- বইয়ের নামঃ মিলনের বিবিধ রচনা
- লেখকের নামঃ ইমদাদুল হক মিলন
- বিভাগসমূহঃ আত্মজীবনী
আমার কবি রফিক আজাদ
রফিক ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার লেখাটা পড়ছি৷ এই লেখা তুমি জোর কইরা ছোট করার চেষ্টা করবা না৷ লেখা যেইভাবে আগায়, আগাইবো৷ যতবড় হয় হইব৷ আমি এই লেখা ছাপবো৷
একজন কবিকে নিয়ে আমি উপন্যাস লিখেছিলাম৷ কবির নাম রফিক আজাদ৷ উপন্যাসের নাম ‘দুঃখ কষ্ট’৷ রফিক আজাদের কবিতা থেকেই রাখা হয়েছিল নামটি৷
‘পাখি উড়ে গেলে পাখির পলক পড়ে থাকে
কঠিন মাটিতে৷
এই ভেবে কষ্ট পেয়েছিলে’
‘৭৮ সালের কথা৷ আমি তখন রফিক আজাদের প্রেমে মগ্ন৷ তার একেকটা কবিতা বেরোয়, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাই৷ চবি্বশ ঘণ্টার আঠার ঘণ্টায়ই কাটাই রফিক আজাদের সঙ্গে৷ তিনি আমাকে আদর করে ডাকেন ‘বেটা’ আমি ডাকি রফিক ভাই৷
‘ইত্তেফাক’ ভবন থেকে একটা সাপ্তাহিক কাগজ বেরুবার তোড়জোড় চলছে৷ কাগজের নাম ‘রোববার’৷ আমি জগন্নাথ কলেজে অনার্স শেষ ক্লাসে পড়ছি৷ বিষয়, অর্থনীতি৷ রফিক ভাই বাংলা একাডেমীতে কাজ করেন৷ বাংলা একাডেমীর মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘উত্তরাধিকার’ এর সম্পাদক৷ কিন্তু সেই কাজ তার ভালো লাগছে না৷ যখন তখন অফিস ফাঁকি দিচ্ছেন৷ দুপুর কাটাচ্ছেন সাকুরা গ্রীন কিংবা অন্য কোন কারণ৷ দুপুরের পর চলে যাচ্ছেন ইত্তেফাক ভবনে৷ রাহাত খান তার বন্ধু৷ রোববার পত্রিকার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রফিক আজাদকে৷ বাংলা একাডেমীর চাকরি রেখেই রোববার সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি৷ নিজের নাম উহ্য রেখে রোববারের কাজ করবেন৷ সকাল থেকে দুপুর অব্দি বাংলা একাডেমীতে, দুপুরের পর থেকে ‘রোববার’৷ আমার অনার্স পরীক্ষার বিশেষ বাকি নেই৷ ইকোনোমিক্স মাথায় উঠে গেছে৷ সকাল বেলা আমি গিয়ে হাজির হই বাংলা একাডেমীতে, রফিক আজাদের টেবিলের সামনে বসে কাপের পর কাপ চা খাই, একটার পর একটা সিগ্রেট খাই৷ পকেটে টাকা-পয়সা থাকলে রফিক ভাইকে নিয়ে দুপুরের মুখে মুখে চলে যাই কোন বার কাম রেস্টুরেন্টে৷ সেখানে পানাহার করে ইত্তেফাক ভবন, রোববার অফিস৷ জীবনের প্রথম চাকরি হল রোববারে৷ জুনিয়র রিপোর্টার বা এরকম কিছু৷ বেতন চারশ’ টাকা৷
টাকা-পয়সা নিয়ে কে ভাবে৷ রফিক আজাদের সঙ্গে থাকতে পারছি, কাজ করতে পারছি এটাই তো বিশাল ব্যাপার৷
এসবের বছর দুয়েক আগে রফিক আজাদের সঙ্গে আমার পরিচয়৷
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক তখন ‘বিচিত্রা’৷ বিচিত্রায় আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়েছে৷ গল্পের নাম ‘না সজনী’৷ সেই সময়কার যুবক-যুবতীদের নিয়ে লেখা একটু অন্য ধরনের প্রেমের গল্প৷ রবীন্দ্রনাথের গান থেকে নাম নেয়া হয়েছে৷ চারদিকে ভালো একটা সাড়া পড়েছে৷ আমি গেছি বাংলা একাডেমীতে৷ দোতলার একটা রুমে রশিদ হায়দার, সেলিনা হোসেন আর রফিক আজাদ বসেন৷ রশিদ হায়দার আমার পরিচিত৷ তার ছোট ভাই জাহিদ হায়দার আমার বন্ধু৷ ওদের চতুর্থ ভাই দাউদ হায়দারের জন্য পরিবারটি খুবই বিখ্যাত৷ সবাই লেখালেখি করেন৷ রশিদ হায়দার গল্প-উপন্যাস লেখেন৷ আমি তার টেবিলের সামনে বসে আছি৷ পাশের টেবিলে মাথা গুঁজে কাগজপত্র ঘাঁটছেন সেলিনা হোসেন৷ বাংলা একাডেমীর ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘ধান শালিকের দেশ’ সম্পাদনা করেন তিনি৷ আমার দিকে একবারও ফিরে তাকাননি৷ একটু দূরে কোণের দিককার টেবিলে বসে আছেন রফিক আজাদ৷ আমি তাকে চেহারায় চিনি৷ কুস্তিগিরদের মতো চেহারা৷ বেঁটে, তাগড়া জোয়ান৷ হাতকাটা গেঞ্জি পরেন, গলায় চেন, হাতে বালা৷ নাকের তলায় ইয়া গোঁফ, হাতে সারাক্ষণই সিগ্রেট৷ ঢাকার রাস্তায় ড্রাগ খেয়ে মোটরসাইকেল চালান৷ ‘বিচিত্রা’ তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল৷
কাছ থেকে রফিক আজাদকে কখনও দেখিনি৷ রশিদ হায়দারের টেবিলে বসে আড়চোখে দেখছি৷ সাদা রংয়ের হাতাকাটা টাইট গেঞ্জি পরা৷ গলায় মোটা চেন, এক হাতে তামার বালা, অন্য হাতে সিগ্রেট৷ উত্তরাধিকার পত্রিকার কপি দেখছেন৷ সামনে চায়ের কাপ৷
এসময় একটা মজার ঘটনা ঘটল৷
হাতের কাজ ফেলে চায়ে চুমুক দিলেন রফিক আজাদ৷ রশিদ হায়দারকে বললেন, ওই রশিদ, বিচিত্রায় এ সপ্তাহে একটা ছেলে গল্প লেখছে, ইমদাদুল হক মিলন নাম, তুই চিনস?
রশিদ ভাই হাসলেন৷ এই তো আমার সামনে বইসা আছে৷
রফিক আজাদ আমার দিকে তাকালেন৷ ওই মিয়া এইদিকে আসো৷
আমার তখন বুকটা কেমন ধুগধুগ করছে৷ বিচিত্রায় আমার লেখা ছাপা হয়েছে সেই খবর রাখেন রফিক আজাদ, আমাকে ডাকছেন তার টেবিলে৷ যে কবি আমাদের হিরো, তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো?
রফিক আজাদ জাঁদরেল মুক্তিযোদ্ধা৷ কাদের সিদ্দিকীর সহকারী ছিলেন৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারী৷ চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময় কবিতা লিখে দেশ কাঁপিয়ে দিলেন৷ ‘ভাত দে হারামজাদা, নইলে মানচিত্র খাবো’৷ বঙ্গবন্ধু ক্ষমতায়৷ কবিতা চলে গেল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে৷ সরাসরি তাকেই আক্রমণ৷ পুলিশ ইনটেলিজেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি মহল তত্পর হয়ে উঠল৷ বঙ্গবন্ধুর কানে গেল এই ঘটনা৷ তিনি রফিক আজাদকে ডেকে স্নেহের ধমক দিলেন৷ সংশয় কেটে গেল৷ বন্ধুরা ধরে নিয়েছিল কবিতা লেখার অপরাধে রফিক আজাদকে জেলে যেতে হবে৷
আমার চেহারা কিছুটা রফিক আজাদ টাইপ৷ পরনে জিন্স, ফুলসপি শার্টের হাতা গুটানো, মাথায় লম্বা চুল, কসাইদের মতো ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে ঝুলে পড়া মোচ৷ দেখতে গুণ্ডাদের মতো৷ সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই রফিক আজাদ বললেন, বসো৷
বসার পর বললেন, তোমার গল্পটা আমি পড়ছি৷ একটা কাজ করো, উত্তরাধিকারের জন্য একটা গল্প দেও৷ কবে দিতে পারবা?
সপ্তাহখানেক৷
ঠিক আছে৷ চা খাইবা?
না৷
আরে খাও মিয়া৷
চা আনলেন৷ আমি তখনও কিছুটা আড়ষ্ট৷ চা খেয়ে উঠে আসছি, রফিক ভাই আমার পিছু পিছু এলেন৷ রুম থেকে বেরিয়ে বললেন, ওই মিয়া, একশ’ টাকা দিয়া যাও৷
আমি হতভম্ব৷ বলে কী? এইমাত্র পরিচয়, এইমাত্রই ধার!
আমার পকেটে তখন টাকা থাকে৷ বড়ভাইয়ের কনস্ট্রাকশন বিজনেস আমি খানিকটা দেখি৷ ইকোনোমিক্স পড়া, উন্মাদের মতো লেখালেখি, একটি বালিকার সঙ্গে প্রেম এতকিছুর ফাঁকে বড় ভাইর বিজনেস দেখি৷ পকেটে সবসময় ডানহিলের প্যাকেট৷ ডানহিল দামি সিগ্রেট৷ ওই সিগ্রেট দেখেই রফিক ভাই বুঝে গিয়েছিলেন আমার পকেটে টাকা আছে৷ ডানহিল সিগ্রেট তাকে অফারও করেছিলাম৷ তিনি যেন অতিশয় দয়া করে সিগ্রেটটা নিলেন৷ দু-তিনটা টান দিয়ে বললেন, ধুরো মিয়া, এইটা কী সিগ্রেট খাও? ভাতের মতন লাগে৷
মানিব্যাগ থেকে খুবই বিনয়ের সঙ্গে একশ’ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম৷ মনে মনে ভাবছি, আমাকে কি শালা ধোর (মক্কেল) ভাবলো নাকি৷ লেখার সঙ্গে একশ’ টাকাও চাইল?
কিন্তু রফিক আজাদের জন্য গল্প লিখতে বসে ভালো রকম ফাঁপরে পড়ে গেলাম৷ বিক্রমপুর অঞ্চলের একটা গ্রামের বাজার, বাজারের মানুষজন, সার্কাসের জোকার, হতশ্রী এক বেশ্যা, একজন হিন্দু কম্পাউন্ডার, একজন পাগল আর নিয়তির মতো একটি সাপ এসব নিয়ে লিখতে শুরু করেছি৷ লেখা তরতর করে এগোচ্ছে৷ প্রচলিত গদ্যের ভেতরে ভেতরে নির্বিচারে ব্যবহার করে যাচ্ছি বিক্রমপুরের আঞ্চলিক শব্দ৷ সপ্তাহখানেক লেখার পর দেখি ফুলস্কেপ কাগজের চবি্বশ পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে কিন্তু লেখা শেষ হয়নি৷ শেষ কী, মনে হচ্ছে যেন একটি চাপ্টার মাত্র শেষ হয়েছে৷
আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল৷
রফিক ভাই এক সপ্তাহের টাইম দিয়েছেন, উত্তরাধিকারের মতো পত্রিকায় ছাপা হবে লেখা, সেই লেখা শেষ হচ্ছে না? খুবই অসহায়, কাতর অবস্থা৷ চবি্বশ পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে গেলাম বাংলা একাডেমীতে! রফিক ভাই খুশি৷ লেখা আনছো? দেও৷
দিলাম৷ তিনি চোখ বুলাতে লাগলেন৷ ‘৭৬ সালের কথা৷ আমার হাতের লেখা তখন পরিষ্কার, গোটা গোটা৷ শিশুরাও পড়তে পারবে৷ তখন কম্পিউটার কম্পোজের নামই আসেনি পৃথিবীতে, সাবেকি টাইপ রাইটারে টাইপ করানো বেশ খরচের ব্যাপার৷ জেরোস্ক মেশিনও সর্বত্র পাওয়া যায় না৷ জেরোস্কোর চেয়ে ফটোকপি শব্দটা বাংলাদেশে বেশি প্রচলিত৷ আমি ফটোকপি করার কথাও ভাবিনি৷
রফিক ভাই লেখা দেখছেন, ভয়ে ভয়ে বললাম, রফিক ভাই, লেখাটা শেষ হয়নি৷
তিনি চমকালেন, কী কও মিয়া! শেষ হয় নাই মানে?
শেষ করতে পারিনি৷ লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে৷
রফিক ভাই চিন্তিত ভঙ্গিতে সিগ্রেট ধরালেন৷ তখন তিনি বেদম সিগ্রেট খান৷ একটার আগুন থেকে আরেকটা ধরান৷ আমি অপরাধীর মতো মুখ করে বসে আছি৷ সিগ্রেট টানার ফাঁকে ফাঁকে আবার লেখাটায় চোখ বুলালেন তিনি৷ তারপর বললেন, ঠিক আছে! লেখাটা আগে আমি পড়ি৷ এক সপ্তাহ পরে আইসা খবর নিও৷
গেছি এক সপ্তাহ পর৷ রফিক ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার লেখাটা পড়ছি৷ এই লেখা তুমি জোর কইরা ছোট করার চেষ্টা করবা না৷ লেখা যেইভাবে আগায়, আগাইবো৷ যতবড় হয় হইব৷ আমি এই লেখা ছাপবো৷
আঠারো মাস ধরে সেই লেখা উত্তরাধিকারে ছেপে গেলেন রফিক ভাই৷ আমার প্রথম উপন্যাস ‘যাবজ্জীবন’ লেখা হল এভাবে৷ এই আঠারো মাসে বিখ্যাত হয়ে গেলাম আমি৷ সাহিত্যের মেধাবী পাঠক, শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী জনৈক ইমদাদুল হক মিলনের ব্যাপারে একটু নড়েচড়ে বসলেন, উত্সাহী হয়ে উঠলেন৷
যাবজ্জীবন লেখার সময় দিনের পর দিন রফিক ভাই আমাকে সাহিত্য বুঝিয়েছেন, বাংলা বানান শিখিয়েছেন৷ তখন আমি এত ভুলভাল লিখি৷ সাহিত্যের পড়াশোনাটা একদম নেই৷ রফিক ভাই লেখকদের নাম বলেন আর আমি সেসব লেখকের লেখা খুঁজে খুঁজে পড়ি৷ দিনে দিনে সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে গেল, রফিক ভাই-ই আমার ধ্যান-জ্ঞান-প্রেম৷ রাতেও গিয়ে কখনও কখনও তার বাড়িতে থাকি৷
তারপর এলো রোববারের কাল৷
পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে, জামালপুরের একটা সাহিত্য সম্মেলনের দাওয়াত পেলেন রফিক ভাই৷ আমাকে বললেন, ওই মিয়া, যাইবানি?
আমি তো একপায়ে খাড়া৷ রফিক ভাইর সঙ্গে থাকতে পারা মানে সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির সঙ্গে থাকা৷ রফিক ভাইর চালচলন, কথাবার্তা, গলা ফাটিয়ে হাসা, পোশাক-আশাক সবকিছুরই আমি মহাভক্ত হয়ে গেছি৷ তখন পর্যন্ততিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র৷
ব্যাগ কাঁধে রফিক ভাইর সঙ্গে বাসে চড়লাম৷
এসবের কিছুদিন আগে রফিক আজাদের বিখ্যাত কবিতার বই ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ বেরিয়েছে৷ কী বই, কী একেকখানা কবিতা৷ বাংলাদেশের তরুণ কবি, কবি যশপ্রাথর্ী এবং কবিতার পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সেই বইয়ে৷ প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অসম্ভবের পায়ে’ থেকেই তিনি পাঠকপ্রিয়, দ্বিতীয় গ্রন্থ, ‘সীমাবদ্ধ জলে সীমিত সবুজে’ তাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে৷ তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ বাংলাদেশের কাব্যজগত্ কাঁপিয়ে দিল৷
আমি সেই কবির সহযাত্রী হয়েছি, এরচেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে!
জামালপুরে আমাদের থাকতে দেয়া হল সরকারি এক খামারবাড়ির বাংলোয়৷ জ্যোত্স্নায় ভেসে যাওয়া রাত৷ আমাদের পানের ব্যবস্থা ছিল না৷ বাংলোর বারান্দায় বসে সিগ্রেট খাই দু’জনে৷ সামনে বিশাল সূর্যমুখীর মাঠ৷ মাঠের কোণে একটা চাপকল৷ চাঁদের আলো সরাসরি পড়েছে সূর্যমুখীর মাঠে৷ কী যে অপূর্ব লাগছে৷ চারদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, ফুলের গন্ধ নিয়ে আদুরে একটা হাওয়া কোত্থেকে বয়ে আসে কে জানে৷ একটা রাতপাখি ডানায় জ্যোত্স্না ভেঙে মাঠের উপর দিয়ে উড়ে যায়৷ রফিক আজাদের কী হয় জানি না, আমার ভেতরে তৈরি হয় আশ্চর্য এক ঘোর৷ আশ্চর্য এক তৃষ্ণা যেন ফাটিয়ে দিতে চায় বুক৷ আমার ইচ্ছা করে চাপকলটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, জ্যোত্স্নায় গড়া এক যুবতী তার মায়াবী হাতে চেপে দিক চাপকল৷ অাঁজলা ভরে জল পান করি আমি৷ আজন্মের তৃষ্ণা মেটাই৷
রফিক আজাদেরও বুঝি তখন আমার মতোই অবস্থা৷ তার ভেতরও তৈরি হয়েছে ঘোর৷ সেই আশ্চর্য জ্যোত্স্না রাতে আমি তারপর একজন কবির ভেতরকার আরেকজন কবিকে জেগে উঠতে দেখি৷ একজন মানুষের ভেতরকার আরেকজন মানুষকে জেগে উঠতে দেখি৷ যে কবি থাকেন অন্তরালে, যে মানুষ থাকে অন্তরালে, সমগ্রজীবনে এক-দুবারের বেশি তার দেখা পায় না অন্য কেউ৷ রফিক ভাই তার জীবনের কথা বললেন, কবিতার কথা বললেন৷ অকালে হারিয়ে যাওয়া তার প্রিয় বোনটির কথা বললেন৷ আর বললেন, সেই মেয়ের কথা৷ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘ওপারে লায়লার লালবাড়ি’৷
কে এই লায়লা?
কোন সে দূরন্ত প্রেমিক নদী সাঁতরে যায় লায়লার লালবাড়িতে?
জামালপুর থেকে ফিরে এসে রফিক আজাদকে নিয়ে, উপন্যাস লিখলাম, ‘দুঃখ কষ্ট’৷ উপন্যাসের প্রতিটি চাপ্টার শুরু হল রফিক আজাদের কবিতার লাইন দিয়ে৷ একটি লাইন ‘দেয়ালে দেয়ালে, অনিবার্য অন্ধকারে’৷
রোববার বেরুবার আট-দশমাস পর আমি জার্মানিতে চলে গেলাম৷ জার্মানি তখন দুটো দেশ৷ আমি গেলাম পশ্চিম জার্মানিতে৷ বন শহরে আমার কয়েকজন বন্ধু ছিল৷ প্রথমে গিয়ে তাদের কাছে উঠলাম৷ দিন বিশেক বনে থেকে চলে গেলাম স্টুটগার্টে৷ স্টুটগার্টে কয়েক মাস থেকে চলে গেলাম পাশের ছোট্ট শহর সিনডেলফিনগেনে৷ এই শহরটি বলা হয় মার্সিডিস সিটি৷ কারণ বিখ্যাত মার্সিডিস বেঞ্জের মূল কারখানা এই শহরে৷
জার্মানিতে গিয়েছিলাম রোজগারের আশায়৷ টাকা রোজগার করে জীবন বদলাব৷ হয়নি৷ প্রবাস জীবন আমি সহ্য করতে পারিনি৷ আমাদের দেশের নিম্নস্তরের শ্রমিকের কাজ ছাড়া কোন কাজে পয়সা নেই৷ ওইসব কাজ আমি করতে পারছিলাম না৷ তাছাড়া দেশে রয়ে গেছে কত প্রিয় মানুষ, কত প্রিয়জন, তাদের ছেড়ে আছি৷ আমার মন পড়ে থাকত দেশে, সেসব প্রিয় মানুষদের কাছে৷ মা-ভাইবোন তো আছেই, যুবতী হয়ে ওঠা প্রেমিকাটি আছে, বন্ধুবান্ধব আছে, লেখালেখি করে একটা জায়গা তৈরি করেছিলাম সেই জায়গাটি আছে আর আছেন রফিক আজাদ৷ আমি সবাইকে চিঠি লিখি৷ সবাই আমাকে চিঠি লেখে৷ রফিক ভাইকে চিঠি লিখি কিন্তু তার চিঠির কোন জবাব আসে না৷ দশ-বারোটি চিঠি লেখার পর তার একটা চিঠি পেলাম৷ চিঠির দুটো লাইন এখনও মনে আছে, ‘গদ্য লেখার ভয়ে আমি কাউকে চিঠি লিখি না৷ কিন্তু মনে মনে প্রতিদিন তোমাকে অনেক চিঠি লিখি৷ তুমি কেমন আছো, মিলন?’
মনে আছে এই লাইনটি পড়ে আমি শিশুর মতো কেঁদেছিলাম৷
জার্মানি থেকে ফিরে এলাম দু’বছর পর৷ যেদিন ফিরলাম, রফিক ভাইর সঙ্গে দেখা হল তার পরদিন৷ আমাকে দেখে কী যে খুশি হলেন! সেদিনই বেতন পেয়েছেন, বেতনের পুরো টাকাটা আমাকে নিয়ে দামি মদ খেয়ে শেষ করে দিলেন৷ একটা মাস কী করে সংসার চলবে একবারও ভাবলেন না৷
আবার আগের জীবনে ফিরে এলাম আমি৷ রোববারে নতুন করে চাকরি হল৷ ইত্তেফাক ভবনের সামনে ট্রাকচাপা পড়ে মারা গেল এক পথচারী৷ পুরো শরীর ঠিক আছে শুধু মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে ট্রাকের চাকা৷ মাথাটা চ্যাপ্টা হয়ে রাস্তার সঙ্গে মিশে গেছে৷ ট্রাক ড্রাইভারদের সঙ্গে পুলিশের টাকা-পয়সার সম্পর্ক৷ ট্রাফিক পুলিশের হাতে মোটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভার ট্রাক নিয়ে উধাও হয়ে গেল৷ আমি একটা রিপোর্ট লিখলাম রোববারে৷ পুলিশ সম্পর্কে একটা আপত্তিকর মন্তব্য করে ফেললাম৷ সেই লাইনটির ওপর ‘ছিপি’ লাগিয়ে বাজারে ছাড়া হলো পত্রিকা৷ ছিপি তুলে পুলিশরা সেই লাইন পড়ল এবং দেশের সব পুলিশ ক্ষেপে গেল৷ ‘৮৩ সালের কথা৷ এমন কথাও আমার কানে আসতে লাগল গোপনে আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হবে৷ তখন পুলিশের ঊধর্্বতন একজন আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন৷ তিনি লেখক৷ রফিক আজাদ যখন টাঙ্গাইলের মওলানা মুহম্মদ আলী কলেজের বাংলার লেকচারার তখন তার ছাত্র ছিল আরেফিন বাদল৷ বাদল ভাইয়ের সঙ্গে মোসলেহউদ্দিন সাহেবের খুবই খাতির৷ বাদল ভাইকে ধরে দিনের পর দিন ছুটোছুটি করে আমাকে রক্ষা করলেন রফিক ভাই৷ সেই আতংকের দিনে প্রতিটা দিন প্রতিটা মুহূর্ত রফিক ভাই আমার হাতটা ধরে রেখেছেন, আমার পাশে থেকেছেন৷ রাতের বেলা তার বাড়িতে নিয়ে রেখেছেন আমাকে৷ নিজের বাড়িতে কিংবা অন্য কোথাও থাকলে পুলিশ যদি আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে!
