয়বরকত যে ভালো হবে জানে। হাট সেরে, কোমরে তহবিল বেঁধে বেপারিরা রাত বেরাত বাড়ি ফেরে। একজনকে ধরতে পারলেই কাজ ইনশাল্লাহ হয়ে যাবে।

বিড়ি টানতে টানতে কিরমান আবার একটু উদাস হয়ে গিয়েছিলো। সন্ধ্যার পরপরই চাঁদ উঠেছিল আকাশে। জ্যোৎস্না ছিল। সেই জ্যোৎস্নায় বাড়ির দাওয়ায় বসা দুজন মানুষ। হাতে জোনাকির মতোন জ্বলছিল বিড়ি। জ্যোত্সায় কিরমানের বীভৎস মুখের দিকে তাকিয়ে জগু কী যেন কী কারণে, বুকের ভেতরে নদীর স্রোতের মতো ছটফটানি থাকা সত্ত্বেও ওঠে যেতে পারে না। কথা বলতে পারে না। চুপচাপ থাকে। বিড়ি টানে।

কিরমান বলল, বাইত আইন্না মাইয়াডারে ঘরে উডাইলাম। কুপি আঙ্গাইয়া নিজের মুখের পট্টিখানা খুলোম। খুইল্লা চাইয়া দেহি কী, মাইয়াডা পিটপিট কইরা আমারে দেহে। বুজলাম আমারে হের মোনে ধরছে। ধরব না ক্যা! চেহারাখানা তো আল্লায় দিলে আছিল। রাজা-বাদশার লাহান আছিল। বুজলি জউগ্যা, তরে কইলাম না মাইয়া মাইনষে আমার চেহারা দেখলে মইজ্জা যাইত।

জগু বলল, খালিসেন ভাউজে মজছিল। আর কেউ তো মজে নাই। শুনে কিরমান খ্যাক খ্যাক করে একটু হাসে। হ, তর ভাউজেই মজছিল। ম্যালাদিন বাদে আমারে কইছিল, তুমার চেহারাসুরৎ যুদি খবিসের লাহান অইত তাইলে আমি তুমার লগে থাকতাম না।

হ, ঐ একজনের কাছেই তুমার চেহারা ভালা আছিল, জগুর গলায় শ্লেষের ভাব। ব্যাপারটা টের পেয়ে কিরমান বলল, বেডা তরা তো অহনতরি পোলাপান। মাইয়া মাইনষের মোন তরা কী বুঝবি! একখান মাইয়া মাইনষের মোন দেইখা বেবাক মাইয়া মাইনষের মোনের আসল গুমরডা বুজা যায়। ভালমন্দের জাগায় বেবাক মাইয়া মানুষ এক রকম।

হ, যা কইতাছিলাম। মাইয়াখানরে তো পয়লা দেইখাই আমার মোনে ধরছিল। বাইত আইনা যহন বুজলাম আমারেও হের মোনে ধরছে, তখন সোনাদানা টেকা-পয়সা যা ভাগে পাইছিলাম বেবাক হের পায়ের সামনে হালায় দিলাম। মুলাম গলায় কইলাম, আইজ থিকা আমার বেবাক জিনিস তর। তুই খালি আমার লগে থাকিচ। ছাইরা যাইচ না। যায় নাই রে। কুনদিন যায় নাই। এগার বছর আমার লগে ঘর কইরা মরল। আমার জীবনে সেরা দিন গেছে ঐ এগার বছর। ডাকাতি আমি ছাইরা দিছিলাম। হেয় কইছিল, আমি তুমার লগে থাকুম তুমি যুদি মাইনষের মাথায় বারি দেওন ছাইরা দেও।

চুরি-ডাকাতি ছাইরা দেও।

হুইনা আমি কইলাম, তাইলে তরে আমি খাওয়ামু কী! নিজে খামু কী!

হেয় কইল, তুমার গতর আছে না। গতর খাড়াইয়া কাম করবা। দিন বাদে নাইলে একসন্দা খামু। আমার কুন দুখ থাকব না।

ছাইরা দিলাম। ডাকাতি করন ছাইরা দিলাম আমি। নিজের তো আর খেতখোলা আছিল না। মাইনষের খেতে কামলা দিতাম। আমার কুনো দুখ আছিল না। যেদিন কামলা দিতাম হেদিন ভরপেট খাওন জুটত। না দিতে পারলে, কাম না পাইলে দুইজনে না খাইয়া থাকতাম। তাও দুখ আছিল না। সুখে নিদ যাইতাম।

তয় ভাউজের তর একখান দোষ আছিল। পেটখান আছিল হের বাজা। পোলাপান অয় নাই। এইডা মোনে অয় আগে থিইকাই জানত হেয়। নাইলে আমি টাইন্না লইয়াইলাম এত বড় ঘরের মাইয়া ডাকাতইতের লগে চুপচাপ আইয়া পড়ছিল কেমনে! হেয় জানত বাজা মাইয়ামাইনষের বিয়া কইরা কেঐ ঘরে রাখব না। খেদাইয়া দিব। নিজে থিকা যে হেরে লইয়া যাইতাছে, মানুষ অইলে হেয় তারে কুনদিন খেদাইয়া দিব না।

আমিও খেদাইয়া দেই নাই। বুকে তুইল্লা রাখছিলাম। হেয় আমারে পুচ করতো, পোলাপানের লেইগা তুমার মোন কান্দে না?

কইতাম, কান্দে।

তাইলে?

তাইলে কী?

আমার তো বাজা পেট। পোলাপান অইব না।

না অইলে কী করুম। আমার কপালে পোলাপান নাই।

দুখ অয় না?

অয়। তাইলে?

তাইলে কী! তুই বাজা না অইয়া আমি যুদি খোজা অইতাম, তাইলে কী করনের আছিল।

অনেকক্ষণ ধরে এসব প্যাচাল শুনে জগু খুব বিরক্ত হয়েছিল। রুক্ষ্ম গলায় বলল, এই হগল কিচ্ছা হুনতে আমি আহি নাই। কামের কতা কও। তুমি যাইবা? নাইলে সাফ কতা কইয়া দেও। আমি আমিনদ্দির কাছে যাই।

কিরমান কোনও কথা বলে না। আনমনে একবার আকাশের দিকে তাকায়। আকাশের চাঁদ দিনে দিনে আধখানা হয়ে গেছে। কমজোরি একটা জ্যোৎস্না কিরমানের বাড়ির ওপর, গাছপালার ওপর শুকনো কলাপাতার মতো লেপটে আছে। ঘরে মাটির গাছার ওপর বসে টিমটিম করে জ্বলছিল একটি কুপি। একবার ঘরটার দিকেও তাকায় কিরমান। আহা, এই ঘরডায় এগার বচ্ছর আছিল গেরস্তবাড়ির মাইয়াডা। হেয় আইজ নাই। ঘরডা বহুদিন ধইরা আন্দার অইয়া রইছে। কুপি আঙ্গাইলেও আন্দারডা যায় না। বুক কাঁপিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে কিরমানের।

জগু বলল, আমিনদ্দির কাছে গেলে কইব গুরুরে থুইয়া আমার কাছে আইছচ ক্যারে? টিটকারি দিব আর হাসব। হেইডা আমার ভাল্লাগব না দেইখাই তো তুমারে এতদিন ধইরা কইতাছি। তুমি তো আইজকাইল আর মাইনষের মইদ্দে নাই। থাকলে ধিকটা তুমার থাকত। জিদটা তুমার থাকত। আমিনদ্দি যহন কইব, হ বেডা থো তগ কিরমাইন্নার কতা। অমুন কত ডাকাইত দেকলাম। বুড়া অইলে বেবাক হালায় মেকুর অইয়া যায়। তহন তুমার ইজ্জতখান থাকব কই! এইডা খালি আমারে কও।

একথা শুনে কিরমানের ভেতর হঠাৎই যৌবনকালের ক্রোধটা একটুখানি ফিরে আসে। বুড়ো বয়সে যখন তখন গলায় খানিকটা শ্লেষ্ম জমে থাকে। খুক খুক করে দুখানা কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে কিরমান। তারপর বলে, তয় তুই আমারে নিবিই জউগ্যা?

আবছা জ্যোত্সায় জগু এবার দাঁত কেলিয়ে হাসে। তুমি কী কও গুরু! না নিলে তুমার কাছে বিলায়ের লাহান এমুন ঘুরঘুর করিনি। তুমি আমারে যাই মোনে কর গুরু আমি কইলাম তুমার ভালাডাই চাই। তুমি বুড়া অইয়া গেছ, কামকাইজ কর না, কী দিয়া কী খাও আল্লায়ই জানে। আমি চাই আমার লগে থাইকা থাইকা দুই চাইরডা পয়সা কামাও তুমি। নাইলে খাইবা কী? দিন যাইব কেমনে?

শুনে কিরমান খ্যাক খ্যাক করে হেসেছে। মাইনষের খাওনদাওন আল্লার আতে। পেড দিছে হেয় খাওনও দিব হেয়। এইডা তর ভাউজে হিগাইছিল আমারে। হ। কতাডা হাচাই। আমি কুনদিন না খাইয়া থাকি নাই। পেডের ভাত আল্লায় জোগাইয়া দিছে।

মাথার বাবড়ি চুল ঝাঁকানি দিয়ে, ভাটার মতো চোখ দুটো পিটপিট করে, মুখের আগাছার মতো দাড়ি গোঁফে অযথা একবার হাত বুলিয়ে জগু বলল, তয় একখান কতা জিগাই তুমারে।

আবছা জ্যোত্সায় জগুর চোখ পিটপিটানিটা দেখতে পায় না কিরমান। বলল, জিগা।

তুমি কুন কামকাইজ করো না। জমিজিরাতও নাই তুমার। থাকনের মইদ্যে আছে এই দশ কদম বাড়িখান আর ঐ একখান ছাপড়া ঘর। তুমি ভাত পাও কই? আর এই যে নিমিষে নিমিষে বিড়ি খাও, এই হগল আহে কইথিকা?

আল্লায় দেয়।

আল্লায় তুমার কাছে ফিরিশতা পাডায়নি?

তুই ছাড়া আমার কাছে যারা আহে তারা ফিরিশতার লাহানই। আমার সাগরেদ আছিল বার তের জন। শেষকালে সেন তুই আইলি। তুই তো একখান খাডাস। আর অরা অইল ফিরিশতা। অহনও ডাকাতি কইরা যা পায় রাইতে আইয়া আমার গুরুদক্ষিণাডা দিয়া যায়। কামকাইজে যাওনের আগে কইয়া যায়, বুদ্ধি লইয়া যায়। একথায় জগুর মনে একটু দুঃখের ভাব হয়। গলা নরম করে সে বলল, আমারে তুমি দোষ দিতে পার না গুরু। তুমি কামকাইজ ছাইরা দেওনের পর আমারে আর কেউ দলে লইতে চায় না। আমার বলে সবাব খারাপ। ডাকাতির সোনাদানা, টেকাপয়সা বলে আতে পাইলে আমি চুরি করি। হামলাইয়া রাখি। যারা এমুন অবিশ্বাস করে তাগো লগে কাম করুম কেমনে! কিরমান রামদার মতো ধারালো গলায় বলল, চুরির অব্যাস তো তর আছেই জউগ্যা। এইডা মিত্যা কতানি! আমার লগে শেষবার তুই যহন বাইনখাড়া ডাকাতি করতে গেছিলি, একখান অনন্ত তুই হামলাইয়া রাকছিলি না! পরে কোকসায় আমার লাত্তি খাইয়া সেন বাইর করলি। মোনে নাই? আ?

জগু এবার খুব দমে যায়। বার দুয়েক ঢোক গিলে খড়নাড়ার মতো শুকনো গলায় বলল, হ, ঐ একবারই তো করছিলাম। কী করুম কও। আমার সংসার বড়। নয়খান পোলাপান। বুড়ো মা আছে, একখান রাড়ি বইন আছে। বইনের আণ্ডাবাচ্চা তিনডা। ডাকাতি কইরা ভাগে যা পাই হেতে ভাত জোডে না।

তর কুনদিন জুটব না। চোরডাকাইতগও নিয়মনীতি থাকন লাগে। বুজছ? তর কুনও নিয়মনীতি নাই। হেইবার আমি লগে না থাকলে দলের মাইনষে তরে কাইট্টা রজতরেখার পাইতে হালায় দিত। কেঐ খবর পাইত না। তর সংসারে খাঐন্না মানুষ বেশি, হেইডা দলের মাইনষেরে কইলে হেরা দয়া কইরা তরে বেশি দিত। আপদে বিপদে তরে সাহাইয্য করত। তুই চুরি করল্লি ক্যা?

জগু মন খারাপ করে বলল, হ, হেই পাপেঐ তো আইজকাইল ভাত জোডে না। নাইলে তো দলেঐ থাকতাম। ছেচড়ামি করন লাগত না। কিরমান বলল, ভাত জোড়ে না দেইক্কাঐ এবার তর লগে আমি যামু। চিন্তা করি না। আমারে দিয়া যুদি তর সংসার কয়দিন ভালা কইরা চলে, হেইডা আমি করুম। তয় হোন, তরে একখান কিচ্ছা কই। এক চোররে হের ওস্তাদে হিগাইছিথল, কুনদিন মাগীর ভাউরার বাইত চুরি করবি না, কিরপিনের ঘরে চুরি করবি না, চুরি করতে গিয়া মাইয়া মাইনষের শইল্লে আত দিবি না, মাইয়ামানুষ অইল মায়ের জাত। হেগ ইজ্জতের উপর জোরজুলুম করবি না। এই তিন কতা যুদি না মানচ, তাইলে দেকবি হাজার সোনাদানা চুরি করলেও জইরা আইব না তর। বউ পোলাপান না খাইয়া মরব। চোরায় ওস্তাদের কতা মাতায় লইয়া পয়লা দিন গেছে চুরি করতে। সিং দিয়া এক গেরস্তের ঘরে হানছে। হাইন্দা দেহে কী, ঘরের মইদ্যে টেমি জ্বলতাছে। দেইখা চোরায় আঐলে খাড়াইছে। খাড়াইয়া দেহে গেরস্তের বউখান বিচনায় হুইয়া রইছে, আর হের মরদে মাতার সামনে বইয়া বউর মাতা আতাইয়া দিতে দিতে কইতাছে, ও বিবিসাব ওডেন। উইট্টা আমারে ভাত দেন। বউডায় কয় কি, নাআ আমিইই উটতেএএ পারুমমম না আআ, আতে পায়ে আইজ সাদ কইরা আলতা দিছি। তুমারে ভাত বাইরা দিলে আমার আতের আলতা বিনাশ অইয়া যাইব। হুইনা মরদে কয় হায় হায় এইডা আমারে আগে কইবেন না। সব্বোনাশ, আপনের আতের আলতা উইট্টা গেলে তো বিষণ খেতি অইয়া যাইব। ভাত আমি নিজেই বাইরা খাইতাছি। আপনে নিদ যান। মোনের আনন্দে নিদ যান। আর রোজ আপনে আতে পায়ে আলতা দিবেন। আমার বুকের উপরে আপনের পাও দুইখান উড়াইয়া নিদ যাইবেন। তাইলে পাওয়ের আলতাও নষ্ট অইব না। এই কতা কইয়া গেরস্তে গিয়া ভাত বাড়তে বহে। দেইখা। চোরার মোনে অইল ওস্তাদের কতা। ওস্তাদে কইছিল, মাগীর ভাউরার বাইত চুরি করবি না। চোরা ফিরত আইল। চুরি করল না। আর এদিকে চোরার ঘরে কইলাম ভাত নাই। বউ পোলাপান না খাইয়া রইচে। নিজে না খইয়া রইচে। খিদায় হারা রাতইত নিদ আহে না চোরার। পোলাপান কান্দে। বউ খিদার চোডে বইক্কা চোরার মরা বাপ জিন্দা করল হারা রাইত। পরদিন চোরায় হারাদিন না খাইয়া থাইকা রাইতে আবার গিয়া এক গেরস্তের ঘরে সিং কাটল। নিশি রাইতে বাড়ির বেবাক মাইনষে নিদ যাইতাছে। তয় একজন খালি জাগনা। বাড়ির মরদড়া। হেয় নিশি রাইতে টেমি জ্বালাইয়া রেজগি পয়সা। গুণতাছে। তিন চাইর টেকার রেজগি গুনতাছে এমুন কায়দা কইরা য্যান কুনো আজ অয়। দুনিয়ার কেঐ য্যান না বোজে। একখান কইরা পয়সা গুণে আর চোরের লাহান। চাইরমিহি চায়। কেঐ আবার দেখলোনি। পয়সার আওয়াজ আবার কেঐ হুনলনি। চোরায় আঐলে খাড়াইয়া খাড়াইয়া বেবাক দেহে। পেডে খিদা। খাড়াইয়া থাকতে থাকতে চোরের ঠ্যাংয়ে বিষ ধইরা যায়। গেরস্তে তিন চাইর টেকার রেজগি গণা আর শেষ অয় না। একখান পয়সা বিশ পঞ্চাশবার কইরা গণে। মোরগে বাগের লগে লগে পয়সাডি একখান ত্যানায় বান্দে গেরস্তে। তারবাদে ছনের ঘরের চালের ভিতরে গুইজ্জা। রাখে। না জানলে দুনিয়ার কেঐ বুঝবো না চালের ছনের মইদ্যে পয়সা হামলাইয়া রাকছে গেরস্তে। টেমি নিবাইয়া গেরস্তে তারবাদে হুইয়া পড়ে। চোরায়তো বেবাকঐ দেখছে। ইচ্ছা করলে চালের ছনের মইদ্যে আত দিয়া পোটলাডা লইয়া লইতে পারে হেয়। তয় চোরায় কইলাম লইল না। ওস্তাদে কইছিল কিরপিনের বাইত চুরি করবি না। পেডে দুই দিনের খিদা লইয়া চোরা ফিরত আইল। বাইত আইয়া দেহে খিদার চোডে বেবাক পোলাপান চিইক্কার পাড়তাছে। খালি আতে চোরায় ফিরছে দেইখা বউ মুইরা পিছা লইয়া বাইরে আইল। পোলাপানের খাওন দিতে পারো না জন্ম দিছ ক্যান। বাইরও বাইত থনে।

মোনের দুখে বাইতথন বাইর অইয়া গেল চোরায়। গিয়া এক জঙ্গলে বইয়া রইল হারাদিন। তারবাদে হাইঞ্জাকালে জিদ কইরা জঙ্গল থন বাইর অইল। তিন কোশ দূরে রাজার বাড়ি। আইজ রাজার বাইতঐ চুরি করতে যাইব। যা আছে বরাতে। চুরি আইজ করব। চুরি না কইরা বাইত ফিরব না। খিদায় জান যায়। রাজবাড়ি যাইতে যাইতে রাইনিশি অইয়া গেল। রাজার বাইত তো, বুজলি জউগ্যা, ম্যালা পাইক পেয়াদা পাহারাদার। চোরায় বহুৎ তদবির কইরা ভিতর বাইত গিয়া হান্দায়। তারবাদে যাইতে যাইতে এক্কেরে রাজকন্যার ঘরে। গিয়া দেহে ঘরের মইদ্যে সোন্দর একখানা ঝাড়াবাত্তি জ্বলতাছে। পালঙ্কে হুইয়া নিদ যাইতাছে রাজকন্যায়। রাজকন্যার গাও ভরা মণি মাণিক্য হিরা জহরতের গয়না। দেইখা চোরের মাথা খারাপ অইয়া যায়। আস্তে আস্তে গিয়া খাড়ায় রাজকন্যার সিতানের সামনে। বেতভারে নিদ যাইতাছে কন্যায়। ইচ্ছা করলেঐ গাও ভরা মণি-মাণিক্য, হিরা, জহরতের গয়না। দেইখা চোরের মাথা খারাপ অইয়া যায়। আস্তে আস্তে গিয়া খাড়ায় রাজকন্যার সিতানের সামনে। বেভোরে নিদ যাইতাছে কন্যায়। ইচ্ছা করলেঐ গাও থিকা বেবাগ গয়না খুইলা লইতে পারে চোরায়। চোরায় পাগলের লাহান আত দিতে যায়। তহনঐ মোনে অয় ওস্তাদের কতা। ওস্তাদে কইছিলো বেগানা মাইয়া মাইনষের শইল্লে আত দিচ না। চোরায় থাইমা যায়। তহন রাজকন্যার এক দাসী আইতে লইছিলো কন্যার ঘরে। চোরারে তো দেইখা হালায়। দেইখা হালানের লগে লগেঐ চিইক্কার মারে। আর যাইবা কই। পাইকপেয়াদারা আইয়া চোরারে ধইরা হালায়। পরদিন বিয়ানে আতবান্দা চোরারে দরবারে লইয়া যায় পাইক পেয়াদারা। চোরার বিচার অইব। ঐ রাইজ্যে চুরির শাস্তি গর্দান। ডরে চোরার কইলজা হুঁকাইয়া যায়। রাজ দরবারে হেয় আর খাড়াইয়া থাকতে পারে না। শইল্লে কাঁপন ধইরা গেছে। আত পাও ঠকঠক কইরা কাপতাছে। সিঙ্গাসনে বইয়া রাজায় জিগাইল, তুই রাজকন্যার ঘরে হানছিলি ক্যা?

চোরায় মোনে করল, গর্দান যহন যাইব তাইলে আর মিত্যা কতা কইয়া ফায়দা কী। হাঁচা কতা কইয়াঐ মরি। কইল, চুরি করতে হুজুর।

তাইলে চুরি না কইরা খাড়াইয়া রইছিলি ক্যা?

হাঁচা কতা কমু হুজুর?

ক।

হুইনা মোনে ইট্টু বল পায় চোরায়। কয়, আমার ওস্তাদে কইয়া দিছিল বেগানা মাইয়া মাইনষের শইল্লে আত দিবি না, মাইয়াছেইলারা মার জাত। আর কিরপিনের ঘরে চুরি করবি না, মাগীর ভাউরার ঘরে চুরি করবি না। আমি বউ পোলাপান লইয়া তিন দিন ধইরা না খাইয়া রইছি। তিনদিনঐ চুরি করতে গেছি। পয়লা রাইতে যার বাইত গেছি, হেয় দেহি মাগীর ভাউরা। চুরি করতে পারি নাই। পরদিন একবাইতে গেছি। গিয়া দেহি হেই বেডা জাত কিরপিন। চুরি করতে পারি নাই। কাইল রাইতে আইছিলাম আপনের বাইত। রাজকন্যার ঘরে গিয়া দেহি হের গাও ভরা মণিমাণিক্যের গয়না। খুলতে গিয়া ওস্তাদের কতা মোনে অইছে। ওস্তাদে কইছিল বেগানা মাইয়ামাইনষের শইল্লে আত দিচ না। হের লাইগা চুরি করতে পারি নাই। ধরা পইরা গেলাম।

বেবাক কতা হুইনা চোরারে রাজায় ছাইরা দিল। লগে ম্যালা ধনরত্ন দিল, জাগাজমিন দিল। বুজছচ জউগ্যা। নিয়মনীতি মাইন্না চল্লে হেই মাইনষে কুনদিন বিপাকে পড়ে না। ভাতে মরে না। তর কুন নিয়মনীতি নাই দেইক্কা এই দশা অইছে।

কিচ্ছা শুনে জগু খুব বিরক্ত হয়েছিল। বলল, এত প্যাচাইল পাইরো না তো। বুইড়া অইয়া গেলে মাইনষে কামের থিকা আকামের কতা বেশি কয়। তুমি কাইল আমার লগে যাইবা। বিয়ানে আইয়া আমি তুমারে লইয়া যামু।

কিরমান আর কোনও কথা বলেনি।

জগু চলে যাওয়ার পরও একাকী অনেকক্ষণ দাওয়ায় বসে থেকেছে কিরমান। বসে বসে বিড়ি টেনেছে। কিরমানের ছাপড়া ঘরের ওপর, ঘরের পেছনকার গাছপালার ওপর ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্না পড়ে ভৌতিক একটা পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল। ঘরের ভেতর জ্বলছিল কুপি। তার ছিটকে আসা আলো এবং ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্নায় দাওয়ায় বসে থাকা কিরমানকে মনে হচ্ছিল প্রাচীন ঝোপঝাড়ের মতো। বিড়ির একবিন্দু আগুনকে মনে। হচ্ছিল জোনাকি পোকার মতো। অনেক রাতে গ্রীষ্মকালের উষ্ণতা কমে গিয়ে পৃথিবী যখন শীতল হতে শুরু করে, গাছপালা আর মাটি থেকে যখন ওঠতে শুরু করে কোমল শীতলতা, তখন কিরমান উঠে গেছে তার ঘরে। তারপর হাঁড়ি থেকে দুপুরে বেঁধে রাখা ভাত সালুন বাসনে নিয়ে যখন খেতে বসেছে, তখন বহুকাল বাদে তার মনে পড়েছে। গেরস্তবাড়ির মেয়েটির কথা। এগার বছর কিরমানের সঙ্গে ঘর করেছিল। পুরনো অভ্যেস বদলে কিরমান যখন দিনে দিনে মানুষ হয়ে উঠেছে তখুনি কলেরায় মরল। মরে কিরমানকে আবার ডাকাত করে দিয়ে গেল। সাগরেদরা ম্যালা চেষ্টা তদবির করেও এগারো বছর কিরমানকে দলে নিতে পারেনি। গেরস্তবাড়ির মেয়েটি মারা যাওয়ার পর আবার তারা এসে ফুসলাতে লাগল। একদিন, দুদিন। কিরমান আবার ডাকাত হয়ে গেল। দিন যাচ্ছিল সুখেই। গেরস্তবাড়ির মেয়েটার শোক ডাকাতের উন্মাদনায় ভুলতে চাইছিল কিরমান। মারটা খেয়ে গেল চরে ডাকাতি করতে গিয়ে। দলের সবাই পালাতে পেরেছিল। ধরা পড়ে গেল কিরমান একা। তারপর হাজার লোকের মার। দুখানা থান ইট হাঁটু আর পায়ের পাতার মাঝখানে রেখে দুদিকে ওঠে দাঁড়াল চউরা দুই তাগড়া জোয়ান। হাড়টা কালিবাউসের শুকনো কাঁটার মতো মট করে ভেঙে গেল। তারপর সেই দুই জোয়ানের একজন গজাল দিয়ে খুঁচিয়ে তুলল কিরমানের একটা চোখ। আরেক জোয়ান খেজুর গাছ চাছার ছেনি দিয়ে আস্তেধীরে চাঁছল কিরমানের দুগালের চামড়া। তারপর রজতরেখার তীরে ফেলে রেখে দিল।

তবু জানে বেঁচে এসেছিল কিরমান। কিন্তু শরীরে যে ভাঙ্গনটা ধরল, তা আর সারল না। শরীরের কতা মনে পড়লেই গেরস্তবাড়ির মেয়েটির কথা মনে পড়ে। মরে গিয়ে জীবনটা অন্যরকম করে দিয়ে গেল কিরমানের।

কালরাতে এসব কথা খুব মনে পড়েছিল কিরমানের বহুকাল বাদে। তারপর আর ঘুম আসেনি কিরমানের। সারারাত জেগে থেকেছে। বিড়ি টেনেছে। তারপর সকালবেলা ওঠে সারা শরীরে চপচপ করে তেল মেখেছে কিরমান। খালি গা, নিম্নাঙ্গে ছেঁড়া লুঙ্গি। কোমরে কিরমান বেঁধেছে লাল গামছা। শক্ত করে। তারপর জগুর সঙ্গে যখন পথে নেমেছে তখন কিরমান বহুকাল বাদে আবার ফিরে গেছে তার যৌবনে। সে একটা দিন ছিল। উন্মাদনার দিন। বিড়ি ধরিয়ে জগু বলল, সড়ক দিয়া যাইবানি গুরু?

কিরমান একটু আনমনা ছিল। চমকে ওঠে বলল, যেহনদা গেলে হবিরে যাওন যায় হেই পথেই ল। আমি বুড়া মানুষ, ল্যাংড়া। বেশি আটতে পারুম না।

তাইলে গাংপাড় দিয়া যাইগা। কাইশবনের ভিতরদা। পথ সোজা অইব। হবিরে যাওন যাইব।

ল।

তারপর দুজন মানুষ সড়ক ছেড়ে নাবালে, কাশবনের ভেতর নেমে যায়। সড়কটা এসেছে মুন্সিগঞ্জ থেকে। তারপর টঙ্গিবাড়ি হয়ে খানিকটা ঘুরপথ চলে গেছে দিঘিরপাড়ের দিকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই সড়কে উঠেছিল দুজন।

কিরমানের মতো জগুরও খালি গা, চপচপ তেলমাখা কিরমানের ছিল ঝাড়া হাত-পা। কিন্তু জর হাতে ছিল ছালার একখানা থলি। তাতে কী আছে কিরমান জানে। ধারালো একখানা হাতখানেক লম্বা দা আর একখানা গুরু জবাই করার ছুরি। থলি হাতে জগুকে দেখে কেউ বুঝবে না কী উদ্দেশ্যে চলেছে মানুষটা।

সড়কে ম্যালা হাটুরে ছিল। জগুকেও দেখাচ্ছিল হাটুরেদের মতো। তার পেছনে কিরমানকে মনে হচ্ছিল ল্যাংড়াখোঁড়া ভিক্ষুকের মতো। যেন দিঘিরপাড়ের হাটে ভিখ মাগতে চলেছে।

কাশবনের ভেতর দিয়ে, রজতরেখার গা ঘেঁষে চিরল একটা পথ সোজা চলে গেছে দিঘিরপাড়ের দিকে। তাড়াতাড়ি হাট ধরতে দুচারজন কারবারি এই পথে চলাচল করে। বিকেলবেলা, কোমরে টাকার তহবিল বেঁধে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছুবার লোভেও ফেরে কেউ কেউ। সেরকম একজনকে পেলেই কাজ হয়ে যাবে।

সকালবেলার রোদ খুব তেজি ছিল সেদিন। গভীর কাশবনের ভেতরে রোদ পড়ে তা থেকে ছিটকে উঠছিল দমবন্ধ করা একটা গর্মি ভাব। ল্যাংড়া পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে কিরমানের তেল চকচকে শরীরে ফুটে উঠছিল শিশির বিন্দুর মতো ঘাম। ক্রমে দরদরিয়ে নামতে থাকে সেই ঘাম। বিকৃত মুখটা গরমে আরো বিকৃত হয়ে গেছে। নাক মুখ দিয়ে বেরুচ্ছিল গরম হাওয়া। হাসফাস করতে করতে তবুও হাঁটে কিরমান। থেমে থেমে। বহুকাল বাদে এতটা পথ হাঁটছে সে। হাঁটাও যে এত কষ্টের কোনোকালে টের পায়নি কিরমান। তবুও হাঁটে। শেষ কষ্টটা তাকে আজ করতে হচ্ছে। তবে নিজের জন্য নয়। জগুর জন্যে। তার অছিলায় যদি জর সংসারের মানুষজন দুবেলা পেট ভরে। খেতে পায় ক বেলা।

জগু হাঁটছিল বেশ দ্রুত। তার কোনো ক্লান্তি নেই। উদ্দীপনা আছে। কাশবনের গরমে সেও খুব ঘেমেছে। ঘামে ভেজা শরীর রোদে চকচক করছে। কিরমানকে ফেলে বারবারই বহুদূর এগিয়ে যাচ্ছিল সে। তারপর কাশবনের আড়াল পড়ে গেলেই কিরমানের জন্যে অপেক্ষা করছিল। কিরমান কাছাকাছি এলে দাঁত কেলিয়ে বলছিল, কী অইল গুরু আটতে পার না?

আগের লাহান কি আর পারিরে। একখান পাও ল্যাংড়া। তিনকুড়ি বয়েস অইল।

তাইলে ইট্টু বহ। জিরাও।

একথায় কিরমানের ভেতর যৌবনকালের চিতাবাঘটা লাফিয়ে ওঠে। জেদে সারা শরীর ছটফটিয়ে ওঠে। হেইদিনকার পোলা জউগ্যা, অর কাছে আমি নত অমু! আমার ল্যাংড়া পাওডার বলও তো রাখে না শইল্লে। বুড়া অইচি কী অইছে। পাওডা ল্যাংড়া না অইলে। আমার লগে আইট্টা পারতনি!

মুখে এসব কথা জগুকে সে বলে না। হা করে শ্বাস টানতে টানতে বলে, না জিরান লাগব না বেডা। কী মোনে করচ তুই আমারে! ল্যাংড়া অইছি কী অইচে, বুড়ী অইচি কী অইছে! মইরা গেছিনি। তর লাহান দুই জুয়ানে অহনেও কাবু করতে পারব না আমারে। জগু বলল, হেইডা জানি গুরু। তয় তুমি অমুন আবজাব করতাছ ক্যা?

গরমে। দেহচ না কেমুন গরম পড়ছে আইজ।

হ। সড়কে কইলাম এত গরম লাগে না। কাইশ্যাবোনে গরমডা বেশি লাগে। হের লেইগাঐ আইজ এই পথে কেঐ নামে নাই। নাইলে এহেনদা তো ম্যালা মাইনষে আডে যায়।

তয়?

তয় কী?

এহেনদা কেঐ না আইলে তর কাম অইবনি?

বিয়ালে আইব। দেইখো নে। হবিরে বাইত যাওনের লেইগা বেবাক কারবারিরা এহেনদা আডেতথন আহে। বিয়ালে কাইশ্যাবোনে এমুন গরম থাকে না।

কিরমান কোনও কথা বলে না। পা টেনে টেনে হাঁটে।

বেলা যত বাড়ছিল রোদ তত তীব্র হচ্ছিল। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও। স্থির কাশবন থেকে রোদের তোড়ে চুটপুটে একধরনের আওয়াজ উঠছিল। আর নিঃশব্দে উঠছিল উষ্ণতা। মানুষের জানপরান আইঢাই করার মতো উষ্ণতা। এসবের ভেতর দিয়ে পা টেনে হাঁটতে হাঁটতে কিরমানের কেবল মনে হয় কত দূর দিঘিরপাড়। কিরমানের বাড়ি থেকে দিঘিরপাড়ের দূরত্ব ছয় মাইল। সেটা সড়কের ঘুরপথে গেলে। কাশবনের এই রাস্তা ধরে গেলে মাইল দেড়েক কমে আসে।

কতদূর এল তারা। জগুকে জিজ্ঞেস করলে জগু খ্যাক খ্যাক করে হাসবে। বেবাক ভুইলা গেছ গুরু। এইডা কুন কতা অইল! কতবার ডাকাতি কইরা এই জঙ্গলে বইয়া ভাগ করছি না আমরা!

সত্য কথা। ম্যালাদিন ডাকাতির মালসামান, টেকা-পয়সা গয়নাগাঁটি এই জঙ্গলে বসে ভাগ করেছে তারা। সন্ধ্যের মুখে মুখে বড় ধানচালের আড়তটায় হানা দিয়েছিল। চার পাঁচ বেপারি বসে তখন টাকা গুণছিল। ছুরি উঁচিয়ে সেই সব টাকা নিয়ে তারা এসে ঢুকেছিল এই জঙ্গলে। তারপর চাঁদের আলোয় ভাগ বাটোয়ারা করেছিল। মনে আছে। কতোদূর এল, একথা তাহলে জগুকে জিজ্ঞেস করে কেমন করে!

কিন্তু কিরমানের যে আর চলে না। নাকমুখ দিয়ে ঝা ঝা করে বেরুচ্ছে উষ্ণতা। ল্যাংড়া পাটা টনটন করে। বুকের ভেতরটা হাঁসফাস করে। তেষ্টায় গলাটা হয়ে গেছে চৈত্রের মাঠ। কিরমান আর পারে না। ডাকাতি করতে এসে শেষমেষ বুক ফেটে মরবে নাকি!

তখুনি গলায় আবার সেই হা হা করা তেষ্টা। একটুখানি জিরিয়ে নেবার ফলে কিরমান এখন খানিকটা ধাতস্থ। দুহাতে মাটি ভর দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় সে। দেখে জগু বলল, কী অইল গুরু?

পানি খামু।

তারপর হাঁটু অব্দি জলে নেমে দুআজলা ভরে জল খায় কিরমান। অনেকক্ষণ ধরে খেয়ে খেয়ে পেটটা ঢোল করে ফেলে। তারপর নদী থেকে ওঠে আসবে, কিরমানের চোখ যায় মাঝনদীতে। সেখানে জলের তলা থেকে উপরে ঠেলে উঠছে মোলায়েম মাটির চর। দেখে কিরমান বুঝতে পারে নৌকা নেই কোন নদীতে।

বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে কিরমানের।

নদী থেকে ওঠে জগুর পাশে বসে কোচর থেকে বিড়ি বের করে সে। নিজে ধরায়, জগুকে ধরিয়ে দেয়। তারপর নদীর দিকে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, ঐ জউগ্যা গাঙ্গে চর পড়ল কবেরে?

জগু নড়েচড়ে বলল, দুই সন ধইরা। অহনও চরটা পুরা জাইগ্যা উডে নাই। আহেবার উইট্টা যাইব।

আহারে এই নদীখান কী আছিল আগে! বাইষ্যাকালে ত্যাজ আছিল কী! খরালিকালেও আদাঘন্টা লাগত পার আইতে। আডের দিন কত মহাজনী নাও থাকত গাঙ্গে। আইত, যাইত। মাল্লারা গাইত। ছিপ নাও লইয়া কতবার ডাকাতি করছি আমরা এই গাঙ্গে। আহারে। দিন বদলাইয়া গেছে। তহন আমার শইল্লেও জুয়ানকী আছিল, গাঙ্গেও পানি আছিল। অহন আমিও বুড়া অইচি গাঙ্গেও চর পইরা গেছে।

কোমর থেকে গামছা খুলে বীভৎস মুখটা গলাটা মুছল কিরমান। জগু থলি থেকে দাটা ছুরিটা বের করেছিল। দাটা তার পায়ের কাছে পড়া, ছুরিটা হাতে। আঙুলের ডগায় ধার পরীক্ষা করে সে খচ করে ছুরিটা বসিয়ে দিল নদীর তীরের নরম মাটিতে। ঠিক সেই সময় কোত্থেকে ওঠে সিরসিরে একটা হাওয়া। নদীর জল ছিল স্থির। জলের ভেতর থেকে ঠেলে ওঠা কোমল মাটির চর রোদ পেয়ে ছুরির ধারের মতো চকমক করছিল। সিরসিরে হাওয়ায় জলের স্থিরতা ভেঙ্গে যায়। পেছন থেকে কাশপাতা নত হয়ে লুটোপুটি খায় কিরমান আর জগুর শরীরে।

বিড়ির ধোঁয়া বাতাসে মেশাতে মেশাতে জগু বলল, মোনে অয় দিন ভালাঐ যাইব গুরু।

অত বড় মারটা খেয়ে মরেনি। আর আজ যদি জগুর সঙ্গে মামুলি একটা কাজে এসে মরে তাহলে সাগরেদরা কোনোদিন গুরু বলে তার নাম মুখে আনবে না। ঘৃণা করবে। গালাগালি দিয়ে তার নামের ওপর থুতু ছেটাবে। সে বড় লজ্জা, সে বড় অপমান। কী করা যায়? হাটে আর বুদ্ধি খোঁজে কিরমান। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে জগুকে ডাকে। ঐ জউগ্যা, হোন।

জগু বেশ অনেকটা এগিয়েছিল। কিরমানের ডাকে পেছনে কিরে তাকায়। কী কও? আডেঐ যাবিনি?

না।

তাইলে!

তাইলে কী?

ল এহেনেঐ বইয়া থাকি। আড তো আর বেশি দূর না।

হ ভালা কথা কইছ। লও বহি।

চিরল পথটা ছেড়ে দুজন মানুষ তারপর নদীর একেবারে কাছে চলে এল। পেছনে কাশবন রোদ আটকে রেখেছে। এমন একটা জায়গায় বসে আকাশের দিকে তাকাল কিরমান। দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে। কতোক্ষণ বসে থাকতে হবে আল্লাহ মালুম।

তবুও বসতে পেরে জানটা বেঁচে গেছে কিরমানের। এখন একটু জিরিয়ে ভরপেট পানি খেয়ে নিলে, তারপর বিড়ি ধরালে অপেক্ষা করতে কষ্ট হবে না।

পানি খাওয়ার কথা ভাবতেই শুকনো গলাটা, বৃষ্টির অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকা চষা জমির মতো হা হা করে ওঠল কিরমানের। ইচ্ছে হল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যত ইচ্ছে পানি খায়। কিন্তু ল্যাংড়া পা টেনে এত দূর হেঁটে আসার সঙ্গে সঙ্গে পানি খেলে বুকে বাঁধ পড়ে মরবে। জগুর সঙ্গে ডাকাতি করতে এসে মরণ। নামের ওপর থুতু ছিটাবে সাগরেদরা।

কিরমান অপেক্ষা করে। নদীর দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে। তারপর একটা ব্যাপার খেয়াল করে চমকে ওঠে। রজতরেখা তো দিঘিরপাড়ের হাট ছুঁয়ে পদ্মায় গিয়ে পড়েছে। আগে তো হাটের দিন নদীতে ম্যালা মহাজনী নাও থাকত। মাল নিয়ে হাটে যেত, ফিরে আসত। আজ নৌকা নেই কেন নদীতে!

কিরমান কোনও কথা বলে না। উদাস চোখে নদীর যেখানটায় চর ক্রমশ জেগে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে বিড়ি টানে।

বিড়িতে পুরু দম নিয়ে সুখটান দিয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে জগু ডাকল, গুরু।

যেন নদীর জলে ডুব মেরেছিল কিরমান। জগুর ডাকে মাথা তুলে বলল, কী কচ?

তুমারে অমুন লাগতাছে ক্যা?

জগুর দিকে মুখটা ফ্যাকাশে করে একটু হাসে কিরমান। কেমুন?

মোনে অয় শইলডা তুমার ভালা না।

কিরমান আবার নদীর দিকে মুখ ফেরায়। বিষণ্ণ গলায় বলে, না শইল ভালাঐ আছে। যা দেহচ হেইডা অইল বয়েস। বয়েস অইলে দুনিয়ার বেবাক জিনিসেরই চেহারা বদলাইয়া যায়। গাঙ্গডারে দেহচ না, কী আছিল আর কী অইয়া গেছে।

হ। তয় তুমারে একখান কতা কই গুরু। তুমি এমুন নামকরা ডাকাইত অইলে কী অইব কতাবার্তা কও বহুত গ্যানি মাইনষের লাহান। হুনলে মোনডা কেমুন করে।

তারপর আবার সব চুপচাপ। নদীর জল আগের মতোই স্থির হয়ে আছে। সাদা মাটির চর জলের তলায় ওঠে দাঁড়াবার জন্যে উতলা হয়ে আছে। কাশবন অবিরাম ছড়িয়ে যাচ্ছিল উষ্ণতা আর চুটপুটে শব্দ। নদীর পাড়ের ভাঙ্গনের গর্তে বাসা বেঁধে আছে। দুনিয়ার গাঙ শালিক। তাদের উড়াউড়ি আর কিচিরমিচিরের শব্দে নির্জন এলাকাটি ছিল মুখর হয়ে। কিরমান নিবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সব। পেছনে কাশবনের ছায়া দীর্ঘ করে কখন বিকেল হয়ে যায় টের পায় না সে।

নদীপাড়ের নরম মাটিতে গাঁথা ছুরিটা টেনে তুলে লুঙ্গিতে খুব যত্ন করে মোছে জগু। তারপর বলে, আমার আতে থাকব এই ছুরিডা। আর তুমি লইবা দাওখান। তুমার কিছুই করন লাগব না। যা করনের আমিই করুম। তুমি খালি দাওডা লইয়া আমার সঙ্গে খাড়াইয়া থাকবা।

কিরমান কোনও কথা বলে না। ভেতরে ভেতরে কীরকম একটা লজ্জা খেলা করে তার। হায়রে জীবন! একটা সময় ছিল তখন ডাকাতি করতে গিয়ে কে কীভাবে কাজ করবে তা বুঝিয়ে দিত কিরমান। আর আজ তাকেই উল্টো সব বুঝিয়ে দিচ্ছে জগু।

মনটা কেমন মেন্দা মেরে থাকে কিরমানের। নদীর দিকে তাকিয়ে আবার বিড়ি বের করে।

সন্ধের মুখেমুখে মানুষের শব্দ পেল তারা। দূর থেকে কথা বলতে বলতে আসছিল দুতিনজন। সেই শব্দ পেয়েই ছুরি হাতে ঘাসফড়িংয়ের মতো লাফ দিয়ে ওঠল জগু। ফিসফিস করে বলল, গুরু আইতাছে। মুখে নদীর স্রোতের মতো উত্তেজনা ছিল তার। দেখে কিরমান খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, যা তুই রেকি কইরা আয়।

হ যাইতাছি, বলে শেয়ালের মতো গুঁড়ি মেরে, নিঃশব্দে কাশবনের ভেতর মিলিয়ে যায় জগু। জগু চলে যাওয়ার পর কেমন একটা একাকিত্ব চারদিক থেকে চেপে ধরে কিরমানকে। ডাকাতি করতে এসে এই প্রথম তার বুকের ভেতর রজতরেখার মতো একটা ভয় মাথা ঠেলে উঠতে চায়। হাত-পা কেমন অবশ লাগে। নিজেকে মনে হয় প্রাচীন কালের বটবৃক্ষের মতো। অনন্তকাল ধরে যেন শেকড়বাকড় নামিয়ে দিয়ে এই নদীতীরে বসে আছে। এই সময় চোখেমুখে বিশাল উত্তেজনা নিয়ে ফিরে আসে জগু। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ওড গুরু। কাম অইয়া গেছে। বেপারি আইতাছে একজন। কোমরের বান্দা তফিলডা পিরনের ফাঁক দিয়া দেহা যায়।

কিরমান ঠাণ্ডা গলায় বলল, একলানি?

না লগে আর দুইজন আছে। আরে হেতে কী! তুমার চেহারা আর আমার ছুরি দেকলে দেইখোনে বেপারিরে হালাইয়া কেমতে আর দুইজন দৌড় দেয়।

কিরমান দুহাতে মাটি ভর দিয়ে দাঁড়ায়। তারপর দাটা হাতে নিয়ে পা টেনে টেনে জগুর পেছনে হাঁটে।

চিরল পথটার কাছাকাছি এসে কাশবনের আড়ালে নিঃশব্দে ওঁৎ পাতে দুজন মানুষ। জগু ফিসফিস করে বলল, আমি পয়লা গিয়ে সামনে খাড়ামু। তারবাদে তুমি।

কিরমান কথা বলে না। শুধু মাথাটা একবার নাড়ে।

লোকগুলো কাছাকাছি চলে এলে গরু জবাই করার আধহাত লম্বা ছুরিটা হাতে লাফ দিয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল জগু, যা আছে দিয়া দেও। চিইক্কর মারবা না।

কিরমান আড়ালেই দাঁড়িয়েছিল। হাত-পা কেমন অসাড় লাগছে তার। নড়াচড়া করবে, শরীরে বল পায় না কিরমান। কাশবনের ফাঁকফোকর দিয়ে তাকিয়ে দেখে তিনজন লোক উদ্যত ছুরি হাতে জগুকে সামনে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বেপারির মতন লোকটা দুহাতে চেপে ধরেছে তার কোমরে বাধা তহবিলটা।

জগু আবার বলল, দেও। হবিরে দেও নাইলে ছুরি হান্দাইয়া দিমু। বলে বেপারি মতন লোকটার কোমরের দিকে একটা হাত বাড়িয়েছে সঙ্গে সঙ্গে দুপাশের দুজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। মুহূর্তে জগুর হাতের ছুরিটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। লোক দুটো কায়দা করে ফেলল জগুকে। দেখে বেপারি মতন লোকটা পাল খাওয়ার অপেক্ষায় থাকা গরুর মতন গলা খুলে চেঁচাতে লাগল, ডাকাইতে ধরছে, ডাকাইতে ধরছে। আউগগারে ডাকাত ধরছে। জগুকে নিয়ে অন্য দুজন তখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিরমান বুঝতে পারল সুবিধা করতে পারছে না জগু। এখন তার সামনে গিয়ে। দাঁড়ানো উচিত। দা হাতে ঐ চেহারার আরেকজনকে দেখলে লোকগুলো কাবু হয়ে যাবে।

কিন্তু কিরমানের পা চলে না। শরীরটা অবশ লাগে। বুকের ভেতর কেমন কেমন করে। তখন হঠাই বাইন মাছের মতো পিছলে গেল জগু। তারপর লাফিয়ে ওঠে কাশবন পাথালে ছুটতে শুরু করলো। ঐ ডাকাইত যায়, ধর ধর বলে লোক তিনটেও ছুটতে শুরু করে জগুর পেছন পেছন। দা হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে কিরমান। বুক কাঁপিয়ে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।

খরা কিংবা বৃষ্টির পরে

তারপর একদিন বৃষ্টি নামল। বিকেলবেলা। দুপুরের পর সারা আকাশ জন্ডিস রোগীর চোখের রঙ ধারণ করেছিল। মাটি থেকে আকাশসীমা পর্যন্ত জমেছিল কুয়াশার মতো পাতলা ধুলার একটা রেখা। গাছের পাতায় কাঁপন তোলার মতো হাওয়া ছিল না। কোথাও। দেশজুড়ে চলছে প্রচণ্ড খরা। শীতকাল শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছে। এখন জুন মাস যায়, তবুও প্রতিদিন সূর্যের তেজ বেড়ে চলেছে। গুলি খাওয়া বাঘের মতো রোদ গোত্তা খেয়ে বেড়ায় সারা দেশে। উত্তরবঙ্গে মাইল মাইল শস্যের মাঠ রোদে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে আসছে খরায় শস্যনাশের খবর। খবরের কাগজগুলো হুমড়ি খেয়ে লিড হেডিঙে ছেপে দিচ্ছে সেই খবর। দেখে দেশবাসীর মাথায় প্রতিদিন একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছে তীব্র রোদ। উষ্ণতায় হাঁসফাঁস করছে মানুষ। তবু বেঁচে থাকার নেশায় দিগ্বিদিক ছুটছে।

সকালবেলা অফিসে এসে আলাউদ্দিন আলী (৩১) প্রথমে খানিক জিরিয়ে নিয়েছে। গেণ্ডারিয়া থেকে প্রতিদিন হেঁটে আসে মতিঝিলে। তার অফিসে। একটা প্রাইভেট ফার্মের কেরানি আলাউদ্দিন আলী। মাইনে ছশো চল্লিশ টাকা। সকাল নটায় বাড়ি থেকে বেরোয় সে। তারপর টানা চল্লিশ মিনিট, নামাপাড়া হয়ে, পুরোনো রেললাইনের নিচে যে প্রাচীন ধোলাইখাল, রাস্তা শর্টকাট করে সেখানে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে ধান্দাবাজ মানুষ, পেরিয়ে যেতে আসতে দশ পয়সা করে লাগে, বিশ পয়সা খরচ করে আলাউদ্দিন আলী অফিসে যায়, ফিরে আসে। অফিসের গেটে এসে, সেখানে ডালা নিয়ে বসে এক পানবিড়িঅলা, দশ পয়সায় একটা পান কিনে মুখে দেয় আলাউদ্দিন আলী। চারতলার সিঁড়ি ভেঙে যখন অফিসে নিজের টেবিলে এসে বসে, দশটা বাজতে তখন বিশ মিনিট। পান চিবোতে চিবোতে ওই বিশটা মিনিট রেস্ট আলাউদ্দিন আলীর। সাড়ে চার বছর এই নিয়মে অফিস করেছে সে। সিগারেট খায় না আলাউদ্দিন আলী, চা খায় না। দুপুরের আহার চারখানা আটা রুটি আর সবজি। বউ তৈরি করে দেয়। বাড়ি থেকে ছোট্ট টিফিন বক্সে ভরে নিয়ে আসে। দুপুরবেলা আয়েশ করে খায়। তারপর পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে দেয়ে ঢেঁকুর তুলে পিয়ন দিয়ে আনায় একটা পান। দশ পয়সা। মোট চল্লিশ পয়সা সারা দিনের খরচ আলাউদ্দিন আলীর। ছশো চল্লিশ টাকা মাস মাইনে, দুজন মানুষের খাই খরচা সাধ আহ্লাদ এবং বাড়িভাড়া দিয়ে চল্লিশ পয়সার বেশি নিজের জন্য একটা খরচ কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব!

আলাউদ্দিন আলী থাকে ডিস্টিলারি রোডে। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রেললাইনের পাশে গেণ্ডারিয়ায় যে বাঁধানো পুকুর তার উত্তর গলির মুখে একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ির নিচের তলায় মাঝারি সাইজের একটা রুম, এক চিলতে বারান্দা, বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা, তারপর পাঁচ কদম খোলা জায়গা, গেটের সঙ্গে ছোট্ট বাথরুম। আলাউদ্দিন আলীর সংসার। সংসারে বউ সুফিয়া, আর কেউ নেই। মা বাপ গত হয়েছেন অনেককাল। বড় দুবোন বিয়ে হয়ে চলে গেছে। এখন স্বামীর সংসার সামলায় একজন রায়ের বাজারে আরেকজন নোয়াব গঞ্জে। বছরে দু বছরে এক আধবার বোনদের সঙ্গে, ভাগ্নে-ভাগ্নীদের সঙ্গে দেখা হয় আলাউদ্দিন আলীর।

আর একটা ছোট ভাই ছিল। কামালউদ্দিন। চৌষট্টি সালের রায়টের সময় তাঁতীবাজার এলাকায় থাকত আলাউদ্দিন আলীরা। রায়ট করতে এসে এক রাতে আগুন দিল লোক। আগুন দেখে বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়েছিল সবাই। তারপর যে যেদিকে পারে ছুট।

কামালউদ্দিন তখন আট ন বছরের। সেই যে বাড়ি থেকে ছুটে বেরুল, আর ফিরল না। তারপর কতদিন গেল রাত গেল। মা মরেছিল আগেই। কামাল কামাল করে বাপটাও গেল। কিন্তু কামাল ফিরল না।

এখন মাঝে মাঝে মনটা খারাপ থাকলে কামালউদ্দিনের কথা মনে পড়ে আলাউদ্দিন আলীর। সংসারে এখন আপন বলতে কেউ নেই আলাউদ্দিন আলীর। শুধু বউটা। মেয়ে মানুষ দিয়ে কী হয়! বোঝে শুধু খাওয়াটা আর শোয়াটা। ভাইটা থাকলে আপদে-বিপদে পাশে এসে দাঁড়াত! আহারে কামালটা বেঁচে আছে কি মরে গেছে কে জানে।

কিন্তু সময়ে অসময়ে আলাউদ্দিন আলীর মনে হয় ভাইটা তার বেঁচে আছে। একদিন ঠিকঠাক করে আসবে। কামালউদ্দিনের সঙ্গে একদিন না একদিন তার দেখা হবেই।

আজ সকালে নাশতাটা খেয়ে মুখে পান পুরে আলাউদ্দিন আলী যখন বেরুবে, হাতে রুটি ভাজির টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে সুফিয়া বলল, কাল রেশন তুলতে হবে। ঘরে কিন্তু টাকা-পয়সা নেই।

শুনে আলাউদ্দিন আলীর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। সকালবেলাই শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড গরম। ছশো চল্লিশ টাকা মাইনের কেরানির ঘরে তো আর ফ্যান থাকে না! জামা কাপড় পরে ঘামছিল আলাউদ্দিন আলী। রেশন তোলার কথাটা শুনে গরমটা আরো বেড়ে যায় তার। তবু চৌকির ওপর খানিক বসে পান চিবোয় সে। সুফিয়াকে দেখে পেটের কাপড় পিঠের কাপড় সরিয়ে খসখস করে পেট পিঠ চুলকাচ্ছে। পেটটা দিন দিন উঁচু হচ্ছে। চারমাস চলছে সুফিয়ার। কথাটা মনে হতে মাথার ভিতরটা চক্কর খায় আলাউদ্দিন আলীর। আর পাঁচ ছয় মাস বাদেই সংসারে আসবে একটা নতুন মানুষ। ঝামেলা পোহাতে যাবে একগাদা টাকা। তারপর দিনদিন খরচ বাড়বে। বাড়তি টাকাটা আসবে কোত্থেকে! এখনই মাসের শেষ দিকে এডভান্স নিয়ে রেশন তুলতে হয়, বাজার করতে হয়।

বাজারটা সপ্তাহে একদিন, রোববার নিজে করে আলাউদ্দিন আলী। সারা সপ্তাহেরটা। মাছমাংস তো কপালে জোটে না। আলুভর্তা, ডাল আর ভাজিভুজি। তবু মাসের শেষটা আর চলে না। আড়াই শো টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাকি তিনশো নব্বই টাকায় দুজন মানুষের সংসার কি চলতে চায়! সুফিয়াটা ভালো মেয়ে বলে এসব নিয়ে কখন কথা বলে না। টেনেটুনে সংসারটা ঠিকই চালিয়ে নেয়। বাড়িঅলার চাকর ছেলেটাকে পটিয়ে পাটিয়ে সপ্তাহের রেশনটা তুলিয়ে নেয়।

সুখে-দুঃখে দিন চলে যাচ্ছিল ঠিকই। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে কখন কোনও আবদার করেনি সুফিয়া। শখ করে কোনও জিনিসের বায়না ধরেনি। ঘুরতে নিয়ে যেতে বলেনি, সিনেমা দেখাতে বলেনি। আলাউদ্দিন আলীর সংসারে এসেই বুঝে গিয়েছিল এটা একটা জেলখানা, আমোদ-আহ্লাদ কিংবা শখ করার জায়গা নয়। জীবনটা মেনে নিয়েছিল সুফিয়া। তবু মেয়েমানুষ চিরকালই মেয়েমানুষ, সন্তান না চেয়ে কি পারে! প্রথম থেকেই একটা সন্তানের বায়না ধরেছিল সুফিয়া। সব বুঝেও। পৃথিবীতে আল্লাহ কোনও মানুষ পাঠালে তার অন্নের সংস্থান করেই পাঠান, এসব বুঝিয়েছে আলাউদ্দিন আলীকে।

পুরুষমানুষ কি এসব সহজে বোঝে! তবু ব্যাপারটা অনেক কাল ঠেকিয়ে রেখেছিল। শেষপর্যন্ত পারেনি।

ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে সকালবেলা আলাউদ্দিন আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। তারপর সুফিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছে আজ এডভান্স নেব।

শুনে মৃদু হেসেছে। তারপর পেটপিঠ চুলকাতে লেগে গেছে সে।

সুফিয়ার শরীর ভরে গেছে ঘামাচিতে। নাকের তলায় সকালবেলাই জমে গেছে ঘাম। ইস কী যে গরম এবছর। তবু সুফিয়ার মুখে সকালবেলা আলাউদ্দিন আলী দেখেছে এক ধরনের প্রশান্তি। গরম ঘামাচি দারিদ্র? সব ছাপিয়ে সন্তান আসছে এক সুখেই কি বিভোর হয়ে থাকে সুফিয়া?

তারপর সুফিয়ার জন্য কী যে এক মায়ায় বুক ভরে গেছে তার। এই সময়ে মেয়েদের ভালো খাওয়াদাওয়া দরকার, পুরোপুরি বিশ্রামের দরকার। সুফিয়া এসবের কিছুই পাচ্ছে না। তার ওপর শরীর ভরে গেছে ঘামাচিতে। কী যে শুরু হল এবছর! এত গরমে মানুষ বাঁচবে কেমন করে!

রোদে পুড়ে ঘামে হাঁসফাঁস করতে করতে আলাউদ্দিন আলী যখন অফিসে পৌঁছে দশটা বাজতে তখন পনের মিনিট বাকি। এই প্রথম পাঁচ মিনিট লেট হল আলাউদ্দিন আলীর। আর আজ বহুদিন বাদে অফিসের সামনের দোকানটা থেকে পান খেতে ভুলে গিয়েছিল আলাউদ্দিন আলী।

সে কি কোনও ঘোরের মধ্যে চল্লিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে এল আজ!

অফিসে এসে আলাউদ্দিন আলী দেখে ইলেকট্রিসিটি নেই। কলিগরা যে যার টেবিলে বসে ঘামছে। দু-একজন শার্টের সব বোতাম খুলে জানালার সব পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে কোথাও কি হাওয়া আছে! কদিন ধরেই এরকম হচ্ছে। যখন তখন ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। নাগাড়ে চার পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। খরায় জল নেমে গেছে নিচে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটেছে। কী যে হবে!

নিজের টেবিলে বসে হা করে শ্বাস টানে আলাউদ্দিন আলী। তারপর ক্যাশিয়ার বিপিন বাবুর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিপিনবাবু পাতলা পাঞ্জাবি পরা, চশমা চোখে মাথা নিচু করে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আলাউদ্দিন আলী ডাকল, বাবু।

বিপিনবাবু মুখ তোলেন। তারপর মোটা লেন্সের ভেতর থেকে সোজা আলাউদ্দিন আলীর মুখে। কী ব্যাপার আলাউদ্দিন সাহেব? আলাউদ্দিন আলী কথা বলে না। কাঁচুমাচু করে। বিপিনবাবু হেসে বললেন, কত?

শখানেক।

ছুটির সময় নিয়ে যেয়েন।

শুনে আলাউদ্দিন আলী খুব খুশি। হে হে করে একটু হেসে বলল, পেপারের একটা পাতা দিন না। পড়ি।

বিপিন বাবু মাঝের একটা পাতা খুলে দিলেন।

নিজের টেবিলে এসে কাগজটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে আলাউদ্দিন আলী। এক জায়গায় বক্স করা ছোট্ট একটা খবর পড়ে মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায় তার। উত্তরবঙ্গের জনৈক সত্তর বছর বয়স্ক বৃদ্ধ, খরায় বৃষ্টির অভাবে মাইল মাইল শস্যের মাঠ ছারখার হয়ে যাচ্ছে দেখে খালি গায়ে গিয়ে বিলের জমিতে গিয়ে বসেছেন। তারপর বৃষ্টির জন্যে আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছেন। নাগাড়ে তিনদিন জমিতে বসেছিলেন তিনি। প্রার্থনার ভঙ্গিতে তোলা ছিল দুহাত।

তিনদিন অন্নজল স্পর্শ করেননি। তবু বৃষ্টি হয়নি। চারদিনের দিন সকালবেলা সংসারের অন্যান্য লোক যখন তাকে ফিরিয়ে আনতে গেছে তখন তিনি মৃত।

একটি লোকের জীবন নিয়েও আল্লাহ বৃষ্টি দেননি। কথাটা ভেবে কেন যে আলাউদ্দিন আলীর মনে হয় পৃথিবীতে কোনও কালেই বুঝি আর বৃষ্টি হবে না। উষ্ণতায় মারা যাবে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ।

সারাদিন মনটা খারাপ হয়ে থাকে। অফিসে তেমন কাজকাম ছিল না। তবু সময়টা কেটে গেছে।

বিকেলবেলা অফিস থেকে বেরিয়ে আলাউদ্দিন আলী দেখে রোদ নেই। আকাশ জন্ডিস রোগীর চোখের মতো। মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত কুয়াশার মতো জমে আছে পাতলা ধুলোর রেখা। এক বিন্দু হাওয়া নেই। মাটির চুলো থেকে আগুন তুলে নেয়ার পরও যেমন উষ্ণতা থাকে, তেমনি উষ্ণতা চারদিকে। তবুও আলাউদ্দিন আলীর মনে একটা ফূর্তির ভাব। একশো টাকা এডভান্স পাওয়া গেছে। টাকাপয়সা পকেটে থাকলে হাজার দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও নিম্নবিত্ত মানুষের মনে আলাদা একটা সুখ থাকে। আলাউদ্দিন আলী এখন সেই সুখে বিভোর।

টিকাটুলীর মোড়ে এসে আলাউদ্দিন আলীর মনে পড়ল সকালবেলা অফিসের সামনে দোকান থেকে পানটা আজ খাওয়া হয়নি। মনে পড়তেই পানের নেশাটা চড়ে যায়। একটা স্টেশনারি দোকান থেকে পান নিয়ে যখন মুখে পোরে তখন সুফিয়ার কথা মনে পড়ে তার। ঘামাচিতে শরীর ভরে গেছে সুফিয়ার। যে হারে গরম বাড়ছে প্রতিদিন তাতে ঘামাচি কমার কোনও সম্ভাবনা নেই। এই সময় মেয়েদের একটা ভালো। খাওয়াদাওয়া দরকার, আরামআয়েশের দরকার। কোনওটাই পায় না সুফিয়া। বরঞ্চ বাড়তি কষ্ট পাচ্ছে ঘামাচির। এইট্টুকু কষ্ট থেকে যদি সুফিয়াকে না বাঁচাতে পারি তো আমি কেমন স্বামী। কথাটা ভেবে ঘামাচি মারার মোক্ষম ওষুধ, মাইসেল পাউডার পৌনে সাত টাকা দিয়ে একটা কিনে ফেলল আলাউদ্দিন আলী। তাতে মনে একটা পরিতৃপ্তি আসে তার। পাউডারের টিন হাতে পান চিবোতে চিবোতে, জন্ডিস রোগীর চোখের মতো আকাশের তলা দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাঁচ বছরের পুরোনো সংসারে ফিরে এল। আলাউদ্দিন আলী। বিকেলবেলা।

বারান্দায় বসে পেটপিঠের কাপড় সরিয়ে ঘামাছি মারছিল সুফিয়া। গায়ে ব্লাউজ নেই। বলে ভারি বুক ইতিউতি উঁকি দিচ্ছিল। সে সবের খেয়াল ছিল না তার।

সুফিয়া মগ্ন হয়ে ঘামাচি মারছে দেখে আলাউদ্দিন আলী একটু গলা খাঁকারি দিল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে শরীরে আঁচল টেনে দেয় সুফিয়া। তারপর আলাউদ্দিন আলীকে দেখে হেসে ফেলে। ও তুমি, আমি ভাবলাম কে না কে?

একথায় বহুকাল বাদে বউর সঙ্গে একটু ঠাট্টা করে আলাউদ্দিন আলী। অন্য কেউ আসে নাকি?

যা।

তারপর আলাউদ্দিন আলীর হাতে পাউডারের টিন দেখে লাফিয়ে ওঠে সুফিয়া। থাবা দিয়ে টিনটা নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার জন্যে এনেছ?

তো কার জন্যে! আমার কি আর দু-একটা বউ আছে?

কত দাম?

পৌণে সাত টাকা।

এই এতগুলো টাকা খরচ না করলেই পারতে!

আলাউদ্দিন আলী কথা বলে না। ঘরে ঢুকে জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে সুফিয়ার চেহারায় আলাদা একটা লাবণ্য খেলা করছে দেখে পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেলে। ভেতরে ভেতরে সুফিয়া যে প্রচণ্ড খুশি হয়েছে, বুঝতে দেরি হয় না তার।

অফিসের জামাকাপড় সদরঘাটের নিকসন মার্কেট থেকে অতি সস্তায় কেনা সাহেবদের পুরোনো শার্টপ্যান্ট খুলে খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে ছোট বারান্দায় এসে বসে আলাউদ্দিন আলী। শরীরে ঘাম শুকিয়ে গিয়ে লবণ হয়ে গেছে দেখে সুফিয়া ভাঙা তালপাতায় তাকে বাতাস করছিল। তখনি একবার বিদ্যুৎ চমকে ওঠে আকাশে। বহুকাল বাদে, যেন এই প্রথম পৃথিবীতে মেঘ ডাকছে, এমন করে, দশদিক মুখরিত করে মেঘ ডেকে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সুফিয়া বলল, আয় আয়।

আলাউদ্দিন আলী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, বৃষ্টি হলে দুনিয়াটা ঠাণ্ডা হয়, মানুষ বেঁচে যায়।

একথার পরপরই শুরু হয় দমকা শুকনো বাতাস। রাজ্যের ধুলোবালি উড়ে আসে আলাউদ্দিন আলীর ছোট্ট ঘরে। ধুলোর দাপটে অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক। সুফিয়া ছুটে গিয়ে ঘরের জানালা বন্ধ করে। তারপর ঘরে ষাট পাওয়ারের বালব জ্বেলে দেয়।

তখুনি বাতাসের সঙ্গে কেঁপে আসে বৃষ্টি। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকায়, মেঘ ডাকে। আলাউদ্দিন আলী বসেছিল বারান্দায়, বৃষ্টিতে হাওয়ায় তার শরীর জুড়িয়ে যেতে থাকে। বৃষ্টি দেখে সবচেয়ে খুশি হয়েছে সুফিয়া। দৌড়ে ছোট্ট উঠোনে নেমে যায় সে। তারপর বুক পিঠের কাপড় ফেলে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।

সুফিয়াকে এখন বাচ্চা মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। আলাউদ্দিন আলী তাকিয়ে দেখে।

স্বামীর সামনে মেয়েদের কোনও লজ্জা থাকে না। কী রকম অবলীলায় বুকের পিঠের কাপড় ফেলে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে সুফিয়া!

আলাউদ্দিন আলী বলল, বেশি ভেজাভেজি কোরো না। জ্বরজারি হবে। এসময় অসুখ বিসুখ খারাপ। বাচ্চার প্রবলেম হতে পারে। সুফিয়া হাসতে হাসতে বলে, তুমি অত ভেব না গো। কিছু হবে না। বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজলে ঘামাচি সব মরবে।

আহা, তাহলে পাউডারটা কেন কিনলাম।

আফসোস হচ্ছে?

পৌণে সাতটা টাকা!

মনে কর আমার জন্যে গচ্চা দিলে। বলেই সুফিয়া খুব হাসে। কখনও তো আমার জন্যে তোমার তেমন খরচা হয়নি। এবার একটু না হয় হল।

শুনে আলাউদ্দিন আলীর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। খরচটা কি হত না, সামর্থ থাকলে ঠিকই হত। কিন্তু কথাটা বলা হয় না।

অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে, শাড়িছায়া পাল্টে, ঘরের ভেতর ষাট পাওয়ারের আলোর তলায় দাঁড়িয়ে শরীরে পরম যত্নে মাইসেল পাউডার মাখছিল তখুনি লাইট চলে যায়। মুহূর্তে মৃত্যুর মতো গভীর অন্ধকার নেমে আসে। থেকে থেকে মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আলাউদ্দিন আলী কাত হয়ে শুয়েছিল চৌকির ওপর। আলো চলে যেতেই ধড়ফড় করে ওঠে। ম্যাচ কোথায়? হারিকেন জ্বাল।

সুফিয়া বলল, ব্যস্ত হয়ো না। আমি দেখছি।

তারপর হাতড়ে হাতড়ে ম্যাচ বের করে সুফিয়া। হারিকেন জ্বেলে দেয়।

হারিকেনের আলোয় খাওয়াদাওয়া যখন শেষ করেছে দুজন, তখন আলো ফেরেনি।

সাড়ে আটটা নটা বাজে। আলাউদ্দিন আলী বলল, চল শুয়ে পড়ি। গরমে কতকাল ঘুমুতে পারিনি। আজ শান্তিতে ঘুমুব।

হারিকেন নিবু নিবু করে সুফিয়া যখন বিছানায় গেছে, বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে, দমকা হাওয়াটা একদম নেই। বৃষ্টির পরে পৃথিবী এখন শীতল। সুফিয়া বিছানায় শুয়ে আলাউদ্দিন আলীর বুকে পিঠে নরম হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। তখন আলাউদ্দিন আলীর মনে পড়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে করতে উত্তরবঙ্গে শস্যের মাঠে বলে মারা গেছেন এক বৃদ্ধ। অতঃপর বৃষ্টি হল বৃদ্ধের প্রার্থনা সফল হল, বৃদ্ধ দেখে যেতে পারলেন না।

একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে আলাউদ্দিন আলীর। তখুনি গলির মুখে লোকজনের হল্লাচিল্লার শব্দ পাওয়া যায়। প্রথমে খেয়াল করে না আলাউদ্দিন আলী। সুফিয়া বলল কী হল? এত হইচই?

আলাউদ্দিন আলী কান পেতে শব্দটা শোনে। তারপর বলে, বুঝতে পারছি না। বেরিয়ে দেখে আসব?

না, এই অন্ধকারে বেরুতে হবে না।

হল্লাচিল্লাটা তখন আরও বেড়েছে। অনেক লোকজন একত্রে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। গলির একেবারে মুখে। কী ব্যাপার?

আলাউদ্দিন আলী জোর করে বিছানা ছাড়ে। তারপর খালি গায়ে, লুঙ্গি পরা অবস্থায় হারিকেনটা নিয়ে ঘর থেকে বেরোয়। দেখে আসি। এখুনি চলে আসব।

সুফিয়া বলল, দেরি কোরোনা। অন্ধকারে আমার ভয় করবে।

গলির মুখে এসে আলাউদ্দিন আলী দেখে লোকজন জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। সেখানে কাত হয়ে পড়ে আছে একটা লাইটপোস্ট। লাইটপোস্টের তলায় একটা রিকশা। লোকজনের হাতে হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের আলোয় দেখা যায় রাস্তায় ভিড়ের মাঝমধ্যিখানে লুঙ্গি কাছামারা, খালি গা জোয়ান মর্দ এক যুবক উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আলাউদ্দিন আলী কিছু বুঝতে না পেরে একজনকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ভাই?

ঝড়বৃষ্টি দেখে রিকশা রেখে লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। কী দুর্ভাগ্য দেখুন, লাইটপোস্টটা কাত হয়ে পড়ল বুকের ওপর।

মারা গেছে?

হ্যাঁ, বোধ হয় সঙ্গে সঙ্গেই।

শুনে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে আলাউদ্দিন আলীর। চৌষট্টির রায়টে হারিয়ে যাওয়া কামালউদ্দিনের কথা মনে পড়ে। তারপর ভিড় ঠেলে যুবকের লাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মুখ দেখার উপায় নেই। শুধু কুচকুচে কালো পিঠটা দেখা যায়। পিঠভর্তি ঘামাচি। বছরের প্রথম বৃষ্টি পেয়ে, ঘামাচি মারার লোভেই কি সে রিকশা নিয়ে লাইটপোস্টের তলায় বসেছিল। যুবক কি জানত গোপনে তার আজরাইল এসে বসে আছে ওই লাইটপোস্টে।

হারিকেন হাতে ফিরে আসতে আসতে আলাউদ্দিন আলী মনে মনে বলল, ভাই আমার ভাই। কথাটি কি সে এই যুবক না চৌষট্টির রায়টে হারিয়ে যাওয়া ভাই কামালউদ্দিনের উদ্দেশে বলল, বুঝতে পারে না।

ঘরে এসে আলাউদ্দিন আলী দেখে বহুকাল বাদে ঠাণ্ডা পেয়ে নিঃসাড়ে ঘুমুচ্ছে সুফিয়া। বউটাকে আর ডাকে না সে। হারিকেন নিবু নিবু করে তার পাশে শুয়ে পড়ে। কিন্তু শুয়ে না পড়ে এতকাল বাদে ঠাণ্ডা রাত পেয়েও ঘুম আসে না তার। হারিয়ে যাওয়া ভাইটার কথা মনে পড়ে। আর চোখের ওপর বারবার ভেসে ওঠে উপুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা। রিকশাঅলা যুবকের লাশ। কামালউদ্দিন নয় তো!

ঘুম আসে না আলাউদ্দিন আলীর। অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে না ঘুম না জাগরণ এমন। একটা অবস্থায় সুফিয়ার পাশে পড়ে থাকে সে। ভোররাতে একটু তন্দ্রামতন এসেছিল। হঠাৎ সুফিয়ার চিৎকারে লাফিয়ে ওঠে আলাউদ্দিন আলী। দেখে ঘরে ষাট পাওয়ারের বালব জ্বলছে। বিকেলবেলাটা ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছিল। সুইচ অফ করা হয়নি বলে লাইটটা ইলেকট্রিসিটি ফিরে পেয়ে আপনা আপনি জ্বলে ওঠেছে। আর সেই আলোয় মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে চিৎকার করছে সুফিয়া। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে।

প্রথমে আলাউদ্দিন আলী কিছুই বুঝতে পারে না। ভ্যাবলার মতন খানিক বসে থাকে চৌকির ওপর। তারপর লাফিয়ে নেমে সুফিয়াকে জড়িয়ে ধরে। কী হয়েছে?