সেই লেখার অপরাধে রোববার থেকে আমার চাকরি গেল৷ রফিক আজাদ এবং আরেফিন বাদলের চেষ্টায় মুসলেহউদ্দিন সাহেব ব্যাপারটা ম্যানেজ করলেন৷
চাকরি নেই, রফিক ভাইর সঙ্গে তারপরও প্রায় প্রতিদিন দেখা হয়, আগের মতোই চলছে আড্ডা হৈ-চৈ, পানাহার৷ আমি সিদ্ধান্তনিয়েছি আর চাকরি-বাকরি করব না, লেখাই হবে আমার পেশা৷ বাংলাদেশে তখন পর্যন্তশুধু লেখাকে পেশা করার সাহস পায়নি কেউ৷ আটাশ-ঊনত্রিশ বছর বয়সের যুবক ইমদাদুল হক মিলন এরকম এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্তনিয়ে নিল৷
আত্মঘাতী কেন?
তখন বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় একটা গল্প লিখলে বড়জোর ২০ টাকা পাওয়া যায়৷ পত্র-পত্রিকার সংখ্যা খুবই কম৷ প্রকাশকদের পায়ে ধরলেও বই ছাপাতে চায় না৷ ঈদ সংখ্যা বেরোয় দু’তিনটা৷ উপন্যাস লিখলে টাকা পাওয়া যায় তিনশ’ থেকে পাঁচশ’৷ তারপরও নাক উঁচু পত্রিকাগুলো তরুণ লেখকদের পাত্তা দেয় না৷
আমার তখন কী যে মর্মান্তিক অবস্থা৷ বহুকাল অপেক্ষা করা কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে যাওয়া মেয়েটিকে বিয়ে করেছি৷ সে সন্তানসম্ভবা৷ বড় ভাইর সংসারে থাকি, দশটা টাকা রোজগার করতে পারি না৷ উঠতে-বসতে নানা প্রকারের অপমান৷ সহ্য করতে না পেরে একদিন স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম৷ আমার শ্বশুরপক্ষ টাকাঅলা, কিন্তু তাদের সঙ্গে তেমন সদ্ভাব নেই৷ একমাত্র মেয়েটি নিজের পছন্দে আমার মতো একটা অপদার্থকে বিয়ে করেছে, জার্মানির মতো দেশে গিয়েও যে দুটো পয়সা রোজগার করে ফিরতে পারেনি, তাদের বাড়িতে যাওয়া আমার নিষেধ৷ কিন্তু বড় ভাইর সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি৷ স্ত্রী বেচারিটি মন খারাপ করে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠল৷ ওর বাবা নেই, মা এবং দুই ভাই সে তাদের নয়নের মণি৷ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মা খুবই কান্নাকাটি করলেন, ভাইরা বুকে টেনে নিল বোনকে৷ ওদের যৌথ পরিবার৷ ছয় মামা এবং এক বোন বিশাল একটা বাড়ির একেক ফ্ল্যাটে থাকেন৷ বোন সবার বড়৷ সেই বোনের মেয়েটি আমার স্ত্রী৷ মামাশাসিত সংসার৷ আমার শাশুড়ির পিঠাপিঠি ভাইটি সংসারের অধিকর্তা৷ তার আদেশে বিশাল পরিবারটি চলে৷ আমার শ্বশুর অল্প বয়সে মারা যান৷ ব্যবসায়ী ছিলেন৷ টাকা-পয়সা ভালোই রেখেই গেছেন৷ শাশুড়ি সেই টাকা বিজনেস করার জন্য ভাইকে দিয়েছেন৷ লঞ্চ-জাহাজের ব্যবসা করে অগাধ টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছে পরিবারটি৷ ভদ্রলোক যেমন টাকাঅলা তেমনি রাগি৷ আমার মায়ের মামাতো বোনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে৷ সম্পর্কে আমার খালু, অন্যদিকে স্ত্রীর বড় মামা৷ আমার সঙ্গে ভাগি্নর বিয়েতে তিনিই বাগড়া দিয়েছিলেন৷ আর তার আদেশের বাইরে কিছুতেই যাবে না পরিবারটি৷ তবু আমাদের বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু বিয়ের পর ওই বাড়িতে যাওয়া আমাদের নিষিদ্ধ হয়েছে৷ তারপরও দায়ে পড়ে আমার নরম নিরীহ স্ত্রীটি চোখ মুছতে মুছতে সেই বাড়িতে গিয়ে উঠেছে৷ ওই যে সে নিজ থেকে গিয়েছে তাতেই পাথরটা গলে গেল৷ মা-ভাইরা তো তাকে বুকে টেনে নিলই, মামা-মামীরা, মামাতো ভাইবোনরাও নিল৷ কিন্তু আমি তখনও ওই বাড়িতে ঢুকিনি৷ বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে রাত কাটাই৷ দু’তিনটা দিন মাত্র৷ শ্বশুরবাড়ির কাছে লম্বা মতো একটা ঘর ভাড়া নিলাম৷ উপরে টিন চারদিকে ইটের দেয়াল৷ ভাড়া সাতশ’ টাকা৷ নিজেদের বাড়ি থেকে আমার বিয়ের খাটটা, দুটো সিলিং ফ্যান আর আমার লেখার টেবিলটা নিয়ে এসেছি৷ তাদের প্রাসাদের মতো বাড়ির পাশে এরকম একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি, স্ত্রী লজ্জায় সেই বাড়িতে আসে না৷ টিফিন কেরিয়ারে করে দু’বেলা আমার খাবার পাঠায়৷ ফ্যানের হাওয়ায় ঘর ঠাণ্ডা হয় না৷ গরমে ঘামে ভাসতে ভাসতে আমি মাথা গুঁজে উপন্যাস লিখি৷
ওই ঘরে এসে রফিক আজাদ আমাকে একদিন দেখে গেলেন৷ আমার দুঃখ-দারিদ্র্যের জীবন, অপমানের জীবন পাত্তাই দিলেন না৷ অতি কষ্টে আমি একটা কেরু কোম্পানির জিনের পাইট ম্যানেজ করেছিলাম, ওই খেয়ে জীবন ও সাহিত্য নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়ে চলে গেলেন৷ সেই ভাষণে মন এবং কব্জির জোর তৈরি হল৷ ‘ভূমিপুত্র’ নামে একটা উপন্যাস লিখলাম, কিছু প্রেমের গল্প লিখলাম৷ প্রকাশকদের সঙ্গে কথা হল প্রতি মাসে ৪/৫ ফর্মার একটা করে প্রেমের উপন্যাস লিখব, তারা থোক কিছু টাকা দেবেন৷
লিখতে লাগলাম৷ জীবন বদলাতে লাগল৷
তখন সারাদিন লিখি, সন্ধ্যায় গিয়ে রফিক আজাদের সঙ্গে আড্ডা দেই৷ এ সময় রফিক ভাইর কবিতার বই বেরুলো৷ বইয়ের নাম ‘প্রিয় শাড়িগুলো’৷ বইটা আমাকে উত্সর্গ করলেন৷ বইয়ের একটা কবিতার নাম ‘জ্যোত্স্নাকে আমার চাই’৷
জ্যোত্স্না আমার স্ত্রীর নাম৷ হাসতে হাসতে রফিক ভাইকে বললাম, আমার জ্যোত্স্নাকে তুমি চাও?
রফিক ভাই বললেন, আরে না বেটা, আমি যেই জ্যোত্স্নাকে চাই তাকে একজীবনে পাওয়া যায় না৷ তার জন্য বহুজীবন অপেক্ষা করতে হয়!
রফিক ভাইর সঙ্গে এদিক-ওদিক সাহিত্য সম্মেলনে যাই৷ যশোর না খুলনায় যেন প্রবন্ধ সাহিত্যের আলোচনা সভার সভাপতির হঠাত্ শখ হল ঢাকা থেকে আগত কবি এবং ঔপন্যাসিকের চেহারা দেখবেন৷ তিনি এই দু’জনকে কখনও দেখেননি৷ আমার হাত ধরে মঞ্চে উঠলেন রফিক আজাদ৷ বললেন, সভাপতি সাহেব, আমাদের চেহারা দেখে আপনার ভালো লাগবে না৷ আমরা লিখি ভালো কিন্তু চেহারা জলদসু্যদের মতো৷
ভদ্রলোক হতভম্ব৷
এসব করে আমাদের দিন যায়৷ রফিক আজাদের দুটো বই সম্পাদনা করলাম আমি৷ ‘বাছাই কবিতা’ এবং ‘প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা’৷ ততদিনে রফিক ভাই তার জীবন বদলে ফেলেছেন৷ হঠাত্ হঠাত্ তাকে কেমন অন্যমনস্ক এবং বিষন্ন হতে দেখি৷ এমন মন খারাপ করা একেকটা কবিতা লেখেন,
বালক ভুল করে নেমেছে ভুল জলে
বালক পড়েছে ভুল বই
পড়েনি ব্যাকরণ, পড়েনি মূল বই৷
এসব কবিতা পড়ে আমার বুক হু হু করে, ইচ্ছা করে রফিক আজাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই৷ তার হাতটি ধরে বলি, প্রিয় বালক রফিক আজাদ, আমি এখনও সেই আগের মতোই তোমার অনুরাগী৷
আমার যুদ্ধ
সইয়ের বাড়িতে বসে খবরটা মা পেয়ে গেল।
আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। গ্রামে মিলিটারি এসেছে, জ্বালাও পোড়াও করেছে, মানুষ মেরেছে। কিন্তু আমাদের বাড়িটা মিলিটারিরা লুটপাট করেনি।
কে করেছে?
লুট হয়ে যাওয়া বাড়িতে ফিরেই আমি তা জেনে গিয়েছিলাম।
তখনও দুপুর হয়নি।
লুট হয়ে যাওয়া বাড়ির আঙিনায় বসে শিশুর মতো কাঁদছি। অদূরে লুটের হাত থেকে বেঁচে থাকা আমাদের একমাত্র সম্পদ মায়ের কোরআন শরীফটা রেহালের ওপর রাখা।
আমি কাঁদছিলাম সেই দিকে তাকিয়ে।
দুপুরের পর পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলো মা। চার পাঁচমাইল দূরের পুম্বাইলে গ্রাম থেকে ছুটতে ছুটতে এসেছে। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি এসেছে, যেকোনও আপদ হতে পারে রাচ্চায়, মা সেইসব কেয়ারই করেনি। তার পরনে সস্তা ধরনের একটা প্রিন্টের শাড়ি। বাড়িতে ঢুকে দেখে মাটিতে অসহায় ভঙ্গিতে বসে কাঁদছি আমি। প্রথমেই আমার দিকে তাকালো না মা। চারদিক তাকিয়ে ফাঁকা শূন্য বাড়িটা দেখলো। রেহালের ওপর রাখা কোরআন শরীফটা দেখে ছুটে গিয়ে সেই কোরআন শরীফ বুকে চেপে ধরল।
তারপর তাকালো আমার দিকে।
একহাতে বুকে ধরা কোরআন শরীফ, অন্যহাত রাখল আমার মাথায়। কান্দিস না বাজান, কান্দিস না। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
মাকে দেখে আমার কান্না আরও বেড়ে গেছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমগ কিছু নাই মা। আমরা পথের ফকির হইয়া গেছি।
মা আবার সেই কথা বলল, ধৈর্য ধর।
পথে আসতে আসতে মা বোধহয় খবর পেয়ে গিয়েছিল কে লুট করেছে আমাদের বাড়ি।
সেই বদমাশ কেরামত আলীর ভাই। লোকটার নাম আক্কাস আলী।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়ে আক্কাসের বাড়িতে গেল মা। গিয়ে দেখে আমাদের বাড়ির টিন কাঠ খাট চৌকি চেয়ার টেবিল এমনকি হাঁড়িপাতিল থালাবাসন পর্যন্ত আক্কাসের বাড়ির উঠানে। আক্কাস আর তার বড়ভাই কেরামত দুজনে আমাদের দুটো চেয়ার নিয়ে বসে আছে।
মা গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়াল। আক্কাস এইটা তুমি কি করছ? আমার বাড়ির ঘরদুয়ার সব লুট করলা?
আক্কাস না, কেরামত কেলানো একটা হাসি হাসল। আমরা তো লুট করি নাই। লুটের হাত থিকা বাঁচাইছি।
কেমনে বাঁচাইলা? আমার বাড়ির সব জিনিস দেখি তোমগ উঠানে পইড়া রইছে।
সব আপনের না মামানী।
তয় কার?
এই উঠানে যেইসব জিনিস দেখতাছেন, এইসব জিনিস এই পাড়ার আরও কয়েকজন মাইনষের। যাগো যাগো বাড়ি লুট হইতেছিল, সেইসব বাড়িতে গিয়া লুটতরাজ করা মানুষগ আমরা ঠেকাইছি। তাগো হাত থিকা জিনিসপত্র যতটা রক্ষা করতে পারছি, সব এই বাড়িতে লইয়া আইছি।
কও কী?
এবার কথা বলল, আক্কাস। হ মামানী, আমার আপনের লগে মিছাকথা কই না।
মা চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছে আমাদের বাড়ির সব জিনিস আক্কাসের বাড়ির উঠানে। তারপরও তারা বলে ওইসব জিনিস নাকি আমাদের না!
মা অনেকক্ষণ তর্ক বিতর্ক করল তাদের সঙ্গে। কাজ হলো না, মার কথা ওরা পাত্তাই দিল না।
শেষপর্যন্ত মা বলল, তোমরা কী কইতে চাও উঠানের এইসব জিনিসের মধ্যে কিছুই নাই আমার?
কেরামত বলল, আছে।
কী আছে?
আপনের বাড়ির ছয়খান টিন আছে।
মাত্র ছয়খান টিন?
হ। লুটতরাজকারীদের হাত থিকা আপনের বাড়ির মাত্র ছয়খান টিনই আমরা বাঁচাইতে পারছিলাম। আপনের ছয়খান টিন আপনে লইয়া যান।
মা আর কোনও কথা বলল না, বাড়িতে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। মা আর আমি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ধরাধরি করে ছয়টা টিন নিয়ে এলাম বাড়িতে। ওই ছয়খানা টিনই তখন আমাদের সম্বল, আর কিচ্ছু নেই। মার পরনে প্রিন্টের সচ্চা একটা শাড়ি। আমার পরনে হাঁটুর কাছে ছেঁড়া ফুলপ্যান্ট, আর কোড়া রঙের অতি পুরনো একটা স্যান্ডোগেঞ্জি।
মনে আছে, ছেঁড়া প্যান্টটার রঙ ছিল খয়রি।
ততোক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে।
আমাদের খাওয়া হয়নি কিছুই। কোত্থেকে হবে, বাড়ির কোথাও তো কিছু নেই। সবই তো লুট হয়ে গেছে। আমার চোখের পানি আর ফুরায়ই না, শুধু ভাইয়ের কথা মনে হয়। কোথায় আছে আমার বড় ভাই, ভাবী আর ছোটবোন? কোথায় আছে আমার সেই বাউণ্ডুলে মেজোভাই, কে জানে? বেঁচে আছে , না মরে গেছে সবাই তাই বা কে জানে? যে বাড়িতে, যে ঘরের চার দেয়ালের মাঝখানে, মাথার ওপর রোদ বৃষ্টি ঠেকাবার চালা ছিল যে ঘরে, সেই ঘরের ভিতর জড়াজড়ি করে বড় হওয়া, জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো আজ কে কোথায়? পাকিস্তানী জন্তুগুলো হামলার পর হামলা চালিয়ে কোথায় কীভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে আমাদেরকে। তাদের হামলার সুযোগে আমাদের কিছু নিজস্ব মানুষও নিঃস্ব করে দিয়েছে আপনজনকে।
অন্যদের কথা আমি তখন ভাবতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম শুধু আমার আর আমার ওই দুঃখিনী মায়ের কথা।
এই দুজন মানুষ আমরা বাঁচবো কী করে?
মাথা গুঁজবো কোথায়?
খাবো কী?
পরবো কী?
বুকে কোরআন শরীফটা মা ধরেই রেখেছেন। এই অবস্থায় আমাদের একমাত্র অবলম্বন ওই পবিত্র গ্রন্থ। যেন এই গ্রন্থই যাবতীয় বিপদ আপদ থেকে, ঝড়ঝঞ্জা থেকে রক্ষা করবে অসহায় মা এবং ছেলেকে।
আমার কান্না থামে না দেখে মা আমাকে বুঝাতে লাগল, এইভাবে কান্দিস না। কান্দন থামা। এইটাও আল্লাহর একটা পরীক্ষা। আল্লাহপাক বিপদ আপদ দিয়া তার বান্দাগো পরীক্ষা করে। ধৈর্য ধর, আল্লাই পথ দেখাইবো।
ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
কোথায় রাত কাটাবো আমরা?
চারপাশের যেকোনও বাড়িতে গিয়েই রাত কাটাতে পারি। কোনও বাড়িতেই সেভাবে লোকজন কেউ নেই। বেশির ভাগ বাড়িই খালি পড়ে আছে। যেকোনও একটাতে গিয়ে উঠলেই হয়।
মা বলল, নিজের বাড়ি ছাইড়া আমি কোনখানে যামু না।
আমি অবাক! তাইলে থাকবা কই?
এই বাড়িতেই থাকুম।
এই বাড়িতে তো ঘরদুয়ার কিচ্ছু নাই?
তারপরও এই বাড়িতেই থাকুম।
গ্রামে যখন তখন আসতে পারে মিলিটারি। গুলি করে আর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে মারতে পারে সবাইকে। এসব শোনার পর থেকে প্রত্যেক বাড়িতেই বড় বড় গর্ত করা হয়েছিল, অর্থাৎ ট্রেঞ্চ করা হয়েছিল। থানাঅলারা আর গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকের বুদ্ধি পরামর্শে প্রত্যেক বাড়িতে ট্রেঞ্চ করেছিল লোকে। আমাদের বাড়িতে বড় একটা ট্রেঞ্চ করেছিলাম আমি। অনেকটা কবরের আকৃতি। বাড়ির পিছন দিকটায়। ভিতরে বসে থাকলে বাইরে থেকে দেখে মিলিটারিরা যেন কিছু অনুমান করতে না পারে এইভাবে করেছিলাম ট্রেঞ্চটা। ঝোঁপঝাড়ের ভিতরে ট্রেঞ্চ করে তার ওপর আড়াআড়ি করে বাঁশ ফেলে বাঁশের ওপর চালার মতো করে দিয়েছিলাম বাঁশের তৈরি একটা বেড়া, তার ওপর কয়েক ঝুড়ি মাটি আর মাটির ওপর কিছু ঝোঁপঝাড়। একদিককার মুখ ফাঁকা। সেই দিক দিয়ে ট্রেঞ্চে নামা যাবে। ওই মুখটার ওপর ফেলে রেখেছিলাম আলগা একটা বেড়া। ট্রেঞ্চে নেমে সেই বেড়া টেনে দিলে বোঝা যাবে না এর ভেতর মানুষ আছে কী না?
মা বলল, রাতটা আমরা ওই গর্তে কাটামু।
শুনে আমি চমকে উঠলাম। কও কী তুমি?
হ।
ওই রকম জায়গায় সারারাত বইসা থাকতে পারবা?
পারুম। তুই পারবি কী না সেইটা ক?
তুমি পারলে আমিও পারুম।
তয় আর চিন্তা নাই।
কিন্তু খাইবা কী? খাওনের তো কোনও পথ দেখতাছি না।
কাইল সকাল পর্যন্ত না খাইয়া থাকন লাগবো। পারবি না?
আমি কাতর গলায় বললাম, আমার তো অহনই খিদায় পেট জ্বইলা যাইতাছে।
মা বলল, ধৈর্য ধর বাজান, ধৈর্য ধর। একটামাত্র রাইত। পেটের খিদা চাইপা রাখি। কাইল আল্লাহপাক কোনও না কোনও ব্যবস্থা করবোই। খিদা সহ্য করতে না পারলে চাপকল থিকা পানি খাইয়া আয়।
আমাদের বাড়িতে পুরনো একটা চাপকল ছিল। সবই লুট হয়ে গেছে, চাপকলটা লুট হয়নি। আক্কাসের চোখে চাপকলটা বোধহয় পড়েইনি। পড়লে মাটির তলার পাইপ পর্যন্ত টেনে তুলে নিয়ে যেত।
মার কথায় চাপকলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একহাতে চাপকল টিপে, অন্যহাতে অনেকক্ষণ ধরে পানি খেলাম। গাল মুখ চটচটে হয়েছিল চোখের পানিতে। চাপকলের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখটা খুব ভালো করে ধুয়ে ফেললাম। ময়লা স্যান্ডোগেঞ্জি মুখের কাছে তুলে মুখ মুছতে মুছতে এলাম মার কাছে।
মার বুকে তখনও কোরআন শরীফ। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাচ্ছে চারদিকে। মার হাত ধরে ট্রেঞ্চে গিয়ে নামলাম। প্রথমে নামালাম মাকে। তারপর নিজে নেমে আলগা ঝাপটা টেনে দিলাম ট্রেঞ্চের মুখে। মুহূর্তে গভীর গভীরতর এক অন্ধকার জগতে চলে গেলাম।
মৃত্যুর জগৎ কী ঠিক এই রকম না?
কবর কী ঠিক এই রকম না?
এই রকম অন্ধকার আর নির্জন?
জীবিত মানুষের কবরবাসের অভিজ্ঞতা কী রকম কেউ তা জানে কী না জানি না। আমি আমার কবরবাসের অভিজ্ঞতা টের পেলাম সেই রাতে।
ট্রেঞ্চের এককোণে বুকে কোরআন শরীফ জড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে মা। মাঝখানে বিঘত পরিমাণ ব্যবধান, আমি বসে আছি। দুজন মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ টের পাই দুজনে। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলি না।
কবরে থাকা মানুষ কী কথা বলে?
মা সবসময় দোয়া পড়েন একটু শব্দ করে। সেই রাতে সেই কবরের অন্ধকারে বসে মা কোনও শব্দ করছিল না। বুকে জড়ানো কোরআন শরীফ নিয়ে আল্লাহকে মা ডাকছিল নিঃশব্দে। ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল।
আল্লাহকে ডাকছিলাম আমিও। মায়ের মতো নিঃশব্দেই ছিল সেই ডাক। এই করে করে ঘুম এবং জাগরণের মাঝখানকার একটা অবস্থা তৈরি হলো দুজনেরই। নাকি ওই অবস্থাটাকে বলে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানকার অবস্থা?
এই অবস্থা কাটলো ভোররাতের দিকে।
সারারাত আমাদের চারপাশে কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। ছিল মাটির তলার নৈঃশব্দ। সেই প্রথম আমি আবিষ্কার করেছিলাম নৈঃশব্দের ভিতরেও থাকে এক রকম শব্দ। সেই শব্দ জীবনের শব্দ না, সেই শব্দ মৃত্যুর শব্দ।
মৃত্যুর শব্দ থেকে জীবনের শব্দে ফিরলাম ভোররাতে। বহুদূর থেকে ভোরবেলার পবিত্র হাওয়ায় আমাদের মা ছেলের কবরের ভিতরে মিহিন সুরে ভেসে এলো ফজরের আজানের শব্দ। সেই শব্দে মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরে এলাম আমরা। মা একটু নড়েচড়ে উঠল। আজানের শব্দ পাছ ধলা?
আমিও একটু নড়ে উঠলাম। হ মা পাই।
তয় তো ফজর হইছে?
হ।
ল তয় অহন বাইর হই।
লও।
মা ছেলে তখন আমরা কবর থেকে বেরিয়ে এলাম। খোলা জায়গায় দাঁড়াবার পর আশ্চর্য এক অনুভূতি হলো আমার। ভোরবেলার হাওয়া, পাখির ডাক আর গাছপালার গন্ধে, পায়ের তলার ঘাস মাটির গন্ধে মনে হলো এই প্রথম পৃথিবীর মাটি হাওয়াতে, ঘাসের বনে আর গাছগাছালির শীতলতায় বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের অন্যকোনও গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসে যেন পা দিয়েছি আমি। অথবা মৃত্যুর জগৎ থেকে এইমাত্র ফিরেছি জীবনে। সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভিতর মুচড়ে উঠল তীব্র ক্ষুধা। কাল থেকে কিছ্ইু যে খাওয়া হয়নি, কবরের অন্ধকারে একবারও টের পাইনি সেই অনুভূতি। এখন পেলাম।
মাকে বললাম, মা আমি খিদায় মইরা যাইতাছি। যেমনে পারো আমারে কিছু খাওয়াও।
মা বলল, আমি বন্দোবস্ত করতাছি। তুই কোনও চিন্তা করিস না।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়েই বাঁশবাগানের ওদিককার রাস্তা দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেল মা। কোথায় গেল জানি না। আমি বসে রইলাম কাল সারাদিন যেখানটায় বসেছিলাম, বাড়ির আঙিনার ঠিক সেই জায়গাটাতে। আমার তখন মাথা কাজ করছে না। চিন্তা চেতনা অনুভূতি সব লোপ পেয়ে গেছে খিদায়। ট্রেঞ্চে রাত কাটিয়েছি বলে হাত পা মুখ মাথা সব ভরে আছে ধুলোতে। নিজেকে মনে হচ্ছে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা খিদার কষ্টে ধুকতে থাকা মৃতপ্রায় কোনও শেয়াল।
মা ফিরে এলো বেশ তাড়াতাড়ি।
হাতে একটা এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি। হাঁড়িতে কিছু চাল। এসেই কোরআন শরীফটা রাখল রেহালের ওপর। রেহালটা ঠিক সেই আগের জায়গাতেই ছিল।
মা তারপর চাপকলটার কাছে গিয়ে হাঁড়ির চালগুলো ধুঁয়ে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে নিয়ে এলো। আমাদের রান্নাচালার ওদিকটাও ফাঁকা। শুধু মাটির চুলা দুটো আছে। লাকড়ি খড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। চুলার একপাশে ছোট্ট ন্যাকডায় জড়ানো থাকে ম্যাচ। ম্যাচটা সেভাবেই আছে। সেই ম্যাচ জ্বেলে চুলায় আগুন জ্বাললো মা।
এলুমিনিয়ামের হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটতে লাগল চাল। জাউ রান্না করল মা। পাতলা জাউ না, থকথকে। থালা বাসন কিচ্ছু নেই। কেমন করে খাবো এই জিনিস?
একটা সময়ে দেখি নিজের অজান্তেই আমি এবং আমার মা মুঠো করে হাঁড়ি থেকে সেই থকথকে জাউ তুলছি আর পাগলের মতো খাচ্ছি। কোনও দিকেই খেয়াল নেই আমাদের।
পেটপুরে জাউ খাওয়ার ফলে শরীরের শক্তিটা আমার ফিরে এসেছিল। মাও বেশ শক্ত সামর্থ্য মহিলা। সারাদিন খেটেখুটে মা আর আমি মিলে আক্কাসের বাড়ি থেকে আনা ছয়টা টিন দিয়ে রোদ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার মতো একটা চালা মতো করে ফেললাম। বাঁশের খুঁটিখাঁটি দিয়ে একেবারেই যেনতেন একটা ব্যবস্থা। দুজন মানুষ কোনওরকমে ঘুমাতে পারে এইটুকু মাত্র জায়গা।
আহা রে, কত জৌলুশ একদিন এই বাড়ির ছিল। আর আজ?
চালাটার দিকে যতবার তাকাই, আমার চোখ ভরে আসে জলে। বুকটা হু হু করে। আমাদের বাড়ি লুট করেছিল কেরামতের ভাই আক্কাস। আক্কাসের কথা ভেবে বুকের ভেতর হুঙ্কার ছেড়ে জেগে উঠতে চায় এক ঘুমন্ত সিংহ।
আক্কাস শুয়োরের বাচ্চাকে আমি দেখে নেবো। কোনও না কোনওদিন প্রতিশোধ ওর ওপর আমি নেবোই।
এলাকার তরুণ যুবকরা তখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া শুরু করেছে। আগে থেকেই যাচ্ছিল। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি আসার পর গোপনে গোপনে যাওয়া বেড়ে গেল। আমার বয়সী আমার বন্ধুরাও কেউ কেউ চলে গেল। যারা যায়, তারা কেউ কেউ গোপনে গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করে। দেখা করে বলে, কী রে ধলা, যাবি? চল যাইগা।
মার সামনেই কেউ কেউ এরকম কথা বলে। মা তাদেরকে বলে, তোরা যা বাজান, ধলা পরে যাইবো।
কেন যে মা আমাকে এভাবে ফিরিয়ে রাখছিল আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সবাই জানে আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। কোনও রকমে তৈরি করা একটা টিনের চালায় মা আর আমি থাকি। ধার উধার করে মা কিছু চাল জোগাড় করে কিছু আনাজপাতি ডাল মাছ জোগাড় করে। ওই খেয়ে কোনও রকমে আমরা বাঁচি। কেরামত আলীর শত্রুতায় এই অবস্থা আমাদের। ভাইকে দিয়ে সে আমাদের বাড়ি লুট করিয়েছে। ওই যে আমার বোনকে পাঁচ নম্বর বউ বানাতে চেয়েছিল। মা রাজি হয়নি দেখে এইভাবে সে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল।
কেরামতের কথা ভাবলে আমার কখনও কখনও মনে হয় বাংলাদেশে জন্মে, বাঙালির ঘরে জন্মে, বাঙালি হয়েও কোনও কোনও মানুষ ছিল পাকিচ্চানী মিলিটারির নরপশুগুলোর চেয়েও নিকৃষ্ট।
আমার বুকটা তখন ক্রোধে জ্বলে। আমার ইচ্ছে করে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। ট্রেনিং নিয়ে অস্র হাতে ফিরে আসি। পাকিস্তানী মিলিটারিগুলোর সঙ্গে গুলি করে মারি কেরামত আর আক্কাসের মতো বাংলাভাষায় কথা বলা নিকৃষ্টতম জীবগুলোকে।
মাকে বলি এইসব কথা। মা আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে এসে এইসব অনাচারের প্রতিশোধ নিই।
মা বলে সেই এক কথা। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
হাসিবুজি তখন পুম্বাইলে, মার সইয়ের বাড়িতে। ছোটবোন রাশেদা ঢাকায় বড় ভাইয়ের কাছে। মেজোভাইয়ের খবর নেই। কোথায় আছে কে জানে! শুনেছি বড় ভাইয়ের একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম রেখেছে মামুন। ভাই ভাবী আর তাদের একমাত্র সন্তান , সঙ্গে আছে রাশেদা, আমার ছোটবোন। কারও কোনও খবর নেই। বেঁচে আছে না মরে গেছে জানি না। শুধু তিনজন মানুষের ব্যাপারে নিশ্চিত। যে হ্যাঁ, এই তিনজন মানুষ আমরা বেঁচে আছি। মা হাসিবুজি আর আমি।
মা আর আমি দুজন অসহায় মানুষ কী যে হতাশা নিয়ে বেঁচে আছি তখন। এই হতাশা সহ্য হয় না। এই হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
মাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভোররাতের দিকে একদিন আমি একা একা রওনা দিলাম। মুক্তিযুদ্ধে যাবো। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসবো।
মোচ্চফা আর আবুল খায়ের আগেই চলে গিয়েছিল। গিয়ে কী যেন কী কারণে আবার ফিরে এসেছে। ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। শুনেছি ফিরে এসেছে কিন্তু কোথায় আছে জানি না।
আমারও শেষপর্যন্ত যাওয়া হলো না। কাঁচামাটিয়া নদী পার হয়ে আটদশ মাইল হেঁটে গিয়েছিলাম। যেতে যেতে মনে হয়েছিল, এ আমি কী করছি? আমার অসহায় মাকে আমি কার কাছে ফেলে যাচ্ছি? আমি চলে গেলে মার আর থাকলো কে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে আক্কাস আলীর বাড়ি থেকে পাওয়া ছয়খানা টিনের নড়বড়ে চালার তলায় কুপি জ্বালিয়ে আমার আশায় বসেছিল মা। বসে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিল। ছায়ার মতো নিঃশব্দে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কুপির আলোয় দেখি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মা আমার কোরআন শরীফ পড়ছে।
ঈশ্বরগঞ্জে ঢুকেই মিলিটারিরা ক্যাম্প করেছিল সরকারি ডাকবাংলোয়। আমাদের বাড়ি থেকে বেশ কাছে সেই ডাকবাংলো। দিনেরবেলায় এদিক ওদিক ছাড়িয়ে যায় পাকিচ্চান আর্মি। চারপাশের গ্রাম থেকে ধরে আনে অসহায় নিরীহ মানুষ। হিন্দুপাড়াগুলো খালি হয়েছিল আগেই। একেবারেই দরিদ্র যেসব হিন্দুপরিবার, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই যাদের, সেইসব পরিবারের ছেলে বুড়ো যুবতী বউঝি কিশোরী মেয়ে যাকে পায় ধরে ডাকবাংলোর ক্যাম্পে নিয়ে আসে। পুরুষগুলোকে রাইফেল দিয়ে বেদম মারে। বুট দিয়ে এমন এক একটা লাথি, মাটিতে ফেলে বুটের তলায় চেপে ধরে গলা। আহা রে, সেইসব মানুষের প্রাণ ফাটানো চিৎকার। ঝোঁপজঙ্গলে আর বাঁশবনে লুকিয়ে থেকে সেইসব মানুষের মরণ চিৎকার শুনি আমি। রাগে ক্রোধে বুক জ্বলে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।
ক্যাম্পের কাছেই আমাদের পাড়াটা বলেই কী না কে জানে, এদিকটায় মিলিটারিরা আসেনি। তাদের ধারণা এইপাড়ার সবগুলি বাড়িই বুঝি ফাঁকা। কোনও বাড়িতেই বুঝি কোনও মানুষ নেই। মানুষ ধরতে তারা চলে যায় অন্যদিককার পাড়ায়, অন্যদিককার গ্রামে। রাতেরবেলা গভীর অন্ধকারে মায়ের পাশে শুয়ে থেকে থেকে নারীকণ্ঠের চিৎকার শুনতে পাই। ডাকবাংলো থেকে ভেসে আসে সেই চিৎকার। ওই যে রামগোপালপুর জমিদার বাড়ির কাছে একবার গিয়েছিলাম তবলার আওয়াজ আর নারীকণ্ঠের চিৎকার শোনার জন্য। এই চিৎকারও সেই চিৎকারের মতোই। যন্ত্রণায় যেন জীবনের শেষ চিৎকারটি দিচ্ছে কোনও নারী। বাবা বাবা, তুমি আমার বাবা। ছাইড়া দাও আমারে, ছাইড়া দাও।
বুঝতে পারি, ভয়ঙ্কর ভাবে চলছে নির্যাতন। ধর্ষণ। হয়তো বা পালাক্রমে চলছে। আফ্রিকার বন্যকুকুরের দল যেভাবে চারদিক থেকে ঘেরাও করে ধরে নিরীহ হরিণ, চারদিক থেকে খাবলে খুবলে ছিঁড়তে থাকে তার মাংস, এযেন ঠিক সেই রকম এক কাজ। মানুষ হয়ে মানুষের ওপরই এরকম নির্যাতন চালাচ্ছে মানুষের মতো দেখতে একশ্রেণীর বন্যকুকুর।
ক্যাম্পের আশেপাশে কোনও লাশ চোখে পড়তো না। মেরে লাশগুলো ওরা ফেলে দিয়ে আসতো দূরের বিল বাওড় কিংবা ডোবা নালায়।
আমাদের পাড়াটা বাস্তবিকই সুনসান হয়ে গেছে, নির্জন হয়ে গেছে। লোকজন বলতে গেলে নেই। আছে ওই শালারপুত আক্কাস। বউবেটি নিয়েই আছে। ওর সঙ্গে কেমন কেমন করে ভাব হয়েছে পাকিস্তান আর্মির। যে বেটা ক্যাপ্টেন, ঈশ্বরগঞ্জ থানার দায়িত্বে, ওই পুঙ্গিরপুতের সঙ্গে খাতির জমিয়েছে আক্কাস। আক্কাসের মতো এলাকার আরও দুচারজন রাজাকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে। ততোদিনে সারা দেশেই পাকিস্তানের পক্ষের লোকগুলো রাজাকার হতে শুরু করেছে। শান্তিবাহিনীর সদস্য হতে শুরু করেছে।
এসব দেখে মা গেল ভয় পেয়ে।
পাড়ায় একমাত্র যুবক ছেলে আমি। আক্কাস যদি এই কথা মিলিটারিদের জানিয়ে দেয় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এর আগে থানা কম্পাউন্ডে, স্কুলের মাঠে মুক্তিযোদ্ধার প্রাথমিক একটা ট্রেনিংও নিয়েছিলাম আমি। আক্কাস এসব জানে।
মা আমাকে বলল, তুই সইরা যা ধলা। আমার যা হওনের হইব তুই তোর জান বাঁচা।
আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার অভাবটা তখন আর নেই। মার সইয়ের বাড়ি থেকে বিরাট একবচ্চা চাল, বেশ কয়েক সের ডাল, আনাজপাতি তরিতরকারি চারজন লোক এসে দিয়ে গেছে। যা দিয়ে গেছে দুজন মানুষের সেই খাবারে তিন চারমাস চলবে।
এদিক দিয়ে আমি খানিকটা নিশ্চিন্ত।
মা অন্তত না খেয়ে মরবে না। তাও মাকে বললাম, বেশি অসুবিধা দেখলে তুমি পুম্বাইলে চইলা যাইও। মাউই মার বাড়িতে গিয়া থাইকো। ওই বাড়িতে থাকলে ভালো থাকবা তুমি। তোমার সই তো আছেই, হাসিবুজিও আছে। আর ওইদিকে তো মিলিটারি যাওনের প্রশ্নই ওঠে না। তুমি পুম্বাইলে চইলা যাইও।
মা বলল, কইলাম না আমারে লইয়া তুই চিন্তা করিস না। তুই তাড়াতাড়ি সইরা যা।
পরনে সেই ছেঁড়া খয়রি প্যান্ট আর স্যান্ডোগেঞ্জি। আমি পথে নামলাম।
স্টেশনের ওদিক দিয়ে একটা রাস্তা আছে। ওই রাচ্চা দিয়ে কয়েক মাইল গেলে ঢুফির বাজার। ‘ঢুফি’ শব্দটার অর্থ হলো ঘুঘু। ঘুঘু পাখি। ঢুফির বাজার মানে ঘুঘুর বাজার। ওই দিকটায় শোনলাম মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প হয়েছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুক্তিযোদ্ধারা। ততোদিনে দেশের এদিক ওদিক যুদ্ধ শুরু করেছে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। সামনাসামনি যুদ্ধ করছে, গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করছে। টাঙ্গাইলের ওদিকে কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী পাকিস্তানী মিলিটারি মেরে সাফা করে ফেলছে। গোপনে গোপনে যারা স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্র শোনে তাদের কাছ থেকে এইসব খবর পাই।
ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্পে দশ পনেরোটা আর্মির গাড়ি। প্রায়ই এই গাড়িগুলো ভরে মিলিটারিরা যায় হালুয়াঘাটের দিকে। কাদেরিয়া বাহিনী হালুয়াঘাটের ওইদিক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে নাকি পাকিস্তান আর্মি যাচ্ছে কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে। কিন্তু যুদ্ধে পাকিস্তানীরা একদমই সুবিধা করতে পারছে না। কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে বেধরক মরছে।
ঈশ্বরগঞ্জের ওই পুঙ্গিরপুত ক্যাপ্টেন কেরামত আলী আক্কাস আলীর মতো নেড়িকুত্তাগুলোকে ডেকে বলেছে, আমাদের অনেক রাজাকার দরকার। যে বাড়িতে চারজন পুরুষ আছে, সেই বাড়ির দুজনকে অবশ্যই রাজাকার হতে হবে। যারা হতে চাইবে না তাদেরকে গুলি করে মারবো।
পাকিস্তানের প্রেমে গদগদ হয়ে স্বেচ্ছায় রাজাকার হয়েছিল অনেকেই। আবার কেউ কেউ হয়েছিল প্রাণের ভয়ে, বাঁচার তাগিদে। ভিতরে ভিতরে তারা স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ। ওপরে ওপরে রাজাকার। এই শ্রেণীর রাজাকাররা অনেক রকমভাবে আমাদের অনেক উপকার করেছে। আমি তাদেরকে রাজাকার মনে করি না। মনে করি তারাও আসলে মুক্তিযোদ্ধা। জীবন বাঁচাবার জন্য ওপরে ওপরে তারা রাজাকার, ভিতরে ভিতরে তারা মুক্তিযোদ্ধা।
এলাকার কিছু স্বচ্ছল হিন্দুও রয়ে গিয়েছিল। আক্কাসরা সেইসব হিন্দুদেরকে খুঁজে বের করেছে। মিলিটারিদের কাছে তাদের হদিস দিয়েছে। মিলিটারিরা গিয়ে ধরে এনেছে। ধরে এনে প্রথমেই কিন্তু মেরে ফেলেনি। আক্কাসরা কেউ কেউ ততোদিনে বেশ ভালো উর্দু শিখে গেছে। মিলিটারিরা তাদের মাধ্যমে প্রস্তাব দিয়েছে, হিন্দুগুলোকে বলো ওরা যদি পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, ওরা যদি মুসলমান হয়, তাহলে প্রাণে বেঁচে যাবে। ওদেরকে আমরা মারবো না।
রাইফেলের নলের মুখে, প্রাণের ভয়ে রাজি হয়ে গেছে সবাই। মসজিদের ইমাম সাহেবকে আগেই এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে ক্যাম্পে। তিনি নিয়ম মতো ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছেন অসহায় হিন্দুদেরকে।
কিন্তু মুসলমান হতে চেয়েও বাঁচতে পারলেন না আমাদের চূর্নিখোলা হাইস্কুলের হেডমাস্টার, হরিদাস ভট্টাচার্য আমার বন্ধু রুনুর বাবা। রাতেরবেলা তাঁকে ধরে নিয়ে গেছে ক্যাম্পে। খবর পেয়ে রুনুর বড়ভাই বেনু ছুটে গেছে। তাকেও আটক করেছে মিলিটারিরা। দুজনেই রাজি হয়ে গেছে মুসলমান হতে। বলেছে, পরিবারের অন্যান্যদেরকেও মুসলমান করে ফেলবে তারা। কেরামত আর আক্কাস দুইভাই ছিল সামনে। মিলিটারিদেরকে তারা বলল, হেডমাস্টার লোক ভালো না। যতই মৌলবি ডেকে তাকে মুসলমান করা হোক, এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই সে ধর্মটা মানবে না, পরিবার নিয়ে রাতের অন্ধকারে উধাও হয়ে যাবে।
তাদের কথা শুনে আমার সেই প্রিয় স্যার আর তার বড়ছেলেকে, আমার প্রিয়বন্ধু রুনুর বাবা আর তার বড়ভাইকে কেরামত আর আক্কাসের চোখের সামনে গুলি করে মারলো মিলিটারিরা। সেই মৃত্যু দৃশ্য থেকে হায়েনার মতো খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছিল কেরামত আর আক্কাস।
হেডমাস্টার স্যার আর তার বড়ছেলেকে আক্কাসরা এইভাবে হত্যা করিয়েছিল পুরনো একটা ক্রোধ মিটাবার জন্য। ঈশ্বরগঞ্জে রুনুদের ছিল অঢেল জায়গা সম্পত্তি। কেরামত লোভী চেয়ারম্যান। রুনুদের জায়গা সম্পত্তি বেশ কিছু সে দখল করেছিল। ওসব নিয়ে স্যারের সঙ্গে মামলা মোকদ্দমাও চলছিল। মামলায় জিততে পারছিল না কেরামত। অন্যদিকে আরও জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিল। স্বাভাবিক অবস্থায় তো স্যারকে খুন করা যায় না। কারণ স্যার খুবই জনপ্রিয় মানুষ। তাকে খুন করালে খুবই বিপদে পড়বে কেরামত। এইজন্য মিলিটারিদের মাধ্যমে পথের কাঁটা সরিয়ে দিল।
আমার সঙ্গে তখন একটা পয়সাও নেই।
সকালবেলা স্টেশনের ওদিক দিয়ে রওনা দিয়েছি। তার আগে আক্কাসের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আক্কাসের বাড়ি আমাদের বাড়ির সঙ্গেই তো। সকালবেলা আমি গোসল করেছি। গামছা পরে গোসল করে ওই ছেঁড়াপ্যান্ট গেঞ্জি পরেছি। তারপর চুপচাপ পথে নেমেছি। আক্কাস কিছু বুঝতেই পারেনি।
ঢুফির বাজার জায়গাটা ঈশ্বরগঞ্জ থেকে বেশ অনেকটা দূরে। ক্ষেতখোলা বিল বাওড়ের ভেতর দিয়ে, গ্রামের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পথ। আমি হাঁটছি, হাঁটছি। ঢুফির বাজারে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল।
ঢুুফির বাজারে গিয়ে দেখি এ যেন একেবারেই অন্যরকমের একদেশ। মানুষের কোনও চিন্তা টেনশান কিচ্ছু নেই। বাজার করছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। কোনও ভাবনাই নেই কারুর। দেশে যে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, পাকিচ্চানীরা যে মানুষ মেরে শেষ করে ফেলছে এসব নিয়ে যেন মাথা ব্যথা নেই। একেবারেই স্বাভাবিক অবস্থা চারদিকে।
আমি অবাক।
এ কোন দেশে এলাম?
কোথায় আমাদের শ্বাসরুদ্ধকর ঈশ্বরগঞ্জ, আর কোথায় এই ঢুফির বাজার? হাতেরম মুঠোয় প্রাণ নিয়ে ঢুকতে হয় ঈশ্বরগঞ্জে। এই বুঝি রাজাকাররা ধরে নিয়ে গেল মিলিটারি ক্যাম্পে, এই বুঝি ক্যাম্পের পিছনে নিয়ে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে দাঁড় করালো, এই বুঝি গুলি করে দিল বুকে।
আর ঢুফির বাজার?
ঢুফির বাজার যেন আমরা যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, সেই স্বাধীন এক টুকরো বাংলাদেশ।
আমার মন ভালো হয়ে গেল।
বুক ভরে গেল উচ্ছ্বাস আনন্দে।
বাজারের দিকে যাচ্ছে এমন একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, এখানে মুক্তিবাহিনী কোথায় থাকে?
লোকটা সন্দেহের চোখে আমার দিকে তাকালো। কেন?
এখানকার মুক্তিবাহিনীতে আমার এক আত্মীয় আছে। আমি একটু তার লগে দেখা করুম।
তোমার আত্মীয়র নাম কী?
ঈশ্বগঞ্জের আব্দুল জব্বার আমার চে’ দুবছরের বড়। কিন্তু আমার তুই তুকারি বন্ধু। শুনেছি আগরতলা থেকে সে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। ঢুফির বাজারের এই দিকেই আছে।
আব্দুল জব্বারের নামই আমি সেই লোকটাকে বললাম।
আব্দুল জব্বার নামটা শুনে লোকটা বেশ চঞ্চল হলো। দূরের একটা বটগাছ দেখিয়ে বলল, ওই বটগাছের ওদিক দিয়া যাও। গেলেই দেখবা বাঁশঝাড়ওয়ালা একটা বড়বাড়ি, ওই বাড়িতেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প।
দ্রুত হেঁটে সেই বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি আমার বয়সী, আমার চে’ বড় এরকম তিরিশ চল্লিশজন যুবক। অনেকেই আমার চেনা, অনেকেই ঈশ্বরগঞ্জের ছেলে। আব্দুল জব্বারকে পেলাম প্রথমেই। সঙ্গে আছে সাত্তার। আমাকে দেখে হইচই পড়ে গেল বাড়িতে।
জব্বার বলল, তুই আইছস ক্যান?
আমিও মুক্তিবাহিনীতে যামু। আমিও ট্রেনিং লমু।
সাত্তার বলল, তোর ট্রেনিং লওনের কাম নাই, তুই যা গা।
না আমি যামুই। তোরা আমার যাওনের ব্যবস্থা কর।
জব্বার বলল, সবাই গেলে তো হইব না। সবাই মরলে তো চলবো না। তোর যাওনের কাম নাই।
জব্বারের পরনে হাফপ্যান্ট, কোমরে মোটা বেল্ট। তার ওপর হাফহাতা শার্ট। মাথার চুল লম্বা লম্বা। মুখ দাড়িগোঁফে ভরা। চোখ দুটো টকটকে লাল। জব্বারের কাঁধে ঝুলছে স্টেনগান। গলার আওয়াজ কেমন মোটা ফ্যাফ্যাসে হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানারকম অর্ডার দিচ্ছে।
সাত্তার বলল, তুই মনে হয় বোঝস নাই ধলা। জব্বার হইল আমগ কমান্ডার।
আমি জব্বারের মুখের দিকে তাকালাম। তুই আমারে না করিস না দোস্ত। আমারে ট্রেনিংয়ে পাঠা।
জব্বার ঠাণ্ডা গলায় বলল, থাক এইখানে, পরে বুঝুম নে।
আমি থেকে গেলাম।
একজন মধ্যবয়সী মহিলা রান্নাবান্না করতো ক্যাম্পে। দুপুরবেলা খেলাম সেই মহিলার রান্না ভাত একপদের মাছ আর ডাল। রাতেরবেলা খাসির মাংস আর ভাত। বিকেলবেলা কারা যেন একটা খাসি দিয়ে গিয়েছিল। সেই খাসি জবাই করে রাতেরবেলা বিরাট খাওয়া দাওয়া। খাসির মাংসের বড় বড় টুকরা আর তেলতেলে ঝোল, কী যে আরাম করে খেলাম। মনে হলো বহুদিন পর পেটভরে খাচ্ছি।
খাওয়ার দাওয়ার পর আলাদা করে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল জব্বার। বলল, তোর আগরতলা যাওনের কাম নাই। তোর ট্রেনিং নেওনের দরকার নাই। সবার ট্রেনিং লাগে না। তুই অন্যকাম কর।
কী কাম?