সুফিয়া কথা বলতে পারে না। গোঙায়। ব্যথায় মুখ দিয়ে ফেনা ওঠছে তার। নিম্নাঙ্গ ভেসে যাচ্ছে রক্তে, মেঝে ভেসে যাচ্ছে।

আলাউদ্দিন আলী কী করবে বুঝতে পারে না। বারান্দায় ছুটে এসে দোতলায় লোকদের ডাকে। একটু আসুন তো দয়া করে। আমার ভারি বিপদ।

মিনিট পাঁচেক পর বাড়িঅলা সাদেক সাহেব আর তার স্ত্রী নেমে আসেন। সাদেক সাহেবের স্ত্রী সুফিয়াকে এক পলক দেখেই বললেন, আলী সাহেব ডাক্তার ডেকে আনুন। আপনার স্ত্রীর এবরসন হয়ে গেছে। শুনে মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায় আলাউদ্দিন। আলীর। নিজেকে নিজেই মিনিট দুয়েক চিনতে পারে না সে।

কিন্তু এই ভোররাতে আলাউদ্দিন আলী কোন ডাক্তারের কাছে যাবে, খানিক বুঝতে পারে না। এক সময় মনে পড়ে সাবেক শরাফতগঞ্জ লেইনে মফিজ ডাক্তারের বাসা। বাসাটা চেনা আছে। ডেকে, হাতে পায়ে ধরে ডাক্তারকে আনা যাবে। মফিজ ডাক্তার ভালো লোক।

হাতে ডাক্তার সাহেবের ব্যাগ, পেছনে মফিজ ডাক্তার আলাউদ্দিন আলী যখন ফিরছে, তখন ভোরবেলার পবিত্র আলো ফুটে ওঠেছে চারদিকে। কাল সন্ধ্যার ঝড়বৃষ্টির ফলে ভেজা একটা ভাব চারদিকে। ধুলোবালির চিহ্ন নেই।

বাঁধানো পুকুরটার কাছাকাছি এসে আলাউদ্দিন আলী দেখে পুকুরের চারদিকে লোকজনের ভিড়। দেখে আলাউদ্দিন আলী একটু অবাক হয়। হাতে ডাক্তারের ব্যাগ পিছনে মফিজ ডাক্তার, সুফিয়ার এবরসন হয়ে গেছে, সব ভুলে আলাউদ্দিন আলী পুকুরের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন দৃশ্যটা চোখে পড়ে তার। হাতমুখ বাঁধা এক যুবতীর লাশ ভাসছে পুকুরে। মুখটা কাপড় দিয়ে বাধা বলে চেহারা বোঝা যায় না। হাত দুটো বাঁধা বুকের কাছে। শরীরে কাপড় নেই। সাদা শরীরটা জলের ওপর স্থির হয়ে আছে। লোকে বলাবলি করছে, রেপ কেস। রেপ করে, হাত মুখ বেঁধে পুকুরে। ফেলে দিয়ে গেছে। থানায় খবর দেয়া উচিত।

আলাউদ্দিন আলী পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে সব শোনে, সব দেখে। বহুদিন খরার পরে কাল বৃষ্টি হয়েছিল। লাইটপোস্ট চাপা পড়ে গলির মুখে পড়েছিল এক যুবক। হলেও সে তার হারিয়ে যাওয়া ভাই হতে পারে। ভোররাতে সুফিয়ার এবরসন হয়ে গেল। এখন ধর্ষিতা যুবতীর লাশ ভাসছে পুকুরে। এসবের মানে কী?

খেলোয়াড়

বল এখন বীরুর পায়ে। বীরু প্রতিপক্ষের রক্ষণসীমানায় ঢুকে গেছে। চমৎকার চমৎকার বীরু ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছে পেনালটি সীমানার দিকে। বাধা দিল প্রতিপক্ষের স্টপার নাসিম। নাসিমকে ডস দিয়ে গোলমুখে ঢুকে গেছে বীরু। ডানপায়ে তীব্র শট। গোল, গোল।

দূরাগত শব্দের মতো হামিদ ভাইয়ের ভরাট গলার এরকম কমেনট্রি হচ্ছিল মাথার খুব ভেতরে। স্টেডিয়াম ভরা দর্শক আজ। খেলা শেষ হতে তিন চার মিনিট বাকি। দর্শক ধরে নিয়েছে খেলাটি ড্র হবে। কিন্তু আজ খেলতে নেমেই আমার জেদ চেপে গিয়েছিল। গোল দেবই। সুযোগ আসেনি। হাফটাইম পেরিয়ে যায়। গোলশূন্য অমীমাংসিত। দেখেশুনে আমার মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড়। অবশ্য আমি তেমন নামকরা প্লেয়ার নই। ক্লাব আমার ওপর খুব একটা ডিপেন্ডও করে না। সাপোর্টাররা কেউ কেউ হয়ত করে।

কিন্তু আমার আজ প্রথম থেকেই জেদ ছিল, গোল দেব। চান্স আসে। সাপোর্টারদের করতালিতে স্টেডিয়াম ভেঙে পড়ে। সাপোর্টারদের মধ্য থেকে কে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, বাকআপ বীরুদা। আমার মনে হয় মাথার অনেক ভেতর থেকে আসছে শব্দটা। চোখে দেখি ঝাপসা কুয়াশায় সামনেই হা করে আছে বিশাল গোলপোস্ট। তার মাঝমধ্যিখানে লিলিপুটের মতো একটা মানুষ। প্রতিপক্ষের গোলকিপার। তখন মাথার ভেতর থেকে আবার সেই শব্দ, বাকআপ বীরুদা। ডান পায়ে তীব্র শট নিই। অবলীলায় গোল হয়ে যায়। আ এই সময়টা আমার খুব প্রিয়।

গোল হতেই গ্যালারি করতালিতে ভেঙে পড়ে। শুরু হয় তুমুল হৈ চৈ। দলের খেলোয়াড়রা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। চার পাঁচজন শূন্যে তুলে দোলায়। সেই অবস্থায় আমি গ্যালারির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ি। হাসি। সিকি মিনিটে সিকি শতাব্দী সময় পেরিয়ে যায়।

প্রতিপক্ষের তিনজন খেলোয়াড় মধ্যমাঠে সার ধরে দাঁড়িয়েছে। সেন্টার হয়ে গেল। বল আফসানের পায়ে। আফসান লম্বা শট করল। আমার এখন আর কোনও উত্তেজনা নেই। বলটা চড়ুই পাখির মতো মধ্যমাঠে নাচানাচি করছে। প্রতিপক্ষ খুব উইক হয়ে গেছে। ড্র হলেও মানইজ্জত থাকত! এখন সময়ও নেই। গোল শোধ করার প্রশ্নই ওঠে না।

হঠাৎ দেখি বলটা আমার দিকে ছুটে আসছে। কে পাস দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গ্যালারিতে হৈ চৈ। পাবলিক সিওর হয়ে গেছে, বীরুর পায়ে বল এলেই গোল। কিন্তু আমি গা করি না। আর গোল দিয়ে কী হবে। জিতে তো গেছিই।

ডান পায়ে আলতো করে বলটা ধরে রাখি। প্রতিপক্ষের কামালকে দেখি গুলতির গুলির মতো ছুটে আসছে। বলটা নইমকে পাস দিই আমি। তখুনি রেফারির বাঁশি বেজে ওঠে। খেলা শেষ। গ্যালারিতে আরেক রাউন্ড হৈ চৈ। আমাদের সাপোর্টাররা একতালে হাততালি বাজাতে থাকে। আমরা আস্তেধীরে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসি।

কী আশ্চর্য, খেলার সময় টের পাইনি বুটের ভেতর ডানপায়ের পাতায় মৃদু একটা ব্যথা। এখন হাঁটার তালে নেচে ওঠছে ব্যথাটা। কী হল?

আজ তো মারেনি কেউ!

রঞ্জু ভাই, ক্লাব সেক্রেটারি বললেন, বীরু আজ তুই ক্লাবেই থেকে যা। রাতে হেভি চলবে।

আমি কথা বলি না। একটা মাত্র গোল দিয়ে ক্লাবকে আমি আজ জিতিয়েছি। আমার আজ খাতির হবে অন্যরকম। রাতেরবেলা ক্লাবের সব এডভাইজাররা আসবেন। খাওয়া-দাওয়া হবে। পরে চলবে ড্রিংকস আর রাতভর ফ্লাশ খেলা। দারুণ কাটবে রাতটা। যদিও আমি মদ খাই না, ফ্লাশ খেলার তো প্রশ্নই ওঠে না! টাকা কই! আমি তো আর পয়সাঅলা বাপের পোলা নই।

তবুও ক্লাবে থাকলে আড্ডাফাজ্ঞা মেরে ভালো কাটত রাতটা! উপায় নেই। ক্লাবে থাকলে বাবা রাগ করেন। অথচ ক্লাবে থাকলে কত সুবিধে ছিল। সিঙ্গেল রুম পেতাম। রেগুলার প্রাকটিসটা হত ভালোভাবে। অন্তত ফুটবল সিজনটা। কিন্তু বাবা একদম নারাজ। ব্যাকডেটেড লোক। তার ধারণা খেলাধুলা জিনিসটাই খারাপ। তার ওপর ক্লাবে থাকলে চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে।

শালা চরিত্র।

বাবার ইচ্ছে ছিল আমি ডাক্তার হব। কিন্তু লেখাপড়ায় আমি কখনও তেমন ভালো ছিলাম না। টেনেটুনে ক্লাশ ডিঙাতাম। তবুও বাবার ইচ্ছেয় ইন্টারমিডিয়েট পড়েছিলাম সায়েন্স নিয়ে। বায়োলজি মেইন সাবজেক্ট। পর পর তিনবার পরীক্ষা দিয়েও ইন্টারমিডিয়েট পাস করা আমার হয়নি। বলতে কি লেখাপড়া ব্যাপারটা আমি কখনও তেমন সিরিয়াসলি নিইনি। আমার ভালো লাগত না।

ছেলেবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি অদ্ভুত টান ছিল আমার। মনে আছে, আমি যখন খুব ছোট, পাড়ার পাঠশালায় পড়ি, তখন আমাদের মিলব্যারাক মাঠে রেগুলার খেলাধুলা হত। ফুটবল সিজনে ফুটবল, ক্রিকেট সিজনে ক্রিকেট। আমি পাঠশালায় না গিয়ে, বগলে বইশ্লেট, শীতকালের সকালে মাঠে চলে যেতাম ক্রিকেট খেলা দেখতে। বাবা কতদিন ডিসপেন্সারি থেকে ফেরার পথে আমাকে কান ধরে বাড়ি নিয়ে এসেছেন।

তারপর আরো বড় হয়ে, যখন গেণ্ডারিয়া হাই স্কুলে পড়ি, তখন থেকে তো আমি হায়ারে খেলি। পাড়ার ভালো প্লেয়ার, স্কুল টীমের এক নম্বর প্লেয়ার। সবাই বেশ খাতির টাতির করে। সেই বয়সে আমি স্কুল পালিয়ে রেললাইন ধরে স্টেডিয়াম চলে যেতাম খেলা দেখতে। শুনে বাবা আমাকে কম মারধোর করেননি। সেই মারের কথা ভাবলে এখনও সিরসির করে ওঠে।

একদিন, তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি, টেস্ট পরীক্ষার দুমাস বাকি। বাবা মাস্টার রেখে দিয়েছেন। বিকেলবেলা আমি সেই মাস্টার, আমাদের স্কুলের সবচে ভালো টিচার ফখরুল স্যারের বাসায় গিয়ে পড়ে আসি। স্যারের বাসায় পড়তে যেতাম ঠিকই, কিন্তু আমার একদম ভাল্লাগত না। ফখরুল স্যার এক অঙ্ক কী যে যত্নে তিন চারবার করে বোঝাতেন। আমার মাথায় ঢুকত না। আসলে হত কি, ফখরুল স্যার অঙ্ক করিয়ে যেতেন, আমি সেই অঙ্কের পরিবর্তে খাতায় দেখতাম উদাস একটা মাঠের ছবি। বাইশজন প্লেয়ার ফুটবল খেলছে সেই মাঠে। এই সুন্দর বিকেলে আমি ফখরুল স্যারের কাছে বন্দি হয়ে আছি, আর সবাই খেলছে। আমার খুব মন খারাপ হয়ে যেত। একদিন। অঙ্ক করতে না গিয়ে বইখাতা নিয়ে চলে গেলাম মাঠে। সেদিন মিলব্যারাক মাঠে ধুপখোলা ভার্সাস মিলব্যারাক খেলা। আমি মাঠে যেতেই সবাই চেপে ধরল, বীরু তোকে খেলতে হবে। পাড়ার প্রেস্টিজ। শুনে আমি একটু কাইকুই করি। আমার পরনে লুঙি, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। লুঙি পরে কি খেলা যায়। অবশ্য বাসায় আমার খেলার প্যান্ট আছে, বুট নেই কিন্তু এনক্লেট আছে। কিন্তু বাসায় এখন যাওয়া যাবে না।

আমি লুঙি কাছা দিয়ে, বইখাতা পাড়ার পোলাপানের হাতে দিয়ে খালি পায়ে খেলতে নামি। ইস কী খেলা যে খেলেছিলাম সেদিন! হাফ টাইমের সময় মাঠে হাত পা ছড়িয়ে বসে দুপয়সা দামের আইসক্রিম খাচ্ছি। আমার চারপাশে ছোটখাটো ভিড় লেগে আছে। ভিড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখি বাবা আসছেন। নিশ্চয় কোনও রোগীকে ইনজেকশান দিতে যাচ্ছেন। দেখে আমার হয়ে যায়। যে ছেলেটির হাতে আমার বইখাতা ছিল, তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ছোঁ মেরে বইখাতাগুলো নিয়ে ভোঁ দৌড়। মাঠের সবাই তো হা। কিন্তু বাবা ততক্ষণে আমাকে দেখে ফেলেছেন। ব্যাপারটা বুঝতে পাড়ার ছেলেদের দেরি হয় না।

সেদিন আমার পরিবর্তে কে খেলেছিল মনে নেই। তবে একটা কথা স্পষ্ট মনে আছে, ধুপখোলা গ্রুপ হাফ টাইমের পর আমার দেয়া তিনটে গোল শোধ করেও আরো একটি গোল দিয়ে গিয়েছিল। এই কারণে পাড়ার ছেলেরা ম্যালা দিন আমার বাবার ওপর বিলা হয়েছিল। পাড়ার দেয়ালে দেয়ালে বাবার নামে খাতারনাক পোস্টার পড়েছিল। মিলব্যারাক মাঠে বাবার নামে চলবে না চলবে না জাতীয় শ্লোগানও দিয়েছে ছেলেরা। বাবা কেয়ার করেননি। কিন্তু আমাকে হেভি ধোলাই দিয়েছিলেন। মনে পড়লে এখন বুক কাঁপে। তবুও খেলা আমায় ছাড়েনি। কিংবা আমি খেলাকে।

ক্লাবে এসে বুট খুলে দেখি পায়ে ব্যথার কোনও চিহ্ন নেই। বুটের বাইরে এসে পা দুটো বেশ আরাম পাচ্ছে। কিন্তু ব্যথাটা আছেই। থেকে থেকে চাপা দেয়। আমি ডানপায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। চাপা পড়া ঘাসের মতো রঙ হয়েছে পায়ের। এক সময় প্রায় এরকম গায়ের রঙ ছিল আমার। খেলতে খেলতে রঙটা পাল্টে গেছে। এখন আমার গায়ের রঙ তামাটে।

আমি দেখতে মোটামুটি চলনসই। লম্বা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। বুকের মাপ চৌত্রিশ। পাতলা গোঁফ আছে। আমার চুল উনিশশো একষট্টি সাল স্টাইলে ছাঁটা।

একাত্তরের পর থেকে আমাদের জেনারেশানের ছেলেদের লম্বা চুল রাখা চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আমি কখনও রাখিনি। বারবার ইচ্ছে হয়েছে, রাখা হয়নি বাবার জন্যে। বাবা পছন্দ করেন না। মাসে একবার চুল ছাঁটাতে হবে। এটা বাবার কথা। এই সেদিনও মাসের প্রথমদিকে বাবার সঙ্গে আমাকে সেলুনে যেতে হত। নরসুন্দর সাহেব বাবার। ডিরেকশানে আমার চুল হেঁটে দিতেন। আজকাল বাবা অবশ্য সেলুন পর্যন্ত যান না। কিন্তু চুল হেঁটে এসে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাবাকে এখন দেখাতে হয়। অবশ্য দেখে বাবা কখনও খুশি হন না। দুএকবার চুল হেঁটে এসেও আমাকে আবার সেলুনে যেতে হয়েছে। বাবার পছন্দ হয়নি।

একটা জিনিস আমি এই তেইশ বছর বয়সেও বুঝতে পারি না, অত নিয়মের ভেতর থেকে কী হয় জীবনে। বাবাকে তো জন্মের পর থেকে দেখছি ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠেন। বাড়ির কাছে বুড়িগঙ্গা, ওঠে সোজা চলে যান নদীতে। তার আগে আমাদের সব ভাইবোনকে ডেকে তুলে পড়তে বসান। ডিসপেন্সারিতে যান কাঁটায় কাঁটায় সাতটায়। এর কোনও ব্যতিক্রম দেখিনি। কিন্তু লোকটা জীবনে পেয়েছে কী? সারাজীবন বজলু ডাক্তারের কম্পাউন্ডার। মাস মাইনে চারশো সত্তর টাকা। ফাউ পাওনা বছরে একজোড়া পাজামা, একজোড়া চার পকেটঅলা ফুলহাতা শাদা শার্ট আর একজোড়া বাটার স্যান্ডেল। ছাতা আছে একটা। কমপক্ষে দশটা তালি পড়েছে তাতে। বিক্রমপুরে কানি দুয়েক জমি ছিল এককালে। স্বাধীনতার পর পরই বিক্রি হয়ে গেছে। থাকার মধ্যে সাতটি ছেলেমেয়ে, চারশো সত্তর টাকা মাইনের কম্পাউন্ডারি আর কালীচরণ সাহা স্ট্রিটের একটা তিনতলা বিরাট বাড়ির নিচের তলায় ত্রিশ ফুট বাই বার ফুট মাপের লম্বাটে একটা রুম। গাদাগাদি করে আমরা নটি মানুষ ওই স্যাঁতস্যাঁতে ড্যাম্পপড়া রুমটির ভেতর জীবনযাপন করছি।

এই বাড়িটার একটা ইতিহাস আছে। মালিক ধলেশ্বর বাবুর কোনও উত্তরাধিকারী ছিল না। জীবদ্দশায় ধলেশ্বরবাবু থাকতেন চিলেকোঠায়। বাড়ির ভাড়াটে। সবই হিন্দু। দোতলা তিনতলা মিলে ছত্রিশটা রুম। প্রতি রুমে একটা করে ফ্যামিলি। বেঁচে থাকতে ধলেশ্বরবাবু মাস ভাড়া দিতেন। যে যা দেয়। কিন্তু কে কত করে দিত ধলেশ্বরবাবু ছাড়া অন্য কেউ তা জানত না। বাবা এই চান্সটা নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন। আজ ত্রিশ বছর ধলেশ্বরবাবু মারা গেছেন। বহুকাল। সে কথা আমার মনে নেই। গল্পটা মার কাছে শোনা।

আমার মা, সে আরেক ক্যারেক্টার। মহিলাকে আমি কখনও উঁচু গলায় কথা বলতে শুনিনি। নিঃশব্দে কাঁদতে দেখেছি বহুবার। ভোর পাঁচটা থেকে রাত দশটা অব্দি টানা কাজ করেন। দিনে তাঁকে কখনো ঘুমুতে দেখিনি। অসুখ বিসুখে পড়ে থাকতে দেখিনি। একটার পর একটা ভাইবোন হয়েছে আমার। এই ঘরের ভেতরই সন্তানের জন্ম দিয়ে। দিন দুয়েক বিছানায় থেকেছেন তিনি, তারপর আবার সংসারের কাজ।

কেমন করে যে পারেন। ভাবলে মাথার ভেতর অন্ধকার ঢুকে যায়।

রঞ্জু ভাই বললেন, কী হয়েছে বীরু?

আমি ডান পা দেখিয়ে বলি, ভীষণ ব্যথা করছে।

কেউ মেরেছিল?

না তো!

তাহলে?

বুঝতে পারছি না। রঞ্জু ভাইর হাতে সিগারেট ছিল, টান দিয়ে বললেন, এমনিতেও অনেক সময় ব্যথা হয়। বাড়ি গিয়ে গরম জলে স্যাঁক দে, ঠিক হয়ে যাবে।

আমি একটা সোফার ওপর কাৎ হয়ে শুয়ে আছি। চানটান করে এখন বেশ ফ্রেশ লাগছে। জার্সি খুলে নিজের হাওয়াই শার্ট আর বেলবটম প্যান্ট পরেছি। এর মধ্যে দু রাউন্ড চা হয়ে গেছে। এখন আসবে বিরিয়ানি। আমার আজ খাতিরই অন্যরকম, যা বলব তাই হবে।

কিন্তু পার ব্যথাটা..

বিরিয়ানিটা খেয়েই কেটে পড়ব। বাড়ি দিয়ে গরমজলে বরিক পাউডার ফেলে স্যাঁক দিতে হবে। কিন্তু সাইকেল চালিয়ে যেতে পারব তো?

ধুৎ শালা মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আমি রঞ্জু ভাইর কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে ধরাই। আমি সিগারেট খাই না। আমার বাবাও না। বাবা খান না পয়সার অভাবে, আমি অন্য। কারণে। সিগারেট খেলে দম নষ্ট হয়ে যায়। খানিক দৌড়লেই টায়ার্ড লাগে। প্লেয়ারদের সিগারেট খেতে নেই।

কিন্তু এখন খাচ্ছি আমার মুড অফ হয়ে আছে বলে। সিগারেট খেলে যদি ভালো হয়। আমি সিগারেট খাচ্ছি, কোত্থেকে ইউসুফ ছুটে আসে। কী বে সিগ্রেট খাস ক্যালা?

শুনে আমি হাসি। ইউসুফ ঢাকাইয়া পোলা, খেলে ভালো। কথা বলে যাচ্ছেতাই ভাষায়। আর হেভি মাল টানে।

আমি ইউসুফের কথার জবাব দিই না। একটা সিগারেট খেলে কী হয়! আমি তো কাল সকাল ওঠেই কালিচরণ সাহা রোড থেকে শুরু করে সতীশ সরকার রোড হয়ে, লোহারপুল বাঁয়ে রেখে ভাট্টিখানা হয়ে সোজা ডিস্টিলারী রোড, ধুপখোলা মাঠের চারদিকে ঘুরে দীননাথ সেন রোড ধরে মিলব্যারাক মাঠ পর্যন্ত আমার রেগুলার দৌড়টা দৌড়ে নেব। ফাঁকে শুধু একবার, শুধু একবার স্বপ্নের মতো সেই বাড়িটার সামনে দাঁড়াব। জানালায় আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে সেই মেয়ে। তার রুমে তখনও জ্বলবে নীল ডিমলাইট। লো ভলমে বাজবে ভারি সুন্দর একটা মিউজিক। একটা। সিগারেটের কারণে কি কাল সকালের আমি একটা রোড কম দৌড়াব! ভেবে আমার খুব হাসি পায়।

ঠিক তখুনি কাঁঠালপাতার ঠোঙায় বিরিয়ানি আসে। সঙ্গে সঙ্গে হৈ চৈ, থাবাথাবি। পায়ের ব্যথাটা আছে বলে আমি নড়ি না। সোফায় কাৎ হয়ে শুয়েছিলাম। শুয়েই থাকি। আজ তো আমি হিরো। একমাত্র গোলটি দিয়ে দল জিতিয়ে দিয়েছি। কেউ না কেউ আমার ঠোঙাটা এগিয়ে দেবেই।

দেয়। স্বয়ং রঞ্জু ভাইই। আমি কাৎ হয়ে শুয়ে বিরিয়ানি খাই। খাচ্ছি, খাচ্ছি, নয়ন এসে হাজির।

যাবি না রে?

যাব।

তাড়াতাড়ি খা।

আমি বলি, এক গ্লাস জল দে তো।

পানি ক। নইলে দিমু না।

আমি মৃদু হেসে বলি, আচ্ছা পানিই দে।

নয়ন জল এনে দেয়। ও একটু পাগলা টাইপের। আমাদের এলাকায়ই থাকে। নিজে খেলে না কিন্তু সব খেলায় আছে। আমাদের ক্লাবের মহাভক্ত। প্লেয়ারদের সবার সঙ্গে ওর তুই তুকারি সম্পর্ক।

নয়নটা পাগলাটে হলে কী হবে, কথা বলে খুব মজা করে। যেমন হিন্দুদেরকে এদেশের লোকে মালাউন বলে গাল দেয়। কিন্তু নয়ন বলে ফেরাউন। শুনে আমার বেশ মজাই লাগে।

আমি নয়নকে বললাম, আমার ডান পায়ে খুব ব্যথা হচ্ছে দোস্ত, সাইকেল চালিয়ে বোধহয় যেতে পারব না।

নয়ন বলল, ঠিক হ্যায় আমি চালিয়ে নিয়ে যাব। তুই তোর বোচকাবাচকি ওঠা। তোয়ালে আর ঘামে ভেজা মোজা এসব নিয়ে আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সাইকেলটার সামনে আসি। জিনিসগুলো কেরিয়ারে রেখে তালা খুলে বলি, চল।

.

হারিকেনটা টিমটিম করে জ্বলছে। ঘরের ভেতর আবছা আলোছায়া। ভ্যাপসা গরম পড়েছে কদিন। আর খুব মশা। ভাইবোন সব গাদাগাদি শুয়ে আছে। মা বসে বসে পাঁচ বছরের ছোট ছেলেটিকে বাতাস করছে।

আমি বারান্দায়, আমার রুমে রুম বলতে এক চিলতে বারান্দার দুদিকে বুকা বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি হাত দশেক জায়গা। সরু দুজন মানুষ এক সঙ্গে নড়তে পারবে না, এমন। সাইকেলটা রাখতে রাখতে বলি, একটু গরম জল কর মা।

মা নিঃশব্দে ঘরের কোণে স্টোভ জ্বালেন। সাড়া পেয়ে দিদিও ওঠেছে। দিদির কাশির শব্দ পাই। দিদি আমারচে তিন বছরের বড়। আমার এখন তেইশ দিদির ছাব্বিশ। বাঙালী মেয়েরা কুড়িতে বুড়ি। দিদি বুড়ি হয়েছে ছবছর আগে। দিদির এখনও বিয়ে হয়নি। দিদিটা দেখতে খুব খারাপ। হোঁকা টাইপের শরীর। কালো মোটা ঠোঁট, দাঁত উঁচু। হাসলে বিচ্ছিরি দেখায়। আজ পর্যন্ত কতজন যে দিদিকে দেখে গেল। শুধু দেখাই। কাজ হয়নি। কোন গরিব পাট্টি রাজি হলেও ডিমান্ড করে হেভি। আমার কম্পাউন্ডার বাপ সেসব শুনে ভিরমি খায়। এসব ভাবতে ভাবতে তোয়ালে জাঙে মোজা। অন্ধকার বারান্দায় মেলে দিই। শব্দ পেয়ে খাঁচার ভেতর টিয়েটা শিস দিয়ে ওঠে। পাখিটা তিন বছর এই সংসারে আছে। ছোলাটোলা আজকাল বাবাও এনে দেন। অভ্যেস হয়ে গেছে।

মা বললেন, জল নে।

আমি লুঙি পরতে পরতে দিদিকে বলি, জলটা আন তো। আর একটা কুপি জ্বালিয়ে দিস। এক হাতে টিনের কুপি আরেক হাতে গরম জলের বাটি নিয়ে আসে। কুপিটা চৌকির ওপর রেখে বলল, খাবি না?

নারে, ক্লাবে খেয়েছি।

জিতেছিস?

হা। একটা গোলে। গোলটা আমিই দিয়েছি।

দিদি চলে গেলে আমি এই প্রথম দিদির ভেতর কেমন একটা বিষণ্ণতা খেয়াল করি। দিদিটা কেমন ম্লান হয়ে গেছে আজকাল। আগে খানিকটা উজ্জ্বল ছিল। একটু হাসতটাসত। বহুকাল দিদিকে হাসতে দেখি না। দিদির জন্যে আমার বুকের ভেতরটা। হঠাৎ কেমন তোলপাড় করে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি তার পর আমার পুরনো ছেঁড়া গামছার খানিকটা ভিজিয়ে পায়ে স্যাঁক দিতে থাকি।

রাত বাড়ে। কিন্তু ব্যথাটা কমে না। বাবা এখনও ফেরেন নি। ফিরে যদি দেখেন আমি বসে বসে পা স্যাঁকছি, রাগ করবেন। আমি বাবাকে এসব দেখাতে চাই না। আবার দিদিকে ডাকি। দুটো ব্যথাফ্যাথার ট্যাবলেট দে।

আমাদের ঘরে ব্যথাফ্যাথার ট্যাবলেট কিছু থাকেই। বাবা বিনিমাগনা নিয়ে আসেন। কখন কার লাগে।

দিদি ট্যাবলেট এনে দিলে, খেয়ে কুপি নিভিয়ে শুয়ে পড়ি। দোতলার কোনও ঘরে একটা বাচ্চা কেঁদে ওঠে। তখন অন্ধকার বারান্দায় টিয়েটা মৃদু একটা শিস দেয়। কানের কাছে প্যানপোন করে রাষ্ট্রীয় মশা। টায়ার্ড লাগে তবুও ঘুম আসে না। বাবার কথা মনে হয়। দশটার বেশি বাজে। বাবা এখনও ফেরেন নি। কম্পাউন্ডার মানুষ। বুড়ো ডাক্তার সাহেব চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ ডিসপেন্সারি খুলে বসে থাকেন।

বাবা চেয়েছিলেন আমাকে দিয়ে সাধ পূরণ করতে। আমারও হল না।

বাবা হেরে গেছেন।

প্রথমবার ইন্টারমিডিয়েট ফেল করার পর বাবার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ফুটবল সিজনে ইতিউতি পঞ্চাশ একশো টাকা খ্যাপ মেরে বেড়াই। সেই টাকায় নিজে চলি। মাকে দিদিকে দিই কিছু। বাবাকে জানতে দিই না। অবশ্য তখন থেকেই জানতাম পাশটাশ আমার হবে না। সিজনে খেলে দুপয়সা কামাতে পারব। একটু ভালো খেললে বড় টিমে চান্স। ইয়ারলি কন্ট্রাক্ট। ম্যালা টাকা।

কিন্তু সে কবে?

এসব ভেবে একটা টিউশানি যোগাড় করেছিলাম। তনুগঞ্জ লেনে। ক্লাস এইটের ছাত্রী দিপু। দিপু খুব সুন্দর ছিল। দিপুকে প্রথম দিন দেখেই আমি আমার ছোট্ট নোট খাতায় লিখেছিলাম, দিপু খুব সুন্দর। লেখাটি দিদি কেমন করে দেখে ফেলে। তারপর আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, দিপু কে রে?

আছে একজন।

শুনে ঠোঁট টিপে হেসেছিল।

মাস ছয়েক চালিয়েছিলাম টিউশনি। ততদিন আমার আশা ছেড়ে বাবা চোখ দিয়েছেন। হিরুমিরুর দিকে। ওদের কারো যদি হয়। কিন্তু ওদুটো আরো বাজে ছাত্র। সেভেন এইটেই ফেল করে। ছোট বোনগুলোও গাধা। কাউকে দিয়ে বাবার আশা পূরণ হবে না। বাবা একদম হারু পাট্টি।

অন্ধকার বিছানায় শুয়ে এসব ভাবছি। পায়ে ব্যথা। ঘুম আসে না। বাবার জন্যে দুঃখে মন ভরে যায়। সংসারে কিছু কিছু লোক আছে যাদের কোনও স্বপ্নই সত্য হয় না। বাবা সেই দলের ক্যাপটেন। হারু ক্যাপটেন। দুয়ো।

.

ভোররাতে ঘুম ভেঙে যায়। লোহারপুল মসজিদে তখন আজানের শব্দ। এই শব্দটা বরাবরই আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু আজ ঘুম ভাঙতেই টের পাই ডান পায়ে অসম্ভব ব্যথা। শরীরটাও গরম হয়ে গেছে। আর কেমন একটা অস্বস্তিভাব। গা চুটপুট করে। ব্যথায় জ্বর এসে গেছে।

ওঠে বসব, পারি না। ডান পাটা একদম নাড়তে পারি না।

লোহারপুলের বিমের মতো ভারি হয়ে গেছে।

বিছানায় শুয়ে থেকেই দেখি আবছা অন্ধকারে বাবা চান করতে যাচ্ছেন বুড়িগঙ্গায়।

ভাইবোনরাও সব ওঠে পড়েছে। গুনগুন করে পড়ছে শব্দ পাওয়া যায়।

আমাদের ঘরটা একদম খুপরি। অনেকটা বেলা হলেও বোঝা যায় না। সারাদিন ঘাপটি মেরে থাকে অন্ধকার। সাড়ে সাতটা আটটা পর্যন্ত হারিকেন জ্বালিয়ে, কুপি জ্বালিয়ে পড়াশুনা করে ভাইবোনগুলো। বৃষ্টিবাদলার দিনে সারাদিন হারিকেন জ্বলে ঘরে।

রোজ এসময় আমিও ওঠে পড়ি। ওঠে খেলার প্যান্ট পরি, ডোরাকাটা গেঞ্জি আর কেডস পরে দৌড়াতে বেরুই। কালীচরণ সাহা রোড থেকে শুরু করে সতীশ সরকার রোড হয়ে লোহারপুর বাঁয়ে রেখে ভাট্টিখানা হয়ে সোজা ডিস্টিলারি রোড। তারপর ধূপখোলা মাঠের চারদিক ঘুরে দীননাথ সেন রোড হয়ে মিলব্যারাক মাঠ। দৌড়লে দম বাড়ে। প্র্যাকটিস করতে সাইকেল নিয়ে ক্লাবের মাঠে যাই বিকেলবেলা। গত দুবছর এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আজ আমি ডান পা নড়াতেই পারছি না। দৌড়তে যাব কেমন করে!

খারাপ লাগে। সে আমার অপেক্ষায় জানালায় দাঁড়িয়ে থাকবে। ঘরে তার নীল ডিম লাইট জ্বলবে। মিষ্টি সুরে বাজবে মিউজিক। এই তেইশ বছরের জীবনে ওই একটিমাত্র সুন্দর দৃশ্য আমার অপেক্ষায় থাকে। হায় কতদিন যে ওই প্রিয় দৃশ্যটির কাছে আমার। ফিরে যাওয়া হবে না!

রাগে-দুঃখে আমার কান্না পেতে থাকে।

.

দুপুরবেলা বাবা গম্ভীরমুখে আমাকে একটা ইনজেকশান দিলেন। হিরু বোধহয় ডিসপেন্সারিতে গিয়ে বাবাকে খবর দিয়েছিল। সকাল থেকে আমার বেঘোর জ্বর। পায়ের ব্যথাটা মারাত্মক হয়ে গেছে। কেন যে এরকম ব্যথা হল, কিছু বুঝতে পারি না। ব্যথায় সারা সকাল ককিয়েছি। চায়ের সঙ্গে দুটো ব্যথার বড়ি খেয়েছি। কাজ হয়নি। মার তো আর আমার দিকে চোখ দেয়ার সময় নেই। দিদি আমার সঙ্গে আছে। সকাল থেকে কতবার যে গরম জলে বরিক পাউডার দিয়ে পায়ে স্যাক দিয়েছে। তাতে ব্যথাটা খানিক কমে। স্যাক বন্ধ হলেই আবার বাড়ে। দিদিকে কাহাতক বলব লজ্জা করে।

বাবা ইনজেকশান দেয়ার পর ব্যথাটা আস্তেধীরে কমে আসে। মা পাতলা ট্যালট্যালে বালি দেন খেতে। চোখ বুজে খেয়েই নিই। বালি খাওয়ার অভ্যেস আছে আমার। জন্মে। আমি কখনও দুধ পাইনি। মার বুকের দুধ ছাড়া। আমার কোনও ভাইবোনও পায়নি। ছেলেবেলায় বার্লির সঙ্গে মা আমাদের চালের আটা গুলে খাওয়াত। রাতের বেলা শোয়ার আগে মাকে রেগুলার দেখতাম দুমুঠো চাল ভিজিয়ে রাখতেন। সকালবেলা সেই চাল বেটে বার্লির সঙ্গে জ্বাল দিয়ে রাখতেন। ছেলেবেলায় ওই ছিল আমাদের সারাদিনের খাদ্য।

বিকেলের মুখে, বেরিয়ে যাবার সময় বাবা এক পলক আমাকে দেখে যান। কথা বলেন না। ইনজেকশান দেবার সময়ও বাবা আমাকে কোনও কথা জিজ্ঞেস করেননি।

বাবার কি আমার উপর রাগ! বহুকাল বাবা আমার সঙ্গে কথা বলেন না।

আজ বাবা যখন আমাকে ইনজেকশান দিচ্ছিলেন তখন সেই মারাত্মক ব্যথা এবং জ্বরের ঘোরেও আমি বাবাকে একটু খেয়াল করে দেখি। বহুকাল বাবাকে এত কাছ থেকে দেখা হয়নি। বাবার চেহারাটা কেমন ভেঙে গেছে। দেখে আমার বুকটা কেমন করে। বাবার কত স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হব। দিদির ভালো জায়গায় বিয়ে হবে। কোনও স্বপ্নই সত্য হয়নি। লোকটা চিরকাল হেরে গেল।

.

পাঁচ দিনের মাথায় আমি একটু একটু হাঁটাচলা করতে পারি। ব্যথাটা কমে গেছে। জ্বরও। তবুও মা আমায় বেরুতে দেন না। পাঁচদিন প্র্যাকটিসে যাইনি বলে পরশুদিন রঞ্জু ভাই এসেছিলেন। এসে দেখেন আমি বিছানায়। দেখে তো হা। অনেক প্যাচাল পাড়লেন। ভাগ্য ভালো শিঘ্র আমাদের কোনও খেলা নেই। রঞ্জু ভাই বললেন, আরো সপ্তাহখানেক রেস্ট নে। তারপর তিনশো টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে চলে গেলেন। আমার পথ্যটথ্য লাগবে। বুঝতে পারি এ সবই সেদিনের গোল দেয়ার ফল। কাল বিকেলে বিছানা ছেড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়িময় খানিকটা হাঁটাহাঁটি করেছি। আজ বিকেলে কেন যেন মনে হয় আমার বুঝি পুনর্জন্ম হল। কাল থেকে নতুন করে আমি আবার সব শুরু করব। অবশ্য আরো দুচারদিন ফ্রিলি দৌড়তে পারব না। তবুও কাল সকালে আমাকে বেরুতেই হবে।

আমার অপেক্ষায় সেকী এখনও জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে! নাকি পাঁচ দিনের পা ব্যথা আমার জীবন থেকে প্রিয়তম দৃশ্যটা হরণ করেছে।

সন্ধের মুখে মুখে যখন দিদি ধুপতি জ্বালিয়ে দিয়েছে হিরুর বইপত্র রাখার বাক্সটার ওপর, যেখানে দেয়ালের সঙ্গে ঝুলছে ফুটপাথ মার্কা কালীর বাঁধানো ছবি, তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তারপর দুচাত নমস্কারের ভঙ্গিতে বুকে কাছে তুলে মনে মনে কালীকে বলি, মা মাগো সে যেন আমার অপেক্ষায় থাকে।

কী আশ্চর্য, কথাটা মনে মনে উচ্চারণ করি আর আমার চোখ জলে ভরে আসে, কেন যে!

.

সকালবেলার পৃথিবী খুব সুন্দর লাগছে আজ। ফুরফুরে একটা হাওয়া আছে, ট্যালট্যালে বার্লির মতো আলো ফুটো করে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাড়ি থেকে বেরিয়েই বহুকাল বাদে মনটা বড় ভালো হয়ে যায় আমার।

আজ আমি কেডস পরিনি, খেলার প্যান্ট গেঞ্জি পরিনি। সবুজ রঙের পুরনো লুঙি আর বাঁ বগলের কাছে ফেঁসে যাওয়া পাতলা পাঞ্জাবি পরে বেড়িয়েছি। এখনও ভালো করে হাঁটতে পারি না। ডান পাটা টেনে টেনে হাঁটি। ভালো করে পা ফেললে ব্যথাটা চিলিক দিয়ে ওঠে।

খুঁড়িয়ে হাঁটছি। তবুও আমার মন খারাপ হয় না। কতদিন দেখি না তাকে। আজ দেখা হবে। মা কালীর আশীর্বাদে দোতলার জানালায় ছবির মতো দাঁড়িয়ে থাকবে সে। ঘরের ভেতর জ্বলবে নীল পাতলা আলো। ক্যাসেটে বাজবে মিষ্টি মিউজিক। আহ।

দীননাথ সেন রোডে সেই সুন্দর বাড়ি। ছবির মতন। শাদা দোতলা। সামনে চমৎকার বাগান। বাগানে কত যে ফুল ফুলের মতো ফুটে আছে। বারান্দায় একটা এলসেশিয়ান, গ্যারাজে একটা নীল গাড়ি।

নীল কি এ বাড়ির প্রিয় রঙ!

এসব ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির মুখোমুখি লাইটপোস্টটির তলায় গিয়ে দাঁড়াই। কিন্তু গেটের সামনে একটা লালহোন্ডায় বসে আছে রাজপুত্রের মতো এক যুবক। একটা পা মাটিতে নামানো। কালো প্যান্ট আর সাদার ওপর চক্রাবক্রা শার্ট পরা। বুকের কাছে দুটো বোতাম খোলা, গলায় সোনার চেন। বুকের কাছে লেপটে আছে আধুলির মতো লকেট। হাতে দামি সিগারেট, থেমে থেমে টানছে সে।

এত সকালে এই যুবক কী করছে এখানে! এ বাড়ির কাউকে নিয়ে যুবকের কি দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা!

ঠিক তখুনি দোতলা থেকে চারদিকের পৃথিবী সুন্দর করে নেমে আসে সেই মেয়ে। পরনে তার সমুদ্র রঙের শাড়ি। ব্লাউজ নীল রঙের। কপালে চাঁদের মতো টিপ। নীল রঙের। দেখে আমি সব ভুলে তাকিয়ে থাকি। ঘোর লেগে যায়।

যুবকের হোন্ডার সামনে এসেই মিষ্টি করে হাসল সে। তারপর কী বলে, আমার সে কথা কানে যায় না। আমি অবাক হয়ে তাকে দেখি। ঈশ্বর এত সুন্দর মানুষও তৈরি করেছেন পৃথিবীতে! তার হাসিতে আমি দেখতে পাই, এইমাত্র মনোরম আলোয় ভরে গেল পৃথিবী। কিন্তু সেই মেয়ে একবারও আমার দিকে তাকায় না। সেকি আমায় চিনতে পারে না! সে ততক্ষণে যুবকের হোন্ডার পেছনে চড়ে বসেছে। আমি তার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি নীল সুন্দর স্যান্ডেল পরা। শাড়ি একটুখানি ওঠে আছে। আহ পায়ের রঙ কী তার। পাকা সবরি কলার মতো। আমি অপলক তাকিয়ে থাকি।

বারান্দা থেকে এলসেশিয়ানটা এসে দাঁড়িয়েছে গেটের সামনে। যুবক হোন্ডা স্টার্ট দিতেই সে ডান হাতে যুবকের কোমর জড়িয়ে বলল, গুডবাই।

আমি মনে মনে বলি, গুডবাই। মুহূর্তে চোখের ওপর থেকে দৃশ্যটা হারিয়ে যায়। তখন বুঝতে পারি সে গুডবাই দিয়েছিল কুকুরটাকে।

বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

সেই সময় চার পাঁচজন বৃদ্ধ, সৌম্য সম্রান্ত চেহারায়, দামি লাঠি হাতে দ্রুত আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। বেচে থাকার নেশা। ভোরবেলা হাঁটাহাঁটি করলে পরমায়ু দীর্ঘ হয়ে যায়। এই মুহূর্তে আমি ঠিক বুঝতে পারি না, মানুষ যে কেন দীর্ঘকাল পৃথিবীতে বেচে থাকতে চায়।

আমি আস্তেধীরে সেই বাড়ির সামনে থেকে ফিরে আসি। ফিরে সোজা মিলব্যারাক মাঠ। মাঠে হাঁটাহাঁটি করছে দুএকজন, তাদের চার পাশে আবছা মতন কুয়াশা ঝুলে আছে, আমার চোখে মাঠটা বড় দুঃখী, বড় উদাস দেখায়। মাঠের কোণে স্যান্ডেল দুটো খুলে আমি রাখি। তারপর লুঙি কাছা মেরে, সেই ছেলে বেলা একবার যেমন খেলতে নেমেছিলাম, হুবুহু সেই স্টাইলে মাঠে নামি। ডান পাটা ব্যথা করে। তবু আমার আবার শুরু করতে হবে। আমি আস্তেধীরে দৌড়াতে থাকি। দৌড়াতে থাকি।

গগনবাবুর জীবন চরিত

ভোররাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেন গগনবাবু। ধু-ধু কালো একটা পথ নির্জনে পড়ে আছে। পথের দুপাশে সার ধরা গাছপালা। কোথাও কোনও শব্দ নেই, হাওয়া নেই। পাতলা বার্লির মতো ম্লান একটা আলো ফুটে আছে চারদিকে। সেই আলোয় কালো পথটা বড় অলৌকিক মনে হয়। দূরে বহুদূরে পথের একেবারে শেষ মাথায় সাদা। পাজামা পাঞ্জাবি পরা একজন মানুষ ছোট্ট পাখির মতো ধীরে হেঁটে যায়। কোথায় কোন প্রান্তরের দিকে যায, গগনবাবু বুঝতে পারে না।

ঘুম ভেঙ্গে যায়।

ঘুম ভাঙার পরও গগনবাবু খানিক বুঝতে পারেন না জেগে আছেন, না ঘুমিয়ে। স্বপ্নের শেষ দৃশ্যটা তখনও লেগে আছে তাঁর চোখে। ধু-ধু পথের একেবারে শেষ প্রান্তে ধীরে মন্থর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে একাকী এক মানুষ। দূর থেকে মানুষটাকে দেখায় ছোট্ট পাখির মতো।

তখনি নোয়াব বাড়ির মসজিদ থেকে ফজর নামাযের আজান ভেসে আসে।

তাঁতীবাজার থেকে নোয়াব বাড়ি কাছেই। মাইকে আযানের শব্দটা একদম স্পষ্ট পাওয়া। যায়।

ফজর আযানের আগে পুরোনো ঢাকা বড় শব্দহীন হয়ে থাকে। যেন বা মৃত শহর। কোথাও কোন প্রাণের স্পন্দন নেই। আযানের ললিত সুর সেই শব্দহীনতা ভেঙে খান খান করে দেয়। গগনবাবু জানেন এখুনি আস্তেধীরে জেগে ওঠবে পুরোনো ঢাকা। কাক ডাকবে, কলতলায় ভিড় করবে গৃহস্থ নারীপুরুষ। সময়টা গগনবাবুর খুব প্রিয়।

চোখ মেলে গগনবাবু প্রথমে তার ঘরের ভেতরটা দেখেন। লম্বা ধরনের ঘুপটি মতন একটা ঘর। ঘরের অর্ধেক জুড়ে বহুকালের পুরোনো একটা চৌকি। বাকি অর্ধেকে রান্নাবান্না আর ছেলেমেয়েদের শোয়াপড়ার জায়গা। এই ঘরের ভাড়া ষাট টাকা।

গগনবাবু যখন প্রথম আসেন তখন ভাড়া ছিল পনের টাকা। সে অনেককাল আগের কথা। দিনে দিনে ভাড়া বেড়েছে ঘরের। বাড়িঅলা হরিপদ একটা চামার। ছোট জাতের মানুষ তো, কৈবর্ত, চামার হবেই।

শালা একটা পয়সা কম নেবে না। ছসাতটা খুপরি ঘর ভাড়া দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে রাজার হালে মৌজে জীবন কাটাচ্ছে। কাজকাম কিছুই করে না। ভাড়া তোলে আর খায়। থাকে ছাদের ওপরকার বড় একখানা ঘরে। বাচ্চাকাচ্চা নেই। থাকার মধ্যে আছে। ধুমসি মতন বউটা। বউটা একটু পেটফোলা টাইপের। দেখলে মনে হয় অনন্তকাল ধরে গর্ভবতী হয়ে আছে। কিন্তু সত্যিকার গর্ভবতী সে কখনও হয় না। দোষ বউটার না হরিপদর, কে জানে! গগনবাবুর সময় কোথায় ওসব নিয়ে মাথা ঘামানোর।

গগনবাবুর ঘরের ভেতর এখন এই সকালবেলা একটা অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে। চৌকির একপাশে, মাথার কাছে একটিমাত্র জানালা। দিনরাত খোলা থাকে জানালাটা। হলে হবে কী, আলো যেটুকু আসে তাতে ঘরের অন্ধকার পুরোপুরি কখনও কাটে না। বৃষ্টিবাদলার দিনে তো কথাই নেই, ঘোরতর রৌদ্রের দিনেও অন্ধকারটা গগনবাবুর ঘর থেকে কখনও বেরিয়ে যায় না। চিরকালীন দারিদ্র্যের মতো লেগে আছে।

গগনবাবুর ছেলেমেয়েরা জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে মেঝেতে। হঠাৎ করে তাকালে, বোঝার উপায় নেই ওই অতটুকু জায়গায় পাঁচ পাঁচটি মানুষ শুয়ে আছে।

পাঁচজন মানুষের কী অতটুকু জায়গায় শোয়া হয়।

আহা বড় কষ্ট বাচ্চাগুলোর। দুএকজন ইচ্ছে করলে চৌকির ওপরও শুতে পারে। কিন্তু গগনবাবুর ওই অভ্যেস, অন্যের সঙ্গে এক বিছানায় শুতে পারেন না। এটুকু বনেদিপনা এখনো তার চরিত্রে রয়ে গেছে। ব্যাপারটা সনাতনী বোঝে। ষোল সতের বছর গগনবাবুর ঘর করছে বুঝবে না!

নিজেও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শোয় সনাতনী। বড় শান্তনম আর ঠাণ্ডা প্রকৃতির মানুষ সনাতনী। সারা দিনে কথা বলে দশ পনেরটা। সংসার করে যন্ত্রের মতো। ফজর আযানের পর শুরু করে একটানা চালিয়ে যায় রাত নটা দশটা অব্দি। এর কোন বিরাম দেই। হিসেব করলে দেখা যাবে সনাতনী একা আসলে চার মানুষের কাজ করে। রান্নাবান্না, বাসন কোসন মাজা, ছেলেমেয়েদের জামাকাপড় ধোয়া, কী করে না সনাতনী!

গগনবাবুর বড় মেয়েটির বয়স চৌদ্দ বছর। নাম কমলা। কমলারানী মুখার্জী। ক্লাস নাইনে পড়ে। বড় ঢিলেঢালা স্বভাবের মেয়ে। ঘরসংসারের কাজ একদম বোঝে না। স্কুল আর পড়াশুনো নিয়ে আছে। সকালবেলা ওঠে মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে ভাই-বোনদের নিয়ে পড়তে বসে কমলা। নটার দিকে ওঠে চানটান করে, রুটি আর ভাজিভুজি খেয়ে যায় স্কুলে। ছোট ছেলে দুটোও যায়। ওরা পড়ে মিউনিসিপ্যালিটির প্রাইমারী স্কুলে। একদম ছোট মেয়ে দুটির একটির বয়স তিন বছর আরেকটির এক বছর দুমাস। এক বছর দুমাসেরটি সনাতনীর বুকের দুধ আর সস্তায় কেনা পাতলা ট্যালট্যালে বার্লি খেয়ে বেঁচে আছে। আহা কোনকালে জন্মাল বাচ্চাগুলো। চারদিকে ঘোরতর অভাব, দুর্দিন। সুখের মুখ দেখল না বাচ্চাগুলো। ভালো খাওয়াপরা পেল না।

ভালো খাওয়া পরা কী, দুবেলা পেটপুরে শাকভাতও তো খেতে পায় না।

এসব ভেবে এই ভোরবেলাই বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস পড়ল গগনবাবুর।

নিয়তি!

সব নিয়তি!

নয়তো কী জীবন ছিল গগনবাবুর, কী হয়ে গেছে।

গগনবাবুর ছিলেন বিক্রমপুরের বনেদি হিন্দু। মুখার্জী। বানীখাড়ার ছোটখাটো জমিদার ছিলেন গগনবাবুর বাবা স্বর্গীয় জীবন মুখার্জী।

জীবন মুখার্জীর একমাত্র সন্তান গগন মুখার্জী। গগনবাবু।

গগনবাবু ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন কলকাতা গিয়ে। সঙ্গে দুজন চাকর। টাকা পয়সার অভাব নেই, খাওয়া-দাওয়ার অভাব নেই। মুখ দিয়ে যে জিনিসের নাম উচ্চারণ করতেন, জীবন মুখার্জীর একমাত্র ছেলে, সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটি হাতের কাছে এসে হাজির হত।

আহা! কী জীবন কী হয়ে গেছে। এখন সেই জীবনের কথা ভাবলে বিশ্বাস হয় না। মনে হয় কিচ্ছাকাহিনী।

জীবন মুখার্জী গত হলেন পার্টিশনের আগের বছর। খুবই জাঁদরেল ধরনের মানুষ ছিলেন। দোর্দণ্ড প্রতাপ তার। তার ছেলে গগনবাবু হয়েছেন খুব নিরীহ প্রকৃতির। সরল সোজা। জমিজিরাতের ঘোরপ্যাঁচ যেমন বুঝতেন না তেমন, বুঝতেন না জীবনের ঘোরপ্যাঁচ। ফলে হাতছাড়া হয়ে গেল সব।

পার্টিশনের আগের বছর দেশ জুড়ে ভয়াবহ দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়েছিল। যেসব মুসলমান কৃষক জীবন মুখার্জীর বর্গা জমির দখল ছাড়তে নারাজ তাদের মধ্যে কেউ কেউ জীবন মুখার্জীর একমাত্র উত্তরাধিকার গগন মুখার্জিকে জানে মেরে ফেলার পাঁয়তারা করছিল। রাতের অন্ধকারে গরু কোরাবানি দেয়ার ছুরি নিয়ে আসবে গগন মুখার্জীকে কোরবানি দিতে, কথাটা শোনার পরই সামান্য টাকা-পয়সা যা হাতে ছিল তাই নিয়ে গ্রাম ছেড়েছিলেন গগন বাবু। সে কতকাল আগের কথা। তারপর আর কখন। গ্রামে ফেরা হয়নি গগনবাবুর। এখনও মাঝেমধ্যে গ্রামের জন্যে মনটা বড় কাঁদে। এই তো ঢাকার খুব কাছেই তাঁদের সেই গ্রাম। মুন্সিগঞ্জ থেকে দীঘিরপাড় যাওয়ার পথে পড়ে। সকালবেলা বেরুলে দিনে দিনে ঘুরে আসা যায়। কিন্তু যাওয়া হয়নি গগনবাবুর। সেই ভয়টা মনের তলায় এখন লুকিয়ে আছে। গেলে যদি সেই মুসলমান কৃষকরা কিংবা তাদের উত্তরাধিকার কেউ গরু কোরবানি দেয়ার ছুরি নিয়ে গগনবাবুকে কোরবানী দিতে আসে।

গগনবাবু মৃত্যুকে ভয় পান।

গগনবাবুর আত্মীয়স্বজনরা সব আগেভাগেই গ্রাম ছেড়ে কোলকাতা চলে গিয়েছিল। গগনবাবুরও যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কী যেন কী কারণে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। তাছাড়া কোলকাতা গিয়ে গগনবাবু করবেনই বা কী! তাঁর যাবতীয় আত্মীয়স্বজনই তো কলকাতায় উদ্বাস্তু। উদ্বাস্তুদের কাছে গিয়ে আরেকজন উদ্বাস্তু কেমন করে আশ্রয় নেবে। খড়কুটোর মতো উড়ে তখন দিন কেটেছে গগনবাবুর। কোলকাতায় না গিয়ে তিনি এসেছিলেন ঢাকায়। সেই যে ঢাকায় এসেছেন ঢাকা থেকে আর বেরন নি। দিন কেটে গেছে। তবে খড়কুটোর মতো উড়তে উড়তে এক সময় ভগবানের কৃপা জুটেছিল গগনবাবুর। এজি অফিসে কেরানির চাকরি পেয়েছিলেন। সেই চাকরি এখন আছে। সত্তর টাকা মাইনেয় ঢুকেছিলেন, এখন পান চারশো আশি। তখন ছিলেন একা। এখন না, খাওয়াপরার মানুষ সাতজন। ঘরভাড়া ষাট টাকা। অতিশয় কষ্টের জীবন। তবুও এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন গগনবাবু। অভ্যস্ত হওয়ার কারণ অবশ্য সনাতনী। নিঃশব্দে গগনবাবুর সংসার তৈরি করেছে সনাতনী। সেই সংসার টেনেহিঁচড়ে চালিয়ে নিচ্ছে।

সনাতনীর কথা মনে হতেই গগনবাবুর টের পেলেন, চৌকির ওপর, সনাতনী তার পাশে শুয়ে আছে। রাতেরবেলা কখন ছেলেমেয়ে ফেলে ওঠে এসেছে চৌকিতে গগনবাবু টের পাননি। স্বামীর বুকে মুখ রেখে ঘুমোনোর বড় সাধ তার। এতকালের পুরোনো মানুষ গগনবাবু, হলে কী, সনাতনীর টানটা কমেনি। প্রথম যৌবনের মতো এখন স্বামীর বুকে মুখ রেখে ঘুমোতে চায়। ওভাবে ঘুমোলে একহাতে আবার খামছে ধরে রাখে গগনবাবুর একটা বাহু।

হাতাঅলা কোরা গেঞ্জি পরে শোয়ার অভ্যেস গগনবাবুর। সনাতনী যেদিন তাঁর বুকে মুখ রেখে ঘুমোয় সেদিন ঘুমঘোরে গগনবাবুর বাহুর কাছের গেঞ্জি খামছে ধরে রাখে। যেন ওভাবে ধরে না রাখলে সনাতনীকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে নিঃশব্দে পালিয়ে যাবেন গগনবাবু। এমন এক জায়গায় পালিয়ে যাবেন যেখান থেকে মানুষ আর কখনও ফিরে আসে না।

কথাটা ভেবে আজ সকালে আপন মনে হাসেন গগনবাবু। তারপর সনাতনীর হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চান। সনাতনী ঘুমের ভেতর কেঁপে ওঠে। চমকে চোখ মেলে। স্বামীর মুখের দিকে তাকায়। গগনবাবু কোন কথা বলেন না। গভীর মায়ামমতায় সনাতনীকে চেপে ধরেন।

তখন মেঝেতে শোয়া ছোট মেয়েটি ঘুম ভেঙে হাতের কাছে মাকে না পেয়ে ট্যা ট্যা করে কেঁদে ওঠে। স্বামীর হাত ছাড়িয়ে ওঠে যায় সনাতনী। মেয়েকে দুধ দেবে।

গগনবাবু তারপর আড়মোড় ভেঙে বিছানা ছাড়েন। মাথার কাছে সিজার সিগ্রেটের প্যাকেট আর ম্যাচ থাকে। হাতড়ে হাতড়ে প্যাকেটটা নেন গগনবাবু। ম্যাচটা নেন। তারপর দিনের প্রথম সিগ্রেটটা ধরিয়ে টানতে টানতে ঘর থেকে বেরোন। খানিক পরই বারোয়ারি পায়খানায় লাইন পড়বে। হরিপদর ভাড়াটেরা সব ওঠে লোটাবদনা নিয়ে দৌড়াবে পায়খানার দিকে। তার আগেই কাজটা সেরে রাখা ভালো। পায়খানাটা কুয়োতলার পাশেই। এই ভোরবেলাই কে যেন ঢুকে পড়েছে। কুয়োতলার কাছাকাছি গিয়ে পায়খানার বন্ধ দরোজার দিকে একবার তাকান গগনবাবু। তারপর তাকান কুয়োতলার দিকে। তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নেন।

এতক্ষণে চারদিক বেশ ফরসা হয়েছে। কাঁচা জামরুলের মতন একটা আলো ফুটে ওঠেছে চারদিকে। সেই আলোর তোয়াক্কা না করে গগনবাবুর পাশের ঘরের পাচি, ছাব্বিশ সাতাশ বছরের ধুমসি মেয়েছেলেটা অবলীলায় জল বিয়োগ করছে। দৃশ্যটা দেখে ভারি একটা লজ্জা পান গগনবাবু। পরপর দুবার সিগ্রেটে টান দেন। এক ফাঁকে দেন ছোট্ট একটা গলা খাকারি। গলা খাকারিটা দেন পাচিকে জানান দেওয়ার জন্যে। ভাবখানা এই রকম, ওহে পাচি সাবধান। পর পুরুষে তোমারজল বিয়োগ দেখছে!

কিন্তু পাচি ওসব গা করবার মতো মেয়েছেলে না। লাজলজ্জার বালাই নেই তার। অবলীলায় পরপুরুষের চোখের সামনে কাপড় তুলে বসে যেতে পারে। চান করে বুকের কাপড়-টাপড় ফেলে এতটা বয়স হয়েছে পাচির বিয়ে হয়নি। বিয়ে হয়নি বলেই কি দিনে দিনে অমন বেহায়া আর নির্লজ্জ হয়ে গেছে সে। কুৎসিত সব ক্রিয়াকলাপ ঘটবার সময়ও আশেপাশে তাকিয়ে দেখে না। দেখার প্রয়োজন বোধ করে না। একরাতে জল বিয়োগ করতে বেরিয়ে পাচির অতিশয় জঘন্য একটি ব্যাপার দেখে ফেলেছিলেন গগনবাবু। তার এবং পাচিদের ঘরের পেছন দিকটার সরুগলিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাচি আর সুবল

সুবল গগনবাবুকে দেখতে পায়নি। পাটি পেয়েছিল। কিন্তু তোয়াক্কা করেনি। নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। কী করবে। এতটা বয়স হয়েছে, বিয়ে হয়নি পাচির। বুড়ো বাপের সাধ্য নেই মেয়ে বিয়ে দেয়ার।

কিন্তু মানুষের শরীর বড় অবুঝ। সে কোন শাসন মানতে চায় না।

পাচির শরীরও শাসন মানে না।

কিন্তু এইসব ক্রিয়াকলাপ তো মানুষ মানুষের চোখ বাঁচিয়ে করে। পাচি অত খোলামেলাভাবে মানুষের চোখের ওপর কেমন করে করে! কেন করে?

যে সমাজে একটি মেয়ে শরীরে ভরা যৌবন নিয়ে নিরন্তর ছটফট করে বেড়ায়, সংসারের অভাব অনটনে যে সমাজে যুবতী কন্যার বিয়ে হয় না, সমাজের দশজন মানুষের চোখের সামনে দিনদুপুরে এই কারণেই কি লীলা করে পাচি আসলে বলতে চাইছে, দেখ হে সমাজবাসী, কেমন করে তোমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছি আমি। দেখ আমাকে দেখ। এসব কথা ভাবতে ভাবতে পাচির জন্যে কী রকম একটা মায়া হয় গগনবাবুর। তখন চকিতে একবার ভোররাতে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে তাঁর। ধু-ধু পথের শেষপ্রান্তে একাকী হেঁটে যায় এক মানুষ।

তারপর নিজের চৌদ্দ বছরের মেয়ে কমলার কথা মনে পড়ে গগনবাবুর। হিন্দু ঘরের মেয়ে। বিয়ে দিতে থোক টাকা লাগবে। মেয়ে বিয়ে দেয়ার অত টাকা গগনবাবু পাবেন কোথায়! টাকার অভাবে পাচির মতো কমলারও বিয়ে হবে না। ছাব্বিশ সাতাশ বছর বয়সেও আইবুড়ো থেকে যাবে কমলা। কিন্তু মানুষের শরীর বড় অবুঝ। সে কোন শাসন মানতে চাইবে না। কমলার শরীরও পুরুষ সঙ্গ চাইবে। পাড়ার ছোঁকরারা রাতবিরাতে এসে ঘরের পাশের গলিতে টেনে নেবে কমলাকে। এই অব্দি ভেবে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলেন গগনবাবু।

গগনবাবুর বাবা জীবন মুখার্জীর বড় শখ ছিল একটা মেয়ের। হয়নি। হলেরাজরানীর মতো মানুষ হত মেয়েটি। সোনাদানায় মুড়ে, মালখানগরের জমিদার ললিত মোহনের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতেন। ললিত মোহন ছিলেন বাবার বন্ধু। বন্ধু পুত্রের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেয়ার বড় শখ ছিল তাঁর।

অথচ গগনবাবুর তিনটি মেয়ে। বড়টির বয়স চৌদ্দ। সেটির বিয়ে নিয়ে এখুনি চিন্তায় ঘুম হয় না গগনবাবুর। একেই বলে নিয়তি। সকালবেলার ক্রিয়াকর্ম সেরে, চান টান করে গগনবাবু যখন ঘরে ঢোকেন তখন পুরোনো সংসারটি তার জেগে গেছে। ছেলেমেয়েরা মুখ ধুয়ে পড়তে বসেছে। সকালবেলা ঘরটায় আলো একদমই ঢুকতে চায় না। কুপি জ্বালিয়ে মাটির গাছার ওপর রেখে তার পাশে গোল হয়ে পড়তে বসেছে সবাই। ছোট মেয়েটিকে একটা টিনের বাটির একমুঠ মুড়ি দিয়ে ওদের পাশে বসিয়ে দিয়েছে সনাতনী। একটা দুটো করে মুড়ি খুটে খাচ্ছে মেয়েটি। পাশে সনাতনী কেরোসিনের স্টোভ জ্বেলে চা করছে। এখন এককাপ করে আদা চা আর এক মুঠ করে মুড়ি খাবে ছেলেমেয়েরা। তারপর নটা দশটার দিকে রুটি আর ভাজিভুজি খেয়ে স্কুলে যাবে তিনজন। তার আগে গগনবাবু যাবেন অফিসে।

সকালবেলা বাজার করার নিয়ম নেই গগনবাবুর সংসারে। অফিস ফেরার পথে বাজারটা ঘুরে আসেন তিনি। আনাজপাতি কিনে আনেন। সস্তায় পচাধচা মাছ কিনে আনেন। এতেই সংসার চলে।

দু-পাঁচটা উপরি টাকা আজকাল প্রায়ই পান গগনবাবু। সে টাকায় অফিস ফেরার পথের বাজার খরচটা ওঠে যায়। দুপুরবেলা অফিস ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চা আর দুটো বিসকিট খাওয়া যায়। সকালবেলা তো ভরপেট রুটিভাজি খেয়ে বেরোন। দুপুরবেলা না খেলেও চলে। বাসায় ফিরে রাতে একবার ভাত খাবেন। তারপর চৌকিতে একা শুয়ে ঘুম।

কিন্তু উপরি পয়সাটা পেলে দুপুরবেলা চা বিসকিট খাওয়ার জন্যে মনটা বড় আকুলি বিকুলি করে। মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে চা বিসকিটটা তিনি খান। দিন চলে যাচ্ছে গগনবাবুর।

অফিসে যাওয়ার আগে গগনবাবু আজ অদ্ভুত একটা কাজ করলেন। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরেছেন, পায়ে কদিন আগে সারানো হয়েছে এমন একঝোড়া পাম্প সু, একদম তৈরি হয়ে সনাতনীকে বললেন, এক কাপ চা খাওয়াবে?

ছোট মেয়েটিকে চামচে করে বার্লি খাওয়াচ্ছিল সনাতনী। গগনবাবুর কথায় মুখ তুলে তাকাল। মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেল তার।

কিন্তু সনাতনী মুখের হাসি হাসি ভাবটা দেখলেন না গগনবাবু। তিনি দেখলেন অন্য একটা দৃশ্য। বহুকাল পর সনাতনীকে আজ বড় সুন্দর লাগছে। ফরসা মুখটা পাকা পেয়ারার মতো চকচক করছে। চোখ দুটো বরাবরই খুব সুন্দর সনাতনীর। সেই চোখে আজ অদ্ভুত এক দৃষ্টি। গভীর এক প্রশান্তি। সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর। সনাতনীর সিঁথির সিঁদুর দেখে কেন যে বুকের খুব ভেতরে একটা মোচড় লাগে গগনবাবুর। গগনবাবু মারা গেলে সিঁথির সিঁদুর মুছে যাবে সনাতনীর। সনাতনী আর কখনও সিঁদুর পরবে না।

গগনবাবুর মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়।

সনাতনী এমনিতেই খুব কম কথা বলে। গগনবাবু মারা গেলে কি একেবারেই বোবা হয়ে যাবে।

ভোররাতে দেখা স্বপ্নের কথাটা আবার মনে পড়ে গগনবাবুর। ধু-ধু পথের শেষপ্রান্তে একাকী হেঁটে যায় এক মানুষ।

স্বপ্নের কথাটি কি সনাতনীকে বলবেন গগনবাবু।

সনাতনী ততক্ষণে স্টোভ জ্বেলে চায়ের জল বসিয়েছে। ছোট মেয়েটিকে দিয়েছে কমলার কোলে। মায়ের মতোই বোনকে কোলে বসিয়ে চামচে করে বার্লি খাওয়াচ্ছি কমলা। দৃশ্যটা দেখে পা ঝুলিয়ে চৌকিতে বসেন গগনবাবু। তারপর পকেট হাতড়ে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করেন। ম্যাচ বের করেন। তখন দিনের প্রথম কথাটা বলে সনাতনী। চা খেয়ে নাও। তারপর সিগ্রেট ধরাও। শুনে গগনবাবু একটু চমকে ওঠেন। মনে হয় বহুকাল পর যেন গলা শুনছেন। চায়ে চুমুক দিয়ে ভারি একটা গরম টের পেলেন গগনবাবু। বললেন, ভারি গরম পড়েছে গো। সনাতনী বলল, কাঁঠাল পাকা গরম। এই গরমে গাছের সব কাঁঠাল পেকে যায়।

তারপর হাতপাখা নিয়ে স্বামীর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আস্তেধীরে বাতাস করতে থাকে সনাতনী।

চা শেষ করে সিগ্রেট ধরান গগনবাবু। নটা বাজে। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়া উচিত।

তাঁতীবাজার থেকে এজি অফিস হেঁটে যেতে আধঘণ্টা লাগে।.এখন না বেরুলে সময় মতো অফিস পৌঁছুনো যাবে না।

কিন্তু কেন যে আজ ওঠতে ইচ্ছে করে না গগনবাবুর। অকারণে সনাতনীর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থাকেন গগনবাবু।

সনাতনী বললো, কী দেখছ?

কিছু না।

তারপরে একটু থেমে গগনবাবু বললেন, অফিস যেতে আজ ইচ্ছে করছে না।

তাহলে কাজ নাই গিয়ে।

বাসায় থেকে কি করব?

শুয়ে থাক।

না চলেই যাই। বলে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন গগনবাবু। সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছেলেটা এসে তার হাত ধরে। একটা কাঁঠাল আনবে বাবা।

কথাটা এমন করে বলে ছেলেটা, গগনবাবুর বড় মায়া হয়। ছেলেটার নিশ্চয় কাঁঠাল খাওয়ার সাধ হয়েছে।

আনবেন, নিশ্চয় গগনবাবু আজ একটা কাঁঠাল আনবেন। ছেলের মাথায় হাত রেখে গগনবাবু বললেন, আনব বাবা। আনব।

তারপর কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে ঘর থেকে বেরোন।

বাইরে বেরিয়ে গগনবাবু টের পান বেজায় রোদ ওঠেছে আজ। বেজায় গরমও পড়েছে। সনাতনী বলেছে, এই গরমে গাছের সব কাঁঠাল পেকে যায়। সেই কথা শুনেই বুঝি কাঁঠালের বায়না ধরেছে ছেলেটা। আজ অফিসে গোটা দশেক টাকা উপরি পেলেই হয়। বিকেলবেলা অফিস থেকে বেরিয়ে বড়সড় একটা কাঁঠাল কিনবেন গগনবাবু। কাঁঠালটা কাঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। কাঁঠাল দেখে ছেলেমেয়েরা বড় খুশি হবে। সনাতনী বড় খুশি হবে। ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীর মুখ খুশি দেখা পুরুষ জন্মের শ্রেষ্ঠ উপহার। আজ সেই উপহারটা পাবেন গগনবাবু। কিন্তু অফিসে আজ সকাল থেকেই কিছু কিছু ভুল হতে থাকে গগনবাবুর।

সাধারণত এমন কখনও হয় না তার। আজ কেন যে হচ্ছে।

কাজ থামিয়ে গগনবাবু একটা সিগ্রেট ধরান। তারপর উদাস হয়ে সিগ্রেট টানতে থাকেন। গগনবাবুর পাশের টেবিলে বসে অল্পবয়সী নজরুল। ভারি ফূর্তিবাজ লোক নজরুল। মাথায় উত্তমকুমারের মতো চুল। সুযোগ পেলেই পকেট থেকে কাকুই বের করে চুল আঁচড়ায় সে। এখন তাই করছিল। তবে চুল আচিড়াতে গগনবাবুর উদাস ভঙ্গিতে সিগ্রেট টানাটা খেয়াল করল সে। বলল, কী হইছে দাদা? অমন কইরা সিগ্রেট টানতাছেন?

কথাটার জবাব দিলেন না গগনবাবু। বললেন, খাবেন একটা?

দেন।

কাকুই পকেটে রেখে গগনবাবুর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল নজরুল। সিগ্রেট নিয়ে ধরাল। তারপর একাকী যেন নিজের কাছে বলছে এমন স্বরে বলল, শালা আজব আদমি। আসতেছে না কেন?

গগনবাবু উদাস গলায় বললেন, কে?

আছে এক মক্কেল। একটা কাজ কইরা দিছি। পঞ্চাশটা টেকা দেওনের কথা। পাত্তা নাই হালার।

গগনবাবু আস্তে করে বললেন, আসবে। অস্থির হচ্ছেন কেন?

নজরুল লোকটা ঝোঁকের মাথায় কথা বলে ঝোঁকের মাথায় কাজ করে। বলল, আপনে কইলেন দাদা, আইব!

হ্যাঁ আমার মনে হয়।

পঞ্চাশটা টেকা তাইলে আমি পামু?

পাবেন।

নজরুল আঙুল তুলে বলল, পাইলে দশ টেকা আপনের। ওয়ার্ড ইজ ল।

নজরুলের কথা শুনে ভারি একটা উত্তেজনা বোধ করেন গগনবাবু। দশটা টাকা পেলে কাঁঠালটা কেনা হবে। লাঞ্চ আওয়ারেই হেডক্লার্কের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন। মনটা ভালো লাগছে না। থেকে থেকে স্বপ্নের কথাটা মনে হয়। মনটা বড় উদাস লাগে গগনবাবুর।

সিগ্রেট শেষ করে আবার কাজে মন দেন গগনবাবু।

দেড়টার দিকে নজরুলের সেই মক্কেল এসে হাজির। এসেই নজরুলকে ডেকে নেয় বারান্দায়। দেখে গগনবাবু বুঝে যান দশটা টাকা তিনি পাবেন। উত্তেজনায় চেয়ার ঠেলে ওঠে দাঁড়ান তিনি। মিনিট পাঁচেক পর দামি সিগ্রেট মুঠো করে ধরে, ভারি একটা কায়দা করে টানতে টানতে ফিরে আসে নজরুল। এসে গগনবাবুর হাতে গুঁজে দেয় সবুজ একখানা দশ টাকার নোট। মুখটা একটু গম্ভীর তার। টাকা গুঁজে দিতে দিতে বলল, ওয়ার্ড ইজ ল।

টাকাটা হাতে পেয়ে পরিকল্পনাটা কাজে লাগিয় ফেলেন গগনবাবু। হেডক্লার্কের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। হেডক্লার্ক বুড়ো মানুষ। চুলদাড়ি সব সাদা হয়ে গেছে। তার। মুখে দাঁত আছে গোটা পাঁচেক। খুবই ভালো ধরনের মানুষ। খানিক আগেই বাড়ি থেকে আনা রুটি আর ডিমভাজা দিয়ে লাঞ্চ করেছেন। এখন তারিয়ে তারিয়ে চা খাচ্ছেন। গগনবাবুকে দেখে বললেন, কী?

শরীরটা ভালো নেই স্যার।

বাড়ি যাবেন?

জি স্যার।

চলে যান, চলে যান।

হেডক্লার্ক সাহেব এত সহজে ছুটি দিয়ে দেবেন ভাবেননি গগনবাবু। খুবই খুশি হলেন, তিনি। হাত তুলে হেডক্লার্ক সাহেবকে একটা আদাব দেন। তারপর অফিস থেকে বেরোন।

ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনের কাছে এসে অনেক দরদাম করে সাড়ে চার টাকায় লম্বা মতন বিশাল কাঁঠাল কেনেন গগনবাবু। কাঁঠালটা বেশ পাকা, বেশ ভারি। শিক দিয়ে পাকানো হয়নি। একদম গাছপাকা। দুজায়গায় খারার মাঠের মতো ইরল চিরল ফাটা। সেই ফাটা দিয়ে ভুর ভুর করে বেরুচ্ছে তীব্র গন্ধ। গালা কাঁঠাল হবে। মুড়ি দিয়ে গালা কাঁঠাল, আহা বড় স্বাদের। টাকা তো পকেটে আছেই, সেরখানেক মুড়িও কিনে নেবেন গগনবাবু। তারপর রাতের বেলার সব ছেলেমেয়ে নিয়ে গোল হয়ে বসে কাঁঠাল মুড়ি খাবেন। হাতে সামান্য সরষের তেল মাখিয়ে অতিশয় যত্নে কাঠালের কোয়া খুলে খুলে দেবে সনাতনী।

বনগ্রামের কাছাকাছি এসে গগনবাবু টের পান কাঁঠাল বহন করা কাঁধটা বড় ব্যথা হয়ে গেছে। কাঁঠালটা বেশ ভারি। দশ বার সেরের কম হবে না।

কাঁধ বদল করার জন্যে দুহাতে কাঁঠালটা শূন্যে তুলে ধরেন গগনবাবু। তারপর কায়দা করে অন্য কাঁধে বসাতে যান। হাত দুটো কি মুহূর্তের জন্যে সামান্য কেঁপে যায় গগনবাবুর। কাঁঠালটা ধপ করে পড়ে রাস্তায় তারপর গড়গড় করে গড়িয়ে যায় রাস্তায় একেবারে মাঝে। রাস্তায় ম্যালা গাড়িঘোড়া ছিল, গগনবাবু খেয়াল করেন না। পাগলের মতো দিশেহারা হয়ে ছুটে যান কাঁঠাল ধরতে। ঠিক তখুনি বুনো মোষের মতো গোঁ গোঁ করতে করতে ছুটে আসে ট্রাক। গগনবাবু দুহাতে কেবল ধরেছেন কাঁঠালটা। ট্রাক এসে দলাইমলাই করে দিয়ে যায় কাঁঠালটাকে, গগনবাবুকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গগনবাবু দেখতে পান ধুধু কালো একটা পথ নির্জনে পড়ে আছে। পথের দুপাশে সার ধরা গাছপালা। কোথাও কোন শব্দ নেই, হাওয়া নেই। পাতলা বার্লির মতো ম্লান একটা আলো ফুটে আছে চারদিকে। সেই আলোয় কালো পথটা বড়ো অলৌকিক মনে হয়। দূরে বহুদূরে পথের একেবারে শেষ মাথায় সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা একটা মানুষ। ছোট্ট পাখির মতো ধীরে হেঁটে যায়। কোথায় কোন প্রান্তরের দিকে যায়, গগনবাবু বুঝতে পারেন না।

গাছপালার ভূমিকা

ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে মাথা বের করে সাপটা দেখে চারদিকের ঘন গাছপালায় সকালবেলার রোদ খেলা করছে। ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে গাঁদা ফুলের পাপড়ির মতো রোদের টুকরো এসে ছড়িয়ে পড়েছে বনভূমিতে। চারদিকে পোকামাকড় ডাকছে, কীটপতঙ্গ ডাকছে। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে মধুপোকা, প্রজাপতি আর দু-একটা ফড়িং। কাছে কোথাও কোন ঝোপের আড়ালে কিংবা কোন গাছের ডালে, পাতার আড়ালে বসে মিষ্টি সুরে ডাকছে একটা পাখি। মোলায়েম বাতাসটা আছে। গাছের পাতায় মৃদু কাঁপন তুলে, ফুলের গন্ধ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বনময়। কোথাও কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই দেখে সাপটা তার প্রাচীন লম্বা শরীরটা ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে টেনে বের করে। সামনে কোমল দুর্বাঘাসের ছোট্ট একটা মাঠ উদাস, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে পড়ে আছে। মাঠের পাশে হলুদ ফুলের ঝোপটার কাছে দীর্ঘকায় কী একটা প্রাণী খানিক এদিক যাচ্ছে খানিক ওদিক যাচ্ছে। স্থির হয়ে প্রাণীটার দিকে তাকায় সাপটা। তারপর বুঝতে পারে, প্রাণীটা মানুষ। মানুষ দেখে মেজাজটা বিগড়ে যায় তার। এই সময় অন্য কোনও বিপজ্জনক জীব দেখলে মাথায় রগ চড়ে যায়। খানিকটা ভয়ও হয়। মানুষকে বিশ্বাস নেই।

সাপটা তবুও ধীরমন্থর গতিতে দুর্বাঘাসের মাঠটা পাড়ি দেয়। খানিক চলেই থামে সে। মাথা তুলে মানুষটার গতিবিধি লক্ষ্য করে। এক সময় দেখে, ফুলের ঝোপ পেরিয়ে গাছপালার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। দেখে বড় নিশ্চিন্ত হয় সে, বড় খুশি হয়। মাঠ ভেঙে, একটা ঝোপের আড়াল দেখে, বুকের তলায় নরম ঘাস এবং মাথার ওপর মিঠেল ছায়া দেখে লম্বা শরীরটা বিছিয়ে দেয়। বয়স হয়েছে। খানিক চলাচলেই ক্লান্তবোধ করে সে। বসন্তকালেও সকালবেলার রোদে বেশ তেজ। মাথাটা ঘাসের ওপর রেখে পড়ে থাকে সাপটা। বনভূমির ভেতর কোথায় কী ঘটছে খেয়াল করে না সে।

.