এলাকায় আর্মি আইছে না?
হ আইছে।
তোর কাম হইল ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্প থিকা আর্মি কই যায় না যায়, এই খবর রাখন। রাজাকাররা কী করে না করে, এই খবর রাখন। সব খবর লইয়া তুই এই ক্যাম্পে আইসা আমারে জানাইয়া যাবি। তয় কামডা করতে হইব খুব সাবধানে। এইটাও কিন্তু মুক্তিবাহিনীরই কাম। এই কাম করলে তুই মুক্তিযোদ্ধা হইয়া যাবি। এইটা তোর ডিউটি। কাইল সকালেই তুই ঈশ্বরগঞ্জ চইলা যা। কাম শুরু কর।
ঢুফির বাজার ক্যাম্প থেকে আমার বন্ধু কমান্ডার জব্বারের আদেশ পালন করতে অন্যরকমের এক মুক্তিযোদ্ধা হয়ে আমি ঈশ্বরগঞ্জে ফিরে এলাম। জব্বার যেভাবে বলেছিল সেইভাবে কাজ শুরু করলাম।
ডাকবাংলোর অদূরে বিশাল এক মাঠ।
সেই মাঠে গরু চড়ায় এলাকার হতদরিদ্র কৃষকরা। এই শ্রেণীর মানুষকে মিলিটারিরাও কিছু বলে না, রাজাকাররাও কিছু বলে না। আমি গিয়ে তাদের সঙ্গে মিশে গেলাম। ছেঁড়া একটা লুঙ্গি জোগাড় করেছি, গামছা এবং মাথলা জোগাড় করেছি। জুন জুলাই মাসের রোদে পুড়ে যাচ্ছে দেশ, খোলামাঠ ঝাঁ ঝাঁ করে রোদে। হাঁটু পর্যন্ত উঁচু করে ছেঁড়া লুঙ্গি পরি। কোমরের কাছে বাঁধি পুরনো গামছা, মাথায় মাথলা দিয়ে হতদরিদ্র কৃষকদের সঙ্গে মিশে ওদের গুরুগুলো চড়াই। আমাকে পেয়ে কেউ কেউ তাদের গরু আমার জিম্মায় দিয়ে অন্যান্য কাজে চলে যায়। আমি গরু চড়াবার ফাঁকে ফাঁকে ডাকবাংলোর আর্মি ক্যাম্পের দিকে চোখ রাখি। তারা কী করে, কাকে ধরে আনে, কাকে মারে সব দেখে রাখি।
কখনও কখনও রাখালের সাজেই বাজারের দিকে যাই। বাজারের চারদিকে গিজগিজ করে রাজাকার। প্রত্যেকের কাঁধে থ্রি নট থ্রি রাইফেল। প্রত্যেকেই নিয়েছে রাজাকারি ট্রেনিং। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অনেকেই রাজাকার না। ওই যে বলেছি জীবন বাঁচাবার জন্য রাজাকার হয়েছে কেউ কেউ। ওই শ্রেণীর রাজাকাররা সত্যিকার অর্থেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। কারণ তারা নানারকম ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছিল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে।
প্রথম দিন আমাকে রাখালের চেহারায় দেখে ওরকম দুজন রাজাকার জিজ্ঞেস করলো, কী রে ধলা, খবর কী?
আমি শুকনো গলায় বললাম, কোন রকমে মারে লইয়া বাঁইচা আছি ভাই। তোমগ এইদিককার খবর কী?
এইরকম টুকটাক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আগাতে চাচ্ছি। রাজাকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ওইসব মুক্তিযোদ্ধা বুঝে যায়, আমি আসলে কী জানতে চাই, আমি আসলে কাদের হয়ে কাজ করছি?
ওরা আমাকে খবর দিতে শুরু করে। কাইল সকালে দুই গাড়ি আর্মি যাইবো হালুয়াঘাটে।
পরদিন ভোররাতে ওঠে আমি দৌড়ে যাই ঢুফির বাজার ক্যাম্পে। জব্বারকে দিয়ে আসি যতটুকু খবর সংগ্রহ করতে পেরেছি। দৌড়ে দৌড়ে যাই, দৌড়ে দৌড়ে আসি। তারপরও ফিরতে দুপুর পেরিয়ে যায়।
যেসব রাজাকার ভিতরে ভিতরে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের উদ্দেশ্য একটাই, কাঁধের অস্ত্রটি আর যতগুলো সম্ভব গুলি নিয়ে ওরা একদিন উধাও হয়ে যাবে। সম্ভব হলে আর্মি ক্যাম্প থেকে অস্ত্র চুরি করে উধাও হয়ে যাবে। রাজাকার হিসাবে অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং তো ওদের আছেই।
এরমধ্যে জনা পঁচিশেক অস্ত্র আর গুলি নিয়ে উধাও হয়েছে। সরাসরি চলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। যারা এভাবে পালিয়েছে, তারা নিজেরা বেঁচেছে ঠিকই কিন্তু তাদের ফ্যামিলি বাঁচেনি। তাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে আর্মি। মা বাপ ভাইবোন আত্মীয় স্বজন যাকে যাকে পেয়েছে ধরে নিয়ে এসেছে। টর্চারে টর্চারে মেরে ফেলেছে। অস্ত্র নিয়ে কোথায় পালিয়েছে তাদের বাড়ির ছেলে, সেইসব খবরও বের করে ফেলেছে। কিন্তু ধরতে পারেনি একজনও মুক্তিযোদ্ধাকে।
আসল রাজাকারগুলো বাজারে আমাকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেই ওদের মতো রাজাকারিতে নাম লেখতে বলতো। ট্রেনিংটা লইয়া ল ধলা। অস্ত্র পাবি, খাওন দাওন টেকা পয়সা পাবি, অসুবিধা কী?
আমি কাতর গলায় বলি, আমার মা বুড়ো মানুষ তারে নিয়া বড় বিপদে আছি। মার দেখভাল করতে হয়। রান্নাবান্না কইরা খাওয়াইতে হয়। বাড়ি লুট হয়ে গেছে, থাকি খোলা আসমানের তলায়। এই অবস্থায় মারে বাঁচাইয়া রাখন আমার বড় কর্তব্য।
ওইসব রাজাকার জানে মা আর আমি ছাড়া আমার ভাইবোন আর কেউ বেঁচে নেই। সব মারা গেছে। ওদের বুঝি একটু মায়াও লাগতো আমার জন্য। আমাকে আর কিছু বলতো না।
শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান হয়েছে ওসমান গনি। এলাকায় ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। বিদ্বান লোক, বুদ্ধিমান লোক। হঠাৎ করে সে গেছে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে। এত ভালো লোক কিন্তু শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চেহারাটা তার বদলে গেল। এমন অত্যাচার শুরু করলো লোকজনের ওপর। তার দোসর হিসেবে আছে সেই কেরামত আলী চেয়ারম্যান। ওই শুয়োরের বাচ্চা আবার একটা ভালো পথ ধরেছে, মিলিটারি আর রাজাকারদের সঙ্গেও খাতির , মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেও খাতির। দুই দলকেই হাতে রাখে। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে টাকা পাঠায়, চাল ডাল ওষুধ পাঠায়। কেরামত আলীর এই কায়দা আবার ওসমান গনি টের পায় না। হাতে ক্ষমতা পেয়ে ওসমান গনি গেছে পাগল হয়ে। পাকিচ্চানী মিলিটারিদের চেয়েও বেশি নৃশংস হয়ে উঠেছে সে। যাকে খুশি তাকে ধরে নিয়ে আসে। দিন দুপুরে গুলি করে মারে। মেয়েদেরকে ধরে এনে দিন দুপুরে অত্যাচার চালায়। কোনও কোনও লোককে ধরে এনে তার চেহারার দিকেও তাকায় না, চামচাগুলোকে অর্ডার দেয়, মাইরা ফালা।
হিন্দু হোক মুসলামান হোক, অবিরাম মানুষ মারতে শুরু করলো ওসমান গনি। কোন জনমে কার সঙ্গে তার বিরোধ ছিল সেইসব বিরোধের প্রতিশোধ নিতে লাগলো। অন্যদিকে রাজাকাররা চালাচ্ছে লুটপাট। ওসমান গনি যেহেতু শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান, তার আদেশে চলতো রাজাকাররা। লুটপাট করে বড়লোক হয়ে গেল লোকটা। আগেই বলেছি শিক্ষিত মানুষ। উর্দু খুব ভালো বলে। আর্মিদের সঙ্গে গড় গড় করে কথা বলে। উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে নিজের ফায়দা লুটে।
আমার মাকে খুবই শ্রদ্ধা করতো ওসমান গনি। ভাবী ডাকতো।
একদিন বাজারের দিকে যাচ্ছি, দশ পনেরোজন রাজাকার নিয়ে বাজারে চক্কর দিচ্ছে ওসমান গনি। হাত ইশারায় আমাকে ডাকলো, এইদিকে আয়।
ভয়ে বুকটা ধ্বক করে উঠল আমার। ঢোক গিলে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আসলামালায়কুম চাচা।
সে আমার সালামের জবাব দিল না। কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কই যাস?
বাজারে যাই চাচা, বাজারে।
বাজারে যাইতাছস ক্যান? খালি ভেগাবণ্ডের মতন ঘুইরা বেড়াও ক্যান? রাজাকারি ট্রেনিংটা লইতে পারো না?
ভয়ে ভয়ে বললাম, ট্রেনিং কেমনে লমু? আমার তো কেউ নাই চাচা?
নাই মানে?
মা আর আমি ছাড়া তো কেউ নাই। বেবাকতে মইরা গেছে।
হ। ওইডা আমি জানি।
অহন মার অবস্থাও খুব খারাপ। যখন তখন মইরা যাইবো। আমি বাজার বোজার কইরা মারে খাওয়াই। বাড়ির পাকশাক বেবাকই আমার করতে হয়।
কস কী তুই?
হ চাচা।
ওসমান গনি একটু চিন্তিত হলো। তোর মার অসুখ? কেউ নাই? আইচ্ছা তুই যা। মার সেবাযতœ কর গিয়া।
সঙ্গের রাজাকারদের বলল, ওরে কেউ কিছু কইয়ো না। বুড়া মা ছাড়া ওর অহন আর কেউ নাই। ভাইবোন বেবাক মইরা গেছে।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাজারে না গিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে। মাকে বললাম ওসমান গনির কথা।
পরদিন গেলাম ঢুফির বাজার। ক্যাম্পে গিয়ে জব্বারকে বললাম ওসমান গনির কথা। তার অত্যাচার এবং মানুষ মারার কথা।
জব্বার চুপচাপ সব শুনে রাখল।
ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্পে কিছু মিলিশিয়াও আসছে। কালো সালোয়ার কামিজ পরা। ভয়ঙ্কর দেখতে এক একটা। রাজাকারদের নিয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াই তারা। গরিব দুঃখী গৃহস্থলোকেরা টুকটাক জিনিসপত্র নিয়ে আসে বাজারে, সেইসব জিনিসের যেটা যেটা পছন্দ হয় সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে নেয়। কেউ কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না। করলেই ধাম করে কোঁকসা বরাবর বুটপরা পায়ের লাথি। কখনও কখনও রাইফেলের বাট দিয়ে বারি। মুদিদোকান থেকে তেলের টিন নিয়ে যাচ্ছে, একজন গৃহস্থ হয়তো দুটো মুরগি এনেছে বিক্রি করতে, ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাঠ থেকে ধরে নিয়ে আসছে গরু ছাগল। জবাই করে খাচ্ছে ক্যাম্পে বসে। শুয়োরের বাচ্চাদের আনন্দ উল্লাসের সীমা নেই। কিন্তু এলাকার লোক নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকের বাড়িতেই খাবার নেই।
ওসমান গনিকে একদিন দেখলাম, জঘন্য ব্যবহার করলো এক গৃহস্থের সঙ্গে। লোকটা বুড়ো মতন, মুখে পাঁকা দাড়ি। একজোড়া মুরগি বিক্রি করতে এনেছে বাজারে। ওসমান গনির চোখে পড়ল সেই মুরগি। একজন রাজাকারকে বলল, বুইড়ার কাছ থিকা ওই দুইটা লইয়া আমার বাড়িতে দিয়া আয়।
লোকটা কাতর গলায় বলল, বাবারে, আমার ঘরে কয়েকদিন ধইরা খাওন নাই। ঘরে বেচনের মতন কোনও জিনিসও নাই। খালি এই মুরগি দুইটা আছিল, এই দুইটা বেইচা চাইল ডাইল লইয়া বাড়িত যামু। বউ পোলাপাইনরে খায়ামু।
লোকটাকে বিরাট ধমক দিল ওসমান গনি। কথা কইস না নডিরপুত। গুল্লি কইরা দিমু।
লোকটা ওসমান গনির সঙ্গে একটু তর্ক করেছিল। আপনের মতন মানুষ এমন করলে আমরা যামু কই, কার কাছে যামু?
ওসমান গনি আর কথা বলল না। একজন রাজাকারকে কী ইশারা করল, দুতিন মিনিটের মধ্যে ক্যাম্প থেকে একদল মিলিশিয়া এলো, এসে প্রথমে লোকটার দাড়ি ধরে দুতিনটা হেঁচকা টান দিল। তারপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল বাজারের মাটিতে। লোকটার চোখ দিয়ে তখন পানি পড়ছে। শব্দ করে কাঁদছে না সে, কাঁদছে নিঃশব্দে। মুরগি নিয়ে ওসমান গনির দল চলে গেছে। বাজারের মাটি থেকে গামছাটা কুড়িয়ে উঠে দাঁড়াল সেই লোক। গামছায় চোখ মুছতে মুছতে হাঁটতে লাগল।
আমি তখন ভয়ে ভয়ে থাকি, পালিয়ে পালিয়ে থাকি। যখন যেটুকু খবর পাই, জব্বারকে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসি।
এই খবরও দিয়ে এলাম।
বাপ এবং ভাইকে মেরে ফেলার পর রুনুদের ফ্যামিলিটা তছনছ হয়ে গেছে। কে কোথায় চলে গেছে কিছুই জানি না আমি। এদিকে মিলিটারিরা কেমন যেন একটু বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে। দেশের সর্বত্র চলছে প্রচণ্ড যুদ্ধ। ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্পে মিলিটারিদেরকে খুবই অস্থির দেখি। প্রথম প্রথম যে ভয় গ্রামের মানুষের ছিল তা যেন বেশ কিছুটা কমে এসেছে। রাতভর টহল দেয় আর্মি। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে। উড়ো খবর পেয়ে কোথাও কোথাও ছুটে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধানে। সঙ্গে রাজাকার আর শান্তিবাহিনীর লোক। গভীর রাতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠে কোনও বাড়িতে। প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে টুকটাক যুদ্ধ হচ্ছেই। কোনও বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা আছে বা আশ্রয় নিয়েছে শুনলেই কোনও কিছু না ভেবে সেই বাড়ি ঘেরাও করে গোলাগুলি শুরু করে মিলিটারিরা। তারপর আগুন জ্বালিয়ে দেয় সেই বাড়িতে।
জব্বারদের ক্যাম্পেও দেখি এক ধরনের অস্থিরতা। দল বেঁধে একেক দিকে যাচ্ছে তারা। মিলিটারি যাতে অনায়াসে সর্বত্র যাতায়াত করতে না পারে সেইজন্য ছোটখাটো পুল ব্রিজ সব উড়িয়ে দিচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। রামগোপালপুরের ব্রিজটা উড়ালো ডিনামাইট দিয়ে। এই ব্রিজটা ছিল বহু পুরনো। গৌরিপুরের ব্রিজটা উড়ালো, সেটাও পুরনো ব্রিজ। শুধু ময়মনসিংহের ব্রিজটা উড়াতে পারলো না। রামগোপালপুর আর গৌরিপুরের ব্রিজ ধ্বংস হয়ে গেছে শুনে ময়মনসিংহের ব্রিজের দুপাশে প্রচুর আর্মি ছিল পাহারায়। মুক্তিযোদ্ধারা ওদিকটাতে যেতে পারেনি।
একেকদিক মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা তখন আগাচ্ছে। জব্বাররা প্ল্যান করেছে এবার তারা ধীরে ধীরে ঈশ্বরগঞ্জের দিকে আগাবে। কীভাবে ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্প আক্রমণ করবে তার পরিকল্পনা চলছে।
এসময় একদিন রুনু এসে হাজির ঢুফির বাজার ক্যাম্পে। উ™£ান্তের মতো চেহারা। আমাদের সেই রাজপুত্রের মতো রুনু আর নেই। মাথার চুল কাকের বাসার মতো, চোখ গর্তে ঢুকে গেছে, চেহারা ভাঙাচোরা। সুন্দর মুখটা ভরে গেছে দাড়িগোঁফে। কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে গেছে।
আমি সেদিন জব্বারদের ক্যাম্পে।
রুনুকে দেখে হইচই পড়ে গেল ক্যাম্পে।
জব্বার বলল, কী রে রুনু, তুই আছিলি কই?
রুনু উদাস গলায় বলল, মিলিটারি ক্যাম্পে।
কী?
হ। আমি ধরা পইড়া গেছিলাম। বাবারে আর দাদারে মাইরা ফালানের পর আমরা সবাই পলাইতেছিলাম। বাড়ির সবাই পলাইতে পারছে আমি পারি নাই। আমি ধরা পইড়া গেছি।
জব্বার হলো কমান্ডার। সে কথা বলবার সময় অন্যকেউ কথা বলে না। তারপরও সাহস করে রুনুকে আমি জিজ্ঞাস করলাম, তোরে টর্চার করছে?
রুনু বলল, বহুত টর্চার করছে।
জব্বার বলল, কীভাবে টর্চার করছে?
যত রকমভাবে করা যায়। মারতে মারতে আমার হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙ্গা দিছে। বহুত ম্যান্টাল টর্চার করছে। দেখস না আমার কথাবার্তার ঠিক নাই।
সত্যি রুনু কেমন যেন একটু অ্যাবনরমাল। রুনুর জন্য যে আমার কী খারাপ লাগলো।
জব্বার বলল, মিলিটারির হাত থেকে তুই বাঁইচা আইলি কেমনে?
জামিনে আইছি।
কে তোর জামিন হইছে?
হইছে একটা লোক, তোরা চিনবি না।
কেমনে সে তোর জামিন হইলো?
আর্মির লগে তার খুব খাতির। আমারে দেইখা তার মায়া লাগছে। আমি তার হাতেপায়ে ধইরা কইছি, আপনে আমার জামিন হন, পাঁচটা দিনের লেইগা আমারে ছাড়ান। আমি হিন্দুর পোলা, এক জবানের মানুষ। ঠিক পাঁচদিন পর আপনার কাছে ফিরত আসুম। এই পাঁচদিনে আমি আমার মা ভাইবোনরে খুুঁইজা বাইর করুম। খালি একটু জানতে চাই, তারা বাঁইচা আছে কি না।
আমি বললাম, লোকটা তোরে বিশ্বাস করলো? রাজি হইল তোর কথায়?
হ হইল।
জব্বার বলল, তুই এইসব বলার পর মিলিটারিগ হাত থিকা তোরে ছাড়াইলো কেমনে?
মিলিটারিগ গিয়া সে কইলো, ও খুব ভালো পোলা, আমি ওর জামিন হইলাম। ও পাঁচদিন পর ফিরত আইবো। না আইলে আমারে গুল্লি কইরা মাইরেন।
এই রকম ঘটনা কী ঘটে?
নিজের জীবনের বিনিময়ে অচেনা একটি ছেলেকে কি কেউ এইভাবে ছাড়ায়?
আমরা কেউ কিন্তু ঘটনাটা বিশ্বাস করলাম না। জব্বার আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, রুনুর মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আর্মির টর্চারে ওর সব কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। তোর তো ঘনিষ্ঠ বন্ধু তুই ওরে আড়ালে ডাইকা নিয়া ভালো কইরা সব জাননের চেষ্টা কর।
আমি রুনুকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলাম। রুনু, কই ধরা পড়ছিলি তুই?
রুনু উদাস গলায় বলল, কংশনদী পার হওনের সময়।
আর্মিরা তোরে কই ধইরা লইয়া গেছিল?
কংশনদীর ওইপারের ক্যাম্পে।
অহন তুই কী করবি?
ওই ক্যাম্পে ফিরত যামু।
কচ কী?
হ। যেই লোকটা আমার জামিন হইছে, আমি না গেলে তো সে ছাড়া পাইবো না। তারে তো মিলিটারিরা গুল্লি কইরা মারবো।
আরে বেডা, ওরে লইয়া তুই চিন্তা করছ ক্যান? তারে মিলিটারিরা গুল্লি কইরা মারুক, নাইলে ছাইড়া দেউক, ওইডা তো তোর ব্যাপার না। তুই তোর জান বাঁচা! ওই ক্যাম্পে ফিরত গেলে মিলিটারিরা তো বেডা তোরে গুল্লি কইরা মারবো।
রুনু অপলক চোখে আমার মুখের দিকে তাকালো। তুই এইডা কী কইলি ধলা? আমি আমার মা ভাইবোনরে দেখনের লেইগা পাগল হইয়া গেছিলাম। আমার অনুরোধে অচেনা একটা লোক আমার জামিন হইছে। তুই একবার ভাইবা দেখ তো কতবড় আত্মার মানুষ সে। আমার জন্য জীবনের রিস্ক নিছে। আর আমি তার লগে বেঈমানি করুম? নিজের জীবন বাঁচানের লেইগা জামিনদাররে মাইরা ফালামু। এইডা হয় না দোস্ত। আমার জীবন তো এমনেই শেষ হইয়া গেছে। বাপ মরছে বড়ভাই মরছে। মা আর বইনগুলোও মনে হয় বাঁইচা নাই। ছোট ভাইটাও হয়তো মরছে। তয় আর আমার একলা বাঁইচা থাকনের অর্থ কী? আমি একজন নামকরা হেডমাস্টারের পোলা। জীবন বাঁচানের জন্য ওই রকম বাপের পোলার তো জবান নষ্ট করন ঠিক হইব না।
ওই রাতটা আমাদের সঙ্গে থাকলো রুনু।
সবাই মিলে অনেক বুঝালাম তাকে। তুই যাইচ না রুনু, তুই তোর জানটা বাঁচা।
মানুষ যে নিজের জীবনকে এত তুচ্ছ করতে পারে সেই প্রথম আমি তা টের পেলাম। সতেরো আঠারো বছরের একজন যুবকের কাছে জীবনের চেয়ে যে তার জবানের দাম বড় ওই প্রথম আমি তা দেখলাম।
রুনু কোনও কিছু কেয়ারই করলো না। পরদিন সকালে বলতে গেলে হাসি মুখেই চলে গেল কংশনদীর ওপারকার আর্মি ক্যাম্পে।
রুনুর জন্য আমি খুব কেঁদেছিলাম।
রুনুর সঙ্গে ওই আমার শেষ দেখা।
কংশনদীর ওপারকার আর্মি ক্যাম্প থেকে রুনু আর কখনও ফিরে আসেনি।
জব্বারদের ক্যাম্পে পাগলাটে ধরনের একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। কাছাকাছি এলাকার বেশ বড় ঘরের ছেলে। বাপ হয়েছে শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান, ছেলে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা।
আমি সেদিন ক্যাম্পে।
সেই ছেলেটা জব্বারের কাছে এসে বলল, আজ রাতেই সে তার বাপকে মারতে চায়।
জব্বার বলল, পারবি?