বুড়ো মানুষটা কাল রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছে। ভোররাতের দিকে। দেখে, মাথার কাছে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। স্ত্রীকে দেখে স্বপ্নের ভেতরও চমকে ওঠেছে সে। স্ত্রী মারা গেছে সাত বছর। তাহলে মাথার কাছে এসে দাঁড়াল কোত্থেকে!

মানুষটা অবাক হয়ে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছে, তুমি?

মাথার ঘোমটা টেনে স্ত্রী বলেছে, তুমি আমাকে চিনতে পার না! সাত বছরেই আমার কথা ভুলে গেছ?

মানুষটা তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। কতকাল হয়ে গেল তোমাকে দেখি না। বয়স হয়ে গেছে, চোখে ছানি, কোনও কিছুই ঠিকঠাক চিনতে পারি না আজকাল।

শুনে স্ত্রী হাসে। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় মানুষটার। তোমাকে ফেলে আমি একদম থাকতে পারছি না। বড় অশান্তি, বড় মন খারাপ। তুমি কেমন আছ গো?

শুনে স্বপ্নের ভেতরেই মানুষটার চোখে জল এসে গেছে। সংসারে বড় অশান্তি। ছেলেরা দেখতে পারে না। ছেলের বউরা দূর দূর করে। নাতি নাতনিরা গালাগাল দেয়। খেতেপরতে গঞ্জনা, ওঠতে বসতে গঞ্জনা। সংসারের বাড়তি মানুষ হয়ে গেছি আমি। কাজকাম করতে পারি না। দুটো টাকা কামাবার মুরোদ নেই। ছেলেদের ঘাড়ে বসে খাই। কী করব বল, গায়ে জোরবল নেই। চোখে ছানি। দশ কদম হাঁটলে জান বেরিয়ে যায়। এইভাবে বেঁচে থাকতে ভাল্লাগে না। আমাকে তুমি নিয়ে যাও।

স্ত্রী বলল, দুঃখ কর না। আমি তোমাকে নিয়ে যাব।

তখন হাসি ফুটে ওঠেছিল মানুষটার মুখে। স্ত্রীর একটা হাত টেনে এনে দুহাতে নিজের বুকে চেপে ধরেছে। সত্যি বলছ তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?

তারপরই ঘুম ভেঙে গেছে। তখন সকালবেলার আলো মাত্র ফুটেছে।

ছেলেরা গাইগরু নিয়ে, লাঙল-জোয়াল নিয়ে মাঠে চলে গেছে। বউরা ওঠে সংসারকর্মে মন দিয়েছে। নাতি নাতনিরা কেউ ওঠেছে কেউ ওঠেনি। মানুষটা তখন বিছানা ছেড়েছে। তারপর ঘাট সেরে পুকুরে গিয়ে অজু করেছে। নামাজ পড়ে, টুপিটা মাথায় হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে বাড়ির কাছের এই নিরালা বনভূমিতে। জায়গাটা খুব প্রিয়। তার। চারদিকে গাছপালা ঝোপঝাড়। ঘাস ফুল প্রজাপতি পাখি। সর্বোপরি অগাধ নির্জনতা। এখানটায় এলেই বুকভরে শ্বাস টানা যায়। সংসারের জটিলতার কথা, দুঃখ দারিদ্রের কথা, গঞ্জনা ও একাকিত্বের কথা মনে পড়ে না। মানুষটা বড় স্বস্তি পায়। কিন্তু আজ এখানটায় এসেও স্বস্তি পাচ্ছে না মানুষটা। স্বপ্নের কথা মনে পড়ছে। স্ত্রীর কথা মনে পড়ছে। স্ত্রী বলেছে, তাকে নিয়ে যাবে। এ কথার মানে কী!

মনের ভেতরে কু-ডাক ডাকে। বুকটা আনচান করে মানুষটার। স্থির থাকতে পারে না সে। বয়সী দুর্বল শরীরেও বনভূমিটা চষে ফেরে সে। মাথার ওপর পাখি ডাকে, চারদিকে ডাকে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ, সে শুনতে পায় না। বনে অনেক ফুল ফুটেছে, ফুলে ফুলে উড়ছে মধুপোকা, প্রজাপতি, সে দেখতে পায় না। মোলায়েম বাতাসে ফুলের মৃদু গন্ধ, সে টের পায় না। তার মনের ভেতর বসে স্ত্রী কেবল বলছিল, তোমাকে আমি নিয়ে যাব। এই দুঃখী সংসারে তোমাকে আমি আর রাখব না।

.

বনের গাছপালা দেখে পৃথিবীতে ভারী সুন্দর একটা সময় শুরু হয়েছে। বসন্তকাল। সূর্যের মিষ্টি তেজ পড়েছে তাদের ওপর। চমৎকার হাওয়া বইছে। ঝোপঝাড়ে ফুটেছে ফুল, ফুলে উড়ছে মধুপোকা, প্রজাপতি। ঘাসবনে মন খুলে ডাকছে পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ। তাদের ডালে বসে ডাকছে পাখিরা। বনের বয়সী একটা সাপ সুন্দর একটা ঝোপের মিঠেল ছায়ায় শুয়ে আরামে ঘুমুচ্ছে। বসন্তকালীন রোদও সইতে পারে না সাপটা। আর আছে, প্রায়ই বনে আসে যে বুড়ো মানুষটা, সে। মানুষটা বুঝি আজ খানিকটা অস্থিরচিত্ত। বনময় চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছে। দেখে গাছপালারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আহা বাছা, তোমার মনে কিসের দুঃখ!

তারপর মন খারাপ করে গাছেরা তাকায় দূরপ্রান্তে। দেখে পরস্পর পরস্পরের হাত ধরাধরি করে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে অল্পবয়সী একজোড়া মানব-মানবী। চেহারায় স্বপ্ন আর উদভ্রান্তির চিহ্ন তাদের। বনভূমির কাছাকাছি এসে মেয়েটি বলল, আমি আর হাঁটতে পারছি না। চল বনের ভেতরে, গাছপালার ছায়ায় বসে একটু জিরিয়ে নেই। ছেলেটি মৃদু হেসে মেয়েটির দিকে তাকায়। ছোটখাটো মিষ্টি চেহারার মেয়েটি। তীব্র লাল রঙের একটা শাড়ি পরেছে। তার বেণী করা লম্বা চুল কালনাগিনীর মতো পড়ে আছে পিঠে। কোমল পা দুটো ধুলোয় ধূসরিত। ছেলেটির একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল সে। মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। তার সুন্দর চোখ দুটো রাত্রি জাগরণের ফলে বসে গেছে।

মেয়েটির মুখে তাকিয়ে গভীর ভালোবাসায় ছেলেটির বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে। ছেলেটির পরনে সাদা পাজামা আর নীল রঙের ফুলহাতা শার্ট। মাথার কোঁকড়া চুল উসকো-খুসকো। বেশ কয়েকদিন ক্ষৌরকর্ম করা হয়নি বলে মুখের দাড়িগোঁফ বনভূমির দুর্বাঘাসের মতো। এসবের ফাঁকফোকর দিয়েও তার চেহারায় অদ্ভুত একটা স্বপ্ন, দুশ্চিন্তা আর উদভ্রান্তির মিশেল দেখা যায়। হাতে তার বেতের একটা স্যুটকেস। ধুলোবালি লেগে পাজামার পায়ের কাছটা মলিন। দেখে বোঝা যায়, বহুদূর পাড়ি দিয়ে এসেছে, বহুদূর যাবে। মেয়েটির মতো সেও ছিল অতিশয় ক্লান্ত।

তবুও ছেলেটি বলল, লঞ্চঘাট খুব একটা দূরে নয়। একবার লঞ্চে ওঠে বসতে পারলে নিশ্চিন্তে জিরানো যেত।

মেয়েটি বলল, লঞ্চঘাট খুব একটা দূরে নয়। বহুদূর চলে এসেছি আমরা। এখানে আমাদের কেউ চিনবে না। তাছাড়া ভীষণ খিদে পেয়েছে আমার।

রাতে কিছু খাওনি?

ওরকম দুশ্চিন্তায় খেতে পারে কোনও মানুষ!

কিসের দুশ্চিন্তা?

এবার মেয়েটি খুব সুন্দর করে হাসে। তুমি বলেছিলে দুপুররাতে আমাদের বাড়ির পেছন দিকের বাগানে থাকবে। আমি খুব সাবধানে, মা বাবা ভাইভাবীদের চোখ এড়িয়ে আমার স্যুটকেস গুছিয়েছি। তারপর নিজের ঘরে শুতে গেছি। খেতে বসেছিলাম ঠিকই, খেতে পারিনি। আমার ঘরে আবার আমাদের বাড়ির কাজের বুড়িটা থাকে। যুবতী মেয়ে একলা ঘরে থাকে কেমন করে। কিন্তু চিন্তা হল ঘর থেকে স্যুটকেস হাতে বেরুবার সময় বুড়িটা যদি টের পেয়ে যায়। তুমি তো জানোই আমাদের বাড়িতে এমনিতেই ম্যালা লোকজন। বাবা বড় গেরস্ত, ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান। রাত-দুপুরঅব্দি লোকজন আসা-যাওয়া করে তার কাছে। তুমি বাগানে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে আর আমি যদি না বেরুতে পারি! কেউ যদি ব্যাপারটা জেনে যায়, তাহলে তো আর রক্ষা নেই। ঘরে তালাবন্ধ করে দুদিনের মধ্যে বাবা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। তাহলে মরে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও উপায় থাকবে না। জীবনে যদি তোমাকেই না পেলাম তাহলে বেঁচে থেকে লাভ কী। বল এরকম অবস্থায় মুখে খাবার রোচে কারো!

ততক্ষণে বনভূমির ভেতরে ঢুকে গেছে দুজনে। মেয়েটি বলল, বা কী সুন্দর নিরিবিলি জায়গা। এখানে কিন্তু অনেকক্ষণ জিরাব।

ছেলেটি আমতা আমতা করে বলল, লঞ্চ!

তুমি না বললে ওই স্টেশনে দুতিন ঘন্টা পরপর একটা করে লঞ্চ আসে।

তা আসে।

তাহলে আর কি! এখনতো আর আমাদের কোনও তাড়া নেই। যে কোনও একটা লঞ্চ পেলেই হবে। যখন ইচ্ছে শহরে গিয়ে পৌঁছুলেই হবে।

কিন্তু

কী?

তোমার বাবা যদি এই স্টেশানেও লোক পাঠায়।

এতদূরে কাউকে পাঠাবে না। আমরা যে এই পথে যাচ্ছি তা সে অনুমানই করতে পারবে না। তাছাড়া

কী?

লোক পাঠালেই আমাকে ধরে নিতে পারবে নাকি! তুমি তো আর জোর করে আমাকে নিয়ে পালাচ্ছ না। আমি ইচ্ছে করেই তোমার সঙ্গে এসেছি। একবার যখন তোমার হাত ধরে পথে নেমেছি, মরে গেলেও আর ফিরে যাব না।

তোমার বাবার অনেক ক্ষমতা। যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন তিনি।

এখন আর কিছুই করার নেই তার। আমি তো একবার ভেবেছিলাম, বিয়ে ঠিক করলে সোজা তোমাদের বাড়ি গিয়ে ওঠব। সেখানেই তোমার বউ হয়ে থেকে যাব। তুমি সাহস পেলে না।

একটা বনফুলের ঝোপ দেখে তার ছায়ায় হাতের স্যুটকেসটা নামিয়ে রাখল ছেলেটা। মেয়েটাও বসে পড়ল। কিন্তু ছেলেটা দাঁড়িয়ে থেকে চারদিকে তাকাচ্ছিল। তারপর কাছেপিঠে কেউ নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে সেও বসে পড়ল মেয়েটির পাশে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ওভাবে তোমাকে নিয়ে গ্রামে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। তোমার বাবা আমাকে ধরে নিয়ে, গলা কেটে লাশটা গুম করে ফেলত। কেউ টেরও পেত না। তাছাড়া, আমার মতো একটা ছেলের কাছে তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে দেবেনই বা কেন বল! কোনও কারণ তো নেই।

ওময়েটি অবাক হয়ে বলল, কীরকম?

আমি গরিবঘরের বেকার ছেলে। লেখাপড়া যেটুকু শিখেছি তাতে শহরে গিয়ে যে চাকরি করব, হবে না। আবার মাঠে গিয়ে যে চাষাবাস করব, তাও পারি না। দেশের সবচে খারাপ শ্রেণী হল আমার মতো এই শ্রেণীটা। এই শ্রেণীর লোকের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দেয় না। এদের প্রেম-ভালোবাসায় যাওয়াই উচিত নয়।

মেয়েটি বিরক্ত হয়ে বলল, এখন ওসব কথা বল না তো। আমার ভালো লাগছে না। খিদে পেয়েছে।

ছেলেটি দুঃখী গলায় বলল, কিন্তু এখানে তোমাকে আমি কী খাওয়াব।

মেয়েটি কোনও কথা বলে না মুচকি হেসে স্যুটকেস খোলে। তারপর একটা পোটলা বের করে ছেলেটির পায়ের কাছে মেলে দেয়। তাতে কিছু সুস্বাদু পিঠা, নারকেলের নাড়, চালকুমড়োর মোরব্বা। দেখে চোখ দুটো চকচক করে ওঠে ছেলেটির। কাল রাতে তারও কিছু খাওয়া হয়নি। এখন পায়ের কাছে সুস্বাদু খাদ্য দেখে খিদে নাড়িভুঁড়ি লাফিয়ে ওঠে।

ছেলেটি বলল, এগুলো।

স্যুটকেসে ভরে রেখেছিলাম। পথে যদি খিদে পায়!

তুমি খুব সংসারী মেয়ে হবে।

মেয়েদের এসব বুঝতে হয়, বলে একটা পিঠা তুলে ছেলেটিকে খাইয়ে দেয় মেয়েটি। ছেলেটিও খাইয়ে দেয় তাকে। দুজনের চেহারায় ফুটে ওঠে পরিতৃপ্তির একটা চিহ্ন! ক্লান্তি দূর হয়ে যেতে থাকে।

খাওয়া শেষ হলে ছেলেটি বলল, এখন পানি পাব কোথায়?

মেয়েটি কোনও কথা না বলে স্যুটকেসের ভেতর থেকে পানিভর্তি একটা বোতল বের করে। দেখে ছেলেটি বলল, তাই তো, স্যুটকেসটা এত ভারি ছিল কেন এখন বুঝতে পারছি।

তারপর ঢকঢক করে বোতল থেকে পানি খায় সে।

মেয়েটি বলল, পেটে খাবার থাকলে যে কোনও বিপদে মানুষ খানিকটা শক্তি পায়। বলে নিজেও বোতল থেকে পানি খায়।

ছেলেটি বলল, তুমি সত্যি খুব লক্ষ্মী মেয়ে। তারপর ঝোপের একটা ডাল টেনে, কয়েকটা বনফুল ছিঁড়ে মেয়েটিকে দেয়। নাও।

মেয়েটি পেছন ফিরে বলল, পরিয়ে দাও।

ফুলগুলো মেয়েটির বেণীর ভেতর গেঁথে দিল ছেলেটি।

মেয়েটি তারপর ছেলেটির কোলে মাথা দিয়ে গুটিসুটি শুয়ে পড়ে।

ধীরে মেয়েটির মাথায় ভালোবাসার হাত বুলিয়ে দেয়।

মেয়েটি বলল, কি ভাবছ?

ভাবছি শহরে গিয়ে বন্ধুর বাসায় ওঠব। কিন্তু কতদিন একজনের ঘাড়ে থাকা যায়। এই বিদ্যেয় চাকরি জুটবে না। কেমন করে চলব তোমাকে নিয়ে!

ওসব এখন ভাবতে হবে না।

না ভেবে উপায় কি বল। ঝোঁকের মাথায় তোমাকে নিয়ে পালালাম, শেষটা যদি সামলাতে না পারি।

শেষটা মানে!

যদি তোমাকে ঠিকমতো খাওয়াতে-পরাতে না পারি।

সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

কেমন করে হবে?

আমি আমার সব গয়নাগাটি সঙ্গে নিয়ে এসেছি। বেশকিছু টাকাও আছে। ওই টাকা আর গয়না বিক্রি করে মোটামুটি ভালো একটা টাকা হবে তোমার। তোমার বন্ধুর বাসায় মাসখানেক থাকতে পারব না আমরা?

তা পারব।

ওই একমাসের মধ্যে তুমি সব গোছাবে।

কি গোছাব?

গয়না বেচার টাকা, আমার নগদ টাকা একত্র করে তুমি একটা ছোটখাটো দোকান করবে। তারপর একটা বাসা ভাড়া করে আমরা সেই বাসায় ওঠে যাব। আমরা কোনও পাপ করিনি সুতরাং আল্লাহ আমাদের সহায় হবে। দেখো তুমি খুব উন্নতি করবে। প্রচণ্ড আবেগে ছেলেটি কোনও কথা বলতে পারে না। চোখে জল আসে তার। মেয়েটি তখন আস্তেধীরে ঘুমিয়ে পড়ছিল।

.

মাথার ওপর দাঁড়িয়ে প্রেম-ভালোবাসার একটা মনোরম দৃশ্য দেখে বনের গাছপালা। বনফুল ঝোপটার আড়ালে, ছায়ায় বসে আছে একজন যুবা পুরুষ। আর তার কোলে মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে যুবতী এক নারী। একপাশে রাখা আছে বেতের স্যুটকেস। সামনে অবহেলায় পড়ে আছে খাদ্যদ্রব্য বাঁধার ন্যাকড়াটা, জলের খালি বোতল। বহুদূর থেকে এসেছে তারা, বহুদূর যাবে। দেখে গাছপালাদের বলতে ইচ্ছে করে, সুখে থাকো। বাছারা, সুখে থাকো। কিন্তু গাছপালারা কথা বলতে পারে না। ঈশ্বর তাদের কথা বলতে বারণ করেছেন।

মন খারাপ করে অন্যদিকে মুখ ফেরায় গাছেরা। তখন দেখতে পায়, দীর্ঘকায় বুড়ো মানুষটা ক্লান্ত হয়ে জিরাতে বসেছে একটা ঝোপের মিঠেল ছায়ায়। দেখে চমকে ওঠে তারা। বিষধর প্রাচীন সাপটা যে ওখানেই নিদ্রামগ্ন। শব্দ পেলেই, শরীরে স্পর্শ পেলেই মাথায় রাগ চড়ে যাবে তার, দংশাবে।

গাছপালাদের ইচ্ছে করে মানুষটিকে ওখান থেকে সরিয়ে আনে। কিন্তু তারা চলাফেরা করতে পারে না। ঈশ্বর তাদের চলাফেরা করতে বারণ করেছেন। ভয়ে ঝিম মেরে থাকে বনের সব গাছপালা।

.

অনেকক্ষণ হাঁটাচলার ফলে ভারী একটা ক্লান্তি বোধ করে বুড়ো মানুষটা। ঝোপের আড়ালে বসে হাত পা মেলে দেয় সে। তখনি ডানহাতে শীতল একটা ছোঁয়া পায়। কচুরিপানা ভর্তি পুকুরের জল শীতকালে যেমন হিম হয়, স্পর্শটা সেরকম। চমকে হাতটা টেনে নেয় সে। তার আগেই সুখন্দ্রিায় বিপ্ন দেখে ফুঁসে ওঠেছে সাপটা। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেছে তার। মাথায় রাগ চড়ে গেছে। পাতার মতো ফনা তুলে মুহূর্তেই রাগটা ঝেড়ে দিল সে।

তারপর বুড়ো মানুষটার দীর্ঘ চিৎকারে কেঁপে ওঠে বনভূমি। দুঃখে নীরব হয়ে থাকে অসহায় গাছপালা। ভয় পেয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় সাপটা। বসন্তকালীন মোলায়েম বাতাসটা মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। একটাও পাতা নড়ে না। কোথাও রোদ থাকে স্থির হয়ে। ফুল কোন গন্ধ দেয় না। মধুপোকা, প্রজাপতি ওড়ে না। ঘাসবনের পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ স্তব্ধ হয়ে যায়। যুবাপুরুষের কোলে শুয়ে থাকা যুবতীটি ভয় পেয়ে লাফিয়ে ওঠে। ছেলেটি একহাতে স্যুটকেস অন্য হাতে মেয়েটির একটা হাত ধরে দৌড়াতে শুরু করে।

নিরীহ গাছপালা নীরব দর্শক হয়ে জগৎসংসারের এইসব খেলা দেখে।

গাহে অচিন পাখি

হাওয়ায় কী একটা ভাজা পোড়ার গন্ধ ওঠে। ভারী মনোহর। সেই গন্ধে মাছচালার ধুলোবালি থেকে মুখ তোলে বাজারের নেড়িকুত্তাটা। তারপর প্রথমেই তার প্রভু পবন ঠাকুরকে খোঁজে। নেই। গন্ধ আর প্রভুর টানে কুত্তাটা তারপর ওঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে পুরোনকালের রোঁয়া ওঠা মদ্দা শরীরখান টানা দেয়। তখন দেখে দূরে খাদ্যি খাওয়ার দোকানটার সামনে প্রভু বসে আছে। গন্ধটাও সেদিক থেকেই আসছে।

কুত্তাটা তারপর কিছু না ভেবে গন্ধের দিকে, প্রভুর দিকে ছুটে যায়।

.

আমার বাপে আছিল ডাকাইত। বিরামপুরের বুড়া মাইনষের মুখে হোনবেন কেষ্ট ঠাকুরের নাম ডাক। মাইনষে কইত কেষ্টা ডাকাইত। যাগ বয়েস পাঁচ কুড়ি ছয় কুড়ি। আমার বাপের নামে হেই আমলে গেরস্তরা রাইত্রে গুমাইত না। রাইত্রে বিচনায় হুইয়া পোলাপান কানলে বউ-ঝিরা কইত, কেষ্টা আইল। কেষ্টার নামে পোলাপানেও ডরাইত। কান্দন থামাইত, গুমাইয়া পড়ত। গেরামে গেরামে মাইনষে চকি দিত। দল বাইন্দা। কেষ্টারে ঠেকাও। অইলে অইব কী, কাম অইত না। বাপে আমার ঠিকই মাইনষের মাতায় বাড়ি মারত। সব্বশান্ত করত। দিবেননি কত্তা একখান আমিত্তি? লতিফ ময়রা। খুব মনোযোগ দিয়ে রসে ডোবা আমৃত্তি তুলে মাটির ঝুঁজরে রাখছিল। ঝাজরের নিচে। বসানো একখান বালতি। আমৃত্তির রস চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে তাতে।

লতিফ বসে আছে মাটি থেকে হাতখানেক উঁচু একটা চৌকির ওপর। তার ডান দিকে দোকানের ভেতর মিষ্টির আলমারি। ওপরের দুটো রেকে সাজানো চমচম, বালুসাই কালোজাম, সন্দেশ, আমৃত্তি ও গজা। আর নিচের রেকে পেতলের বিশাল গামলায় রসে ডোবা রসগোল্লা, লালমোহন ছানার আমৃত্তি। সারা দিনে সতের বার আলমারির কাঁচ মোছে লতিফ। পদ্মার জলের মতো ঘোলা কাঁচ। একটার এক কোণা ভাঙ্গা। আর দুটোতে হিজিবিজি ফাটল। হলে হবে কী, কাঁচ পাল্টায় না লতিফ। অযথা পেচ্ছাব পায়খানার মতো কিছু পয়সা বেরিয়ে যাবে। দরকার কী! ভাঙ্গা আলমারি কি কম দেয়!

লতিফের বা দিকে দোকানের বাইরে পরপর সাজানো আঁঠালো মাটির তিনখান আলগা চুলা। একখান দুমুখী আর একখান একমুখী। দুমুখীটায় বিয়ানরাতে এসে তুলে দেয় পুরোনকালের বিশাল একটা কেটলি। হ্যাঁন্ডেলে ছেঁড়াখোঁড়া কাপড় জড়ানো। তাপে তাপে পোড়া মাটির রং ধরেছে।

কেটলির মুখে পাতলা কাপড় দোপাল্লা করে বাঁধা। ছাঁকনি। রাত একপ্রহর অব্দি চায়ের জল ফোটে কেটলিতে। বিয়ানরাতে একবার মাত্র পদ্মার জল আর চা পাতা ছেড়ে চুলায় ওঠায়। তাতেই রাত একপ্রহর অব্দি চলে।

গাঁও গ্রামের লোকে আর কত চা খায়। তবুও পুরো এক কেটলি চা শেষ হয় লতিফ ময়রার। আর তিন-চার সের দুধ।

দুধের কড়াইটা থাকে কেটলির পাশেই। দুমুখী চুলার অন্যটায়। চায়ের গেলাস, চিনির টোফা থাকে লতিফের পায়ের কাছে। চুলার সঙ্গে। গাহাকরা চাওয়া মাত্রই কেটলিটা গেলাসের ওপর একটুখানি কাৎ করে লতিফ। তারপর গোল চামচে একচামচ দুধ, ছোট্ট চামচে দেড় চামচ চিনি। হাতের মাপ বটে লতিফের। একফোঁটা দুধ এদিক-ওদিক হয় না, এক রোয়া চিনি। এসবই অভ্যেস। বহুকালের।

লতিফের দোকানটা ছোট। দোকানের ভেতর মিষ্টির আলমারিটা, কিছু হাড়ি পাতিল বস্তা আর চৌকিটা ছাড়া অন্য কিছু থোয়ার জায়গা নেই লতিফের। গাহাকরা বসে সব বাইরে। বাইরে, লতিফের দোকানের সামনেটা খোলামেলা। একদিকে লতিফের চুলাচাক্কি আর অন্যদিকে লম্বা একখান টেবিল। পায়া নড়বড় করে তার। টেবিলের দুপাশে লম্বা দুখানা বেঞ্চি। বেঞ্চির গা ঘেঁষে লতিফের দোকানের দুনম্বর ঝাঁপ ঠিকানা দেয়ার বাঁশটা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে। অন্যটা চুলার কাছে।

সবই অনেককালের পুরানো জিনিসপত্র। কিছুই বদলানো হয়নি লতিফের। পাই পাই হিসেব করে এই অব্দি এসেছে। সংসারটা ভারী লতিফের। সাতখানা পোলাপান। আর একখান আছে বউর পেটে। মাস দুয়েক বাদে নাজেল হবে। বুড়ি মা আছে। আর একটা ঢ্যাংগা বোন। কুড়ির ওপর বয়েস। বিয়ে দেয়া হয়নি। টাকা-পয়সার অভাব।

ভোর থেকে রাত দশটা অব্দি দোকান চালায় লতিফ। তারপর ক্যাশবাক্স খালি করে টাকা-কড়ি বাধে তফিলে। দোকানে ভারি চারখান তালা লাগায়। তারপর দেড় মাইল বিল পাড়ি দিয়ে বাড়ি যায়।

জশিলদিয়া থেকে মেদিনীমণ্ডল যেতে মাঝে একবিল। পাক্কা দেড় মাইল। চাঁদনী রাতে সেই বিল পাড়ি দিতে দিতে লতিফ কেবল একটা কথাই ভাবে, এইদিন থাকব না। দোকানের আয়-উন্নতি বাড়ব। টেকা-পয়সার অভাব মাইনষের চিরদিন থাকে না।

এই কথাটা লতিফ ভেবে আসছে, আজ সতের-আঠার বছর। কিন্তু দিন বদলায়নি। আয়-উন্নতি বাড়েনি লতিফের। যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে সব। দোকানটা আর লতিফ নিজে। আসলে লতিফ তার জীবনের ঘোরপ্যাঁচটা বোঝে না। আয়-উন্নতি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খরচটাও যে বেড়েছে লতিফ তা বোঝে না। এই দোকান দেয়ার পরই বিয়ে করেছে লতিফ। মা, বোন ছাড়া আর একটা নতুন মানুষ এসেছে। তার খাইখরচা। স্বাদ-আহ্লাদ। তারপর বছর পর বছর আর একজন করে। সাকুল্যে মানুষ এখন এগারোজন। আর একজন নাজেল হওয়ার ফিকির করছে।

টাকা-পয়সার মারটা যে এইখানে লতিফ বোঝে না। এখনো আশায় আছে এইদিন থাকব না। আয়-উন্নতি বাড়ব। জীবন অন্যরকম অইয়া যাইব।

দুএকখানা বড় গাহাক পেলে ধারণাটা জোর পায় লতিফের। এই যেমন, আজ সকাল বেলা কান্দিপাড়ার মাজেদ খা আধমণ আমৃত্তির অর্ডার দিয়ে গেছে। কাল সকালে নেবে। বাপের চল্লিশার মেজবানি। গরু মারবে একখান। আর আগল আগল ভাত। পয়সা দিয়েছে আল্লায়। আত্মাটাও বড় মাজেদ খার। মাংসভাতের পর খাওয়াবে আমৃত্তি। আর অন্যদিকে, সত্তর-আশি টাকার কাজ হয়ে যাবে লতিফের। সেই সুখে বিভোর হয়েছিল লতিফ।

সকালবেলা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেছে মাজেদ খাঁ। আগাম। টাকাটা হাতে পেয়েই জিনিসপত্র জোগাড় করেছে লতিফ। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে রাতে ফিরবে না। একলা মানুষ পুষ্যি অনেক। সেই ভয়ে দোকানে কর্মচারী রাখে না লতিফ। একলাই আধমণ আমৃত্তি বানাতে হবে। আধমণ আমৃত্তি কি যা-তা কথা! রাত কাবার হয়ে যাবে। জিনিসপত্র জোগাড় করতেই দুপুর পার হয়ে গেছে লতিফের। তারপর একমুখী চুলো দুটো সাজিয়ে, একটা চিনির সিরা তুলেছে। অন্যটায় তেলের কড়াই। পায়ের কাছে, ক্যাশবাক্সের সঙ্গে বড় একটা এলুমিনিয়ামের, বাঁকা-ত্যাড়া গামলায় ময়দার পানি আর কলাই মিশিয়ে হাতে যখন নারকেলের তলা ফুটো আইচা নিয়ে বসেছে, তখন দুপুর পার। বাজার ভেঙে গেছে।

বাজারটা চালু থাকে দুপুর অব্দি। মানুষের হল্লাচিল্লা, দোকানিদের হাকডাক, আনাজপাতি, পেঁয়াজ, রসুনের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে। আর পচা মাছের বোঁটকা একটা গন্ধ আসে মাছচালার দিক থেকে। এসবের ওপর আছে বাজারের সম্পূর্ণ আলাদা চিরকালীন গন্ধটা।

সকালের দিকে আজার পায় না লতিফ। বাজার করতে এসে গেরামের গণ্যমান্য লোকেরা লতিফের দোকানে আসে–চা খেতে। বরাত ভালো থাকলে মিষ্টিও খায়। এক আধসের কিনেও নেয় কেউ কেউ। সেই আয়ে জীবন চলে যাচ্ছে লতিফের। আজ সতের-আঠার বছর।

তারপর দুপুরবেলাটা সব ফাঁকি, নিটাল। জনা সাতেক স্থায়ী দোকানদার ছাড়া বাজারের নেড়িকুত্তাটা আর পবনা পাগলা, সারা জশিলদিয়া বাজারে কেবল একজনই। জেলেরা যে যার আঁকা মাথায় ফিরে যায়। চারপাশের গেরাম থেকে যেসব গেরস্তরা ক্ষেতের আনাজপাতি নিয়ে আসে, গোয়ালারা আসে দুধ নিয়ে, বিক্রি হলে ভালো, না হলে যে যার বস্তু নিয়ে দুপুরের মুখে মুখে ফিরে যায়। বাজারের খোলা চত্বরে তখন পবনা পাগলা, নেড়ি কুত্তাটা আর দোকানের ভেতরে আজার দোকানিরা।

বাজারখোলার পাশেই বড় গাঙ, পদ্মা। দুপুরের পর পদ্মার হু হু হাওয়া এসে বাজারের ধুলোবালির সঙ্গে খেলা করে। বাজারখোলার চিরকালীন গন্ধটা একটুখানি উসকে দেয়। তখন বাড়ি থেকে আনা ভাত পানি খায় লতিফ। তারপর খালি গায়ে, বাবুরহাটের লুঙ্গি পরা, মাজায় বাঁধা একটা লাল গামছা ক্যাশবাক্সের সঙ্গে আয়েশ করে বসে বিড়ি টানে। আজ সেই আজারটা পায়নি লতিফ। ভাতটা এক ফাঁকে খেয়ে নিয়েছে। তারপর বিড়ি টানতে টানতে আধমণ আমৃত্তির মালসামান ঠিকঠাক করে যখন বসেছে তখন বিকাল হয় হয়।

চার পাঁচ খোলা আমৃত্তি তুলে ঝুঁজরের ওপর রেখেছে লতিফ তখন দুতিনজন গাহাক এল। গেরামের যুবক পোলাপান। তাই দেখে এক হাতে আমৃত্তি আর অন্য হাতে চা বানিয়ে ফেলে লতিফ। তারপর গাহাকদের টেবিলে দিয়ে যখন আবার এসে চুলার পাড়ে বসে তখন টের পায় আমৃত্তি ভাজার গন্ধে বাজারের হাজার বছরের পুরনো গন্ধটা বেপাত্তা। হু হু হাওয়া বাজারময় বয়ে বেড়াচ্ছে আমৃত্তি ভাজার মনোহর গন্ধ। সেই গন্ধে সতের-আঠার বছরে যা হয়নি লতিফের আজ তাই হয়। পেটের ভেতরটা চনমন করে ওঠে। একখান আমৃত্তি খাওয়ার সাধ জাগে।

কিন্তু কাজটা করে না লতিফ। একখান আমৃত্তির দাম পড়ে এক সিকি। একদিন খেলে যদি লোভটা বেড়ে যায়। লোকসান। লোকসান হলে পুষ্যিরা খাবে কী!

এসব ভাবতে ভাবতে আরেক খোলা আমৃত্তি তোলে লতিফ। তখন দেখে চুলার ওপারে এসে দাঁড়িয়েছে পবন ঠাকুর। লোকে বলে পবনা পাগলা। চেহারা সুরৎ কী–শালার! ধড়খান মরা গয়া গাছের মতো। মাথাভর্তি বাবড়ি চুল। মুখে কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ। চোখ দুটো গর্তে। তবুও ভাটার মতো দেখতে। হাত-পা মরা ডালপালার মতো পবনার। বুকের পাসলী গোনা যায়। পেটখান দেখলে মনে হয়, ফেন গালার মাইট্টা খাদা উল্টো করে বসানো। তার তলায় টুটাফাটা একখান ধুতি। জন্মের পর থেকেই যেন পড়ে আছে।

মাছচালার মাটিতে শোয় পবনা, মাটিতে বসে। ফলে ধুতিটার রঙ হয়েছে বাজারে বাইলা মাটির মতো। আর পবনার গায়ের গন্ধটা বটে, বাজারের হাজার বছরের পুরোনো গন্ধটাও বাইসানরে বলে পালায়। পবনা হেঁটে গেলে মনে হয়, গেরস্তর আনাজপাতির ক্ষেত থেকে খড় আর বাঁশের মাথায় পোড়া মাটির মালসা বসানো তাড়ুয়াটা হেঁটে যাচ্ছে। গেরস্তর ক্ষেতখোলা পাহারা দেয়। ইঁদুর-বাদুড় তাড়ায়।

পবনাকে দেখলে বাজারের লোকজন যায় ক্ষেপে। কুত্তা-বেড়াল খেদানোর মতো দূর দূর করে। কিন্তু পবনাও, চিজ একখান। কারো দোকানের সামনে গেলে কিছু না কিছু আদায় করবেই। ঘেঙটি পাড়ার ওস্তাদ! দিনরাত বড়পেট খিদে নিয়ে ঘোরে। দোকানিদের কাছে যায়। এটা নেয়, ওটা নেয়। তারপর মাছচালার ওদিকে নিরালায় বসে আয়েশ করে খায়। সঙ্গে থাকে বাজারের নেড়িকুত্তাটা। জগৎ সংসারে এই একটাই জীব পবনার বড় বাধুক। পবনা নিজে খাবে যা তার একটুআধটু কুত্তাটাকেও দেয়। রাতের বেলা পবনা যখন ধুলোবালি গায়ে দিয়ে মাছচালায় শোয় কুত্তাটাও থাকে পাশে। পাশাপাশি দুটো জীবকে একরকমই দেখায়। খোলাবাজারে যেসব গেরস্তরা আনাজপাতি নিয়ে বসে, ভালো বেচাবিক্রি হলে খুশি মনে এক আধ পয়সা দেয় পবনাকে, পবনা তখন অন্য দোকানিদের কাছ থেকে দুপয়সায় দুআনার জিনিস আদায় করে। কতকাল ধরে যে এটা চলে আসছে কেউ জানে না। লতিফও না।

লতিফ এই বাজারে আছে সতের-আঠার বছর। তখন থেকে পবনাকে দেখে। একই রকম। ঐ একখান ধুতি পরা, একরকমই চেহারা সুরৎ। দিন এল গেল, কাল বদলাল। পবন ঠাকুর বদলায় নি। আরো কতকাল যে এই সুরৎ আর ধুতিখান নিয়ে টিকে থাকবে, কে জানে!

পবনাকে দেখে এখন এই কথাটা মনে হলো লতিফের। তারপর একটু মায়া হয়। দূর দূর করে না তাড়িয়ে লতিফ বলল, কিরে পবনা কই আছিলি হারাদিন? আইজ দিহি তরে দেকলাম না?

এই কথায় পবনা খুব খুশি। কেউ নরম গলায় কথা বললে সেখানে লেগে যায় সে। এখনো তাই করে। লতিফের চুলার ওপারে ঝাঁপ ঠিকনা দেয়ার তারা হয়ে দাঁড়ানো বাঁশটার সঙ্গে মাটিতে আসন পিঁড়ি করে বসে। তারপর দাঁত কেলিয়ে হাসে। আপনারে তো হারাদিন দেখলাম কত্তা। বহুৎ কাম করতাছেন।

হ। ম্যালা কাম পইরা গেছে আইজ। হারা রাইতঐ দোকানে থাকতে অইব।

ক্যা?

মাজেদ খার বাপের চল্লিশা কাইল। আদামোণ আমিত্তি বানাইয়া দিতে অইব।

লোকের ভালো খবর শুনলে পবনা খুব খুশি হয়। যেন নিজেরই বিরাট একটা কিছু হয়ে যাচ্ছে এমন গলায় বলল, আ হা হা হা হা। ভালা কতা বহুৎ ভালা কতা। ভগবান দেউক, আরো দেউক আপনেরে। ঠিক তখনি মাছচালার দিক থেকে ছুটে আসে নেড়ি কুত্তাটা। পবনার দোসর।

লতিফের গাহকরা ওঠে এসবের একটু পরে। পয়সা দিয়ে চলে যাওয়ার পর লতিফ দেখে গেলাসগুলো টেবিলের ওপর পড়ে আছে। তার হাত আজার না। একহাতে আমৃত্তি পেঁচিয়ে ছাড়ছে তেলের কড়ায়ে আর অন্য হাতে রসের সিরা থেকে তুলে ঝুঁজরে রাখছে। টেবিল থেকে চায়ের গেলাস আনে কে?

লতিফ বলল, ঐ পবনা গেলাসটি আন।

কেউ কোনও কাজের কথা বললে পবনা খুব খুশি হয়। ছুটে গিয়ে গেলাস এনে দেয়। দুইয়া দিমু? লতিফ ভাবে, পবনার হাতে চার গেলাস দোয়াইতে দেকলে বদনাম অইয়া যাইব। গেরামের গইন্যমাইন্য মাইনষে তাইলে আর আমার দোকানে চা খাইতে আইব না। এগারোজন পুষ্যি লইয়া আমি কি তাইলে না খাইয়া মরুম! ইট্টুহানি আয়াশের লাইগা দোকানের বদনাম করুম! লতিফ ব্যবসায়ী মানুষ। মুখে এসব কথা বলে না। পবনা পাগল-ছাগল মানুষ। বাজারের নেড়িকুত্তা। তবুও।

লতিফ কায়দা করে বলল, না থাউক। থুইয়া দে। আইজ আর গাহাক আইব না। আজাইর পাইলে আমিঐ ধুমুনে!

গেলাস কটা লতিফের পায়ের কাছে রেখে দেয় পবনা। তারপর আবার মাটিতে আসন পিঁড়ি করে বসে। একখান আমিত্তি দিবেন নি কত্তা?

শুনে লতিফ একটু বিরক্ত হয়। নারকেলের আইচায় আমৃত্তির মশলা তেলের কড়াইয়ের ওপর প্যাচিয়ে প্যাচিয়ে ছাড়ে। তুই হারাদিন খালি খাওনের প্যাঁচাইল পারচ ক্যা?

এ কথায় পবনা খিকখিক করে একটু হাসে। কী করুম কত্তা, পোড়া পেটখান খালি খাই খাই করে। আর আইজ আপনে যেই আমিত্তি ভাজতাছেন, ঘেরানে গাঙের মাছও উপরে উইট্টা যাইব! আমি তো মানুষঐ। গাঙপার বইয়া আছিলাম। তহন বাজার থনে একখান বাতাস গেল। হায় হায় বাতাসে খালি আমিত্তির ঘেরান হেই ঘেরান পাইয়া আমি পাগলের লাহান দৌড়াইয়া আইলাম।

লতিফ কোনো কথা বলে না। হাসে। আর মনোযোগ দিয়ে তেলের কড়াইয়ে আমৃত্তি ছাড়ে, আমৃত্তি তোলে। পবনা বলল, দেন একখান আমিত্তি। ভগমান আপনের কিরপা করব।

শুনে লতিফ কেন যে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর উদাস গলায় বলে, পবনারে আইজ হারা রাইত আমার আমিত্তি ভাজন লাগব। তুই এই চুলার পারেঐ বইয়া থাকিচ। হারারাইত। বোজচ না, একলা মানুষ হারারাইত বইয়া আমিত্তি ভাজুম। আমার ডর করে। বাজানে কইত আমিত্তি ভাজনের ঘেরানে বলে পরিস্তান থনে জ্বিনপরিও আইয়া। পড়ে।

পবনা বলল, এই যে আপনের এহেনে বইলাম কত্তা, আর উড়ুম না। তয় একখান কতা কই আপনেরে, আইজ এই বাজারে জ্বিনপরি আইবই। যেই ঘেরান বাইরাইছে। তামান দুনিয়াঐ এই ঘেরান পাইব!

লতিফ কোনও কথা বলে না। এক কড়াই আমৃত্তি ছেড়ে ওঠে। তারপর দোকানের ভেতর থেকে দুটো করে আটখান মাটির পাতিল এনে চৌকির কাছে মাটিতে সার ধরে রাখে। আড়াই সেরি পাতিল একেকখান। নবকুমারের দোকান থেকে দুপুরবেলাই এনে রেখেছে। দেখে পবনা বলল, কয় সেইরা পাইল্লা?

আড়াই সেইরা।

কয়খান?

আষ্টখান। তুই কি নিকাস বুজচ না বেড়া? আড়াই সেইরা আষ্টখান পাইল্লা না অইলে আদমোণ আমৃত্তি আডেনি?

পবনা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। হ। তয় একখান কতা কই আপনেরে কত্তা, আমি কইলাম পুরা আড়াই সের আমিত্তি এক বহায় খাইতে পারুম। এক ঢোকও পানি খামু না। ইট্টুও উড়ুম না।

শুনে ধমকে ওঠে লতিফ। বড়ো প্যাচাইল পারচ তুই। তর বাপেনি খাইছে কুনোদিন। এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি?

মাছচালার দিক থেকে হেঁটে আসছিল আউয়াল। মুদি মনোহারির দোকান চালায়। সারাদিন দোকানে থাকে না আউয়াল। আগে থাকত। নতুন বিয়ে করছে, রাতেরবেলা। বউর কাছে না থাকলেনি হয়!

বাড়ি যাওয়ার সময় লতিফের দোকানে একবার আসে আউয়াল। খানিকক্ষণ বসে যায়। গল্পগুজব করে। বেচাবিক্রির আলাপ। হাসি, বিড়ি খাওয়া।

আজ হাসতে হাসতেই আসে আউয়াল। তারপর লতিফের দিকে তাকিয়ে বলে, কী কয়, পাগলায়? লতিফও হাসে। কয় ও বলে এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারব। এক ঢোকও পানি খাইব না, ইট্টুও উডব না।

হালায় একটা পাগলঐ। বলে ট্যাক থেকে বিড়ি বের করে আউয়াল। লতিফকে দেয় একখান। নিজে নেয়। তারপর বিড়ি ধরিয়ে বেঞ্চে বসে। ঐ পাগলার পো, তর বাপেনি খাইছে কুনোদিন এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি!

তারপর আবার হাসে।

আউয়াল মানুষটা মন্দ না। ঠাট্টামসকরা পছন্দ করে। আর হাসতে। এজন্যে দোকানে গাহাক পড়ে বেশি আউয়ালের। দেখে অন্য দোকানিদের পোদ জ্বলে। হলে হবে কী, কেউ কিছু বলে না।

পবনা বলল, আমার বাপে পারত পাঁচ সের খাইতে। এক বহায়। আমি হেই বাপের পোলা, আড়াই সের পারুম না। দিয়া দেহেন কত্তা কেমনে খাই।

লতিফ বিরক্ত হয়ে বলল, আজাইরা প্যাচাইল পারিচ না পবনা। বয়। অন্য কথাবার্তা ক, আমার কাম আউগগাইব।

একথায় পবনা একটু উদাস হয়। ফাঁকা শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, আমার বাপে আছিল ডাকাইত। বিরামপুরের বুড়া মাইনষের মুখে হোনবেন কেষ্ট ঠাকুরের নাম ডাক। মাইনষে কইত কেষ্টা ডাকাইত। যাগ বয়েস পাঁচ কুড়ি ছয় কুড়ি। আমার বাপের নামে হেই আমলে গেরস্তরা রাইত্রে গুমাইত না। রাইত্রে বিচনায় হুইয়া পোলাপান কানলে বউ-ঝিরা কইত, কেষ্টা আইল। কেষ্টার নামে পোলাপানেও ডরাইত। কান্দন থামাইত, গুমাইয়া পড়ত। গেরামে গেরামে মাইনষে চকি দিত। দল বাইন্দা। কেষ্টারে ঠেকাও। অইলে অইব কী, কাম অইত না। বাপে আমার ঠিকই মাইনষের মাতায় বাড়ি মারত। সব্বশান্ত করত। দিবেননি কত্তা একখান আমিত্তি?

পবনার শেষ কথাটা কেউ গায়ে মাখে না। লতিফ মনোযোগ দিয়ে ঝাঁজরের ওপর আমৃত্তি তোলে। আউয়াল বিড়ি টানতে টানতে বলে, তর বাপে আছিল ডাকাইত। মাইনষের মাতায় বাড়ি মাইরা টেকা-পয়সা, মাল-সামাল লইত আর তুই নেচ বিক্কা কইরা। বলে আবার সেই গাহাক ভোলানো হাসিটা হাসে।

পবনা বলল, এইডা অইল গিয়া কত্তা বরাতের খেইল। ডাকের কথা আছে না চোর ডাকাতের গুষ্টির অন্ন জোড়ে না। আমার অইছে হেই দশা।

তারপর ফুরুক করে মুখের ভেতর লালা টানে পবনা। কত্তা, দিবেন নি একখান! পেট্টা পুইরা গেল!

লতিফ কথা বলে না। বলে আউয়াল, ঐ পবনা পারবি তুই আড়াইসের আমিত্তি খাইতে? এক বহায়?

কন কী কত্তা? পারুম, হাচাঐ পারুম। দিয়া দেহেন না!

যুদি না পারচ?

না পারলে আপনেরা বিচার করবেন?

কী বিচার করুম?

যা আপনেগ মনে লয়।

আউয়াল মানুষটা আমুদে। পবনার কথায় হঠাৎ ভারী ফূর্তি হয় তার! যুদি তুই এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারচ, আমিত্তির দাম তো আমি দিমুঐ আবার কাইল থনে আমার দোকানে তর খাওন-থাকন ফিরি। যতদিন তুই বাঁচবি। আর যুদি না পারচ তাইলে এই বাজার থনে আইজঐ তরে বাইর কইরা দিমু। কুনুদিন এহেনে আর আইতে পারবি না। ক রাজি আছচ নি?

পবনা ফূর্তিতে গর্দান কাৎ করে। ফুরুক করে মুখের ভেতর লালা টেনে নেয় আবার। এক বহায় তো খামুঐ। এক ঢোকও পানি খামু না। উড়ুমও না।

লতিফ এসব কথা খেয়াল করছিল না। আধ মণ মিষ্টির অর্ডার, ষাট-সত্তর টাকার কাজ। ঐ একটা চিন্তায়ই সে মগ্ন। দিন বুঝি তার বদলায়।

আউয়াল বলল, হুনছনি লতিফ?

লতিফ আনমনে বলল, কী? পবনা যদি এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারে তয় আমিত্তির দাম তো আমি দিমু। আবার কাইল থনে আমার দোকানে অর থাকন খাওনও ফিরি।

আউয়াল মৃদু হেসে বলল, কী কচ পবনা?

হাচাঐ কই কত্তা। দিয়া দেহেন না।

আউয়ালের কেন যে এত উৎসাহ। বলল, খাড়া, মানুষজন ডাক দেই। বলেই চেঁচিয়ে আশপাশের দোকানিদের ডাকে। ও মিয়ারা, আহেন ইদিকে। কাম আছে।

শুনে লতিফ হাসে। আর ভেতরে ভেতরে খুশি হয়। আরো আড়াই সের আমৃত্তি বুঝি বিক্রি হয়ে গেল তার। আরো দশ বারো টাকার বুজি কাজ হয়।

আউয়ালের হাঁক ডাকে দুতিনজন আজার দোকানদার এসে জোটে। কী অইল আউয়াল মিয়া? আউয়াল মহা ফূর্তিতে ঘটনাটা বলে, শুনে কাশেম বলল কী কচ পবনা? হাচাঐ পারবি? নাইলে বুজিচ বাজার ছাড়তে অইব। এহেনে আর কুনুদিন আইতে পারবি না।

পবনা খ্যাক খ্যাক করে হাসে। কত্তারা আমি কি আপনেগ লগে মশকরা করতাছি নি? এবার কথা বলে লতিফ। বুইজ্জা দৈক পবনা, আড়াই সের আমিত্তি এক বহায় খাওন। খেলা কতা না।

পবনা বলল, আবার বোজ?

বুজছি বুজছি, দিয়া দেহেন।

এবার উত্তেজনা বেড়ে যায় আউয়ালের। লতিফ। টেকা আমি দিমু।

লতিফ তো মহাখুশি। তবুও মুখে কিছু একটা বলতে যাবে, তাকে থামায় কাশেম। তোমার কী লতিপ বাই, দেও। ইট্টু কষ্ট কইরা আড়াই সের আমিত্তি বেশি বানাইবা! দাঁড়িপাল্লা হাতে নিয়ে লতিফ বলল, আমার অসুবিদা নাই। মাল-সামান আছে। আদা ঘণ্টার খাটনি। আমি চিন্তা করি পাগলার লেইগা।

পবনা বলল, আমার লেইগা আপনের কুন চিন্তা নাই কত্তা। আপনে আমিত্তি বানান আর দেহেন, পাগলায় কেমনে বেবাকটি খায়।

দু পাল্লায় সোয়াসের করে গরম আমৃত্তি মেপে, একটা মাটির খাদায় ঢেলে পবনাকে দেয় লতিফ। তারপর হাসে। অহনও টাইম আছে পবনা বুইজ্জা দেক।

পবনার তখন দিকবিদিকের খেয়াল নেই। হাতের সামনে গরমা গরম আড়াইসের আমৃত্তি। সবগুলোই তার। একলা খাবে। কতকালের সাধ। খাওয়ার সাধ পূরণের যে কী সুখ, পবনা ছাড়া পৃথিবীর আর কে তা এই মুহূর্তে জানে!

প্রথম আমৃত্তিটা মুখে দিয়ে পবনা বলল, আহা কী সোয়াদ গো কত্তা। আইজ রাইতে আপনের দোকানে জ্বিনপরি আইবঐ।

এ কথায় লতিফ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বাপের মুখে শুনেছিল, খাঁটি মিষ্টি নিতে পরিস্তান থেকে জ্বিনপরি আসে গভীর রাতে। দোকানের বেবাক মিষ্টি নিয়ে যায়। যত হাঁড়ি মিষ্টি নেয় টাকা দেয় তত হাঁড়ি। ভাগ্যকুলের কালচাঁদ একরাতে সাত হাঁড়ি টাকা পেয়েছিল। সেই টাকায় কালচাঁদ এখন মহা ধনী। কলিকাতায় শয়ে শয়ে মিষ্টির দোকান তার। বাড়ি, গাড়ি।

লতিফ ভাবে, আইজ রাতে যদি হাচাঐ জ্বিনপরি আহে আমার দোকানে! যুদি আধামণ আমিত্তি লইয়া আধামণ টাকা দেয়! ইস তাইলে আর কথা নাই। এই দিন থাকব না। বদলাইয়া যাইব।

গপাগপ দশটা আমৃত্তি খেয়ে পবনা বলল, বেশি খাওন সামনে থাকলে আমার আবার ইট্টু প্যাচাল পারতে অয়, বুজলেননি কত্তারা। আপনেরা আইজ্ঞা করলে কই।

আউয়াল বিড়ি ধরিয়ে বলল, ক। তয় বুজিচ, বেবাক কইলাম খাইতে অইব। ওকাল পাকাল করতে পারবি না।

পবনা হাসে। দেহেন না কত্তা কেমনে খাই।

তারপর আর একটা আমৃত্তি মুখে দেয়। একবার আমার বাপে গেছে চরে ডাকাতি করতে। আমি তহন পোলাপান। সাত-আষ্ট বচ্ছর বয়েস। আমাগ বাড়ি আছিল কোরাটি গেরামে। পদ্মার পারে। অহন আর কোরাটির নামগন্ধ নাই। পদ্মায় ভাইঙ্গা গেছে। তয় আমি করতাম কী, হারাদিন গাঙপার পইরা থাকতাম। মায় আমারে গাঙপার থনে দইরা আইন্না বাতপানি খাওয়ায়।

পবনা আর একটি আমৃত্তি মুখে দেয়।

ততক্ষণে আরো দুচারজন দোকানদার এসে ভিড় করছে লতিফের দোকানের সামনে। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বেঞ্চে বসে। সবাই হা করে দেখছে পবনাকে। পবনার পাশে কুত্তাটা। আমৃত্তির লোভ তারও আছে। এর মধ্যেই বার দুয়েক ঘেউ দিয়ে ফেলেছে সে। কী ঠাকুর, আমারে ইট্টু দিবা না! নাকি একলা একলাই খাইবা! আ? পবনা খেয়াল করেনি। সুখের সময় কে কার কথা মনে রাখে!

আমৃত্তি চিবাতে চিবাতে পবনা বলল, বাজানে গেছে চরে ডাকাতি করতে। সাত দিন চইলা যায়, ফিরে না। কুনো সম্বাদ নাই। গাঙপার আটতে আটতে আমার খালি বাজানের কথা মনে অয়। কাসার বাসনে বাত বাইরা দিলে মারে আমি জিগাই, বাজানে আহে না ক্যা মা?

মায় কয়, আইব বড়ো কামে গেছে।

তয় বাজানে কুনওদিন ডাকাতি করতে গিয়া দুই দিনের বেশি দেরি করত না। হেই কথা ভাইবা মনডা কেমুন করে আমার। অইলে অইবো কি, পোলাপান মানুষ, মারে বেশি কতা জিগাইতে পারি না। রাইত-বিরাইত জাইগা হুনি আন্দার গরে মায় জানি। কার লগে কতাবার্তা কয়। বিয়ানে কেঐরে দেহি না। মারে জিগাইলে কয়, আমি গুমের তালে কতা কই।

আবার তিন চারটা আমৃত্তি খায় পবনা। ততক্ষণে বিকেল ফুরিয়ে গেছে। পদ্মার হাওয়ার সঙ্গে কাশরেণুর মতো উড়ে উড়ে আসছে অন্ধকার। দোকানে দোকানে জ্বলে উঠেছে হারিকেন, হ্যাজাগবাতি। লতিফ ময়রাও যে কোন ফাঁকে পুরনোকালের জংধরা হ্যাজাগটা পাম্প করে, তেল ভরে কাঁচ পরিষ্কার করে ম্যানটেলে আগুন দিয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। হ্যাজাগটা এখন মিষ্টির আলমারির সঙ্গে বসে জ্বলছে। কী আওয়াজ তার। শোঁ শো। সেই আওয়াজের সঙ্গে মিলেমিশে আসছে আগরবাতির গন্ধ। সন্ধেবেলা দোকানে আগরবাতি জ্বালায় লতিফ। আজ সতের-আঠার বছর। যে ধর্মের যে রীতি। হিন্দুরা দেয় ধূপ, মুসলমানরা আগরবাতি। যাবতীয় সুগন্ধই বুঝি পবিত্র।

হ্যাজাগ জ্বালিয়ে লতিফ আবার বসেছে চুলার পাড়ে। মনোযোগ দিয়ে আমৃত্তি তুলছে। পবনার চারপাশের ভিড়টা একটুও নড়েনি। দোকানিদের কত কাজ থাকে সন্ধ্যেবেলা, আজ সেসব কাজের কথা কারো মনে নেই।

হ্যাজাগের দিকে তাকিয়ে আবার দুখান আমৃত্তি খায় পবনা। ছয় দিনের দিন নিশি রাইতে গুমের তালে আমি হুনি কি, কই জানি বহু দূরে কী একখান পইক ডাকতাছে। কু কু। হুইনা আমার বুকের বিতরে কেমুন জানি করে। পোলাপান মানুষ তো, কিচ্ছু বুঝি না। বিয়ানে উইট্টা দেহি মনে নাই কিছু। পরদিন দুইফর বেলা, আমি আর মায় বইয়া রইছি দাওয়ায়, এমুন টাইমে একজন অচিন মানুষ আইল। মাতায় তার আড়াই সেইরা একখান মাইট্টা পাইলা। নতুন। মুখখান আবার বাঁশকাগজ দিয়া বান্দা। দেকলে মনে অয়, মিষ্টি মাতায় লইয়া বিয়ার চলনে যাইতাছে। আমি চাইয়া চাইয়া মানুষটারে দেহি। হেয় দেহি আমাগ বাইতঐ আহে। দেইক্কা আমি আর আমুদে বাঁচি না। আমাগ কুনো সজন আইলনি। মেলাদিন বাদে আইল দেইক্কা বুঝি মিষ্টি লইয়া আইছে। মিষ্টির মইদ্যে আমিত্তি অইল আমার জানপরান। পাইলা দেইখা আমার লোভ পইরা যায়। আহা আইজ পেট বইরা আমিত্তি খামু। কুনোদিন তো ভরপেট আমিত্তি খাই নাই। দুই চাইরখান খাইছি। পেডের কোণাও ভরে নাই।

আউয়াল বলল, ঐ পবনা খাচ না? অহনো তো একসেরও খাইতে পারচ নাই। বেবাকটি যুদি না পারচ তাইলে বুজিচ। আইজঐ পিডাইয়া বাজার থেকে খেদামু।

লোকে বোঝে, আড়াই সের আমৃত্তির দাম দিতে অইব। আবার কাইল থনে পবনার থাকন-খাওন। জেদের চোটে কাজটি করেছে আউয়াল। সেই রাগে ভেতরে ভেতরে গজরাচ্ছে এখন। দেখে অন্য দোকানিরা খুশি হয়। ভালা হোগামারানি খাইছে হালায়। পয়সার গরম, বোঝ অহন!

লতিফও মনে মনে হাসে। হোগায় গুরা কিরমি অইলে এমুনঐ অয়।

কথা বলতে বলতে পবনা একটু আনমনা হয়েছিল। আউয়ালের খাকানিতে আমৃত্তির কথা মনে পড়ে। আবার নতুন করে খাওয়ার লোভটা হয়। এক থাবায় দুতিনটে আমৃত্তি তোলে পবনা। মুখে দেয়। এইভাবে চার পাঁচবার। দেখে ভিড়টা হল্লাচল্লা করে ওঠে। এইবার পবনা ওকাল করব।

শুনে গর্জে ওঠে আউয়াল। লতিফের দোকানের ঝাঁপ ঠিকনা দেওয়ার বাঁশটা আঁকড়ে ধরে। ওকাল করলেই পিডান আরম্ভ করুম।

পবনা সেসব খেয়াল করে না। আমৃত্তির স্বাদ মুখে নিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। চেইতেন না কত্তা। বহেন আর দেহেন। তয় আমারে ইষ্ট্র কতাবার্তা কওনের টেইম দিতে অইব।

পবনা আবার দুটো আমৃত্তি খায়। মানুষ করল কি, বুজলেননি কত্তারা, পাইল্লাখান মার পার সামনে নামাইয়া ইট্টু খাড়ায়। খরালিকাল আছিল। কত্তার চুলার লাহান গরম অইয়া গেছে দুনিয়া। মানুষ গাইম্মা চুইম্মা সারা। মাজায় বান্দা আছিল লাল একখান গামছা। খুইল্লা মোক পোছে। চেহারাখান কী তার, দেকলে ডর করে। মাথায় বাবরি চুল। মোকে খাশির লাহান কালা মোচ, দাড়ি। চকু দুইখান শোল মাচের পোনার লাহান লাল। কইল, ওস্তাদ আপনেগ লেইগা মিষ্টি পাইছে। হেয় আইব সাতদিন বাদে। হুইনা মায় আমার কুনো কতা কয় না। মানুষ কুন দিকে যে চইলা যায়, আর দেহি না। তয় আমার তহন কুনওদিকে খেল নাই। মায় যেমুন বইয়া রইছিল, তেমুনঐ বইয়া থাকে দেইখা আমার পরানডা আইঢাই করে। পাইল্লাড়া খোলে না ক্যান মায়। বইয়া রইছে ক্যা! মোক দিয়া আবার লোল পড়ে আমার। সইতে না পাইরা কাগজ ছেদা কইরা পাইল্লার ভেতর আত দেই আমি। হায় হায়, আত দিয়া দেহি কি, মিষ্টি কৈ! আতে দেহি বেতকাডার লাহান কী বিন্দে! উঁকি দিয়া দেহি কি, হায় হায় মিষ্টির নামে হারে বাইশ, পাইল্লার মইদ্যে বাজানের কল্লাডা। বাজানের মাথার চুল আছিল কুডিকুডি। বেতকাডার লাহান খাড়াখাড়া। মোক ভরা মোচ, দাড়ি। গায়ের রঙখান আছিল চুলার ছাইয়ের লাহান। আন্দারে বাজানের চকু দুইডা ছাড়া আর কিছু দেহা যাইত না। পাইল্লার মইদ্যে বাজানের কল্লাডা দেইক্কা, পোলাপান মানুষ কিচ্ছু বুঝি না আমি। কই, মাগো, দেহ পাইল্লাডার মইদ্যে দিহি বাজানের মাতাডা।

কী কচ? মায় আমার পাইল্লার মইদ্যে ফালাইয়া পড়ে। তার বাদে চিৎকার মাইরা অজ্ঞেন। বুঝলেননি কত্তারা, মায় অজ্ঞেন অইয়া গেল। হেয়া দেইক্কা আমি চিক্কইর আরম্ভ করি। আমার চিক্কইরে পশ্বিরা দরাইয়া আহে। ঐ পবনা কী অইছে রে? আ?

আমি কিছু বুঝি না। কী কমু। পশ্বিরা বাজারেন কল্লাড়া বাইর করে। তার বাদে হারা গেরামের মানুষ আইয়া ওডে আমাগ বাইত। আসলে অইছিল কী, বুজলেননি কত্তারা, চরে ডাকাতি করতে গিয়া ডাকাতির মালসামান লইয়া সাকরিদগ লগে কাইজ্জা লাগে বাজানের। হের লগের মাইনষেঐ হেরে মারে। তার বাদে কল্লাডা কাইট্টা আত্মীয় বাইত মিষ্টি পাডানের লাহান আমাগ বাইত পাডাইয়া দেয়।

পবনা আর দুতিনটে আমৃত্তি খায়। লোকজন নিজেদের মধ্যে কী কী সব কবার্তা কয়, পবনার কথা শোনে কি শোনে বোঝা যায় না। কেবল পবনা আড়াই সের আমৃত্তি খেতে পারবে কি, পারবে না, তাই নিয়ে কথা।

আউয়াল দেখে অর্ধেকের বেশি আমৃত্তি খেয়ে ফেলেছে পবনা। বাকি অর্ধেকও বুঝি

খেয়ে ফেলবে! যেভাবে কথা বলে আর খায়, বেজায় লোকসান হয়ে গেল আউয়ালের। কেন যে চালাকি করে আগে সময় বেঁধে দেয়নি। এখন পবনা যদি সারারাত বসে আস্তে ধীরে খায় আর কথা বলে! এ কথা ভেবে ভাবনায় পড়ে যায় আউয়াল। পবনা যদি সারারাত বসে খায়, তাহলে তো তারও সারারাত বসে থাকতে হবে। ওদিকে নতুন বউ বিছানায় শুয়ে সারারাত এপাশ ওপাশ করবে। সকালবেলাও বাড়ি ফেরা যাবে না। দোকানে যেতে যেতে কাল সন্ধ্যা। তখন বউ থাকবে মুখ ভার করে। কথাই বলবে না। তার ওপর নতুন শরীরের স্বাদ। আহা দুনিয়ার যাবতীয় মিষ্টি দ্রব্যের চেয়েও মিষ্টি। সেই কথা ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যায় আউয়ালের।

খেঁকিয়ে বলে ঐ পবনা হবিরে কর। তর লেইগা কি হারা রাত বইয়া থাকুমনি?

এ কথায় পবনা একটু বেজার হয়। এমুন কলাম কতা নাই কত্তা। আমি কইছি এক বহায় খামু। বান্দা টেইম দেই নাই। আপনি খালি দেকবেন আমি না খাইয়া উডিনি। তাইলে যা মনে লয় করবেন।

লতিফ ততক্ষণে ছ সাত সের আমৃত্তি ভেজে শেষ করেছে। মাটির ঝাজরটা এখন আমৃত্তিতে ভরা। না সরালে ভোলা নামাবে কোথায়। এই ভেবে লতিফ তার টিনের দাঁড়িপাল্লা টেনে নেয়। গামছা দিয়ে মোছে। তারপর সোয়াসের ওজনের দুখান বাটখারা এক পাল্লায় আরেক পাল্লায় আমৃত্তি মেপে নতুন পাতিলে রাখতে থাকে। এক একটায় দুপাল্লা করে। মাপতে মাপতে বাইরেও চোখ রাখে। বাইরে আড়াই সেরের কারবার। আট ন টাকার কাজ। কথাটা ভেবে ভেতরে ভেতরে খুশিতে মরে যায় লতিফ। আইজ সবকিছু কেমুন জানি লাগে! বিয়ানে পাইলাম আদামোণ আমিত্তির গাহক। বিয়ালে আড়াই সের। নিশি রাইতে ভাইগ্যাকুলের কালাচান্দের দোকানের লাহান আমার দোকানে আইজ জ্বিনপরি আইব নাতো! আদামোণ আমিত্তি লইয়া আদামোণ টাকা যুদি দেয়! হায় হায়রে, তাইলে আর কতা নাই। দিন বদলাইয়া যাইব। দিন বদলের চিন্তায় মগ্ন থাকে লতিফ। বাইরে কে কী বলে, পবনা কতটা আমৃত্তি খায় না খায় খেয়াল করে না।

পবনার কথায় চুপ করে থাকে আউয়াল। নিজের দোষে নিজে ফেঁসেছে। কিছুই বলার নেই। তবুও তেজি গলায় বলে, বাইত যামু না বেডা!

পবনা হাসে। যাইয়েন নে। বহেন, হপায় তো হাজ অইল। তারপর আবার আমৃত্তি মুখে দেয়। ঘজ ঘজ করে আমৃত্তি চিবায় আর কথা বলে। বাজানে তো মরল। হেই দুঃখে আমি আর বাইত থনে বাইর অই না। খালি চিন্তা করি, মাইনষে মইরা যায় কই! ফিরত আহে না ক্যা! তয় একখান কতা কী, মারে দেহি আগের চাইয়া যেমুন বেশি আশিখুশি। পোলাপান মানুষ তো, বুজি না, ক্যান! রাইতে আন্দার গরে হুইয়া ফুসুর-ফাসুর মানুষের কতা হুনি। বেডা মাইনষের গলা। কেডা আহে রাইতে আন্দার ঘরে! মায় তার লগে কী এত কতা কয়? অইলে অইব কী, বেশি পুচপাঁচ করন যায় না। আমি পোলাপান মানুষ জিগাইলে মা কয়, তুই সপন দেহচ। আর নাইলে আমি যে গুমের তালে কতা কই, হেই হুনচ। হায় ভগমান! তার বাদে অইল কি, বুজলেননি কত্তারা। একদিন নিশিরাইতে অইছে কী, আমি গুমের মইদ্যে হুনি কই জানি বহুত দূরে হেই পইকডা আবার ডাকতাছে। কু কু। হেই ডাকে আমার নিদ ছুঁইটা যায়। ডর করে। আন্দারে আইত্তাই, মা মাগো। মার কুনো হদিস পাই না। এই ঘুটঘুইট্টা আন্দারে মায় গেল কই! তার বাদে মালুম করি পেশাব পাইখানা ফিরতে গেছে। আইবোনে। আবার গুমাইয়া যাই। এক গুমে রাইত পার। মাইনষে কয় না কালগুম, বুজলেননি কত্তারা। বিয়ানে উইট্টা দেহি মায় তো আমার কুনোহানে নাই। পাড়া বইরা বিচরাই, গেরাম নাই। মায় আমার কুনো হানে নাই। হেষমেষ যাই দাইমার বাড়ি। হেয়ও আমার লগে মারে বিচরায়। নাই। মায় আমার নাই।

দাইমার আছিল এক মাইয়া, হরিদাসী। আমার লাহান বয়েস। দাইমার পতি চিতায় গেছে একখান ঘোড়া রাইখা। সেই ঘোড়াখান বেলদারগ কাছে বর্গা দিয়া, মাইয়া লইয়া দুইবেলার অন্ন জোটে দাইমার। এমুন মানুষ হেয়। আমি আর হরিদাসী মিইল্লা বেবাক জায়গায় মারে বিচরাই। সম্বাত নাই। আমি পোলাপান মানুষ, বিয়াল অইয়া যায়, মারে না দেইক্কা আমি চিক্কইর পারি। হেই দেইক্কা দাইমায় আমারে তাগ বাড়ি লইয়া গেল। বুজলেননি কত্তারা, তার বাদে কতদিন গেল, আইল, মায় আমার আর আইল না। বয়েসকালে বুজি মার একখান পিরিতের মানুষ আছিল। রাইতে বাজান থাকত না বাইত, হেই মানুষখান আইয়া মার লগে কতাবাত্তা কইত। বাজানে বাইচা থাকতে হের ডরে নাগরের আত ধইরা পলাইতে পারে নাই মায়। কেষ্টা ডাকাতের গরের বউ লইয়া পালাইব, এমুন ক্ষেমতা কুন মাইনষের আছে! তয় পালাইল, বাজানে মইরা যাওনের পর। আমারে একলা থুইয়া।

পবনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আস্ত একখান আমৃত্তি মুখে দিয়ে উদাস হয়ে চিবায়। কুত্তাটা কুত্তাদের চিরকালীন ভঙ্গিতে তখনো পবনার পাশে বসা। অবাক হয়ে প্রভুকে দেখছে। প্রভু যে আজ তাকে না দিয়ে একলাই খায়! কী কারণ? মানুষের সব আচরণ বোঝে না সে। মানুষ জাতটা বড় অদ্ভুত। কুত্তাদের মতো না। কুত্তাটা কেবল এই কথা ভাবে।

ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। বাজারের ঠিক ওপরে ফুটে উঠেছে কাটা বাঙির মতো চাঁদ। তার ম্লান একটা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে বাজারের সাদা মাটিতে। পদ্মার হাওয়াটা। আছেই। বাজারের ওপর ঘুরে ঘুরে আমৃত্তি ভাজার গন্ধ আর চাঁদের আলোর মিশেল দিচ্ছে এখন।

আমৃত্তি চিবাইতে চিবাইতে গলা খাকারি দেয় পবনা। বুজলেননি কত্তারা, আমি তার বাদে দাইমার বাইতে থাকি। নিজের মাইয়ারে আর আমারে এক রহমঐ সোয়াগ আল্লাদ করে দাইমায়। রাইতে হোয়ায় তার লগে। অইলে অইব কি, মার কতা কলাম আমি ভুলি না। যহন তহন মনৰ্ডা কান্দে। পরান কান্দে। আর দিন যায়। শইলখান আমার বাজানের লাহানঐ জুয়ান তাগড়া অইতে থাকে। হেই দেইখা দাইমায় একদিন কয়, অই পবনা জুয়ান মদ্দ তো অইয়া গেলি কামকাইজ কর। বিয়াসাদি কর। আমি আর কয়দিন। আপনা পেডেরডা তো আছেই, তুইও অহন আপনাঐ। তগ বেবস্তা না কইরা চিতায় উডুম কেমনে?

কামকাইজের কতাডা ভালাই, বিয়াসাদির কতা, বুজলেন না কত্তারা, হুইনা আমার লাজ করে। কই, কী করুম? বাজানের লাহান চুরি-ডাকাতি?