অবশ্যই পারবো।
তয় বাড়িতে গিয়া মারনের কাম নাই। আমগ ক্যাম্পে ধইরা লইয়া আয়।
সত্যি সত্যি রাত দুপুরে মুক্তিযোদ্ধা ছেলে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে এলো শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান বাপকে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝখানে গামছায় চোখ বাঁধা শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান। মুক্তিযোদ্ধা ছেলে তার দিকে রাইফেল তাক করলো।
জব্বার বলল, এই রকম মাইনষের লেইগা গুল্লি খরচা করনের কাম নাই। বাইড়াইয়া মার শুয়োরের বাচ্চারে।
অবিশ্বাস্য কাণ্ড!
সেই ছেলে একা পিটিয়ে মারলো বাপকে।
পাশাপাশি দুটো ঘটনা। জামিনদারের জন্য নিজের জীবন দিতে চলে গেল রুনু। আর মুক্তিযোদ্ধা ছেলে পিটিয়ে মারলো স্বাধীনতা বিরোধী বাপকে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তখন চলে গেছে তুঙ্গে। পাকিস্তান আর্মি গেছে দিশেহারা হয়ে। মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাদের। ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্প থেকে একদিন কয়েক গাড়ি ভরে মিলিটারি গেল হালুয়াঘাটে। কোনও রকমে জান বাঁচিয়ে ফিরতে পারলো মাত্র কয়েকজন। বাকিগুলোকে সাবাড় করে দিয়েছে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্পে অদ্ভুত ধরনের একজন পাকিচ্চানী সোলজার ছিল। লোকটার নাম লাল খাঁ। সে কখনও আর্মির পোশাকই পরতো না। সবসময় সাধারণ পোশাক। পাকিস্তানী সিল্কের প্রিন্ট করা লুঙ্গি আর ঢোলাঢালা কামিজ পরতো। পায়ে চপ্পল। এই পোশাকে সে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াতো। গরিব মানুষের সঙ্গে গিয়ে তামাক খেতো, বাচ্চা কাচ্চাদের সঙ্গে গিয়ে মাঠে ফুটবল খেলতো।
আমার সঙ্গে কেমন কেমন করে একটু খাতির হলো লাল খাঁর।
একদিন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি যে এইভাবে ঘুইরা বেড়াও, মুক্তিযোদ্ধারা যদি তোমারে গুলি করে মারে?
লাল খাঁ বলল, আমারে কেউ মারবো না। কারণ আমি কাউরে মারি নাই। বাঙালি জাতি কোনও অন্যায় করে নাই। অন্যায় করতাছি আমরা। নিরীহ মানুষের ওপর আমরা জুলুম চালাইতাছি। এইটা আমাদের অন্যায়।
লাল খাঁ কথা বলতো বাংলা উর্দু মিশিয়ে। উর্দুর সঙ্গে কিছু কিছু বাংলা শব্দ। তার কথাবার্তা আমরা পরিষ্কারই বুঝতাম। কামিজের পকেট থেকে প্রায়ই সে আমাদেরকে চিঠি বের করে দেখাতো। এই যে দেখ, দেশ থেকে চিঠি আসছে। আমার বউ কান্নাকাটি কইরা চিঠি লিখছে। একটা ছোট বাচ্চা আছে আমার। বাচ্চাটার কথা খুব মনে হয়। তারে খুব দেখতে ইচ্ছা করে।
বাচ্চার একটা ছবি থাকতো লাল খাঁর পকেটে। আমাকে একদিন সেই বাচ্চার ছবিও দেখালো। ফুটফুটে সুন্দর এক শিশুমুখ। দেখে আমার মনে হলো পৃথিবীর সব শিশুর মুখ একই রকম পবিত্র। কোনও শিশুর মুখেই কোনও পাপচিহ্ন থাকে না। শত্রুতা মিত্রতার চিহ্ন থাকে না। শত্রুর সন্তানকে দেখেও ইচ্ছা করে তার মুখটা বুকে চেপে ধরি। কপালে চুমু খেয়ে বলি, মানুষ হও।
মানুষের বয়স বাড়ে। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হয় তারা। কিন্তু অনেক মানুষই আর মানুষ হয় না। দেখতে মানুষের মতো, আসলে জন্তু। যেমন ছিল একাত্তোরের পাকিস্তানী মিলিটারিরা।
লাল খাঁ ছিল বেলুচিচ্চানের লোক।
বেলুচ রেজিমেন্টকে মিথ্যে বলে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল ইয়াহিয়া সরকার। তাদেরকে বলা হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তান দখন করে নিতে চাইছে হিন্দুরা। পাকিচ্চানের অন্যান্য রেজিমেন্টের সঙ্গে তোমরাও যাও পূর্ব পাকিচ্চানে। গিয়ে হিন্দুদেরকে মারো। পূর্ব পাকিচ্চানকে বিধর্মীদের হাত থেকে রক্ষা করো। দুই পাকিচ্চানই মুসলমানদের দেশ। পূর্ব পাকিচ্চানকে হিন্দুদের হাতে তুলে দিও না, দেশটাকে রক্ষা করো।
একথা জেনে পূর্ব পাকিচ্চানে এসেছিল বেলুচ রেজিমেন্ট। এই রেজিমেন্টের সোলজাররা যখন তেজগাঁ এয়ারপোর্টে এসে নেমেছে, গাড়ি চরে যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে, তখন শোনে চারদিককার মসজিদে মসজিদে আজান হচ্ছে। আজানের শব্দ শুনে তারা চমকে উঠেছে। পরস্পর চাওয়া চাওয়ি করেছে পরস্পরের মুখের দিকে। উচ্চপদস্থরা বলাবলি শুরু করলো, আমাদেরকে যে বলা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে কোনও মুসলমান নেই, পূর্ব পাকিচ্চান চলে গেছে হিন্দুদের হাতে, এদেশে তাহলে আজান হচ্ছে কেমন করে? চারদিকে এত আজানের শব্দ!
পরে আস্তে ধীরে খবর নিয়েছে তারা। খবর নিয়ে জেনেছে, ইয়াহিয়া সরকার তাদেরকে মিথ্যে বলে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে অতি সামান্যই হিন্দু। এবং তারা অতিশয় নিরীহ। পূর্ব পাকিচ্চানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সংখ্যা শতকরা আশি ভাগ।
এই তথ্য জানার পর বেলুচ রেজিমেন্টে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। নিরীহ নিরস্ত্র মুসলমানের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করবে না। তারা ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো।
কিন্তু চাইলেই তো ফিরে যাওয়া যায় না। আর্মির নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাম্পে যেতে হলো তাদের। কোথাও কোথাও দু চারজন হিন্দু মারলো তারা। কিন্তু বেশির ভাগ বেলুচ সোলজারই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেনি।
এই তথ্য কথাটা সত্য আমি জানি না। লাল খাঁর কথায় আর আচরণে কিছুটা বিশ্বাস করেছিলাম।
লাল খাঁ একদিন আমাকে বলল, সে হালুয়াঘাট যাচ্ছে। মানে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ক্যাপ্টেনের আদেশ অমান্য করার সাধ্য তার নেই। সুতরাং সে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধ করবে না। সে অবশ্যই ফিরে আসবে। যুদ্ধে তার মৃত্যু হবে না, কারণ সে কোনও মানুষ হত্যা করেনি।
যাওয়ার সময় পরিষ্কার তার চোখে পানি দেখলাম আমি।
কিন্তু লাল খাঁ আর ফিরে আসেনি। হালুয়াঘাটের যুদ্ধে লাল খাঁ মারা যায়। একজন সৎ পাকিস্তানী সৈনিকের মৃত্যু আমাকে কিছুটা দুঃখি করেছিল।
মাঝে মাঝে সারারাত আমার মা উঠোনে বসে নামাজ পড়তো।
ফুটফুটে জ্যোৎস্না রাত হোক কিংবা গভীর অন্ধকার রাত হোক, জায়নামাজের সামনের দিকে একটা মোমবাতি জ্বেলে রাখতো মা আর নামাজ পড়তো। এরকম খোলা জায়গায় বসে আল্লাহকে ডাকার মধ্যে তার এক মানসিক প্রশান্তি কাজ করতো।
ততোদিনে আমাদের দুজন মানুষের সংসারে আবার লেগেছে অভাব অনটন। মার সইয়ের পাঠানো চাল ডাল আনাজপাতি সব শেষ হয়ে গেছে। আমাদের দিন চলে অতিকষ্টে। চারদিকে তখন ভয়াবহ যুদ্ধের ডামাডোল। পুম্বাইল থেকে যে মাউই মা আবার বস্তা ভরে চাল পাঠাবে, তিন চারজন কামলা মজুর দিয়ে পাঠাবে সংসার চালাবার অন্যান্য দ্রব্য সেসবের কোনও উপায়ই নেই।
আমাদের পুরো পাড়াটাতেই চলছে এই রকম অভাব অনটন।
ভালোর মধ্যে কিছুটা ভালো আছে মোচ্চফারা। আমাদের মস্তু। বাজারে ওদের একটা কাপড়ের দোকান আছে আর একটা মুদি দোকান। কাপড়ের দোকানটা বন্ধ পড়ে আছে, মুদি দোকানটা খুলেছে মস্তুর বাবা। টুকটাক কিছু বিক্রিবাটাও হয়। ওই দিয়ে মস্তুদের সংসার চলে। কিন্তু অন্য প্রত্যেকটা বাড়িতেই অভাব।
ওই সময়কার এক রাতের ঘটনা।
উঠোনে নামাজ পড়ছেন মা। সেজদা দিয়ে পড়ে আছেন। কতক্ষণ সেজদায় থাকবে মা নিজেই তা জানে না। আমি শুয়ে আছি আক্কাসের বাড়ি থেকে আনা সেই ছয়খানা টিনের নড়বড়ে চালার তলায়। কিন্তু চোখে ঘুম নেই। উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছি। আনমনা চোখে সেজদা দেয়া মাকে দেখছি। মার মাথার কাছে পিটপিট করে জ্বলছে অর্ধেক শেষ হওয়া মোমবাতি।
হঠাৎ কাছে কোথাও শুনি, গটগট করে শব্দ হচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারি না শব্দটা কিসের। পরমুহূর্তে বুঝে যাই মিলিটারিদের বুটের শব্দ।
তার মানে মিলিটারিরা ঢুকেছে আমাদের পাড়ায়?
আমি চিৎকার করে মাকে ডাকলাম, মা তাড়াতাড়ি ওঠো। মিলিটারি আসতাছে।
মার কোনও সাড়া নেই।
আমি দুবার তিনবার ডাকলাম।
মা সেজদা থেকে উঠলোই না।
আমি আর কী করি! অন্ধকারেই দৌড়ে চলে গেলাম বাড়ির পিছন দিকটায়। সেই ট্রেঞ্চে গিয়ে ঢুকলাম।
ভয়ে হাতপা কাঁপছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ওদিকে আর্মি ততোক্ষণে আমাদের উঠানে। উঠানে এসে দেখে সেজদায পড়ে আছে আমার মা। মাথার কাছে জ্বলছে আধপোড়া মোম।
মাকে এই অবস্থায় দেখে মিলিটারিরা একটু থমকালো তারপর চারদিকে টর্চ ফেলে ফেলে দেখতে লাগলো সবকিছু। আমাদের নড়বড়ে চালা, শূন্য আঙিনা, সব দেখে সেজদা দেয়া মাকে টেনে তুলল। আপকা এক বেটা হায়ঃ
শুনে মা মনে করল, আমাকে খুঁজতে আসছে মিলিটারিরা। ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে।
সে হাউমাউ করে কান্না শুরু করল।
ট্রেঞ্চে বসে মায়ের কান্নার শব্দটা আমি শুনতে পেলাম। শুনে আশ্চর্য এক অনুভূতি হলো। আমাকে না পেলে তো আমার মাকেই ওরা গুলি করে মারবে। আমি বেঁচে থাকবো আর আমার মাকে ওরা মেরে ফেলবে?
না না, এটা হওয়া ঠিক হবে না। আমি যাবো, আমিই মিলিটারিদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। মারতে হলে আমাকেই মারুক ওরা।
এই ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে দেখি, আমার হাত পায়ের কাঁপন বন্ধ হয়ে গেছে। বুকের ভেতর কোত্থেকে এসেছে অদৃশ্য এক সাহস। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে আমি যেন আমি না, আমি যেন আসলে রুনু হয়ে গেছি। আমার সেই বন্ধু রুনু, মা বাবার খোঁজে আর্মি ক্যাম্পে একজনকে জামিনে রেখে পাঁচদিনের জন্য বেরিয়ে এসেছিল। আমরা হাজারবার বলার পরেও নিজের জীবনের কথা সে ভাবেনি। জামিনদারকে বাঁচাতে ফিরে গিয়েছিল সেই আর্মি ক্যাম্পে।
রুনু বাঁচাতে গিয়েছিল জামিনদারকে, নিজের জীবনের বিনিময়ে। আর আমি আমার জীবনের বিনিময়ে নিজের মাকে বাঁচাবো না?
ট্রেঞ্চ থেকে বেরিয়ে উঠানে এসে দাঁড়ালাম মিলিটারিদের সামনে।
আমাকে দেখে মায়ের কান্না আরও বেড়ে গেল। দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে আমাকে আড়াল করে দাঁড়াল।
একজন অফিসার তীক্ষ্মচোখে আমার দিকে তাকালো। ইয়ে কোন হায়?
মা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ওরে মাইরেন না বাবারা, ও আমার ছোটছেলে। আমরা দুজনই আছি। আর কেউ বাঁইচা আছে না মইরা গেছে জানি না।
অফিসার বাংলা উর্দু মিশিয়ে বলল, আপকা কই ডার নেহি হায়। হামলোগ মার নে কে লিয়ে নেহি আয়া।
তারপর পকেট থেকে কিছু টাকা বের করল। আপকা এক বেটা হায়, দাউদ কোম্পানি মেঃ
ঘটনা কিন্তু একেবারেই অন্যরকম। যে অফিসার কথা বলছে সে আসলে একজন মেজর। আজই ঢাকা থেকে ঈশ্বরগঞ্জে এসেছে। ঢাকায় দাউদ কোম্পানির অফিসে বড়ভাইয়ের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। কথায় কথায় সে বড়ভাইকে বলেছিল তাকে যেতে হচ্ছে ঈশ্বরগঞ্জে। শুনে বড়ভাই করেছে কি, সেই মেজরকে কিছু টাকা দিয়েছে, দিয়ে বলেছে, ঈশ্বরগঞ্জ ডাকবাংলোর ক্যাম্পের খুব কাছে আমাদের বাড়ি। সেই বাড়িতে আমার মা, ছোটভাই আর ছোটবোন আছে। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি তা তারা জানে না। তাদের সংসারেও খুব অভাব। এই টাকাটা তুমি আমার মায়ের হাতে পৌঁছে দিও। রাত দুপুরে মেজর তার বাহিনী নিয়ে আমাদের বাড়িতে এসেছে সেই টাকা পৌঁছে দিতে।
শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম আমি আর আমার মা। একদিকে ভাই যে ভাবী বাচ্চা আর ছোটবোনকে নিয়ে বেঁচে আছে এটা নিশ্চিত হলাম, অন্যদিকে ভাইয়ের পাঠানো টাকায় দুজন মানুষ বেশ কিছুদিন খেয়ে পরে বাঁচতে পারবো।
মনে আছে, বারোশো টাকা পাঠিয়েছিল ভাই। একাত্তোর সালে বারোশো টাকা মানে বিশাল ব্যাপার। দুজন মানুষের তিন চারমাস চলে যাবে।
মার হাতে টাকাটা দিয়ে মেজর তাকালো তার সঙ্গে আসা মিলিটারিদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে চটের বড় একটা ব্যাগ হাতে একজন এগিয়ে এলো। সেই ব্যাগ থেকে একে একে বেরুলো সাদা দুখানা ধুতি, বাঁশপাতার শক্তঠোঙায় সুতলি দিয়ে বাঁধা তিন চারসের চিনি, আর বিশাল বিশাল দুটো লিপটন চায়ের প্যাকেট।
সেই মেজরের সঙ্গে ভাই এসব জিনিসও পাঠিয়েছে।
চলে যাওয়ার সময় মেজর জিজ্ঞেস করলো, আপনার ছেলে বলেছিল, তার একটা বোনও আছে এই বাড়িতে। অর্থাৎ আপনার মেয়ে, সে কোথায়?
মা বলল, সে আছে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে।
মেজর বলল, ইচ্ছা করলে সে এই বাড়িতে এসেও থাকতে পারে। আপনাদের কোনও ক্ষতি কেউ করবে না।
মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর মা আবার সেজদায় পড়লো। অনেক কান্নাকাটি করলো আল্লাহর কাছে। শোকর গুজার করলো।
আমার মনে যে তখন কী আনন্দ। যাক আমার ভাইটা বাঁইচা আছে।
পরদিন অল্পকিছু টাকার বাজার করে দিলাম মাকে। সংসারে যা যা লাগে কিনেকেটে দিয়ে নিজে বেরিয়ে গেলাম খবর সংগ্রহের কাজে।
মিলিটারি আর রাজাকাররা তখন নিজেরাই আছে বেশ পেরেশানির মধ্যে। এখন আর মেয়ে টেয়ে ধরে এনে ফুর্তি করার সময় নেই তাদের। তারা পাগলের মতো ঘুরছে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে। মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে দুচারজন সাধারণ মানুষ ধরে নিয়ে আসে, এনে ভয়ানক টর্চার করে। ডাকবাংলোর আঙিনায় একটা জাম্বুরা গাছ ছিল। পা উপরের দিকে, মাথা নিচের দিকে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে নিরীহ লোকগুলোকে ঝুলিয়ে রাখতো। লোকগুলোর কী যে চিৎকার, কী যে আর্তনাদ আমার কানে আসতো। ঢুফির বাজারে গিয়ে জব্বারদেরকে এসব জানিয়ে আসতাম।
একদিন একটা বিভৎস্য দৃশ্য চোখে পড়ল।
তার আগের রাতে অনেকদিন পর একটা মেয়ের চিৎকার শুনেছিলাম আর্মি ক্যাম্পে। বাবা গো, বাবা গো, মইরা গেলাম গো। আমারে ছাইড়া দাও, তোমরা আমার বাবা।
পরদিন সকালে স্টেশনের দিকে গেছি, রাচ্চার ধারে দেখি একজন যুবতী মেয়ের লাশ পড়ে আছে। শরীরের এদিক ওদিক রক্তমাখা। মুখটা হা হয়ে আছে। কোনও রকমে একটা কাপড় প্যাঁচিয়ে ঢাকা হয়েছে তার লজ্জাস্থান। পথচারিরা আড়চোখে দেখছে লাশ। কিন্তু মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াচ্ছে না, দ্রুত হেঁটে পেরিয়ে যাচ্ছে জায়গাটা।
সেদিনই ঢুুফির বাজার গিয়ে ঘটনাটা বললাম জব্বারকে।
জব্বার গম্ভীর গলায় বলল, আর মাত্র কয়টা দিন।
কথা বলবার সময়, লক্ষ্য করলাম জব্বারের চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে, দাঁত কিড়মিড় করছে। অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে করতে নিজের চুল যেন নিজেই টেনে ছিঁড়ে ফেলছে।
গৌরিপুর রাজবাড়িতেও ক্যাম্প করেছে মুক্তিযোদ্ধারা।
কিন্তু শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের ওখানে ভয়াবহ নরহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তান আর্মি। ট্রেন ভরে, মালগাড়ি ভরে, মানুষ ধরে ধরে আনছে কোন কোন জায়গা থেকে। ব্রিজের কাছে এনে লাইন করে দাঁড় করাচ্ছে। তারপর পাখির মতো গুলি করে মারছে। কিশোরগঞ্জ থেকে, আঠারো বাড়ি থেকে, সোহাগী থেকে মানুষ এনে শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের ওখানে মারছে। মেরে ফেলে দিচ্ছে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীতে। মানুষের পঁচা লাশ খাচ্ছে কাক, কুকুরে।
আমি একদিন আর্মির হাতে ধরা পড়ে গেলাম।
খানিক আগে ঢুফির বাজার থেকে ফিরেছি। সকালবেলা দৌড়ে গেছি জব্বারদেরকে এই এলাকার খবর জানাতে। তেমন কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর ছিল না। তবু নিয়ম মাফিক যা জানাবার জানিয়ে এলাম। যেমন দৌড়ে দৌড়ে গিয়েছিলাম, তেমন দৌড়ে দৌড়েই ফিরে এসেছি। তারপরও দেখি দুপুর প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এমন খিদা লেগেছে, বাড়ি ঢুকে দেখি মা রান্নাবান্না গোসল সেরে জোহরের নামাজ পড়ার জন্য তৈরি হয়েছে। চালার তলায় মাত্র জায়নামাজ বিছিয়েছে, আমি বললাম, খুব খিদা লাগছে মা, তাড়াতাড়ি ভাত দাও।
মা বলল, নামাজ পড়া শেষ করি, তারপর।
আমার আর খিদা সহ্য হচ্ছিল না। তারপরও মার জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। পুকুরে গিয়া একটা ডুব দিয়ে এলাম। গামছায় শরীর মাথা মুছে, লুঙ্গি পরে বাড়ির বাইরের দিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। ওখানটায় একটা বেলগাছ, প্রায় মাটিতে শুয়ে পড়েছে। কোনও কোনও সময় ওই গাছটায় আমরাও চিৎ হয়ে শুয়ে পড়তাম। বেলগাছে বড় বড় কাঁটা থাকে। সেইসব কাঁটা থাকে মাথার দিককার সরু সরু ডালপালায়, গোড়ার দিকটায় থাকে না। সুতরাং আরাম করেই শোয়া যেত গাছটার ওপর।
পেটের খিদা চেপে রাখার জন্য বেলগাছটাকে কোলবালিশের মতো জড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছি আমি। নামাজ শেষ করেই ভাত বাড়বে মা, আমাকে ডাকবে। সেই অপেক্ষায় আছি।
প্রচণ্ড খিদায় একটু কী তন্দ্রামতো আসে মানুষের? নাকি শরীর অবসন্ন হয়ে কোনও একটা ঘোর তৈরি হয়? আমারও বোধহয় তেমন কিছু হয়েছিল। সেই ঘোরের মধ্যে হঠাৎ শুনি আমার খুব কাছে চারদিকেই ছুটোছুটি করছে অনেকগুলো বুটপরা পা। বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়েও যেন এগিয়ে আসছে ওরকম অনেক বুটের শব্দ।
চট করেই গাছ থেকে নেমেছি।
নেমে দেখি, চারদিকেই মিলিটারি। এস এম জি, এল এম জি বুকের কাছে ধরা, কারও হাতে রাইফেল, কারও হাতে স্টেনগান। আমাদের পুরো পাড়া ঘেরাও করে ফেলেছে। খালি গায়ে লুঙ্গিপরা আমি। আমার চুল থাবা দিয়ে ধরলো একজন। ধরে সমানে থাপ্পড়, সমানে লাথি। এমনিতেই ক্ষুধায় কাতর, তার ওপর ওরকম মার! চোখের সামনে হাজার হাজার সর্ষে ফুল দেখছি আমি। আমার মাথা ঘুরছে, আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। সর্ষে ফুলের জায়গায় চোখে নেমে আসছে ঘোরতর অন্ধকার।
আস্তে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছি।
ওই অবস্থায়ও মুহূর্তকালের জন্য আমার মনে হলো, আমি যে মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফরমার, মিলিটারিরা কী সেই কথা জেনে গেছে?
তাহলে তো আমার বাঁচার আর কোনও পথ নেই।
এখনই গুলি করে মারবে আমাকে।
তখনই আরেকজন রাইফেলের বাট দিয়ে ধামাধাম কয়েকটা বারি মারলো পিটে। তীব্র যন্ত্রণায় প্রাণ ফাটানো চিৎকার দিচ্ছি আমি।
আমার মা সেই মুহূর্তে কোথায়, পাড়ার লোকজন কে কোথায়, কিছুই আমি জানি না।
মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলাম।
কিন্তু জ্ঞান হারায়নি।
জ্ঞান আমার আছে।
নাকমুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। উপুড় হয়ে পড়ার ফলে মুখের কাছটায় রক্তে ভিজে উঠেছে মাটি। সেই অবস্থায় দেখি, বুকের কাছে এস এম জি ধরে মিলিটারিদের একজন এগিয়ে এলো আমার কাছে। চুল ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বসিয়ে ফেলল আমাকে। বইঠ, ছালা ছুয়ার কি আওলাদ।
মাটিতে অসহায় ভঙ্গিতে বসে রক্তমাখা মুখ নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে মিলিটারির দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। আমার তখন একটাই কথা মনে পড়ছে। মৃত্যু আমার আর কতটা দূরে? কখন গুলিটা ওরা করবে? কোন মুহূর্তে এই পৃথিবী ছেড়ে যাবো আমি?