হেই হুইনা দাইমায় আমারে মুইরা পিছা লইয়াহে পিডাইতে। চুরি-ডাকাতি করনের লাইগা তরে পালছি, এ্যা গোলামের পো।

দাইমারে আমি বহুত ডরাইতাম। কই, তয় তুমি কও কী কাম করুম।

দাইমায় আর কতা কয় না। পরদিন বেলদারগ থনে ঘোড়াডা ফিরাইয়া আনে। ঘোড়াডার নাম আছিল পঙ্খিরাজ। আইনা দাইমায় কয়, ল এই ঘোড়াডা দিলাম। এইডা লইয়া আডবার গোয়ালীমান্দ্রা যাবি, দিগলী যাবি। ধানচাইল টানবি, গেরস্তর সবজি টানবি। আমরা তিনজন মানুষ, দিন চইলা যাইব। হরিদাসী তহন ডাঙ্গর অইয়া গেছে। জোলাগ কাপড় পিন্দা চলে। আর খালি আসে, খালি আসে। আমারে দেইখাও লাজ করে। হেই দেইকা, বুজলেননি কত্তারা দাইমায় হরিদাসীর লগেঐ আমারে

কথাটা শেষ করে না পবনা। পাগলছাগল মানুষ, তবুও লাজলজ্জা আছে। তাই দেখে লোকজন হাসে। আমৃত্তি ভাজতে ভাজতে লতিফ বলে, কইয়া হালা পবনা, হরিদাসীর লগে আদম খেলা খেলনের বেবস্তা কইরা দিল।

শুনে হাসির রোল পড়ে যায়। পবনা কথা বলে না। আমৃত্তির খাদার দিকে তাকায়। তাকিয়ে খুশি হয়। পেরায় খতম অইয়া আইছে। আর তিন সাড়ে তিন গণ্ডা অইব আছে। পেডের তো অহনও কিছু অয় নাই আমার। আহা কী সুখ গো! আউয়াল কত্তায় কইছে কাইল থনে হের দোকানে থাকন-খাওন ফিরি। আমারে আর পায় কোন হালায়! সুখের কথা ভাবে, আর গপাগপ আমৃত্তি মুখে দেয় পবনা। পঙ্খিরাজ আছিল হরিদাসীর বাপের আমলের। বেলদারগ কাছে বর্গা আছিল। হালায় বেলদারের পোরা জবর খাটাইত পঙ্খিরাজরে। ধানচাইল টানাইতে টানাইতে আমরক্ত বাইর কইরা হালাইত। পঙ্খিরাজরে পয়লা দিন দেইক্কাঐ আমার এমুন মায়া লাগল, কী কমু কত্তারা। বিলে ছাইরা আইট কইরা খাওয়াইলাম কয়দিন। দেহি, হ পঙ্খিরাজ ঝাড়া দিয়া উডছে। তার বাদে শুরু করলাম কাম। গোয়ালীমান্দ্রার আডে যাই, দিগলীর আড়ে যাই। আডবার না থাকলে যাই অইলদার বাজারে, শিমইল্লার বাজারে। আয় বরকত ভালোই অয়। দিন। চইলা যায়। তয় আমি কইলাম কত্তারা, পঙ্খিরাজরে জবর সোয়াগ করতাম। হারাদিন। কাম কইরা রাইতে দিতাম বিলে ছাইরা। পঙ্খিরাজ আছিল আমার খুব বাদুক। বিয়ানে রইদ উডনের আগেঐ বাইত আইয়া পড়ত। আবার কামে যাও। পেডের ধান্দা অইল। বড় ধান্দা। তয় পঙ্খিরাজরে কলাম হরিদাসী দেকতে পারত না। কইত, এইডা অইল আমার হতিন। এই ফাঁকে আরেকখান কতা কই কত্তারা, যেদিনঐ আডেবাজারে যাইতাম, বাইত আহনের টেইমে আমি কলাম একখান দুইখান আমিত্তি কিন্না খাইতাম। আমিত্তি খাওনের লোবটা আমার যে কেমুন হেইডা আপনেরা বুজবেন না। বাজানের কল্লাডা যেদিন মিষ্টির পাইল্লার লাহান আমাগো বাইত আইল, ঐদিন যে লোবটা অইছিল, আহা আইজ পেড বইরা আমিত্তি খামু–হেই লোবটা আর যায় নাই। অহনও আছে। মাইনষে কয় না, ভগমান মানুষের বেবাক আশা পূরণ না করলেও দুই-একখান করে। আমার আমিত্তি খাওনের আশাডা কইলাম পূরণ অইয়া গেল। এই যে আইজ। ইচ্ছামতোন খাইতাছি। পেড বইরা। বলেই পবনা আবার আমৃত্তি মুখে দেয়। তাই দেখে আউয়ালের মুখে মরা বটপাতার রঙ ধরে। আদতেই তো হালায় বেবাকটি খাইয়া হালাইব। আর তো আছে পাঁচ ছয়খান। ইসরে কী কামডা করলাম। কতডি টেকা লোকসান। আবার কাইল থনে পাগলার থাকন-খাওন দিতে অইব। ঘাইরামি করলে বদলাম।

নিজের ওপর রাগে জ্বলে যায় আউয়াল।

কাশেম বলল, হ বুজেছি, বেবাকটিঐ খাইব হালায়।

তারপর পবনাকে বলে, একটানে খাইয়া হালা পবনা। দেইক্যা দোকানে যাই।

লতিফ বলে, আর কী দেকবা, যাও। ঐতো আর কয়খান।

ধীরেসুস্তে খাউক।

আউয়াল মনে মনে বলে, তোমার কি চোদানির পো। খালি মাইনষের হোগা মারনের তালে থাক।

মুখে এসব কথা বলা যায় না। আউয়াল আবার বিড়ি ধরায়। তারপর চাঁদের ম্লান আলো আর পদ্মার হাওয়ার ওপর ধোয়া ছাড়তে শোনে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হরিদাসী গেল পোয়াতী অইয়া। হেই দেইক্কা আমি হারাদিন পঙ্খিরাজরে লইয়া আডবাজারে পইরা থাকি। আমিত্তি খাওন ছাইরা দেই। খাওনের মুখ বাড়তাছে। আয় না বাড়লে কেমনে চলব। দাইমায়ও হেই কতাঐ কয়। ভালা কইরা কামকাইজ কর। পোলাপান অইলে। খরচা আছে। খালি হরিদাসী কয়, এত কাম কইর না। নিজের জানপরানডার খেল রাইখ। পবনা আবার একটা আমৃত্তি মুখে দেয়। মুখে দিয়েই টের পায়, পেটটা কেমন করে। বুকটা কেমন করে। হায় হায় ওকাল পাকাল অইব না তো! তাইলে সব্বনাশ অইয়া যাইব। আউয়াল কত্তায় অহনঐ বাস দিয়া পিডাইব। কাইল থনে এই বাজারে আর থাকন যাইব না। তাইলে আমি যামু কই। যাওনের একখান জাগা আছিল দাইমা। হেয় চিতায় উটছে একযোগে বার বচ্ছর।

পবনা একটু নড়েচড়ে বসে। তাতে পেটটা একটু আরাম পায়। বুকটা একটু আরাম। পায়। একদিন রাইতে হরিদাসীর বেদনা উঠল। বাইত আছিল একখান গর। দাইমায় কইল, ঐ পবনা তুই গিয়া গাছতলায় ব। এই টেইমে মরদরা গরে থাকে না।

উডানে আছিল একখান রোয়াইল গাচ। আমি হেই গাছের লগে ঢেলান দিয়া বহি। নিশি রাইত। পঙ্খিরাজ গেছে বিলে। আসমানে চুনাকুমড়ার লাহান গোল একখান চান। চান্নী কী! ফক ফক করে। মাইত্তে ফুঁ দিলে ধুলাবালি উড়তে দেহা যায় এমুন। আমি গাচতলায় বইয়া বইয়া বিড়ি টানি আর হুনি গরের মইদ্যে হরিদাসী আহুইজ্জা বেদনায় কোকায়। আমার কেন জানি পরান কান্দে। কেমুন যানি লাগে। এমনু টেইমে হুনি কী, বুজলেন নি কত্তারা, কই জানি বহুত দূরে হেই পইকখান ডাকতাছে। কু কু। হুইনা আমার পরান কান্দে। কেমুন যানি লাগে। বিয়ান অয় নায়, তখন দাইমায় চিক্কইর দিয়া উঠল। হায় হায় রে, কী সব্বনাস অইল গো। আমি দউর পাইরা গরে যাই। গিয়া। দেহি হরিদাসী নিজে গেছে, পেডেরডাও লইয়া গেছে। দেইক্কা আমার যে মাতার মইদ্যে একখান চক্কর মারল, হেই চক্করডা আর কুনদিন গেল না। অহনও আছে।

পবনা তারপর আর কোনও কথা বলে না। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী যে দেখে, কী যে ভাবে, কেউ জানে না।

খাদায় তখন একটা মাত্র আমৃত্তি। দেখে আউয়াল উঠে দাঁড়ায়। মরা বটপাতার মতো মুখটা নিয়ে বলে, খাইয়া হালা পবনা। বাইত যামু। ম্যালা রাইত অইল।

কাশেম বলল, দেরি করচ ক্যা পবনা? খাইয়া হালা।

পবনার তখন পেটটা কেমন করে, বুকটা কেমন করে। এত কালের পুরনো শরীরটা আর নিজের মনে হয় না। ভাবটা চেপে থাকে পবনা। মুখে খুব বিনীতভাবে বলে, কত্তারা, এইডা না খাইলাম। কুত্তাড়া হারাদিন বইয়া রইল, এইডা অরে দেই।

শুনে গর্জে ওঠে আউয়াল। বানড়ামি পাইছ বেডা হালা। খাও। নাইলে অহনঐ পিডামু। পবনার আর কথা বলার মুখ থাকে না। মনে মনে কুত্তাটার কাছে ক্ষমা চায় সে। ভাইরে ক্ষমা কইর।

তারপর শেষ আমৃত্তিটা মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় পবনা। দাঁড়িয়ে টের পায় এতকালের পুরনো শরীরটা আর তার নিজের মধ্যে নেই। অচেনা হয়ে গেছে।

তখন ভিড়টা ভাঙছে। দোকানিরা পবনার গর্বে বুক ফুলিয়ে ফিরে যাচ্ছে। কত পদের কথা তাদের। সাব্বাস পবনা, বাপের নাম রাখছচ।

পবনা এ সবের কিছুই শোনে না। অচিন শরীরখান টেনে টেনে, চাঁদের ম্লান আলো মাথায়, নদীর দিকে হেঁটে যায়। পৃথিবীর দূর কোনও প্রান্তে বসে কি সেই পাখিটা তখন ডাকছিল। কু কু!

পরদিন সকালে মাছচালার ধুলোবালি থেকে মুখ তুলে নেড়ি কুত্তাটা তার প্রভু পবন ঠাকুরকে খোঁজে। নেই।

কুত্তাটা তারপর ওঠে। উঠে বাজারময় চক্কর খায়। প্রভুকে খোঁজে। নেই, প্রভু কোথাও নেই।

কুত্তাটা তারপর মন খারাপ করে নদী তীরে যায়। সেখানে জেলেদের দুতিনখান নাও ডাঙায় উপুর করে রাখা। মেরামত হবে। আলকাতরা মাইটা তেল খেয়ে আবার জলে নামবে।

কুত্তাটা দেখে দুখান নাওয়ের মাঝখানে মাটিতে তার প্রভু পবন ঠাকুর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। দেখে কুত্তাটা দুতিনখান ঘেউ দেয়। পবন ঠাকুর নড়ে না। কুত্তাটা কী বোঝে কে জানে, সে আর ঘেউ দেয় না। একটা নাওয়ের সামনে পা তুলে পেচ্ছাব করে।

গ্রাম মানুষের কথকতা

মিয়াদের ছাড়া বাড়ির দক্ষিণের নামায় এলোমেলোভাবে ছড়ান আটখানা খেজুর গাছ। ভরা বর্ষায় গাছগুলোর কোমর অব্দি ওঠে জল। কোনও কোনও বর্ষায় কোমর ছাড়িয়ে বুক ছুঁই ছুঁই।

এবারের বর্ষা তেমন ছিল না। গাছগুলোর কোমর ছুঁয়েই নেমে গেছে। ফলে প্রায় প্রতিটি গাছেরই কোমরের কাছে স্বচ্ছল গেরস্ত বউর কোমরের বিছের মতো লেগে আছে বর্ষাজলের দাগ। বয়সের ভারে নৌকোর মতো বাঁকা হয়েছে যে গাছটি বর্ষাজল তার পিঠ ছুঁয়েছিল। সারা বর্ষা পিঠ ছুঁয়ে থাকা জল মনোহর একটি দাগ ফেলে গেছে পিঠে। এই গাছটির সামনে দাঁড়িয়ে গভীর আনন্দে একটি শ্বাস ফেলল দবির গাছি। বহুকাল পর প্রিয় মানুষের মুখ দেখলে যেমন হয়, বুকের ভেতর ঠিক তেমন এক অনুভূতি হল তার। ভারের দুদিকে ঝুলছে দশ বারোটা হাঁড়ি। সাবধানে ভারটা গাছতলায় নামাল সে। তারপর শিশুর মতো উজ্জ্বল হয়ে গেল। একবার এই গাছটির গায়ে পিঠে হাত বুলোয় আরেকবার ওই গাছটির। পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলে, মা মাগো, মা সগল কেমুন আছ তোমরা? শইল ভালো তো? কেউর কোনও ব্যারাম আজাব নাই তো, বালামসিবত নাই তো?

উত্তুরে হাওয়ায় শন শন করে খেজুরডগা। সেই শব্দে দবির গাছি শোনে গাছেরা তার কথার পিঠে কথা বলছে। ভালো আছি বাজান, ভালো আছি। ব্যারাম আজাব নাই, বালা মসিবত নাই।

বর্ষা নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেজুরতলায় জন্মেছে টিয়েপাখি রঙের বাকসা ঘাস। কার্তিকের কোনও এক সময় সাতদিনের জন্য নামে যে বৃষ্টি, লোকে বলে কাইত্তানি, এবারের কাইত্তানির ধারায় রাতারাতি ডাগর হয়েছে বাকসা ঘাস। এখন মানুষের গোড়ালি ডুবে যাওয়ার মতো লম্বা।

এইঘাস ছেঁয়ে আছে মরা খেজুর ডগায়। গাছের মাথায় মরে যাওয়ার পর আপনাআপনি ঝরে পড়েছে তলায়। পাতাগুলো খড়খড়ে শুকনো কিন্তু কাঁটাগুলো শুকিয়ে যাওয়ার পরও কাঁটা। টেটার নালের মতো কটমটে চোখে তাকিয়ে আছে। যেন তাদের আওতায় এলেই কারও আর রক্ষা নেই। খেজুরতলায় পা ফেললেই সেই পা ফুটো করে শরীরে ঢুকবে তারা, ঢুকেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে কাঁটাফোঁটা জায়গায় কাঁথা সেলাবার উঁচ দিয়ে যতই ঘাঁটাঘাঁটি করুক, খেজুর কাঁটার তীক্ষ্ণ ডগাটির কোনও হদিস মিলবে না। সে মিশে যাবে রক্তে। রক্তবাহী রগ ধরে সারা শরীর ঘুরে বেড়াবে। দেড় দুমাস পর বুক কিংবা পিঠ ফুটো করে বেরুবার চেষ্টা করবে। প্রচণ্ড ব্যথায় মানুষের তখন মরণদশা। কেউ কেউ মরেও।

সীতারামপুরের পুষ্প ঠাকরনের একমাত্র ছেলে মরেছিল খেজুর কাঁটায়। বেজায় দুরন্ত স্বভাবের ছেলে ছিল। শীতের রাতে ইয়ার দোস্তদের নিয়ে রস চুরি করতে গেছে কুমারভোগ। টর্চ মেরে মেরে এগাছ থেকে হাড়ি নামায়, ওগাছ থেকে নামায়। তারপর গাছতলায় দাঁড়িয়েই হাঁড়িতে চুমুক। কারও কিছু হল না, ফেরার সময় ঠাকরনের ছেলের ডানপায়ে ফুটল কাঁটা। এক দুদিন একটু ব্যথা হল পায়ে। ঠাকরন নিজে উঁচ দিয়ে ঘাটাঘাটি করল ছেলের পা। কাঁটার হদিস পেল না। চার পাঁচদিনের মাথায় মা ছেলে দুজনেই ভুলে গেল কাঁটার কথা।

ঠিক দেড়মাস পর এক সকালে পিঠের ব্যথায় চিৎকার শুরু করল ঠাকরনের ছেলে। কোন ফাঁকে সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে তার। না নড়তে পারে না বিছানায় ওঠে বসতে পারে। শবরী কলা রঙের মুখখানা ছেলের সরপুটির পিত্তির মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠাকরন কিছু বুঝতে পারে না, দিশেহারা হয়ে ডাক্তার কবরেজ ডাকে, ফকিরফাঁকরা ডাকে। হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি, পানিপড়া, তাবিচকবচ, আয়ুর্বেদি আর কত পদের যে টোটকা, কিছুতেই কিছু হল না। পাঁচদিন ধরে ব্যথায় কাতরাল ছেলেটি তারপর বিয়ান রাতের দিকে মারা গেল। পিঠের যেখানটায় ব্যথা হচ্ছিল সেই জায়গাটি ছেলের তখন থকথক করছে। দেখেই বোঝা যায় চামড়ার তলার মাংসে পচন ধরেছে। লাশ নাড়াচাড়ার সময় বোধহয় চাপ পড়েছিল, চামড়া ফেটে গদ গদ করে। বেরুল রোয়াইল ফলের মতো পুঁজ। সেই পুঁজের অন্তরালে দেখা গেল মাথা উঁচিয়ে আছে একখানা খেজুরকাঁটা।

এ অনেককাল আগের কথা। তারপর থেকে এ তল্লাটে রস চুরি হয় না। লোকে মনে করে খেজুরগাছ হচ্ছে মা জননী। মা যেমন বুকের দুধ শুধুমাত্র তার সন্তানের জন্য লুকিয়ে রাখে, খেজুরগাছ ঠিক তেমন করে তার রস লুকিয়ে রাখে গাছির জন্য। গাছি ছাড়া অন্য কেউ এসে বুকে মুখ দিলে কাঁটার আঘাতে মা জননী তাকে বিক্ষত করেন, জান সংহার করেন। নইলে এই যে এতকালের পুরনো গাছি দবির, বয়স হল দুকুড়ির কাছাকাছি, গাছ ঝুরছে বালক বয়স থেকে, কই তার পায়ে তো কখনও কাঁটা ফুটল না! গাছ ঝুরতে ওঠে কাঁটার একটি খোঁচাও তো সে কখনও খায়নি! এসব ভেবে নৌকোর মতো বাঁকা হয়ে থাকা গাছটির পায়ের কাছে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে দুহাত ছোঁয়াল দবির গাছি। তিনবার সালাম করল গাছটিকে। বহুকাল পর মায়ের কাছে ফিরে আসা আদুরে ছেলে যেমন করে ঠিক তেমন আকুলি বিকুলি ভঙ্গিতে গাছটিকে তারপর দুহাতে জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলল, মা মাগো, আমার মিহি (দিকে) ইট্টু নজর রাইখো মা। গরিব পোলাডার মিহি নজর রাইখো। এই দুইন্নাইতে তোমরা ছাড়া আমার মিহি চাওনের আর আছে কে! তোমরা দয়া না করলে বাচুম কেমনে! আমি তো বছর ভর তোমগ আশায় থাকি! তোমগ দয়ায় দুই তিনটা মাস সুখে কাটে। আর বছর ভালোই দয়া করছিলা। এইবারও তাই কইরো মা। মাইয়া লইয়া, মাইয়ার মারে লইয়া বছর যেন খাইয়াপইরা কাটাইতে পারি।

.

ছনুবুড়ির স্বভাব হচ্ছে দিনমান টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর টুকটাক চুরি করা, মিথ্যে বলা। কুটনামিতে তার কোনও তুলনা নেই। বয়স কত হয়েছে কে জানে! শরীরটা কঞ্চির পলকা ছিপঅলা বড়শিতে বড় মাছ ধরলে টেনে তোলার সময় যেমন বেঁকে যায় তেমন করে বেঁকে গেছে। যেন এই শরীরটা তার পলকা কঞ্চির ছিপ, মাটির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা বয়স নামের অদৃশ্য শক্তিশালী এক মাছ এই ছিপে গাঁথা পড়েছে, মাছ তাকে টানছে, টেনে বাঁকা করে ফেলছে। কোন ফাঁকে যে ভেঙে পড়বে ছিপ কেউ জানে না। যুদ্ধটা চলছে। এই যুদ্ধের ফাঁকেই নিজের মতো করে জীবনটা চালিয়ে যাচ্ছে ছনুবুড়ি। এগ্রাম সেগ্রাম ঘুরছে, এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরছে, চুরি করছে, মিথ্যে বলছে। এর কথা ওকে, ওর কথা তাকে, ছনুবুড়ি আছে বেশ। মাথায় পাটের আঁশের মতো সামান্য কিছু চুল, মুখে একটিও দাঁত নেই, একেবারেই ফোকলা, শরীরের চামড়া তীব্র খরায় শুকিয়ে যাওয়া ডোবানালার মাটির মতো, পরনে এটেল মাটি রঙের একখানা থান, হাতে বাঁশের একখানা লাঠি আর দুচোখে ছানি নিয়ে কেমন করে যে এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ছনুবুড়ি, ভাবলে তাজ্জব লাগে।

আজ দুপুরে সড়কের ওপাশে, পুবপাড়ার জাহিদ খাঁর বাড়ি গিয়েছিল ছনুবুড়ি। জাহিদ খাঁর ছেলের বউদের অনুনয় করে দুপুরের ভাতটা সেই বাড়িতেই খেয়েছে। খেয়ে ফেরার সময় ছানিপড়া চোখেই দেখতে পেয়েছে বাড়ির পেছন দিককার সবজি বাগানে বেগুন ফলেছে, টমেটো ফলেছে। এখনও তেমন ডাগর হয়নি বেগুন, টমেটোগুলো ঘাসের মতো সবুজ, লাল হতে দিন দশ বারো লাগবে। কিন্তু চুরির লোভটা সামলাতে পারেনি সে। বার দুতিনেক এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক টুক করে দুতিনটে বেগুন ছিঁড়েছে, চার পাঁচটা টমেটো ছিঁড়েছে। তারপর কোনও দিকে না তাকিয়ে পথে নেমেছে।

সার্থকভাবে চুরি করার পর মনে বেজায় একখানা স্ফুর্তি থাকে ছনুবুড়ির। এমনিতেই দুপুরের খাওয়াটা হয়েছে ভালো, ঢেকিছাটা লক্ষ্মীদিঘা চালের ভাত আর খলিসা মাছের। ঝোল, তার ওপর অমন সার্থক চুরি, ছনুবুড়ির স্বভাব জেনেও বাড়ির কেউ টের পায়নি, পথে নেমে বুড়ি একেবারে আহ্লাদে আটখানা। বেগুন টমেটো টোপরে (কোচর) নিয়ে যক্ষের মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে বুকের কাছে আর হাঁটছে খুব দ্রুত। সার্থকভাবে চুরি করে বেরিয়ে আসার পর এই বয়সেও ছনুবুড়ি হাঁটে একেবারে হুঁড়ির মতো। বয়স নামের শক্তিশালী মাছটা টেনে তখন তাকে খুব একটা কাবু করতে পারে না।

আজও পারেনি। দ্রুত হেঁটে প্রথমে ছনুবুড়ি গেছে হাজাম বাড়ি। সেই বাড়িতে বসে অনেকক্ষণ ধরে তামাক খেয়েছে। টোপরের বেগুন টমেটো একহাতে আঁকড়ে ধরা বুকের কাছে অন্যহাতে নারকেলের ছোট্ট হুঁকা। গুরগুর গুরগুর করে যখন তামাক খাচ্ছে। হাজাম বাড়ির মুরব্বি সংসার। আলী হাজামের সেজো মেয়ে তছি বুকের কাছে আঁকড়ে ধরা টোপরটা দেখে ফেলল। তছি হচ্ছে জন্মপাগল। মাথা ঠিক নেই তার, কথাবার্তার ঠিক নেই। যুবতী বয়স তছির কিন্তু চালচলন শিশুর মতো। ফলে তছির নাম পড়েছে তছি পাগলনি।

ছনুবুড়ির টোপরের দিকে তাকিয়ে তছি পাগলনি বলল, ও মামানি টুপরে কী তোমার? সংসার আলী হাজামের ছেলেমেয়েরা ছনুবুড়িকে ডাকে বুজি, তছি পাগলনি ডাকে মামানি। এই মামানি ডাকটা শুনলে পিত্তি জ্বলে যায় বুড়ির। কোথায় বুজি কোথায় মামানি! আত্মীয় অনাত্মীয় যে কাউকে বুজি ডাকা যায় কিন্তু মামানি ডাকা যায় না। মামানি ডাক শুনলেই মনে হয় হাজামরা ছনুবুড়ির আত্মীয়। হাজামরা হচ্ছে ছোট জাত, অচ্ছুত। তারা কেমন করে ছনুবুড়ির আত্মীয় হয়! গ্রামের লোকে শুনলে বলবে কী! ছনুবুড়ির শ্বশুরপক্ষকে হাজাম ভাববে না তো! আজকালকার লোকেও মানুষের অতীত, নিয়ে কম ঘাটায় না। যা নয় তাই খুঁচিয়ে বের করা স্বভাবের মানুষের কি আকাল আছে গ্রামে!

এসব ভেবে রেগে গেল বুড়ি। তছি যে জন্মপাগল ভুলে গেল। হুঁকা নামিয়ে খেকুড়ে গলায় বলল, ঐ ছেমড়ি তুই আমারে মামানি কচ কেন লো? আমি তর কেমুন মামানি? সঙ্গে সঙ্গে ছনুবুড়ির সামনে, মাটিতে শিশুর মতো লেছড়ে-পেছড়ে বসল তছি। মাথাভর্তি উকুন তার, সারাক্ষণ মাথা চুলকোচ্ছে। এখনও চুলকোল। চুলকোতে। চুলকোতে বলল, কেমুন মামানি জানি না। টুপরে কী লও? কই থিকা চুরি করলা?.. একে মামানি ডাক তার ওপর অমন মুখের ওপর চুরির অপবাদ, মাথা একেবারে বিগড়ে গেল বুড়ির। হাতের লাঠি নিয়ে তড়বড় করে উঠে দাঁড়াল সে। গলা তিন চারগুণ চড়িয়ে ফেলল। আমি চোর? আমি চুরি করি, আ! হাজাম জাতের মুখে এতবড় কথা?

ছনুবুড়ির রাগ চিৎকার একদম পাত্তা দিল না তছি। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে হি হি করে একটু হাসল। তারপর মাথা চুলকোতে চুলকোতে নির্বিকার গলায় বলল, তুমি তো চোরই মামানি। মেন্দা বাড়ির ঝাঁকা থিকা হেদিনও তো তোমারে কহি (এক ধরনের সবজি চুরি করতে দেখলাম। আইজ কী চুরি করছ? দেহি টুপরে কী?

এবার চুরির কথা আর পাত্তা দিল না বুড়ি। আবার মামানি নিয়ে পড়ল। ইচ্ছা কইরা মামানি কও আমারে। আত্মীয় বানাইছ, হাজাম বানাইছ আমারে! ওই মাগি আমি কি হাজাম জাতের বউঝি যে আমারে তুই মামানি কচ!

তছির বড়ভাই গোবেচারা ধরনের আবদুল তার বউ আর তছির মা তিনজনেই তখন বুড়িকে থামাবার চেষ্টা করছে। অর কথায় আপনে চেইত্তেন না বুজি। ও তো পাগল, কী থুইয়া কী কয়!

কিয়ের পাগল, কিয়ের পাগল ও? ভেক ধরছে। অরে আমি দেখছি না তারিক্কার লগে ইরফাইন্নার ছাপড়ায় ঢোকতে। পাগল অইলে এই হগল বোজেনি?

এ কথায় তছির মা ভাই একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। ভাইর বউ মুচকি হেসে মাথায় প্রথমে ঘোমটা টানল তারপর পশ্চিমের ছাপড়ায় গিয়ে ঢুকল।

তছি ততক্ষণে বুঝে গেছে তার নামে বদকথা বলছে ছনুবুড়ি। লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়াল সে। পাগল বলে কথার পিঠে কথা বলতে শেখেনি সে, এক কথা শুনে বলে অন্য কথা। এখনও তাই করল। ঝগড়ারত বেড়ালের মতো মুখ খিঁচিয়ে বলল, ঐ বুড়ি কুটনি, চুন্নিবুড়ি, মামানি ডাকলে শইল জ্বলে, না? হাজামরা মানুষ না! ছোড জাত? তয় এই ছোড জাতের বাইত আহ ক্যা? তাগ বাইত তামুক খাওনের সুময় মনে থাকে না তারা হাজাম! হাজামরা যেই উক্কায় তামুক খায় হেই উক্কায় মুখ দেও কেমনে? হাজামগ থালে বইয়া দেহি কতদিন ভাত খাইয়া গেছ! বাইরে অও আমগ বাইত থন। বাইর অও। আর কুনওদিন যদি এই বাইত্তে তোমারে দেহি টেংরি ভাইঙ্গা হালামু।

তছির মারমুখো ভঙ্গি দেখে ছনুবুড়ি দমে গেছে। মুখে কথা আটকে গেছে তার। গো গো করতে করতে হাজাম বাড়ি থেকে নেমেছে সে। দক্ষিণের মাঠ ভেঙে হাঁটতে শুরু করছে। এখন শেষ বিকেল। এসময় বাড়ি ফেরা উচিত। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনালে হাঁটা চলায় অসুবিধা। ছানিপড়া চোখে এমনিতেই ঝাপসা লাগে পৃথিবী। তার ওপর যদি হয়। অন্ধকার, পথ চলতে আছাড় উষ্টা খাবে ছনুবুড়ি। এই বয়সে আতুড় লুলা হয়ে বেঁচে থাকার অর্থ নেই। ঘরে বসে জীবন কাটাবার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।

এসব ভেবে দ্রুত পা চালাচ্ছে বুড়ি, মিয়াদের ছাড়া বাড়ির দক্ষিণে এসেছে, বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে যে লম্বা টোসখোলা ঝোপ সেই ঝোপের এপাশ থেকে হেলেপড়া খেজুর গাছটির পায়ের কাছে ছানিপড়া চোখেও একটি লোককে বসে থাকতে দেখল। দেখে থমকে দাঁড়াল। গলা টানা দিয়ে বলল, কেডারে খাজুর তলায়?

খেজুরতলা থেকে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া এল। আমি।

আমি কে?

মানুষটি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাসি হাসি মুখ করে আমুদে গলায় বলল, কও তো কেডা?

বয়সী মাথাটা সামান্য কাঁপাল ছনুবুড়ি। গলা চিনা চিনা লাগে!

তারপরই শিশুর মতো উজ্জ্বল হল সে। চিনছি। দউবরা। ঐ দউবরা খাজুর তলায় কী করচ তুই? গাছ ঝুরছ?

দবির গাছি বলল, না অহনও ঝুরি না। জিনিসপত্র লইয়া বাইর হইছি। আইজ ঘুইরা ঘাইরা গাছ দেখতাছি। কাইল পশশু রুম। তুমি আইলা কই থিকা?

জাহিদ খাঁর বাড়ি দাওত খাইতে গেছিলাম।

কেডা দাওত দিল তোমারে?

জাহিদ খাঁর বড় পোলায়। পোলার বউডা এত ভালো, দুই একদিন পর পর ঐ দাওত দিয়া খাওয়ায় আমারে। কয় আমারে বলে অর মার মতন লাগে।

ছনুবুড়ির কথা শুনে নিঃশব্দে হাসল দবির গাছি। কী খাওয়াইল?

ভাত আর চাইর পাঁচ পদের মাছ। ইলসা, টাটকিনি, গজার। বাইং মাছও আছিল। আমি খাই নাই। শেষমেষ দিল দুদ আর খাজুরা মিডাই (খেজুর গুড়)।

অহন খাজুরা মিডাই পাইল কই?

আর বছরেরডা মুড়ির জেরে (টিনে) রাইক্কা দিছিল।

তারপর দবির গাছিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, বউ এত ভালো বুঝলি দউবরা, গাছের বাইগন, বিলাতি বাইগন (টমেটো) অহনও ডাঙ্গর অয় নাই হেইডিও কতডি ছিড়া আমার টুপরে দিয়া দিল। কইল বাইত লইয়া যান। হাজাম বাড়ি গেছি। তামুক খাইতে আমার টুপুর দেইখা তছি পাগলনি কয় কি, কী চুরি করলা! ক, আমি বলে চোর!

ছনুবুড়ির স্বভাব জানার পরও তছির ওপর একটু রাগল দবির গাছি। বলল, বাদ দেও পাগল ছাগলের কথা। অর কথায় কী যায় আহে।

ছনুবুড়ি খুশি হয়ে বলল, হ অর কথায় কী যায় আহে। তয় তুই একখান কাম করিচ বাজান, পয়লা দিনের রস আমারে ইট্টু খাওয়াইচ।

খাওয়ামুনে। তয় দুই চাইরদিন দেরি হইব।

ক্যা, দেরি হইব ক্যা?

গাছ ঝুইরা ঠিলা পাততে সময় লাগব না! উততইরা বাতাসটা আইজ খালি ছাড়ছে। আইজ থিকা রস আইছে গাছে। বেবাক কিছু ভাও করতে দুই তিনদিন লাগব। পয়লা দিনের রস খাওয়ামুনে তোমারে, চিন্তা কইর না। অহন খালি দেহ উততইরা বাতাসটা কেমনে ছাড়ছে! এইবারের রস দেখবা কেমুন মিডা অয়!

বিকেল শেষের হা হা করা উত্তুরে হাওয়ায় ছনুবুড়ির পাটের আঁশের মতো চুল তখন ফুর ফুর করে উড়ছে। এ হাওয়ায় মনে কোনও পাপ থাকে না মানুষের, কুটনামো থাকে না কিন্তু ছনুবুড়ির মনে সামান্য কূটবুদ্ধি খেলা করতে লাগল।

.

বাড়ি থেকে বেরুবার সময় ছনুবুড়ি দেখতে পেল তার ছেলের বউ বানেছা এলাগেন্দা পোলাপান (ছোট ছোট ছেলেমেয়ে) নিয়ে ঘরের মেঝেতে বসে বউয়া (তেল এবং পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে তৈরি এক ধরনের ভাত, চাল এবং খুদ কুটো দিয়েই হয়।) খাচ্ছে। বেশ খানিকটা বেলা হয়েছে, এসময় বউয়া খেলে দুপুরের ভাত বিকেলে খেলেও অসুবিধা নেই। আর বিকেলে ভাত খাওয়া মানে রাতে না খেলেও চলবে। গেরস্ত বাড়িতে যখন অভাব দেখা দেয় তখন অসময়ে বউয়া কিংবা জাউ খায় সংসারের লোকে।

তাহলে কি ছনুবুড়ির ছেলের সংসারে অভাব লেগেছে!

অভাব তো লাগবার কথা নয়। বুড়ির একমাত্র ছেলে আজিজ গাঁওয়াল (ফিরি করা) করে। ভারে বসিয়ে কাঁসা পেতলের থালাবাসন, জগ গেলাস, কলশি পানদান নিয়ে দেশ গ্রাম চষে ফেরে। নতুন একখানা কাঁসাপেতলের থালা কিংবা বদনা, পানের ডাবর কিংবা পানদান গেরস্ত বাড়ির বউঝিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিনিময়ে সেইবাড়ি থেকে নিয়ে আসবে পুরনো কাঁসা পেতলের ভাঙাচোরা কিংবা বহুকাল ধরে ব্যবহার করা জিনিসপত্র। একখানা নতুন জিনিসের বিনিময়ে আনবে দুতিনখানা পুরনো জিনিস। তারপর সপ্তাহে সপ্তাহে লৌহজং বাজারে গিয়ে ওজনদরে সেইসব জিনিস বিক্রি করে অর্ধেক টাকার জিনিস কিনবে অর্ধেক টাকা কোঁচড়ে গুজবে। ওই অর্ধেক টাকাই মুনাফা। তার ওপর খেতখোলাও আছে আজিজের। ভালোই আছে। আড়াই কানির মতো হবে। পুরো আড়াই কানিই পড়েছে ইরির আওতায়। বর্গা দিয়েও ধান যা পাওয়া যায় বছর চলে স্বাচ্ছন্দে। যদিও আজিজের সংসারটা বড়। বিয়ের পর বছর থেকে সেই যে পোলাপান হতে শুরু করেছে বউয়ের, এখনও থামেনি। বড় পোলার বয়স হয়েছে এগার বার বছর। এখনও দেখ পেট উঁচু হয়ে আছে বানেছার। সাত মাস চলছে। মাস দুয়েক পর কোনও একদিন ব্যথা উঠবে। আলার মা ধরণী এসে খালাস করে দিয়ে যাবে। পোলা না মাইয়া কী হল সে নিয়েও আগ্রহ থাকবে না সংসারের কারও। না আজিজের, না বানেছার। এমন কী পোলাপানগুলোও তাকিয়ে দেখবে না, ভাই হল। তাদের, না বোন। যে যাকে নিয়ে আছে তারা।

আর ছনুবুড়ির তো কথাই নেই। সে তো এই সংসারে থেকেও নেই। বিয়ে করে বানেছাকে যেদিন সংসারে আনল আজিজ তার পরদিন থেকেই সংসারের বাড়তি মানুষ হয়ে গেল ছনুবুড়ি। বাড়িতে বড়ঘর একটিই, সেই ঘরটি চলে গেল ছেলে বউর দখলে। উত্তরের ভিটেয় আছে মাথার ওপর টিনের দোচালা আর চারদিকে বুকাবাঁশের (বাঁশ চিড়ে তার তেরকার সাদা নরম অংশ দিয়ে তৈরি) বেড়া, ঢেঁকিঘর। একপাশে বেলদারদের (নিচু ধরনের এক সম্প্রদায়) রোগা ঘোড়ার মতো কালো রঙের বহুকালের। পুরনো ঢেঁকিটা লোটে (ঢেকির মুখ যে গর্তে পড়ে) মুখ দিয়ে পড়ে আছে, আরেক পাশে উঁই হয়ে আছে লাকড়িখড়ি, এসবের মাঝমধ্যিখানে, লেপাপোছা সামান্য জায়গা থাকার জন্য পেল ছনুবুড়ি। নিজের কাঁথা বালিশ নিয়ে ছনুবুড়ি তারপর থেকে ওখানেই শোয়।

দিন চলে যাচ্ছে।

কিন্তু ছেলের বউ হিসেবে বানেছা খুব খারাপ। সংসারে এসে ঢোকার পর থেকেই দু চোখে দেখতে পারে না শাশুড়ীকে। কি ভালো কথা কি মন্দ কথা, ছনুবুড়ির কথা শুনলেই ছনছন করে ওঠে। চোপা (মুখ) এত খারাপ, শাশুড়িকে কী ভাষায় গালাগাল করা যায় তাও জানে না। মুখে যা আসে তাই বলে। এমন কি সতীন পর্যন্ত।

প্রথম প্রথম এই নিয়ে কেচ্ছাকেলেংকারি হয়েছে সংসারে। বানেছা যেমন ছনুবুড়িও তেমন, বউ শাশুড়ির কাইজ্জা কিত্তনে পাড়ার মানুষ জড় হত। শেষদিকে যখন হাতটাতও তুলতে শুরু করল বানেছা, তখন উপায়অন্ত না দেখে থেমে গেছে ছনুবুড়ি। শাশুড়ি হয়ে বউর হাতে মার খাওয়া! ছি!

আর পেটের ছেলে আজিজ, সে এমন মেউন্না, বউর ওপর দিয়ে কথা বলার মুরোদ নেই। বউ অন্যায় করলেও দোষ সে মাকেই দেয়। এসব দেখে সংসারের ওপর থেকে মন উঠে গেছে বুড়ির। তারপর থেকে সংসারে সে থেকেও নেই। বাড়ি থাকলে নাতিনাতকুরদের হাত দিয়ে ভাততরকারি পাঠায় বানেছা, ছনুবুড়ি খায়। কখনও যদি না পাঠায় সে নিয়ে রা কাড়ে না। কারণ পাড়া চড়ে ছোটখাট চুরিচামারি করে, কুটনামি করে টুকটাক খাদ্য যা জোগাড় করে সে তাতে নিজের পেটটা বুড়ির খালি থাকে না। সময় অসময়ের খিদেটা মারতে পারে।

তবে দেশগেরামের লোক ছনুবুড়ির আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে খুব হাসিমশকরা করে। এতবড় কূটনি হয়েও ছেলেবউর কুটনামির কাছে মার খেয়ে গেছে বুড়ি। কাইজ্জা কিত্তনে ছনুবুড়ির বেজায় ধার, সেই ধার মার খেয়ে গেছে বানেছার কাছে। পারতিকে বউর সঙ্গে সে কথা বলে না। বউকে চোখের ওপর দেখেও কথা বলে না, না দেখার ভান করে।

কিন্তু আজকের ব্যাপারটি অন্যরকম। আজ সকাল থেকেই পেটভর্তি খিদে বুড়ির। সকালবেলা মুখে দেয়া যায় এমন কোনও খাদ্য নিজের সংগ্রহে ছিল না। কাল দুপুরে জাহিদ খাঁর বাড়ি ভাত খেয়েছে তারপর থেকে একটা বিকেল গেছে, পুরো একটা রাত তারপর এতটা বেলা, মানুষ বুড়ো হলে কী হবে পেট কখনও বুড়ো হয় না, খিদেটা বেজায় লেগেছে ছনুবুড়ির। আর এসময় বাড়ির বউ পোলাপান নিয়ে বউয়া খাচ্ছে। যদিও ছেলের সংসারের অভাবের কথাটাও মনে হয়েছে ছনুবুড়ির, একাধারে বউয়ার। গন্ধে নিজের পেটের খিদেটাও জাগা দিয়ে উঠেছে।

ছনুবুড়ি এখন কী করে!

ছেলেবউর সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছে মনে নেই বুড়ির। আজ বুড়ি ভাবল নাতি নাতকুরদের মাধ্যমে বউর সঙ্গে ভালোভালোই দুএকখানা কথা বলে সংসারের অভাবের কথাটা জেনে নেবে এবং নিজের জন্য একথালা বউয়াও জোগাড় করবে। কুটনামি একটু করে দেখুক কাজে লাগলেও লাগতে পারে।

বড় ঘরের পিড়ায় বসল ছনুবুড়ি। ঘরের ভেতর গলা বাড়িয়ে মেজ নাতিটাকে ডাকল। ও হামেদ, হামেদ কী কর ভাই? বউয়া খাও?

সংসারে একমাত্র হামেদেরই সামান্য টান দাদির জন্য আছে। সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ।

কিয়ের বউয়া?

খুদের।

খুদের বউয়া খাও ক্যান, ঘরে কি চাউল নাই?

হামেদ কথা বলবার আগেই বানেছা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, চোক্কে বলে দেহে না, তয় ঘরে বইয়া যে আমি পোলাপান লইয়া বউয়া খাই হেইডা দেহে কেমতে?

খোঁচাটা সঙ্গে সঙ্গে হজম করল ছনুবুড়ি। যেন বউর সঙ্গেই কথা বলছে এমন স্বরে বলল, কে কইছে চোক্কে দেহি না! অল্পবিস্তর দেহি।

সঙ্গে সঙ্গে বানেছা বলল, আইজ যে অহনতরি বাইত্তে? আইজ যে অহনতরি পাড়া বেড়াইতে বাইর অয় নাই?

বাইর অইতাছিলাম।

তয়?

ছনুবুড়ি বুঝে গেল বানেছার আওয়াজটা ভালো না। এখুনি কাইজ্জা কিত্তন লাগাবে সে। বুড়ি আর বানেছার উদ্দেশ্যে কথা বলল না। হামেদকে বলল, ও হামেদ, আমারে ইট্টু বউয়া দে। বিয়াইন্নাবেলা আমারও তো খিদা লাগে!

হামেদ কথা বলবার আগেই বানেছা একেবারে তেড়ে উঠল। ইস একদিন পোলাপান লইয়া ইট্টু বউয়া খাইতে বইছি তাও মাগির সইজ্জ অয় না। অরে দেওন লাগব এক থাল! এই বুড়ি, বাইর অইলি বাড়িত থন!

বানেছার কথা শুনে ছনুবুড়িও তেড়ে উঠতে গিয়েছিল, কী ভেবে সামলাল নিজেকে। গলা নরম করে সরাসরি বানেছাকে বলল, এমুন কইর না বউ। কয়দিন পর আহুজ পড়ব, এই সমায় ময়মুরব্বিগ বদদোয়া লইতে অয় না। একবার আহুজ পড়ন আর একবার মউতের মুক থিকা ফিরত আহন এক কথা।

একথায়ও বানেছার মন গলল না। আগের মতোই রুক্ষ্ম গলায় সে বলল, এত আল্লাদ দেহানের কাম নাই। মউতের মুখে আমি পেত্যেক বচ্ছরঐ যাই, আবার ফিরতও আহি। তোমার বদদোয়ায় আমার কিচ্ছু অইব না। হকুনের দোয়ায় গরু মরে না। তাইলে দুইন্নাইতে আর গরু থাকত না। খালি হকুনঐ থাকত।

আজিজের মেজছেলে ন-দশ বছরের হামেদ তখন খাওয়া শেষ করেছে। এই ছেলেটি বেশ আমুদে স্বভাবের। এই বয়সেই বয়াতিদের গান শুনে সেইগান গলায় তুলে ফেলে। কয়েকদিন আগে তালুকদার বাড়ি গিয়ে খালেক কিংবা মালেক দেওয়ানের দেহতত্ত্বের গান শুনে এসেছে। স্মরণশক্তি ভালো ছেলেটির। একবার দুবার শোনা গান অবিকল বয়াতিদের মতো করে গাইতে পারে। মা দাদীর কথা কাটাকাটির মধ্যেও গলা ছেড়ে গান জুড়ে দিল সে।

মা লো মা ঝি লো ঝি বইন লো বইন করলাম কী
রঙ্গে ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।

নাতির গান শুনে খিদের কষ্ট এবং ছেলেবউর করা অপমানে বহুকাল পর বুকের অনেক ভেতর থেকে ছনুবুড়ির ঠেলে উঠল গভীর কষ্টের এক কান্না। এঘরের পিড়ায় বসে এখন যদি কাঁদে ছনুবুড়ি ওই নিয়েও কথা বলবে বানেছা। হয়ত আরও অপমান করবে তাকে। এই অপমানের ভয়ে চোখে জল নিয়েই উঠে দাঁড়াল ছনুবুড়ি। বাড়ির নামার দিকে হাঁটতে লাগল। ঘরের ভেতর হামেদ তখন গাইছে,

নৌকার আগা করে টলমল
বাইন চুয়াইয়া ওঠে জল।
কত ভরা তল হইল এই গাঙ্গে
ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।

.

বেশ শক্ত করে কুট্টির হাত ধরেছেন মিয়া বাড়ির কত্রী রাজা মিয়ার মা। ধরে খুবই সাবধানে বড় ঘরের সিঁড়ি ভাঙছেন। একটি করে সিঁড়ি ভাঙছেন, কয়েক মুহূর্ত করে দাঁড়াচ্ছেন। দাঁড়িয়ে গাভীন গাইয়ের শ্বাস ফেলার মতো করে শ্বাস ফেলছেন। সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় মানুষ না হয় ক্লান্ত হয় নামার সময়ও যে হয়, তাও মাত্র চার পাঁচটা সিঁড়ি, কুট্টি ভাবতেই পারে না। মোটা হলে যখন এতই কষ্ট তাহলে মোটা হওয়ার দরকার কী! কে বলেছে এত মোটা হতে!

শেষ সিঁড়িটা ভেঙে মাটিতে পা দিলেন রাজা মিয়ার মা, ভারি স্বস্তির একখানা শব্দ করলেন। যেন পুলসুরাত পেরিয়ে এসেছেন এমন আরামদায়ক একখানা ভাব। তারপরই কুট্টির মুখের দিকে তাকালেন, বাজখাই গলায় বললেন, জলচকি দিছস?

কুট্টি সঙ্গে সঙ্গে বলল, দিছি বুজান।

তারপর রাজা মিয়ার মার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। জলচকি না দিয়া আপনেরে ঘর থিকা বাইর করুমনি? আমি জানি না উডানে নাইম্মা খাড়াইতে পারেন না আপনে! লগে লগে বহন লাগে। এর লেইগা আগেই জলচকি দিছি, তারবাদে আপনেরে ঘর থিকা বাইর করছি।

ভালো করছস। তয় আমি তো আইজ উডানে বহুম না।

বলেই কুট্টির কাঁধে কলাগাছের মতো একখানা হাত রাখলেন রাজা মিয়ার মা। শরীরের ভার খানিকটা ছেড়ে দিলেন। সেই ভারে কুট্টি একটু কুঁজো হয়ে গেল। বিশ একুশ বছরের রোগা পটকা মেয়ে কুট্টি তার পক্ষে এরকম একখানা দেহের সামান্য ভারও বহন করা সম্ভব নয়।

কুট্টির ইচ্ছে হল কথাটা বুজানকে বলে। কিন্তু বলার জো নেই। রাজা মিয়ার মার দেহ এবং মেজাজ দুটোই এক রকম। রাগ করতে পারেন এমন কোনও কথা মুখের ওপর। কিংবা আড়ালে আবডালে বললে, সেকথা যদি তাঁর কানে যায় তাহলে আর কথা নেই। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। তার আগে যে গালাগালখানা করবেন সেই গালাগাল শুনে গর্তে গরম জল ঢেলে দেয়ার পর যেমন ছটফটে ভঙ্গিতে বেরয় সাপ কিংবা তুরখুলা (এক ধরনের বড় পোকা) ঠিক তেমন করে কবর থেকে বেরুবে কুট্টির যত মৃত আত্মীয়। তাতে অবশ্য কুট্টির কিছু আসবে যাবে না কিন্তু এই বাড়ির বাঁধা কাজ হারালে কুট্টির কোথাও দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না। না খেয়ে মরণ। আর খিদের কষ্ট কী যেন তেন কষ্ট! সব কষ্ট সহ্য করা যায় খিদের কষ্ট সহ্য করা যায় না। সেই কষ্টের চে এই ভার বহন করা কোটি গুণ ভালো।

কুঁজো শরীরেও মুখটি হাসি হাসি করল কুট্টি। বলল, আমি জানি আপনে আইজ কই বইবেন।

রাজা মিয়ার মাও হাসলেন। ক তো কো?

আমরুজ (জামরুল) তলায়।

হ ঠিক কইছস।

এর লেইগা জলচকিডা আমরুজ তলায়ঐ দিছি।

এই বাড়ির রান্নাঘরটি উঠোনের একেবারে মাঝখানে। দক্ষিণের ভিটেয় দোতলা বিশাল একখানা টিনের ঘর। ঘরটির নিচের তলাও পাটাতন করা। দক্ষিণমুখো বাড়ির পুকুর বরাবর একতলা দোতলা। দুতলাতেই রেলিং দেয়া বারান্দা। বেশ দূর থেকে গাছপালার মাথা ছাপিয়ে মিয়া বাড়ির দোতলা ঘরটি দেখা যায়।

বাড়ির পশ্চিম এবং উত্তরের ভিটেয় আছে আরও দুখানা পাটাতন ঘর। বছরভর তালামারা থাকে ঘর দুটো। এতদিন হল এই বাড়িতে আছে কুট্টি এক দুবারের বেশি। ঘর দুটো খুলতে দেখেনি। বন্ধই যদি থাকবে ঘর দুটো তাহলে রাখবার দরকার কী!

তিনখানা ঘরের প্রত্যেকটির থেকে পাঁচ সাত কদম করে জায়গা হবে বাদ দিয়ে পুবের ভিটেয় রান্নাঘর। রান্নাঘরখানির অবশ্য কায়দা বেশ। দেশগেরামের রান্নাঘরের সঙ্গে মেলে না। মাথার ওপর টিনের চালা নেই, টালির ছাদ দেয়া।

এই রান্নাঘরটির পেছনেই মাঝারি ধরনের একটি জামরুল গাছ। বাড়ি এলে কোনও কোনও সময় জলচৌকি পেতে এই জামরুল তলায় বসে বড় আরাম পান রাজা মিয়ার মা। শীতকাল, গরমকাল সব সময়ই দেহে তাঁর গরম ভাব। দুচার কদম হাঁটলেই ঘামে জবজব করে শরীর। ভেতর থেকে ঠেলে বেরয় উষ্ণতা। জামরুল তলায় বসলে এই উষ্ণতা কমে। জায়গাটা সব সময়ই শীতল। জামরুলের পাতায় ঝিরিঝিরি হাওয়াটা সব সময়ই খেলে। আজ সকালে, বেশ খানিকটা বেলা হয়ে যাওয়ার পর কুট্টির কাঁধে ভর দিয়ে এই জামরুল তলার দিকেই যাচ্ছেন রাজা মিয়ার মা। অতিকায় দেহধারী বলে তাঁর হাঁটাচলা খুবই ধীর। চোখের পলকে পৌঁছনো যায় এমন জাগায় পৌঁছুতেও তাঁর সময় লাগে বেশ খানিকটা।

এখনও লাগছে।

তবে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছেন রাজা মিয়ার মা। গলার আওয়াজও তাঁর দেহ এবং মেজাজের মতোই। ভালোমন্দ যে কোনও কথা বললেই পিলে চমকায়। বেশ অনেকদিন ধরে এই বাড়িতে থাকার পরও, এখনও কেমন পিলে চমকাচ্ছে কুট্টির। বুজান বাড়ি এলে অবশ্য সারাক্ষণই এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে থাকে সে। ভেতরে ভেতরে অপেক্ষা করে কবে বাড়ি থেকে যাবেন তিনি। কবে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে কুট্টি।

রাজা মিয়ার মা বাড়ি না থাকলে এই বিশাল বাড়িটির মালিক কুট্টি। বড় বুজান অবশ্য আছেন বাড়িতে, বাঁধা কামলা আছে আলফু। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। বড় বুজান বয়সের ভারে পঙ্গু। সারাক্ষণই শুয়ে আছেন বিছানায়। হাঁটাচলা করা তো দূরের কথা, বিছানায় উঠে বসতে পর্যন্ত পারেন না। কথা বলেন হাঁসের ছায়ের মতো চিচি করে। আর আলফুকে তো মানুষই মনে হয় না কুট্টির। মনে হয় গাছপালা, মনে হয় ঝোপঝাড় কিংবা গেরস্তদের বার বাড়ির সামনে নিথর হয়ে থাকা নাড়ার পালা। জলজ্যান্ত একজন মানুষকে যে কেন এমন মনে হয় কুট্টির! বোধহয় কথা আলফু বলে না বলে। বোধহয় ভালোমন্দ সব ব্যাপারেই আলফু সমান নির্বিকার বলে। মুখে ভাষা থাকার পরও আলফু বোবা বলে। রাজা মিয়ার মা বললেন, বুদ্দিসুদ্দি তো তর ভালঐ কুট্টি, তারবাদেও জামাইর ঘর করতে পারলি না ক্যা?

এমনিতেই বুজানের দেহের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে কুট্টি, মনে মনে ভাবছে কখন ফুরবে এইট্টুকু পথ, কখন বুজানকে জলচৌকিতে বসিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে সে, তার ওপর আচমকা এরকম একখানা কথা, তাও ওরকম বাজখাই গলায়, কুট্টি বেশ ভড়কে গেল। কথাটা যেন বুঝতে পারল না সে এমন গলায় বলল, কী কইলেন বুজান?

এত কাছে থেকেও তাঁর কথা কেন বুঝতে পারেনি কুট্টি এই ভেবে রাজা মিয়ার মা সামান্য রাগলেন। গলা একটু চড়ল তাঁর। এই ছেমড়ি (ছুড়ি) কানে কম হোনচনি?

কুট্টি সঙ্গে সঙ্গে বলল, না।

তয়?

হুনছি ঠিকঐ।

কথার তাইলে জব দেচ না ক্যা?

ততক্ষণে জামরুল তলায় পৌঁছে গেছে তারা। জামরুল তলায় পেতে রাখা বেশ বড় আকারের জলচৌকিতে রাজা মিয়ার মাকে ধরে বসাল কুট্টি। কুট্টির মতো তিন কুট্টি অনায়াসে বসতে পারে যে চৌকিতে সেই চৌকিতে একা বসার পরও চৌকির চারদিক দিয়ে উপচে পড়লেন রাজা মিয়ার মা। ব্যাপারটা খেয়াল করল না কুট্টি। বুজানকে বসিয়ে দেয়ার পরই ক্লান্তির একটা শ্বাস ফেলল। তারপর হাসিমুখে বলল, এমতেই হতিনের সংসার তার মইদ্যে দেয় না ভাত। খিদার কষ্ট আমি সইজ্জ করতে পারি না বুজান।

বাড়ির নামার দিকে অনেকগুলো আমগাছ নিবিড় হয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে রাজা মিয়ার মা বললেন, বেডা করত কী?

গিরস্তালি করত। ছোড গিরস্ত। তয় শিমইল্লা বাজারে একখান মুদি দোকান আছিল।

তয় তো অবস্তা ভালো। ভাত দিতে পারত না ক্যা?

সংসার বড়। আগের ঘরের ছয়ডা পোলাপান। ভাই বেরাদর আছে চাইর পাঁচজন।

বেডার তো তাইলে বয়স অনেক।

কুট্টি হাসল। হ আমার বাপের বইস্যা।

এমুন বেড়ার লগে বাপে তরে বিয়া দিল ক্যা?

কী করব! এতডি বইন আমরা! আমি বেবাকতের বড়। আমার বিয়া না অইলে অন্যডির বিয়া অয় না।

এর লেইগা হতিনের সংসারে মাইয়া দিব?

কুট্টি কথা বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারপর আনমনা হয়ে গেল।

রাজা মিয়ার মা বললেন, গরিব মাইনষের ঘরে মাইয়া না অওনঐ ভাল। তর অন্য বইনডির বিয়া অইছে?

দুইজনের অইছে।

আর আছে কয়জন?

অহনও দুইজন আছে।

তর বাপে করে কী?

শীতের দিনে লেপ তোশকের কাম করে। খরালিকালে কামলা খাডে।

এতে সংসার চলে?

না চলে না।

তয়?

খাইয়া না খাইয়া বাইচ্চা আছে মানুষটি।

এতডি মাইয়া না অইয়া দুই একটা পোলা অইলে কাম অইতো। জুয়ান পোলা থাকলে রুজি কইরা সংসার চালাইতো।

পোলার আশায়ই বলে এতডি মাইয়া জন্ম দিছে আমার মা বাপে। বুজছে পোলা অইবো, অইছে মাইয়া।

একটু থেমে রাজা মিয়ার মা বললেন, তুই তগো বাইত্তে যাচ না?

না।

ক্যা?

মা বাপে আমারে দেকতে পারে না। বাইত্তে গেলে ধুর ধুর কইরা খেদাইয়া দেয়।

কচ কী?

হ।

ক্যা, এমুন করে ক্যা?

ঐ যে জামাই বাইত থিকা পলাইয়া আইয়া পড়ছি, এর লেইগা।

খাইতে পরতে না দিলে আবি না?

খাইতেও দিবো না পরতেও দিবো না, তার উপরে হতিনের সংসার। ওহেনে মানুষ থাকে কেমতে! একখান কাপোড়ে আমি বচ্ছর কাডাইতে পারি বুজান, হতিনের গনজনা সইজ্জ করতে পারি, স্বামী আমার লাগে না, খালি একখান জিনিসের কষ্ট আমার। খিদা। খিদার কষ্ট আমি সইজ্জ করতে পারি না। পেড ভইরা খাওন পাইলে আমি আর কিছু চাই না। আমার মা বাপে এইডা বোজে না। হেরা মনে করে আমি তাগো মান ইজ্জত ধুলায় মিশাইয়া দিছি। কন তো বুজান, পেডে খিদা লইয়া মান ইজ্জত দেহন যায়নি!

কথা বলতে বলতে শেষ দিকে গলা বুজে এল কুট্টির। ঠিক তখনই ছনুবুড়িকে দেখা গেল মিয়াবাড়ির দিকে হেঁটে আসছে।

.

মিয়াদের ভিটায় উঠেই জামরুল তলায় রাজা মিয়ার মাকে দেখতে পেল ছনুবুড়ি। দেখে মনের ভিতর অপূর্ব এক আনন্দ হল। নিজের বাড়িতে, নিজের বউর কাছে হওয়া খানিক আগের অপমান একদম ভুলে গেল। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে কুঁজা শরীর সোজা করবার চেষ্টা করল। তারপর দ্রুত হেঁটে জামরুল তলায় এল। ফোকলা মুখখানা হাসি হাসি করে বলল, আরে বুজানে বাইত্তে আইছে নি? কবে আইলেন? চোক্কে আইজকাইল একফোডাও দেহি না, তাও দূর থিকা আপনেরে দেকছি। আদতে আপনেরে দেহি নাই বুজান, দেকলাম আপনেগো বাড়ির আমরুজ তলাডা জোছনা রাইতের লাহান ফকফক করতাছে। দিনে দোফরে জোছনা উটবো কেমতে! বোজলাম এইডা তো জোছনা না, এইডা তো আমার বুজানে। বুজানের শইল্লের রঙখান জোছনার লাহান। আন্দার ঘরে বইয়া থাকলেও ফকফইকা অইয়া যায়। কবে আইছেন বুজান?

গলা যতটা নরম করা যায় করলেন রাজা মিয়ার মা। পশশু দিন আইছি।

মাওয়ার লনচে?

হ। মাওয়ার লনচ ছাড়া আমু কেমতে ক? ছিন্নগরের লনচে আইলে এতদূর থিকা আমারে বাইত্তে আনবো কেডা?

রাজা মিয়ার মায়ের অদূরের মাটিতে বসল ছনুবুড়ি। ক্যা আলফু গিয়া আনবো! আপনে তো আইবেন পালকিতে কইরা!

এতদূর থিকা পালকিতে আইলে খরচা অনেক। মাওয়া থিকা আহন ভাল। তয় দিনডা পুরা লাইগ্যা যায়। বিয়ান ছয়ডার লনচে উটলে বিয়াল অইয়া যায়। ছিন্নগর দিয়া আইলে দুইফইরা ভাত বাইত্তে আইয়া খাওন যায়।

ভাতের কথা শুনে পেটের ভিতর ক্ষুধাটা ছনুবুড়ির মোচড় দিয়ে উঠল। বহু বহু বছরের পুরানা নাকে ভেসে এল গরম ভাপ ওঠা ভাতের গন্ধ। অহন যুদি একথাল ভাত পাওয়া যাইতো! লগে সালুন না অইলেও চলতো। খালি ইট্টু নুন, খালি একহান কাঁচা মরিচ।

নিজের অজান্তেই জিভ নাড়ল ছনুবুড়ি, ঢোক গিলল। রাজা মিয়ার মা এসব খেয়াল করলেন না। খেয়াল করল কুট্টি। জিজ্ঞাসা করতে চাইল, এমুন কইরা ঢোক গিললা ক্যা বুজি? খিদা লাগছেনি? বেইল অইছে, অহনতরি কিছু খাও নাই!

তার আগেই রাজা মিয়ার মা বললেন, রাস্তাডা অইয়া গেলে এই হগল যনতন্না আর থাকবো না।

ক্ষুধার জ্বালায় আনমনা হয়েছিল ছনুবুড়ি। কথাটা বুঝতে পারল না। বলল, কীয়ের যনতন্না বুজান?

এই যে ঢাকা থিকা লনচে কইরা বাইত্তে আহন! আমি মোডা মানুষ, একলা চলাফিরা করতে পারি না। ঢাকা থিকা চাকর লইয়াহি। বহুত খরচা পইড়া যায়। রাস্তা অইয়া গেলে পোলার গাড়ি লইয়া ভো কইরা আইয়া পড়ুম। এক দেড়ঘণ্টা লাগবে বাইত্তে আইতে। দরকার অইলে যেইদিন আমু হেইদিনই ফিরত যাইতে পারুম। রাজা মিয়ায় কইছে বড় সড়ক অইয়া যাওনের পর সড়ক থিকা গাড়ি আইতে পারে এমন একখান আলট (ছোট সড়ক) বাইন্দা দিব বাড়ি তরি (পর্যন্ত)। নিজেগো গাড়ি লইয়া তাইলে বাড়ির উডানে, এই আমরুজ তলায় আইয়া পড়তে পারুম। কুট্টি খালি আমারে ধইরা গাড়ি থিকা নামাইবো। আর কোনও মানুষজন লাগবে না। বুজানে যতদিন বাইচ্চা আছে হেরে তো না দেইক্কা পারুম না! এই বাড়িঘর, জাগাজমিন, খেতখোলা, গাছগাছলা এই হগল তো না দেইক্কা পারুম না!

রাজা মিয়ার মায়ের এত কথার একটা কথা কান্র লাগল ছনুবুড়ির। গাছগাছলা। লগে লগে আগের দিনকার কূটবুদ্ধিটা মাথায় এল। দবির গাছির মুখ ভেসে উঠল ছানিপড়া চোখে। বুদ্ধি খাটায়া যদি ভাল মানুষ সাজা যায় বুজানের কাছে তাহলে দুপুরের ভাত এই বাড়িতে খাওয়া যাবে। কোনও না কোনওভাবে বুজানকে খুশি করতে না পারলে ভাত তো দূরের কথা এক গেলাস পানি চাইলেও বুজান বলবেন, তরে অহন পানি দিব কেডা? পুকঐরে গিয়া খাইয়া আয়।

এত টাকা পয়সা থাকলে কী হবে, এত জায়গাজমিন, খেতখোলা থাকলে কী হবে রাজা মিয়ার মা দুনিয়ার কিরপিন (কৃপণ)। স্বার্থ আদায় না হলে কারও মুখের দিকে তাকান না।

ছনুবুড়ি মনে মনে বলল, স্বার্থঐত্তো, বড় স্বার্থ। প্যাঁচখান লাগাইয়া দেহি। কাম না অইয়া পারবো না।

গলা খাকারি দিয়ে কথা মাত্র শুরু করবে ছনুবুড়ি তার আগেই দোতালা ঘর থেকে খুনখুনা গলায় কুট্টিকে ডাকতে লাগলেন বড়বুজান। কুট্টি ও কুট্টি, কই গেলি রে? আমি পেশাব করুম। আমারে উডা। ডহি (এক প্রকারের হাঁড়ি) বাইর কর।

রাজা মিয়ার মা কান খাড়া করে বললেন, ঐ কুট্টি, বুজানে ডাক পারে। তাড়াতাড়ি যা।

মাত্র পা বাড়িয়েছে কুট্টি, বললেন, হোন, বুজানরে পেশাব করাইয়া ভাত চড়া। সালুন রানবি কী?

মাছ আছে।

কী মাছ

কই আছে, মজগুর (মাগুর) আছে। আপনে আইবেন হুইন্না পুকঐর থিকা ধইরা রাখছে আলফু। কোনডা রান্দুম?

মজগুর রান।

আইচ্ছা।

দ্রুত হেঁটে দোতালা ঘরের দিকে চলে গেল কুট্টি।

এই বাইত্তে আইজ মজগুর মাছ রানবো (রান্না)। গরম ভাতের লগে মজগুর মাছের তেলতেলা সুরা (ঝোল) একটা দুইটা টুকরা আর একথাল ভাত যুদি খাওন যায়! শীতের দিন আইতাছে। এই দিনের জিয়াইন্না (জিয়ল) মাছ বহুত সাদের অয়। ওই রকম মাছ দিয়া একথাল ভাত যুদি খাওন যায়!

মুখের ভিতর জিভটা আবার নড়ল ছনুবুড়ির। আবার একটা ঢোক গিলল সে। তারপর খুবই সরল ভঙ্গিতে কথা শুরু করল। একটা কামলায় আপনেগো অয় বুজান?

কথাটা বুঝতে পারলেন না রাজা মিয়ার মা। ছনুবুড়ির মুখের দিকে তাকালেন। ক্যা অইবো না ক্যা? কাম কাইজ তো আলফু ভালঐ করে।

হ তা তো করেঐ। তয় একলা মানুষ কয়মিহি খ্যাল (খেয়াল) রাকবো! বাড়িঘরের কাম, খেতখোলার কাম, ছাড়া বাইত্তে এতডি গাছগাছলা!

বাড়িঘরের কাম কিছু আছে, খেতখোলায় কোনও কামঐ নাই। অহন তো আর আগের দিন নাই, আমন আউসের চাষ দেশগেরামে অয়ঐ না। অয় খালি ইরি। আমগো বেবাক খেতেই ইরি অয়। তাও বর্গা দেওয়া। বর্গাদাররা ধান উডাইয়া অরদেক (অর্ধেক) ভাগ কইরা দেয়। বছরের খাওনডা রাইখা বাকিডা রাজা মিয়া বেইচ্চা হালায়। খেতখোলার মিহি আলফুর চাইতে অয় না। তয় গাছগাছলার মিহি চায়। ছাড়াবাড়ির মিহি চায়।

হ দোষ তো আলফুর না, দোষ অইলো দউবরার।

রাজা মিয়ার মা ভুরু কুঁচকে বললেন, কোন দউবরা? কিয়ের দোষ?

বুজানের আগ্রহ দেখে ছনুবুড়ি বুঝে গেল, কাজ হবে। পেটের ক্ষুধা পেটে চেপে কথা বলার ভঙ্গি আরও সরল করে ফেলল সে। মুখখানা এমন নিষ্পাপ করল যেন এই মুখে কোনও কালেই পড়েনি পাপের ছায়া।

ছনুবুড়ি বলল, ওই দ্যাহো, কথাডা আপনেরে তো কইয়া হালাইলাম। এইডা মনে অয় ঠিক অইলো না। কূটনামি বহুত খারাপ জিনিস।

রাজা মিয়ার মা গম্ভীর গলায় বললেন, কী কবি তাড়াতাড়ি ক ছনু। কূটনামি তর করন লাগবো না। আসল কথা ক।

হ আসল কথাঐ কমু। আপনে আমার থিকা অনেক ছোড তাও আপনেরে আমি বুজান কই। আপনে আমারে কন তুই কইরা। এতে ভাল লাগে আমার। আমি আপনেরে বহুত মাইন্য করি। আপনেরে যহন বুজান কইরা ডাক দেই মনে অয় আপনে আমার বড় বইন। আমি আপনের ছোডঃ।

এবার ছনুবুড়িকে জোরে একটা ধমক দিলেন রাজা মিয়ার মা। এত আল্লাইন্দা প্যাচাইল পারিছ না। আসল কথা ক।

এই ধমক একদমই কাবু করতে পারল না ছনুবুড়িকে। সে যা চাইছে কাজ সেই মতোই হচ্ছে। রাজা মিয়ার মা যত বেশি রাগবেন তার তত লাভ। কথা শেষ করে ভাতের কথাটা তুললেই হবে।

ছনুবুড়ি উদাসীনতার ভান করল। দউবরারে চিনলেন না? দবির গাছি। গাছ ঝুড়ে। পাড়া বেরাইন্না একখান মাইয়া আছে, নূরজাহান। খালি এই বাইত্তে যায় ঐ বাইত্তে যায়। ডাঙ্গর মাইয়া, বিয়া দিলে বচ্ছরও ঘোরব না, আহুজ পড়বো। নূরজাহানরে অহন খালি বড় সড়কে দেহি। মাইট্টাইলগো কনটেকদার আছে আলী আমজত, খালি হেই বেডার লগে গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর। কোনদিন হোনবেন পেটপোট বাজাইয়া হালাইছে।

এবার গলা আরেকটু চড়ালেন রাজা মিয়ার মা। তর এই বেশি প্যাচাইল পাড়নের সবাবটা গেল না ছনু। এক কথা যে কত রকমভাবে ঘুরাইয়া প্যাচাইয়া কচ। দউবরা কী করছে, কীয়ের দোষ তাড়াতাড়ি ক আমারে।

আপনে তো বাইত্তে আইছেন পশশু দিন, দউবরা আপনের লগে দেহা করে নাই?

না।

কন কী?

আমি কি তর লগে মিছাকথা কইনি।

ছি ছি ছি ছি ছি আপনে মিছাকথা কইবেন ক্যা বুজান? আপনে কোনওদিন মিছা কথা কইছেন? তয় দউবরা আপনের লগে দেহা করলো না? এতবড় সাহস অর?

আরে কী করছে দউবরা?

কাইল বিয়ালে অবে দেখলাম আপনেগো ছাড়াবাইত্তে।

কচ কী! কী করে?

এ ছনুবুড়ি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আর কী করবো! অর যা কাম।

খাজুরগাছ ঝোড়ে?

হ।

আমার ছাড়াবাড়ির খাজুরগাছ?

হ।

আমার লগে দেহা না কইরা, আমার লগে কথা না কইয়া তো দউবরা কোনওদিন এমুন কাম করে না! জীবন ভইরা ও আমার গাছ ঝোড়ে! আমি বাইত্তে না থাকলে বুজানের লগে কথা কইয়া যায়। দউবরা তো ইবার আহে নাই! আইলে বুজানে আমারে কইতো!

না আহে নাই। দউবরা নিজ মুখে আমারে কইছে।

কী কইলো?

কইলো যেই কয়দিন পারি বুজানগো ইবার জানামু না। জানাইলেঐ অরদেক রস দেওন লাগবো। পয়লা কয়দিন রসের দাম যায় খুব। কয়ডা আলগা পয়সা কামাইয়া লই। তারবাদে জানামু।

রাজা মিয়ার মা আকাশের দিকে তাকালেন। শেষ হেমন্তের আকাশ প্রতিদিনকার মতো নতুন। দুপুরের মুখে মুখে দেশগ্রামের মাথার উপর রোদে ভেসে যাচ্ছে আকাশ। গাছগাছালির বন কাপিয়ে হাওয়া বইছে। রাজা মিয়ার মা সেই হাওয়া আঁচ করলেন। হাওয়ায় মৃদু শীতভাব। এসময় রস পড়বার কথা না। গাছেরা রসবতী হয়েছে ঠিকই তবে রস পড়বে আরও সাত আটদিন পর।

ছনুবুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় রাজা মিয়ার মা বললেন, অহনতরি রস পড়নের কথা না। শীত পড়ে নাই, রস পড়বো কেমতে?

লগে লগে পরনের মাইট্টা (মেটে) রঙের ছেঁড়া কাপড় গায়ে জড়াবার চেষ্টা করল ছুনবুড়ি। কন কি শীত পড়ে নাই? শীতে বলে আমি মইরা যাই! আপনে মোডা মানুষ, বড়লোক, শইল্লের গরম আর টেকার গরম মিল্লা শীত আপনে উদিস পাইবেন কেমতে? হোনেন বুজান, আপনের ছাড়া বাড়ির বেবাকটি খাজুরগাছ কাইল হারাদিন ধইরা ঝোড়ছে দউবরা। আইজ বিয়ানে দউবরারে আমি দেকলাম রসের ভার কান্দে লইয়া হালদার বাইত মিহি যায়। রস কইলাম পড়তাছে। দউবরা কইলাম আপনের বাড়ির রস বেইচ্চা আলগা পয়সা কামাইতাছে।

শীত পড়ল কী পড়ল না, রস সত্য সত্যই পড়ল কী পড়ল না এবার আর ওসব ভাবলেন না রাজা মিয়ার মা। বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে উঠলেন। এতবড় সাহস গোলামের পোর! আমারে না জিগাইয়া আমার গাছ ঝোড়ে! ঐ কুট্টি, আলফুরে ডাক দে। ক যেহেন থিকা পারে দউবরারে বিচরাইয়া লইয়াইতে।

বড়বুজানের কাজ সেরে অনেকক্ষণ হল রান্নাঘরে এসে ঢুকেছে কুট্টি। ভাত চড়িয়ে মাগুর মাছ কুটেছে। মাগুর মাছ না ঘষে খান সা বুজানে। এখন সেই মাছ ধারাল থানইটের ওপর ফেলে অতিযত্নে ঘষছে কুট্টি। ঘষে ঘষে খয়েরি রঙ সাদা করে ফেলছে। এই ফাঁকে বুজান এবং ছনুবুড়ির সব কথাই শুনেছে। শুনে ছনুবুড়ির ওপর বেদম রাগ হয়েছে। পরিষ্কার বুঝেছে দবির গাছির নামে মিছাকথা বলছে ছনুবুড়ি। নিশ্চয় কোনও মতলব আছে।

তবু বুজান যখন বলেছেন আলফুকে না ডেকে উপায় নাই।

কোটা মাছ মালশায় রাখল কুট্টি। ভারী একখানা সরা দিয়ে ঢাকল। তারপরই বিলাইটার (বিড়াল) কথা মনে হল। চারদিন হল বিয়াইছে (বাচ্চা দিয়েছে)। ফুটফুটা পাঁচটা বাচ্চা। দোতালার এককোণে ফেলে রাখা ভাঙা চাঙারিতে গিয়ে বসেছিল বাচ্চা দিতে, সেখান থেকে আর নামেনি। মেন্দাবাড়ির হোলাটার (হুলো) হাত থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করার জন্য তাদের ছেড়ে নড়ছে না। পাহারা দিচ্ছে। পাহারা দিতে দিতে না খেয়ে কাহিল হয়ে গেছে। বিলাইদের নিয়ম নীতি আজব। হোলা বিলাইরা নাকি এই রকম। কচিছানা খেয়ে ফেলে। মা বিলাইরা এজন্য ছানা পাহারা দেয়।

বাচ্চা দেওয়ার আগে হোলাটা দিনরাত এই বাড়িতে পড়ে থাকত। দুইটাতে কী ভাব তখন! সময় অসময় নাই রঙ ঢঙ করে। এখন সেই কর্মের ফসল একজনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য না খেয়ে মরে যাচ্ছে আরেকজন। দুনিয়াতে মা জীবদেরই কষ্ট বেশি। পুরুষদের কষ্ট নাই।

এসব ভেবে ফেলে আসা সংসারের কথা মনে হল কুট্টির। স্বামী পুরুষটার কথা মনে হল। তারপরই চমকাল কুট্টি। হোলাটা চারদিন ধরে প্রায়ই আসছে এই বাড়িতে।

নিজের ঔরসজাতদের সামনে ভিড়তে পারছে না মা বিলাইয়ের ভয়ে। এখন বাড়িতে ঢুকে যদি মাছের গন্ধ পায়, যদি রান্নাঘরে কাউকে না দেখে তাহলে মাছ কোথায় আছে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। যে সরা দিয়ে মাছ ঢেকেছে কুট্টি ওই সরা থাবার ধাক্কায় ফেলে দিতে সময় লাগবে না তার। যদি মাছ সব হোলায় খেয়ে ফেলে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

সরার ওপর একটা থানইট চাপা দিল কুট্টি : সেই ফাঁকে শুনতে পেল জামরুল তলায় বসে মতলবের কথাটা বলছে ছনুবুড়ি। বুজান, এতদিন পর দেশে আইছেন আপনে, আপনেরে আমি বহুত মাইন্য করি, আইজ আপনে আমারে এক ওক্ত খাওয়ান। আপনেরা ধনী মানুষ, আমারে এক ওক্ত খাওয়াইলে আপনেগো ভাত কমবো না! আল্লায় দিলে আরও বাড়বে। খাইয়াইবেন বুজান?

.