আমার তখন মার কথা মনে পড়ে না, ভাইবোনদের কথা মনে পড়ে না। বন্ধুবান্ধব কিংবা প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে না। দিলুর কথাও মনে পড়ে না। মৃত্যু ভয়ে আল্লাহকে ডাকতেও ভুলে যাই আমি।
ক্যাপ্টেন বা মেজর ধরনের একজন অফিসার এলো এসময়। মুঠি করে ধরলো আমার চুল। টেনে হেঁচড়ে নিয়ে গেল রাচ্চায়। নিয়ে আবার সেই গালাগাল, বইঠ, ছালা ছুয়ার কি আওলাদ।
বসতে গিয়ে দেখি, আমার মতন অনেক মানুষ লাইন ধরে বসে আছে। মিলিটারিরা আরও মানুষ ধরে আনছে। আরও মানুষকে লাইন ধরে বসাচ্ছে। লাইন শুধু লম্বাই হচ্ছে।
নাকমুখের ব্যথা রক্ত এসবের কিছুই আমি আর টের পাচ্ছি না। শুধু টের পাচ্ছি বাঁপায়ের বুড়ো আঙুলটায় কী রকম একটা জ্বলুনি, কী রকম একটা ব্যথা। মুমূর্ষু চোখে তাকিয়েছি। দেখি, বাঁপায়ের বুুড়ো আঙুলের পুরো নখটা ওঠে গেছে। টপটপ করে রক্ত পড়ছে সেই আঙুল থেকে।
ওদিকে একটার পর একটা সাধারণ মানুষ ধরে আনছিল মিলিটারিরা। বাড়ির ভিতর থেকে, বাড়ির বাইরে থেকে। পুকুরে গোসল করতে নেমেছিল লোক, ভেজা কাপড়ে তাদেরকেও ধরে এনেছে। কেউ কেউ সাবান মেখে গোসল করছিল, গায়ে তখনও রয়ে গেছে সাবানের ফেনা।
কতক্ষণ পর দেখি, আমার মাকেও ধরে এনেছে।
কিন্তু মিলিটারিরা কাউকেই মারছে না, কাউকেই কোনও টর্চার করছে না, কিছু বলছেও না। শুধু পাড়ার আণ্ডাবাচ্চা থেকে শুরু করে সব মানুষ ধরে এনে পুকুরপাড়ে লাইন ধরে বসিয়েছে। লাইন করেছে দুটো। একলাইনে পুরুষ, আরেক লাইনে মহিলা।
আমরা যে পুকুরপাড়ে বসে আছি, তার পাশেই রেললাইন। হঠাৎ রেলগাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ পাওয়া গেল। তাকিয়ে দেখি, স্টেশনের দিক থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে একটা মালগাড়ি। আমরা সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। সবাই বুঝে গেছে, আমাদেরকে এখন এই মালগাড়িতে তোলা হবে। বগি ভরে ভরে নিয়ে যাওয়া হবে ময়মনসিংহের দিকে। শম্ভুগঞ্জ ব্রিজের কাছে নিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে আবার লাইন ধরে দাঁড় করাবে। সামনে ব্রক্ষ্মপুত্র নদী, পিছনে পাকিচ্চান আর্মি। ট্যা ট্যা করে গুলি ছুঁড়বে। আর আমরা একেকজন লুটিয়ে পড়বো ব্রক্ষ্মপুত্রের জলে। পরদিন আমাদের লাশ ভাসতে থাকবে নদীর এদিক এদিক। পানি সাঁতরে কুকুররা যাবে না সেই লাশ খেতে। ক্ষুধার্ত কাকগুলো উড়ে উড়ে গিয়ে বসবে আমাদের লাশের ওপর। ঠুকরে ঠুকরে খাবে আমাদের চোখ নাক ঠোঁট।
আমার তখন মার মুখটা দেখতে ইচ্ছা করছে।
কই, কোথায় আমার মা?
ওই তো, ওই যে দূরে বসে আছে।
আমাকে তাকাতে দেখে মাও তাকিয়েছে আমার দিকে। চিৎকার করে বলল, ডরাইস না বাজান। কিছু হইব না। আল্লারে ডাক।
আমার শরীরে তখন কোনও রকমের কোনও অনুভূতি নেই। আল্লাহকে ডাকার ক্ষমতাও যেন লোপ পেয়েছে।
এসময় একজন আর্মি অফিসার এগিয়ে এলো।
ছফুটের মতো লম্বা। টকটকে ফর্সা গায়ের রং। চেহারা খুব সুন্দর। সে এসে ইংরেজিতে বলল, তোমাদের মধ্যে ভালো উর্দু কে জানে?
আমাদের মস্তুর এক বোনজামাই ঢাকায় থাকতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঈশ্বরগঞ্জে চলে এসেছে। সেও বসেছিল আমাদের সঙ্গে লাইন ধরে। অফিসারের কথা শুনে উঠে দাঁড়াল, ম্যায় জানতা হো।
মস্তুর বোনজামাই গোসল করতে নেমেছিল পুকুরে। ওই অবস্থায় তাকে ধরে আনা হয়েছে। লোকটার শরীর মাথা সবই ভিজা।
আর্মি অফিসার তাকে উর্দুতে বলল, তুমি সবাইকে বুঝিয়ে বলো, আমরা তোমাদেরকে ধরেছি একটা বিশেষ কারণে। পাকিস্তান আর্মির একজন বাঙালি কর্নেল, তার নাম কর্নেল তাহের। সে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে এসেছে। আমরা শুনেছি এই এলাকায় সে গা ঢাকা দিয়ে আছে। ধারণা ছিল তোমাদের মধ্যেই একজন সেই কর্নেল তাহের। আমরা নানা রকমভাবে পরীক্ষা করে দেখলাম, তোমাদের মধ্যে কর্নেল তাহের নেই। কিন্তু আমরা এও জানি, এই পাড়াতেই কর্নেল তাহেরের শ্বশুরবাড়ি। তার শ্বশুর খুবই নামকরা ডাক্তার। ঠিক আছে, তোমরা যাও, তোমরা মুক্ত।
কর্নেল তাহেরের শ্বশুর, সেই হৃদয়বান বিশাল মাপের ডাক্তার মানুষটিকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল ডাক্তার সাহেবের আরেক মেয়ে নিলুফারকে।
কর্নেল তাহেরের স্ত্রীর নাম লুৎফা। আমি ডাকতাম লুৎফা আপা।
নিলুফার ছিল আমার বন্ধু।
পুরোনাম নিলুফার ইয়াসমিন। সাবিনা ইয়াসমিনের বড়বোন, খান আতাউর রহমানের স্ত্রী, বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিনের সঙ্গে আমার বন্ধু এই নিলুফার ইয়াসমিনের বেশ একটা মিল ছিল। আমাদের নিলুফারও গান গাইতো। আমি গান গাই, নিলুফার গান গায়। যখন তখন ওদের বাড়িতে ছুটে যাই আমি। পেয়ারাগাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে পেয়ারা ভাগ করে খাই দুজনে। বাড়ির ছেলের মতোই সবাই আমাকে ভালোবাসে। লুৎফা আপা যখন বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসে তখন আমাদের কত আবদার, আপার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে কত যে চকলেট বিস্কুট খেয়েছি! রসোগোল্লা খাওয়ার টাকাও অনেকবার দিয়েছেন লুৎফা আপা।
আর ডাক্তার সাহেবের তো কোনও তুলনাই ছিল না। এলাকার গরিব দুঃখি মানুষের চিকিৎসা করতেন বিনা পয়সায়। ফার্মেসি খালি করে গাদা গাদা ওষুধ দিয়ে দিতেন রোগীদের। পয়সা নিতেন না।
এইরকম একজন মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর্মি? সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের নিলুফাকে?
ভয়ে আতঙ্কে জড়োসড়ো হয়ে আছে নিলুফা। বাবার পাশে যখন তাকে গাড়িতে বসিয়েছে মিলিটারিরা, নিঃশব্দে কাঁদছিল নিলুফা। সেই অবস্থায় আমার দিকে একবার চোখ পড়ল। কী যে করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে, আমার বুকটা তোলপাড় করতে লাগলো।
মিলিটারিরা যাদেরকে ধরে নিয়ে যায় তারা কি আর ফিরে আসে?
নিলুফা কি ফিরে আসবে?
ডাক্তার সাহেব কি ফিরে আসবেন?
মনে আছে, এই দুজন মানুষের জন্য আমি আল্লাহর কাছে অনেক কেঁদেছিলাম। আল্লাহ তুমি তাদেরকে সহি সালামতে রেখো, তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখো, তাদেরকে ইজ্জতের সঙ্গে ফিরিয়ে এনো।
পরের দিন কর্নেল তাহেরের মা এলেন আমাদের এলাকায়। তিনি খবর পেয়েছিলেন তার বিয়াই আর বিয়াইয়ের মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে মিলিটারিরা। তাদের বাড়ি হচ্ছে শম্ভুগঞ্জের ওদিককার এক গ্রামে। সাত ছেলের জননী তিনি। অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী, দেখলেই শ্রদ্ধা জাগে এমন একজন মানুষ। তিনি এসেছেন শুনে গ্রামের মানুষজন একত্রিত হয়েছে। সেই মানুষজনের সামনে দাঁড়িয়ে অসাধারণ কিছু কথা বললেন তিনি। আমার সাতছেলে, সাতজনকেই যুদ্ধে পাঠিয়েছি। এদেশের প্রতিটি যুবক আমার ছেলে। এদেশের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা আমার ছেলে। যদি আমার সাতছেলের সাতজনই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়, যদি সাতজনই প্রাণ দেয় দেশের স্বাধীনতার জন্য, আমার একটুও দুঃখ হবে না। আপনাদের এলাকার যার যেটুকু সামর্থ্য আছে, তাই নিয়ে আপনারা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করুন। একজনও বসে থাকবেন না। আপনারা কী করছেন? বসে আছেন কেন? যুদ্ধে যাচ্ছেন না কেন?
মানুষজন সব উদ্দীপ্ত হয়ে গেল।
তিনি বললেন, মানুষের যেমন মা বাবার প্রতি দায় থাকে, মা বাবার কাছে যেমন ঋণী থাকে সন্তান, দেশের কাছেও ঠিক সেইরকম ঋণ থাকে মানুষের। মনে রাখতে হবে, এই দেশের কাছে, এই মাটির কাছে আপনারা সবাই ঋণী। এই এক সুযোগ আপনারা যুদ্ধে চলে যান। দেশ স্বাধীন করে দেশ এবং মাটির ঋণ শোধ করুন।
একজন সত্যিকার মায়ের চেহারা কেমন হয়, কর্নেল তাহেরের মাকে দেখে আমি সেদিন বুঝেছিলাম।
মুক্তিযুদ্ধ তখন চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে এগুচ্ছে। চারদিক থেকেই আসছে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের সংবাদ। পাকিস্তান আর্মির খুবই নাস্তানাবুদ অবস্থা। সোহাগী বাজারে হঠাৎ করে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান আর্মির বেশ কয়েকজনকে মেরে ফেলল মুক্তিযোদ্ধারা। রামগোপালপুরেও ঘটল একই ঘটনা। ভৈরবের দিকে পাকিস্তান আর্মির বিরাট এক দলকে ছিন্নভিন্ন করে দিল মুক্তিযোদ্ধারা। এখন যে কোনওদিন আক্রমণ চলবে ঈশ্বরগঞ্জ ক্যাম্পে।
ঢুফির বাজারে জব্বারদের খবর নিতে গেছি।
গিয়ে দেখি ক্যাম্প নেই। ক্যাম্প ওঠে গেছে। কোথায় চলে গেছে আমার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা, কিছুই বুঝতে পারছি না। হতাশ হয়ে ফিরে এলাম।
গ্রামে এসে শুনি আরেক দুঃসংবাদ। আক্কাস বদমাশটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ করে কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে সে। রাজাকার আলবদর আলশামস সব মিলে শান্তিবাহিনী। শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান ওসমান গনি বহাল তবিয়তে আছে। নেই শুধু আক্কাস। বাড়িতে বউ বাচ্চা সবাই আছে, আক্কাস উধাও।
কোথায় গেল সে?
কেন গেল?
আমার মন হতাশায় ভরে গেল। আক্কাসের ওপর কি আমার সেই প্রতিশোধ নেয়া হবে না? আমাদের বাড়ি লুট করেছিল, সেই লুটের প্রতিশোধ কি আমি নেবো না?
আক্কাসের কথা ভেবে সেই রাতটা আমি আর ঘুমাতেই পারলাম না।
কর্নেল তাহেরের শ্বশুর, সেই মহান ডাক্তারের নাম খোরশেদ আলম।
তাঁকে এবং তাঁর মেয়ে নিলুফারকে দুদিন পর সসম্মানে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল মিলিটারিরা। তাদের গায়ে ফুলের টোকাটিও দেয়নি।
এইভাবে পাচ্চিান আর্মির হাত থেকে ফিরে আসা সত্যি খুব বিস্ময়কর ঘটনা। কিন্তু ডাক্তার সাহেব আর তাঁর মেয়ে ফিরে এসেছিলেন। বোধহয় মানুষের ভালোবাসায় আল্লাহ তাঁদেরকে প্রিয় মানুষের কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
আমি, আমার মা ও কবরের অন্ধকার
সইয়ের বাড়িতে বসে খবরটা মা পেয়ে গেলেন। আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। গ্রামে মিলিটারি এসেছে, জ্বালাও পোড়াও করেছে, মানুষ মেরেছে। কিন্তু আমাদের বাড়িটা মিলিটারিরা লুটপাট করেনি।
কে করেছে?
লুট হয়ে যাওয়া বাড়িতে ফিরেই আমি তা জেনে গিয়েছিলাম।
তখনও দুপুর হয়নি।
লুট হয়ে যাওয়া বাড়ির আঙিনায় বসে শিশুর মতো কাঁদছি। অদূরে লুটের হাত থেকে বেঁচে থাকা আমাদের একমাত্র সম্পদ মায়ের কোরআন শরীফটা রেহালের ওপর রাখা।
আমি কাঁদছিলাম সেই দিকে তাকিয়ে।
দুপুরের পর পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলেন মা। চার পাঁচমাইল দূরের কুম্বাইল গ্রাম থেকে ছুটতে ছুটতে এসেছেন। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি এসেছে, যেকোনও বিপদ আপদ হতে পারে রাস্তায়, মা সেইসব কেয়ারই করেননি। তাঁর পরনে সস্তা ধরনের একটা প্রিন্টের শাড়ি। বাড়িতে ঢুকে দেখে মাটিতে অসহায় ভঙ্গিতে বসে কাঁদছি আমি। প্রথমেই আমার দিকে তাকালেন না মা। চারদিক তাকিয়ে ফাঁকা শূন্য বাড়িটা দেখলেন। রেহালের ওপর রাখা কোরআন শরীফটা দেখে ছুটে গিয়ে সেই কোরআন শরীফ বুকে চেপে ধরলেন।
তারপর তাকালেন আমার দিকে।
একহাতে বুকে ধরা কোরআন শরীফ, অন্যহাত রাখলেন আমার মাথায়। কান্দিস না বাজান, কান্দিস না। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
মাকে দেখে আমার কান্না আরও বেড়ে গেছে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমগ কিছু নাই মা। আমরা পথের ফকির হইয়া গেছি।
মা আবার সেই কথা বললেন, ধৈর্য ধর।
পথে আসতে আসতে মা বোধহয় খবর পেয়ে গিয়েছিলেন কে লুট করেছে আমাদের বাড়ি।
সেই বদমাশ কেরামত আলীর ভাই। লোকটার নাম ফজল আলী।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়ে ফজলের বাড়িতে গেলেন মা। গিয়ে দেখেন আমাদের বাড়ির টিন কাঠ খাট চৌকি চেয়ার টেবিল এমনকি হাঁড়িপাতিল থালাবাসন পর্যন্ত সেই বাড়ির উঠানে। ফজল আর তার বড়ভাই কেরামত দুজনে আমাদের দুটো চেয়ার নিয়ে বসে আছে।
মা গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালেন। ফজল এইটা তুমি কী করছ? আমার বাড়ির ঘরদুয়ার সব লুট করলা?
ফজল না, কেরামত কেলানো একটা হাসি হাসল। আমরা লুট করি নাই। লুটের হাত থিকা বাঁচাইছি।
কেমনে বাঁচাইলা? আমার বাড়ির সব জিনিস দেখি তোমগ উঠানে পইড়া রইছে।
সব আপনের না মামানী।
তয় কার?
এই উঠানে যেইসব জিনিস দেখতাছেন, এইসব জিনিস এই পাড়ার আরও কয়েকজন মাইনষের। যাগো যাগো বাড়ি লুট হইতেছিল, সেইসব বাড়িতে গিয়া লুটতরাজ করা মানুষগ আমরা ঠেকাইছি। তাগো হাত থিকা জিনিসপত্র যতটা রক্ষা করতে পারছি, সব এই বাড়িতে লইয়া আইছি।
কও কী?
এবার কথা বলল, ফজল। হ মামানী, আমরা আপনের লগে মিছাকথা কই না।
মা চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছেন আমাদের বাড়ির সব জিনিস ফজলের বাড়ির উঠানে। তারপরও তারা বলে ওইসব জিনিস নাকি আমাদের না!
মা অনেকক্ষণ তর্ক বিতর্ক করলেন তাদের সঙ্গে। কাজ হলো না, মার কথা ওরা পাত্তাই দিল না।
শেষপর্যন্ত মা বললেন, তোমরা কী কইতে চাও উঠানের এইসব জিনিসের মধ্যে কিছুই নাই আমার?
কেরামত বলল, আছে।
কী আছে?
আপনের বাড়ির ছয়খান টিন আছে।
মাত্র ছয়খান টিন?
হ। লুটতরাজকারীদের হাত থিকা আপনের বাড়ির মাত্র ছয়খান টিনই আমরা বাঁচাইতে পারছিলাম। আপনের ছয়খান টিন আপনে লইয়া যান।
মা আর কোনও কথা বললেন না, বাড়িতে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। মা আর আমি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ধরাধরি করে ছয়টা টিন নিয়ে এলাম বাড়িতে। ওই ছয়খানা টিনই তখন আমাদের সম্বল, আর কিচ্ছু নেই। মার পরনে প্রিন্টের সস্তা একটা শাড়ি। আমার পরনে হাঁটুর কাছে ছেঁড়া ফুলপ্যান্ট, আর কোড়া রঙের অতি পুরনো একটা স্যান্ডোগেঞ্জি।
মনে আছে, ছেঁড়া প্যান্টটার রঙ ছিল খয়েরি।
ততোক্ষণে বিকেল হয়ে গেছে।
আমাদের খাওয়া হয়নি কিছুই। কোত্থেকে হবে, বাড়ির কোথাও কিছু নেই। সবই লুট হয়ে গেছে। আমার চোখের পানি আর ফুরায়ই না, শুধু ভাইয়ের কথা মনে হয়। কোথায় আছে আমার বড়ভাই, ভাবী আর ছোটবোন? কোথায় আছে আমার সেই বাউণ্ডুলে মেজোভাই, কে জানে? বেঁচে আছে , না মরে গেছে সবাই তাই বা কে জানে? যে বাড়িতে, যে ঘরের চার দেয়ালের মাঝখানে, মাথার ওপর রোদ বৃষ্টি ঠেকাবার চালা ছিল যে ঘরে, সেই ঘরের ভিতর জড়াজড়ি করে বড় হওয়া, জড়াজড়ি করে বেঁচে থাকা মানুষগুলো আজ কে কোথায়? পাকিস্তানী জন্তুগুলো হামলার পর হামলা চালিয়ে কোথায় কীভাবে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে আমাদেরকে। তাদের হামলার সুযোগে আমাদের কিছু নিজস্ব মানুষও নিঃস্ব করে দিয়েছে আপনজনকে।
অন্যদের কথা আমি তখন ভাবতে পারছিলাম না, ভাবছিলাম শুধু আমার আর আমার ওই দুঃখিনী মায়ের কথা।
এই দুজন মানুষ
আমরা বাঁচবো কী করে?
মাথা গুঁজবো কোথায়?
খাবো কী?
পরবো কী?
বুকে কোরআন শরীফটা মা ধরেই রেখেছেন। এই অবস্থায় আমাদের একমাত্র অবলম্বন ওই পবিত্র গ্রন্থ। যেন এই গ্রন্থই যাবতীয় বিপদ আপদ থেকে, ঝড়ঝঞ্জা থেকে রক্ষা করবে অসহায় মা এবং ছেলেকে।
আমার কান্না থামে না দেখে মা আমাকে বুঝাতে লাগলেন, এইভাবে কান্দিস না। কান্দন থামা। এইটাও আল্লাহর একটা পরীক্ষা। আল্লাহপাক বিপদ আপদ দিয়া তার বান্দাগো পরীক্ষা করে। ধৈর্য ধর, আল্লাই পথ দেখাইবো।
ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
কোথায় রাত কাটাবো আমরা?
চারপাশের যেকোনও বাড়িতে গিয়েই রাত কাটাতে পারি। কোনও বাড়িতেই সেভাবে লোকজন কেউ নেই। বেশিরভাগ বাড়িই খালি পড়ে আছে। যেকোনও একটাতে গিয়ে উঠলেই হয়।
মা বললেন, নিজের বাড়ি ছাইড়া আমি কোনখানে যামু না।
আমি অবাক! তাইলে থাকবা কই?
এই বাড়িতেই থাকুম।
এই বাড়িতে তো ঘরদুয়ার কিচ্ছু নাই?
তারপরও এই বাড়িতেই থাকুম।
গ্রামে যখন তখন আসতে পারে মিলিটারি। গুলি করে আর বাড়িঘরে আগুন দিয়ে মারতে পারে সবাইকে। এসব শোনার পর থেকে প্রত্যেক বাড়িতেই বড় বড় গর্ত করা হয়েছিল, অর্থাৎ বাংকার করা হয়েছিল। থানাঅলারা আর গ্রামের নেতৃস্থানীয় লোকের বুদ্ধি পরামর্শে প্রত্যেক বাড়িতে বাংকার করেছিল লোকে। আমাদের বাড়িতে বড় একটা বাংকার করেছিলাম আমি। অনেকটা কবরের আকৃতি। বাড়ির পিছন দিকটায়। ভিতরে বসে থাকলে বাইরে থেকে দেখে মিলিটারিরা যেন কিছু অনুমান করতে না পারে এইভাবে করেছিলাম বাংকারটা। ঝোঁপঝাড়ের ভিতরে বাংকার করে তার ওপর আড়াআড়ি করে বাঁশ ফেলে বাঁশের ওপর চালার মতো করে দিয়েছিলাম বাঁশের তৈরি একটা বেড়া, তার ওপর কয়েক ঝুড়ি মাটি আর মাটির ওপর কিছু ঝোঁপঝাড়। একদিককার মুখ ফাঁকা। সেই দিক দিয়ে বাংকারে নামা যাবে। ওই মুখটার ওপর ফেলে রেখেছিলাম আলগা একটা বেড়া। বাংকারে নেমে সেই বেড়া টেনে দিলে বোঝা যাবে না এর ভেতর মানুষ আছে কী না?
মা বললেন, রাতটা আমরা ওই গর্তে কাটামু।
শুনে আমি চমকে উঠলাম। কও কী তুমি?
হ।
ওই রকম জায়গায় সারারাত বইসা থাকতে পারবা?
পারুম। তুই পারবি কী না সেইটা ক?
তুমি পারলে আমিও পারুম।
তয় আর চিন্তা নাই।
কিন্তু খাইবা কী? খাওনের তো কোনও পথ দেখতাছি না।
কাইল সকাল পর্যন্ত না খাইয়া থাকন লাগবো। পারবি না?
আমি কাতর গলায় বললাম, আমার তো অহনই খিদায় পেট জ্বইলা যাইতাছে।
মা বললেন, ধৈর্য ধর বাজান, ধৈর্য ধর। একটা মাত্র রাইত। পেটের খিদা চাইপা রাখ। কাইল আল্লাহপাক কোনও না কোনও ব্যবস্থা করবোই। খিদা সহ্য করতে না পারলে চাপকল থিকা পানি খাইয়া আয়।
আমাদের বাড়িতে পুরনো একটা চাপকল ছিল। সবই লুট হয়ে গেছে, চাপকলটা লুট হয়নি। ফজলের চোখে চাপকলটা বোধহয় পড়েইনি। পড়লে মাটির তলার পাইপ পর্যন্ত টেনে তুলে নিয়ে যেত।
মার কথায় চাপকলটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একহাতে চাপকল টিপে, অন্যহাতে অনেকক্ষণ ধরে পানি খেলাম। গাল মুখ চটচটে হয়েছিল চোখের পানিতে। চাপকলের ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখটা খুব ভালো করে ধুয়ে ফেললাম। ময়লা স্যান্ডোগেঞ্জি মুখের কাছে তুলে মুখ মুছতে মুছতে এলাম মার কাছে।
মার বুকে তখনও কোরআন শরীফ। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাচ্ছে চারদিকে। মার হাত ধরে বাংকারে গিয়ে নামলাম। প্রথমে নামালাম মাকে। তারপর নিজে নেমে আলগা ঝাপটা টেনে দিলাম বাংকারের মুখে। মুহূর্তে গভীর গভীরতর এক অন্ধকার জগতে চলে গেলাম।
মৃত্যুর জগৎ কী ঠিক এই রকম না?
কবর কী ঠিক এই রকম না?
এই রকম অন্ধকার আর নির্জন?
জীবিত মানুষের কবরবাসের অভিজ্ঞতা কী রকম কেউ তা জানে কী না জানি না। আমি আমার কবরবাসের অভিজ্ঞতা টের পেলাম সেই রাতে।
বাংকারের এককোণে বুকে কোরআন শরীফ জড়িয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছেন মা। মাঝখানে বিঘত পরিমাণ ব্যবধান, আমি বসে আছি। দুজন মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ টের পাই দুজনে কিন্তু কেউ কোনও কথা বলি না।
কবরে থাকা মানুষ কি কথা বলে?
মা সবসময় দোয়া পড়ে একটু শব্দ করে। সেই রাতে সেই কবরের অন্ধকারে বসে মা কোনও শব্দ করছিলেন না। বুকে জড়ানো কোরআন শরীফ নিয়ে আল্লাহকে মা ডাকছিলেন নিঃশব্দে। ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিলেন।
আল্লাহকে ডাকছিলাম আমিও। মায়ের মতো নিঃশব্দেই ছিল সেই ডাক। এই করে করে ঘুম এবং জাগরণের মাঝখানকার একটা অবস্থা তৈরি হলো দুজনেরই। নাকি ওই অবস্থাটাকে বলে জীবন এবং মৃত্যুর মাঝখানকার অবস্থা?
এই অবস্থা কাটলো ভোররাতের দিকে।
সারারাত আমাদের চারপাশে কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। ছিল মাটির তলার নৈঃশব্দ। সেই প্রথম আমি আবিষ্কার করেছিলাম নৈঃশব্দের ভিতরেও থাকে এক রকম শব্দ। সেই শব্দ জীবনের শব্দ না, সেই শব্দ মৃত্যুর শব্দ।
মৃত্যুর শব্দ থেকে জীবনের শব্দে ফিরলাম ভোররাতে। বহুদূর থেকে ভোরবেলার পবিত্র হাওয়ায় আমাদের মা ছেলের কবরের ভিতরে মিহিন সুরে ভেসে এলো ফজরের আজানের শব্দ। সেই শব্দে মৃত্যুর জগৎ থেকে ফিরে এলাম আমরা। মা একটু নড়েচড়ে উঠলেন। আজানের শব্দ পাছ লাল?
আমিও একটু নড়ে উঠলাম। হ মা পাই।
তয় তো ফজর হইছে?
হ।
ল অহন বাইর হই।
লও।
মা ছেলে তখন আমরা কবর থেকে বেরিয়ে এলাম। খোলা জায়গায় দাঁড়াবার পর আশ্চর্য এক অনুভূতি হলো আমার। ভোরবেলার হাওয়া, পাখির ডাক আর গাছপালার গন্ধে, পায়ের তলার ঘাস মাটির গন্ধে মনে হলো এই প্রথম পৃথিবীর মাটি হাওয়াতে, ঘাসের বনে আর গাছগাছালির শীতলতায় বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের অন্যকোনও গ্রহ থেকে পৃথিবীতে এসে যেন পা দিয়েছি আমি। অথবা মৃত্যুর জগৎ থেকে এইমাত্র ফিরেছি জীবনে। সঙ্গে সঙ্গে পেটের ভিতর মুচড়ে উঠল তীব্রক্ষুধা। কাল থেকে কিছ্ইু যে খাওয়া হয়নি, কবরের অন্ধকারে একবারও টের পাইনি সেই অনুভূতি। এখন পেলাম।
মাকে বললাম, মা আমি খিদায় মইরা যাইতাছি। যেমনে পারো আমারে কিছু খাওয়াও।
মা বললেন, আমি বন্দোবস্ত করতাছি। তুই কোনও চিন্তা করিস না।
কোরআন শরীফ বুকে নিয়েই বাঁশবাগানের ওদিককার রাস্তা দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন মা। কোথায় গেলেন জানি না। আমি বসে রইলাম কাল সারাদিন যেখানটায় বসেছিলাম, বাড়ির আঙিনার ঠিক সেই জায়গাটাতে। আমার তখন মাথা কাজ করছে না। চিন্তা চেতনা অনুভূতি সব লোপ পেয়ে গেছে খিদায়। বাংকারে রাত কাটিয়েছি বলে হাত পা মুখ মাথা সব ভরে আছে ধুলোতে। নিজেকে মনে হচ্ছে গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা খিদার কষ্টে ধুকতে থাকা মৃতপ্রায় কোনও শেয়াল।
মা ফিরে এলেন বেশ তাড়াতাড়ি।
হাতে একটা এলুমিনিয়ামের হাঁড়ি। হাঁড়িতে কিছু চাল। এসেই কোরআন শরীফটা রাখলেন রেহালের ওপর। রেহালটা ঠিক সেই আগের জায়গাতেই ছিল।
মা তারপর চাপকলটার কাছে গিয়ে হাঁড়ির চালগুলো ধুঁয়ে পরিমাণ মতো পানি দিয়ে নিয়ে এলেন। আমাদের রান্নাচালার ওদিকটাও ফাঁকা। শুধু মাটির চুলা দুটো আছে। লাকড়ি খড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারপাশে। চুলার একপাশে ছোট্ট ন্যাকডায় জড়ানো থাকে ম্যাচ। ম্যাচটা সেভাবেই আছে। সেই ম্যাচ জ্বেলে চুলায় আগুন জ্বাললেন মা।
এলুমিনিয়ামের হাঁড়িতে টগবগ করে ফুটতে লাগল চাল। জাউ রান্না করলেন মা। পাতলা জাউ না, থকথকে। থালা বাসন কিচ্ছু নেই। কেমন করে খাবো এই জিনিস?
একটা সময়ে দেখি নিজের অজান্তেই আমি এবং আমার মা মুঠো করে হাঁড়ি থেকে সেই থকথকে জাউ তুলছি আর পাগলের মতো খাচ্ছি। কোনও দিকেই খেয়াল নেই আমাদের।
পেটপুরে জাউ খাওয়ার ফলে শরীরের শক্তিটা আমার ফিরে এসেছিল। মাও বেশ শক্ত সমর্থ মহিলা। সারাদিন খেটেখুটে মা আর আমি মিলে ফজলের বাড়ি থেকে আনা ছয়টা টিন দিয়ে রোদ বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার মতো একটা চালা মতো করে ফেললাম। বাঁশের খুঁটিখাঁটি দিয়ে একেবারেই যেনতেন একটা ব্যবস্থা। দুজন মানুষ কোনওরকমে ঘুমাতে পারে এইটুকু মাত্র জায়গা।
আহা রে, কত জৌলুশ একদিন এই বাড়ির ছিল। আর আজ?
চালাটার দিকে যতবার তাকাই, আমার চোখ ভরে আসে জলে। বুকটা হু হু করে। আমাদের বাড়ি লুট করেছিল কেরামতের ভাই ফজল। ফজলের কথা ভেবে বুকের ভেতর হুঙ্কার ছেড়ে জেগে উঠতে চায় এক ঘুমন্ত সিংহ।
ফজল শুয়োরের বাচ্চাকে আমি দেখে নেবো। কোনো না কোনোদিন প্রতিশোধ ওর ওপর আমি নেবোই।
২
এলাকার তরুণ যুবকরা তখন মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া শুরু করেছে।
আগে থেকেই যাচ্ছিল। ঈশ্বরগঞ্জে মিলিটারি আসার পর গোপনে গোপনে যাওয়া বেড়ে গেল। আমার বয়সী আমার বন্ধুরাও কেউ কেউ চলে গেল। যারা যায়, তারা কেউ কেউ গোপনে গোপনে আমার সঙ্গে দেখা করে। দেখা করে বলে, কী রে লাল, যাবি? চল যাইগা।
মার সামনেই কেউ কেউ এরকম কথা বলে। মা তাদেরকে বলেন, তোরা যা বাজান, লাল পরে যাইবো।
কেন যে মা আমাকে এভাবে ফিরিয়ে রাখছিলেন আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। সবাই জানে আমাদের বাড়ি লুট হয়ে গেছে। কোনও রকমে তৈরি করা একটা টিনের চালায় মা আর আমি থাকি। ধার উধার করে মা কিছু চাল জোগাড় করেন, কিছু আনাজপাতি ডাল মাছ জোগাড় করেন, ওই খেয়ে কোনও রকমে আমরা বাঁচি। কেরামত আলীর শত্র“তায় এই অবস্থা আমাদের। ভাইকে দিয়ে সে আমাদের বাড়ি লুট করিয়েছে। ওই যে আমার বোনকে পাঁচ নম্বর বউ বানাতে চেয়েছিল। মা রাজি হননি দেখে এইভাবে সে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছিল।
কেরামতের কথা ভাবলে আমার কখনও কখনও মনে হয় বাংলাদেশে জন্মে, বাঙালির ঘরে জন্মে, বাঙালি হয়েও কোনও কোনও মানুষ ছিল পাকিস্তানী মিলিটারির নরপশুগুলোর চেয়েও নিকৃষ্ট।
আমার বুকটা তখন ক্রোধে জ্বলে। আমার ইচ্ছে করে মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে ফিরে আসি। পাকিস্তানী মিলিটারিগুলোর সঙ্গে গুলি করে মারি কেরামত আর ফজলের মতো বাংলাভাষায় কথা বলা নিকৃষ্টতম জীবগুলোকে।
মাকে বলি এইসব কথা। মা আমি মুক্তিযুদ্ধে যাই। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে এসে এইসব অনাচারের প্রতিশোধ নিই।
মা বলেন সেই এক কথা। ধৈর্য ধর, ধৈর্য ধর।
খুশিবুজি তখন কুম্বাইলে, মার সইয়ের বাড়িতে। ছোটবোন মাজেদা ঢাকায় বড়ভাইয়ের কাছে। মেজোভাইয়ের খবর নেই। কোথায় আছে কে জানে! শুনেছি বড়ভাইয়ের একটা ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম রেখেছে মামুন। ভাই ভাবী আর তাদের একমাত্র সন্তান , সঙ্গে আছে মাজেদা, আমার ছোটবুজি। কারও কোনও খবর নেই। বেঁচে আছে না মরে গেছে জানি না। শুধু তিনজন মানুষের ব্যাপারে নিশ্চিত। যে হ্যাঁ, এই তিনজন মানুষ আমরা বেঁচে আছি। মা খুশিবুজি আর আমি।
মা আর আমি দুজন অসহায় মানুষ কী যে হতাশা নিয়ে বেঁচে আছি তখন। এই হতাশা সহ্য হয় না। এই হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।
মাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভোররাতের দিকে একদিন আমি একা একা রওনা দিলাম। মুক্তিযুদ্ধে যাবো। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসবো।
মোস্তফা আর আবুল খায়ের আগেই চলে গিয়েছিল। গিয়ে কী যেন কী কারণে আবার ফিরে এসেছে। ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। শুনেছি ফিরে এসেছে কিন্তু কোথায় আছে জানি না।
আমারও শেষপর্যন্ত যাওয়া হলো না। কাঁচামাটিয়া নদী পার হয়ে আটদশ মাইল হেঁটে গিয়েছিলাম। যেতে যেতে মনে হয়েছিল, এ আমি কী করছি? আমার অসহায় মাকে আমি কার কাছে ফেলে যাচ্ছি? আমি চলে গেলে মার আর থাকলো কে?
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার রাতে ফজল আলীর বাড়ি থেকে পাওয়া ছয়খানা টিনের নড়বড়ে চালার তলায় কুপি জ্বালিয়ে আমার আশায় বসেছিলেন মা। বসে বসে কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ছায়ার মতো নিঃশব্দে মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি। কুপির আলোয় দেখি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে মা আমার কোরআন শরীফ পড়ছেন।
আসলে কী ঘটেছিল
এই বাড়ির কাজের লোকটির নাম বারেক।
তিরিশ একত্রিশ বছর বয়স। এখনও বিয়ে করেনি। রোগা পটকা কেংলা ধরনের। চেহারায় মিষ্টতা আছে, চোখ দুটো সুন্দর। এক বালতি পানি এনে দরজার বাইরে একপাশে রাখল সে। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে। তবু বালতি ভরা টলটলে পরিষ্কার পানিটা দেখতে পেলাম। বারেককে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে এভাবে বালতি ভরা পানি রাখলে কেন?
বারেক কী রকম একটু রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল। গ্রামের লোক হলেও কথা সে মোটামুটি শুদ্ধভাষায় বলে। শুধু দুয়েকটা শব্দের গণ্ডগোল হয়। বিক্রমপুরের মানুষ বলে এলাকার দুয়েকটা শব্দ শুদ্ধভাষার মধ্যে ঢুকে যায়।
এখনও ঢুকল। ‘এমতেই রাখলাম।’
বুঝলাম, ‘এমতেই’ মানে এমনি। বললাম, এমনি এমনি এক বালতি পানি সারারাত এখানে থাকবে?
বারেক আবারও সেই হাসিটা হাসল। থাকলে অসুবিধা কী? পানি অনেক দরকারি জিনিস। কত সময় কত কাজে লাগতে পারে। এই ধরেন রাত্রে আপনার পাও ধোয়ার দরকার হইল, হাতমুখ ধোয়ার দরকার হইল, তখন কষ্ট কইরা চাপকলের ওইখানে না গিয়া এই বালতির পানি দিয়াই কাজটা আপনে সারলেন।
আমার ওসবের দরকার হবে না। আমার ঘুম খুব গভীর। শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে যাই। একঘুমে রাত শেষ করি। সকাল সাতটার আগে ঘুম ভাঙে না।
নতুন জাগায় একটু অসুবিধা হইতে পারে।
কিসের অসুবিধা?
ঘুমের। অনেক মানুষ আছে জায়গা বদল করলে, বিছানা বদল করলে সহজে ঘুমাইতে পারে না। আপনে অনেকদিন পর নানারবাড়িতে বেড়াইতে আসছেন। এখানে ঢাকা শহরের মতন ঘুম আপনের নাও হইতে পারে।
ঘরে ঢুকে পুরনো আমলের পালঙ্কে পা ঝুলিয়ে বসলাম।
আমার নানাবাড়ি গ্রাম এলাকার বিশাল বনেদী এক বাড়ি। বাইরের দিকে একতলা পুরনো একটা দালান। সেটাকে বলে কাছারি ঘর। লোকজন এলে ওই ঘরে বসে। তারপর ভেতরবাড়ি। ভেতরবাড়ির চারদিকে চারটা বড় বড় টিনের ঘর। মাঝখানে মাঠের মতন বিশাল উঠোন। পুনুখালা আর বাড়ির বহুকালের পুরনো ঝি রহিমা যে ঘরটায় থাকে তার পাশেই রান্নাঘর। নানা নানী মারা যাওয়ার আগেই বিধবা হয়েছেন পুনুখালা। তাঁর একটা মাত্র মেয়ে। সেই মেয়ে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। স্বামী স্ত্রী দুজনেই সিডনিতে ভাল চাকরি করে। আমার কোনও মামা নেই বলে মা আর পুনুখালা এখন এই বাড়ির মালিক। মা তো ঢাকাতেই থাকেন, পুনুখালা থাকেন এই বাড়িতে। দুচার বছরে এক আধবার মা হয়তো আসেন। মার সঙ্গে আমিও এসেছি কয়েকবার। একা কয়েকদিন পুনুখালার কাছে থাকার জন্য এই প্রথম এলাম। আমার এমবিএ শেষ হয়েছে কদিন আগে। এখন কিছুদিন অলস সময় কাটাবো। তারপর চাকরি বাকরিতে ঢুকবো। মা বললেন, যা তোর খালার কাছ থেকে বেড়িয়ে আয়। চলে এলাম।
এতবড় বাড়িটায় তিনজন মাত্র মানুষ। পুনুখালা রহিমা আর বারেক। আজ আমি এলাম বলে লোক হয়েছে চারজন। দুপুরবেলা এসে পৌঁছাবার পর দিনমজুর ধরনের কয়েকজন পুরুষ মহিলা দেখেছি। তারা কেউ গোলাঘরের কাজ করছিল, উঠোনের রোদে ধান শুকিয়ে বস্তায় ভরছিল। কেউ কেউ কাজ করছিল বাড়ির পেছন দিককার সবজি বাগানে। বড় পুকুরটার পারেও আরেকটা সবজি বাগান, সেখানেও কাজ করছিল কয়েকজন। সন্ধ্যার আগে আগেই যে যার কাজ শেষ করে চলে গেছে। এখন বাড়িটা একেবারেই নির্জন।
milon_ki_ghoechilo_2.jpg বিকেলবেলা বারেককে নিয়ে পুরো বাড়ি ঘুরে দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে বাড়িটা আসলে একটা খামারবাড়ি। ফার্ম হাউজ। বনজ ফলজ আর ঔষধি গাছে ভর্তি। নানা প্রকারের সবজি ফলছে বাগানে। পুকুরগুলো ভরে আছে মাছে। শুধু একটা জিনিসই নেই, গরু। বাড়িতে গরু নেই। পুনুখালা গরু পছন্দ করেন না। গোবরের গন্ধে তাঁর বমি আসে।
আমি আবার গরু খুব ভালবাসি। বাবার বন্ধু আরেফিন আংকেলের একটা গরুর খামাড় আছে ময়মনসিংহের ফুলপুরে। একবার সেই খামার দেখতে গিয়েছিলাম। গরুগুলোকে যা ভাল লেগেছে! সবচে’ ভাল লেগেছে গরুদের পানি খাওয়া দেখতে। গামলায় মুখ দিয়ে অদ্ভুত এক শব্দে পানি খাচ্ছিল। সেই শব্দটা এখনও কানে লেগে আছে।
আহা এই বাড়িতে যদি দুয়েকটা গরু থাকতো তাহলে গরুদের পানি খাওয়াটা আবার দেখতে পেতাম। অদ্ভুত সেই শব্দটা শুনতে পেতাম।
এই বাড়িতে পল্লীবিদ্যুৎ আছে। কিন্তু রাত নটার পর থাকে না। এজন্য সাড়ে আটটা পৌনে নটার মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই শুয়ে পরে।
আজও তাই হলো।
milon_ki_ghoechilo_3.jpg পুনুখালা বললেন, তুই দক্ষিণের ঘরে থাক বাবা। ওই ঘরের পালঙ্কটা সুন্দর। তোর নানা শুতেন। নানার খাটে নাতী শুলে ঘুম ভাল হবে। বারেকও থাকবে তোর সঙ্গে।
আমার একা ঘরে ঘুমানোর অভ্যাস। বারেক সঙ্গে থাকবে শুনে একটু গাঁইগুই করলাম। আমি একাই থাকতে পারবো খালা। বারেক অন্যঘরে ঘুমাক।
খালা বললেন, বারেক রোজ রাতেই ওই ঘরে ঘুমায়। ও ঘুমাবে মেঝেতে আর তুই পালঙ্কে। অসুবিধা কী? এত নির্জন বাড়ি, রাতে যদি ভয় পাস?
ভয় পাবে কেন?
ভূতের ভয় পেতে পারিস।
আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। ভূতের ভয় আমার নেই। ঠিক আছে তুমি যখন বলছ বারেক থাক আমার সঙ্গে। অসুবিধা নেই।
milon_ki_ghoechilo_4.jpg পালঙ্কে উঠে বসেছি, বারেক মেঝেতে তার বিছানা মাত্র শেষ করেছে, পল্লীবিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভরে গেল ঘর। বারেক বলল, দেখছেন অবস্থা? কী রকম অন্ধকার!
আমার ভালই লাগছে।
বলেন কী? এই রকম অন্ধকার আপনের ভাল লাগতেছে?
হ্যাঁ। কারণ আমি এখনই শুয়ে পড়ব, আর শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুম। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘুম খুব জমে।
তয় জমাইয়া ঘুম দেন। রাত্রে যদি ঘুম ভাঙ্গে, যদি কোনও দরকার হয়, ডাইকেন আমারে।
মনে হয় দরকার হবে না।
বারেক কথা বলল না। মৃদু শব্দে হাসল।
শুয়ে পড়তে পড়তে বললাম, হাসছ কেন?
এমতেই হাসছি।
ঠিক আছে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম বারেক। গুড নাইট।
বারেকও এসব আধুনিক কায়দা জানে। সেও বলল, গুড নাইট।
রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের ভেতর থেকেই কী রকম একটা শব্দ পাচ্ছিলাম, অচেনা একটা গন্ধ এসে লাগছিল নাকে। ঘুম ভাঙার পর টের পেলাম শব্দটা আসছে দরজার বাইরে থেকে। চব চব, চব চব এইরকম শব্দ। কোনও একটা জন্য যেন পানি খাচ্ছে।
milon_ki_ghoechilo_5 কয়েকটা মাত্র মুহূর্ত, শব্দটা চিনে ফেললাম। আরে, এ তো গরুর পানি খাওয়ার শব্দ! আরেফিন আংকেলের ফুলপুরের খামারে গরুদের পানি খাওয়ার শব্দ পরিষ্কার মনে আছে আমার। ঠিক এইরকম শব্দ। গন্ধটা চিনতেও দেরি হলো না। গরুর গায়ের গন্ধ। দরজার বাইরে বালতিতে যে পানি সন্ধ্যাবেলা রেখেছিল বারেক সেই পানি গরুতে খাচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে খাচ্ছে। খাওয়া যেন থামছেই না।
কিন্তু এই বাড়িতে তো গরু নেই। গরু নামের জন্যটা দুই চক্ষে দেখতে পারেন না পুনুখালা। গোবরের গন্ধে তাঁর বমি আসে। তাহলে এত রাতে কোত্থেকে এলো গরু? কাদের গরু এত রাতে এই বাড়িতে এসে বারেকের রাখা বালতিভরা পানি খাচ্ছে? তাছাড়া গরু খুবই দামি প্রাণী। গৃহস্থরা গরু খুবই যত্নে গোয়াল ঘরে বেঁধে রাখে রাত্রে। কেউ কেউ রাত জেগে পাহারা দেয়। গরু চোরের অভাব নেই দেশগ্রামে। শুনেছি চান্স পেলেই গৃহসে’র গোয়াল থেকে গরুচুরি করে গ্রামের হাট বাজারে বিক্রি করে দেয় গরুচোরগুলো। কসাইদের কাছে বিক্রি করে দেয়, যাতে মুহূর্তেই চামড়া বিক্রি হয়ে যায় ট্যানারিঅলাদের কাছে, কেজি দরে মাংস বিক্রি হয়ে যায় খদ্দেরদের কাছে। বিক্রমপুর এলাকায় গরুর নাড়িভূড়িকে বলে ‘আতড়ি উঝুড়ি’। সেই জিনিসও পরিষ্কার করে, তেল মশলা দিয়ে রান্না করে খায় অনেকে। খুবই নাকি টেস্টি জিনিস। গরুর হাড়মাথাও আজকাল ফেলনা জিনিস না। টোকাইরা কুড়িয়ে নিয়ে হাড্ডিঅলাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেই জিনিস চালান হয়ে যায় বিদেশে। গরুর হাড্ডি শুকিয়ে পাউডার করে সেই পাউডার থেকে তৈরি হয় সিরামিকসের প্লেট পেয়ালা। আর দুধ এবং মাংসের জন্য গরু, হালচাষের জন্য গরু, সবমিলিয়ে গরু হচ্ছে অপরিসীম প্রয়োজনীয় এক প্রাণী।
এইরকম প্রয়োজনীয় দামি প্রাণী কোন বাড়ির গোয়াল থেকে ছুটে এসে রাত দুপুরে আমার নানাবাড়ির পানি খাচ্ছে?