পশ্চিম উত্তরের ভিটার পাটাতন ঘর দুইটার মাঝখান দিয়ে পথ। সেই পথে খানিক দূর আগালে দুই তিনটা বাঁশঝাড়, তিন চারটা আম আর একটা কদমগাছ। সারাদিন আবছা মতন অন্ধকার জায়গাটা। পাটাতন ঘরের চালা আর গাছপালার মাথা ডিঙিয়ে রোদ এসে কখনও এখানকার মাটিতে পড়তে পারে না। যদিও বা পড়ে দুই এক টুকরা, বাঁশঝাড় তলায় জমে থাকা শুকনা বাঁশপাতার উপর রোদের টুকরাগুলিকে দেখা যায় মাটির নতুন হাঁড়ির ভাঙা চারার মতো। রাজা মিয়ার মা যেদিন বাড়িতে এলেন সেদিন থেকে এদিকটায় কাজ করছে আলফু।

বাঁশঝাড় ছাড়িয়ে দূরে, বাড়ির নামার দিকে পায়খানা ঘর। বিক্রমপুর অঞ্চলের বাড়িগুলি তৈরি হয় বাড়ির চারদিক থেকে মাটি তুলে উঁচু ভিটা তৈরি করে তার ওপর। এই ভিটার ওপর আবার ভিটা করে তৈরি হয় ঘর। যদি পাটাতন ঘর হয় তাহলে ভিটা করবার দরকার হয় না। বাড়ির যেদিকটা সবচাইতে দরকারি, বাড়ি থেকে বের হবার জন্য দরকার, সেদিকটাকে বলা হয় বারবাড়ি। বাড়ি তৈরির সময় বারবাড়ির দিক থেকে মাটি তোলার পরও বের হবার সময় খানিকটা নিচের দিকে নামতে হয়, ওঠার সময় ও উঠতে হয় কয়েক কদম। বর্ষাকালে চকমাঠ ভরে পানি যখন বাড়ির ভিটার সমান উঁচু হয়ে ওঠে তখন বাড়িগুলিকে দেখা যায় ছাড়া ছাড়া দ্বীপের মতন। এক বাড়ির লগে। আরেক বাড়ির যোগাযোগের উপায় ডিঙিনৌকা, কোষা নৌকা।

বনেদি বাড়িগুলির পায়খানা ঘর থাকে বাড়ির সবচাইতে কম দরকারি, জঙ্গলা মতন দিকটায়। ঘরদুয়ারের পিছনে, অনেকটা দূর এগিয়ে একেবারে নামার দিকে। গাছপালার আড়ালে এমনভাবে থাকবে ঘরখানা যেন দূর থেকে না দেখা যায়।

এই অঞ্চলের মানুষের রুচির পরীক্ষা হয় পায়খানা ঘর দেখে। মেয়ের বিয়ার সম্বন্ধ আসলে পাত্রপক্ষের কোনও না কোনও মুরব্বি কোনও না কোনও অছিলায় বাড়ির ওই ঘরখানা একবার ঘুরে আসবেন। ওই ঘর দেখে বাড়ির মানুষ আর মেয়ের রুচি বিচার করবেন। এইসব কারণে বড় গিরস্ত আর টাকা পয়সাআলা লোকের বাড়ির পায়খানা ঘরখানা হয় দেখবার মতন। ভাঙনের দিকে চারখানা শালকাঠের মোটা খাম (থাম) পুতে বাড়ির ভিটা বরাবর টংঘরের মতো করে তৈরি করা হবে ঘরখানা। কড়ুই কাঠ দিয়ে পাটাতন করা হবে। মাথার ওপর ঢেউটিনের দো কিংবা একচালা। চারদিকে ঢেউটিনের বেড়া। কখনও কখনও বেড়া চালা রং করা হয়। খামগুলি পোতবার আগে আলকাতরা, মাইট্টাতেলের (মেটেতেল) পোচ দেওয়া হয়। তাতে কাঠে সহজে ঘুণ ধরে না।

বাড়ির ভিটা থেকে পায়খানা ঘরে যাওয়ার জন্য থাকে লঞ্চ স্টিমারে চড়ার সিঁড়ির মতো সিঁড়ি। সিঁড়ির দুইপাশে, পুলের দুইপাশে যেমন থাকে রেলিং, তেমন রেলিং। বাড়ির বউঝিরা যেন পড়ে না যায়।

রাজা মিয়াদের বাড়ির পায়খানা ঘরখানা ঠিক এমন। বাঁশঝাড়তলা ছাড়িয়ে। এই জায়গাটা নিঝুম, ঝরাপাতায় ভর্তি। সারাদিন এই দিকটাতেই কাজ করছে আলফু। বাঁশঝাড় পরিষ্কার করছে, ঝরাপাতা ঝাড়ু দিয়ে এক জায়গায় ভুর দিচ্ছে। আগাছা ওপড়াচ্ছে। সাপখোপের বেদম ভয় রাজা মিয়ার মার। তার পায়খানায় যাওয়ার পথ পরিষ্কার না থাকলে মুশকিল। আলফু সেই পথ পরিষ্কার রাখছে।

কুট্টি এসব জানে। জানে বলেই সোজা এদিকটায় এল। এসে একটু অবাকই হল। আলফু নাই। পরিষ্কার বাঁশঝাড়তলা নিঝুম হয়ে আছে। থেকে থেকে উত্তরের হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় শন শন করছে বাঁশপাতা।

আলফু গেল কোথায়!

পশ্চিমের ঘরটার পিছন দিয়ে একটুখানি পথ আছে দক্ষিণ দিককার পুকুর ঘাটে যাওয়ার। সেই পথের মাঝ বরাবর পুরানা একটা চালতাগাছ। কুট্টি আনমনা ভঙ্গিতে সেই পথে পা বাড়াল। একটুখানি এগিয়েই আলফুকে দেখতে পেল উদাস হয়ে চালতাতলায় বসে আছে। হাতে বিড়ি জ্বলছে কিন্তু বিড়িতে টান দিচ্ছে না।

কুট্টি অবাক হল। রাজা মিয়ার মা আছেন বাড়িতে তারপরও কাজে ফাঁকি দিয়ে চালতাতলায় বসে আছে আলফু! এতবড় সাহস হল কী করে!

দূর থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলফুকে দেখতে লাগল কুট্টি।

জোঁকের মতো তেলতেলা শরীর আলফুর। মাথার ঘন চুল খাড়া খাড়া, কদমছাট দেওয়া। পিছন থেকে দেখছে বলে আলফুর মুখ কুট্টি দেখতে পাচ্ছে না। পিঠ দেখছে, ঘাড় দেখছে আর দেখছে মাজা। পরনে সবুজ রঙের লুঙ্গি। মাজার কাছে গামছা বাঁধা। গামছাটা এক সময় লাল ছিল, দিনে দিনে রঙ মুছে কালচে হয়ে গেছে।

চালতাপাতার ফাঁক দিয়ে আলফুর তেলতেলা পিঠে, ঘাড়ের কাছাকাছি এসে পড়েছে একটুকরা রোদ। সেই রোদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই শরীরের ভিতর অদ্ভুত এক উষ্ণতা টের পেল কুট্টি। অদ্ভুত এক উত্তেজনায় ভরে গেল তার শরীর। মুহূর্তের জন্য মনে পড়ল ফেলে আসা স্বামী মানুষটার কথা। রাত, অন্ধকার ঘর, পুরুষ শরীর, শ্বাস প্রশ্বাসের গন্ধ, ভিতরে ভিতরে দিশাহারা হয়ে গেল কুট্টি। ভুলে গেল সে কেন এখানে আসছে, কী কাজে!

মানুষের পিছনে যত নিঃশব্দেই এসে দাঁড়াক মানুষ, কোনও না কোনও সময় নিজের অজান্তেই মানুষ তা টের পায়। বুঝি আলফুও টের পেল। বিড়িতে টান দিয়ে আনমনা ভঙ্গিতেই পিছনে তাকাল সে। তাকিয়ে কুট্টিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। কুট্টির দিকে তাকিয়ে রইল।

কুট্টির তখন এমন অবস্থা কিছুতেই আলফুর মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। চোখ মুখ নত হয়ে গেছে গভীর লজ্জায়। এক পায়ে আঁকড়ে ধরেছে আরেক পায়ের আঙুল।

ধীর গম্ভীর গলায় আলফু বলল, কী?

লগে লগে স্বাভাবিক হয়ে গেল কুট্টি। নিজেকে সামলাল। আলফুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বুজানে কইলো দবির গাছিরে ডাইক্কা আনতে। মনে অয় হালদার বাইত্তে গেছে গাছ ঝোড়তে। যান তাড়াতাড়ি যান।

বিড়িতে শেষটান দিল আলফু তারপর উঠে দাঁড়াল। আর একবারও কুট্টির মুখের দিকে তাকাল না, একটাও কথা বলল না, বারবাড়ির দিকে চলে গেল।

তারপরও চালতাতলায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল কুট্টি।

.

দোতলা ঘরের সামনের দিককার বারান্দায় খেতে বসেছে ছনুবুড়ি। টিনের খাউব্বা (গামলা মতন) থালায় ভাত তরকারি নুন সব এক সঙ্গে দিয়েছে কুট্টি। টিনের মগের একমগ পানি দিয়েছে। তারপর নিজে চলে গেছে মাঝের কামরায়।

মাঝের কামরার একপাশে কালো রঙের কারুকাজ করা উঁচু পালঙ্ক। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে সেই পালঙ্কে কাত হয়েছেন রাজা মিয়ার মা। কুট্টি তার পা টিপে দিচ্ছে। রাজা মিয়ার মা যতক্ষণ চোখ না বুজবেন, মুখ হাঁ করে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ঙো ঙো করে শব্দ করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত ছুষ্টি নাই কুট্টির। চোখ বুজে মুখ হাঁ করে ওরকম শব্দ করার মানে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। বুজান ঘুমালে তবে খেতে যাবে কুট্টি। দুপুর বয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধায় পেট পুড়ে যাচ্ছে তার।

বুজানের পা টিপছে আর ভোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে ছনুবুড়ির খাওয়া দেখছে কুট্টি। কুঁজা হয়ে বসে ফোকলা মুখে হামহাম করে খাচ্ছে। একটার পর একটা লোকমা (নলা) দিচ্ছে মুখে। কোনওদিকে তাকাচ্ছে না।

এই বয়সেও এত খিদা থাকে মানুষের।

কুট্টির ইচ্ছা হল ছনুবুড়িকে জিজ্ঞাসা করে, ও বুজি আট্টু ভাত লইবানি? আট্টু ছালুন!

বুজানের ভয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় না। এখনও ঘুমাননি বুজান। তার পা টিপা ফেলে ছনুবুড়ির খাওয়ার তদারকি করছে কুট্টি এটা তিনি কিছুতেই সহ্য করবেন না। পায়ের কাছে বসে থাকা কুট্টিকে লাথি মারবেন। ও রকম মোটা পায়ের একখানা লাথথি খেলে পাঁচদিন আর মাজা সোজা করে দাঁড়াতে হবে না কুট্টির।

তবে ছনুবুড়িকে একবারে যতটা ভাত দিয়েছে কুট্টি, তরকারি যতটা দিয়েছে তাতে পেট ভরেও কিছুটা ভাত থেকে যাওয়ার কথা। সেইট্টুকুও ফেলবে না বুড়ি। জোর করে খেয়ে নিবে।

তাহলে কুট্টির কেন ইচ্ছা হল ছনুবুড়িকে জিজ্ঞাসা করে, আটু ভাত লইবানি?

বোধহয় বুড়ির খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে।

কিন্তু বুজান আজ ঘুমাচ্ছেন না কেন? মুখ হাঁ করে ঙো ঙো শব্দ করছেন না কেন? খিদায় তো পেট পুড়ে যাচ্ছে কুট্টির!

শরীরের সব শক্তি দিয়ে জোরে জোরে বুজানের পা টিপতে লাগল কুট্টি।

ঠিক তখনই দক্ষিণের বারান্দার দিকে কার গলা শোনা গেল। বুজান বলে বাইত্তে আইছেন? বুজান ও বুজান।

এই ডাকে মাত্র বুজে আসা চোখ চমকে খুললেন রাজা মিয়ার মা। মাথা তুলে বারান্দার দিকে তাকালেন। ক্যাডা?

আমি দবির, দবির গাছি।

হাছড় পাছড় করে বিছানায় উঠে বসলেন রাজা মিয়ার মা। দউবরা, খাড়ো।

তারপর কুট্টির কাঁধে ভর দিয়ে পালঙ্ক থেকে নামলেন। কুট্টির একটা হাত ধরে দক্ষিণের বারান্দার দিকে আগালেন। সেই ফাঁকে খেতে বসা ছনুবুড়ির দিকে একবার তাকাল কুট্টি। বুড়ির খাওয়ার গতি এখন আরও বেড়েছে। একটার পর একটা লোকমা যেন নাক মুখ দিয়ে খুঁজছে সে। কুট্টি বুঝে গেল দবির গাছির গলা শুনেই খবর হয়ে গেছে বুড়ির। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাত শেষ করে পালাবে। কূটনামি ধরা পড়ার আগেই চোখের আঐলে (আড়ালে) চলে যাবে।

দুইমুঠ ভাতের জন্য যে কেন এমন করে মানুষ!

দক্ষিণের বারান্দায় এসে রেলিং ধরে দাঁড়ালেন রাজা মিয়ার মা। কীরে গোলামের পো, এতবড় সাহস তর অইল কেমতে?

রাজা মিয়ার মাকে দেখে মুখটা হাসি হাসি হয়েছিল দবিরের। এখন তার কথায় সেই মুখ চুন হয়ে গেল। কিয়ের সাহস বুজান?

জানচ না কিয়ের সাহস?

সত্যঐ জানি না বুজান। খোলসা কইরা কন।

আমারে না জিগাইয়া আমার বাড়ির গাছ ঝোড়ছস ক্যা? আমার বাড়ির রস আইজ থিকা বেচতে বাইর অইছস!

বুজানের কথা শুনে দবির আকাশ থেকে পড়ল। আপনে এই হগল কী কইতাছেন বুজান! আপনেরে না কইয়া আপনের বাড়ির গাছ ঝুড়ুম আমি! আপনে বাইত্তে না থাকলে বড়বুজানরে কমু না? আর রস বেচুম কেমতে? রস তো অহনতরি পড়েঐ নাই! পড়বো কেমতে, শীত পড়ছেনি? এই হগল কথা আপনেরে কেডা কইলো?

দবিরের কথায় থতমত খেলেন রাজা মিয়ার মা। তবু গলার জোর কমল না তার। আগের মতোই জোর গলায় বললেন, যেই কউক, কথা সত্য কী না ক?

দবির বুঝে গেল এটা ছনুবুড়ির কাজ। কাল বিকালে মিয়াদের ছাড়া বাড়ির খাজুরতলায় তাকে বসে থাকতে দেখেছে বুড়ি।

দবির বলল, আমি কইলাম বুজছি কথাডা আপনেরে কেডা কইছে। তয় আমার কথা আপনে হোনেন বুজান, দশবারো বছর ধইরা আপনের বাড়ির গাছ ঝুড়ি আমি, কোনওদিন আপনের লগে কথা না কইয়া আপনের গাছে উডি নাই। আপনে বাইত্তে না থাকলে বড়বুজানরে কইয়া যাই। কাইল থিকা উততইরা বাতাসটা ছাড়ছে। লগে লগে ছ্যান লইয়া, ভার লইয়া বাইত থিকা বাইর অইছি আমি। আপনের ছাড়া বাড়ির খাজুরতলায় আইছি। আটখান হাড়ি রাখছি খাজুরতলায়। রাইক্কা বাইত্তে গেছি গা। আইজ বিয়ানে উইট্টা গেছি হালদার বাড়ি। হেই বাইত্তে আছে চাইরখান গাছ। চাইরখান হাড়ি রাইক্কাইছি গাছতলায়। মরনি বুজির লগে বন্দবস্ত কইরাইছি। তারবাদে আইলাম আপনের কাছে। আপনের লগে কথা কইয়া বাইতে গিয়া ভাত খামু তারবাদে যামু আমিনদ্দি সারেঙের বাড়ি। উত্তর মেদিনমন্ডল, দক্ষিণ মেদিনমন্ডল, মাওয়া কালিরখিল এই কয়ড়া জাগার যেই কয়ডা বাড়ির গাছ ঝুড়তে পারি ঝুড়ুম। যাগো লগে বন্দবস্ত অইবো তাগো গাছতলায় হাড়ি রাইক্কামু, যাতে গাছতলায় হাড়ি দেইক্কা অন্য গাছিরা ঐ মিহি আর না যায়। আপনের ছাড়া বাইত্তে হাড়ি রাইক্কা গেছি আমি, গাছে অহনতরি উডি নাই, ছানের একখান পোচও দেই নাই। আইজ আপনের লগে কথা কইয়া কাইল থিকা ঝুড়ুম। যুদি আমার কথা বিশ্বাস না অয় আলফুরে পাডান ছাড়া বাইত্তে গিয়া দেইক্কাহুক। যুদি আমি মিছাকথা কইয়া থাকি তাইলে আপনের জুতা আমার গাল।

রাজা মিয়ার মা কথা বলবার আগেই কুট্টি বলল, আলফুর লগে আপনের দেহা অয় নাই?

দবির অবাক গলায় বলল, না।

বুজানে তো আলফুরে পাডাইছে আপনেরে ডাইক্কানতে!

আলফুর লগে আমার দেহা অয় নাই।

রাজা মিয়ার মা বললেন, তাইলে তুই আইলি কেমতে?

আমি তো নিজ থিকাই আইছি আপনের লগে বন্দবস্ত করতে! বুজান, আলফু যহন বাইত নাই তয় কুট্টিরে পাডান। এক দৌড় দিয়া দেইক্কাহুক আমি মিছাকথা কইছি কিনা!

রাজা মিয়ার মা মাথা দুলিয়ে বললেন, না তুই মিছাকথা কচ নাই। যা বোজনের আমি বুঝছি।

কুট্টির দিকে তাকালেন তিনি। ঐ কুট্টি দেকতো কূটনি মাগি আছেনি না ভাত খাইয়া গেছে গা?

কুট্টি গলা বাড়িয়ে সামনের দিককার বারান্দার দিকে তাকাল। তাকিয়ে দেখতে পেল ভয় পাওয়া শিশুর মতো টলোমলো পায়ে যত দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি ভেঙে উঠানে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছে ছনুবুড়ি। বারান্দায় পড়ে আছে তার শূন্য থালা। সেখানে ঘুর ঘুর করছে হোলাটা।

পালিয়ে যাওয়া ছনুবুড়ির দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মায়ায় মন ভরে গেল কুট্টির। দুইমুঠ ভাতের জন্য এক মানুষের নামে আরেক মানুষের কাছে মিথ্যা কথা বলে বেড়াচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, গালাগাল খাচ্ছে। হায়রে পোড়া পেট, হায়রে পেটের খিদা!

ছুনুবুড়িকে বাঁচাবার জন্য ছনুবুড়ির মতো করে ঠাইট না ঠাইট (জলজ্যান্ত) একটা মিথ্যা বলল কুট্টি। না, ছনুবুড়ি নাই বুজান। খাইয়া দাইয়া গেছে গা।

তবু ছনুবুড়িকে বাঁচাতে পারল না কুট্টি। নিজের বাজখাঁই গলা দশগুণ চড়িয়ে গালিগালাজ শুরু করলেন রাজা মিয়ার মা। ঐ রাড়ি মাগি, ঐ কৃটনির বাচ্চা, এমনু ভাত তর গলা দিয়া নামলো কেমতে? গলায় ভাত আইটকা তুই মরলি না ক্যা? আয় গলায় পাড়াদা তর ভাত বাইর করি।

কুঁজা শরীর যতটা সম্ভব সোজা করে, দ্রুত পা চালিয়ে মিয়াবাড়ি থেকে নেমে যেতে যেতে বুজানের গালিগালাজ পরিষ্কার শুনতে পেল ছনুবুড়ি। ওসব একটুও গায়ে লাগল না তার। একটুও মন খারাপ হল না। এইসবে কী ক্ষতি হবে ছনুবুড়ির! ভাতটা তো ভরপেট খেয়ে নিয়েছে! পেট ভরা থাকলে গালিগালাজ গায়ে লাগে না।

জীবনযাত্রা

ঠাক মশাই!

খাটের ওপর আড়াআড়ি শুয়েছিল মনীন্দ্র। চোখে চশমা, ধুতির ওপর হাতাঅলা কোরা গেঞ্জি পরা। মাথার কাছে পরিষ্কার কাঁচের হারিকেন। পোকা খাওয়া একখানা বই মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল মনীন্দ্র। ঘরের ভেতর. জনা চার পাঁচ লোক। একজন হাতাঅলা চেয়ারে বসা, বাকি কজন সার ধরে বেঞ্চে। কম্পাউন্ডার মজিদ জলচৌকিতে বসে ছোট হামানদিস্তায় কী কী সব গুঁড়ো করছিল। লঙ এলাচ আর দারুচিনির মিশ্র একটা গন্ধ হামানদিস্তা থেকে ওঠে আস্তেধীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল ঘরের ভেতর।

বেঞ্চে বসা একজন আবার ডাকল, ঠাক মশাই!

এবার একটু নড়েচড়ে ওঠল মনীন্দ্র। কিন্তু বই থেকে চোখ ফেরাল না। বলল, ক। ইট্টু যাওন লাগে।

কই?

মনীন্দ্র চোখ তুলে তাকাল। খানিক তাকিয়ে থেকে বলল, তোমায় বাড়ি কই?

কুমারবুক। আমি পিয়ার খার পোলা।

ও। কি অইছে?

গুটি ওঠছে।

কয়জনের?

মার।

খালি তর মারই?

হ। দশা খুব খারাপ। চিনোন যায় না।

দেহাইছচ কারে?

ছেলেটি একটু থেকে থামে। মনীন্দ্রও। তারপর ছেলেটি কিছু বলার আগেই মনীন্দ্র বলল, কালা জাউল্লারে দেহাইছচ?

ছেলেটি মাথা নিচু করে বলে, মার অবস্থা খারাপ দেইক্কা ….

মনীন্দ্র বইটা মুড়ে মাথার কাছে রাখে। তারপর বিছানায় ওঠে বসে। কালা জাল্লারে আবার নে গা। আমি যামু না।

কালা জাউল্লা দুইদিন ধইরা যাইতাছে, কাম অয় না।

অইব। যা।

তারপর অন্যান্য লোকজনের দিকে তাকিয়ে মনীন্দ্র বলল, একজনের চিকিৎসা করা রুপি আমি দেহি না।

ছেলেটি তবুও কাইকুঁই করে। বাবায় কইছিল টেকা-পয়সা যা লাগে…

শুনে মনীন্দ্র এবার রেগে গেল। টেকা দিয়া মনীনরে পাওয়া যায় না। আমি যামু না। যা। ছেলেটি তবুও বসে থাকো। আড়চোখে মনীন্দ্র দেখে।

ছেলেটির দিকে আর তাকায় না মনীন্দ্র। একবার গলা খাকারি দেয়।

তারপর কম্পাউন্ডার মজিদকে বলে, অরে যাইতে ক মইজ্জা।

মজিদ হামানদিস্তা থামিয়ে ছেলেটির দিকে তাকায়। যাও, কর্তায় একবার না করলে হেই জায়গায় আর যায় না। তুমি যাওগা।

এবার ওঠে ছেলেটি। লুঙি আর ফুলহাতা শার্ট পরা। বগল পর্যন্ত হাতা গোটানো। উদ্ধত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যায় সে। মনীন্দ্রকে আদাবও দেয় না।

উঠোনে নেমে কম্পাউন্ডার মজিদকে গাল দিয়ে যায় ছেলেটি। মজিদের ওপর দিয়ে গালটা আসলে মনীন্দ্রকেই দিয়ে যায়। নোয়াব অইয়া গেছ হালার পো! খাড়াও পাইয়া লই তোমারে!

মজিদ শুনতে পায় না। নিবিষ্ট মনে হামানদিস্তায় কবরেজি ওষুধের মশলা বানাচ্ছে। ঘাটের কাছে বর্ষার জলে একটা কোষা নাও ছেড়ে যায়, জলে বৈঠা পড়ার শব্দ হয়, কেউ খেয়াল করে না।

মনীন্দ্র বলল, রাইত অইতাছে, যা খাইয়া আয়গা মজিদ।

হামানদিস্তা রেখে ওঠে মজিদ। খালি গা, ধড়টা বিশাল তার। দাঁড়ালে পর বিশাল আকৃতিটা চোখে পড়ে মজিদের। দাঁড়িয়ে ঘরের লোকগুলোর দিকে একবার তাকায় মজিদ। তারপর হারিকেনের স্পষ্ট আলোয় ঘরের ভেতর দীর্ঘ ছায়া ফেলে উঠোনে নেমে যায়। পুকুরের ওপারে নিবিড় আমবাগান, সেই আমবাগানে একটা রাতপাখি কঁ কঁ করে ডেকে ওঠে ঠিক তখুনি।

মনীন্দ্র তাকিয়েছিল ওষুধের আলমারিটার দিকে। কাঁচের আলমারির ভেতর তিন রকমের ওষুধ সাজানো। এলপ্যাথি হোমিওপ্যাথি কবরেজি। মনীন্দ্র সবরকমের চিকিৎসা জানে। এমন কি ফকিরি টোটকা এসবও।

চেয়ারের বসা লোকটি মনীন্দ্রের বয়েসী। লম্বা শাদা দাড়ি মুখে, মাথায় গোল টুপি। মোবাড়ির লোক। গাঁয়ের পাঁচ মাথার এক মাথা সালতাবদ্দিন। সালতাবদ্দিন মনীন্দ্রর একেবারে হাতের লোক। মজিদ বেরিয়ে যেতেই সালতাবদ্দিন বলল, মইজ্জা কি রাইতেও বাইত যায়নি?

শুনে হাসে মনীন্দ্র। তয় খাইব কই? বাওনের লগে খাইবনি।

এ কথা শুনে বেঞ্চে বসা লোকগুলো হাসে।

মজিদ হাজামের পোলা, ভদ্রসমাজের বাইরের লোক। ওর ভাই বেরাদররা কামলা মজুর খাটে, বুড়ো বাপ শীতকালে মুসলমানির কাজ করে বেড়ায়। মজিদকে মনীন্দ্র রেখেছে কম্পাউন্ডার হিশেবে, পাহারাদার হিশেবে। দশ বিঘের ওপর বাড়িখানা তার। বিশাল আম কাঁঠালের বাগান, বিশাল পুকুর, বাঁশঝাড়, কপাটি খেলার মাঠ। মজিদ কম্পাউন্ডার এসবের পাহারাদারও।

সালতাবদ্দিন বলল, চদরী আইবো কবে?

শুনে নড়েচড়ে ওঠল মনীন্দ্র। হাতের বইটা বন্ধ করে শাদা ফরাশ বিছানো খাটের ওপর আধশোয়া হল। আইয়া পরনের কতা। দেরি করতাছে ক্যা বুজি না। চদরী নাই আমার বহুত অসুবিধা অইতাছে। বাইষ্যাকাল। মজিদের লইয়া বাইর অইতে অয়। বাড়ি খালি থাকে। দেশ গেরাম গেছে চোর ছেচ্চরে ভইরা। কাইল পশ্চিমের ঝার থিকা ছয় সাত বাঁশ কাইট্টা লইয়া গেছে।

মনীন্দ্রর কথায় বেঞ্চে বসা লোকগুলো একটু আহাউঁহু করে। একজন লুঙির কোঁচর থেকে কুম্ভিপাতার বিড়ি বের করে ধরায়। আরেকজন বলে, চদরী কর্তায় কইলকাত্তা গেছে দুই বচ্ছর পর। ইট্টু বেড়াইয়া খেলাইয়া আইব না।

কেউ কোন কথা বলে না।

খানিকপর বেঞ্চে বসা অল্পবয়সী একজন সালতাবদ্দিনকে বলল, লন যাই নানা। রাইত অইল।

সালতাবদ্দিন একটু নড়েচড়ে ওঠে। মনীন্দ্রর দিকে তাকায়, যাইগা মনীন্দ্র।

মনীন্দ্র বলল, আর ইট্টু বহ। পিয়ার খার বাইত গেলাম না ক্যা হুইন্না যাও।

তারপর একটু হাসে মনীন্দ্র। হাসতে হাসতে বলল, পরে তো কইবা সেকেগো লগে বনিবনা নাই মনীন্দ্রর।

শুনে সালতাবদ্দিন হাসে। কথা বলে না।

মনীন্দ্র বলল, পিয়ার খার বউ বাঁচব না। কালা জাউল্লা আবল তাবল চিকিৎসা করে। নমোর পুতেরে হিগাইলাম আমি, অহনে হেয়ই আমার থিকা বড় কেরামত। অর মরণও প্রিয়নাথের মতনই অইব। শেতলা মায়ই নিব অরে। বহুত বাইড়া গেছে নমোর পুতে। দেইখো তোমরা।

প্রিয়নাথের ব্যাপারটা সালতাবদ্দিনের জানা। মনীন্দ্রর কম্পাউন্ডার ছিল। দশ বার বছর লেগে চেপে থেকে টুকটাক ব্যবস্থাও শিখেছিল। দিনে দিনে গোপন কিছু রোগীপত্র জোগাড় হয়ে গিয়েছিল প্রিয়নাথের। সস্তা ডাক্তার, দুআনা চার আনায় ওষুধ পথ্য দেয়, নাড়ি দেখে। গোপনে গোপনে লোকজন আসা-যাওয়া করে প্রিয়নাথের কাছে। প্রিয়নাথও সুযোগ পেলেই মনীন্দ্রকে ফাঁকি দিয়ে রোগীবাড়ি যায়। কিন্তু মনীন্দ্র বড় চালাক লোক। বামুনের পৌলা। জগৎসংসারে আপন কেউ নেই। দেশ ভাগ হয়ে গেল, তবু একলা পড়ে আছে এদেশে। দশ বিঘের ওপর বাড়িখানা আগলাচ্ছে, ডাক্তারি কবিরাজি করে পয়সা কামাচ্ছে দেদার। এসব বুঝতে দেরি হয় না তার। প্রিয়নাথের বড় দোষ ছিল সুযোগ পেলেই মনীন্দ্রর কিছু বদনাম গাইত সে। সবই আসছিল মনীন্দ্রের কানে। তক্কে তক্কে ছিল মনীন্দ্র। কবে সুযোগ আসবে, কবে প্রিয়নাথকে দেখে নেবে সে। সুযোগ এসেছিল।

মাওয়ার বেলদারবাড়ি গুটিবসন্তের চিকিৎসা করতে গিয়েছিল প্রিয়নাথ। বেজায় ওঠা ওঠেছিল সেবার ওফা বেলদারের। দেখে প্রিয়নাথ গেল ভয় পেয়ে। রোগী দেখবে কি, বাড়ি ফিরতে না ফিরতে নিজেই রোগী হয়ে গেল প্রিয়নাথ। দুদিন তার কোনও খোঁজ খবর নেই। কিন্তু মনীন্দ্রর কাছে খবর হয়ে গেছে, প্রিয়নাথ চললেন।

তিনদিনের দিন প্রিয়নাথের বুড়ি মা এসে পা জড়িয়ে ধরল মনীন্দ্রর।

কত্তা, পোলাডারে বাঁচান।

কিন্তু মনীন্দ্র গেল না। একদিনেই ওফা বেলদার আর তার ডাক্তারবাবু প্রিয়নাথ মারা গেল। মনীন্দ্র হচ্ছে গিয়ে এই এলাকার বড় গুণিন। কে বাচবে কে মরবে রোগী দেখেই বলে দিতে পারে সে। কখনও কখনও না দেখেও পারে। এমনও দেখা গেছে গুটিবসন্তে শরীর পচে গেছে রোগীর, মনীন্দ্রকে খবর দিয়েছে তখন, মনীন্দ্র গিয়ে চিকিৎসা সারিয়েছে। প্রয়োজনে মনীন্দ্র নাকি জিভ দিয়ে চেটে চেটে রোগীর শরীর থেকে বসন্ত তুলে নেয়। কাজী বাড়ির আকবরকে নাকি বাঁচিয়েছিল ওরকম চেটে চেটে। আকবর এখন মাওয়ার বাজারে মুদিমনোহারির দোকান করে।

এসব গল্প মেদিনীমণ্ডলের সবার জানা। মনীন্দ্র সম্পর্কে এরকম গল্প অনেককাল ধরে চলছে চারপাশের গ্রামে।

মজিদ ফিরে এল খানিক পর। ঘাটে নৌকা বাঁধার শব্দ পেয়েই বেঞ্চে বসা লোকগুলো ওঠে। সালতাবদ্দিন বলল, আর না মনীন্দ্র, ম্যালা রাইত অইছে। যাই।

মনীন্দ্র কোনও কথা বলে না। একে একে লোকগুলো সব অন্ধকার উঠোনে নেমে যায়। তারপর ঘাটে নৌকা ছাড়ার শব্দ, জলে বৈঠা পড়ার শব্দ।

মজিদকে দেখেই আড়মোড় ভাঙল মনীন্দ্র। খাটের তলা থেকে বইলাঅলা খড়ম দুটো বের করে পরল। তারপর মাটিতে চটর চটর শব্দ তুলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। চৌধুরী নেই, মনীন্দ্রকেই করতে হয় সব। রান্না বান্না, হাট বাজার। বামুনের পোলা, বেজাতের হাতেরটা তো আর খেতে পারে না!

রান্নাঘরে গিয়ে চুলো জ্বালায় মনীন্দ্র। চুলোর ওপর এক কড়াই দুধ থাকে সব সময়। ঘন্টায় ঘন্টায় দুধ খায় মনীন্দ্র। রাতের বেলা ভাত খায় না। ফলটা মিষ্টিটা খায়। রোগীবাড়ি থেকে ম্যালা কিছু পায় মনীন্দ্র। ফলপাকুর, মিষ্টি, মাছ। মনীন্দ্রের রান্নাঘর ভর্তি থাকে খাবারে।

আজ রাতেরবেলা মনীন্দ্র দুটো সবরিকলা নেয়, কাঁসার বড় বাটিতে একবাটি দুধ নেয়। এই তার রাতের খাবার। চৌধুরী থাকলে এসব মনীন্দ্রকে করতে হয় না। চৌধুরীই করে সব। কিন্তু মাসখানেক হল চৌধুরী গেছে কোলকাতা। ছেলেমেয়েরা সব কোলকাতায় চৌধুরীর। হিন্দুস্থান পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই। চৌধুরী দুবছর তিনবছর পর গিয়ে দেখা করে আসে তাদের সঙ্গে। বিষম লোভী মানুষটা। মনীন্দ্রর রক্ত সম্পর্কের কেউ না। তবুও এদেশে পড়ে আছে শুধু লোভে। মনীন্দ্র বলেছে চিতায় ওঠার আগে বাড়িটা চৌধুরীর নামে দলিল করে দিয়ে যাবে। সেই আশায়ই ছেলেমেয়ে ছেড়ে এদেশে পড়ে আছে চৌধুরী।

আজ রাতে রান্নাঘরে বসে দুধ কলা খেতে খেতে এসব কথা মনে পড়ে মনীন্দ্রের। মনে পড়ে হাসি পায়।

পাশের ঘরে মজিদ আবার হামানদিস্তা ঠুকছে। চুক চুক চুক। চারদিকের গাছপালায় রাত্রিকাল গম্ভীর হচ্ছে। অবিরাম ডাকছে পোকামাকড়। পশ্চিমের বাঁশঝাড়ে দুতিনটে শেয়াল সুর করে ডাকে। শুনে দুধকলা খেতে খেতে মনীন্দ্রর বুকের মধ্যে কেমন একটু কষ্ট হয়। বর্ষাকালে, শেয়ালদের অভাব যাচ্ছে। গোরস্থানে গিয়ে যে মরা খাবে, উপায় নেই। চারদিকে জল। শেয়ালের ডাকে অনাহারের গন্ধ পায় মনীন্দ্র। ভারী একটা কষ্ট হয় তার। গলা দিয়ে দুধকলা নামতে চায় না।

উঠোনের পরই ঘাট। খালিকালে ঘাটটা থাকে বেশ দূরে। বাড়ির নামার দিকে ছোট্ট গোল পুকুর। বর্ষা এসে, বর্ষায় জল ক্রমশ ফুলতে শুরু করলে ঘাটটা ক্রমশ ওপর দিকে ওঠে আসে। এখন যেমন উঠোনের সঙ্গেই ঘাট। রান্নাঘর থেকে চার কদম ফেললেই ঘাট। এবার জলের যে রকম জোর দেখা যাচ্ছে বোধ হয় মনীন্দ্রের উঠোনেই চলে আসবে বর্ষার ঢল।

বানবন্যায় ভেসে যাবে দেশ।

ঘাটের কাছে জিংলাগাছের সঙ্গে মনীন্দ্রের নাওটা বাঁধা। অন্ধকার করে জলের ওপর ভাসছে নাওটা। তার ওপর দিয়ে পাখায় পতপত শব্দ তুলে উড়ে যায় দুটো বাদুড়। কুপি হাতে নাওটার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় মনীন্দ্র। অন্ধকার গাছপালার দিকে তাকিয়ে বাড়ি বন্ধ করার মন্ত্র পড়ে। তারপর ঘাটপাড় থেকে উঠোনের দিকে ওঠে আসে। হাতে কুপি, মুখে মন্ত্র। পায়ে বইলাঅলা খড়মের চটর চটর শব্দ তুলে উঠোনময় হাঁটে মনীন্দ্র। মন্ত্র পড়ে। মজিদ সেই ফাঁকে হামানদিস্তা থামিয়ে রান্নাঘরে শুতে যায়।

মজিদ ঘুমিয়ে পড়ার পরও অনেকক্ষণ জেগে থাকে মনীন্দ্র। উঠোনে পায়চারি করে। কখনো কুপিটা জ্বালিয়ে রাখে পুজোর ঘরে।

চারদিক খোলা। ছোট্ট চৌচালা ঘর, তার মাঝমধ্যিখানে কুপি জ্বালিয়ে রেখে নিজের ঘরে ফিরে যায় মনীন্দ্র। কত কী যে মনে পড়ে তখন! সনাতনীর কথা, পাশের বাড়ির মুসলমান মেয়েগুলোর কথা, মেয়েদের মার কথা।

বিয়ের পর পরই সনাতনী জেনে গিয়েছিল পাশের বাড়ির মুসলমান বউটার সঙ্গে গোপন সম্পর্ক মনীন্দ্রর। এজন্যেই বউর ব্যাপারে উদাসীন মনীন্দ্র। স্বামীর ব্যাপারে সব জেনে শুনে কদিন খুব কাঁদল সনাতনী। তারপর এক রাতে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিল। মনীন্দ্র সে রাতে গিয়েছিল মেন্দাবাড়ি। মেন্দাবাড়ি ছিল গানের আসর। কৃষ্ণলীলা। ভারী জমজমাট আসর। সনাতনী পুড়ে মরে গেল, মনীন্দ্র টেরও পেল না। কৃষ্ণলীলায় বিভোর হয়ে রইল। রাতেরবেলা এসব কথা আজকাল প্রায়ই মনে পড়ে মনীন্দ্রর। কতকাল হয়ে গেল, পুরো ত্রিশ বছর, তবুও সনাতনীকে ভুলতে পারেনি মনীন্দ্র।

মনীন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর দরোজা বন্ধ করে মাথার কাছে হারিকেন নিয়ে শুয়ে পড়ল। হোমিওপ্যাথির বইটা মেলে ধরল চোখের ওপর।

কিন্তু পড়তে ভাল্লাগে না মনীন্দ্রর। রাতেরবেলা শরীরের ভেতর ঘুরপাক খায় অসম্ভব এক যন্ত্রণা। বয়স হয়ে গেল তিন কুড়ির কাছাকাছি, তবুও কামটা মরেনি মনীন্দ্রর। রাতেরবেলা এখন শরীর আনচান করে। যুবক বয়স থেকেই মনীন্দ্র খুব কামপ্রিয়। এখন, এই বুড়ো বয়সেও তাগড়া পুরুষের মতন সঙ্গম করতে পারে সে। এসব কবরেজি ওষুধের গুণ। সনাতনী মারা গেছে ত্রিশ বছর। মনীন্দ্র আর বিয়ে করেনি। বামুনের পোলা বিয়ে করলে অধর্ম হয়। কিন্তু শরীর কি ধর্ম অধর্ম মানে! পাশের বাড়ির বউটার সঙ্গে ভাব ছিল মনীন্দ্রর। সনাতনী মারা যাওয়ার পর সুযোগ পেলেই বউটা এসে মনীন্দ্রর সঙ্গে খাটে ওঠত। অভাবের সংসার তার, স্বামী খেতখোলা করে, তাতে সংসার চলে না। মনীন্দ্র চালটা ডালটা দেয়, নেয় কেবল শরীরটা। দিন চলে যায়।

মনীন্দ্রর বড় দোষ ছিল এক নারীতে বেশিকাল সুখ পেত না সে। পাশের বাড়ির বউটাকে একসময় আর ভালো লাগেনি তার। ততদিন বউটার বড় মেয়ে পরী বেশ ডাগরডোগর হয়ে ওঠেছে। মনীন্দ্রর চোখ পড়ল পরীর ওপর। একদিন পরীও কেমন করে যেন ওঠে এল খাটে। মনীন্দ্র ডাক্তার মানুষ। গর্ভ না হওয়ার ওষুধ খাওয়াত। ফলে পরী নির্ভয়ে মনীন্দ্রর কাছে আসত।

পরীর মা অবশ্য জেনে গিয়েছিল ব্যাপারটা চেপে থাকত। মনীন্দ্র পরীকে তার মায়ের কথা বলেছে। ফলে মা মেয়ে দুজনই দুজনার কাছে অপরাধী। দুজনেই চেপে থাকত। তিন বছর পর বিয়ে হয়ে গেল পরীর। তখন তার ছোটটা নুড়ি ধরল মা বোনের পথ। সেও রাতে বিরাতে, দিন দুপুরে যখন সুযোগ পায় মনীন্দ্রর কাছে যায়। নুড়ি একটু দুর্বল শরীরের মেয়ে ছিল। কিন্তু মনীন্দ্র অতিরিক্ত কামুক। নুড়ির বেশ কষ্ট হত, শরীর বইতে চাইত না। তবুও যেত। মনীন্দ্রর চালটা ডালটায় সংসার চলে তাদের। বাবা খেতখোলা। করে ভরপেট খাওয়াতে পারে না। কী করবে! ভাতের চেয়ে কি শরীর বড়!

নুড়ির বিয়ের পর বাড়ির শেষ মেয়ে টুকি। টুকির তখন বয়েস খুব কম। এগার বার হবে। গাবের মুচির মতন বুক ওঠেছে। পাখির মতন চঞ্চল টুকি। চৌপরদিন মনীন্দ্রর বাড়ি পড়ে থাকে। পেয়ারা গাছে চড়ে, আমগাছে চড়ে। কথায় কথায় খিলখিল করে। হাসে। মনীন্দ্রকে ডাকে ঠাকদা বলে।

এই টুকিকেও একদিন খাটে তুলল মনীন্দ্র। টুকির বয়স কম। রক্তাক্ত হয়ে গেল। কিন্তু মেয়েমানুষ তো, ভগবান সহ্যশক্তি দিয়েছেন। একটুও কাঁদলো না টুকি। মনীন্দ্র দু পুরিয়া হোমিওপ্যাথি খাইয়ে এক আগল চালডাল দিল, আনাজপাতি দিল। তাই কাঁখে নিয়ে খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি চলে গেল টুকি।

তারপর নিয়মিত।

টুকি একটু অন্যরকম মেয়ে ছিল। পরী নুড়ি কিংবা তাদের মার মতন শুধু খাওয়াটা আর শোয়াটাই বুঝত না। মনীন্দ্রকে ভালোবাসত মেয়েটা। বড় ভালোবাসত। সময়ে অসময়ে এসে সেবাযত্ন করত, আদর সোহাগ করত। ঘরটা ঝেড়ে দিত, ওষুধের আলমারিটা নেড়েচেড়ে গোছগাছ করে দিত। অসুখবিসুখ করলে দিনরাত থাকত মনীন্দ্রর কাছে। ঘরের বউর মতন। অতটুকু মেয়ে কী করে যে পারত এসব!

টুকির শরীরে অদ্ভুত একটা গন্ধ ছিল। কোনও মেয়েমানুষের গায়ে এরকম গন্ধ পায়নি মনীন্দ্র। কাঁচা পেয়ারা গাছে কুড়োল মারলে যেরকম গন্ধ ওঠে, ঐরকম গন্ধ। গন্ধটা বড় ভালো লাগত মনীন্দ্রর। বড় প্রিয় ছিল গন্ধটা।

টুকির আর একটা অভ্যেস ছিল। রাতের বেলা কখনো মনীন্দ্রর কাছে থাকলে পুরো জামা কাপড় খুলে শুত। শোয়ার ভঙ্গিটা সরীসৃপের মতন। দুহাতে মনীন্দ্রর কোমরের ওপর। একপা তুলে সারারাত পড়ে থাকত। ঘুমাবার সময় একটুও নড়াচড়া করত না।

পরপর দুবার গর্ভবতী হয়েছিল টুকি টুকির মা-বোনরা মনীন্দ্রর সঙ্গে শুয়ে কেউ গর্ভবতী হয়নি। মনীন্দ্র ওষুধবিষুধ দিত। টুকিকেও দিয়েছিল। কাজ হয়নি।

ব্যাপারটা দেখে মনীন্দ্র খুবই অবাক হয়েছিল। তার ওষুধে কাজ হয় না। আশ্চর্য ব্যাপার! পরে বুঝেছে টুকি আসলে আদিনারী। পুরুষসঙ্গেই গর্ভবতী হয়। ওষুধবিসুধে ধরে না।

সেই টুকিরও একদিন বিয়ে হয়ে গেল আজ এক বছর। পুরো একবছর। সেই বাড়ির পোলা মংলা জেদাজেদি করে বিয়ে করল টুকিকে। মংলার একটা পা ছোট, হাটে ত্যাড়া হয়ে। শরীরটা দশাসই, বুসিকালির মতন গায়ের রঙ। চৌপরদিন গাঁজা টানে। রাতে করে ডাকাতি। চোখদুটো কোড়া পাখির চোখের মতন লাল।

যখন মংলার সঙ্গে টুকির বিয়ের কথা হচ্ছে, গোপনে মনীন্দ্র একটা ভাঙানি দিয়েছিল। ঘটক ছিল কাজির পাগলার বশির মোল্লা। বশির মোল্লাকে মনীন্দ্র বলেছিল টুকির স্বভাব চরিত্র খারাপ। মনীন্দ্রর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। বশির গিয়ে মংলাকে বলল। শুনে মংলা গেল ক্ষেপে। হোক খারাপ, এই মেয়েকেই সে বিয়ে করবে।

করলও।

তখন তো মনীন্দ্রর মাথায় বাড়ি। তার জন্যে যে আর কেউ রইল না! মংলার আগেও টুকির অনেক সম্বন্ধ এসেছে, মনীন্দ্র গোপনে ভাঙানি দিয়েছে। কারণ একটাই, টুকি চলে গেলে তার হবে কী।

তবুও চলে গেল টুকি।

বিয়ের আগের দিন মনীন্দ্রর সঙ্গে গোপনে একবার দেখা করেছিল টুকি। অনেক কথা বলেছিল, অনেক কেঁদেছিল। শেষবারের মতোন শরীরের সুখ দিয়েছিল মনীন্দ্রকে। সেই টুকির কথা ভেবেও আজকাল রাতে ভালো ঘুম হয় না মনীন্দ্রর। শরীরটা ছটফট করে, ঘুমোলে স্বপ্ন দেখে টুকিকে। ভালো লাগে না। ওঠে বাইরে যায়। রাতেরবেলা বাইরের গাছপালায় মৃদু একটা হাওয়া থাকে, জমাট একটা অন্ধকার থাকে। মাথার ওপর দিয়ে নিশাপাখি উড়ে যায়। দূরে কোথাও একাকী কঁ কঁ করে কেঁদে ওঠে কী এক পাখি। বাঁশঝাড়ে ছুটোছুটি করে শেয়াল। উঠোনের শেষে ডাকাডাকি। সবকিছু মিলিয়ে পুরনো পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না মনীন্দ্রর। তিনকুড়ি বয়েস হল, আর কত কাল। কোনও কোনও মধ্যরাতে আকাশে চাঁদ ওঠলে উঠোনে পায়চারি করতে করতে গুনগুনিয়ে গান গায় মনীন্দ্র, আমার এমন জনম আর কী হবে, মানুষ দেখতে এসেছিলাম ভবে।

পুবের ঘরে বুড়ো সমেদ খুক খুক করে কাশে। কদিন ধরে শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তার। বর্ষার মুখে দিন কতক ম্যালা খাটাখাটনি গেছে। ধানিবিলের জমি দুটোয় সোনাদিঘা ধানের ফাঁকে ফাঁকে আড়ালি আর সেচি জন্মেছিল। বর্ষার আগে নিড়ানি পড়েনি বলে গোড়ায় জল পেয়ে আগাছাগুলো রাতারাতি ছেয়ে ফেলল জমি। ধানগুলো নষ্ট হয়। হাজামবাড়ির রবাকে নিয়ে দিন কয়েক ক্ষেত ডোগাল সমেদ। আড়ালি আর সেচি তুলে ফেলে দিল। ফলে ধানগাছগুলো হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কদিন হল থোর বেরিয়েছে, সমেদ দিনচারেক আগে দেখেছে। জলের ওপর ভেসে থাকে নধরপুষ্ট ধানচারা। বর্ষাকালীন হাওয়ায় ভারি থোর মাথায় নিয়ে দোল খায়। বড় ভালো লাগে দেখতে।

সেদিন থেকেই একটু একটু শরীর খারাপ সমেদের। কাশিটা চাগা দিয়েছে। রাতেরবেলা ঘুসঘুসে জ্বর হয়। বরাবরই ঠাণ্ডার বাই সমেদের। বর্ষার নতুন জল, বড় তেজ তার। গা ডোবালে জ্বরজারি নির্ঘাৎ।

সমেদ কদিন বাড়ি থেকে বেরয় না। আতবী বেরুতে দেয় না। এখন তেমন কোনও কাজ নেই। তবুও কাল বিকেলে বেরিয়েছিল সমেদ। আতবী বলেছিল মনীন্দ্রর কাছে। যেতে। মনীন্দ্র বিনিমাগনা ওষধপথ্য দেয়।

কিন্তু সমেদ যায়নি। বলেছিল যাবে। যায়নি। বিলের জমি দুটো ঘুরে ফিরে দেখে বাড়ি ফিরেছে।

বাড়ি ফিরতেই আতবী ধরেছে, গ্যাছেলা?

সমেদ কাশতে কাশতে বলেছে, না।

ক্যা?

সমেদ আর কথা বলেনি।

আতবী আবার বলেছে, কাশতে কাশতে তো মইরা যাইবা!

শুনে খ্যাকিয়ে উঠেছে সমেদ, মরলে মরমু।

আতবী তারপর আর কোন কথা বলেনি।

মনীন্দ্রকে দুচোখে দেখতে পারে না সমেদ। কারণটা আতবী ঠিক জানে না। আঁচ করে তার ব্যাপারটা সমেদ জানে। পরী নুড়ি টুকির ব্যাপারও জানে। হাজার হোক পুরুষ তো। স্বামী হয়ে, বাপ হয়ে, ঘরের বউ মেয়েদের পরপুরুষের সঙ্গে শোয়ার কথা জেনে সেই মানুষকে দেখতে পারবে কেমন করে!

এসব ভেবে ভেতরে ভেতরে রাগও হয় আবীর। বউমেয়েদের যে পুরুষ দুবেলা খাওয়াতে পারে না, তার অত তেজ থাকবে কেন!

মুখে বলে না কিছু। বয়স হয়ে গেছে, ঝগড়াঝাটি ভাল্লাগে না আজকাল। চেপে থাকে আতবী। সব চেপে থাকে। অবশ্য দশ বছর আগে হলে নিজেই মনীন্দ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়াত। স্বামীর জন্যে ওষুধ, আর নিজের জন্যে আনত কিছু গোপন সুখ।

কিন্তু আজ আর যাওয়া যায় না মনীন্দ্রের কাছে। বয়স হয়ে গেছে। কাম নেই।

কিন্তু মনীন্দ্রর কথা মনে হলে মনটা এখন বড় আনচান করে। বড় ভালো মানুষটা, বড় দরদী। আতবীর সংসারটা মনীন্দ্রই চালিয়েছে বারো আনা। সমেদের যা রোজগারপাতি তাতে সারাবছর এক বেলা করেও খাওয়া হত না। মনীন্দ্র চালটা ডালটা দিয়েছে, টাকাটা পয়সাটা দিয়েছে। নিয়েছে খুব কম। মেয়েগুলো বড় হওয়ার আগে আতবীকে ওঠতে হত মনীন্দ্রের খাটে। পরী নুড়ি টুকি বড় হয়ে মাকে হাছিব দিয়েছে। ক্ষতি কী! যে মানুষটা তাদের জন্য এত কিছু করেছে, তার জন্যে কিছুই তারা করবে না! পেটের চেয়ে ইজ্জত বড় হল!

সমেদকে এসব বুঝিয়ে বলা যায় না। বড় হিংসুটে মানুষ। তার সংসারের জন্যে যে এতকিছু করেছে মনীন্দ্র, সেসব সমেদ শুনতে চায়না। আতবী জোর দিয়ে কিছু বললে তেড়ে আসে মারতে। বুড়ো বয়সেও জেদ কমেনি মানুষটার। এখন পুবের ঘরে বসে কিরকম খুক খুক করে কাশছে। কেশে কেশে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। কাশি থামলেই মুখ হা করে অনেকক্ষণ ধরে শ্বাস টানবে। বুকের হাড়পাঁজরা শ্বাস টানার তালে তালে নড়বড় নড়বড় করবে। দেখলে মায়া হয়। কিন্তু আতবী কী করবে। মন্দ্রির কাছে সমেদ যাবে না। মরে যাবে। তবুও না।

.

টুকির মা, ও টুকির মা!

কোন ফাঁকে থেমে গেছে সমেদের কাশি। এখন আতবীকে ডাকছে সে।

রান্নাঘরে বসে দেয় আতবী, কী?

আমারে ইট্টু তামুক দেও।

দিতাছি।

তারপর আবার সব চুপচাপ।

সমেদের কাশির শব্দ না থাকলে বাড়িটা বড় নিশ্ৰুপ হয়ে যায়। চারদিকে বর্ষার জল, গাছপালা, বাড়িতে বুড়োবুড়ি দুজন মাত্র মানুষ। কথা বলার লোক নেই,শব্দ উঠবে কোত্থেকে! অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে তামাক সাজায় আতবী। সংসারে তেমন কোনও কাজকাম নেই। বুড়োবুড়ির সংসার, একবেলা দুটো রান্না করলে দিনমান চলে যায়। বাকি সময়টা উঠোনে বসে থাকে আতবী। হঠাৎ সমেদ ডাকে, তামাক দিতে বলে। একটা কাজ পায় আতবী। অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে তামাক সাজে। ফুঁ দিয়ে দিয়ে টিকা জ্বালায়। তারপর নিজে খানিক টেনে ধোঁয়া। উঠিয়ে সমেদের হাতে নিয়ে দেয়। সমেদ মনোযোগ দিয়ে তামাক টানে। টানার তালে তার বুকের হাড়পাঁজরা নড়বড় করে। দেখে বুড়ি আতবী ভেতরে ভেতরে কাপে।

মানুষটা মরে গেলে বিধবা হয়ে যাবে আতবী। ভেবে বড় কষ্ট হয়। বিধবা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ ভালো।

এসব ভেবে আবার সমেদকে অনুনয় করে আতবী। হুনছ, একবার যাও ঠাকুরের কাছে।

হুঁকা নামিয়ে ঘোলা চোখে আতবীর দিকে তাকায় সমেদ। তাকিয়ে থাকে। আতবী দেখে মানুষটার চেহারায় ক্রোধ জ্বলছে। যে কোনও সময় ফেটে পড়বে। বয়স হয়েছে, ঝগড়াবিবাদ ভাল্লাগে না। আতবী আস্তে ধীরে উঠোনে নামে। মনে মনে গালাগাল দেয় সমেদকে। মরুগগা গোলামে। আমার কী!

.

দুপুরের পর কাশতে কাশতে কোষা নাও নিয়ে বেরয় সমেদ। বিলে যাবে। আতবী বসে ছিল উঠোনের কোণে। সমেদ একবার তাকাল আতবীর দিকে। কথা বলল না। আতবীও বলল না। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল ছোট্ট বৈঠা বেয়ে গাছপালার আড়ালে আস্তে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল আবীর। মানুষ মরে গেলে আর ফিরে আসে না। এই মানুষটা কাশতে কাশতে মরে গেলে আর কোনদিন ফিরে আসবেনা। আতবী যাবে বিধবা হয়ে।

এসব ভেবে হঠাৎই লাফিয়ে ওঠে আতবী। সমেদ বিলে গেছে, ফিরতে অনেক সময়। এই ফাঁকে মনীন্দ্রর সঙ্গে একটু দেখা করে এলে হয়। সমেদের জন্যে খাওয়ার ওষুধ আনা যাবে না। আনলেই বুঝে যাবে আতবী মনীন্দ্রর কাছে গিয়েছিল। আরেক অশান্তি দেখা দেবে। ঝগড়া বিবাদ হবে। কিন্তু মনীন্দ্রকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে ব্যবস্থা দিয়ে দেবে মনীন্দ্র। ব্যবস্থামতন কাজ করলে কাশি সেরে যাবে সমেদের। ভেবে আতবী খুব খুশি। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে মনীন্দ্রর সীমানায় গিয়ে দাঁড়ায়।

সমেদের বাড়ির পরই জংলামতন খানিকটা জায়গা। কানিখানেক হবে। আগাছায় ভরে আছে জায়গাটা সেখানে এখন বর্ষার জল। সমেদ কোষা নিয়ে গেছে। আতবী এখন। পার হবে কেমন করে।

জলের ধারে দাঁড়িয়ে দুএক মুহূর্ত কী ভাবে আতবী। তারপর পরনের শাড়িটা পুরোপুরি খুলে হাতে নেয়। ওপারে গিয়ে পরে নিলেই হবে। কেউ তো আর দেখছে না। তাদের বাড়িতেও কেউ নেই। মনীন্দ্রর বাড়িতেও মনীন্দ্র ছাড়া আর কেউ নেই। এই দুপুরবেলা মনীন্দ্রর কাছে কোনও রোগী আসে না। উলঙ্গ আতবীকে দেখলে মনীন্দ্রই দেখতে পারে। সে তো কতই দেখেছে। মনীন্দ্রর কাছে আর লজ্জা কী!

আতবী জলে নামে।

ওপারে এসে শাড়ি পরতে পরতে পুরোনো দিনের কথা খুব মনে পড়ে আতবীর। কত দিন পালিয়ে মনীন্দ্রর কাছে এসেছে সে। রাতেরবেলা, দিনেরবেলা। এখন অনেককালের পুরনো স্মৃতি ভাবতে ভালো লাগে। আজও লাগল। শরীরের ভেতরটা বহুকাল পর চনমন করে উঠল আতবীর। মনীন্দ্র যদি আজও খাটে ওঠতে বলে আতবীকে।

আস্তেধীরে উঠোন পার হয়ে মনীন্দ্রের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় আতবী। দরোজা খোলা, ভেতরে খাটের ওপর শুয়ে আছে মনীন্দ্র। চোখের সামনে ধরা বই। সবকিছু উঠোন থেকেই দেখা যায়।

দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে খুক করে একটু কাশে আতবী। শুনে চোখের ওপর থেকে বইটা সরায় সনীন্দ্র। শুয়ে থেকেই আতবীর দিকে তাকায়। হাঁটুর ওপর উঠে যাওয়া ধুতিটা টেনে নামাতে নামাতে বলে, আহ। ঘরে আহ।

আতবী কথা বলে না। ঘরে ঢোকে।

ততক্ষণে উঠে বসেছে মনীন্দ্র। আতবীকে বলল, বলো।

আতবী কোনও কথা বলেছিল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মনীন্দ্রকে দেখছিল। তিন কুড়ির ওপর বয়স মানুষটার, কিন্তু এখনো কেমন বয়সকালের পুরুষ মানুষের মতন দেখায়। স্বাস্থ্য চেহারা সব আগের মতনই আছে মনীন্দ্রর। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙে একটুও ময়লা লাগেনি। একটাও চুল পাকেনি। ডাক্তার কবরেজ মানুষ, ওষুধবিষুধ খায়, ফলদুধ। খায়, স্বাস্থ্য ভালো থাকবে না কেন!

মনীন্দ্র বলল, শইল ভিজা ক্যা?

আতবী মাথা নিচু করে হাসে। পানি ভাইঙা আইছি।

কী মনে কইরা আইলা?

এই কথাটা মনীন্দ্র বলে সামান্য রসিকতা করে। শুনে বুড়ো বয়সেও শরীরের ভেতর চনমন করে ওঠে আবীর। বয়সকালে এই সুরেই কথা বলত মনীন্দ্র।

আতবী বললো, টুকির বাপের খুব কাশ। কাশতে কাশতে মইরা যায়।

ওষুধ দিমু?

না। তাইলে বুইজ্যা যাইবে আমি আইছিলাম।

শুনে মনীন্দ্র একটু থামে। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, আদা তেল গরম কইরা পিডে ডইল্লা দিও।

তারপর কেউ কোনও কথা বলে না। আবার সব চুপচাপ। আতবী বসে থাকে লম্বা বেঞ্চের এক কোণে। মনীন্দ্রের বাড়িটা বড় নিঝুম হয়ে আছে। বর্ষার জলে গাছপালা রোদেলা দুপুরে বয়ে যাচ্ছে। মিহিন একটা ঝিমমারা শব্দ উঠছে চারদিকে পৃথিবীর থেকে। দুটো বয়সী মানুষ। মুখোমুখি বসে থাকে, কত কী যে মনে হয় তাদের, তবুও কেউ কোনও কথা বলে না।

এক সময় উঠে দাঁড়ায় আতবী। যাইগা।

মনীন্দ্র বলে, তুমি এক্করে বুড়ি অইয়া গেছ।

শুনে হাসে আতবী। বয়েস কি কম অইল?

মনীন্দ্র আর কথা বলে না। আবার শুয়ে পড়ে বিছানায়। আতবী উঠোনে নেমে আস্তে ধীরে হেঁটে যায়। ভারী একটা দুঃখ হয় তার। মনীন্দ্রে বলল বুড়ি হয়ে গেছে আতবী। এজন্যে তাকে ছুঁয়েও দেখল না। বয়সকালে কাছে গেলেই আতবীর শরীর ঘাটত মনীন্দ্র। আজ তার বয়স নেই, এজন্যে মনীন্দ্র তাকে ছুঁয়েও দেখল না। ভেবে বুক ফেটে যায় আবীর। মনীন্দ্রকে দেখে বহুকাল পর কামভাবটা জেগেছিল। কিন্তু আতবীকে দেখে মনীন্দ্র তা বুঝল না। গভীর গোপন দুঃখ কিংবা অভিমানে বুক ফেটে যায়। আতবীর। চোখ ফেটে যায়। জলে নেমে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদে আতবী। মানুষের শরীর নদীর জোয়ার ভাটা, মানুষ তা বোঝে না। হায়রে মানুষ!

.

মেন্দাবাড়ির ঘাটে নৌকা বেঁধে নাইতে নেমেছে মজিদ। জল তোলপাড় করে সাঁতার কাটছে আর গলা খুলে গান গাইছে। মনীন্দ্রর মুখে শোনা গান। আমার এমন জনম। আর কি হবে। সঠিক উচ্চারণ জানে না মজিদ, শব্দে ভুল হয়। তবুও গায়। বড় আমুদে মানুষ। মনীন্দ্রর সামনে ভয়ে বসে থাকে, আড়ালে এলেই রাজা। গান গায়, হাসে, কাঁদে। এই যেমন এখন মোবাড়ির পোলাপান সব ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছে। মজিদকে দেখলেই হৈহৈ করে ছুটে আসে সবাই, হাততালি দেয়। তাতে মজিদ বড় আমোদ পায়। জলে নেমে এখন কত রকমের যে কসরৎ দেখাচ্ছে! মাছের মতন ডুব দিয়ে বহুদূরে চলে যাচ্ছে। তাই দেখে মেন্দাবাড়ির পোলাপান বড় খুশি।

অনেকক্ষণ ডুবোডুবি করে পাড়ে ওঠে মজিদ। নৌকার আগায় বসে লাল গামছায় বিরাট শরীরটা মোছে। ছইয়ের ভেতর থেকে শুকনো লুঙি বের করে পরে। তারপর ভেজা লুঙিটা ছইয়ের ওপর মেলে দিয়ে নৌকা ছাড়ে। দুপুর গড়িয়ে গেছে, পেটের ভেতর বিষম খিদে। আজ বড় খাটাখাটরি গেছে মজিদের। মনীন্দ্রকে নিয়ে চার পাঁচটা গ্রাম ঘুরেছে। মাওয়া জশিলদিয়া কান্দিপাড়া। লগি ঠেলে হাতের ড্যানা ব্যথা হয়ে গেছে।

আর মনীন্দ্র হচ্ছে অদ্ভুত মানুষ। রোগীবাড়ি ঢুকলে বেরুতে চায় না। পান খাবে, গালগল্প করবে। দুনিয়ার মেয়েমানুষের সঙ্গে খাতির মনীন্দ্রের। লোকটা বোধহয় বশীকরণ মন্ত্রও জানে। এতটা বয়েস হল, তবুও মেয়েমানুষের দোষটা গেল না। দেখলেই কুত্তার মতন ছোঁক ছোঁক করে।

মনীন্দ্রের অবশ্য এই একটাই দোষ। এমনিতেই মানুষটা ভালো, দিলদরিয়া আমুদে। গ্রামের সব উৎসব আনন্দে মনীন্দ্রই খরচাপাতি করে বেশি। পয়লা বৈশাখে, গলুইয়ার দিন যে তার বাড়ি যাবে, তাকেই ভরপেট মিষ্টি খাওয়াবে। যাত্রাথিয়েটারেও বেশি চাঁদা দেয় মনীন্দ্র। রাত জেগে পোলাপানের সঙ্গে নাটকও করেছে গেল বছর। মেদিনী মণ্ডলের এমন কোনও মানুষ নেই যার কাছে টাকা না পায় মনীন্দ্রে। সমেদের সংসারটাই তো চলেছে মনীন্দ্রর ওপর দিয়ে। তিন মেয়ের বিয়ে দিল সমেদ, সব মনীন্দ্রর টাকায়।

কিন্তু রসটা আদায় করে নিয়েছে মনীন্দ্র। মেয়েগুলোর রাখেনি কিছু। মজিদ সব জানে। টুকির তো বিয়েই বন্ধ করে রেখেছিল মনীন্দ্র। কিছু তুকতাকও জানে সে। টুকির বিয়ে হয় না বিয়ে হয় না। দিন যায়। টুকির সম্বন্ধ আসে, ভেঙ্গে যায়। সব মনীন্দ্রর কারসাজি।

টুকির বিয়ে হয়ে গেলে তখন কে নিয়ে শোবে কী করে মনীন্দ্র।

কিন্তু একটা কথা ভেবে মজিদ বড় ভয় পায় আজকাল। টুকির যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, মংলা, দামলার সর্দার বাড়ির পোলা। সর্দাররা ডাকাতের বংশ। মংলা যদি জানতে পারে টুকি মনীন্দ্রর সঙ্গে শুত, তাহলে পয়লা টুকিকে তারপর মনীন্দ্রকে কচুকাটা করবে। আল্লারে কী যে হবে তাহলে!

মজিদ আর ভাবতে পারে না। বুকের ভেতর বর্ষার দামাল বাতাস ঢুকে যায়।

.

বাড়ি এসে মজিদ খুব অবাক। বুড়ো বাপ মা, জোয়ান ভাই দুটো হাত-পা ছাড়িয়ে বসে আছে। ঘাটে নৌকা বাঁধতে দৃশ্যটা দেখে মজিদ। টের পায় ঘরে দানাপানি নাই। মেজাজটা বিগড়ে যায় তার। বর্ষাকালটা এরকমই যায় তাদের। ভাই দুটোর কাজকাম থাকে না। বুড়ো বাপের তো শীতকাল ছাড়া কখনোই কাজকাম নেই। সারা বছর অবসর। শীতকালে তবু যাহোক দু চারটে কামকাজ পায় এখনো। বুড়োমানুষ, চোখে ভালো দেখে না। লোকেরা মুসলমানির কাজকাম আজকাল তাকে দিয়ে করতে ভয় পায়। কান্দিপাড়ার আফাজদ্দি খনকারের ছোট পোলাটার মুসলমানি করাল গেলবার। ঘা শুকোয় না পোলাটার। একমাস দেড়মাস সময় নিল। খনকার তাই নিয়ে ম্যালা গালাগাল করেছিল বাপটাকে।

বাপটা নিজেও আজকাল আর সাহস পায় না। বয়স হয়েছে হাত পা কাঁপে। এক চোখে ছানি পড়েছে। তাছাড়া কাজিরপাগলায় সরকারি ডাক্তারখানা হয়েছে, লোকে আজকাল সেখানেই যায়। এসব ভাবলে মজিদের বড় মন খারাপ হয়। মজিদ খুবই সরলসোজা মানুষ। কোন ঝুটঝামেলায় সে নেই। পছন্দও করে না। মজিদ কখনও আগামীকালের কথা ভাবে না, গতকালের কথা ভাবে না। সে আছে আজকের দিনটি নিয়ে। মনীন্দ্রর বাড়ি কাজ করে যা পায় বাড়ি এসে বুড়োবুড়ির হাতে তুলে দেয়। তাছাড়া যখন যা হাতের কাছে পায়, মনীন্দ্রের বাড়ির চালটা ডালটা, আনাজটা চুরি নিয়ে আসে। সংসারে জন্যে এত যে করছে, তারপরও দুবেলা ঠিকঠাক মতন আহার না জুটলে মন খারাপ হবে না!

ঘাটে নৌকা বেঁধে উঠোনে ওঠতেই প্রথমে জ্বলজ্বলে চোখে মজিদের দিকে তাকাল বুড়ো মা বাবা, তারপর আবালের মতন ড্যাবড্যাবা চোখে জোয়ান ভাই দুটো। মজিদ ভেবেছিল একটু রাগারাগি করবে, বলবে, আমি কত টানুম তগো। টানতে টানতে মইরা যামু। আমারে তরা মইরা যাইতে কচ!

কিন্তু মুখগুলো দেখে কীরকম মায়া লাগে বলা হয় না।

মজিদ আবার নৌকায় চড়ে। রবাকে ডেকে বলে, বিয়ালে যাইচ।

কেমন করে যাবে রবা তা জানে। কোনও কথা বলে না। খুশিতে চারজন মানুষের চোখ এখন ঝলসাচ্ছে মজিদ বুঝতে পারে। রাতের বেলা গরমাগরম ভাত খাবে। রবা হয়তো এখন পুঁটি-টেংরাও যোগাড় করে ফেলবে কিছু।

মজিদের একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

.

বিকেলবেলা ধরাছি খেলা হয় ঠাকুরবাড়ি। বর্ষাকাল, মাঠঘাট সব জলের তলায়। গ্রামের ছেলেপান সব ধরাছি খেলার মাঠ পেয়ে ঠাকুরবাড়ি ভিড় করে। মনীন্দ্রও উৎসাহ দেয় তাদের। হাতাঅলা চেয়ার নিয়ে বসে খেলা দেখা। কত মানুষজন, কত নাও, কত কোষা! হল্লাচেল্লা। মজিদ এই বিকেলবেলাটা ঘরের কাজকাম করে কাটায়। উঠোন ঝাড়ু দেয়, ওষুধের আলমারি গুছিয়ে রাখে আর চোরা চোখে রান্নাঘরের বাড়তি জিনিসপত্র দেখে। কোনটা সরালে মনীন্দ্র টের পাবে, কোনটা সরালে পাবে না। ঠিক তখনি রান্নাঘরের পেছনদিককার জলে টাবুরটুবুর শব্দ হয়।

মজিদ বুঝতে পারে রবা এসেছে। কোনও কথা বলে না সে। দূরে গাছপালার আড়ালে ধরাছি খেলার মাঠটা একবার তাকিয়ে দেখে। খেলা খুব জমে গেছে। এখন এদিকে ভুলেও কেউ আসবে না। মজিদ আস্তেধীরে রান্নাঘরের পেছন দিকে যায়। সেখানে হাজার রকমের আগাছা জলের ওপর ভেসে আছে।

প্রথমে রবাকে চোখে পড়ে না মজিদের। কালো শরীরটা আগাছার জঙ্গলে ডুবিয়ে বসে আছে। দেখলে মনে হয় নিজেও আগাছা হয়ে গেছে রবা।

মজিদকে দেখে ঝোপের ভেতর থেকে গলা বের করে রবা। মজিদ কোনও কথা বলে না। আস্তে করে ডান হাতটা রবার দিকে বাড়িয়ে দেয়। রবা মাটির বিরাট একটা হাঁড়ি ঝোপের ভেতর থেকে টেনে বের করে মজিদের হাতে দেয়। মজিদ সাবধানে চারদিকে চায়।

তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে।

ঠাকুরের চাল থাকে কাঠের মাঝারি ধরনের একটা পিপায়। প্রায় ভর্তিই থাকে পিপা। আজও ছিল। মজিদ ঘরে ঢুকে দ্রুত আধ হাঁড়ি চাল ভরে রবার হাতে নিয়ে দেয়। দেখে রবা ভারি খুশি। দাঁত কেলিয়ে একটু হাসে। তারপর হাঁড়িটা জলের ওপর দিয়ে ঠেলে আস্তেধীরে মিলিয়ে যায়। রান্নাঘরের পেছনে মজিদ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। বুক কাপিয়ে ভারি দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।

.

ভোররাতে ঘুম ভাঙে মনীন্দ্রের। জেগে প্রথমে বুঝতেই পারে না জেগে আছে না ঘুমিয়ে। আজকাল প্রায়ই এরকম হয়। রাতের বেলা হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙার পর অনেকক্ষণ বুঝতেই পারে না ঘুমিয়ে আছে না জেগে। কেন যে এরকম হচ্ছে। বয়স! মৃত্যুর কথা মনে হয় মনীন্দ্রের। তিন কুড়ির ওপর বয়স হল, আর কতকাল, আর কতকাল বেচে থাকবে মনীন্দ্র! মানুষ কতকাল বাচে। আয়ুর সুতো কতটা লম্বা মানুষের! ঘুম ভাঙার পর আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না মনীন্দ্রর। রান্নাঘরে শুয়ে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মজিদ। চারদিকের পৃথিবীতে কোনও শব্দ নেই। এই সময় জীবজগতের বেশির ভাগ প্রাণীই ঘুমোয়। ঘুমোয় গাছপালা। জেগে থাকে কীটপতঙ্গ, রাতচরা পাখি, ঝিঁঝি পোকা। যাদের বিষয়কর্মের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর প্রচুর ব্যবধান।

মনীন্দ্র তারপর বিছানা ছাড়ে।

সারারাত মাথার কাছে হারিকেন জ্বলে। ঘরের ভেতর নিবু নিবু হারিকেনের পাতলা আলোটা আছে। সেই আলোয় সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগে।

দরোজা খুলে বাইরে যায় মনীন্দ্র। বাইরে তখন শেষরাতের মিহিন জ্যোৎস্না পড়ে আছে। গাছপালার দীর্ঘ ছায়া পড়ে আছে। তুলতুলে একটা বাতাস আছে, বাতাসটা টুকির হাতের মতো মায়াময়। বেরোতেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। শরীরটা কেঁপে ওঠে মনীন্দ্রের। মনীন্দ্র খানিক আনমনা হয়ে থাকে। খেয়াল করে শোনে চারদিকের গাছপালায় ঝোপঝাড়ে ডাকছে ঝিঁঝি পোকা। দূরে কোথায় ডাকছে কী একটা পাখি। কি পাখি! শেষ রাতে ডাকে!

মনীন্দ্র খেয়াল করে পাখির ডাকটা শোনে। কু কু করে থেকে থেকে ডাকছে। কুপাখি। পাখিটা চিনতে পেরেই চমকে চমকে ওঠে মনীন্দ্র। শরীরটা শীতকালের জলে নেমে যাওয়ার মতন বারকয়েক কেঁপে ওঠে তার। এই পাখিটা অশুভ। মানুষকে মৃত্যুর ডাক দিয়ে যায়। বুকটা তারপর কাঁপতে থাকে মনীন্দ্রের। সনাতনীর কথা মনে পড়ে। সনাতনী মারা গেছে ত্রিশ বছর। স্বামীর ভালোবাসা পায়নি, সেই দুঃখে কচি বয়সে গায়ে আগুন দিল। সনাতনীর জন্যে আজকাল যখন তখন কীরকম একটা দুঃখ হয় মনীন্দ্রের। নিজেকে বড় অপরাধী লাগে, বড় পাপী মনে হয়।

বইলাঅলা খড়মে চটর চটর শব্দ করে উঠোনে নামে মনীন্দ্র। খালি গা, গলায় পৈতে। দূরে কুপাখিটা তখনো ডাকছে। মিহিন জ্যোৎস্না আর গাছপালার অন্ধকারে তুলতুলে বাতাস সেই ডাক ছড়িয়ে দিচ্ছে দিকবিদিকে। এ ডাক মৃত্যুর ডাক। কার মরণডাক ডাকে পাখি!

মনীন্দ্র ডান হাতে পৈতেটা চেপে ধরে বিড় বিড় করে কৃষ্ণ নাম জপে। তারপর আস্তে ধীরে হেঁটে যায় পুজোর ঘরের দিকে।

চারদিক খোলা চৌচালা ঘর। কিন্তু ঘরের মাঝখানে সাদা শাড়ি পরে কে অমন করে দাঁড়িয়ে আছে! চমকে ওঠে মনীন্দ্র। সনাতনী! চিৎকার করে সনাতনীকে ডাকতে যায় মনীন্দ্র। তার আগেই বুঝতে পারে ঘরের পেছন দিককার কলাঝোপের ওপর জ্যোৎস্না পড়ে মানুষের অবয়ব ধরেছে। সেই ছায়াটা এসে পড়েছে পুজোঘরের মাঝখানে।

আগে ভুল দৃশ্য দেখলে হাসত মনীন্দ্র। আজ হাসি পায় না। বুকের ভেতরটা কাঁপে। সনাতনীকেই যেন দেখল সে। কলাগাছের পাতার ভেতর কীরকম যেন মিলিয়ে গেল। সনাতনী কি তাকে ডাকতে এসেছিল?

ভয় করে মনীন্দ্রর। তিন কুড়ির ওপর বয়েস হল, আর কতকাল!

রান্নাঘরে তখনও নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছে মজিদ। দূরে মোরগের বাগ, কোড়লের বাগ। আস্তে ধীরে জাগছে পৃথিবী, জীবজন্তু, গাছপালা। কুপাখিটা আর ডাকে না। মিহিন জ্যোৎস্না গুটিয়ে নিয়েছে চাঁদ। গাছপালা থেকে অন্ধকার কাটতে শুরু করেছে। আর একটি দিন শুরু হল। কিন্তু মনীন্দ্রের আজ ভাল্লাগে না। মনটা কু ডাক ডাকে।

.

দুপুর থেকেই সাঙ্গাত নিয়ে বসেছে মানুষটা। সাঙ্গাতরা গাঁজা ডলছে আর কল্কিতে ভরছে, মানুষটা হরদম টেনে যাচ্ছে। একফাঁকে ডেকে ভাত খাইয়ে দিয়েছে টুকি। মংলা কী উঠতে চায়! টুকি হাত ধরে গাঁজা টেনে এনেছে, ভাত খাইয়া লও। তার বাদে যত ইচ্ছা গাঁজা টাইন্নো। মংলা তবু উঠতে চায় না দেখে তার সাঙ্গাত নশা একটু ঠেলা দিয়ে জড়ানো গলায় বলেছে, যাও ওস্তাদ, বাত খাইয়া আহ। বউ আদর কইরা ডাকতাছে!

টুকির সংসারে আরো দুজন মানুষ আছে। শ্বশুর শাশুড়ি। তারা ধাইধা গেছে মেয়ের বাড়ি বেড়াতে। কদিন পর ফিরবে তার ঠিক নেই। শাশুড়ি বাড়ি থাকলে মানুষটা বাড়ির ভেতর বসে এরকম রাতদিন গাঁজা টানতে পারত না। শাশুড়ি ঝাড়ু নিয়ে যেত পেটাতে।

টুকি অতটা পারে না। মংলা বদরাগী মানুষ। লেংড়াখোঁড়া মানুষরা একটু বদরাগীই হয়। তাছাড়া টুকির এখন শরীর ভারি, আট মাস চলছে। আগে হলে বাচ্চা মেয়ের মতন জোর করতে পারত। এখন পেটের ভারে চলাচল ধীর হয়েছে টুকির। লাফঝাঁপ বন্ধ হয়েছে। তবু মংলাকে হাত ধরে টেনে নিয়েছে ভাত খেতে।

খাওয়া শেষ করে মংলা আবার বসেছে গাঁজার আড্ডায়। চোখ দুটো এখন কোড়াপাখির চোখের মতন লাল দেখাচ্ছে তার। টুকি পাটাতন ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে দেখেছে। তারপর পাটাতনের ওপর হোগলা বিছিয়ে শুয়ে পড়েছে। আজকাল যখন তখন ঘুম পায় টুকির। ক্ষণে ক্ষণে অবশ হয়ে আসে শরীর। বিলকুমড়োর মতন পেটটা বেজায় ভারি, বইতে কষ্ট হয়।

টুকির কী হবে, ছেলে না মেয়ে! একটা ছেলের ভারি শখ টুকির। মনীন্দ্রের মতন টুকটুকে ফর্সা, বড় বড় চোখ, দামাল প্রকৃতির একটা ছেলে যদি টুকির হত!

হবে না। টুকির পেটে তো এখন মনীন্দ্ররটা নয়, মংলারটা। ছেলে হোক মেয়ে হোক মংলার মতনই হবে দেখতে। ভূষিকালো, নাক থ্যাবরা। আবার লেংড়াখোঁড়া না হয়! এই ভয়ে দিনরাত সিঁটিয়ে থাকে টুকি। ছেলে বা মেয়ে যাই হোক মংলার মতন লেংড়া খোঁড়া যদি হয়, এই ভয়ে কেবল ঘুম পায় টুকির।

.

বিকেলের দিকে মংলার ডাকে ঘুম ভাঙে টুকির। ওড বউ, বেইল গেল।

টুকি ধড়ফড় করে উঠে বসে! অনেকক্ষণ ঘুমোবার ফলে চোখ দুটো ফুলে গেছে। তবু খেয়াল করে মংলাকে দেখে। কালো শরীরে কালো রঙেরই পিরান পরেছে, কোমরে লাল গামছা বাঁধা। দেখেই টুকি বোঝে সাঙ্গাত নিয়ে মংলা কোথাও বেরুচ্ছে।

টুকি জিজ্ঞেস করে, কই যাইতাছ?

মংলা বলল, মেদিনীমোণ্ডল যামু।

নিজ গ্রামের নাম শুনে টুকি একটু চমকায়। তারপর খুশি হয়ে বলল, আমারে নিবা? ইট্টু বেড়াইয়া আইতাম!

মংলা বিড়ি টানতে টানতে বলল, না, তরে অহন কোনহানে লইয়া যাওন ঠিক অইব না। আছার ওছার খাইলে প্যাড নষ্ট অইয়া যাইব।

আছার খামু না।

তুই জানস আছার খাবি না!

টুকি এবার থেমে যায়। জানে এখন আর কোনও কথা বললেই রেগে যাবে মংলা। মনীন্দ্রের ব্যাপারটা টের পেয়েছে মংলা। একদিন টুকিকে জিজ্ঞেসও করেছিল; ঠাকুরের লগে তর বলে খাতির আছিল!

কে কইছে?

আমার লগে মিছা কথা কবি না।

টুকি তখন উপায় না দেখে ফোঁস ফোঁস করে কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, আমারে তুমি অবিশ্বাস কর?

মংলা আর কোনও কথা বলেনি। কিন্তু মংলার কথা না বলার মানে টুকি বুঝতে পেরেছে।

ঠাকুরকে একদিন দেখে নেবে মংলা। সুযোগ পেলেই দেখে নেবে।

সেই থেকে ভয়ে ভয়ে আছে টুকি। মংলা আজ মেদিনীমণ্ডল যাচ্ছে শুনে বুকের ভেতরটা হঠাৎ কাঁপতে শুরু করেছে তার। মনীন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে না তো মংলা! শুনে টুকি কেমন একটু রসিকতা করে, কেঐর গলা কাডতে যাইতেছনি। শুনে খ্যাক খ্যাক করে হাসে মংলা, কামই তো মাইনষের গলা কাডন!

নশা তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকে, নাও আইছে ওস্তাদ। লও বাইর অই।

.

বাঁশঝাড়ের ভেতর ছিপ নাওটা ঢুকিয়ে সাবধানে তিনজন মানুষ নামে। জলে কাদায় মৃদু শব্দ হয়। শব্দ বাঁচিয়ে আস্তেধীরে এগোয় তারা। পচা বাশপাতায় মশার রাজত্ব। অবিরাম ভ্যানভ্যান শব্দ করছে তারা। ঝাঁক বেঁধে মানুষগুলোকে কামড়ায়। মানুষগুলো পরোয়া করে না, শব্দ করে না। তাদের তিনজনের হাতে তিনটে রামদা জ্যোৎস্নায় বিদ্যুতের মতন চমকায়।

পায়ের কাছ দিয়ে সড়সড় করে পিছলে যায় গিরিগিটি কিংবা রক্তচোষা। তিনজন মানুষ একত্রে থামে। এখান থেকে মনীন্দ্রর ঘর উঠোন সব স্পষ্ট দেখা যায়। দুএকদিন আগে পূর্ণিমা হয়ে গেছে। চাঁদের আলো এখনও ম্লান হয়নি। চরাচর ধুয়ে যাচ্ছে জ্যোত্সায়। বাঁশঝাড়ের অন্ধকার ভেঙে জ্যোৎস্না ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে চারদিকে। তবু ঘুপটি মতন একটা জায়গা খুঁজে বসে তিনজন। মনীন্দ্রর ঘরের দিকে চোখ রেখে বসে থাকে।

কোমর থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করল মংলা। রামদাটা রাখল পায়ের কাছে। তারপর দুই সাঙ্গাতকে দুটো দিয়ে নিজেও সাবধানে ধরাল। টানতে লাগল।

মনীন্দ্রর ঘরে জনা চার পাঁচ লোক বসে আছে। মনীন্দ্র বিছানার ওপর শোয়া। কান পাতলে দু একটা টুকরোটাকরা কথার শব্দও পাওয়া যায়।

মংলা উদগ্রীব হয়ে কথা শোনে।

দূরে কোথায় তখন কী একটা পাখি ডেকে ওঠে। ঝিঁঝির ডাক তো আছেই। আর আছে। জ্যোৎস্না, চাপিলা মাছের মতন চকচকে জ্যোত্সা। বর্ষার ফলে বাঁশঝাড়ের ভেতর শোল গজার কিংবা ইঁদুরলোভী বোয়াল ঘাই দিয়ে যায়। মংলার তিনজন এসবের কিছুই খেয়াল করে না। চোরাস্রোতের মতো বয়ে যায় সময়।

মনীন্দ্রের ঘরের লোকগুলো ওঠে অনেক রাত করে। ঘাট থেকে একে একে ছেড়ে যায় অনেকগুলো নাও। মনীন্দ্র উঠে একবার বাইরে আসে। বাঁশঝাড়ের কাছে বসে, জল বিয়োগ করে যায়। মংলারা অন্ধকার হয়ে বসে থাকে। মনীন্দ্র দেখে না। চেঁচিয়ে মজিদকে বলে, যা তাড়াতাড়ি খাইয়া আয়গা মজিদ।

তারপর ঘরে গিয়ে ঢোকে।

তারও কিছু পর নাও ছাড়ে মজিদ। দূরে তার বৈঠার শব্দ মিলিয়ে যেতেই তিনজন মানুষ গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। নিঃশব্দে বাঁশঝাড় থেকে বেরোয়। জ্যোত্সায় হাতের রামদা চকচক করে তাদের।

আজ সারাদিন মনটা বড় খারাপ গেছে মনীন্দ্রের। ভোররাতে কুপাখির ডাকে ঘুম ভেঙেছে। তারপর পুজোর ঘরে কলাপাতা দেখল সনাতনী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই থেকে মনটা বড় কু ডাক ডাকছে। আজ কোনও রোগীবাড়ি যায়নি মনীন্দ্র। সারাদিন শুয়ে থেকেছে ঘরে। বিকেলবেলা পোলাপান এসেছে ধরাছি খেলতে, মনীন্দ্র দেখতেও যায়নি। সন্ধ্যের পর নিয়মিত আড্ডা দিতে এসেছে গ্রামের লোকজন। মনীন্দ্র বড় একটা কথা বলেনি। শুয়ে শুয়ে বই পড়েছে। দুএকজন জিজ্ঞেস করেছে, কত্তার কি শইল খারাপ?

মনীন্দ্র জবাব দেয়নি। আড্ডায় মজা ছিল না দেখে খানিক আগে বেরিয়ে গেছে সবাই। মজিদও গেছে খেতে। এখন এত বড় বাড়িটায় মনীন্দ্র একলা। রাত হয়েছে বেশ। একটু একটু ভয় করে মনীন্দ্রের। মজিদটা যে আজ কেন এত দেরি করছে ফিরতে।

হোমিওপ্যাথির বইটা চোখের ওপর খুলে শুয়ে থাকে মনীন্দ্র। মাথায় এক বর্ণও ঢোকে না। অকারণে বুকটা বার দুই কাঁপে।

ঠিক তখনই মৃদু পায়ের শব্দ হয় ঘরের ভেতর। চমকে চোখ তুলে তাকায় মনীন্দ্র। দেখে তিনজন মানুষ, হাতে চকচকে রামদা তাদের, মুখে কালো কাপড় বাঁধা। দেখেই বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা দ্রুত লাফিয়ে ওঠে, মুখ দিয়ে গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোয় না মনীন্দ্ররে। আনমনে ওঠে বসতে চায় সে, পারে না। তার আগেই ঘাড় বরাবর রামদা এসে পড়ে। ওক করে সামান্য একটু শব্দ করে মনীন্দ্র। তারপর বিছানার ওপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

ঠিক তখুনি মনীন্দ্রর বাড়ির পূর্বকোণের বিশাল দেবদারু গাছে বসে প্রাচীন কোড়লপাখিটা কুউক কুউক করে বাগ দিয়ে ওঠে। পাশের বাড়ির বুড়ি আতবী স্বামীর বুকে আদা তেল মালিশ করতে করতে টের পায় নিজের বুকেও মৃদু একটা ব্যথা হচ্ছে। তার। দূর দামলায় একা ঘরে শুয়ে ঘুমের ভেতর কেঁদে ওঠে টুকি। মজিদ গান গাইতে গাইতে ফিরে আসছিল, আমার এমুন জনম আরকি হবে, মানুষ দেখতে এসেছিলাম ভবে। হঠাই গলা আটকে যায় মজিদের। কেউ ঠিকঠাক বোঝে না এসবের কী অর্থ। হায়রে মানুষ!

জোয়ারের দিন

টুপটাপ টুপটাপ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সারাদিন ধরে হচ্ছে। সারারাত ধরে হচ্ছে।

একেকবার থেমে যায় বৃষ্টি, তারপর আবার নামে। কখনও কখনও বিদ্যুৎ চমকায়। গুড় গুড় করে মেঘ ডাকে। যেন বা যাতায় মটর কিংবা অড়হর ভাঙাচ্ছে কেউ। তারপরই বৃষ্টির বেগ বাড়ে। টুপটাপ শব্দে বড় বড় ফোঁটা পড়ে। খানিক পর আবার কমে। কোত্থেকে যে দমকা একটা হাওয়া আসে। শো শো শব্দে গাছপালার ওপর দিয়ে বয়ে যায়। আকাশে অবিরাম চলাচল করে মেঘ। ঈশান কোণ থেকে কালো বর্ণের মেঘ ওঠে আসে মধ্য আকাশে। সেই মেঘে কেবলই বৃষ্টি হয়।

এবারের বর্ষা খুব দ্রুত নেমে আসছে লোকালয়ে।

খালবিল উপচে জল ওঠে যাচ্ছে জমিতে। চোত বোশেখের খরায় শুকিয়ে যাওয়া মাটি জলে ডোবা পাটপাতার মতো কোমল হয়ে ওঠছে। দেখে মনে হয়, আবহমানকাল ধরে এরকম বৃষ্টিপাত হচ্ছে পৃথিবীতে। এখানে কখনও সূর্য ওঠেনি, নীল রোদ পড়েনি প্রান্তরে কিংবা রাতেরবেলা চাঁদ ওঠেনি, শুভ্র জ্যোৎস্না নামেনি চরাচরে। শুধুই বৃষ্টিপাত হচ্ছে।

ইরফানের ঘরের খড়ের চালা ভিজে চপচপ করছে।

জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। সেই সব ফুটো দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে। ঘরের ভেতর। বড় একটা ফুটোর তলায় টিনের থালা পেতে রেখেছে পদ্মা। থেমে থেমে পড়ছে থালার ওপর। আর টুমটুম করে শব্দ হচ্ছে। ঘরের মেঝেও ভিজে ওঠেছে। স্যাঁতস্যাঁতে নরম মাটির গন্ধ পাওয়া যায়। বর্ষা যে খুবই প্রবল হয়ে আসছে বোঝা যায়। দুপুরের পর পর পুরোনো মাথালটা মাথায় পরল ইরফান।

খালুই হাতে নিল। তারপর ঘর থেকে বেরুল। দরোজার বাইরে চালার সঙ্গে দড়ির আংটায় আড়াআড়ি ঝোলানো টেটাটা নামাতে নামাতে আকাশের দিকে তাকাল। দুপুর বেলায়ই কীরকম অন্ধকার হয়ে ওঠেছে চারদিক। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আর তার পর পরই মেঘ ডেকে ওঠেছে।

আঙুলের ডগা বুলিয়ে টেটার ধার পরীক্ষা করল ইরফান। তারপর পদ্মাকে বলল, মেঘে কী ডাক ছাড়ে হুনছচ। কই মাছ উডব আইজ।

পদ্মা ভীতু গলায় বলল, ঠাডা পড়তে পারে। কাম নাই তুমার মাছ মারতে যাইয়া। আমাগোর কই মাছ লাগব না। পদ্মার কথা শুনে ঠা ঠা করে হেসে উঠল ইরফান। জোয়াইরা দিনে ঠাডা পড়ে না। জোয়াইরা মাছ ধরলে তর খারাপ লাগে হেইডা ক। আসল কতাডা ক বউ।

পদ্ম খানিক চুপ করে রইল। তারপর বলল, মাছের বড় সুখের দিন এইডা। তুমি কী নিঠুর গো। এই দিনের মাছ না মারলে কী অয়। মাছ না খাইলে কী অয়!

আবার শব্দ করে হাসে ইরফান। তুই অহন পোলাপান রইছস বউ! কতা কচ পোলাপানের লাহান। মাছের সুখের দিন দেইক্কা মাছ মারব না মাইনষে, মাছ খাইব না! ইরফানের ঘর ছাড়িয়ে বিশ তিরিশ কদম খোলা উঠোন। বৃষ্টিতে উঠোনের আটাল মাটি খুব পেছল হয়েছে। সেই পেছল মাটির উঠোন দিয়া অভ্যস্ত পায়ে হেঁটে যায় ইরফান। পেছন থেকে পদ্মা বলল, হাঁজে হাঁজে আইয়া পইড়। আইজ রাইতে আর মাছ মারতে যাইতে পারবা না।

ইরফান কথা বলে না। হাসে। তারপর উঠোন পেরিয়ে মাঠের দিকে নেমে যায়।

ধানপাটের জমিতে এখন গোড়ালি ডুবে যাওয়ার মতো জল। পাটপাতা বৃষ্টিতে ভিজে ঘন সবুজ হয়েছে কোন ফাঁকে। নদী থেকে খাল বেয়ে জল আসছে গ্রামে। অঞ্চলটা নিচু। খালডোবার সংখ্যা বেশি। বর্ষার মুখে মুখে অল্প সময়ে পুকুর ডোবা ভেসে জল ওঠে যায় মাঠে।

মাঠে নেমে ইরফান দেখতে পায় টুপ টুপ করে অনবরত বৃষ্টি পড়ছে জলের ওপর। বাতাসে ঝিলমিলিয়ে ঢেউ ওঠছে ফসলহীন বাজা জমিতে। কনকনে একটা শীত গড়িয়ে গড়িয়ে বয়ে যায়। এসময় পাট ক্ষেতে মাছ পাওয়া যাবে না। মাছেরা সব কেলি করে রাতেরবেলা। ছুটোছুটি করে অল্প জলে। সেকী উদ্দাম ছুটোছুটি!

মিয়াবাড়ির পুকুর থেকে জল নামছে পাশের নিচু জমিতে। এরকম জলের সঙ্গে ঝাঁকে ঝকে নামে পুঁটি মাছ। পুঁটি মাছের শরীরের দুপাশে লাল রঙের সির পড়ে এসময়। পেটভর্তি থাকে ডিম। আর শরীর কী নরম! কী তুলতুলে!

মিয়াবাড়ির ঘন গাছগাছালির ভেতর ছায়াঘন অন্ধকার জমে ওঠেছে। ঝিম মারা গাছপালা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। সর সর করে একটানা একটা শব্দ হচ্ছে। এক টুকরো কালো মেঘ পেটভর্তি ডিমের ভারে চলতে না পারা রয়না মাছের মতো ধীর ভঙ্গিতে ওঠে আসে মধ্য আকাশে। ফলে ছায়াঘন অন্ধকার আরো অন্ধকার হয়।

মাঠে না গিয়ে মিয়াবাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল ইরফান। জায়গাটা নিরিবিলি। কিছু ঝোপঝাড় আছে, লম্বা লম্বা আড়ালি দল আর বাকসা ঘাস আছে। এই ধরনের জঙ্গুলে জায়গায় শিংমাছ ওঠার সম্ভাবনা। শিংমাছগুলো সবসময় ওঠে। আট দশটা একসঙ্গে হয়ে খেলা করে। ক্যোৎ ক্যোৎ শব্দে চারদিক মাত করে ফেলে। তখন টেটা মারলে একসঙ্গে অনেকগুলো গাঁথা যায়। পেটের ভেতর ডিম থাকে বলে মাছগুলো কমজোরী। এখন বাচ্চা হবে তখন বাচ্চা হবে এমন মেয়েমানুষের মতো ধীর চলাচল তাদের। টেটা মারার পর অনায়াসে খালুইতে তোলা যায়।

মিয়াদের আম বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আকাশে মেঘের সেই গুড় গুড় ডাক আবার শুনল ইরফান। শুনে বুকের ভেতরটা খুশিতে নেচে ওঠত তার। বর্ষা শুরু হওয়ার পর গত কয়েকদিনে আজই প্রথম এরকম শব্দে মেঘ ডাকছে। আজ কই মাছ না ওঠে পারে না। মেঘের এরকম ডাকে উচ্ছলতা বাড়ে কই মাছের। মাথায় বিকার দেখা দেয়। কিছুতেই আর জলায় থাকতে পারে না। কানকো দুটোকে ল্যাংড়া খোঁড়া মানুষের

ক্রাচের মতো ব্যবহার করে ডাঙায় ওঠে আসে।

মিয়াবাড়ির গোমস্তা অখিলা বড় চালাক লোক। পুকুর থেকে চারদিক দিয়ে জল উপচাতে দেখে ছোট মতো নালা কেটে দিয়েছে এক জায়গায়। পুরো জলাটা নেমে আসছে, সেই নালা দিয়ে। সঙ্গে নামছে পুঁটি মাছের ঝাঁক। অখিলা সকাল থেকে একটানা সন্ধ্যে পর্যন্ত মাছ ধরে। খালুই খালুই পুঁটি মাছ। তিনটে খুঁটি দিয়ে ভেঁশালের মতো করে ছোট জাল পেতে দিয়েছে নালার মুখে। জল গড়িয়ে নামে জালের ভেতর দিয়ে আর মাছগুলো আটকে থাকে জালে। রুপোলি শরীরে লাফালাফি করে।

এসব ছোট মাছ ধরতে ভালো লাগে না ইরফানের।

পদ্মার জন্যে কাল পুঁটি মাছ দিয়েছিল অখিলা। সেই মাছ দেখে পদ্মা যে কী রকম আফসোস শুরু করল! পুটি মাছেরা ক্যামন শাড়ি ফিনছে দ্যাহ। এইডা বড় সুখের দিন ওগো। এই মাছটিরে তুমরা মার ক্যান?

পদ্মার কথা শুনে রাগ করেছিল ইরফান। তর যত সোয়াগের কতা বউ! মাছের ভালা সুময় দেইখ্যা, সুখের সময় দেইখ্যা আমরা মাছ মারুম না?

এখন অখিলাকে দেখে পদ্মার কথা মনে পড়ল ইরফানের। মনে পড়ে মেজাজ একটু খারাপ হল। মাছের ভালো সুময়, খারাপ সুময়ে মাইনষের কী যায় আহে! বনের বাঘে কি মাইষের সুখ-দুঃখ দেইখ্যা মানুষ খায়! বিলাইতে কি ইন্দুরের সুখ-দুঃখ দেইখ্যা ইন্দুর খায়। এইডা অইল গিয়া দুনিয়াদারির নিয়ম। একটা জীবে আরেকটারে খাইব। যার জোর বেশি হেয় খাইব কমজোরীগো।

ইরফানকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসল অখিলা। উদোম গায়ে লুঙ্গি কাছা মেরে বসে মাছ ধরছে সে। গন্ধরাজ ফুলের মতো থোকা থোকা পুঁটি মাছ তুলে রাখছে খালুইতে।

অখিলার মেষের মতো কালো শরীরে বৃষ্টির জল গড়াচ্ছে। হাসতেই অখিলার ঠোঁটের দিকে চোখ গেল ইরফানের। উনুনের পোড়া মাটির মতো রং ধরেছে ঠোঁটে। সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে মাছ ধরেছে বলে এই অবস্থা। অখিলার হাসির জবাব না দিয়ে তার খালুইয়ের ভেতরটা উঁকি মেরে দেখল ইরফান। তারপর বলল, কী র‍্যা অখিলার পো, কতডি পাইলি?

আবার আগের মতো করে হাসল অখিলা। দুই খালুই থুইয়া আইছি মেবাই। অহন এইডা ভরলে যামুগা। ভারি শীত করে মেবাই।

কথা বলার ফাঁকে দাঁতে দাঁতে ঠুকে যায় অখিলার। হু হু করে কাঁপছে সে।

নালার মুখে পেতে রাখা জালের দিকে এক পলক তাকিয়ে ইরফান বলল, পুডি মাছ এত ধইরা কী করবি? হেরচে বাইত্তে গিয়া গুমা। কাম অইব।

অখিলা কথা বলে না। একটা মেটে সাপ এসে চোখের পলকে জড়িয়ে ধরে তার জালে। পুরো শরীরটা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে উথালপাথাল করে জালটা। স্বচ্ছ জলের তলার পুঁটি মাছের চলাচল দেখা যাচ্ছিল। দেখে শব্দ করে হেসে ওঠল ইরফান। আর অখিলা হল মহাবিরক্ত।

বিড়বিড় করে গাল দিল সে। হুমুন্দির পুত হাপেই জ্বালাইয়া খাইল। পাঁচটা ছাড়াইলাম। একবার প্যাচাইয়া গ্যালে সহজে ছাড়ান যায় না। জাল ছিঁড়ে যায়।

ইরফান আর কথা বলে না। নালাটা ডিঙিয়ে দক্ষিণের জংলা মাঠে গিয়ে নামে। জায়গাটায় হাগড়া আড়ালি আর বাকসা ঘাসের জঙ্গল। জঙ্গলের কোমর অব্দি ডুবে গেছে। জলে। সেদিকে এগিয়ে গেল ইরফান। শব্দ পেলে মাছেরা সব ছুটে পালাবে। এজন্যে সাবধানে পা ফেলছিল সে।

মাছেরা খুব সচেতন জীব। মেয়েমানুষের মতো। মেয়েমানুষে যেমন চোখ দেখে পুরুষের মতলব টের পায়, মাছেরা তেমন সামান্য শব্দে ভয় পায়।

সাবধানে পা ফেলে ইরফান। পা তোলে।

এক জোড়া কোলা ব্যাঙ লাফ মেরে পালিয়ে গেল পায়ের কাছ থেকে। চমকে টেটা বাগিয়ে ধরল ইরফান। তারপর ব্যাঙ দেখে হেসে ফেলল। কোলা ব্যাঙরাও ডিম ছাড়ে এসময়। আধা জল আধা শুকনোয় পড়ে থেকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর একটানা ডাকে ব্যাঙগুলো। খানিকক্ষণ পর পর কালো দানা দানা ডিম ছাড়ে জলে। মুহূর্তে জলের ভেতর ছড়িয়ে যায় ডিমগুলো।

মিয়াবাড়ির গাছপালা দমকা হাওয়ায় সাপের মতো শোঁ শোঁ শব্দ ছড়ায়। আকাশের তলায় এসে স্থির হয় কালো মেঘ। বিদ্যুৎ চমকায়। গুড় গুড় করে মেঘ ডাকে। তারপর বৃষ্টির তোড় বাড়ে।

মাথলাটা এক হাতে নেড়েচেড়ে ঠিক করে ইরফান। হিজল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে কোমর থেকে বিড়ি আর দেশলাই বের করে। বৃষ্টি এবং বাতাসের আঁচ বাঁচিয়ে কায়দা। করে বিড়ি ধরায়। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মিয়াদের পুকুরের দিকে তাকায়। বর্ষার জলে মিয়াদের পুকুরটা এখন টইটম্বুর। পুকুরের জলে পড়ছে বৃষ্টি। জলের ওপর পড়ছে জল। দেখে মনে হয়, অসংখ্য পোনামাছ পুট পুট করে ভাসছে পুকুরের জলে। একটা ছুঁই লেজ নেড়ে নেড়ে আস্তেধীরে সাঁতার কাটে। হু হু বাতাসটা বয়ে যায়। বাতাসে কনকনে একটা শীত ভাব।

বিড়ি টানতে টানতে হাঁটে ইরফান। বিড়ির ধোঁয়ায় বেশ একটা উত্তেজনা তৈরি হয় শরীরে। পায়ের তলায় শীতল জলের ছোঁয়া টের পাওয়া যায় না।

একটা ছোট ঝোপের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল ইরফান। অল্প অল্প নড়ছে ঝোপটা। মুহূর্তে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠল ইরফানের চোখ। এটা আড়ালির ঝোপ। ভেতর কেমন খল খল শব্দ হচ্ছে। মুহূর্তে দেরি করল না ইরফান। খচ করে টেটা চালিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে স্থির হয়ে গেল ঝোপটা। বিড়িটা শেষাশেষি চলে এসেছে। হাতে আঁচ লাগে। সুখটান দিয়ে ফেলে দিল ইরফান। তারপর যত্ন করে টেটাটা টেনে তুলতে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে মুখটা হা হয়ে গেল ইরফানের। অস্ফুট একটা ভয়ার্ত শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে। টেটাটা অল্প একটু টানতেই শরীর দেখা গেছে জীবটার। কালোর ভেতর হলুদ ডোরাকাটা। গস্তি নাওয়ের কাছির মতো মোটা। হা করা মুখের ভেতর পেট ফোলা বড় সড় একটা রয়না মাছের অর্ধেকটা ঢুকে আছে। ঠিক ঘাড়ের কাছটায় ইরফানের টেটা গেঁথেছে। তবু বেশ ভয় পেল ইরফান। টেটা ছেড়ে সরে এল।

কী সাপ! জাতটাত নয় তো।

না, জাতসাপ তো মাছ খায় না। ঢোঁড়াটোড়া হবে!

মাছখেকো ঢোড়া সাপের কথা ভেবে সাহস পেল ইরফান। সাবধানে এগিয়ে গিয়ে টেটাটা টানল। যাই হোক, শালা ভালো করে গেঁথেছে। ছুটে কামড়াতে অন্তত পারবে না।

সাপটা ততক্ষণে প্রচণ্ড শক্তিকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। পুরো শরীর টেটার সঙ্গে পাচিয়ে উথালপাথাল করছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।

সাবধানে ঝোপের ভেতর থেকে টেটা বের করে আনল ইরফান। ইরফানের ভাবনাই ঠিক। একটা পুরোনো কালঢোঁড়া মাছ খেতে বেরিয়ে টেটায় গাঁথা পড়েছে।

কিন্তু সাপটাকে ছাড়ানো যায় কী করে। তাছাড়া তেঁড়ার মধ্যে এ জাতটা আবার খারাপ। কামড়ালে বিপদ আছে।

এসময় বেশ শব্দ করে মেঘ ডাকল। সেই ডাকে সাপের কথা ভুলে চারদিকে তাকাল ইরফান। তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চাপচাপ অন্ধকার জমে ওঠেছে। গাছপালায়। আগের সেই হাওয়াটা আবার হু হু করে বইতে শুরু করেছে। হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাছে কোথাও গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করেছে কোলা ব্যাঙ। বৃষ্টি কমে এসেছে।

মাঠের দিকটা এখনো ফরসা। কিন্তু অন্ধকার হতে দেরি হবে না। মাঠের দিকে তাকিয়ে কী ভাবল ইরফান। তারপর টেটা ফেলে রেখেই বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। সাপটা যদি একা একা নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় তো ভালো, না হয় কাল সকালে এসে যা হোক ব্যবস্থা একটা করা যাবে। এখন অত বড় সাপ ঘটাতে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া সন্ধ্যেও হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যেরাতে ছোটখাটো একটা ঘুম দিতে হবে। মাঝরাতে যেতে হবে বিলে। রাতের বেলা পশ্চিমের বিলে বোয়াল মাছ পীর ধরে। এই দিনে পীরের বোয়াল না মারলে সে আবার মাছ শিকার হল নাকি!

বাড়ি ফিরে ইরফান দেখতে পেল আবছা অন্ধকারে গোয়ালঘরে গরু বাঁধছে পদ্মা। বকনাটা হাম্বা করে চেঁচাচ্ছে। লেজ ঝাঁপটে মশা তাড়াচ্ছে। এই রকম বৃষ্টিবাদল অথচ মশার কমতি নেই, গরুগুলো রাতভর লেজ ঝাঁপটে তাড়ায়। এদিকে আঙিনার মাটি পচে ওঠেছে বৃষ্টিতে। একাকার কাদা। পা রাখা দায়। আটালে মাটির কাদা বড় পেছল। আর মাটিতে কেমন সোঁদা গন্ধ।

ইরফানকে শূন্য খালুই হাতে ফিরতে দেখে খুবই অবাক হল পদ্মা। হেসে বলল, টেডা কৈ? ইরফান কথা বলল না। ঘরের সামনে ফেলে রাখা থান ইট দুটোর ওপর দাঁড়িয়ে বদনার জলে পায়ের কাদা ছাড়াতে লাগল। পদ্মা ঘরে গিয়ে কুপি জ্বালল। এখন আর বৃষ্টি নেই। দমকা হাওয়াটা আছে। গাছপালায় শোঁ শোঁ শব্দটা হচ্ছে। শব্দটা এমন শুনে মনে হয়, যেনও ভয়ানক তেজী কোনও সাপ থেমে থেমে ফুঁসছে।

মাথালটা খুলে গামছায় শরীর মুছতে মুছতে ইরফান বলল, মনডায় কইছিল হিংয়ের পীর অইব। টেডা মারতেই দেখলাম কালঢোঁড়া। ওরে বাপ র‍্যা! হালার পুতে পাঁচ আতের কম লম্বা না। টেডা ভাইঙা হালাইতে চায়। টেডা হালাইয়া থুইয়া আইয়া পড়লাম।

ইরফানের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল পদ্মা। চোখ ড্যাব ড্যাব করে বলল, মাগো! তুমারে হাপেই খাইব একদিন।

পদ্মার কথা শুনে ঠা ঠা করে হাসে ইরফান। ভাত দে। খাইয়ালইয়া ঘুম দেই।

মাটির হাঁড়ি থেকে ভাত দেয় পদ্মা। কাঁঠাল কাঠের চওড়া একটা পিড়িতে দুপা ভাজ করে বসে গপাগপ ভাত খায় ইরফান। পদ্মা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তারপর বলে, তুমি কী মানুষ গো। ডরভয় নাই পরানে।

ইরফান পদ্মার মুখের দিকে তাকায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পদ্মাকে দেখে। হাসে। তারপর কথা অন্যদিকে ঘোরায়। তর শরীরডায়ও তো জোয়ার লাগছে মনে অয়।

পদ্মা মাথা নিচু করে হাসে। তুমি আবার এই হগল দ্যাহনি!

ঢক ঢক করে জল খায় ইরফান। দ্যাহি র‍্যা! দেহি! হগলই দেহি।

মনে তো অয় না।

কী মনে অয় তোর!

মনে হয় চেক্কা মাছ ছাড়া আর কিছু দেহ না তুমি। কানে মাছের ঘাই ছাড়া আর কিছু হোনো না।

খাওয়া শেষ করে বিড়ি ধরাল ইরফান। তারপর টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল হোগলের বিছানায়। চিৎ হয়ে শুয়ে বিড়ি টানতে লাগল।

হারিকলডা আঙ্গাইয়া থো পদ্মা।

ইরফানের কথা শুনে মুখ ঝামটা মারে পদ্মা। না আউজ রাতে আর মাছ মারতে যাইতে পারবা না।

ইরফান কথা বলে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে বিড়ি টানে। খুক খুক করে অকারণেই বার কয়েক কাশে। তারপর খাকিয়ে ওঠে। প্যাচাল পারিস না। আঙ্গাইয়া গো হারিকলডা। রাইতে আর তরে জাগামু না।

পদ্মা এক পলক ইরফানের মুখের দিকে তাকায়। মুখটা ম্লান হয়ে গেছে তার। কী এক অভিমানে ভরে গেছে বুক। পদ্ম আর কথা বলে না। কাঁচ পরিষ্কার করে কুপির সলতেয় হারিকেন জ্বালায়। ইরফান শুয়ে শুয়ে দেখে গোমড়া হয়ে গেছে পদ্মার মুখ। বউটা এরকমই। একটুতেই বাচ্চা মেয়ের মতো অভিমানী হয়ে ওঠে। গাল ফুলিয়ে মুখ গোমড়া করে। সহজে কথা বলে না।

কুপি নিভিয়ে হারিকেনটা বিছানায় পাশে রাখে পদ্মা। তারপর ইরফানের গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। কিন্তু কথা বলে না। শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইরফান আস্তে করে জিজ্ঞাস করে, পলোডা কই রাখছস?

পদ্মা কথা বলে না। ইরফান সামান্য বিরক্ত হয়। আরে কথা কয় না ক্যা!

পদ্মা আস্তে করে বলল, গোয়াল গরে রাখচি।

তারপর আবার সব চুপচাপ। কেউ কোনও কথা বলে না। হারিকেন ম্লান আলো ছড়াচ্ছে। ঘরের ভেতর। বাইরে গাছপালায় বইছে সেই দমকা হাওয়া। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। গুড় গুড় করে ডাকছে মেঘ। কিন্তু বৃষ্টি নেই।

ইরফানের শরীরে ঘন হয়ে মিশে যায় পদ্ম। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে শোয় ইরফান। গুমাইয়া পড় বউ। পদ্মা যেন সে কথা শুনতে পায় না। ইরফানের পিঠে মায়ামমতা কিংবা অন্যরকম কোনও স্পর্শে হাত রাখে। আস্তে আস্তে হাত বুলায়। গুমাইলা?

ক্যাঁ।

ছকিনার পোলাপান অইব।

হাছা?

হ।

তারপর একটু থেমে স্বামীর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে পদ্মা বলল, আমাগো যদি একটা পোলাপান অইত!

ইরফান কথা বলে না। ঘুমে চোখ টানে তার। ব্যাপারটা টের পেয়ে পদ্মা কাঁদো গলায় বলল, আমারে ইট্টুও মায়া কর না তুমি।

ইরফান আওয়াজ দেয় না। ঘুমের ভান করে। পদ্মা দুহাতে জড়িয়ে ধরে তাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস গলায় বলে, আমারে ইট্টু আদর কর না গো আইজ! আদর করলে আমারও পোলাপান অইব। তুমি দেইখো।

এবার বিরক্ত হয় ইরফান। রাগে গর্জে ওঠে। চুপ কর মাগী। খালি রঙ্গের প্যাচাইল। রাইতে মাছ মারতে যামু। তর লগে পিরীত করতে পারুম না অহন। গুমাইতে দে।

হঠাৎ করে মুখের ওপর যেন চড় মারল কেউ। থতমত খেয়ে গেল পদ্মা। খানিক চুপ করে রইল সে। তারপর গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল। পদ্মার কান্না শুনতে শুনতে অবলীলায় ঘুমিয়ে পড়ল ইরফান।

.

দুপুর রাত চট করে ঘুম ভেঙে গেল ইরফানের।

কয়েকদিন এরকম অভ্যেস হয়ে গেছে। গভীর রাতে ঘুমের ভেতর কেউ যেন ডাক দিয়ে যায় তাকে। ওঠ ইরফান। বিলে মাছ ওঠছে। বোয়াল মাছে পীর ধরছে। দুনিয়া ভইরা গ্যাছে মাছে। মাছ মারতে যাবি না।

সেই ডাকে ঘুম ভেঙে যায় ইরফানের। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে হু হু করে জোয়ারে বাতাসে আসে ঘরের ভেতর। বাতাসে মাছের আঁশটে গন্ধ পায় ইরফান। সেই গন্ধ বিড়ির নেশার মতো কাজ করে। লাফিয়ে ওঠে ইরফান।

আজও ঘুমের ভেতর ওরকম ডাক শুনল ইরফান। শুনে লাফিয়ে উঠল। তারপর হারিকেনটা উসকে দিল। বিড়ি ধরাল। পদ্মাকে দেখল কাত হয়ে ঘুমোচ্ছে। হারিকেনের আবছা আলোয় কান্নার চিহ্ন দেখা যায় পদ্মার চোখে। ঘুমোনোর আগে প্রচুর কেঁদেছে পদ্মা বোঝা যায়। পদ্মার মুখটা দেখে নিঃশব্দে হাসল ইরফান। তারপর হারিকেন হাতে ওঠে দাঁড়াল। না, পদ্মাকে জাগাবে না। টের পেলে বউডা আবার খ্যাচ খ্যাচ শুরু করবে। একলা ঘরে থাকতে ডর করে না আমার!

কিংবা জোয়ারের মাছ ধইর না। তোমার আল্লার কছম। এইডা বড় ভালা সুময় মাছেগো। এসব শুনলে হাসি পায় ইরফানের। কী সব পোলাপানের লাহান কথা! মাছের ডিম পাড়ব তাতে পদ্মার কী! দুনিয়ার বেবাক জীবেই তো হয় ডিম পাড়ে, নয় বাচ্চা বিয়ায়। এইডাই দুনিয়ার নিয়ম। এর লেইগা অত হায়আফসোস দয়া দরদ দেহানের কী অইল। ঝাঁপ সরিয়ে ঘর থেকে বেরুল ইরফান।

বাইরে দাঁড়িয়ে ঝাপটা আবার ঠিকঠাক করে লাগিয়ে দিল। তারপর আকাশের দিকে তাকাল। ম্যাটম্যাটে জ্যোৎস্না ওঠেছে এখন। আকাশে মেঘের চলাচল আছে। আমগাছের মাথায় পাতলা শাড়িতে মুখঢাকা সুন্দরী মেয়ের মতো চাঁদ দেখা যায়। মেঘ এসে বারবার ঢেকে দেয় চাঁদ। তখন আবছা আঁধার নামে। আর সাপের মতো শব্দ করে বয়ে যায় বাতাস।

উঠোনের আটাল মাটিতে পা টেনে টেনে গোয়ালঘরের দিকে যায় ইরফান। পদ্মার বুঝি তখুনি ঘুম ভাঙে! ঘরের ভেতর বিড়বিড় করে একাকী কথা বলার শব্দ পাওয়া যায়। তারপর অস্ফুট কান্নার। শুনে নিঃশব্দে হাসে ইরফান। বউডা অহনও পোলাপান রইছে। ঘুমের তালে কথা কয়, কান্দে। গোয়াল ঘরে ঢুকে পলোটা খোঁজে ইরফান।

গরুগুলো লেজ ঝাঁপটে মশা তাড়াচ্ছিল। বকনাটা অতিরিক্ত দাপাদাপি করছে। দেখে হারিকেনটা একটু উসকে দেয় ইরফান। চালার সঙ্গে লটকে রাখা পলোটা টেনে নামায়। তখুনি দমকা একটা হাওয়া ওঠে। গোয়াল ঘরের পেছনে, বাড়ির নামার দিকে ঘ্যাঙ্গর ঘ্যাঙ্গর ডাকে ব্যাঙ। এক হাতে ঘাড়ের ওপর দিয়ে পলোটা ধরে রেখে অন্য হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে মাঠে নেমে যায় ইরফান। বুকের ভেতর বিশাল এক উত্তেজনা জোয়ারে জলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে যায় তার।

মাঠে এখন গোড়ালি ডুবে যাওয়ার মতো জল ওঠে গেছে। সেই মাঠ দিয়ে ছপছপ শব্দে হেঁটে যায় ইরফান। পশ্চিমের বিল ছাড়া বোয়াল পাওয়া যাবে না। ধানপাটের ক্ষেতে পরী ধরতে ওঠে বোয়াল মাছ। একটা আর একটার গায়ে এমনভাবে লেগে থাকে দেখে দুটোকে একটা মাছই মনে হয়। কোৎ কোৎ করে কী যে শব্দ করে মাছগুলো তখন! মানুষ কাছে গেলেও পালায় না। যৌবন কী অদ্ভুত ক্ষমতায় ভুলিয়ে দেয় মৃত্যুভয়। টেটা দিয়ে পীরের বোয়াল মারা যায় না।

টেটা মারলে একটার বেশি গাঁথে না। পীরের বোয়াল মারতে হয় পলো দিয়ে। পলো দিয়ে আটকে দিতে হয়। তবে পলোতে বোয়াল আটকে সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে হাত দিলে কামড়ে হাত খেয়ে ফেলবে। বোয়াল মাছ এসময় পাগল হয়ে ওঠে। এ যেন দুরন্ত এক বিদ্রোহ মাছেদের! যৌবন বিদ্রোহ।

তবে বোয়ালের মন্ত্র ইরফানের জানা আছে। পলোর ভেতর ঘণ্টাখানেক আটকে রাখলে নরম হয়ে যায় মাছ। তখন ভয় থাকে না। নির্বিঘ্নে তুলে আনা যায়।

ইরফানের পায়ের শব্দে তখন ছোট ছোট মাছ ছুটে পালাচ্ছিল।

লাফিয়ে সরে যাচ্ছিল। ঘাসবনে চুটপুট শব্দ হচ্ছিল। খোলা মাঠে মাঠে জলো বাতাস গড়িয়ে যাচ্ছিল। মরা জ্যোৎস্না ছিল স্থির হয়ে। আকাশপ্রান্তর ছাপিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। থেকে থেকে ডাকছিল জোয়ারের মেঘ। কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছিল না। রাত কী রকম আশ্চর্য এক গভীরতায় মগ্ন হয়েছিল। দূরের ছাড়া বাড়ির সামনে টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছিল। বোঝা যায়, মাছে ধরতে বেরিয়েছে কেউ। দেশ ভরে গেছে মাছে। মানুষেরা সব মনের সুখে সেই মাছ ধরছে। অথচ পদ্মা কী অদ্ভুত মানুষ! জোয়ারে মাছ ধরতে মানা করে!

ছাড়া বাড়িটা বাঁয়ে রেখে বিলের দিকে এগোয় ইরফান।

বিলের প্রান্ত থেকে ক্রমশ জমাট হতে শুরু করেছে পাটক্ষেত। ঘন আঁধার ঘাপটি মেরে বসেছে পাটক্ষেতের ভেতর। পাতলা জ্যোৎস্নাটা বোঝাই যায় না। আস্তেধীরে হাঁটে ইরফান। তার পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ছুটে যায় ছোটবড় নানা রকমের মাছ। সেই স্পর্শে মনে মনে আফসোস করে ইরফান। ইস টেডাটা আনলে কামের কাম অইত। ডুলা আনলে। কামের কাম অইত। মাছে বিল ভইরা গেছে। হেই মাছ মাইরা ডুলা ভইরা হালান যাইত।

পাটক্ষেতের ভেতর দিয়ে সরু আল পথ এখন জলে ডোবা। ঘন পাটগাছের চাপে পথের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। তবু সেই পথ ঠাওর করে হাঁটে ইরফান। এত রাতে বিলে কেউ আসে না মাছ মারতে। ভয় পায়। জোয়ারে বোয়ালের সঙ্গে ভূতের আছর থাকে। কপালে সিঁদুর রং টিপ পরা অতিকায় বোয়াল মাছ মরীচিৎকার মতো পথ ভুলিয়ে গভীর জলায় ডুবিয়ে মারে মানুষকে।

পাটক্ষেত এখন গভীর ঘুমের মতো মগ্ন। অথচ কান পাতলে আশ্চর্য রকমের এক শব্দ পাওয়া যায়। নৈঃশব্দের ভেতরেও এক রকম শব্দ থাকে। এ সেই শব্দ।

কিন্তু পাটক্ষেত এমন নিঃসাড় কেন?

ততক্ষণে বিলের মাঝামাঝি চলে এসেছে ইরফান। কিন্তু বোয়ালের পীর কিংবা তার কোনও আভাস পর্যন্ত পাচ্ছে না। বোয়ালদের আজ হল কী! এরকম রাতে পীর ধরতে ওঠেনি কেন! দূরের চটানে শেয়াল ডাকে। চটানের নামায় অল্প জলে শেয়ালদের চলাচল টের পাওয়া যায়। ইরফান নিশি পাওয়া মানুষের মতো হাঁটে। পায়ের কাছে চেলামাছ তিরতির করে। বিল থেকে জলো বাতাস ওঠে আসে। বিড়ির নেশা পায়, কিন্তু বিড়ি ধরায় না ইরফান। পদ্মার কথা ভাবে। পদ্মাও যেন এক জোয়ারের মাছ। পীর ধরতে চায়!

তখুনি খলখল করে শব্দ হয় পাটক্ষেতের ভেতর।

সঙ্গে সঙ্গে শিকারি বেড়ালের মতো কান খাড়া হয়ে যায়। ইরফানের। ছোট মাছ শিকারের সময় যেমন হঠাৎ করে স্থির হয় বড় মাছ, তেমন করে স্থির হয়ে দাঁড়ায় ইরফান। এই শব্দ বোয়ালের পীর ধরার শব্দ। কাঁধ থেকে পলো নামিয়ে হাতে নেয় ইরফান। হারিকেনটা শূন্যে তুলে বেড়ালের মতো নিঃশব্দে এগোয় শব্দের উৎস খেয়াল করে। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে আর শব্দ পায় না! স্থির হয়ে দাঁড়ায় ইরফান। কান খাড়া করে শব্দের জন্যে। আলতো বাতাসে পাটের পাতা শরীর ছুঁয়ে খেলা করে যায়। কাছাকাছি শব্দ হয় আবার। একটানা খল খল শব্দ। আগের মতোই এগিয়ে যায় ইরফান। কিন্তু কাছাকাছি গিয়ে স্থির করতে পারে না। কোথায় হচ্ছে শব্দ। আবার দাঁড়ায়। কান পাতে। চোখ তীক্ষ্ণ করে। এবার শব্দ হয় ইরফানের ডান দিকে। সে এগিয়ে যায়। মাছ দেখে না। আবার দাঁড়ায়। আবার শব্দ হয়। এবার শব্দটা হয় ইরফানের পেছনে। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায় ইরফান। পেছন দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু মাছ দেখে না। উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

এক সময় সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে অসংখ্য বোয়ালের খল খল শব্দ শুনতে পেল ইরফান। পেয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। এক পা সামনে এক পা পেছনে ডানে। বাঁয়ে চারদিকে চরকাবাজির মতো ঘুরতে শুরু করল সে। কিন্তু একটাও মাছ দেখতে পেল না। শুধু মাছের অবিরাম খল খল খল শব্দ। এক সময় মরা চাঁদের তলায় ঘন কালো মেঘ এসে স্থির হল। খাড়া হয়ে আঁধার নামল বিলে। এবং মাছের শব্দ ক্রমশ সরে যেতে লাগল দূরে। ইরফান সেই শব্দ খেয়াল করে এগিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু সে যত এগোয় তত সরে যায়। বিড়ির নেশার মতো তীব্র এক নেশায় পেয়ে বসে ইরফানকে। ইরফান এগোয়, শব্দ সরে যায়। ইরফান এগোয়, জল ক্রমশ গম্ভীর হয়।

জ্বিন

বিকেলের দিকে বোঝা গেল সারেঙের অবস্থা খারাপ। আজ রাতেই কাবার হবে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চোখ সেদ্ধ ডিমের মতো সাদাটে হয়ে গেছে। দাড়িগোঁফঅলা বিভৎস মুখটা হা করে ঘনঘন শ্বাস টানছে মানুষটা। জব নাই। সারেঙের বয়সী স্ত্রী ঘরের মধ্যে আছাড়পাছাড় খেয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। সেজাল খাঁরে খবর দে তরা। আমার কপাল বুজি পোড়ব। চৌকির ওপর বিবর্ণ মুখে বসে আছে গণি। সারেঙের শিয়রের কাছে ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে তার বউ। নরম ভঙ্গিতে হাতপাখা নাড়ছে। শুকু ছিল পাটাতনের ওপর। সেখান থেকে জামা গায়ে নেমে এল। চৌকির ওপর বাবার আড়াআড়ি বিশাল দেহটা একবার দেখে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, আমি যাইতাছি। ফকিররে লইয়ামু।

তারপর গলির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ইট্টু বাজারে যাও মিয়াভাই। যা যা লাগে লইয়া ভাবিরে কও, পুনু বুজিগ গাচ থনে ফুল লইয়াহুক।

শুকু তারপর বেরিয়ে গেল।

তখন নাবাল মাঠে বিকেল পড়ে যাচ্ছিল। শুকু মাঠে পৌঁছে খোলামেলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস টানে। পশ্চিমে তাকিয়ে দেখে, গ্রামসীমায় সূর্য গড়িয়ে পড়ছে।

শুকুর বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সেজাল খাঁরে পাওয়া যাইব তো। যদি না পাওয়া যায়। কথাটা ভেবে শিউরে ওঠে শুকু। বাবার মরো মরো অবস্থা। আর ফকির সাবের খবরই নাই। হেই যে একদিন আইছিল, আর দেহা নাই।

এসব ভেবে ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে ওঠে ছেলেটা। আইজ শালা ফকিররে যেহেন থনে পারি লইয়া আমু। নইলে বাবায় যুদি মইরা যায়। বাবার মৃত্যুর কথা। ভাবতে পারে না শুকু। বুকের ভিতর ধুগযুগ করে।

এখন ফাগুন মাস। ধানের চারায় সবুজতা নেমেছে। বিকেলটা কী চমৎকার ছড়ানো চারদিকে। শুকু এসব খেয়াল করে না। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয় মেদিনীমণ্ডল থেকে দোগাছী বহুদূর পথ। সামনে ধুধু বিস্তৃত মাঠ। কানি কানি ধানজমি, পাটজমি। পুবদিকে সড়ক সিতারামপুর হয়ে কাজিরপাগলা,তারপর গোয়ালীমান্দ্রা পর্যন্ত চলে গেছে। শুকু হাঁটতে থাকে। আজন্মের চেনা এই পথ কে যেন রাতারাতি টেনে অনেকটা লম্বা করে দিয়ে গেছে। পথ আর ফুরোয় না।

শুকুর খুব বাবার কথা মনে হচ্ছিল। বয়সকালে বিশালদেহী মানুষটা, চুলদাড়িতে কী যে সুন্দর ছিল দেখতে। মালটানা জাহাজের সারেঙ ছিল বাবা। থাকত কোলকাতায়। বছরে দুবছরে বাড়ি আসত। বর্ষাকালে টিপটিপ বৃষ্টির দিনে কেরায় নৌকায় বোঝাই মালপত্র নিয়ে বাড়ি আসত বাবা। শুকু সেই ছেলেবেলায় জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে ফেলত, দূরের বিলে কুয়াশার মতো বৃষ্টি সরিয়ে একটা কেরায় নৌকা এগিয়ে আসছে। এক সময় সেই নৌকাটি তাদের ঘাটে এসে ভিড়ত। তার ভিতর বাবাকে মহাপুরুষের মতো বসে থাকতে দেখে বাড়ির ভেতর উৎসব শুরু হয়ে যেত। রাত অনেকটা বেড়ে গেলেও মার রান্না শেষ হত না। বাবা বাড়ি এলে কত পদের রান্না যে করত মা! বুড়ি তখন মার কোলে।

দেখতে দেখতে বিকেল ফুরিয়ে আসে। অন্তরীক্ষ থেকে অন্ধকার নামে মাঠে। ধানি জমিতে ঝিঁঝি পোকারা ডাকতে শুরু করেছে। শুকু দুএকবার দোগাছীর দিকে তাকায়। গ্রামের গাছগাছালি এখন অন্ধকারের ভেতর। আকাশের তলা দিয়ে বাদুড় উড়ছে। এসবের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুকুর কেবল বাবার কথা মনে হয়। এমন জোয়ান মর্দ মানুষটা দেখতে দেখতে কেমন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেল। শুকুদের বড় ঘরটাই আসলে দোষী। ঐ ঘরে কেউ বেশিদিন টিকবে না। বুড়িটা জন্মের পর থেকে আতুর হয়ে আছে। ন-দশ বছরের মেয়ে, না পারে কথা বলতে না পারে হাঁটতে। সারাক্ষণ চৌকির উপর কুঁজো হয়ে বসে থাকে। বুড়ির জন্মের আগে ঘরের ভেতর অলৌকিক সব দৃশ্য দেখছিল মা। বুড়ি তখন পেটে। হাজামবাড়ি থেকে কোষা-নৌকোয় করে বাড়ি আসছিল মা। সন্ধ্যা হয় হয়। বড় পুকুরটার মাঝামাঝি আসতে কালো জলের তলা থেকে গভীর বুদবুদ তুলে কী যেন একটা জিনিস কোষার তলায় এসে ধাক্কা মারল। সেই ধাক্কায় ছোট্ট কোষা-নাও কাৎ হয়ে প্রায় ডুবুডুবু। আল্লাহ আল্লাহ করে কোনওরকমে ঘাটে এসে পৌঁছল মা। সেই রাতেই স্বপ্নে দেখল সাতটা কাঁসার ডেগ। হা করা মুখে চকচক করছে কাঁচা টাকা। সবচে বড় ডেগটার ভিতর থেকে মানুষের কথা বলার মতো কেউ বলে, নে, নে। মা স্বপ্নের ভিতরেই জানতে চাইল, তোমরা কোথায়?

পুকুরের উত্তর কোণে ছিলাম। সন্ধেবেলা তোর সঙ্গে চলে এসেছি। এখন তার ঘরের মধ্যিখানে ঘুণে খাওয়া খামটার তলায় আছি।

মা আবার জিজ্ঞেস করল, তোমাদের নিতে কী লাগে?

ডেগের ভিতর থেকে শব্দ আসে, জোড়া নারকেল, কমলা আর মাথায় সিঁদুর।

সকালবেলা ওঠেই সেজাল খাঁকে খবর দিল। তখন জাহাজে। মিয়াভাই সেজাল খাঁকে ডেকে আনল। মা সব খুলে বলল তাকে। সেজাল খাঁ বলল, বৈঠক দ্যান। সেই রাতেই বৈঠক দেয়া হল। বৈঠকে মহাজনরা বলল, ঘরে আছর হইছে। যা যা চাইছে তা হইল কপালের সিঁদুর মানে তোর মরদ। জোড়া নারকেল, তোর দুই ছেলে। আর কমলা হইল তোর কন্যা।

মা জানতে চাইল, কন্যা কই বাবা?

হইবো।

শুনে ফুঁপিয়ে ওঠেছিল। এখন তাইলে কী করমু বাবা?

ঘরের মধ্যিখানের খামটা উডাইয়া ফালা।

জাহাজে খবর পাঠানো হল। বাড়ি এসে সেই খামটা পাল্টে ফেলল বাবা। তার কদিন পরে বুড়ি জন্মায়। বুড়ি জন্মের পর মা ঘাটে গেলেই জলের তলায় সেই ডেগেরা এসে হাজির হত। আমাগ তুই ফিরাইয়া দিলি? তর কপাল পুড়ব।

মা তারপর বাড়ির কোথাও একাকী গেলেই সেই স্বর শুনত। রান্না করতে বসলে শুনত। আর রাতের বেলা তো কথাই নেই। কেবল সেই সাতটা ডেগ তার চোখের সীমায় এসে স্থির হয়ে থাকত। সেই অলৌকিক স্বর বাজত কানে। অথচ মার গায়ের পাশে শুয়ে বাবা এসবের কিছুই দেখত না। কিছুই শুনতে পেত না। মা ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে ওঠত ভয়ে, বাবাকে জড়িয়ে ধরত।

তারপর একসময় সেই ডেগেরা আর দেখা দিত না। অলৌকিক স্বরের কথাও আর শুনতে পেত না মা। অথচ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুড়িটা ক্রমশ পঙ্গু অথর্ব হয়ে যেতে লাগল।

.

সেজাল খাঁর উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রথমে গলা খাঁকারি দিল শুকু। তারপর বলল, ফকির সাব বাড়িতে আছেননি?

সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে মেয়েমানুষের গলায় জবাব এল, আছে। মাজারে বাত্তি দেয়। শুকু উঠোনের কোণে জবাগাছের ঘন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে। কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে মশা, পায়ের কাছে কুনো ব্যাঙ লাফায়, ছুঁচো দৌড়ে পালায়। সে দাঁড়িয়ে থাকে। ফকির সাব তাহলে আছেন! কথাটা ভেবে বুকের ভিতর কীরকম সুখসুখ একটা অনুভূতি হয় শুকুর। সে জানে, সেজাল খাঁর ঘরে মাজার আছে। ঘরের পশ্চিম-উত্তর কোণে। ফকির রোজ সন্ধেবেলা মোমবাতি জ্বালায় আগরবাতি জ্বালায় সেই মাজারে। সেজদা দেয়ার ভঙ্গিতে সালাম করে আসলে মহাজনরা সবসময়েই আসাযাওয়া করে। পাকপবিত্র না থাকলে ক্ষেপে যায়। একবার কী দোষ পেয়ে তেঁতুল গাছ থেকে ফেলে দিয়েছিল ফকিরকে। পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তখন থেকে ফকির বড় সাবধান।

খানিক বাদে ফকিরকে দেখা গেল ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। দেখেই অন্ধকার ঠেলে তার কাছে এগিয়ে গেল শুকু। ফকির তীক্ষ্ণচোখে শুকুর দিকে তাকাল, কী খবর মিয়া?

ফকিরের ভাঙাচোরা বসন্তের দাগঅলা মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে শুকু বলল, বাবার অবস্থা ভালা না, আপনের ইট্টু যাওয়া লাগব।

ফকির একটু থেমে রইল। যেন বিশাল কোনও চিন্তাভাবনা চালাচ্ছে মাথার কোষে কোষে। তারপর ভারি গলায় বলল, ব্যবস্থা করছস?

হ মিয়াবাইরে কইয়া আইছি সব জোগাড় কইরা রাখতে।

খাড়াও, আইতাছি।

বলে ফকির আবার ঘরের ভিতর ঢোকে। লম্বা কোর্তা পরে বেরিয়ে আসতে আসতে কারো উদ্দেশ্যে বলে, মেদিনীমণ্ডল যাইতাছি। রাইতে আমুনা।

ততক্ষণে তেঁতুল গাছের ভিতর দিয়ে চাঁদ ওঠেছে। বাঁকা, ক্ষীণ চাঁদ। পাতলা জ্যোৎস্না পড়েছে আর ঝির ঝির করে একটা বাতাস দিচ্ছে। চরাচর জুড়ে আশ্চর্য মগ্নতা। দেখে শুকুর মনটা কেমন যেন ভালো হয়ে যায়। ফকিরের সঙ্গে পা চালিয়ে চালিয়ে হাঁটতে শুরু করে সে।

মাঠে নেমে বিড়ি ধরায় ফকির। ফোঁস ফোঁস টানে, ধোয়া ওড়ায়। শুকু দেখে ফকিরের বিড়ির মাথায় চন্দন বিচির মতো দগদগে আগুন টানে টানে ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। আবছা জ্যোৎস্নায় ফকিরের চোয়াড়ে মুখটা অস্পষ্ট। শুধু বিড়ির টানে নাকের ডগাটা স্পষ্ট হচ্ছে।

শুকু তারপর শুধু মাঠের দিকে তাকায়। চাঁদ দেখে গ্রামের মাথার ওপর। তাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে চাঁদ। বাতাস আছে। ঝিঁঝির ডাক আছে। এসবের ভিতর কেমন শীত শীত করে শুকুর, কেন যে!

ফকির এবার আকাশের দিকে তাকাল। লক্ষ কোটি আলোকবর্ষের ওপারে কোনও নক্ষত্রের ক্ষীণ আলো প্রত্যক্ষ করল যেন। তারপর বলল, হঠাৎই বলল, বুজলা, এই রকম চাঁদনি রাইত আছিল। বাইতে মার দয়া। খালি আমি বাদে হগলতেরই ওঠছে। দুইজন চইলা গেছে। এমুন একখান অবস্থা, কানবারও পারি না। হায় হায়রে আবার। বাঙ্গিও বুনছিলাম হেইবার। হালায় অইছিলও। বেইনের লাহান অইছিল। রাইতে ক্ষেত পাহারা দিতে অয়। চরে থনে ছিপ নাও লইয়া চোর আহে। ভাও বুঝলে নাও ভইরা বাঙ্গি লইয়া যায়। মন ভালনা। অইলে কী অইব, চকে তো না যাইয়া পারুম না। ভাত খাওন লাগবো না।

থেমে বিড়ি ধরায় ফকির। বড় করে টান দেয়। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আবার পুরনো কথায় ফিরে যায়। রাইতে যাইতেছি খেত পাহারা দিতে। বুচছি বিয়াইনা রাইত। ফকফইক্কা জোছনা। কে জানে তখন নিশিরাইত। বাইতে অসুখ। আমার মন ভালনা, কেডা অত খ্যাল করে। যাইতে যাইতে হেই বিলের মধ্যিখানে ঠিক গোরস্তানডা বাঁয়ে রাইখ্যা দুই কদম গেছি। এমুন সময় দেহি তেনায় চলছেন। আমি হ্যাঁরে পিছে থনে দ্যাখতাছি। পাও দ্যাহা যায় না। খালি চুল। সাত আষ্ট হাত লম্বা তো অইবই। হেই চুল দিয়াই য্যান আটতাছে। আমার ডরভয় নাই। বাইতে অসুখ। তেনারে দেইক্কা মনে হইল কামেল দরবেশ অইবেন। পিছে থনে দৌড়াইয়া গিয়া প্যাচাইয়া ধরলাম। একটা ধাক্কা দিল, তিনচাইর কানি জমিনের হেইধার গিয়া পল্লাম। তয় দুখ পাইলাম না। উইট্টা আবার গিয়া দরলাম। তিনবার এইরকম আছার মারল। হ্যার বাদে মুখ গুরাইল। হায় হায়রে কী নুরানি চেহারা! য্যান পুনিমার চান। কইল, কি চাস? আমি কাইন্দা দিলাম। বাবা, আমার হগল গেছে। কইল, ঘর দুয়ার সাফসুতরা রাখিস, হাঁজের বেলায় যামু। আমি বাইতে আইয়া ঠিক কইরা রাকলাম। হাঁজের পর হেরা আইল সাতজন বুঝলা, সাতজন। কইল, ঘরে আসন দে। আর একজন নিতে আইছি।

হ্যার বাদে সব সাইরা যাইব। জিগাইলাম, বাবা আপনারা কারা? কইল জ্বিন ডাকিনি যুগিনি। আমি ডরাইয়া গ্যালাম। কইল, এমুন এমুন কইরা ডাগবি, আমু। পাইয়া গ্যালাম। বুঝলা, পাইয়া গেলাম। তয় হেই রাতেই আমার ছোড ভাইডা মইরা গেল। ওই যে কইছিল আর একজন নিমু। নিল।

শুকু চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল, ফকির থামতেই চমকে ওঠল সে। ফকির আবার বিড়ি ধরিয়েছে। ফোঁস ফোঁস করে টানছে। শুকুর কেমন ভয় ভয় করে। তবু কথা না বললে ভয়টা বেড়ে যেতে পারে ভেবে বলল, অহন কি সাতজনই আছে?

ফকির লম্বা করে বিড়ি টান দেয়। গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ে। না চাইরজন আছে। বড় মাহাজন আহে আমাবইশ্যা রাইতে। আর তিন জন তো নাইই। আসামের এক ফকিররে দিয়া দিছি। ইস হেগো কথা আর কইয়ো না। বড় বদরাগী আছিল। ইট্টু কিছুতেই ক্ষেইপপা যাইত। বেদম মাইরধইর করত আমারে। তয় আসামের হেই ফকিরও আমারে দিছে। বাওয়াণডা বান হিগাইছে, ফিরানি হিগাইছে।

আজ যেন কথা বলার নেশা ধরে গেছে সেজাল খাঁর। চৌদ্দ পনের বছরের বয়েসী ছেলেটার কাছে তামাম জীবনটাই যেন খুলে বলবে। অথচ শুকু এসব শুনতে চায় না। তার ভয় ভয় করে। মনে অয় মানুষটা নিজেই জ্বিন! শুকু জ্বিনের গলা শুনেছে। সেজাল খাঁ আগেও অনেককবার জ্বিন নামিয়েছে তাদের ঘরে। বুড়ির জন্য। শুকু চোখ বুজে গভীর অন্ধকারে বাবার পাশে বসে থেকেছে। জ্বিনের একেক জন একেক স্বরে কথা বলে। শিকড়বাকড় ছুঁড়ে দেয়। দীর্ঘক্ষণ শ্বাস রেখে ফুঁ দেয়। এ ফুয়ে বালা মুসিবত কেটে যায়। সেই জ্বিনদের স্বরের সঙ্গে ফকিরের গলার স্বরের আশ্চর্য মিল। এসব ভেবে আজ কেমন ভয় পেয়ে যায় শুকু।

.

সেজাল খাঁকে নিয়ে শুকু যখন বাড়ি পৌঁছল তখন অপার্থিব নির্জনতা চারদিকে। বেশ খানিকটা রাত হয়েছে। আঙিনায় ওঠতেই ঘেয়ো কুকুরটা কেউ কেউ করে ছুটে এল। শুকু তীব্রস্বরে ধমক দিল কুকুরটাকে। শব্দ পেয়ে গণি বেরিয়ে এল কুপি হাতে। শুকু ঘরের ভিতর ঢুকে বদনায় করে জল নিয়ে এল। ফকিরের পায়ে সেই জল ঢেলে দিতে দিতে বলল, মিয়াবাই, সব আনছো তো?

গণি মৃদু স্বরে বলল, আনছি।

শুকু তারপর চিৎকার করে মাকে ডাকল। ভাবীকে ডাকল। খাওন-দাওন ঠিক কর। শুকুর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ফকির বাধা দিয়ে বলল, আস্তেধীরে করুক। হপায় তো হাঁজ অইল। তারপর ঘরে এসে সারেঙের আড়াআড়ি শরীরটার পাশাপাশি বসে পড়ল। কুপি হাতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সারেঙকে। পাশে দাঁড়িয়ে মা, গণি, গণির বউ আর শুকু কী এক আশায় বুক বাঁধল।

ফকির মুখ ঘুরিয়ে বলল, আগে আল্লা, ভালা অইয়া যাইব। মাহাজনরা যা যা কয় খেয়াল কইরা রাইখেন। ডরের কিছু নাই।

ফকিরের কথায় একধরনের হতাশা টের পায় শুকু। হাবভাব অনিশ্চয়তার এক ছায়া দুলতে দেখে। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডের শব্দ পাল্টে যেতে থাকে শুকুর। বাবায় কি তয় বাঁচব না। কান্না পায় শুকুর। গলা ভিজে আসে তবু নিজেকে শক্ত করে বলল, ইট্টু ভালা কইরা দেখেন ফকির সাব। আমার বাজানের যেনো কুনো ক্ষতি না হয়।

ফকির মৃদু হাসে। ঘাবড়াইও না। মহাজনরা আহুক।

গণি ছোট্ট জলচৌকির উপর ফুল সাজাতে বসে। ছোট্ট চোঙা খুলে বাতাশ ফুলের। রাখে পাশে। বাটিতে চাল ভরে আগরবাতি দাঁড় করায়। কুপির আঁচে মোমের তলা নরম করে জলচৌকির চারদিকে লাগিয়ে দেয়। গ্লাসে রাখে জল, দুধ।

ফকির তারপর ভাত খেতে বসে। গণির বউ ঘোমটার আড়াল থেকেই সাজিয়ে দিচ্ছে খাবার। গোটা গোটা চালের ভাত, বাটি বাটি তরকারি, শুকুও বসেছে পাশে। একবার চৌকির ওপর বাবার শরীরটার দিকে তাকিয়ে ভাতে ঝোল মাখে সে। মা এখন বাবার পাশে বসে আছে। বুড়িটা পাটাতনের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে থাকলে শব্দ টব্দ করত। জড়ানো স্বরে কথা বলতে চাইত। মিয়াভাইটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। বাবার অসুখটা যেন তার উপর ভর করেছে। বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার চেহারা শুকু মনে মনে বলল, মিয়াভাইর কি অইল! এত ঘাবড়ানের কী অইছে ফকির যখন আইছে! আর কোনও ডর নাই। বাজানে ভালা হইয়া যাইব।

ভাতের নলা মুখে পুরে শুকু ফকিরের মুখের দিকে তাকায়। ফকির লোকটা ভাবির দিকে অমন করে তাকাচ্ছে কেন। শুকু হা করে ফকিরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখে ফকির হেসে বলল, ও শুকু। ভাবিরে কও ঘোমটা হালাইতে। শরম কী। ভালা কইরা ইট্টু সুন্দর মুখখান দেহি। কথাটা ভালো লাগল না শুকুর। তবু অকারণে হাসল সেও ফকিরের কথা শুনে। চৌকির উপর বাবার পাশে বসা মা আর ভাত বাড়তে বসা ভাবি দুজনই ঘোমটার ভেতর জড়সড় হয়, শুকু বুঝতে পারে।

গণি বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পারে। কথা অন্যদিকে ঘোরায় সে। খাওনের কিছু নাই ফকির সাব। মনে কষ্ট নিয়েন না।

শুনে হাসে ফকির। আরে না না খাওনের মধ্যে কী!

তারপর ভাতগুলো নেড়েচড়ে বলল, কী চাই এইডা, সোনাদীগা? গণির বউ ঘোমটার আড়াল থেকে মৃদুস্বরে বলল, না সোনাদীগা একটু লম্বা অয়। এইডা লক্ষীদীঘা।

ফকির মুগ্ধ চোখে গণির বউয়ের মুখের দিকে তাকায়। কতা দেহি ময়না পাখির লাহান, কয়না ক্যা।

গণির বউ হাসে। কথা বলে না।

দরোজা ঠেলে হাজামবাড়ির ছেলে দুটো এল তখন। রবা, নবা। মানিকজোড় ফকিরকে সালাম দিয়ে দ্রুত হাতে তামাক সেজে ফেলে তার। ফকির মুখ মুছতে মুছতে বলল, টান টান। রবা নারকেলের হুঁকায় টেনে টেনে ধোঁয়া তোলে। শেষে বড় বড় কয়েকটা টান দিয়ে ফকিরের হাতে দেয়, ধরেন।

ফকির কপালে হাত ছুঁয়ে ছুঁকা ধরে তারপর টানতে থাকে। লোকটার সবকিছুতে কেমন গা ছাড়া ভাব। রোগী মরে যায়, অথচ সে নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজের কাজকর্ম করে যাচ্ছে। দেখে শুকু ভেতরে ভারী বিরক্ত হয়। হালায় কেমুন ফকির! মানুষ মইরা যায় আর ওই হালায় তামুক খায়।

রবা বলল, হোনছেননি ফকিরসাব, আমিন মুন্সী কইলাম মইরা গেছে।

ফকির হুঁকা থামিয়ে বলল, কবে?

কাইল। নাইতে নামছিল। আর উডে না দেইক্কা হ্যার পোলায় নাইম্যা উডাইছে। দ্যাহে শ্যাষ অইয়া গেছে।

আহারে একটা ভালামানুষ গ্যাল।

রবা বলল, মুন্সী বলে কুরান শরিফের ভিতর টাকা পাইত।

হুনছি তো। হকালে উইট্যা কুরান শরীফ খেললেই পাঁচ টাকার একখান নোট পাইত। আপনেও বলে কী পাইছিলেন?

হেই কতা আর কইয়া কী অইবরে ভাই। কপাল দোষে হারাইছি।

ওদের কথা শুনতে শুনতে শুকু ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিল। হাত পা নিসপিস করছে। তার চোখ ভেঙে আসছে ঘুমে। ফকির অহনও বইতাছে না ক্যা। ফকির বলল, মাহাজনরা কইল ঘরের উত্তর পশ্চিম কোণায় পাবি। কেঐরে কইতে পারবি না। পরদিন গুমথনে উইট্টা দেহি হেই জাগার মাডি আ কইরা রইছে। বিতরে চকচক করতাছে সোনা। আমার তহন উস গেন নাই, দেইক্কা মাতা গুইরা গ্যাছে। মনেই অইল না মাহাজনরা নিষেধ করছে কেউরে কইচ না। আমি বাড়ির হগলতরে ডাইক্কা আনলাম। দেহাইলাম। রইল না। রাইতে মাহাজনরা আইল। আমারে কয়, তৈতুইল গাছের নিচে যা। গ্যালাম। একটা থাবড় মারল, ঘুইরা পইড়া গ্যালাম। যহন উস অইল দেহি হকাল অইয়া গ্যাছে। আমার মুহের লৌ পইড়া মাডি ভিজ্জা গ্যাছে। থাবড়ের চোডে দুইডা দাঁত নাই। ক এমুন বেক্কেল অয় মাইনষে!

গণি ওঠে এসে ফকিরের পাশে বসল। হাত কচলাতে কচলাতে বলল, ফকিরসাব রাইত অনেক অইছে। হগলতে জিমাইতাছে। বহেন ইবার।

ফকির হুঁকা ছেড়ে সোজা হয়। রবা নবা তার দুপাশ থেকে সরে গিয়ে চৌকির গা ঘেঁষে বসে। শুকু চোখ ডলতে থাকে। ঘুম আসছে তার। তবু সোজা হয়ে বসে। কুপির আলোয় দেখে ভাবি পাটাতনের ওপর বুড়ির পাশে ছোট হয়ে শুয়ে। হাত পা মুখ সব শাড়িতে ঢাকা। মা তো সন্ধ্যে থেকেই বাবার পাশে বসা। এখন ঠায় বসে আছে। ক্লান্তি নাই। ফকির গলা খাকারি দিয়ে আসনের সামনে স্থির হয়ে বসে। বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তে শুরু করল। ঘরের ভেতর কয়েকজন মানুষের শ্বাস ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। খুব খেয়াল করলে বাইরে প্রকাণ্ড পৃথিবীতে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যায়। চরাচর বিশাল স্তব্ধতায় ডুবে গেছে। বাতাসের চলাচল বড় ক্ষীণ, টের পাওয়া যায় না।

ফকিরের ধ্যান ভাঙে অনেকক্ষণ পর। এবার নিয়মমতো সাবধানবাণী উচ্চারণ করে সে। কেঐ হাকিহুকি করিস না, আসাআসি করিস না। বায়ু ছাড়িচ না তাইলে কইলাম রখ্যা থাকব না। গণি আগরবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এবার মোমবাতি জ্বালিয়ে কুপিটা ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিল সে। ঘরের ভেতর এখন নিঃঝুম শান্ত একটা ভাব। আগরবাতির ধোঁয়া আর তাজা ফুলের গন্ধ মিলেমিশে চমৎকার একটা সুবাস তৈরি করেছে। কীরকম পাকপবিত্র ভাব ধরেছে ঘরটা। শুকুর চোখের আলগা ঘুমটা লাগতে না লাগতেই কেটে গেছে।

ফকির প্রথমে গুনগুনিয়ে, পরে খোলামেলা সুরে দরুদ পড়তে আরম্ভ করে। তার সাথে রবা নবা আর সারেঙের দুই ছেলে গলা মেলায়। চৌকির ওপর সারেঙের ছেলেমেয়ের মাও গুনগুন করে। মোমের ম্লান আলোয় জবুথবু হয়ে বসে থাকা মানুষগুলোর ছায়া লম্বা কিংবা তেরছা হয়ে টিনের বেড়ার ওপর ভৌতিক সব অবয়ব তৈরি করেছে। ক্রমশ উচ্চগ্রামে ওঠে লোকগুলোর স্বর। নেমে যায়। আবার ওঠে। আবার নামে। তারপর একসময় থেমে যায়। তখন আবার স্তব্ধতা। ফকিরে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে টুকটুক করে পাঁচটা টোকা দেয় জলচৌকির আসনে। তারপর মুর্শিদী ধরে।

আমার এই আসরে আইস দয়ালচাঁন

আমার এই আসরে আইস মুর্শিদাচাঁন।

ফকিরের সাথে গলা মেলায় কেউ কেউ। গানের ফাঁকে চট করে থাপ্পড় মারে গায়ে, মশা তাড়ায়। বাইরে রাত ক্রমশ গভীর হতে থাকে।

একটানা অনেকক্ষণ চলে গান। তারপর থামে। ফকির বিড়বিড় করে আবার মন্ত্র পড়ে, টুকটুক করে আবার টোকা দেয়। দরোজা খুলে বাইরে যায় রবা নবা।

শুকুও যায়। উঠোনের কোণে বসে প্রশ্রাব করে। সেই ফাঁকে টের পায় বাইরে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। ঝাঁকড়া আমগাছটায় ঝুপসি অন্ধকার স্থির আছে। শুকুর কেমন ভয় ভয় করে। জ্বিনেরা এসে বসেনি তো ওখানে।

ঠাকুরবাড়ির উঁচু দেবদারু গাছে কোরলে বাগ মধ্যরাত ঘোষণা করে। অবিরাম ঝিঁঝি ডাকছে। চারদিকে শুক্লপক্ষের চাঁদ কখন নেমে গেছে একপাশে।

মাহজানরা এত দেরি করতাছে ক্যান আইজ! শুকুর আবার বাবার কথা মনে হয়। নড়াচড়া নেই মানুষটার। তয় কী?

ওরা ঘরে ফিরে আসার পর আবার মুর্শিদী ধরে ফকির।

তোমায় কোন্ বনে যাইয়া লাগুল পাব, দয়াল রে আমার।
কোন্ বনে যাইয়া লগুল পাব।

শুকুর চোখ ভার হয়ে আসে ঘুমে। গণির গায়ে ঢলে পড়ে সে। গণি ধাক্কা দেয়। সেই ধাক্কা খেয়ে আবার সোজা হয়ে বসে। আবার গান ধরে। গলা দিয়ে স্বর ওঠতে চায় না। তবু গায়।

নিদানকালে একবার দেখা দিও, দয়াল রে আমার।

ফকির তখন বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসে। সেই ফাঁকে রবা নবা ফিসফাস কথা শুরু করে। এইবার আইব র‍্যা। ফকির বাইরেন্থনে জ্বিনেগ লগে কতা কইয়াছে।

শুনে অকারণে রবা নবার ওপর রাগ করে শুকু, ঐ আজামের পোরা হাকিহুকি করস ক্যা। ফকির না না করছে। এমুন করলে আমাগ বাড়ি হুইতে আবি না।

রবা নবা হাসে।

শুকু তারপর গণিকে বলল, মিয়াবাই, অগ কথা হইতে না কর।

গণি পিনপিনে গলায় বলল ঐ ব্যাডারা, কতা কইস না।

ফকির এখন খুব গম্ভীর। গুম হয়ে আছে আসনের সামনে। মোমের আলোয় তার চোয়াড়ে মুখ অচেনা মনে হয়। আসনে পর পর তিনবার পাঁচটা করে টোকা মারে সে। তারপর দ্রুত ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দেয় মোমবাতিগুলো। অন্ধকারে একাকার হয়ে যায় ঘর। শুকু টের পায় তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা সশব্দে ধাক্কা মারছে। যেন প্রকাণ্ড একটা কালো বেড়াল লাফিয়ে নেমেছে ঘরের ভেতর। রক্তের চলাচলে একরকমের রোমাঞ্চকর অনুভূতি। শুকু শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।

সবাই গুন গুন করে দরুদ পড়ছে, ঠিক তখনি টিনের বেড়ায় প্রচণ্ড শব্দ হল। যেন অমিত শক্তিধর, প্রকাণ্ড কোনও প্রাণী বেড়া ভেঙে প্রবেশ করছে ঘরের ভেতর। শুকু ভয়ে সিঁটকে যায়। গণির গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে। এত সাহসী রবা নবা পর্যন্ত সরে বসেছে।

তখন অলৌকিক স্বরে সালাম দেয় জ্বিনেরা। পরপর তিনবার, তিনরকম শব্দে। বোঝা যায়, তারা তিনজন এসেছে।

একজন বলল, ও গণি মিয়া, কী উঁইন্যে স্মরণ করছ বাঁবা।

গণি পিনপিনে গলায় বলল, কী কমু, আপনে তো হগলই জানেন বাবা।

আল্লা বুলো! তার পর দীর্ঘক্ষণ ধরে ফুঁ দেয়ার শব্দ। সেই ফুয়ে ঘরের ভেতর অদ্ভুত এক শীতলতা চলে আসে। দারুচিনি এলাচ আর কাঁচা লবঙ্গের গন্ধে মম করে চারদিক। হাঁত পতো। হাঁত পাঁতো গণি মিয়া।

অন্ধকারে হাত বাড়ায় গণি। শুকু পাশে বসে টের পায়, টুপ করে কিছু একটা খসে পড়েছে গণির হাতের ওপর। গণি আস্তে করে বলে, পাইচি বাবা।

আবার দীর্ঘক্ষণ ধরে সেই ফু। মিহি স্বরের কথায় আল্লা বুলো, আল্লা বুলো।

তারপর অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট স্বর: কাঁলো জীবের দুধ আর জোঁড়া পুঁল্প, বুচ্ছ, গৃহণ করাঁইবাঁ গৃহণ, আল্লা বুলো।

অন্য একটি স্বরে বলল, কন্যা ও কন্যা কন্যাঁ কি চাও, চাঁও কি।

শুকু বুঝতে পারে কথাটা মাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। মা একটু গলা খাঁকারি দিল। চৌকির ওপর বাবার পাশে বসেই ভেজা ভেজা স্বরে বলল, হ্যায় যেন ভাল হইয়া যায় বাবা।

আল্লা বোলো। আল্লা বোলো।

পাখির শিসের মতো শব্দে ফুঁ আসে আবার। ঘরের ভেতর মিঠে গন্ধ ভাসে। তঁয় যাঁই বাবারা, যাঁই কন্যা। আসঁসাঁলামালাইকুম।

তারপর টিনের বেড়ায় প্রচণ্ড শব্দ। ঘরের ভৌতিক পরিবেশ কেটে যায় মুহূর্তে।

তারপর কুপি জ্বালায় গণি। রবা নবা হাই তোলে। শুকু ওঠে দাঁড়ায়। ফকির তখন সেজদার ভঙ্গিতে আসনের সামনে পড়ে আছে। মাহাজনরা এসে ফকিরের পিঠে বসে কেউ, কেউ আসনে বসে। সেই বিপুল ভার বহন করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ফকির। আসনের ওপর রাখা গেলাসের জল ছিটিয়ে তবে তার জ্ঞান ফেরে।

কুপি জ্বেলে গণি প্রথমে আসন থেকে গেলাসের জল ছিটিয়ে দেয় ফকিরের গায়ে। রবা নবা দরোজা খুলে বাইরে গেছে। শুকু চৌকির ওপর বাবার পাশে ওঠে বসেছে। মা তেমনি একঠায় বসে আছে বাবার সামনে। কুপির আলোয় বড় বিষণ্ণ দেখায় তার মুখ।

ঠিক তখুনি হোস করে বিদঘুঁটে একটা শব্দ করে ফকির। তারপর ওঠে বসে। ওঠে প্রথমেই আসন হাতড়ে টাকা আড়াইটা কোর্তার পকেটে পুরলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, রবা, তামুক হাজা।

ওরা ফিরে এসেছে ততক্ষণে। রবা দুটো টিকা বের করে দিয়েছে নবার হাতে। পোড়া দে।

নবা কুপির আগুনে চিমটা দিয়ে টিকা পোড়াচ্ছে।

গণি বলল, তেনারা আইজ তিনজন আইছিলেন।

ফকির জবাব দিল, হ।

রবা কল্কেতে টিকা ভরে ফুঁ দিতে দিতে বলল, কী নাম জানি তেনাগ?

ডাকিনি জুগিনী মধুমতি কণ্ঠমালা। আইজ কণ্ঠমালা আহে নাই। হেই জটঅলা। পা তমুক লম্বা জট। হাকরাইনের রাইতে আহে। জট দিয়া ঝারে।

ফকির কথা বলছে, বোটকা গন্ধ ওঠে ঘরের ভেতর। সেই গন্ধে নাক কেঁচকায় শুকু। বুড়ি পেচ্ছাব করে দিয়েছে। কী গন্ধ! সেয়ানা মেয়ের পেচ্ছাবে গন্ধ হবে না। যাক। ভালোই করেছে, এখন পেচ্ছাব করেছে। মাহাজনরা থাকলে করলেই হয়েছিল। ফকির এখন কথায় মশগুল। ওসব খেয়াল করার সময় নেই তার। গণি গেছে পুকুর ঘাটে। আসনের ফুল জলে ভাসিয়ে দিতে হয়। মাটিতে পড়লে গৃহস্থের অমঙ্গল।

রবা নবা অনর্গল বক বক কর যাচ্ছে ফকিরের সঙ্গে।

ফকির জিজ্ঞেস করল, তরা হেনে করস কী কী আজামের পোরা।

খেত খোত কোবাই। মাতবরের গাছ ফাড়ি।

বাপে কাম করে না।

করে। মাসে দুই মাসে এক আধটা। চোখে ছানি পইড়া গ্যাছে। মাইনষে নিতে চায় না। কান্দিপাড়ার খনকাররা কাম করইছিল। পোলাডার গাও আর হুগায় না। মাইনষে গাইল পারে।

শুকু ওসব খেয়াল করে না। ঘরের কোণে জালালী দুটো বকবকুম শুরু করেছে। কুকুরটা উঠোনে শুয়ে কুঁই কুঁই করছে। শুকুর বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। দুটো জালালী রোজ এসে বসত ঘরের চালে। বাবা দেখে বলল, আশ্রয় চায় সেদিনই একটা পুরনো টুকরি বেধে পশ্চিম কোণে, বারন্ত চালার সঙ্গে, জালালী দুটো বাসা নিল। ঘটনাটা ভাবতে অবাক লাগে। শুকুর বাবায় কি পশুপাখির ভাষাও বুঝত।

গণি ফিরে আসার পর ফকির বলল, দিয়াইছ?

হ।

গণি খোলা দরোজা বন্ধ করে না। বলল, ব্যাপারিগ গলার আওয়াজ পাইলাম। আডে যাইতাছে।

হকাল অইয়া গেছে। ঘুমাইবেন না?

ফকির মাথা নাড়ে। না, ঘুমান যাইব না। আডে যামু।

গণি তখন আসন থেকে বাতাসা নিয়ে বিলিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। রবা নবাকে দেয়, শুকুরকে দেয়, মাকে দেয়। নিজে বাকিটা রেখে দেয় বউর জন্যে। ফকির আসনের বাতাসা খায় না। মাহাজনদের নিষেধ।

ফকির তারপর হুঁকা টানতে টানতে বলল, গণি মিয়া, তোমার বাপেরে আসনের দুধ খাওয়াও। জব খুলব।

ফকিরের কথায় ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে যায় শুকুর। ফ্যাল ফ্যাল করে বাবার দিকে তাকায় সে।

বাবা কেমন টানটান হয়ে শুয়ে আছে।

গণি আসনের ওপর থেকে দুধের গেলাসটা নিয়ে মার হাতে দেয়। হাঁড়িপাতিল খুঁজে একটা চামচও দেয়। মা চামচে করে দুধ খাওয়াতে শুরু করে বাবাকে। গলায় পৌঁছায় না সেই দুধ। কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

শুকু দেখে বাবা কেমন নিস্তেজ, ঠাণ্ডা মেরে আছে। চোখ বন্ধ, মাথা কাৎ হয়ে পড়েছে বালিশ থেকে। হাত-পা টান টান।

চৌকির ওপর থেকে মা গণিকে ডাকে। গণি তুই আইয়া ইট্টু আ করা তো তর বাপেরে, আমি পারি না। দুধ পইড়া যায়।

গণি চৌকির ওপর ওঠে বাবাকে হা করাতে ব্যস্ত হয়। কিন্তু বাবার মুখে হাত ছোঁয়াতেই চমকে ওঠে সে। মাছের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে শরীর। গণির মুখে কথা সরে না। বাবার গায়ের চাদর সরিয়ে দ্রুত বুকে পেটে হাত দেয় সে। মা ব্যগ্র কণ্ঠে বলে, কী, কীরে গণি?

বাইরে তখন অন্ধকার রাত ফিকে হয়ে আসছে। পাখপাখালির ডাকে পৃথিবী ক্রমশ জেগে ওঠেছে। শুকুর বুকের ভেতরটা ধুগবুগ করে। হৃৎপিণ্ডের শব্দ পাল্টে যেতে থাকে। ঠিক তখুনি ডুকরে কেঁদে ওঠে গণি। মা, মাগো, হ্যায় নাই মা, হ্যায় নাই।

 দরগাতলার জোড়া সাপ

দরগাতলার ইটপাজা থেকে মাথা বের করে সাপ দুটো দেখে চমঙ্কার জ্যোৎস্না ফুটেছে।

চারদিকের পৃথিবীতে অবিরাম ডাকছে কীটপতঙ্গ, পোকামাকড় আর ঝিঁঝি পোকা। এ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। রাত কী নিঝুম হয়ে এল।

দরগাতলার সামনে কানি দুয়েক পোড়ো জমি। বাজা। ফসল ফলে না। সেই জমির মাঝামাঝি জায়গায় বিশাল এক বটবৃক্ষ। বৃক্ষটা কতকাল ধরে আছে এখানে, কে জানে। মাথায় ঝাঁপড়ানো ডালপালা। শরীর থেকে নেমেছে গোঁফদাড়ির মতো শেকড় বাকড়, ঝুরি। তীব্র জ্যোত্সা গায়ের জোরে আটকে রেখেছিল গাছটা। ফলে তলায় পড়ে সাপ দুটো সেই অন্ধকারের দিকে তাকাল।

বটবৃক্ষের অদূরে কোদালের মতো চিরল একখানা নদী, নদীর নাম করতোয়া। আগে নদীটা ছিল বেশ দূরে। দিনে দিনে পাড় ভেঙে এগিয়ে এসেছে। এখন পাড়ে তার বেশ কিছু ঝোপঝাড়। দিনমান নিঝুম হয়ে পড়ে থাকে জায়গাটা।

সাপ দুটো নদী তীরের দিকে একবারও তাকাল না। বটবৃক্ষের তলার অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ইটপাজা থেকে প্রাচীন লম্বা শরীর টেনে বের করল। তারপর মাথা তুলে পোড়ো জমিটা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখল। পোড়ো জমির সাদা মাটি জ্যোৎস্নায় চকচক করছে।

পোড়ো জমি ছাড়িয়েই ধানি মাঠ। দিগন্তব্যাপী। সেই মাঠে রাতের বেলা ধাড়ি সব মেঠো ইঁদুরের চলাচল। নাগালের মধ্যে দুটো ইঁদুর পেলেই দুজনের ভরপেট আহার হয়ে যাবে। চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চিন্ত। প্রাচীন লম্বা শরীর বিড়া পাকিয়ে দরগাতলার ইটপাজার আড়ালে পড়ে থাকা যাবে।

সাপ দুটো একত্রে জিভ বের করল। পর পর কয়েকবার। তারপর চলতে শুরু করল।

ধানি মাঠের দিকে যেতে হলে বটবৃক্ষের তলা হয়ে যেতে হয়।

জায়গাটা অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চোখ চলে না। মুখের সামনে আহার থাকলেও দেখা যায় না।

তবুও আলগোছে অন্ধকার বটবৃক্ষ তলাটা পেরিয়ে এল তারা। পেরুবার মুহূর্তে দুজন একসঙ্গে দেখতে পেল নদীর তীরের ঝোপঝাড়ের সামনে একটি মানুষ বসে আছে। দূর থেকে মুখটা দেখা যায় না তার। হাতের বিড়িটা টানে টানে জ্বলছে, দেখতে পায়। মানুষটা একাকী কেন বসে আছে এখানে! কী মতলব তার!

সাপ দুটো ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবে না। পেটে চব্বিশ ঘণ্টার খিদে। বিশাল লম্বা, তেল চকচকে কালো শরীর জ্যোৎস্নায় সম্পূর্ণ মেলে, জ্যোৎস্না কেটে কেটে ধানি মাঠের দিকে এগোয় তারা।

.

দরগাতলার অদূরে নদীতীরের ঝোপঝাড়ের সামনে সন্ধ্যার পর থেকে বসে আছে গজু। এখন রাত এক প্রহর। চরাচর নিঝুম হয়ে গেছে। কেবল ঝিঁঝি পোকার ডাক, কেবল নদী নিরন্তর বয়ে যাওয়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। আর কোনও শব্দ নেই কোথাও।

নদী থেকে ওঠে আসছিল আবহমান হাওয়া। রাতের বেলা হাওয়াটা শীতল হয়। খালি গায়ে একটু একটু শীত টের পাচ্ছিল গজু। সেই শীতভাব কাটাবার জন্যে অবিরাম বিড়ি টেনে যাচ্ছিল সে।

কিন্তু মেয়েমানুষটা এখন আসছে না কেন?

গজু তো নিজ কানে শুনল, রতনকে বলল, বাড়িডা নিটাল অইলেই বাইর অমু। তুমি দরগাতলার সামনে গাঙপাড়ে বইয়া থাইকো। গজু কি ভুল শুনেছে?

এত বড় ভুল তো সারা জীবনেও হয়নি গজুর। জীবন কাটল কালু ওস্তাদের সাগরেদি করে। চোখকান বড় সজাগ গজুর। চোখে দেখা জিনিস কখন ভুল হয় না তার, কানে শোনা জিনিস ভুল হয় না।

তাহলে?

পারু যে রতনারে কইল, তুমি থাইকো।

গজু কি ভুল শুনল।

কিন্তু ওস্তাদ যে কইত, তুই না থাকলে আমার দল ভাইঙ্গা যাইত গজু। হারা জীবন ডাকাতি করণ লাগত না। এতদিন জেলে পইচ্চা মরতাম। বরবাদ অইয়া যাইতাম। কথাটা সত্য। গজু টো না রাখলে, চোখকান সজাগ না রাখলে, কালু ওস্তাদের দল থাকত না। বহু আগে ভেঙে ছারখার হয়ে যেত। তাহলে আজ এতকালের সজাগ চোখকান কী করে গজুর সঙ্গে বেইমানি করে।

নাভির কাছে, লুঙ্গির কোচর থেকে বিড়ির প্যাকেটটা বের করে গজু। ম্যাচ বের করে। নদীর হু হু হাওয়াটা আছেই। সেই হাওয়া বাঁচিয়ে কায়দা করে বিড়ি ধরায় তারপর বিড়ির প্যাকেট আর ম্যাচ জায়গামতো রাখতে গিয়ে আনমনে কোমরের সঙ্গে বাঁধা লাল গামছার আড়ালে যত্নে গুঁজে রাখা ভোজালিটা একবার ছুঁয়ে দেখে।

জিনিসটার উত্তাপই অন্যরকম। একবার ছুঁয়ে দিলেই শরীরে ফিরে আসে দশ মরদের বল। সাহস। ভোজালিটা কোমরে থাকলে পৌষ মাসের শীতেও খালি গায়ে নদীতীরে বসে থাকা যায়। শীত লাগে না। কিন্তু মেয়েমানুষটা?

নদীর দিকে তাকিয়ে পারুর কথা ভাবে গজু। ভাবে আর ফুক ফুঁক করে বিড়ি টানে। চারদিকের জ্যোৎস্না তখন এতটা তীব্র হয়েছে, নদীর জলে মুহূর্তের জন্যে উয়াস ছাড়তে ওঠা মাছও বুঝি দেখা যাবে। চাঁদখানা গোল হয়ে আছে মাথার ওপর। নদীর জলে জ্যোৎস্না পড়ে চকচক করছে। সেই জ্যোৎস্নার দিকে, জলের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।

গজু চোখ তুলে নদী তীরের ঝোপঝাড়গুলো দেখে। তারপর মোটা গর্দানটা ঘুরিয়ে দেখে বটবৃক্ষটা। তলায় গাঢ় হয়ে ছায়া জমে আছে গাছটার। ম্যালা দিনের পুরোনো গাছ। বয়স কত কে জানে! সারা গায়ে খোড়ল। অজস্র ঝুরি নামিয়ে দিয়েছে চারদিকে। যেন বুড়ো মানুষের লম্বা দাড়িমোচ। বাতাসে পাতাগুলো ঝিরঝির করে নড়ছে। তার ওপর পড়েছে জ্যোৎস্না, দেখতে বেশ লাগে।

গজু খানিকক্ষণ গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আবার মুখ ফেরায় নদীর দিকে। নদীটিও! করতোয়া যার নাম। ভাঙে বছর বছর। আগে বটগাছটা ছিল নদীর পোয়া মাইল দূরে। ভাঙতে ভাঙতে কতদূর এগিয়েছে নদী। বটের গোড়া প্রায় ধরে ফেললো আর কী! এবার বর্ষায় কি এতকালের পুরোনো গাছটাও খাবে নদী?

গজু মনে মনে বলল, রেহাই নাই। আর রেহাই নাই।

কিন্তু পারুর হইল কী। মাগিডা বাইর অয় না কেন অহনতরি?

ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে তাঁতীপাড়াটার দিকে তাকাল গজু। নদীর পাড় ঘেঁষে কয়েক ঘর তাঁতীর বাস। বছর দশেক হল দরগাতলায় এসে ঘর বেঁধেছে। দরগাতলার এখন যিনি পীর সাহেব তিনি খুবই দয়ালু ব্যক্তি। নদী তীরে নিজের বিরান জমি ছিল। বিশ-পঞ্চাশ কানির মতো। সেই জমির বেশির ভাগটা দিয়ে দিলেন তাঁতিদের। লোকগুলো থাক এখানে।

বড় দিলদরিয়া মানুষ পীর সাহেব। ফেরেশতার মতো উদার। হাত পেতে, বিপদে পড়ে সাহায্য চাইতে এসে কোনও মানুষ কখনও ফিরে যায়নি তার কাছ থেকে। তাঁতীরা এসে বলেছিল, হুজুর, আমরা গরিব হিন্দু। দয়া করেন। আমাগো জাগা দেন।

নদীতীরে নিজের জমি দিয়ে দিলেন হুজুর। দয়ালু মানুষ তো।

আর দয়ালু হবেন না কেন? কোন বংশের লোক দেখতে হবে না। তার ওপর নিজেও পীর। কামেলদার লোক। জগৎসংসারে এই একজন লোককেই মান্যগণ্য করে গজু। সমীহ করে। ভয় পায়। মানুষটার সামনে চোখ তুলে কথা বলতে পারে না। এই একটা জায়গায় বুকটা কাঁপে গজুর। হুজুরের চেহারা দেখলেই কাঁপে। চেহারায় কী একটা আছে হুজুরের।

নূরানি চেহারা কি একেই বলে?

আর গলার স্বর শুনলে তো কথাই নেই। মনটা শীতল হয়ে যায়। শরীরের ভেতরটা কাঁপে।

ওস্তাদ একবার গজুকে বলেছিল, ল, যাই, একদিন দরগাতলার পীর সাবের বাইত যাই। নগদ টেকা-পয়সা পাওয়া যাইব। সোনাদানা পাওয়া যাইব। হুজুরের বড় মাইয়া আইছে ঢাকা থন।

শুনে আঁতকে ওঠেছিল গজু। জীবনে প্রথমবারের মতো দৃঢ়ভাবে কালু ওস্তাদকে বলল, ক্ষমা চাই ওস্তাদ। ইচ্ছা হইলে আমারে মাইরা হালান। তাও আমি ঐ বাইত যাইতে পারুম না। গলা দা রক্তা উইট্টা মরুম।

শুনে খ্যাক খ্যাক করে হেসেছে ওস্তাদ। হুজুররে তুই খুব মানচ গজু?

হ ওস্তাদ। হেয় দয়ালু পীর। ফেরেশতার লাহান। হের বাইত্তে ডাকাতি করলে নিবংশ অইয়া যামু।

তর তো পোলা একখানঐ।

হ। রতনা। পোলাডা মইরা গেলে আমি একদম পাগল অইয়া যামু।

কালু ওস্তাদ বলেছিল, পীর হুজুররে আমিও খুব মানি। জান গেলেও হের বাইতে আমি ডাকাতি করতে যামু না।

তয় আমারে কইলেন ক্যা?

দেকলাম, পীর হুজুররে তুই কেমন মানচ।

দেকলাম তুই ঠিকঐ আছচ। আর একখান কতা তরে জিগাই গজু, পোলাডারে তুই বহুত মহব্বত করচ?

হ ওস্তাদ, হ। নিজের থিকাও বেশি।

সেই ছেলে রতনের পিরিতের মেয়েমানুষ হল পারু। যার জন্যে দরগাতলার নদীতীরে রাত এক প্রহরঅব্দি বসে আছে গজু। এই কথাটা যদি কালু ওস্তাদ শোনে? শুনলে হাসবে না! শুয়োরের বাচ্চা বলে গাল দেবে না গজুকে।

দিলে দিবে।

বিড়িতে শেষ টান দিয়ে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলল গজু। কী করুম, আমারডা মাইনষের শইল না। রতনার মায় মরছে ম্যালা দিন অইল। বয়েস অইল দুই কুড়ির উপরে। শইল্লে তাপখান অহনতরি কমে নাই। পারুরে দেইকা ম্যালাদিন ধইরা আমার শইল্লের ভিতরে উসপিস উসপিস করে। শইলডা কী ছেমড়ির! করতোয়ার বানের লাহান। হাইটা গেলে মনে অয় দশখান মাইয়ামাইনষের তেজ আছে ছেমড়ির শইল্লে। আমি পাগল অমুনা? কোন মাইনষে পারুরে দেইকা পাগল না অইয়া পারে। যে অইব না, হেই হালায় বেডাঐ না। রতনা তো এর লেইগাঐ গিয়া ভাজ খাইছে ছেমড়ির লগে। ছেমড়িডাও হালায় রতনারে দেইক্কা মইজা গেল। আরে আমি অইলাম রতনার জন্মদাতা বাপ। রতনার থেইকা আমার শইল্লে রস কম আছেনি! আমি তারে মজাইতে পারুম না।

ভেবে, ভেতরে ভেতরে রেগে গেল গজু। আমার পোলার লগে পিরিত কর আর যাই কর মাগি, তোমারে আইজ আমি ছাড়ুম না। তাঁতীপাড়ার দিকে তাঁত চলার শব্দটা থেমে গেছে অনেকক্ষণ। রাত অনেক হল। মানুষ এখন ঘুমুবে। এই সময়টার কথাটা রতনকে বলেছিল পারু।

সেই অপেক্ষায় আছে গজু। রাত যাই হোক, না বেরিয়ে পারবে না পারু। পিরিতের মানুষকে কথা দিয়েছে।

কিন্তু গজুর আর তো তর সয় না। শরীরের ভেতর একটা জন্তু ঢুকে বসে আছে দুপুরের পর থেকে। যখন তখন মাথাচাড়া দেয় জন্তুটা। জোর করে তাকে দমিয়ে রেখেছে গজু। কতক্ষণ, এইভাবে কতক্ষণ থাকতে পারে মানুষ।

গজু একসময় ওঠে দাঁড়াল। পারুদের বাড়ির দিকটা ঘুরে এলেই হয়। কী হালচাল দেখে এলেই হয়। বাড়িটা তো তাতীপাড়ায় ঢোকার মুখেই।

বসে থাকতে থাকতে কোমরে বাঁধা গামছাটা ঢিলে হয়ে গেছে। ওঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে ওঠল গামছায় গুঁজে রাখা ভোজালিটা। কষে গামছাটা বাঁধল গজু। ভোজালিটা যত্ন করে খুঁজে রাখল জায়গামতো। তারপর ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে আস্তেধীরে তাঁতীপাড়ার দিকে হাঁটতে লাগল।

দরগাতলাটা তাঁতীবাড়ি যাওয়ার মুখেই। নাড়ি ধোয়া পীরের মাজারটা আছে। লালসালু কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা। আর আছে পুরোনো দরদালানের ধ্বংসাবশেষ। ইট পাঁজা। বড় কামেলদার লোক ছিলেন নাড়ি ধোয়া পীর। এইরকম জ্যোৎস্না রাতে করতোয়ায় নেমে পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করে নদীর জলে ধুয়ে নিতেন তিনি। একজন তালবেলাম একরাতে হঠাৎ করে দেখে ফেলল ব্যাপারটা। দেখে ভয় পেয়ে গেল। তারপর পালাল। হুজুর অত বড় পীর, টের পেলেন সবই। পরদিনই তালবেলামকে ডেকে বললেন, যা দেখেছ কাউকে বোলে না। বললে গলা দিয়ে রক্ত ওঠে মরবে।

তালবেলাম নালায়েক লোক। বয়সও কম ছিল। লোভ সামলাতে না পেরে একরাতে বউর পাশে শুয়ে বলল, আমি একখান জিনিস দেখছি। কেউরে কইলে গলা দিয়া রক্ত উইঠা মরুম।

.

বউটার কাঁচা বয়েস, ভাবল স্বামী তার কাছে মনের কথা কইতে চায় না। রঙ্গ করতাছে। জোর করে স্বামীকে ধরল সে। কী দেকছ, কওন লাগব আমারে। নইলে থাকুম না তোমার বাইত। এই রাত্রেই বাপের বাইত যামুগা।

তালবেলাম যত বোঝায়, কয়, হুজুর আমারে নিষুদ করছে। কইলে গলা দিয়ে রক্ত উইঠা মরুম।

বউটা কথা শোনে না। মান করে। আমারে তুমি ভাইল দিতাছ। এইভাবে সাতদিন গেল। বউর মান কমে না। তালবেলাম আর কী করে। সংসারে অশান্তি। একরাতে কথাটা সে বউকে বলে দিল। যেই না বলা, গলা দিয়ে রক্ত ওঠে মরল। পীর হুজুরের নিষেধ অমান্য করেছিল যে। মরণ ছাড়া আর কী হবে তার!

নাড়ি ধোয়া পীর হুজুর গত হয়েছে তিন পুরুষ আগে। মাজারটা আছে। বর্তমান পীর হুজুর নিজে তদারক করেন। তিনি ছাড়া মাজারে অন্য কেউ যায় না। গরম মাজার। একটু গরমিল হলে গলা দিয়ে রক্ত ওঠবে। নিশ্চিত মরণ। দুনিয়ার বেবাক ডাক্তার বাইটা খাওয়ালেও বাঁচাইতে পারব না কেউ।

আর নাড়ি ধোয়া পীর হুজুরের মাজারে আছে দুখান সাপ। কী সাপ কে জানে। তেল চকচকে কালো লম্বা শরীর। যখন তখন মাজারের আশেপাশে দেখা যায় তাদের। ইট পাজার আড়ালে দেখা যায়। কারো অনিষ্ট করে না।

লোকে বলে, সাপ দুখানা নাড়ি ধোয়া পীর হুজুরের প্রিয় দুই তালবেলাম। দেহান্তরিত হয়ে সাপ হয়েছে। কারো অনিষ্ট করে না সত্য, কিন্তু চোখের সামনে, পীর হুজুরের মাজারের আশেপাশে কোন পাপ কর্ম দেখলে সহ্য করবে না। বাড়ি গিয়ে হলেও দংশাবে।

সাপ দুটোর কথা মনে হতেই গজু একটু কেঁপে ওঠল। জ্যোৎস্নারাতে আহারে বেরোন তেনারা। বাগে পেলে পাপী মানুষের জান কবচ করবেন। পীর হুজুরের প্রিয় শিষ্য। হুজুর নিজেই দেহান্তরিত করিয়ে মাজার পাহারায় রেখে গেছেন তাদের।

কথাটা মনে করে, নাড়ি ধোয়া পীরহুজুরের মাজারের বহুদূর দিয়ে তাঁতীপাড়ার দিকে পা চালায় গজু। মনে মনে পীরহুজুরের উদ্দেশে বলে, পীরহুজুর আমি মহাপাপী। ম্যালা পাপ করছি জীবনে। ম্যালা মাইনষের গলায় ছুরি ধরছি, মালসামানা ছিনাইয়া লইছি! শইল্লের জ্বালায় আর একখান পাপ কাম করতে আইছি হুজুর। আপনে তো বেবাকঐ জানেন হুজুর। শইল্লের জ্বালা বড় জ্বালা। হের লেইগাই হুজুর, আপনা পেডের পোলার পিরিতির মাইয়া ছেইলাডারে ভোগ করুম আইজ। তয় আপনেরে আমি কতা দিতাছি, নাড়ি ধোয়া পীর, হুজুর, আপনেরে আমি কতা দিতাছি, এইডাই আমার শেষ পাপ কাম। কাইলথন আমি ভালা অইয়া যামু। জীবনে আর কুন পাপ করুম না।

পারুদের বাড়ির দিকটা খুব নিঝুম হয়ে আছে। তাঁত বন্ধ করে পারুর বাপভাইরা ঘুমিয়ে পড়েছে। এটাই বেরুবার সময় পারুর। প্রায় রাতেই রতনের সঙ্গে নদীতীরের ঐ ঝোপটার আড়ালে দেখা করে সে। গজু সব খবর রাখে। আজ দুপুরে নিজ কানে শুনেছে, পারু বলেছে রাইতে যামু। তই কইলাম থাইক্কো।

গজু তখন নাইতে যাচ্ছিল করতোয়ায়। রতন-পারু কেউ দেখেনি তাকে।

তখন থেকেই শরীরটা গরম হয়ে আছে গজুর। শরীরের ভেতর হিংস্র এক জন্তু যখন তখন ছটফটানি শুরু করেছে। গজু মনে মনে বলেছে, ডাকাতি ছাইড়া দিছি ম্যালাদিন। অইলে অইব কী, আইজ শেষ ডাকাতিডা করুম আমি। পারুর সতীত্ব ডাকাতি করুম। বিকেলবেলা কায়দা করে রতনকে পাঠিয়ে দিল বাদলবাড়ি। কালু ওস্তাদের কাছে।

কালু ওস্তাদ নিজেও আজকাল কামকাজ করে না। ছেড়ে দিয়েছে। বয়েস হয়েছে তো! কিন্তু দলটা আছে। সাগরেদরা আছে। ডাকাতি করেই ওস্তাদের বখরাটা দিয়ে যায়। ওস্তাদ একা মানুষ। বিয়ে-শাদি করে নাই। বউপোলাপান নাই। অত টেকা-পয়সা তার লাগে না। গজুকে দেয় কিছু।

সেই টাকা আনতে রতনকে ওস্তাদের কাছে পাঠিয়েছে গজু। আসলে ভাঁওতা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। টাকাটা জরুরি না। হাতে যা আছে বাপপুতের মাসখানেক চলে যাবে। ব্যাপারটা কি টের পেয়েছিল রতন।

বিকেলবেলা গজু যখন বলল, ওস্তাদের কাছে যা রতন। টেকা-পয়সা লইয়া কাইল বিয়ানে আইয়া পড়িছ।

রতন জানে বাদলবাড়ি গেলে আজ রাতে ফেরার উপায় নেই অথচ পারু বলেছে—

রতন কাঁচুমাচু গলায় বলেছিল, কাইল বিয়ানে গেলে খাবি কী মামদার পো। উপাস দিবি! বুড়ো বয়সে আমারে না খাওয়াইয়া রাকবি!

রতন তারপর মন খারাপ করে চলে গেছে।

তখন থেকেই আমোদে আছে গজু। নন্দর দোকান থেকে দুপ্যাকেট বিড়ি কিনেছে। সেই বিড়ি কোমরে, ভোজালিটা কোমরে, গজু এসে বসেছে নদীতীরের ঝোপঝাড়ের আড়ালে।

বিড়ি টানতে টানতে, পারুর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে রাত একপ্রহর।

কিন্তু পারু এখন বেরুচ্ছে না কেন?

ঠিক তখনি ঘরের ঝপ খুলে একটি মেয়েমানুষ নিঃশব্দে উঠোনে নামল। জ্যোৎস্নায় দূর থেকে মেয়েমানুষটাকে চিনতে পারল গজু। পারু।

দেখে উত্তেজনায় বুকটা ফেটে যেতে চাইল গজুর।

পারু তখন নাজুক পায়ে বাড়ি থেকে নামছে। সাবধানে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখা যায় তাকে। শাড়ি খান পাছকোমর করে পরেছে। হাঁটছে। এত সুন্দর ভঙ্গিতে, পরীর মতো লাগে পারুকে। আর সেই দৃশ্য দেখে দমবন্ধ হয়ে আসে গজুর। শরীরের উত্তাপ বেড়ে যায়। ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। মনে মনে ডাকে আয় পারু, আয়। কখন কোন ফাঁকে কোমর থেকে ভোজালিটা বের করে হাতে নিয়েছিল, গজুর খেয়াল নেই। জ্যোৎস্নায় ভোজালির ধারটা নদীর জলের মতো ঝিলিক দিচ্ছিল।

হাতের ভোজালিটা একবার তাকিয়ে দেখে গজু। দেখে বুকের ভেতরটা জীবনে প্রথমবারের মতো কেন যে একটু কেঁপে ওঠে, বুঝতে পারে না।

পারু আসছে।

ধানি মাঠে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সাপ দুটো। আহার পায় না। ইঁদুরগুলো বেজায় চালাক। কেমন করে যে টের পেয়ে গেল সামনেই ওত পেতে আছে মৃত্যু। ঝুপঝাঁপ করে সাপ দুটোর মুখের ওপর দিয়ে পালিয়ে গেল তারা। সাপ দুটো ছোবল মারল কয়েকটাকে। ধরতে পারল না। ফলে মেজাজ তাদের তিরিক্ষি হয়ে গেল।

রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে ধানি মাঠ থেকে ফিরল তারা। ফিরে সোজা চলতে লাগল নদীতীরের ঝোপঝাড়ের দিকে।

তখনি দৃশ্যটা চোখে পড়ল তাদের। সেই মানুষটা এখন ওত পেতে বসে আছে ঝোপঝাড়ের আড়ালে। আর অন্য একটা মানুষ আস্তেধীরে,এগিয়ে আসছে তার দিকে। দৃশ্যটা দেখেই পাপের গন্ধ টের পেল তারা। মুহূর্তে মাথায় লাফিয়ে ওঠল রক্ত। গতি বেড়ে গেল তাদের। মুহূর্তে মানুষ দুটোর মাঝামাঝি চলে এল। তারপর দুজন দুদিকে। মুখ করে, বিশাল ফনা তুলে মানুষ দুটোর মুখোমুখি দাঁড়াল। তীব্র জ্যোৎস্নায় সাপ দুটোর কুলোর মতো ফনা শূন্যে দুলতে লাগল।

দেশভাগের পর

কালরাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি। নিরেট অন্ধকারে কোথায় কোনও এক ঘরে শুয়ে আছি। বাইরে নিঝুম বৃষ্টি। কতকাল ধরে যে এরকম বৃষ্টি হচ্ছে কে জানে! বৃষ্টির তোড়ে হঠাৎই ঘরের একটা দরজা খুলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় দমবন্ধ ভাবটা কাটে আমার। বৃষ্টির ঝাপটায় ঘর ভিজে যাচ্ছে দেখতে পাই। বুক ভরে শ্বাস টানি। ওঠে দরোজাটা, যে বন্ধ করব শক্তি পাই না। বৃষ্টিজলে ঘর ভিজে যায় আর আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখি। তখন কে একজন, ধপধপে সাদা থান পরা, মাথায় ঘোমটা, বাইরে থেকে দরজাটা টেনে বন্ধ করতে চায়। পারে না। বৃষ্টির ভেতর আবছা সেই নারীমূর্তি, কে, এত কষ্ট করেও আমার ঘরের দরজা বন্ধ করতে চাইছে।

স্বপ্নের ভেতরই অবাক হই। খেয়াল করে সেই নারীমূর্তি চেনার চেষ্টা করি। একটু যেন চেনা চেনা মুখটা। কে? দুতিনবার চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি। জবাব আসে না। উঠে দরোজার কাছে গিয়ে দেখি বৃষ্টিতে সাদা থান পরে, মাথায় ঘোমটা, কমললতা দাঁড়িয়ে। আমাকে ওঠে আসতে দেখেই করুণ, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বৃষ্টির অভ্যন্তরে মিলিয়ে যায়। আমি পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকি, কমল, কমললতা। সে শোনে না। মিলিয়ে যায়।

ঘুম ভেঙে আমি তারপর অনেকক্ষণ কিছু ভাবতে পারিনি। ঘুমিয়ে আছি না জেগে, বুঝতেই অনেকটা সময় কেটে যায়।

বয়েস হলে কী এরকম হয়! মত্যু ঘনিয়ে এলে কী এরকম হয়! কালরাতে কমলকে স্বপ্ন দেখার পরপরই ঘুম ভেঙে গেছে। জেগেও অনেকক্ষণ ধরে তারপর কমলকেই দেখেছি। স্বপ্নের মতো জাগরণেও কমল বারবার আমার চোখের ওপর দিয়ে, শাদা থান পরে, মাথায় ঘোমটা করুণ, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হেঁটে গেছে। বৃষ্টি হচ্ছিল, বৃষ্টিজলের ঝাপটায় ঘর ভিজে যাচ্ছিল। কমল বাইরে দাঁড়িয়ে দরজাটা বারবার টেনে বন্ধ করতে চাইছিল। কী অর্থ এসবের! বুঝতে পারি না কিছু। তবে স্বপ্ন দেখার পর থেকে কমলকে আর ভুলতে পারছি না। কমল আমার চোখ থেকে আর সরে না। কতদিন পর যে স্বপ্ন দেখলাম কমলকে!

বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারিনি। এমনিতেই ভালো ঘুম আজকাল হয় না। রাতেরবেলা হাঁসফাঁস করি, এপাশ ওপাশ করি, ওঠে জল খাই। ঘুম কী আসে! আগে ঘুম না এলে কুপি জ্বালিয়ে রামায়ণ পড়তাম। টুকটাক কাজও করেছি অনেক রাত জেগে। কখনও ওষুধের আলমারি খুলে গোছগাছ করেছি, চেয়ার টেবিল ঝেড়েমুছে রেখেছি। বহুকাল এসব আর করা হয় না। চোখে ভালো দেখতে পাই না। কানেও শুনি কম। রাতেরবেলা তাই বড় বেশি অসহায় লাগে। নিঝুম হয়ে পড়ে থাকি। অন্ধকার ডাক্তারখানায় শুয়ে নিজের ভেতরের কত ছবি যে দেখতে পাই, কত কথা যে শুনতে পাই! বেঁচে থাকতে ভাল্লাগে না। কতকাল ধরে যে এইরকম একলা হয়ে আছি! এভাবে জীবন কাটে মানুষের, নির্বান্ধব অবস্থায়!

ডাক্তারবাবু চলে গেলেন সেও এক বছর। কথা ছিল গুছিয়ে গাছিয়ে আমিও চলে যাব। একটা বছর কেটে গেল, কিছুই গোছান হয়নি। আজকাল মনে হয় একটা বছর কী একটা পুরো জীবনেও বুঝি গোছান হবে না আমার। চতুর সময় কেবল পিছলে যাবে।

ডাক্তারবাবু বলেছিলেন দোকানটা বিক্রি করে দেবেন। দিয়ে একবারেই নমস্কার। আমি হতে দিইনি। এত পাষাণ হই কী করে! বললাম, আপনে যান গিয়া কর্তা। আমি আর কয়দিন থাইকা আসি। আমি গরিব মানুষ, আমারে মারব কেডা? ভগবান আছেন। তিনিই দেখবেন। আমার কথা শুনে মানুষটা খুব কাঁদলেন। যেতে কী চান! সারাজীবন যে মাটিতে কাটালেন তাকে ছেড়ে যেতে চায় কে!

কিন্তু না গিয়েই বা উপায় কী! দেশ কি আর দেশ আছে! মানুষ কি আর মানুষ আছে! গত বছরই তো বর্ষাকালে মনীন্দ্র খুন হল। বাবু তো ভয়ে মরেন। একদিন চুপি চুপি। বললেন, উমা রে আর বুঝি থাকন গেল না। মোল্ল সতরডা বচ্ছর তো কাডাইলাম। শেষকালে কি মাইনষের হাতে মরুম! শেষকালে নি খুন হইয়া যামু!

আমি বললাম, কাম নাই কর্তা। চইলা যান। এখনে থাইকা কষ্টই বা করবেন ক্যা? শেষ। বয়েসে একটু আরাম করেন গা। মাইয়ারা আছে, বউমারা আছে তারা যত্নআদি করবো। যান গা।

বাবু অনেকক্ষণ কথা বলেননি। থম ধরে রইলেন। তারপর চারদিকে একবার তাকিয়ে বললেন, বড় মায়া হয়রে। এই মাডি মানুষ ছাইড়া যামু!

বাবুর চেহারা তখন বিবেকানন্দের মতো ভারী দেখাচ্ছিল। দেখে চোখ ছলছল করে আমার। আমি কিছু বলতে পারিনি!

এক সন্ধ্যায় তারপর মাওয়ার ঘাটে গিয়ে চুপি চুপি বাবুকে লঞ্চে চড়িয়ে দিলাম। মতলেব মুদি, গান্ধি ময়রা ওরা বারবার জিজ্ঞেস করেছে, ডাক্তারবাবু কই যাইতাছেন?

বাবু জবাব দিতে পারেননি। আমি মিথ্যে বলেছি সবার কাছে। বাবু একটু কামে ঢাকা যাইতেছেন। তিন চাইরদিন পর আইসা পরবেন।

বাঁধা রোগীদের কাছ থেকে বাবু বিদায় নিয়েছিলেন অন্যভাবে। কাকে কী বলেছেন আমি সব শুনিনি। তো যাওয়ার কদিন আগ থেকেই আমাকে বারবার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কাকে কোন ওষুধ নিয়মিত দিতে হবে, কোন রোগের কী সাধারণ চিকিৎসা। আমি ওসবে মনোযোগ দিইনি। একটা জীবন কাটল বাবুর কম্পাউণ্ডারি করে, বুঝব না কোন রোগের কী চিকিৎসা! বাবুর কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কমল বেঁচে থাকতে কমল, সে মারা যাওয়ার পর এই জলধর ডাক্তার, আমরা দুজনে দুজনার ছায়ার মতো ছিলাম। তাই ডাক্তার বাবু চলে যাওয়ার পর আমি দ্বিতীয়বারের মত একলা হয়ে গেলাম। বাবু অবশ্য বারবার বলেছেন, এখানে থাইকা কাম নাই। তুইও ল আমার লগে। টেকা পয়সা দিয়া কী হইবো!

আমিই জোরাজুরি করে থেকেছি। বলেছি, আপনে যান কর্তা। সবকিছু বেইচ্যা কিছু পয়সা কড়ি হাতে লইয়াই আমি আমু। আমার কোনও ডর নাই। আর দুইজন একলগে গেলে মাইনষে সন্দ করবো। আপদ-বিপদও হইতে পারে।

কথাটার গুরুত্ব দিয়েছিলেন বাবু।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি তখন বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছি। জানের ভয় কার না আছে। বারবার ইচ্ছে হয়েছে বাবুর সঙ্গেই চলে যাই। কলকাতা গেলে অসুবিধা কী! একটা মাত্র পেট, চলে যাবেই। তাছাড়া বাবু তো আছেনই। বাবুর ছেলেরাও শুনেছি বড় বড় সব চাকুরে। কলকাতায় রাজরাজরার মতো বাড়ি। চাকর-বাকরের অভাব নেই। গাড়ি ঘোড়ার অভাব নেই। আমিও তাদের সংসারেই একটা কোনও কাজটাজ নিয়ে থেকে যাব।

আমরা বংশানুক্রমে বাবুদের বাড়িতেই কাজ করে আসছি। আমার পিতা, পিতামহ। তখন কাজিরপাগলায় বিশাল জমিদারি ছিল বাবুদের। বাবুর পিতা বুড়ো চক্রবর্তী মহাশয়ের আমলে সেই জমিদারি প্রায় শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়েছিল। বুড়ো চক্রবর্তীর সংসারে ছিল ওই এক মাতৃহীন সন্তান, জলধর। আমার প্রথম যৌবনে দেখেছি কলকাতায় থেকে ডাক্তারি পড়ছেন জলধরবাবু। সপ্তায় সপ্তায় তাঁর চিঠি আসে। সেই চিঠি পেয়ে বুড়ো মানুষটার কী উচ্ছ্বাস! শীতের সকালে আঙিনার রোদে বসে হবু ডাক্তার ছেলের চিঠি পড়েত পড়তে সকাল যে কখন দুপুর হয়ে যেত মানুষটা খেয়াল করতেন না। কখনও বাড়ির চাকর ঠাকুরদের ডেকে ডেকেও চিঠি পড়ে শোনাতেন। জমিদারির কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তখন। কিন্তু চাকরবাকরের কমতি ছিল না সংসারে। আমার বাবা সারাক্ষণ বুড়ো মানুষটার তদারকিতে থাকতেন। মা থাকতেন ঘরকন্নার কাজে। আমার বোন দুটোর বিয়েথা হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে। আমি তখন হাইস্কুলের একেক ক্লাশে তিনচার বছর ধরে পড়ি। তবু ক্লাশ সিক্সের ওপর যাওয়া হয়নি। ততদিনে জলধরবাবু কলকাতা থেকে ডাক্তার হয়ে এলেন। আহা কী সুন্দর দেখতে ছিলেন মানুষটা তখন। ছেলেবেলায় রূপকথার গল্প শুনতাম, ডালিমকুমারের গল্প। সেই রূপকথার ডালিমকুমার হয়ে জলধরবাবু কাজির পাগলা এলেন। বয়সে আমারচে তেমন। বড় হবেন না। তবু ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাবুকে আমি বেশ সমীহ করে চলতে লাগলাম।

বাবুর ইচ্ছে ছিল কলকাতায় থেকেই ডাক্তারি করবেন। বুড়ো চক্রবর্তী রাজি হলেন না। চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি, এলাকার তাবৎ লোকজনই একদা চক্রবর্তীদের প্রজা ছিল। বাবুকে চক্রবর্তীদের বনেদিয়ানা বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই কাজির পাগলা গ্রামে থেকে ডাক্তারি করতে হবে। বিদেশ বিভুয় থাকলে লোকে চক্রবর্তীদের ভুলে যাবে। বুড়ো চক্রবর্তী বেঁচে থাকতে তা হবে না। তিনি সইতে পারবেন না।

তো ডাক্তারবাবুও মানুষ বটে একখানা। অত বড় মানুষটা, অত শিক্ষিত, বাপের কথা অমান্য করলেন? করলেন না। জীবনটা এই কাজির পাগলা বাজারেই কাটিয়ে দিলেন। ওদিকে নিজের ছেলেগুলোকে দেখ, লেখাপড়া শিখে যে যার মতো বিদেশ বিভুঁয়ে চলে গেল। আবার বলে কিনা ওটাই তাদের দেশ!

এই কথাটা নিয়ে বাবু বড় দুঃখ করতেন। ছেলেমেয়েদের চিঠিপত্র পেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, পয়দা হইলি এই দেশে, অহন কচ কিনা এইডা তগ দেশ না! হায়রে আহাম্মকের দল!

চিঠিতে বাবুকে কলকাতা চলে যাওয়ার কথা লিখত ছেলেরা। তখনই বাবু এসব কথা বলতেন। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ কইরা দেশটারে নাইলে দুইভাগ করলই, কিন্তু আমি যে এই মাটিতে জন্মাইলাম, এইডা তো মিথ্যা কথা না! হায়রে, লেখাপড়া শিখা এইডাও তরা অস্বীকার করতে চাস!

পার্টিশানের পর থেকেই ছেলেরা খুব তাগিদ দিচ্ছিল, এবার চলে এস বাবা। এখন আর ওদেশে পড়ে থাকার মানে হয় না!

কথাটা শুনলেই বাবুর মাথায় রক্ত চড়ে যেত। একাকী বিড়বিড় করতেন সারাক্ষণ। এদেশ ওদেশ কী, পুরাটাই তো এক দেশ, এক মাটি। মাটির বাস নিয়া দেখিচ হারামজাদারা, সব একই বাসের। নাকে বাতাস টাইনা দেখিচ, একই স্বাদের।

সেই মানুষকেও দেশ ছাড়তে হল। জানের ভয় আছে না! কী যে শুরু হল দেশে, মানুষ মানুষকে মারতে চায়। ডাক্তার বাবু চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে, তখন বর্ষাকাল, মনীন্দ্র খুন হল। রাতেরবেলা অন্ধকার জংলা বাড়িতে মানুষটার গলা কেটে রেখে গেল কারা।

এরপর প্রাণে জল থাকে কার! বছর দুয়েক ধরেই তো এরকম শুরু হয়েছে। মুসলমানরা সব মারমুখো হয়ে আছে। চারদিকেই হিন্দু খেদাও ভাব। মনীন্দ্রকে তো খুনই করল। আহা অমন একটা মানুষ!

অবশ্য মনীন্দ্রেরও দোষ ছিল। বড় মেয়েমানুষ ঘেঁষা ছিল মানুষটার স্ববাব। পাশের মুসলমান বাড়ির তিনটি মেয়ে বড় হয়েছিল মনীন্দ্রর হাতের ওপর দিয়ে। একটার বিয়ে থা হয়ে গেলে, পরদেশে চলে গেলে, পরেরটা আসত মনীন্দ্রর কাছে। শোনা যায় একদা যার সঙ্গে মিলমিশ ছিল মনীন্দ্রর, গোপন সম্পর্ক ছিল, তার তিনটি মেয়ের সঙ্গেই পরবর্তী সময়ে সম্পর্ক হয় মনীন্দ্রের।

তো মানুষটা বেজায় চালাক চতুর ছিল। কবিরাজ মানুষ তো! তার ওপ টোটকা ফোটকা জানত। ভূতের আছর ছাড়াতে পারত, মা শেতলার চিকিৎসা সারা বিক্রমপুরে মনীন্দ্রের মতো কেউ জানত না। পচে গেছে এমন রোগীকেও ভাল করেছে মনীন্দ্র। প্রয়োজনে। জিভ দিয়ে কুকুরের মতে নাকি চেটেও নিত মা শেতলার দয়া।

মানুষটা বোধহয় বশীকরণ মন্ত্রও জানত। নইলে এত মেয়েমানুষই বা আসত কেন তার কাছে! কী ছিল মনীন্দ্রর! বাঁশের মতন লম্বা টিংটিঙে শরীর, ধারাল নাক মুখ। বয়স্ক। মনীন্দ্রর কথা ভাবলে অবাক হয়ে যাই আমি। এ কী করে সম্ভব! তার ওপর কোনও মেয়ে কখনও পোয়াতীও হত না! আশ্চর্য!

লোকমুখে পরে শুনেছি, মনীন্দ্র খুন হওয়ার পেছনে মেয়েমানুষ কেলেঙ্কারি ছিল। পাশের বাড়ির সব শেষ মেয়েটির আর বিয়ে হচ্ছিল না। মুসল্লী ঘরের মেয়ে, পাঁচওয়াক্ত নামাজ কালাম হয় যে বাড়িতে, সে বাড়ির মেয়ে কতকাল আবিয়াত থাকবে? বুড়ো মৌলভী বাবা জানপ্রাণ দিয়ে পাত্র দেখছিলেন। দুএকজন পাচ্ছিলেনও। কিন্তু কেমন করে যেন ভেঙে যাচ্ছিল সব বিয়ে। মেয়েটি যে দেখতে খারাপ তাও নয়। চলনসই। চিঠিপত্র লিখতে পারে, কোরান শরীফ পড়তে পারে, জাতবংশ ভাল, সচ্ছল গেরস্থ ঘর, তবু বিয়ে হচ্ছিল না। সবাই ধরে নিয়েছিল এতে মনীন্দ্রের হাত আছে। বাড়ির শেষ মেয়ে চলে গেলে মনীন্দ্রর উপায় হবে কী? এসব ভেবে বিয়ে বেঁধে রেখেছিল মনীন্দ্র।

ওদিকে বিয়ে হচ্ছিল না বলে মেয়েটির যে কোনও দুঃখ আছে তা নয়। সে বেশ হাসিখুশি থাকে সারাক্ষণ। ছুটোছুটি করে, অকারণে হাসে, আমোদ করে। মা বাবা মেয়ের এ অবস্থা দেখে ভাবনায় থই পায় না। অবশ্য এ বাড়ির প্রতিটি মেয়ের সঙ্গেই যে মনীন্দ্রর ভাবসাব, কথাটা সবাই জানে। গ্রামের লোকজনও।

তো সেই মেয়েটি নাকি রোজই মাঝরাতে মনীন্দ্রের জঙ্গুলে বাড়িতে চলে যেত। সারারাত বুড়োভাম মনীন্দ্রর সঙ্গে কাটিয়ে বিয়ানরাতে বাড়ি ফিরত।

দিন যাচ্ছিল এই ভাবে। কিছুকাল পর কেমন করে যেন বিয়ে ঠিক হয়ে যায় মেয়েটির! দামলার ওদিকে। দিনক্ষণ দেখে বিয়েও হয়। কিন্তু মেয়েটির স্বামী কালক্রমে ব্যাপারটি টের পেয়ে যায়। পাজিপাজরা মানুষ। এককালে ডাকাতের সর্দার ছিল। সেই বোধহয় এক নিঝুম বর্ষার রাতে দলবল নিয়ে এসে মনীন্দ্রকে খুন করে যায়।

ত্রাসটা শুরু হয় তারপর থেকে। কোনও কোনও মুসলমান অকারণেই হিন্দুদেরকে বকাঝকা করে, লুঠতরাজ করে। মাওয়ার ওদিকে, মুচিপাড়ায় নারীধর্ষণও হয় কয়েকবার।

ডাক্তারবাবুরই বা দোষ কী? পরিচিত মানুষজন সব পাল্টে গেলে সেখানে কি আর কেউ থাকতে পারে! জানের মায়া বড় মায়া।

ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় মাওয়ার ঘাটে বাবুকে লঞ্চে চড়িয়ে দিলাম। গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতা চলে যাবেন।

তারপর থেকে আমি একা। একটা জীবন কাটল এই মানুষটার সঙ্গে। জাতে বামুন। আমরাও। আমার বাবা বাবুদের বাড়ির ঠাকুর ছিল। বুড়ো চক্রবর্তী মহাশয় মারা যাওয়ার পর, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর, সেই ঠাকুরগিরি চলে এল আমার হাতে। বাবু তখন ডাক্তারখানা খুলে পুরোদস্তুর ডাক্তার। বিয়ে থা করে নিয়েছেন। বৌদি কামারখাড়ার মুখার্জী বাড়ির মেয়ে। রোদে দাঁড়ালে মোমের মতন গলে যান এইরকম নরম, সুন্দর দেখতে।

আমার ঘরেও কমল চলে এসেছে ততদিন। বাবু বললেন, উমা তুই আমার কম্পাউন্ডারি কর। বাড়ির রান্নাবান্না করবে কমল।

আমি রাজি হয়ে গেলাম। লেখাপড়া শিখেছিলাম ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। বাবু বললেন, তুই পারবি। এইভাবে দিন গেল। বাবুর ছেলেপুলের যখন যুবক বয়েস, তখন সারা দেশে বেনিয়া তাড়ানোর হিড়িক। বেনিয়ার বাচ্চারা একদিন পাততাড়ি গোটাল।

পার্টিশানের বছর বৌদি তার ছোট মেয়েটিকে সঙ্গে করে কলকাতা চলে গেলেন। বড়গুলো তো আগে থেকেই কলকাতায়। কিন্তু ডাক্তারবাবু গেলেন না। জমিজিরাত, বাড়িঘর এসবের বন্দোবস্ত করে আসছেন, কথা রইল।

কিন্তু আর যাওয়া হল না বাবুর। আজ যাচ্ছি কাল যাচ্ছি করে ষোল সতেরটা বছর কাটিয়ে দিলেন।

কিন্তু মানুষটা বড় গোছান স্বভাবের ছিলেন। আর কী ধীর স্থির! ভেতরে ভেতরে জমিজিরাত সব বিক্রি করে ফেললেন। বাড়িটাও। দাম পেলেন ভালো। ডামাডোলের মধ্যে বিক্রি করলে তো কিছুই পেতেন না! তবে টাকা-পয়সা সব পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায়। এখানে রাখলেন না। সেই টাকায় তিনমহলা বাড়ি হল কলকাতায়। বৌদির ভাইয়েরা সব ব্যবস্থা করলেন। তারা কলকতার জাদরেল লোক।

এসব দেখে আমার মনে হয়েছে, ডাক্তারবাবুও বোধহয় ভেতরে ভেতরে ঠিক করে রেখেছেন একদিন তিনিও চলে যাবেন। কিংবা দূরদর্শী লোক তো, জেনে গিয়েছেলেন এদেশ একদিন ছাড়তে হবে।

আবার ভাবি, তাহলে অতগুলো বছরই বা কাটালেন কেন এখানে! অনেক আগেই তো চলে যেতে পারতেন! যাওয়ার সময় অত কান্নাকাটিই বা করলেন কেন!

বুঝি না। মাথার ভেতরে অন্ধকার ঢুকে যায়। মানুষের মন, ভগবানও তার থই পান না। আমার বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কমললতার কথা মনে হয়। কালরাতে কমলকে স্বপ্ন দেখলাম, কতদিন পর! বৃষ্টি জলের ঝাপটায় ঘর ভিজে যাচ্ছিল, কমল বাইরে থেকে টেনে দরজাটা বন্ধ করতে চাইছিল। কী মানে এসবের!

তারপর রাত থাকতেই ওঠে পরেছি। ঘরের ভেতরে তখন জমে আছে পাতলা অন্ধকার। দরজা জানালা খুলে দেয়ার পরও সেই অন্ধকার কাটে না। বাইরে ভাতের ফ্যানের মতো আলো ফুটছে। এসব আমি স্পষ্ট দেখতে পাই না। তবে আলো আঁধারের পার্থক্যটা বুঝতে পারি।

দরজা খুলতেই মিহি একটা হাওয়া এসে গায়ে লাগে। উদোম গায়ে শোয়ার অভ্যেস আমার। বাতাসে ক্ষীণ একটু শীতলতা ছিল। শরীর কেঁপে ওঠে, রোম দাঁড়িয়ে যায়। ফারুন শেষ হয়ে এল। এখনও শীতের টানটা রয়ে গেছে। আমি ওষুধ-আলমারির আড়াল থেকে ঝাড়ু বের করে ঘর ঝাঁট দিই। এমন কোনও ময়লা পড়ে না, তবু দিই। অভ্যেস। চিরকাল দিয়ে আসছি। ডাক্তারবাবু শিখিয়েছেলেন নোংরা থেকে মানুষের সব অসুখবিসুখের জন্ম।

ঘর ঝাট দিতে দিতে মনে হয় দূর দিয়ে কেউ যেন হেঁটে যায়। স্পষ্ট দেখতে পাই না, বুঝতে পরি, কোনও মানুষ। হয়তো রুহিতনের ঘরে রাত কাটিয়ে লোকজন জেগে ওঠার আগেই সরে পড়ছে।

আমি চোখ তুলে মানুষটাকে চেনার চেষ্ট করি। পারি না। বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। চোখ দুটো একেবারেই গেছে।

তারপর সারাঘরে গঙ্গাজল ছিটাতে ছিটাতে মনে হয় এসময় তো কাকপক্ষি ডাকার কথা! ডাক বোধহয়। আমি শুনতে পাই না। বুকের ভেতর হাহাকার ওঠে। দিন ফুরিয়ে এল। কবে যে ডাক পড়বে!

সকালের দিকে দুএকজন বাঁধা রোগী আসে। বয়সী মানুষ সব। ওষুধপত্র নেয় আনা দুআনার। মাথা ধরার বড়ি, পেট ব্যথার বড়ি, এইসব। তাছাড়া দোকানে ওষুধপত্র বলতে গেলে নেই। খালি হয়ে গেছে। তবু রোগী আসে। আড্ডা দিতেই আসে। গল্পগাছা করে চলে যায়। নিয়মিত। মাঝেমধ্যে খুবই বিরক্ত হই। মানুষগুলো গল্প করে তো করেই যায়, ওঠতে চায় না। বেলা বাড়ে। তবু রাগ করতে পারি না। ডাক্তারবাবু বলতেন, রোগী হচ্ছে দেবতা। খারাপ ব্যবহার করিস না।

কথাটা মনের ভেতরে বাঁধা। সয়ে যাই।

সকালবেলা নুন চা খাওয়ার অভ্যেস আমার। বাবুরও ছিল। দার্জিলিং থেকে খাঁটি চা পাতা আসত। গরম জলে কয়েক রোয়া নুন মিশিয়ে, কটা পাতা মিশিয়ে গেলাস ভরে সেই চা খেতেন বাবু। পরে আমারও অভ্যেস হয়ে যায়।

রোগীরা সব ভাঙা বেঞ্চিতে বসে গল্প করতে শুরু করে আর আমি কেরোসিনের চুলোয় চায়ের জল চাপিয়ে আসি। বাড়তি থাকলে দুএকজনকে খাইয়েও দিই।

বেলা বাড়ার পর, রোগীরা চলে যাওয়ার পর, ভাত চড়িয়ে চান করতে যাই। এসে সালুন। রান্না। একটু ভাজি, একআধটু ভর্তা, এই তো খাওয়া। দিন আর যেতে চায় না। রোগীও আসে কম। ডাক্তারবাবু নেই, আমার কাছে আসবে কী! ওষুধও তো শেষ। হয়ে এল। বাবু চলে যাওয়ার পর আমি আর মাল তুলিনি ঘরে। ওষুধের আলমারি দুটো দিনকে দিন খালি হয়ে যাচ্ছে। মাল তুলে কী হবে! কদিন পর চলেই তো যাব। বাবুই বলে দিয়ে গেছেন এসব। মাল যা আছে বেইচ্চা শেষ কর। ফাঁক বুইজ্জা সামানপত্র বেচবি, তারপর সোজা কইলকাত্তা। বড় রকমের কোনও ঝুঁকি নিবি না।

আমিও সেই মতো কাজ করেছি। এখন দোকান খালি। হাতে পয়সাও জমেছে বেশ। তবু কী যেন বাকি থেকে যাচ্ছে।

কাল রাতে কমলকে স্বপ্ন দেখার পর থেকে মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। ডাক্তার বাবুর কথা বারবার মনে হয়েছে। কমল মারা যাওয়ার পর তিনিই তো আমার একমাত্র আপনজন ছিলেন।

সকালবেলা ওঠে ঘর ঝাঁট দিয়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে শেষ করতে করতে একটু বেলা হয়ে গেছে। বাবুয়ার চায়ের দোকানে একজন দুজন খদ্দের লাগতে শুরু করেছে তখন। মতলেব রমেশরাও বোধহয় দোকান খুলে বসেছে। মাছও বোধহয় আসতে শুরু করেছে বাজারে। আনাজপাতিও। বাজারটা এবার জমবে। অনেকদিন পর নিত্যকার এই জীবন। সকাল থেকেই আমার আজ খারাপ লাগতে শুরু করে। ডাক্তারবাবুর হাতাওয়ালা চেয়ারটা মুছে রাখতে রাখতে কেন যেন জলে চোখ ভরে আসে! যেন বা ডাক্তারবাবুকেই ছুঁয়ে দিলাম এরকম মনে হয়।

বাবু চলে যাওয়ার পর চেয়ারটা আমার হয়ে গেছে। কিন্তু আমি ভুলেও কখন বসিনি। বাবু চলে গেছেন কথাটা বারবার ভুলে যাই। কখনও আনমনে খালি চেয়ারটার দিকে। তাকালে মনে হয় ডাক্তারবাবু বুঝি কলে গেছেন। এক্ষুনি ফিরে এসে চেয়ারটায় বসবেন। গলা খাকারি দিয়ে, কপালের ঘাম আঙুলে মুছে বলবেন, উমা জল খাওয়া রে! মানুষ চলে যায়, রেখে যায় হরেক রকমের চিহ্ন। সারাটা ঘর জুড়ে বাবুর কত রকমের যে চিহ্ন ছড়ান! বিছানাপত্র, কাঁসার থালা গ্লাস, বইলাঅলা খড়ম, একখানা ছেঁড়া পানজাবি, খান দুয়েক মিহি শান্তিপুরি ধুতি। এইসব দেখে আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে।

কেরোসিনের চুলোয় চায়ের জল চাপিয়ে বসে থাকি। ওঠে আলমারির সামনের দিকটায় গিয়ে বসব ইচ্ছে করে না। চায়ের জল বলকায়, আমি উদাস চোখে পেছনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। চোখে ভালো দেখতে পাই না, তবু বাইরে যে রোদ উঠেছে বুঝতে পারি। পায়ের কাছে তুরতুর করে কী! বাইত্তা? ম্যালা ইঁদুর বাইত্তা হয়েছে ঘরটায়। চোখে ভালো দেখতে পাই না, কানেও হালকা শব্দটব্দ ঢোকে না, তবু মনে হয়। ঘরের ভেতর অবিরাম খুঁটখাট শব্দ হচ্ছে। ইঁদুরে সব কেটেকুটে বিনাশ করছে। পুবদিকের পাটাতনে বুঝি উঁই ধরেছে। দেখতে কী পাই! কাল সন্ধ্যায় গায়ে পিরপির করেছিল অসংখ্য পোকা। বুঝতে পেরেছি উঁই! ঘরের ভেতর সংগোপনে চলছে ক্ষয়কৰ্ম। কানে শুনতে পাই না, দেখতে পাই না চোখে, তবু একাগ্রতায় থাকলে মাথার ভেতর মিহিন একটা ক্ষয়ের শব্দ ধরা পড়ে।

গ্লাসে চা ঢেলে নিয়েছি, তখন বাইরে থেকে কে একজন ডাকল, ঘরে আছেননি? কর্তা? চায়ে চুমুক দিয়ে বলি, কেডা?

আমি ছিরিপদ।

আস।

শ্রীপদ ঘরে ঢোকে। তার পদভারে। পাটাতন ঘরের শিরায় মুদু একটা কাঁপন লাগে। শব্দটব্দ হয় বোধহয়। শুনতে পাই না। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে সব।

চা শেষ করে সামনের ঘরে আসি। খবর কি ছিরিপদ?

শ্রীপদ বসেছিল বেঞ্চে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ফিসফিসে গলায় বলল, খবর হুনছেন নি কত্তা? রায়ট লাগবো বলে?

শুনে আপাদমস্তক কেঁপে উঠি। খানিক কিছু বুঝতে পারি না। বুকের ভেতর কেমন একটা কাঁপন লেগে থাকে। ঢোক গিলে বলি, কই হুনলা?

রতনা গোয়াইলা কইলো। ঢাকা গেছিলো দুদ সাপলাই দিতে। হুইনা আইছে।

বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার। ভগবান জানে কী হইবো! সাবধানে থাইকো ছিরিপদ।

হ। ডরডা তো আমাগঐ। আপনের কী কত্তা! আপনে কইলকাত্তা যানগা। আমাগ নাইলে যাওনের জাগা নাই, আপনের তো আছে! যান গা।

একথার পর কী বলব! আনমনে বাইরে তাকিয়ে থাকি। বুকটা কাঁপে। শেষ বয়সে মানুষের হাতে মরব! ভগবান, কী যে শুরু হল দেশে!

দুপুরবেলা খালে স্নান করতে গিয়ে বনগোটা গাছের তলায় বাতাসে কী একটা উড়তে দেখি। লম্বা দড়ির মতো, শাদা। বাতাসে একবার এদিক যায়, একবার ওদিক। ছোটখাটো জিনিস হলে চোখে পড়ত না। অনেকক্ষণ খেয়াল করে বুঝতে পারি, সাপের খোলস। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এসবই অশুভ চিহ্ন। মন খারাপ হয়ে যায়। কাছে কোথাও একটা সাপ আছে। শীতকাল চলে গেল, এখন গর্ত থেকে বেরুবে। আর যে রকম জঙ্গুলে জায়গা, সাপ তো থাকবেই!

ভয়ে ভয়ে স্নান সেরে আসি।

খালে জল কমে গেছে। কোমর সমানও হয় না। ফাগুন মাসেই খরা শুরু হয়েছে এবার। ধানিমাঠ বুঝি শুকিয়ে ফুটিফাটা। খালে পাম্পমেশিন লাগিয়েছে লোকে, দোন। লাগিয়েছে। সব জল এখন ওঠে যাচ্ছে বোরোধানের মাঠে। কষ্টে কষ্টে স্নান করতে হয়। উঠে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে ঘোলা চোখে চারদিকটা দেখি। বাঁদিকে ভাঙা দরদালান আছে। গাছপালার চাপে চোখে পড়ে না কিংবা আমি দেখতেই পাই না। ওই দরদালানেই নাকি ঘর বেঁধেছে রুহিতন। মেয়েটার কথা ভেবে আর একবার বুকের অনেক ভেতরে মৃদু কাঁপন টের পাই। সাপখোপের ভয় নেই রুহিতনের!

স্নান সেরে ফিরে আসতে আসতে আর একবার সাপের খোলসটা দেখ। বনগোটা গারছের তলায় উদাস হয়ে পড়ে আছে। এখন একটু একটু বাতাসও আছে। ভেজা। শরীরে টের পাই দখিন থেকে বইছে। বাতাসে খোলসটা নড়াচড়া করে, ফরফর শব্দ করে। স্পষ্ট দেখতে পাই না, শুনতে পাই না। আমার বুঝি দিন ফুরিয়ে এল। গুছিয়ে গাছিয়ে কর্তার কাছে চলে যাওয়া বুঝি আর হল না।

খেতে বসে ডাক্তারবাবুর কথা মনে হয়। কলকাতায় এখন বেদম সুখে আছেন মানুষটা। চিঠিপত্রও লেখেন না আজকাল। প্রথম প্রথম লিখতেন। কত কথা যে লিখতেন! দিনে দিনে সিই চিঠি কমে এখন প্রায় বন্ধের মুখে। আগে বাবুর চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম। সেই অপেক্ষা শষ হয়ে গেছে। আজকাল মনে হয়, ডাক্তারবাবুর পুরো ব্যাপারটাই ছিল লোক দেখানো। ছেলেদের চিঠি পেয়ে গালাগাল দেয়া, দেশ ছাড়ার কথা উঠলে রেগে যাওয়া, এমনকি চলে যাওয়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে মেয়েমানুষের মতো কান্না, সবই। এখন মনে হয় মানুষটা বোধহয় জেনে গিয়েছিলেন এদেশে থাকা যাবে না, কিংবা এটা পরদেশ। কষ্টেসিষ্টে চেপে থেকে যা-কিছু হাতিয়ে নেওয়া যায় তাই লাভ।

তবু দোকানটার কোনও বিধিব্যবস্থা করে যেতে পারেননি। পারলে বুঝি বেচে দিয়ে যেতেন। না পেরে আমার জন্য রেখে গেলেন। কিন্তু মানুষটা বোধহয় জানতেন আমি সারা জীবনেও দোকানটার কোনও ব্যবস্থা করতে পারব না। গুছিয়ে গাছিয়ে চলে যাওয়া কোনও দিনও হবে না আমার। ডাক্তার মানুষ তো, শেষ জীবনে বুঝি শরীরের রোগের সঙ্গে সঙ্গে মনুষের মনের রোগ, সরলতা জটিলতাও ধরতে শিখে গিয়েছিলেন। এসব ভাবলে জলে চোখ ভরে আসে আমার। সংসারে কেউ কারও নায়। মানুষ আসলে একা।

.

ছেলেবেলায় এক উদাস বাউল একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে যেত, গাওয়ালেতে আইলারে মন। গানটার সঠিক অর্থ সেই বয়সে বুঝতে পারত না উমাচরণ। এই শেষ বয়েসে আজকাল একাকী নির্জনে মাঝেমধ্যে সুদূর শৈশবের সেই বাউল তার বিষণ্ণ একতারা বাজিয়ে মাথার ভেতরে গান গেয়ে যায়। গাওয়ালেতে আইলারে মন।

এখন গানের অর্থটা একটু একটু বুঝতে পারে উমাচরণ। পৃথিবীতে বাণিজ্য করতেই তো আসে মানুষ। বাণিজ্য শেষ হলে যে অচিনদেশ থেকে আসে আবার সেই অচিনদেশেই ফিরে যায়। মাঝখানে পড়ে থাকে অদ্ভুত এক মায়া। সেই মায়ার নাম জীবন।

বয়স হয়ে গেলে কি মৃত্যু ছায়ার মতো অনুসরণ করে মানুষকে! আজকাল এসব মনে হয় উমাচরণের। কাল রাতে কমলকে স্বপ্নে দেখার পর থেকে বারবারই মনে হচ্ছে, গাওয়াল বুঝি শেষ হয়ে এল তার। এবার ফিরতে হবে।

উমাচরণের ভালো লাগে না কিছু। দরজার সামনে জলচৌকিতে বসে নারকেলের হুঁকায় গুরুক গুরুক করে তামাক টানে। বাইরে রোদের দুপুর ফুরিয়ে গেছে। বাজারে। লোকজনের সাড়াশব্দ কম। দখিনা হাওয়া বইছে। এই সময় মন উদাস হয়ে যায় কেন উমাচরণের!

তখুনি এল রুহিতন। বাবাজী।

উমাচরণ নড়েচড়ে ওঠল। তামাক টানা বন্ধ করে বলল, কেডারে, রুহি?

হ।

উমাচরণ ঘোলা চোখে রুহিতনকে চেনার চেষ্টা করে। ভগবান, চক্ষু দুইডায় যে কী হইল, মানুষজনও চিনতে পানি না।

রুহিতন কথা বলল না। উমাচরণের পাশে পাটাতনের ওপর বসে পড়ল। তারপর আঁচলে আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, হেয় আমারে লইয়া যাইতে চায়।

কে?

জোকার মানুষটা।

কই লইয় যাইতে চায়?

হেয় যেহেনে যাইবো। কয় আমারে ঘর দিবো।

রুহিতনের কথা শুনে উমাচরণ একটু চুপ করে রইল। তারপর হুঁকা নামিয়ে রেখে বলল, তুই কি কচ, যাবিনি?

হেইডা জিগাইতেই তো আপনের কাছে আইলাম।

উমাচরণের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। রুহিতনের জন্য অদ্ভুত এক টান আছে তার। মেয়েটি বোকা। ভালোমন্দ অনেক কিছুই বোঝে না। বোঝে কেবল খাওয়াটা আর শোয়াটা। এই খাওয়া শোয়া বুঝতে গিয়েই বেশ্যা হয়ে গেল।

উমাচরণের সব মনে আছে।

রুহিতনের তখন দশ এগার বছর বয়েস। কোত্থেকে যে কাজিরপাগলা বাজারে এসে জুটল কে জানে! গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া ন্যাকরা জড়ান, দুর্গন্ধ ময়লা, এটোকাটা খায়। রাতেরবেলা বাজারের গলিঘুচিতে পড়ে থাকে। উমাচরণের তখন মধ্য বয়স। ডাক্তার বাবুর মাথায় সাদা টাক মাত্র পড়তে শুরু করেছে।

রুহিতন সারা বাজর ঘুরে বেড়ায়, উমাচরণ দেখে। এঁটোকাটা খায়, দেখে। সময়ে একআধটা পয়সাও দিয়েছে সে। বাসিপচা খাবারও দিয়েছে। মেয়েটির চেহারায় কী যেন একটা ছিল। উমাচরণ খেয়াল করে দেখেছে, বড় সরলতা মাখা মুখ। বোকাসোকা। ড্যাবড্যাবা চোখে তাকালে মায়া হয়।

একদিন খুব সকাল সকাল ঘুম ভেঙেছে উমাচরণের। তখন কানে ভাল শুনতে পায় সে, চোখও চলে টর্চ লাইটের মতো। ঘুমের ভেতর উমাচরণের মনে হয়েছিল ছাইছে ঘিরের পেছনে বসে কে যেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। প্রথমে উমাচরণ ভেবেছে কানের ভুল কিংবা স্বপ্নের ভেতর হচ্ছে শব্দটা। পরে স্পষ্ট হয়েছে। উমাচরণ বাইরে এসে দেখে ঘরের পিছনে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে রুহিতন। সারারাত ঘুমোয়নি বোঝা যায়। চোখমুখ বসা। হাঁটুতে মাথা গুঁজে মিহি সুরে কাঁদছে।

উমাচরণ কাছে গিয়ে এক ধমক লাগিয়েছে, এই ছেমরি কান্দস ক্যা?

রুহিতন কথা বলে না, কাঁদে। কেঁদেই চলে।

উমাচরণ তারপর আর রেগে গেছে। ঘরের ভেতর ডাক্তারবাবু ঘুমোচ্ছেন। জেগে গেলে রাগ করবেন।

উমাচরণ মেয়েটির হাত ধরে টেনে তুলেছে। আঐলে [ আড়ালে ] যা। বাবু জাগলে মুক্তি [ এক ধরনের কিল ] দেবে।

.

কিন্তু মেয়েটিকে টেনে তুলেই অবাক হয়েছে উমাচরণ। নিম্নাঙ্গে চাপ চাপ রক্ত শুকিয়ে আছে। দুএক ফোঁটা তাজা রক্তও দেখতে পায় উমাচরণ। প্রথমে ভাবে মেয়েটি বুঝি ঋতুমতি হয়েছে।

কিন্তু ওসব হলে কান্নার কী আছে!

চকিতে অন্য একটা ব্যাপার তারপর মনে হয়েছে উমাচরণের। মনে হয়ে শিউরে উঠেছে সে। নিচু গলায় রুহিতনকে তারপর জিজ্ঞেস করেছে, কী হইছে ক আমারে? সহজে কথা বলেনি রুহিতন। উমাচরণ জোরাজুরি করায় অনেকক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, রাইতে কেডা জানি আমারে….।

বাকি কথা উমাচরণ বুঝে নিয়েছিল। বুঝে ঘৃণায় দুঃখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর গোপনে চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলেছিল রুহিতনকে।

কিন্তু সারিয়ে তুলেই বা কী হবে। রুহিতন ততদিনে নিজের শরীর চিনে গেছে। তার ওপর বাজারের দামড়াগুলো আধলিটা সিকিটা ধরিয়ে দেয়।

রুহিতন বেশ্যা হয়ে গেল।

ওদিকে উমাচরণের বড় মায়া পড়ে গেল মেয়েটির ওপর। সময়ে অসময়ে রুহিতন তারপর থেকে উমাচরণের কাছে আসে। বাবাজী বলে ডাকে। আর ঐ ডাকে কিযে মায়া, উমাচরণ মেয়েটিকে নিজের বাইরে ভাবতে পারে না। হোক না বেশ্যা, মানুষতো!

তার আর কমলের মেয়েটি বেঁচে থাকলে তো রুহিতনের বয়সীই হত!

আবার কমললতার কথা মনে হয় উমাচরণের। মেয়েটির কথা মনে হয়।

উমাচরণ আনমনা হয়ে গেছে দেখে রুহিতন ডাকে, বাবাজী।

উমাচরণ চমকে ওঠে। নারকেলের কাটা শব্দ করে গড়িয়ে পড়তে চায়। রুহিতন খপ করে ধরে ফেলে। তারপর কাটা হাতে নিয়ে যেন নিজের ঘর এরকম অবলীলায় উমাচরণে ঘরের ভেতরে চলে যায়। সযত্নে জায়গামতো রেখে ফিরে আসে।

রুহিতন এসে আগের জায়গায় বসার পর উমাচরণ একটু গলা খাঁকারি দেয়। তারপর বলে, মাইনষেরে অত একিন [ বিশ্বাস করুন ভালো না রুহি। এহেনে আছচ দশজনে। তরে চিনে, কিছু হইলে হগলেই দেখব। পরদেশে নিয়া মানুষটা যুদি তরে হালাইয়া দেয়, তখন কী করবি! দেখব কেডা তরে!

রুহিতন কথা বলে না। উমাচরণ খুব জোরে জোরে কথা বলছে দেখে একটু হাসে। রুহিতনের সেই হাসি উমাচরণ খেয়াল করে না। বলে, মহারাজা তো মানুষ খারাপ না। বাইরে থিকা তো ভালই দেখা যায়। তয় কওন যায় না কার ভিতরে কী আছে।

আবার একটু থামে উমাচরণ। তারপর বলে, তুইই বুইজ্জা দেক রুহি। যা ভাল মনে হয় কর।

রুহিতন তবু কথা বলে না। খানিক বসে থাকে তারপর ওঠে চলে যায়। ছানিপড়া চোখে উমাচরণ দেখে স্বপ্নের মতন কুয়াশার ভেতর রুহিতনের ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে। দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে উমাচরণের।

রুহিতনও এখান থেকে চলে যেতে চায়! মহারাজার সঙ্গে! মহারাজা সার্কাসের জোকার। কেমন মানুষ কে জানে। একদিন উমাচরণ জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি হিন্দু না মুসলমান? মহারাজা বলেছে, জানি না।

মা বাপের বুঝি ঠিক নেই। রুহিতনেরও তাই। দুজনে মিলত ভালই, কিন্তু সব জেনেশুনে একটি বেশ্যা মেয়েকে যে বিয়ে করতে চায়, তার ভেতর নিশ্চয়ই কোনও চালাকি আছে। বিদেশ বিভুয়ে নিয়ে ব্যবসা করাবে মেয়েটিকে দিয়ে। তারপর বয়েস হয়ে গেলে, মূল্যহীন হয়ে গেলে, খেদিয়ে দেবে।

এসব ভেবে কষ্ট হয় উমাচরণের। রুহিতন তার চোখর ওপর বড় হল। বেশ্যাগিরি করে বেঁচেবর্তে আছে ভালো মতোই। দেশ গেরামের ব্যাপার, এভাবেই চলে যেতে পারবে। কষ্ট হবে না। ভগবান বড় সদয় রুহিতনের ওপর। পেটটা বাঁজা করে দিয়েছে। বেঁচে থাকতে ঝামেলা নেই রুহিতনের।

রুহিতনকে দুতিনবার বাজার থেকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে। গ্রামের মাথা মাথা লোকগুলোও ওঠে পড়ে লেগেছিল মেয়েটির পেছনে। ওঠতি বয়েসী পোলাপান সব নাকি খারাপ হয়ে যাচ্ছে রুহিতনের জন্য। উমাচরণ প্রায় হাতে পায়ে ধরে ঠেকিয়েছিল লোকগুলোকে। তখন রুহিতনকে দেখলেই তার নিজের মেয়ে গৌরীর কথা মনে পড়ত। কিন্তু রুহিতনটা বোকার হদ্দ। নইলে এতদিনে বিস্তর পয়সা করতে পারত। ভদ্রানতিও আছে ছেমড়ির! হাতে পয়সা থাকলে লাখ টাকায়ও খদ্দের নেবে না ঘরে।

কথাটা ভেবে হেসে ফেলে উমাচরণ। ঈশ্বরের পৃথিবীতে কত কিসিমের মানুষ যে আছে! ছেলেবেলায় দেখ একটা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে উমাচরণের। তার বাবা প্রথম জীবনে। বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজে চাকরি নিয়েছিল। খালাসির চাকরি। তখন বৃটিশদের। রাজত্ব। তাদেরই জাহাজ। নামটা আজও স্পষ্ট মনে আছে উমাচরণ্রর। জনার্দন। উমাচরণ ছেলেবেলায় সেই জাহাজের গল্প শুনত বাবার কাছে। কত দ্বীপ দ্বীপান্তরে ঘুরেছে বাবা তার গল্প। সেই গল্প শুনতে শুনতে উমাচরণ রোজ রাতেই দ্বীপ দ্বীপান্তরের স্বপ্ন দেখত তখন। কখনও দেখত একটা অতিকায় জাহাজ আর ধু ধু নীল সমুদ্র। অগাধ জলরাশি বুকে ধরে পড়ে আছে সমুদ্র। দূরে আকশ নেমে এসেছে সমুদ্রে। জাহাজটা সেই আকাশসীমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ছেলেবেলায় স্বপ্নটা শুধুমাত্র স্বপ্নই ছিল। কোনও অর্থ ছিল না স্বপ্নের। এই শেষ বয়েসে এখন সেই স্বপ্নটির কথা মনে হলে কখনও কখনও ভীষণভাবে চমকে ওঠে উমাচরণ। স্বপ্নটা বড় অর্থময় হয়ে যায় আজকাল। মনে হয় মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে কোথায় যেন স্বপ্নটার বড় মিল!

সন্ধ্যের দিকে বাজারটা আবার জমে ওঠে। সার্কাস পার্টিটার জন্যে। পার্টিটা চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। উমাচরণ শুনেছে দুচার দিনের মধ্যেই ওঠে যাবে। এজন্যে ভিড়ভাট্টা একটু বেশি। সন্ধ্যেবেলা হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে বটতলা। মাইকে গান বাজনা হয়, কখনও মোটা গলায় হয় ঘোষণা। ঘরে বসে বয়রা হয়ে আসছে। এই রকম কানে সেই বিশাল শব্দকে ক্ষীণ করে শোনে উমাচরণ। তার ভাল্লাগে না। একাকী বিড়বিড় করে মানুষটা। কী যে বলে নিজেই শুনতে পায় না। তবু বলে। বয়েস হয়ে গেলে কত রকমের উপসর্গ যে দেখা দেয় মানুষের!

ঘরের ছাইছে একটা তুলসী গাছ আছে। সেখানে মাটির ধূপতিতে সন্ধ্যেবেলা ধূপ দেয় উমাচরণ। আর বিড়বিড় করে কমলকে ডাকে, কমল, কমললতা, আমার। আর ভাল্লাগে না গো। আমার আর বাঁইচা থাকতে ভাল্লাগে না। তুমি আমারে নিয়া যাও।

ঘরে এসেও সেই একই ব্যাপার। খালি গায়ে ঘনায়মান অন্ধকারে কিছুই ঠাওর পায় না উমাচরণ। খুঁজে পেতে কুপি জ্বালায়। গাছার [কুপিদানি] ওপর সেই ম্লান কুপি জ্বালিয়ে রেখে কষ্টেশিষ্টে হাত পা ধোয়। তারপর ক্লান্ত হয়ে চৌকির ওপর বসে থাকে।

এই চৌকিতে ডাক্তারবাবু শুতেন। এখন উমাচরণ শোয়। বাবুর এই একটা জিনিসই ব্যবহার করে সে। না করে উপায় নেই। পাটাতনে শুলে ফাঁকফোকর দিয়ে শীত ওঠে। বুড়ো শরীরে ঠান্ডা সহ্য হয় না। বুকে বসে যায়।

কুপির আলোয় ঘরের ভেতর ভৌতিক ছায়া নড়াচড়া করে। বটতলায় লোকজনের হল্লা, মাইকে গানবাজনার শব্দ, উমাচরণের কানে যাবতীয় শব্দই ক্ষীণ হয়ে যায়। চৌকিতে বসে ডাক্তারবাবুর কথা ভাবে সে, কমললতার কথা ভাবে। তার একটা মেয়ে ছিল, গৌরী, চার বছর বয়সে পরীর মতন মেয়েটি বাবুদের দিঘিতে ডুবে মরল। সেই শোক সামলাতে না সামলাতে কমলও গেলে। আজ কত বছর উমাচরণ বড় একলা হয়ে আছে। উমাচরণের এখন কেউ নেই। এসব ভাবলে কান্না পায়। ছানিপড়া চোখে জল আসে। বেঁচে থাকতে ভাল্লাগে না।

তবু কী যেন এক আশায় আছে উমাচরণ। দোকানের সব ওষুধপত্র বিক্রি হয়ে গেছে। ছয়শো তিরিশ টাকা জমেছে হাতে। আর কিছু খুচরো। আলমারি দুটো আর অন্যান্য আসবাব ফাঁক বুঝে বেচে দিলেই খারিজ। একদিন ভোর ভোর মাওয়ার ঘাটে গিয়ে লঞ্চে চড়বে। তারপর কলকাতা।

তখন মন আবার আস্তেধীরে ভালো হয়ে যায় উমাচরণের। ছেলেবেলার সেই জাহাজের স্বপ্নটা দেখে জেগে জেগে। একটা অতিকায় জাহাজ আর নীল ধু ধু সমুদ্র। অগাধ জলরাশি বুকে ধরে পড়ে আছে। দূরে আকাশ এসে নেমেছে সমুদ্রে। সেই কেন্দ্রবিন্দুর দিকে নিঃশব্দে এগুচ্ছে জাহাজ।

তারপর সেই ভর সন্ধ্যেবেলাই উমাচরণ ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দেয়। মানুষ আর মানুষ নেই। শুয়োর হয়ে গেছে সব। চোর হ্যাঁচরে ভরে গেছে দেশ। উমচরণ ভয়ে ভয়ে থাকে। দরজা-জানালা বন্ধ করে নিঃশব্দে চৌকির তলা থেকে টিনের বাক্সটা বের করে। কোমরের কাছে ধুতির ভেতর থেকে সুতোয় বাঁধা চাবি বের করে। বাক্সটা খোলে। তালা খুলতে একটু কষ্ট হয়, সময় লাগে। তবু বড় যত্নে তালাটা খোলে উমাচরণ। বাক্সের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস ন্যাপথলিনের গন্ধ নিয়ে লাফিয়ে ওঠে। ডাক্তারবাবুর কিছু পুরনো ধুতি পাঞ্জাবি ভঁই করে রাখা বাক্সে। এসবের তলা থেকে হাতড়ে হাতড়ে একটা ওষুধের কৌটো বের করে উমাচরণ। তারপর অকারণেই ঘরের ভেতরটা দেখে নেয়। চোখ চলে না, তবু দেখে। কাজটা যে সে করছে কেউ দেখছে। কিনা। পায়ের কাছ দিয়ে বাইত্তা দৌড়ে যায়। গলা চড়িয়ে ধুর ধুর করে উমাচরণ। পাটাতনে শব্দ করে। তারপর কৌটোটা খুলে জিভে আঙুল ভিজিয়ে অনেকক্ষণ ধরে টাকাটা গুণে দেখে। ঠিকঠাকই থাকে সব। তবু রোজ একবার করে গুণে দেখে উমাচরণ। কেন যেন মনে হয়, একদিন দেখবে বাক্সটার তালা ভাঙা, ভেতরের জিনিসপত্র ওলটপালট হয়ে আছে, টাকার কৌটোটা নেই।

উমাচরণ ভয়ে ভয়ে থাকে। কে জানে কখন কী অঘটন ঘটবে! কাল রাতে কমলকে স্বপ্নে দেখেছে। বৃষ্টির জলের ঝাপটায় ঘর ভিজে যাচ্ছে, বাইরে থেকে দরজাটা টেনে বন্ধ করতে চাইছে কমললতা, পারছে না। দুপুরবেলা খালপাড়ে স্নান করতে গিয়ে বনগোটাগাছের তলায় ছানিপরা চোখেও সাপের খোলস পড়ে থাকতে দেখল। হাওয়ায় এদিক ওদিক উড়ছে। এসবই অশুভ চিহ্ন। বড় ভয় করে উমাচরণের। অনুক্ষণ মন্ত্র পড়ার মতো বিড়বিড় করে বিপদ তাড়ায় সে, আলায় বালায় [বিপদ আপদ] দূর হ, দূর হ।

নিরন্নের কাল

পাকা ধানে রং কেমুন অয় বুবু?

সোনার লাহান, গেণ্ডাফুলের পাপড়ির লাহান।

ঘেরান অল না?

অয় না আবার! সাই ঘেরাই অয়। কাতি আগন মাসে ধান পাকলে ঘেরানে দেশ গেরাম ভইরা যায়। রম রম করে। ধানের ঘেরানে দেশগেরামের মানুষ যায় জোয়াইরা মাছের লাহান পাগল অইয়া।

পাগল অইয়া কী করে?

দিনরাইত ধানক্ষেতে পইড়া থাকে। গান গায় আর ধান কাড়ে। গান গায় আর ধানের বোজা আইন্না বাড়ির উড়ানে হালায়। ছোড গিরস্তরা হারাদিন ধান কাইট্টা হাইঞ্জাবেলায় বোঝা বাইন্দা বাড়িতে আনে। তারবাদে বিয়াইন্না রাইতে উইট্টা হেই ধান পাড়ায়। দুইআতে দুই খান চিকন বাঁশের লাডি লইয়া, পায়ের নিচে ছোড ছোড ধানের আডি, নাইচ্চা নাইচ্চা ধান পাড়ায়। বেইল উটতে না উটতে ধান পাড়ান শেষ। আগইল ভইরা, ছালা ভাইরা হেই ধান ঘরে রাইখা আবার যায় ধানক্ষেতে। আগের দিনে ছোড গিরস্তগো ক্ষেতের ধানও একদিনে কাডা অইত না।

আর বড় গিরস্তগো?

হেগ কতা আর কইস না। পুরা মাস লাইগা যাইত হেগ ধান কাড়া শেষ হইতে। শয়ে শয়ে মাইনষে কাইট্টাও মাসের আগে শেষ করতে পারত না। আর বড় গিরস্ত বাড়ির ধান তো মাইনষে পাড়াইয়া কুলাইতে পারত না গরু দিয়া মন দেওন লাগত।

তারবাদে?

তারবাদে হেই ধান ডোলে ভইরা গিরস্তরা হুইয়া বইয়া দিন কাডাইত গান গাইত আমোদ ফূর্তি করত আর তামুক টানত।

আমাগো ধানক্ষেত আছিল না বুবু? আমাগো কুনোদিন ধান অইত না?

অইত না আবার! কত ধান যে অইত! দীনুরে তুই কিচ্ছু দেখলি না। পোড়া কপাল লইয়া পয়দা হইছচ। তর জন্মের আগে, আমি তহন তর লাহান না, তর থিকা আরও ছোড অমু, কাউন্না বিলে ম্যালা ধানের জমিন আছিল বাজানের হেই জমিন আমি কুনদিন চোকে দেহি নাই বাজানের মুকে হুনছি। বাজানরে তখন দেকতাম বিয়াইন্না রাইতে ঘুম থিকা ওডে। উইট্টা এক বাসন পান্তা লইয়া বইত। হেয় পান্তা খাইত আর মায় নাইরকলের উক্কায় তামুক সাজত পান্তা খাইয়াই এক ছিলিম তামুক খাইত বাজানে। হেরবাদে মাজায় লাল গামছাখানা বাইন্দা ঘর থনে বাইর অইত যাইত বিলে। কাউন্না বিলে। যাওনের সময় মায় কইত, বেইল থাকতে আইয়া পইড় বুলবুলির বাপ। দেরি কইর না। বাজানে কইলাম আইত না। দোফরে সোনাদিগা চাউলের ভাত রাইন্দা, কাজলি মাছের ঝোল রাইন্দা মায় বইয়া থাকত। বাজানে হেই ভাত খাইত রাইত দোফরে আয়া।

কাজলি মাছ কেমুন বুবু?

হায়রে পোড়া কপাল। কাজলি মাছ তুই দেহচ নাই দীনু?

না বুবু।

কাজলি মাছ দেখতে পাবদা মাছের লাহান। তয় পাবদা মাছের লাহান বড় না চেপটা না। আরো ছোড আরো চিকন ফকফইক্কা সাদা। খাইতে বহুত স্বাদ! একখান মাছ দিয়া দুই বাসন ভাত খাইতে পারবি তুই।

এই কথা বলে বুলবুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে বুলবুলির চোখের ওপর ভেসে উঠল বাসন ভর্তি সাদা মুক্তোদানার মতো ফুরফুরে ভাত। বাটিভর্তি কাজলি মাছের ঝোল। রান্নাঘরে বসে বুলবুলি আর দীনু গাপুসগুপুস করে ভাত খাচ্ছে।

দৃশ্যটা দেখতে দেখতে বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করে ওঠল বুলবুলির। কতকাল অমন বাসনভর্তি ভাত দেখে না তারা! পেটপুরে ভাত খায় না! পেটপুরে ভাত খাওয়ার যে কী স্বাদ দীনু তা কোনওদিন জানলই না! জন্মে তো ধানের ক্ষেতই দেখল না। পাকা ধানের রং কেমন হয় জানলই না। অথচ দীনুর সাত আট বছর আগে জন্মে কত কী দেখেছে বুলবুলি! সুখের দিন ছিল তখন। বছরভর গোলা ভরা ধান থাকত বুলবুলিদের ঘরে। ঘরের কোণে বিশাল মটকা ভরা থাকত মণকে মণ সরু লালচে চাল। গোয়ালে ছিল দুধের গাই। ভোরবেলা দুধ দোয়ালে কাঁচা দুধের মিঠেল গন্ধে ভরে যেত বাড়ি। কী ঘন, কী স্বাদের দুধ। বাড়ির সঙ্গে ছোট্ট পুকুরটি ভরা থাকত মাছে। কই, শিং, শোল, গজার, মাগুর, ফলি,রয়না, কত পদের মাছ যে ছিল পুকুরে! এক দুবার ঝাঁকি জাল ফেললেই দুবেলার মাছের বন্দোবস্ত হয়ে যেত।

তখন কার্তিক-অঘ্রাণ মাসে খুব শীত পড়ত। একদিকে শীত আরেক দিকে পাকা ধানের ম ম করা গন্ধ। ভোরবেলা সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রোদের আঁচে গিয়ে বসলে কী যে আরাম হত! কী যে সুখের দিন মনে হত একেকটি দিনকে!

সেই সুখের দিন কি আর কখনও ফিরে আসবে!

দীনু বলল, বুবু খিদা লাগছে।

বুলবুলি একবার ভাইটির মুখের দিকে তাকাল। রোদে পোড়া ম্লান মুখে হাসল। খিদা লাগলে খিদার কথা মনে করতে অয়না মিয়াভাই।

বুবুর কথা শুনে দীনু খুবই অবাক হল। অনাহারী শীর্ণ চোখ তুলে বুলবুলির দিকে তাকাল। করুণ দুঃখী গলায় বলল, তয় কি করতে হয়?

বুলবুলির বুকের ভেতরটা আবার হু হু করে তার পেটেও তো খিদে। কেঁচোর দলার ওপর তীব্র রোদ পড়লে কেঁচোরা যেমন আকুলি-বিকুলি করে, বুলবুলির পেটের ভেতর নাড়িভুড়ি তেমন করছে। তীব্র রোদের মতো রাক্ষুসে এক খিদে ঢুকে আছে পেটের ভেতর। এই খিদে তাড়াবার উপায় বুলবুলির নেই।

দীনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুলবুলি বলল, খিদা লাগলে খালি অন্য কথা মনে করতে অয়।

শুনে দীনু বলল বুলবুলির মুখের দিকে তাকায় না, কথাও বলে না। ক্লান্ত পা ফেলে ফেলে দুঃখী ভঙ্গিতে হাঁটে।

মাঠময় এখন মেহেদি রঙের রোদ পড়ে আছে। শস্যহীন খাঁ খাঁ বিষণ্ণ মাঠ। তীব্র খরায় শস্যচারা ঘাস, আগাছা পুড়ে বিবর্ণ হলুদ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও নিশ্চিহ্ন। ঠনঠনে সাদা মাটি উজবুকের মতো পড়ে আছে। পাকা ধানের রং এবারও চোখে দেখবে না দেশ গেরামের মানুষ।

বুলবুলি বল, ল কামার বাড়ি যাই দীনু।

দীনু আনমনে বলল, ক্যা?

কামার বাড়ি গিয়া কচুর লতি তুইল্লা আনি।

পাওয়া যাইব?

যাইতে পারে।

মাইনষে তুইল্লা লইয়া যায় নাই।

বেবাক কি আর নিছে!

তারপর একটু থেমে বুলবুলি বলল, বিচরাইলে মনে অয় পাওয়া যাইব। ল।

দীনু ক্লান্ত এবং বিরক্তির গলায় বলল, আমার হাঁটতে ভাল্লাগে না।

ভাইটিকে বুলবুলি তারপর বেশ একটা লোভ দেখাল। কামার বাড়ি গয়া গাছ আছে দীনু।

ম্যালা গয়া গাছ আছে। ল যাই গয়া পাইলে দেখবি খাইতে কী আরাম!

বুলবুলির কথা শুনে দীনুর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। হাছা?

হ।

তয় লও বুবু। তাড়াতাড়ি লও।

অল্পবয়সী অনাহারী মানুষ দুটো তারপর মাঠ ভেঙে হাঁটতে থাকে।

দীনু বলল, বুবু মায় আইব কুসুম?

বুলবুলি একবার আকাশের দিকে তাকাল। ভিক্কা কিছু পাইলেই আইয়া পড়ব।

বাজানে?

বাজানে তো টাউনে গেছে। টাউনে কামকাইজ করব, তারবাদে চাউলের বস্তা কান্দে লইয়া ফিরা আইব।

চালের কথা শুনে কী যে খুশি হয় দীনু। চোখ দুটো আবার চকচক করে তার। হাছা?

বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে বুলবুলির। ময়লা নোংরা ছেঁড়া আঁচলে ঘষে ঘষে মুখ মোছে সে। আকাশের দিকে তাকায়। রোদও ওঠেছে! বেজায় রোদ। আকাশ ঝিমঝিম করছে। রোদে। মাথার ঘিলু পর্যন্ত টলমল করে। এই রোদে মা বেরিয়েছে ভিখ মাগতে। এ গাঁ ও –গাঁ ঘুরছে দুমুঠো চালের আশায়। এক মালসা ফেনের আশায়। বাপটা ঘুরছে শহরে রাস্তায় রাস্তায় কাজ খুঁজছে।

মা বাবার কথা ভেবে কী রকম এক কষ্ট যে হয় বুলবুলির! পেটের খিদে মুহূর্তের জন্যে ভুলে থাকে সে।

দীনু বলল, এখখান কিচ্ছা কও বুবু।

বুলবুলি চমকে ওঠে। কী কমু?

কিচ্ছা। কিচ্ছা কইতে কইতে হাঁটলে পথ তাড়াতাড়ি ফুরাইব। কোন ফাঁকে কামার বাড়ি যামুগা উদিস পামু না।

কিয়ের কিচ্ছা কমু?

ধানের কিচ্ছা কও বুবু। মাছের কিচ্ছা কও।

দীনুর কথা শুনে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুলবুলি। চোখ তুলে আরেকবার তাকায়। আকাশের দিকে। সূর্যমাখা নাড়ার পারার মতো জ্বলছে। কী তেজ! শীতকালের মাঠে, তুলে নেয়া ফসলের মাঠে খড়নাড়া স্কুপ করে সন্ধেবেলা আগুন ধরিয়ে দিত কৃষাণরা, রাতভর জ্বলত সেই আগুন। রাতেরবেলা সেই আগুনের তাপে উষ্ণ হয়ে থাকত দেশ গেরাম। অঘ্রাণ মাসের বাঘা শীত টের পেত না লোকে। সূর্যের তেজখানা এখন মনে হচ্ছে তীব্র শীতের রাতে মাঠময় জ্বলা খড়নাড়া। রোধের তাপখানা খড়নাড়ার উত্তাপের মতন।

ঘামে ঘাড়গলা চুটপুট করছে বুলবুলির। আঁচলে ঘষে ঘষে আবার ঘাড়গলা মোছে সে। দীনুর মুখটাও মুছিয়ে দেয়। বড় মাতায়, বড় ভালোবাসায়।

শাড়িখানা ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গেছে বুলবুলির। বাড়ন্ত শরীর এই শাড়িতে ঢাকা পড়ে না তবু যত্ন করে শরীরখানা ঢেকে রাখে বুলবুলি। পুরুষমানুষ দেখলে জড়োসড়ো হয়ে থাকে। মা শিখিয়েছে পুরুষজাত লোভীজাত। মেয়েমানুষের শরীর দেখলে মাথার ঘামে কুত্তা পাগল।

সামনে বিশাল একখানা মাঠ। শস্য নেই, ঘাস আগাছা নেই। মাঠের সাদা কঠিন মাটি চকচক করে। দুপুরবেলা দূর কোন প্রান্ত থেকে উড়ে আসে হু হু করা এক হাওয়া। রোদে সয়ে আসে বলে হাওয়ায় নেই শীতলতা। গা তো জুড়োয়ই না, উল্টো গরম। মাঠময় ঘুরে ঘুরে বয়ে যায় হাওয়াটি। ধুলোর চিকন একটি রেখা ওড়াউড়ি করে। দেখে কেমন আনমনা হয়ে যায় বুলবুলি। মাঠের ওপারে গাছপালায় অন্ধকার হয়ে থাকা কামার বাড়ি গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে ভাঙা দরদালান চোখে পড়ে। কামাররা এখানে কেউ নেই। পুরোনো পেশায় পেটের ভাত জোটে না দেখে গ্রাম ছেড়ে যার। যেদিকে সুবিধে চলে গেছে। বাড়িটা ছাড়া পড়ে আছে ম্যালা দিন। গাছপালা এবং আগাছায় জঙ্গল হয়ে আছে। জঙ্গলে কচুর লতি, মুখি এসব পাওয়া যায়। দেশগেরামের মানুষ সব লুটেপুটে নেয়। বুলবুলিও অনেকবার নিয়েছে। এখন আর পাওয়া যায় না। দেশে অনাহার। কচুর লতি, মুখি এ সব তো দূরের কথা, মাঠের পাশে অবহেলায় জন্মে থাকা সেচি শাকটা পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অনাহারী মানুষ সব তুলে নিচ্ছে।

বুলবুলি জানে কামার বাড়ির ঝোপজঙ্গল তন্ন তন্ন করেও কিছু পাওয়া যাবে না। তবু যাচ্ছে, দীনুর জন্যে যাচ্ছে।

দীনুটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। সকালবেলা মা ভিক্ষেয় বেরুতেই দীনু বলল, লও বুবু আমরাও যাই।

বুলবুলি ভিখ মাগতে যেতে পারে না। মার বারণ। বুলবুলির যে বয়স যে শরীর, ভিখ মাগতে গেলে বিপদে পড়বে। লোকে দুচার মুঠো চাল কিংবা আধলিটা সিকিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে দরজা আটকাবে। পুরুষজাত লোভীজাত।

মার মুখে পুরুষমানুষের এই স্বভাবের কথা শুনে বুলবুলি খুব ভয় পেয়েছে। বুকের ভেতরটা কেঁপেছে তার। না খেয়ে মরে গেলেও ভিখ মাগতে যাবে না বুলবুলি।

কিন্তু দীনু এসব বোঝে না তার এসব বোঝার কথা নয়। এই বয়সী বালক মেয়েমানুষের শরীরের জন্যে পুরুষমানুষের লোভের কী বুঝবে!

সকালবেলা দীনু বলেছে, লও বুবু আমরাও যাই।

শুনে ম্লান মুখে হেসেছে বুলবুলি। কই?

খরাত করতে।

মাইনষে পোলাপানগো খরাত দেয় না।

ক্যা?

কী জানি।

শুনে চুপ করে গেছে দীনু। মুখে ভারি দুঃখের একটা ছায়া পড়েছে তার।

তারপরই দীনুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বুলবুলি। বেরিয়ে গ্রামের এদিকওদিক হেঁটে সময় কাটিয়েছে। তারপর দুপুরে মুখে মুখে এসে দাঁড়িয়েছে মাঠের কিনারায়। দীনু বলল, কও না বুবু।

বুলবুলি চমকে ওঠল। কী কমু?

ধানের কিচ্ছা কও। ভাতের কিচ্ছা কও।

দুঃখী বিষণ্ণ চোখে একবার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায় বুলবুলি। ম্লান হাসে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাগো কাউন্না বিলের জমিনের ধান পাকত আগন মাসে। বাজানের মুখে হুনছি আগন মাসে বিলের কিনারে গিয়া খাড়াইলে দেহা যাইত চাইরদিকে খালি পাকা ধান, পাকা ধান। সোনার লাহান বরণ সেই ধানের। গেন্দাফুলের পাপড়ির লাহান বরণ। বিয়ানবেলা বিলে যহন রইদ পড়ত সেই রইদে বিলের পাকা ধান সোনার লাহান ঝকমক ঝকমক করত। বাতাস অইলে গাঙ্গের ঢেউয়ের লাহান দোল খাইত। বাজানে কইত বিলের কিনারে খাড়াইলে বুকটা তার ভইরা যায়। ফূর্তিতে আমুদে ভইরা যায়।

দীনু অবাক গলায় বলল, তারবাদে?

হেই পাকা ধান মুখে কইরা কাইটা নিত টিয়ায়, বাইয়ে। মাইট্টা ইন্দুরেও গদে ভইরা রাখত বচ্ছরের ধান। ধান কাডা অইয়া গেলে ইন্দুরের গদের ধান উড়াইয়া আনত গরিব মাইনষে। ইন্দুরের গদের ধানে তাগো দুই তিন মাসের খাওন অইয়া যাইত।

বুলবুলি একটু থামল। খিদেটা পেটের ভেতর এমন হয়েছে, কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কীরকম এক ক্লান্তি, অবসাদ। কিন্তু দীনু আছে সঙ্গে। কথা তো বলতেই হবে। কথা। বলে খিদে ভুলিয়ে রাখতে হবে দীনুর।

বুলবুলি বলল, বুঝলি দীনু, মাইট্টা ইন্দুরের গদে আবার সাপ গিয়া থাকত। জাইত সাপ, দাঁড়াইস সাপ। ধানের লেইগা গদে হাত দিলে সাপে কাটত। হাজামবাড়ির মজিদরে তো সাপেই কাটছিল।

দীনু বলল, কেমনে! কেমনে সাপে কাটল!

গেছিল ইন্দুরের গদ থিকা ধান উডাইতে। একছালা উডাইছে এমুন সুময় উদ্দিস পাইল হাতের বুইড়া আঙ্গুলে খাজুর কাড়ার লাহান কী একটা জানি বিনদা গেল। কী বিষ! গদ থিকা হাত আর উডাইতে পারে নাই মজিদ। ইন্দুরের গদের মদ্যে হাতখানা রইল, মজিদ গেল মইরা।

সাপের গল্প ভালো লাগল না দীনুর। সে বলল অন্য কথা। আমাগো ডোল আছিল বুবু? বুলবুলি বলল, কচ কী! আছিল না!

কয়ডা?

চাইর পাঁচটা আছিল।

মলনের গরু আছিল?

না হেইডা আছিল না। বাজানে চউরা কামলা লইয়া ধান কাইট্টা আনত। আইন্না উডানে। হালাইত। বিয়াইন্না রাইতে কামলারা গান গাইত আর ধান পাড়াইত। ছোড গিরস্থগো ধান পাড়াইয়াই লয়।

কামলারা কী গান গাইত?

ওই যে হেই গানডা। সোনার ধান কাইট্টা আনো, গোলায় তোলো। গান হুনলে আমার আর ঘুম আইত না। জাইগা থাকতাম। একখান পিড়ি লইয়া দরজার সামনে বইয়া থাকতাম।

চউরা কামলাগো ধান পাড়ান দেখতাম। গান হুনতাম।

চউরা কাগো কয় বুবু?

আগন মাসে পদ্মার চর থিকা শয়ে শয়ে মানুষ আইত দেশ গেরামে। হেগো কয় চউরা। আইত ধান কাটতে। যা ধান কাটত তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ পাইত হেরা। ধান কাটা শেষ অইলে হেই ধান বস্তায় ভইরা চউরারা চইলা যাইত। চউরারা বড় আমুদে মানুষ ভারি সোন্দর গান করত।

কোন ধানের চাউল ভালা বুবু?

সোনাদিগা ধান।

ভাতের স্বাদ কেমুন?

হেই কথা আর কইচ না ভাই!

তারপর একটু থেমে বুলবুলি বলল, কাঁচা নাইরকল খাইছচ?

দীনু বলল, না।

খাচ নাই! না খাইলে বুজবি কেমনে!

তুমি কও।

কাঁচা নাইরকলের যেমুন স্বাদ অয় হেমুন স্বাধ অয় সোনাদিগার ভাতে। তরকারি ছাড়া দুই তিন বাসন ভাত খাইয়া হালান যায়।

শুনে পেটের ভেতর কেমন করে দীনুর! খিদেটা মনে হয় সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। গলাটা শুকিয়ে মাঠের বাঁজা মাটি হয়ে গেছে।

দীনু একটা ঢোক গিলল। এইবার মাছের কিচ্ছা কও বুবু। দুধের কিচ্ছা কও।

কথা বলতে আর ভালো লাগছে না বুলবুলির। খিদেয় শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছে। হাঁটতে ভাল্লাগে না, কথা বলতে ভাল্লাগে না।

দীনুর ওপর কী রকম একটা বিরক্ত লাগছে। চারদিকের আলো হাওয়া মাটি কোনও কিছুই বাস্তব মনে হচ্ছে না। অতিরিক্ত খিদেয় নেশার মতো কী রকম একটা ঘোর তৈরি হয়েছে চোখে। তিনদিন কিছুই প্রায় খাওয়া হয়নি। পরশু দুপুরে ভিক্ষা মেগে একমুঠ চাল পেয়েছিল মা। সেই চালে জাউ বেঁধে খেয়েছে তিনজন মানুষ। তাতে পেটের এক কোণাও ভরেনি। তারপর থেকে টানা উপোস। শরীর থরথর করে কাঁপে বুলবুলির। পা চলতে চায় না।

কিন্তু এসব দীনুকে বুঝতে দেয়া যাবে না। সেইও তো বুলবুলির মতোই। অতটুকু ছেলে না খেয়ে কেমন করে যে এখনও বেঁচে আছে!

দীনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা জ্বলে যায় বুলবুলির। মরা মাছের মতো ফ্যাকাসে। হয়ে গেছে দীনুর মুখ। হাঁটছে, যেন প্রচণ্ড মার খাওয়া এক কুকুরছানা।

দীনুকে দেখে ভেতরে ভেতরে নিজেকে গুছিয়ে নেয় বুলবুলি। ভাইটিকে তার মাছের গল্প বলে। দুধের গল্প বলে। এক দুর্দান্ত সুখের দিন এসে দাঁড়ায় বুলবুলির চোখের সামনে। বাইষ্যাকালে তো দেশ গেরাম পানিতে ডুইবা যায়। খাল দিয়া পদ্মার গাং থিকা ঘোলা পানি আইয়া তো দেশগেরাম ভাসাইয়া দেয়। পানি থাকে তিন মাস। হেই তিন মাস মাছের আকাল অইত না। কত পদের যে মাছ! বাড়ির ঘাডা থিকা জালি দিয়া ম্যালা মাছ ধরত বাজানে। পাবদা টেংরা চটাচটা পুডি রয়না টাকি বাইল্লা, খাও কত মাছ খাইবা। কাতিমাসে পানিতে টান ধরত। তখন দুনিয়া ভইরা যাইত মাছে। বশ্যি হালাইলেই মাছ। জাল হালাইলেই মাছ। ফলি কাউন্না মাগুর আইর বোয়াল। বাজানে এক বিয়াইল মাছ ধরলে হেই মাছ আমরা তিন চাইর দিনে খাইয়া ছাড়াইতে পারতাম না। আর জিউল মাছ তো আছিলই। জিওল মাছ কারে কয় জানসনি দীনু?

দীনু মাথা নাড়ল। না।

যেই হগল মাছ ঘোপায় পানি ভইরা রাখন যায় হেই মাছরে কয় জিওল মাছ। কই শিং মাগুর।

বুজছি

জিওল মাছ পাওয়া যাইত শীতের দিনে। কচুরির মইদ্যে, পানির মইদ্যে যেই হগল জাগায় জঙ্গল অয় হেই হগল জাগায় পাওয়া যায় জিওল মাছ। বাজানে ডুবাইয়া ডুবাইয়া ধরত।

শীতের দিনে আমরা খালি জিওল মাছ খাইতাম। কী স্বাদ যে আছিল হেই মাছে!

এতক্ষণে মাঠটা শেষ হয়। কামার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় বুলবুলি আর দীনু। ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে সাপের মতো বাঁকা একটা পথ চলে গেছে বাড়ির ভেতর। ওরা দুজনে সেই পথে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়।

কিন্তু পুরো বাড়িটা দুতিনবার চষেও কিছুই পায় না ওরা। না দু-একটা কচুর লতি, না এক আধখানা মুখি। দীনু পাগলের মতো পেয়ারা গাছগুলো দেখে। এক আধটা কড়া পেয়ারাও নেই।

দীনু হতাশ গলায় বলল, কই লইয়াইলা বুবু। কিচ্ছু নাই তো!

বুলবুলি বলল, কী করুম ক। মাইনষে বেবাক কিছু খাইয়া হালাইছে।

তারপর হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনে দিকটায় চলে আসে ওরা। বাজারের দিককার বড় সড়কটা চলে গেছে কামার বাড়ির পেছন দিয়ে। সেখানে বাড়ির মুখে একটা দেবদারু গাছ। বহুকালের পুরোনো গাছ। মাথায় ঘন ডালপালা বলে দিনমান তলায় পড়ে থাকে মিঠেল একখানা ছায়া। ক্লান্ত বাজারীরা কখনও কখনও জিরোতে বসে দেবদারুতলায়। মাঠ ছাড়া দু-একটা গরুছাগল এসে অলস ভঙ্গিতে বসে জাবর কাটে। দেবদারুর ডালে বসে থাকে কাক, শালিক।

দীনুকে নিয়ে দেবদারু তলায় চলে এল বুলবুলি। পা আর চলতে চাইছে না। একটু জিরোবে। কিন্তু দেবদারু তলায় একটি লোক বসে আছে। বসে আরামসে বিড়ি কুঁকছে। গায়ে নীল একখানা পিরান তার। সেই পিরানের ওপর গলার কাছে বাঁধা লাল টকটকে রুমাল।

বুলবুলি এবং দীনুর পায়ের শব্দে চমকে মুখ ফেরাল লোকটি। সঙ্গে সঙ্গে বুলবুলি দেখতে পেল মুখভর্তি কুৎসিত বসন্তের দাগ তার। রোদেপোড়া তামাটে চেহারা। মাথার কদমছাটি চুল আর মুখ দেখে বোঝা যায় বহুঘাটের জল খাওয়া লোক সে।

বুলবুলিকে দেখেই হা করে, কী রকম চোখে যেন তাকাল লোকটি। তাকিয়ে রইল। চোখে পলক পড়ে না। দেখে শরীরের খুব ভেতরে অদ্ভুত এক কাঁপন লাগল বুলবুলির। দরকার নেই তবু বুকে আঁচল টানল সে। কেমন জড়োসড়ো হয়ে গেলে।

লোকটির পায়ের কাছে খুবই অবহেলায় পড়ে আছে মুখ বাধা বিশাল ভারি একটি বস্তা। সেই বস্তা দেখে চোখ দুটো চকচক করে উঠল বুলবুলির। লোকটির চোখে দেখে শরীরের খুব ভেতরে যে কাঁপনটা লেগেছিল মুহূর্তে কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল সেই কাঁপন।

বস্তার ভেতর কি আছে।

চাল!

বুলবুলির মতো দীনুও তাকিয়ে ছিল বস্তাটির দিকে। দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসল লোকটি। বলল, বস্তা ভরা চাউল, বাজলা। শিমইল্লা বাজার লুট অইল তো, এক বস্তা মাথায় লইয়া আইয়া পড়লাম।

শুনে অবাক হয়ে লোকটির মুখের দিকে তাকায় বুলবুলি। ভাবে, চাইব নাকি দুমুঠো চাল। এত বড় এক বস্তা চাল। চাইলে কি দুমুঠো দেবে না লোকটি!

বুলবুলির মুখ দেখে লোকটি কী বুঝল কে জানে, বুলবুলির সঙ্গে কোনও কথা বলল না সে। হাত ইশারায় দীনুকে ডাকল, আস, আমার কাছে আস খোকা।

দীনু একবার বুলবুলির দিকে তাকাল। তারপর পায়ে পায়ে লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কি কন? তোমার নাম কি?

দীনু।

বইনের নাম?

বুলবুলি।

লোকটি আবার বুলবুলির দিকে তাকাল। হাসল। বাহবা, বুলবুলি। বুলবুলি পাখি। ভারি সোন্দর নাম!

সেই ফাঁকে বুলবুলি দেখতে পেল লোকটির মুখের দাঁত পোকায় খাওয়া। নোংরা। হাসলে কুৎসিত দেখায়।

লোকটি তখন পিরানের পকেট থেকে চকচকে একটা সিকি বের করেছে। করে দীনুর চোখের সামনে তুলে ধরেছে। এইডা নিবা দীনু। নেও। নিয়া সোজা বাজারে যাও বিসকুট খাইয়া আস। চোখের সামনে চার আনা পয়সা দেখে দীনু একদম পাগল হয়ে। যায়। চার আনায় অনেকগুলো বিসকুট পাওয়া যাবে। খেয়ে বাজারের চাপকল থেকে পানি খেলে পেট এমন ভরা ভরবে, চার দিন আর খিদে লাগবে না।

ছোঁ মেরে পয়সাটা নিল দীনু। তারপর বাজারের দিকে এমন একটা দৌড় দিল, বুলবুলি কিছু বলার আগেই বহুদূর চলে গেল।

দীনু চলে যেতেই বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলল লোকটি। তারপর বুলবুলির দিকে তাকিয়ে হাসল। বুলবুলি পাখি, চাইল নিবানি?

শুনে বুলবুলির অবস্থা হল দীনুর মতো। এমন একটা আনন্দের ঢেউ ওঠল শরীরে। চোখের ওপর বুলবুলি দেখতে পেল লোকটির দেয়া চালে হাঁড়িভরা ভাত রান্না হয়েছে। মুক্তোদানার মতো ফুরফুরে সাদা ভাত। মা সে আর দীনু বাসন ভর্তি করে ভাত খাচ্ছে। লোকটি ততক্ষণে ওঠে দাঁড়িয়েছে। বুলবুলির একটা হাত ধরেছে। দিমু ম্যালা চাইল দিমু। আস।

বুলবুলিকে জঙ্গলের দিকে টেনে নেয় লোকটি। বুলবুলি কথা বলে না। বাধা দেয় না। চোখ জুড়ে তার তখন বাসন ভর্তি ভাতের স্বপ্ন।

.

চড়ুই পাখির মতো লাফাতে লাফাতে ফিরে এল দীনু। বাজারের মুদি দোকান থেকে চার। আনার বিসকুট কিনে খেয়েছে। তারপর আজলা ভরে পানি খেয়েছে চাপকল থেকে। পেট একদম ভরে গেছে। পেট ভরা থাকলে মনে বেদম ফূর্তি আসে মানুষের। দীনু এখন তেমন স্ফুর্তিতে আছে।

হাঁটুতে মাথা গুঁজে গাছতলায় বসেছিল বুলবুলি। আঁচলে দুআড়াইসের পরিমাণ চাল। চালটা বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রেখেছে সে।

দীনুকে দেখেই ওঠে দাঁড়াল বুলবুলি। খিদের চেয়েও বড় কোনও যন্ত্রণায় তখন ধুকছে সে। চোখে মুখে অদ্ভুত এক কষ্টের ছাপ।

কিন্তু দীনু ওসব খেয়াল করে না। বুবুর আঁচলে চাল দেখে খুশিতে পাগল হয়ে যায় সে। উচ্ছ্বাসের গলায় বলল, হেয় তোমারে চাইল দিছে বুবু?

বুলবুলি ক্লান্ত গলায় বলল, হ.

ইস আইজ তাইলে পেড ভইরা ভাত খাওন যাইব।

হ। ল বাইত যাই।

ঠিক তখুনি দীনু দেখতে পেল বুলবুলির পেছন দিকে ছেঁড়াখোঁড়া মলিন শাড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। দেখে চমকে উঠল সে। বুবু তোমার কাপড়ে দিহি রক্ত! এত রক্ত বাইর অইল কেমনে!

বুলবুলির বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। উদাস দুঃখি গলায় বলল, একবার ধান কাটতে গিয়া বাও হাতের লউঙ কাইট্টা হালাইছিল বাজানে। ম্যালা রক্ত বাইর অইছিল। দেইখা মায় কইল ধানক্ষেতে রক্ত দিয়া আইলানি। হুইনা বাজানে কইছিল, পেড ভইরা ভাত খাইতে অইলে রক্ত তো ইট্টু দেওন লাগবই। আমিও আইজ পেড ভইরা বাত খাইওনের লেইগা রক্ত দিছি। এইডি হেই রক্ত। বাজানে দিছিল লউঙ কাইট্টা আমি দিছি অন্য জিনিস কাইট্টা।

কথা বলতে বলতে জলে চোখ ভরে এল বুলবুলির।

নেতা যে রাতে নিহত হলেন

পুলিশ অফিসারটি বেশ মার্জিত ধরনের। চেয়ারে গা এলিয়ে খুবই আয়েশি ভঙ্গিতে সিগ্রেট টানছিলেন তিনি। টেবিলের সামনে দুজন সাধারণ পুলিশের সঙ্গে অত্যন্ত নিরীহ, গোবেচারা, গ্রাম্য লোকটিকে দেখে চোখ তুলে তাকালেন। কিন্তু বসার ভঙ্গিটি বদলালেন না। সিগ্রেটে টান দিয়ে বললেন, কি, ঘটনা কি?

দুজন পুলিশের একজন বলল, আমার খুব সন্দেহ হচ্ছিল।

অপরজন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমারও স্যার। লোকটির চাল-চলন আচার-আচরণ খুবই সন্দেহজনক। নেতার বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল সে।

নেতার কথা শুনে পুলিশ অফিসারটি বেশ ধাক্কা খেলেন। গা এলানো ভাবটা মুহূর্তে কেটে গেল তার। চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন তিনি। টেবিলের ওপর, হাতের কাছে ছিলো তাঁর পুলিশি টুপি। টুপিটা নিয়ে যত্ন করে মাথায় পরলেন। যেন এইমাত্র দায়িত্বে বহাল হলেন। এতক্ষণ যেন ছুটি কাটাচ্ছিলেন।

হাতের সিগ্রেট এসট্রেতে গুঁজে দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখ তুলে লোকটির দিকে তাকালেন অফিসার। আকাশি রঙের ঝুল পকেটঅলা শার্ট পরা। ডোরাকাটা লুঙি বেশ খানিকটা উঁচু করে পরেছে। যেন নিচু করে পরলে ধুলোময়লা লেগে যাবে। লোকটির খালি পা এবং মুখের রঙ প্রায় একই রকম। রোদে পোড়া, নিরেট কালো। মাথার ঘন কালো চুল কদমছাট দেয়া। দাড়িগোঁফ দু একদিন আগে কামিয়েছে। থানার ভেতরকার উজ্জ্বল আলোয় অফিসার দেখতে পেলেন, লোকটির গালের শক্ত চামড়া ভেদ করে ধারালো দাড়িগোঁফ মাথাচাড়া দিচ্ছে।

লোকটির ঠোঁট খুব পুরু। নাক থ্যাবরা। পরিশ্রমী, পেশিবহুল শরীর। কিন্তু চোখ দুটি বেশ কৌতূহলী। বুকের কাছে জীর্ণ কাপড়ের একটি পুঁটলি শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রেখেছে সে।

অফিসার গম্ভীর গলায় বললেন, নাম কী?

প্রশ্নটি কাকে করা হয়েছে বুঝতে পারল না লোকটি। সঙ্গের পুলিশ দুজনের দিকে তাকাল সে।

একজন বলল, আমাদের নয়, তোমার নাম জানতে চেয়েছে।

অপরজন বলল, আমাদের নাম স্যারে জানেন। তোমার নাম বল।

লোকটি সামান্য গলা খাকারি দিল। তারপর অমায়িক মুখ করে বলল, আমার নাম সাহেব রতন। রতন মাঝি।

কি কর?

দুজন পুলিশের একজনের স্বভাব হচ্ছে কথা একটু বেশি বলা। আসলে অফিসারকে তোয়াজ করা। সে হাসি হাসি মুখ করে বলল, নামের শেষে যখন মাঝি আছে নিশ্চয় নৌকা বায় স্যার।

সঙ্গে সঙ্গে রতন নামের লোকটি হা হা করে উঠল। না না সাহেব, না, নৌকা বাইনা। নৌকার মাঝি না আমি। আমার বাবা-দাদায় আছিল মাঝি। সেই থেকে আমাদের পদবি হয়েছে মাঝি।

অফিসার আগের মতোই গম্ভীর গলায় বললেন, তাহলে কি কর তুমি?

রতন বলল, আমি সাহেব ভাগচাষী।

বেশি কথা বলা পুলিশটি বলল, চাষী বুঝি। কিন্তু ভাগচাষী তো বুঝি না। ভাগচাষী জিনিসটা কি!

অফিসার এবার রেগে গেলেন, আঙুল তুলে বললেন, তুমি চুপ কর। আমি যতক্ষণ কথা বলব আমার সামনে একটিও কথা বলবে না। একদম পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

আবার কথা। তোমাকে না বললাম একদম চুপ। একদম পাথর।

লোকটি যেন সত্যি সত্যি পাথর হয়ে গেল।

অফিসার আবার রতনের দিকে তাকালেন, বল।

রতন বলল, কি বলব সাহেব?

কি কর তুমি?

ওই যে বললাম, ভাগ চাষী। নিজের জমি নাই। পরের জমি আধাআধি ভাগে চাষ করি।

বাড়ি কোথায়?

তা অনেক দূর সাহেব। পদ্মার ওপার দিয়ে তিন চার ঘণ্টা একটানা হাঁটতে হয়। গ্রামের নাম উদয়পুর।

এখানে এলে কি করে?

এখানে তো সাহেব আপনার লোকজন ধরে নিয়ে এল।

অফিসার বেশ বিরক্ত হলেন। কিন্তু তার স্বভাব হচ্ছে একটু একটু করে অনেকক্ষণ ধরে রাগেন। তারপর এক সময় ফেটে পড়েন। রাগের প্রাথমিক পর্যায়টা শুরু হয়ে গেছে। গম্ভীর গলায় অফিসার বললেন, এখানে মানে আমি শহরের কথা বলেছি।

রতন সরল ভঙ্গিতে হাসল। শহরে সাহেব লঞ্চে করে এসেছি। পদ্মার পার থেকে সকালবেলা চড়েছি, শেষ বিকালে শহরে এসে নামলাম। বাড়ি থেকে বেরিয়েছি কাল দুপুররাতে। ওই যে বললাম, তিন চার ঘণ্টা হেঁটে নদীতীর, তবে লঞ্চঘাট।

তুমি কি কথা একটু বেশি বল?

রতন খুবই লজ্জা পেল। জ্বি না সাহেব। আপনে জিজ্ঞেস করলেন তাই বললাম।

শহরে তুমি আগে কখনও এসেছ?

জ্বে না।

এই প্রথম?

জ্বে!

কেন এসেছ?

বললে সাহেব আপনে অন্য কিছু ভাববেন না তো!

বল, তবে সত্য কথা বলবে। মিথ্যে বললে কঠিন শাস্তি হবে।

আমি সাহেব নেতাকে দেখতে আসছি।

অফিসার চমকে ওঠলেন। পাথর হয়ে থাকা সেই দুজন পুলিশ এই প্রথম মুখ ঘুরিয়ে দুজন দুজনার চোখের দিকে তাকাল। তারপর আগের ভঙ্গিতে ফিরে আবার পাথর হয়ে গেল।

অফিসার নড়েচড়ে ওঠলেন। নেতাকে দেখতে এসেছ মানে কি? নেতাকে তুমি চেনো? নেতা তোমাকে চেনেন?

রতন অমায়িক মুখ করে বলল, নেতাকে কে না চেনে সাহেব! তারে চিনব না এ হয় নাকি। নেতাও তো দেশের সব মানুষকেই চেনেন। মুখখানা দেখলে আমাকেও চিনবেন। আমিও তো দেশের মানুষ।

তুমি যে নেতার বাড়ির পাশে ঘুরঘুর করছিলে, বাড়ি তুমি চিনলে কি করে?

লঞ্চ থেকে নেমে লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে চলে গেছি। ম্যালা রাত হয়ে গেছে। এত রাতে তো নেতাকে আর দেখতে পাব না। ভাবছিলাম তার বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে থাকব। দিনের বেলা তিনি যখন বেরুবেন দুচোখ ভরে তাঁকে একবার দেখব। পোটলাটা নামিয়ে রাখব তাঁর পায়ের কাছে।

অফিসার হাসলেন। মাথায় ছিট আছে তোমার?

জ্বে না সাহেব।

পোটলায় কি?

চিরে। খুব ভালো চিরে সাহেব। বাড়ির নামায় এক চিলতে জায়গায় কালিজিরে ধান হয়েছিল। খুব অল্প হয়েছিল। পোনে দুসেরের মতো চিরে হয়েছে। চিরেটা সাহেব নেতার জন্যে নিয়ে এসেছি। নেতা একমুঠ মুখে দিলে জীবন ধন্য হয়ে যাবে আমার। আমি সাহেব নেতাকে বড় ভালোবাসি। গরীবের ভালোবাসা। নেতাকে কেমন করে জানাব। ম্যালা দিনের স্বপ্ন ছিল তাঁরে একবার সামনাসামনি দেখব। পায়ের কাছে চিরের পোটলাটা নামিয়ে রেখে পা দুখানা একবার ছুঁয়ে দেখব।

রতন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে আর হল কই! আপনার লোকজন ধরে নিয়ে এল। ঠিকই করেছে। তুমি আসলে বদমাস।

জ্বে!

হা তুমি বদ মতলবে নেতার বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করছিলে। এতক্ষণ ধরে যা বললে সবই মিথ্যে। বানোয়াট। তোমার মতো লোকের এত পয়সা ব্যয় করে, এত পরিশ্রম করে, এতদূর শুধু নেতাকে একপলক দেখতে আসার কথা নয়। অতগুলো চিরে বিক্রি। করলে ভালো পয়সা পেতে তুমি। তুমি এসেছ নিশ্চয় অন্য কোনও মতলবে। ভালোবাসা দেখাতে নয়।

এতক্ষণের হাসিমুখটা মুহূর্তে চূর্ণ হয়ে গেল রতনের। একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গেল সে। কাতর গলায় বলল, না সাহেব না। আমি একটাও মিথ্যা কথা বলি নাই। আমরা মিথ্যা কথা বলি না। মানুষ গরিব হতে পারি সাহেব কিন্তু আমাদের ভালোবাসাটা খাঁটি। আমাদের মতো গরিব মানুষরাই নেতাকে বেশি ভালোবাসে সাহেব। আল্লার কসম খেয়ে বলছি আমি নেতাকে দেখতে আসছি। এ আমার ম্যালা দিনের স্বপ্ন। আপনে বিশ্বাস করেন।

একটু একটু করে অনেকক্ষণ ধরে জমে ওঠা রাগটা এবার ফাটল অফিসারের। প্রচণ্ড রেগে একটা ধমক দিলেন তিনি। চোপ। সেই ধমকে রতন তো বটেই পাথর হয়ে থাকা পুলিশ দুজনও কেঁপে ওঠলো। পুলিশ দুজনের দিকে তাকিয়ে অফিসার বললেন, পোটলাটা নাও। খুলে দেখ ভেতরে কী আছে।

সঙ্গে সঙ্গে রতনের বুক থেকে চিড়ের পোটলাটা ছিনিয়ে নিল একজন। থানার মেঝেতে ফেলে পোটলাটা খুলল। চিড়েগুলো ছড়িয়ে গেলো চারদিকে। চিড়ের তাজা, মিষ্টি একটা গন্ধে থানার গুমোট পরিবেশ কী রকম ম ম করে ওঠল।

অফিসারের কথা শুনে রতনের মনে হল, প্রচণ্ড খরায় চষা জমির মাটির ঢেলা যখন পাথরের মতো হয়ে ওঠে, সেই ডেলা ভাঙবার জন্যে চাষী যে ইটামুগুর ব্যবহার করে, সে রকম একটি ইটামুগুর দিয়ে হঠাৎ করেই কেউ তার বুকে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করেছে। ও রকম আঘাতে দম বন্ধ হয়ে যায় মানুষের। চোখ ঠিকরে বেরোয়। মানুষ কোনও শব্দ করতে পারে না।

রতনও কোনও শব্দ করতে পারল না।

অফিসার বললেন, এই চিড়ে কেমিক্যাল টেস্টে পাঠাও আর বদমাসটাকে লকআপে ভরো।

বেশি কথা বলা পুলিশটি বলল, একটা কথা বলব স্যার।

অফিসার রাগী চোখে তাকালেন। কি?

চিরের গন্ধটা বড় ভালো।

তাতে কি হয়েছে?

বলছিলাম কি একটু মুখে দিয়ে দেখব?

অফিসার প্রচণ্ড রাগলেন। যদি তোমার কোনও একসিডেন্ট হয়। যা বললাম তাই কর। টেস্টে পাঠাও।

রতন তারপর আর একটিও কথা বলেনি। একেবারেই পাথর হয়ে গিয়েছিল। থানা হাজতের দেয়ালে হেলান দিয়ে সারারাত বসে থেকেছে। একজন টহলদার পুলিশ পাঁচ মিনিট পর পর গরাদের সামনে দিয়ে টহল দিয়ে গেছে। রতন তার দিকে ফিরেও তাকায়নি।

ভোরবেলা কীরকম একটা গুঞ্জন ওঠল থানায়। কীরকম একটা ছুটোছুটি। চাপা ফিসফাস। খানিকপর সেই দুজন পুলিশ এসে লকআপ খুলল। রতন মাঝি, বেরোও।

কথা বেশি বলা পুলিশটির প্যান্টের দু পকেট বেশ ফোলা।

রতন নিঃশব্দে লকআপ থেকে বেরোল। পুলিশ দুজন ঠেলে তাকে এনে দাঁড় করাল সেই অফিসারের সামনে।

অফিসার কী রকম দুঃখী মুখ করে চেয়ারে বসে আছেন। চোখে উদাসীনতা কিংবা অন্য কিছু।

রতনকে দেখে চোখ তুলে তাকালেন তিনি। গভীর দুঃখের গলায় বললেন, নেতা কাল রাতে নিহত হয়েছেন। আমরা খবর পেয়েছি তার খুব ঘনিষ্ঠ লোকজন, নেতার আদর্শে বিশ্বাসী, একই রাজনীতি দীর্ঘদিন করেছে তারা ষড়যন্ত্র করে নেতাকে হত্যা করেছে। তোমার ওপর আমি অবিচার করেছি ভাই। যাও বাড়ি যাও তুমি।

বেশি কথা বলা পুলিশটি তখন তার প্যান্টের পকেট থেকে চিড়ে বের করে অবিরাম মুখে পুরছে। রতন বুঝে গেল এই সেই চিড়ে। ভালোবেসে বহুদূর থেকে নেতার জন্যে নিয়ে এসেছিল সে। কালিজিরা ধান কত যে যত্নে বুনেছিল বাড়ির নামায়। সেই ধান শুকিয়ে কত যে যত্নে চিড়েটা কুটে দিয়েছিল তার কৃষাণী!

এসব ভেবে চোখ ভরে আসার কথা রতনের। কিন্তু হল তার উল্টো। চোখ দুটো কী রকম জ্বলে উঠল তার। অফিসারের দিকে তাকিয়ে শীতল গম্ভীর গলায় রতন বলল, আমাকে ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না সাহেব। আমাকে হাজতেই রাখুন। ছেড়ে দিলে নেতা হত্যার প্রতিশোধ নেব আমি।

পাগল সাহেব

বাগানের গাছপালায় বিকেল শেষ হয়ে আসছে দেখে এসডিও সাহেব একটু বিরক্ত হন। শ্রীনাথ হারামজাদা গেল কোথায়? বিকেল পড়ে গেল, এখনও আসছে না কেন? শ্মশানখোলায় গিয়ে একা একাই চিতায় ওঠল নাকি!

কারো ওপর রেগে গেলে সাহেব একটু ঘন ঘন সিগ্রেট খান। আর চা। খালি কাপেও অনেক সময় চুমুক দিয়ে ফেলেন। অন্যমনস্কতা। এই যেমন এখন। আনমনে হেঁটে হেঁটে টেবিলটার সামনে যান সাহেব। বিকেলবেলা, শীতকাল গরমকাল নেই সাহেবের একটু বাগানে বসার অভ্যেস বলে, বেতের গোলটেবিল আর একটা চেয়ার চিরকালের জন্য পাতা আছে বাগানে। বিকেলবেলা চাকর আবদুল কাদের চিনেমাটির কেটলি ভর্তি চা, একটা কাপ আর সিগ্রেট-ম্যাচ রেখে যায়। একা বাগানে, গাছপালার ছায়ায় ফুলের গন্ধে আর মফঃস্বল শহরের পুরোনো হাওয়ায় বসে চা খেতে, সিগ্রেট খেতে সাহেব খুব পছন্দ করেন। তার পরনে তখন আশি সুতোর মিহি লুঙি, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি।

এই দেখে প্রথম প্রথম স্ত্রী খুব আপত্তি করতেন। তুমি এই শহরের এসডিও। বড় সাহেব। সবাই তোমাকে চেনে, শ্রদ্ধাভক্তি করে। বিকেলবেলা তুমি যে লুঙিগেঞ্জি পরে বাগানে বস, বাড়ির পাশ দিয়ে সারা শহরের লোকজনের চলাচল, তারা দেখে কী ভাবে বলো তো!

শুনে সাহেব তাঁর মোটা কাঁচের চশমা নাকের ওপর একটুখানি ঠেলে দেন। তারপর ডানদিকের জ্বতে ছোট বড় তিনটে গিঁট ফেলে বললেন, কী ভাবে?

স্ত্রী বুঝতে পারেন, সাহেব রেগে গেছেন। রেগে গেলে তার ডানদিকের জতে ছোট বড় তিনটে গিঁট পড়ে। গলার স্বর অচেনা হয়ে যায়।

স্ত্রী আর কথা বলেন না। সাহেব বললেন, যতক্ষণ কাছারিতে থাকি, আমি ততক্ষণ এসডিও। বাইরে আমি একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি। লোকের ভাবাভাবিতে আমার কিছু এসে যায় না। এসডিও হয়েছি বলে, নিজের বাড়িতেও কি আমি আমার প্রিয় অভ্যেসগুলো পালন করতে পারব না! তাছাড়া লুঙি পরে, বিকেলবেলা একা একা বাগানে বসে চা সিগ্রেট খাওয়ার সুখ আমি ছাড়া কে বোঝে।

প্রথম প্রথম স্ত্রী দুএকদিন তার সঙ্গে বাগানে গিয়ে বসেছেন। কিন্তু বসেই টের পেয়েছেন সাহেব তার উপস্থিতি পছন্দ করেন না, কিন্তু সাহেব মুখে কিছুই বলেননি। মেয়েমানুষেরা চিরকালই মেয়েমানুষ বলে এসব ব্যাপার বুঝতে পারে। সাহেবের স্ত্রীও বুঝতে পেরেছিলেন। তারপর আর কখনো যাননি। বিকেলবেলা দোতলার রেলিঙে দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যে স্বামীকে দেখেন। একাকী বাগানে বসে আছে কিংবা পায়চারি করছে, চা সিগ্রেট খাচ্ছে। এতকালের চেনা লোকটাকে তখন যে কী অচেনা মনে হয়! এই লোকটাই তাঁর সন্তানের পিতা। বিকেলবেলা রেলিঙে দাঁড়িয়ে প্রায়ই তার এই কথাটা মনে হয়।

এই শহরে আসার কিছুদিন পরে, স্কুল থেকে ফিরে মেয়ে রাণী একদিন বলল, মা জানো বাবা কী করেছেন?

কী?

পেশকার সাহেব তাঁর মেয়েকে নাটকে পার্ট করতে দেবেন না বলে বাবা নাকি তাঁকে খুব বকেছেন। এই নিয়ে স্কুলের মেয়েরা, আপারা খুব হাসাহাসি করেছে আজ। দু একজনকে বলতে শুনলাম, এসডিও সাহেবের মাথায় ছিট আছে।

রাতেরবেলা কথাটা বলতেই এসডিও সাহেব রেগে গেলেন। ডানদিকের জাতে তিনটে গিঁট ফেলে বললেন, মেয়েটার পার্ট করার খুব ইচ্ছে, বুঝেছ। স্কুলে কয়েকবার করেছেও। একবার নাকি বেগম রোকেয়ার চরিত্রে চমৎকার পার্ট করেছিল। তাছাড়া নীলকণ্ঠবাবুরা এবার যে নাটকটা করছে, তার নায়িকার পার্ট ঐ মেয়ে ছাড়া আর কাউকে দিয়ে হবে না।

স্ত্রী গম্ভীর গলায় বললেন, হোক না হোক তাতে তোমার কী?

এ কথায় সাহেব ভীষণ অবাক হয়ে যান। কী বলছ, আমি তো নীলকণ্ঠবাবুদের উপদেষ্টা। ওদের নাটকটি যাতে ভালোভাবে হয়, তা আমি দেখব না! তাছাড়া মেয়েটার যদি উৎসাহ না থাকত তাহলে অন্য কথা। ওর ইচ্ছে তো ষোলোআনা। নীলকণ্ঠবাবু বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছে। বলেছে, বাবাকে বলবেন। কিন্তু পেশকার সাহেবকে বলায়, তিনি পারলে নীলকণ্ঠবাবুকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদেয় করেন। তখন বাধ্য হয়েই আমি—

এসডিও সাহেব একটু থামেন। তারপর কথা নেই বার্তা নেই হো হো করে হেসে ওঠেন। বুঝলে, পেশকার সাহেবকে কীরকম ম্যানেজ করলাম। লোকটার ঘুষফুষ খাওয়ার অভ্যেস। আমি এখানে আসার পরপরই কিছু কাগজপত্র হাতে এসেছে। প্রমাণাদি। সেগুলো হাতে নিয়ে ধীর গলায় বললাম, পেশকার সাহেব চাকরিটা করার ইচ্ছে থাকলে আজ থেকে মেয়েকে রিহার্সেলে পাঠিয়ে দেবেন।

তারপর আবার সেই হাসি। প্রাণখোলা। দেখে স্ত্রী সেই মুহূর্তে আরেকবার ভেবেছেন, সত্যি কি এই লোকটা তার সন্তানের পিতা!

সেই নাটকের টাকা-পয়সাও জোগাড় করে দিয়েছিলেন এসডিও সাহেব। কোর্ট থেকেই টাকা উঠেছিল বেশি। যাকে যাকে জামিন দিয়েছেন, তাদের উকিলদের বলেছেন, জামিন দিলাম। কিন্তু একটা কথা আছে আমার। নীলকণ্ঠবাবুদের নাটকে পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দেবেন।

সেই নাটক স্ত্রীকন্যা নিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন এসডিও সাহেব। মফঃস্বল শহরের নাটক ইত্যাদি শুরু হয় রাত আটটার পর। চলে রাত একটা দুটো অব্দি। এই ব্যাপারটা স্ত্রীর খুব অপছন্দ। তিনি যেতে চাননি। বলেছিলেন, রাণীকে নিয়ে তুমি যাও।

শুনে সাহেবের ডান ভ্রূতে সেই তিনটে ছোটবড় গিঁট। দেখে স্ত্রী আর আপত্তি করেননি। কিন্তু এই লোকের সঙ্গে কে যায় নাটকফাটক দেখতে। মফঃস্বল শহরের ওই নাটক, ছেলেপানদের পার্ট, তাই দেখে কী খুশি সাহেব! তিন চারটে সিন রিপিট করিয়েছেন। নাটক চলছে, একটা সিন শেষ হয়েছে, সামনের সারি থেকে অমনি চেঁচিয়ে উঠলেন সাহেব, আহা এই সিনটা বড় চমৎকার হয়েছে। রিপিট করো।

আবার শুরু হল পুরোনো সিন। এইভাবে তিন চারবার। দেখে পাবলিক তো বিরক্ত হয়েছেই, স্ত্রী কন্যাও কম হয়নি। কিন্তু কারও কিছু বলার নেই।

এই তো গেল এক উৎপাত। সবচে বাজে ব্যাপারটা ছিল, হাতে একটা বেত নিয়ে বসেছিলেন সাহেব। মঞ্চের সামনে, মেঝেতে বাচ্চাকাচ্চারা বসেছিল। অকারণে তারা তো চেঁচামেচি করবেই। আর তাতেই সাহেবের মাথা গরম। প্রায়ই বেত হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন। দুচার ঘা লাগিয়ে দেন। তখন তাকে দেখায় পাঠশালার পণ্ডিত মশায়দের মতো। ওই শ্রেণীর লোকদের স্ত্রীর খুব অপছন্দ।

তারপরও মাসে মাসে নাটক হয় শহরে। সাহেব হলেন বড় উদ্যোক্তা। প্রায়ই রিহার্সেল দেখতে যান। চাঁদাফাদা তুলে দেন। আর নাটকের দিন তো তিনিই সব। কিন্তু স্ত্রী আর যান না। কোনও না কোনও অছিলায় বাড়ি থাকেন। কষ্টটা যায় রাণীর ওপর দিয়ে।

কিন্তু সবচে বাজে কাজটা সাহেব করলেন কিছুদিন আগে। শহরের কলেজে পড়া মুসলমান একটা ছেলের সঙ্গে কবিরাজ বেণীমাধববাবুর বড় মেয়ের প্রেম। শহরের সবাই জানে। কিন্তু হিন্দু মুসলমানের প্রেম, ব্যাপারটা কেউ ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু দুজনেই ডেসপারেট। বিয়ে করবেই।

এসব শুনে কবিরাজ মশাই দুতিনবার মেয়েকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। বারবারই ছেলেটা তার দলবল নিয়ে স্টেশানে গিয়ে উপস্থিত হয়। উপায় না দেখে কবিরাজ মশায় কেস করেন।

একদিকে ছেলের বাপও খুব রেগে গেছে ছেলের ওপর। সে ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করবে, কাছারিতে গেছে।

এসডিও সাহেব ঘটনাটা আগেই শুনেছিলেন। ছেলেটা নাটকফাটক করে। তার