গরুর পানি খাওয়ার শব্দটা তখনও সমানে চলছে। শব্দের সঙ্গে গায়ের গন্ধটাও ঘরে এসে ঢুকছে। একটু যেন গোবরের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে পানি খাওয়ার ফাঁকে ওই কাজটাও সেরে নিচ্ছে গরুটা।
ইস পুনুখালা নিশ্চয় সকালবেলা খুব বিরক্ত হবেন। গোবরের গন্ধে তার বমি হয়ে যেতে পারে।
আস্তে করে বারেককে ডাকলাম। বারেক।
বারেক সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল। জ্বি।
তার মানে গরুর পানি খাওয়ার শব্দে বারেকেরও ঘুম ভেঙে গেছে।
শুনতে পাচ্ছ?
জ্বি পাইতেছি।
এত রাত্রে গরু এলো কোত্থেকে? কাদের বাড়ির গরু এসে বালতির পানি খেয়ে যাচ্ছে। গোবরের গন্ধও পাচ্ছি। আমরা কি উঠবো? দুজনে মিলে গরুটা তাড়াবো?
বারেক ভয়র্ত গলায় বলল, আপনের কি মাথা খারাপ হইছে? চুপচাপ শুইয়া থাকেন। কথাও বইলেন না।
কেন?
সকালবেলা ঘটনা আপনেরে বলবো।
আমাদের কথাবার্তার শব্দেই কী না কে জানে, হঠাৎ পানি খাওয়ার শব্দটা বন্ধ হলো, আর পানির বালতিটা যেন উল্টে পড়ল। গরুটাও যেন দৌড়ে চলে গেল। তার ভারী শরীরের দৌড়ে মৃদু একটা কাঁপন লাগল মাটিতে, পালঙ্কে শুয়েও সেটা টের পেলাম আমি। বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেন কিংবা ভারী ট্রাক চলে গেলে মাটি যেমন কাঁপে ঠিক তেমন করে কাঁপলো পালঙ্ক।
সকালবেলা আমাকে ডেকে তুললো বারেক। ওঠেন ওঠেন, মজার একটা কারবার দেখাই আপনেরে।
উঠলাম। বারেকের সঙ্গে দরজা খুলে বেরুলাম।
বারেক বলল, দেখেন, বালতির দিকে চাইয়া দেখেন।
ঘুম ভাঙা চোখে বালতির দিকে তাকালাম। তাকিয়ে বড় রকমের একটা ধাক্কা খেলাম। চোখ কচলে আবার তাকালাম। না, দৃশ্য বদলায়নি! দৃশ্য একই। বালতিভরা পানি ঠিকই আছে। এক ফোটাও কমেনি। বারেক যেভাবে রেখেছিল ঠিক সেইভাবে আছে বালতি, সেইভাবেই আছে পানি। মাঝরাতে গরুতে তাহলে খেল কী? এতক্ষণ ধরে পানি খাওয়ার শব্দ পেলাম, ওই নিয়ে বারেকের সঙ্গে কথা বলল। আমাদের কথাবার্তার শব্দে বালতি উল্টে দিয়ে ছুটে গেল গরুটা সেই শব্দও পেলাম। আর এখন দেখছি সবই ঠিক আছে। বালতি আছে বালতির জায়গায়, পানি ভরা আছে আগের মতোই। ব্যাপার কী?
আমি তারপর গোবর খুঁজলাম। গোবরের গন্ধ যে পেয়েছিলাম সেই বস্তুটাই বা উধাও হয়ে গেল কোথায়? কোনও চিহ্নই তো নেই।
কাল সন্ধ্যার সেই রহস্যময় হাসিটা হাসল বারেক। বুঝলেন কিছু?
ফ্যাল ফ্যাল করে বারেকের দিকে তাকালাম। মাথা নাড়লাম। না, কিছুই বুঝলাম না। সবই দেখি ঠিক আছে। মাঝরাতে অতক্ষণ ধরে গরুটায় তাহলে খেল কী? শব্দ পেলাম, গরুর গায়ের গন্ধ, গোবরের গন্ধ সবই পেলাম। দৌড়ে চলে যাওয়ার শব্দও পেলাম। আর এখন দেখি বালতিভরা পানি যেমন ছিল তেমনই আছে। গোবরের চিহ্নও নেই।
কোথা থেকে থাকবে? গরু বলে কোনও জিনিস তো আসে নাই।
তাহলে কী এসেছিল? বারেক, তুমি আমার সঙ্গে ফাজলামো করো না। গরুর পানি খাওয়ার শব্দ আমার চেনা। গা এবং গোবর দুটোর গন্ধই চেনা। বালতি উল্টে দৌড়ে চলে যাওয়ার শব্দ আমি পেয়েছি। তুমিও পেয়েছ। এত কিছুর পর বলছ গরু বলে কোনও জিনিস আসেনি। তাহলে কী এসেছিল? আমার মনে হয় তুমি কিছু একটা চালাকি করেছ।
বারেক বিস্মিত চোখে তাকাল। আমি কী চালাকী করবো?
নিশ্চয় আমার ঘুম ভাঙার আগে উঠে চাপকল থেকে বালতি ভরে পানি এনে রেখেছ, গোবর পরিষ্কার করে রেখেছ।
সেইটা কইরা আমার লাভ কী? দরজা খুইলা ঘর থেকে বাহির হইলে সেই আওয়াজ আপনে পাইতেন। চাপকল থেকে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কেন এত কষ্ট করে পানি আনতে যাবো আমি? অন্ধকারে গোবরই বা পরিষ্কার করবো কীভাবে? রাত্রে এই কাজগুলি সারবার কোনও দরকার নাই। দরকার থাকলে সকালবেলা সারবো। আমারে তো কেউ তাড়া দেয় নাই।
বারেকের কথায় যুক্তি আছে। ঠিকই তো। বারেক কেন অন্ধকার রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসব কাজ সারতে যাবে? কাজটা তো এমন কিছু জরুরি না।
বললাম, তাহলে ব্যাপারটা কী?
বারেক গম্ভীর গলায় আবার সেই কথাটা বলল। গরু বলে কোনও জিনিস আসে নাই।
তাহল কী এসেছিল?
আপনে বোঝেন নাই?
না।
এত সহজ জিনিসটা বুঝতাছেন না?
এবার গা কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। গলা কেমন শুকিয়ে এলো। ঢোক গিলে বারেকের দিকে তাকালাম।
বারেক বলল, যদি সত্য সত্যই গরু হইতো তাহলে আপনের কথায় আমি রাজি হইতাম। দুইজনে বাহির হইয়া গরুটা তখনই তাড়ায়া দিতাম। আমার হাতের কাছে ম্যাচ থাকে, হারিকেন থাকে। হারিকেন জ্বালাইয়া দুইজনে বাহির হইলে গরু তাড়ানো কঠিন কোনও কাজ ছিল না। আর একটা কথা হইল, এই বাড়িতে গরু নাই, গরু ঢুকবারও কোনও পথ নাই। বাড়ির চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া। নানান পদের সবজির চাষ হয় বাড়িতে। গরু ছাগল ঢুকলে ক্ষেতের সবজি বিনাশ কইরা ফালাইবো। সামনের দিককার গেটটাও রাত্রে বন্ধ করি আমি নিজহাতে। তাহলে গরু আসবে কোথা থেকে?
শুকনো গলায় বললাম, তাহলে কী এসেছিল?
যে এসেছিল সে মাঝে মাঝেই আসে। কোনও রাতে আমি টের পাই, কোনও রাতে পাই না। তবে সে পানি খাইতে খুবই ভালবাসে। আর তিনাদের পানি খাওয়া আজব রকমের। পানি খাইবেন ঠিকই কিন্তু সেই পানি ফুরাইবো না। তিনার জন্য পানি আমি রোজ সন্ধ্যাবেলাই দরজার বাইরে রাইখা দেই। কোন রাত্রে তিনি আসবেন, কোন রাত্রে পানি খাবেন! যদি মুখের কাছে পানি না পান তাহলে আমার উপরে চেইতা যাইবেন। আমি একলা এইঘরে থাকি। যদি ঘরে ঢুইকা…। ঘরে ঢুকবার জন্য তিনাদের কোনও দরজা লাগে না। হাওয়ার সঙ্গে ঢুকবেন, হাওয়ার সঙ্গে বাহির হইবেন।
ভয়ার্ত গলায় বললাম, ঘটনাটা কি খালা জানেন? রহিমা বুয়া জানে?
না, কেউ জানে না। আমি কাউরে বলি না। বললে যদি আমার উপরে তিনি চেইতা যান? ভাইজান, আপনেও কেউরে বইলেন না।
উপন্যাসের শেষ পর্বটি লিখছি
বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকজন খ্যাতিমান কথা-সাহিত্যিকের মধ্যে অন্যতম ইমদাদুল হক মিলন। আসন্ন ঈদ ও বইমেলায় এই সাহিত্যিকের একাধিক উপন্যাস ও গল্প প্রকাশিত হবে। সাম্প্রতিক ব্যস্ততা নিয়ে ইমদাদুল হক মিলন মুখোমুখি হয়েছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নাহিদ হোসেন।
আপনার ধারাবাহিক উপন্যাস ‘নূরজাহান’ কোন পর্যায়ে আছে?
‘নূরজাহান’ উপন্যাসটি নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ পত্রিকায়। আগামী জানুয়ারিতে এটি শেষ হবে। বর্তমানে আমি এ উপন্যাসের শেষ পর্বটি লিখছি।
আসছে ঈদে পাঠকদের কী কী উপহার দিচ্ছেন?
বিভিন্ন দৈনিক ও সাময়িকীর ঈদ সংখ্যায় উপন্যাস ও বড় গল্প প্রকাশিত হবে। ইতোমধ্যে লেখা শুরুও করে দিয়েছি। বাকিগুলোর জন্য প্র¯’তি নি”িছ।
ঈদ মৌসুমে কয়টি উপন্যাস প্রকাশিত হবে?
খুব বেশি না। বড়জোর ২-৩টি। আর ছোট বড় মিলিয়ে গল্প লিখবো কয়েকটি।
ঈদের জন্য নাটক লিখছেন না?
ইতোমধ্যেই তিনটি নাটক লিখে দিয়ে দিয়েছি। নাটকগুলোর নাম হলো ‘অপহরণের পর’, ‘কয়েকটি মজার চরিত্র’ ও ‘কুসুমের ছবি’।
লেখালেখি ছাড়া টিভি অনুষ্ঠান ইত্যাদির ব্যস্ততা কেমন?
চ্যানেল আইয়ের জন্য একটি টক শো করছি। ‘অনেক কথা বলার ছিলো’ নামের এই টকশোটির ছয় পর্ব রেকর্ড হয়ে গেছে। আরো ছয় পর্ব রেকর্ড হলেই প্রচার শুরু হবে। এছাড়া এটিএন বাংলা ও এনটিভির প্রতিষ্ঠা-বার্ষিকীর বিশেষ দুটি অনুষ্ঠান করবো। একটির রেকর্ডিং আগামীকাল আরেকটি এ মাসের শেষের দিকে।
কে আসে
কে আপনি, কে? এই যে, এই যে আপনি, কালো আলখাল্লা পরে আমার বুক বরাবর এসে দাঁড়িয়েছেন। কে আপনি? আপনার মুখটা আমি দেখতে পাচ্ছি না। আগের দিনকার শাহজাদিদের মতো কালো নেকাবে মুখ ঢেকে রেখেছেন, কিন্তু আকৃতিতে আপনি বিশাল। কোনো মেয়ে এত দীর্ঘাঙ্গী হয় না। আপনি কে? কে আপনি? আরে, চট করে আবার কোথায় চলে গেলেন? এই যে, এই যে…
আমরা তিনটি ভাইবোন কেবিনের বাইরে বসে আছি। হাসপাতালটি চৌদ্দতলা। বাদল ছিল আইসিইউতে। আজ সতেরো দিন সে ডিপ কোমায়। তিন দিন আগে তাকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। অবস্থার একচুলও পরিবর্তন হয়নি। চোখ বন্ধ, লাশের মতো চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ধবধবে সাদা বেডে। মুখে অক্সিজেন-মাস্ক লাগানো। আমাদের হামিদ মামা প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই আছেন বাদলের সঙ্গে। আমরা দশটি ভাইবোন। তিনজন আমেরিকায়। ঢাকায় যে সাতজন, তার মধ্যে বাদলের এই অবস্থা। অন্য ছয়জন যখন যে পারছে হাসপাতালে এসে প্রথমে বাদলের রুমে ঢুকছে, তাকে একপলক দেখে বাইরের বেঞ্চে এসে হতাশ মুখে বসে থাকছে। বাদলের কেবিন ছেড়ে হামিদ মামাও মাঝেমধ্যে এসে বসছেন আমাদের সঙ্গে। বাদলকে নিয়ে আমরা ফেলে আসা দিনের কথা বলি। টুকটাক স্মৃতিচারণা করি।
আজ কোনো কথা হচ্ছিল না। বেঞ্চে আমার দুপাশে বসে আছে দুবোন। একপাশে পলি আরেক পাশে ডলি। পলি আর বাদল যমজ। যমজদের পরস্পরের প্রতি টান থাকে অন্য রকম। সেই টানে আমরা কেউ আসি না-আসি, পলি প্রতিদিন আসে হাসপাতালে। ভাইয়ের মুখ একপলক দেখে বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। কখনো বিড়বিড় করে দোয়া-দরুদ পড়ে, কখনো নিঃশব্দে কাঁদে।
আজও কাঁদছিল সে।
এ সময় বাদলের কেবিন থেকে পাগলের মতো ছুটে এলেন হামিদ মামা। তোরা আয়। তাড়াতাড়ি আয়। বাদল হঠাৎ নড়েচড়ে উঠেছে। মুখ থেকে অক্সিজেন-মাস্ক খুলে ফেলেছে। আর পরিষ্কার ভাষায় কথা বলছে। তাড়াতাড়ি আয়।
সতেরো দিন এই প্রথম আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার হলো। ছুটে গিয়ে ঢুকলাম বাদলের রুমে। বাদলের মুখ দেখে তিন ভাইবোন হতভম্ব। যেন এইমাত্র গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠেছে সে। মুখে বিশ-বাইশ দিনের না কামানো দাড়ি-গোঁফ। তার মুখটা বেশ ফ্রেশ লাগছে। কিন্তু চোখে অদ্ভুত এক চঞ্চল দৃষ্টি। যেন এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। শরীর নড়াতে পারছে না, মাথা ঘোরাতে পারছে না এদিক-ওদিক। শুধু চোখের মণি ঘুরিয়ে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছে। আর কথা বলছে পরিষ্কার গলায়। কোথায় গেল? সে কোথায় গেল?
আমি বাদলের মুখের কাছে ঝুঁকে গেলাম। কে কোথায় গেল? কাকে খুঁজছিস তুই? বাদল, কাকে খুঁজছিস?
চিনি না, আমি তাকে চিনি না। কালো আলখাল্লা পরা মুখে মেয়েদের মতো কালো নেকাব। শুধু চোখ দুটো দেখা যায়। বড় বড় চোখ। ধক ধক করছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে আমার বুক বরাবর এসে দাঁড়িয়েছে।
হামিদ মামা ছুটে গিয়ে ডাক্তার ডেকে এনেছেন। অল্পবয়সী একজন ডাক্তার। সে অনেক দিন ধরেই বাদলকে দেখছে। বলল, কোনো কোনো রোগীর এ রকম হয়। আপনারা নার্ভাস হবেন না। এই অবস্থাটা চলতে থাকবে।
কিন্তু বাদলের কথাবার্তা একেবারেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে আমার। তার চোখ ও কণ্ঠে এক ধরনের ঘোর লেগে আছে। আমাদের প্রত্যেকের দিকেই তাকাচ্ছে সে, আবার কারও দিকেই যেন তাকাচ্ছে না। সবাইকে দেখছে, আবার কাউকেই যেন দেখছে না। আর কথা সে বলেই যাচ্ছে। কোনো এক কালো আলখাল্লা পরা, মুখ কালো নেকাবে ঢাকা মানুষের কথা বলে যাচ্ছে।
…আমি আগেও তাকে দেখেছি। ওই, ওই যে একবার আমার, খুব ছোটবেলায়, খুব ছোটবেলায় বিক্রমপুরে, মেদিনীমণ্ডল গ্রাম, নানির কাছে থাকি। শীতকালের রাত, গভীর রাত, আমার খুব কাশি হচ্ছিল, দম নিতে পারছিলাম না তখন, তখন হারিকেনের আলোয় আমি তাকে ছায়ার মতো একবার দেখেছিলাম। ঠিক এই রকমই। কালো আলখাল্লা পরা, নেকাবে ঢাকা মুখ। শুধু চোখ দুটো দেখা যায়। অন্ধকারে বাঘের চোখ যেমন জ্বলে, তেমন জ্বলছিল। সেই রাতে ছোট নানা আর মামারা গিয়ে জলধর ডাক্তারকে ডেকে আনল কাজির পাগলা থেকে। সকালবেলাই ভালো হয়ে গেলাম আমি…
বাদলের কথা শুনে আমরা তিনটি ভাইবোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। অন্য ভাইবোনদের ফোনে জানানো হয়েছে বাদলের অবস্থা। সে কথা বলছে শুনে যে যার মতো করে রওনা দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনেকে এসে পড়বে।
কিন্তু ডাক্তার বললেন, এ ধরনের রোগী এলোমেলো কথা বলে! কই, বাদল তো তা বলছে না। সে তো তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথাই বলছে। এই ঘটনা তো আমরা সবাই জানি। একটুও তো এলোমেলো কথা না।
…আরেকবার, আরেকবার তাকে আমি দিনের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ওই যে, ওই যে গাড়িটা যেবার আমাকে ধাক্কা দিল, আমাকে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল, আমি, আমি তখন একটা সময়ে দেখি গাড়িটা না, কালো আলখাল্লা পরা, নেকাবে মুখ ঢাকা, বিশালদেহী কে একজন আমাকে চেপে ধরেছে। দম বন্ধ হয়ে আমি যখন মরে যাচ্ছি, তখন, তখন হঠাৎ করে দেখি, আমি মাটিতে পড়ে আছি। কালো আলখাল্লা পরা মানুষটা কোথাও নেই। আমার চারপাশে অনেক লোক…
এবারও আমরা তিন ভাইবোন এ ওর দিকে তাকালাম। সত্যি তো বাদল একবার অ্যাকসিডেন্ট করেছিল। একজন আনাড়ি ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে, বাদল হেঁটে যাচ্ছে পাশ দিয়ে, হঠাৎ করে গাড়িটা এসে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরল বাদলকে। পা দুটো প্রায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল ওর। চার-পাঁচ মাস লেগেছিল ভালো হতে।
…এবার আমি যে রাতে অসুস্থ হলাম, সেই রাতে তাকে দেখলাম আমার পায়ের দিকটায় এসে দাঁড়িয়েছে। যেন পা ধরে আমাকে কোথাও টেনে নিয়ে যাবে। তারপর দেখলাম আজ, এই তো কিছুক্ষণ আগে আমার বুক বরাবর এসে দাঁড়িয়েছিল। কে, ওটা কে? এখন আর দেখছি না কেন? চট করে কোথায় উধাও হয়ে গেল…
ততক্ষণে আমার বড় ভাই, ভাবি, অন্যান্য বোন, বোনজামাই, সবাই এসে পড়েছে। বাদলের কেবিনে বেশ বড় রকমের ভিড়। হামিদ মামা আমাকে ডেকে বাইরে নিয়ে এলেন। তাঁর মুখ বিবর্ণ, ফ্যাকাসে, চোখে ভয়, আতঙ্ক। বললেন, এই লক্ষণটা ভালো না। বাদল মনে হয়, বাদল মনে হয়…
কথা শেষ করতে পারলেন না হামিদ মামা। আমার হাত ধরে বাদলের কেবিনে ঢুকলেন। বাদলের চোখে সেই আগের দৃষ্টি। এখনো যেন কালো আলখাল্লা পরা, নেকাবে ঢাকা মুখ, সেই মানুষকে সে খুঁজছে। আমরা দুজন কেবিনে ঢোকার পরপরই যেন তাকে সে পেয়েও গেল। চোখ দুটো স্থির হলো বাদলের। এই প্রথম তাকে খুব ভয় পেতে দেখলাম। চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি, কণ্ঠে প্রচণ্ড ভয় পাওয়ার সুর। …আরে, আরে এই তো সে। এই তো! এই যে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার ভয় করছে, আমার খুব ভয় করছে। এই, এই ওকে তোমরা সরে যেতে বলো, সরে যেতে বলো। আমার দিকে যেন এগিয়ে আসছে…
ওটাই ছিল বাদলের মৃত্যুমুহূর্ত।
ইমদাদুল হক মিলন
সূত্রঃ প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৬, ২০০৮
হে অচিন পাখি
হাওয়ায় কী একটা ভাজা-পোড়ার গন্ধ ওঠে। ভারি মনোহর। সেই গন্ধে মাছচালার ধুলোবালি থেকে মুখ তোলে বাজারের নেড়িকুত্তাটা। তারপর প্রথমেই তার প্রভু পবন ঠাকুরকে খোঁজে। নেই। গন্ধ আর প্রভুর টানে কুত্তাটা তারপর ওঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে পুরনোকালের রোঁয়া ওঠা মদ্দা শরীরখান টানা দেয়। তখন দেখে দূরে খাদ্যি খাওয়ার দোকানটার সামনে প্রভু বসে আছে। গন্ধটাও সেদিক থেকেই আসছে।
কুত্তাটা তারপর কিছু না ভেবে গন্ধের দিকে, প্রভুর দিকে ছুটে যায়।
আমার বাপে আছিল ডাকাইত। বিকরামপুরের বুড়া মাইনষের মুখে হোনবেন কেষ্ট ঠাকুরের নামডাক। মাইনষে কইত কেষ্টা ডাকাইত। যাগ বয়েস পাঁচ কুড়ি-ছয় কুড়ি। আমার বাপের নামে হেই আমলে গেরস্তরা রাইত্রে গুমাইত না। রাইত্রে বিছানায় হুইয়া পোলাপান কানলে বউ-ঝিরা কইত, কেষ্টা আইল। কেষ্টার নামে পোলাপানেও ডরাইত। কান্দন থামাইত, গুমাইয়া পড়ত। গেরামে গেরামে মাইনষে চকি দিত। দল বাইন্দা। কেষ্টারে ঠেকাও। অইলে অইব কী, কাম অইত না। বাপে আমার ঠিকই মাইনষের মাতায় বাড়ি মারত। সব্বস্বান্ত করত। দিবেননি কত্তা একখান আমিত্তি? লতিফ ময়রা খুব মনোযোগ দিয়ে রসে ডোবা আমৃতি তুলে মাটির ঝাঁজরে রাখছিল। ঝাঁজরের নিচে বসানো একখান বালতি। আমৃতির রস চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তাতে।
লতিফ বসে আছে মাটি থেকে হাতখানেক উঁচু একটা চৌকির ওপর। তার ডান দিকে দোকানের ভেতর মিষ্টির আলমারি। ওপরের দুটো রেকে সাজানো চমচম, বালুসাই, কালোজাম, সন্দেশ, আমৃতি ও গজা। আর নিচের রেকে পেতলের বিশাল গামলায় রসে ডোবা রসগোল্লা, লালমোহন ছানার আমৃতি। সারা দিনে সতেরো বার আলমারির কাচ মোছে লতিফ। পদ্মার জলের মতো ঘোলা কাচ। একটার এক কোনা ভাঙা। আর দুটোতে হিজিবিজি ফাটল। হলে হবে কী, কাচ পাল্টায় না লতিফ। অযথা পেচ্ছাব-পায়খানার মতো কিছু পয়সা বেরিয়ে যাবে। দরকার কী! ভাঙা আলমারি কি কম দেয়! লতিফের বাম দিকে দোকানের বাইরে পরপর সাজানো আঠালো মাটির তিনখান আলগা চুলা। একখান দু’মুখী আর একখান একমুখী। দু’মুখীটায় বিয়ানরাতে এসে তুলে দেয় পুরনোকালের বিশাল একটা কেটলি। হ্যান্ডেলে ছেঁড়াখোড়া কাপড় জড়ানো। তাপে তাপে পোড়া মাটির রং ধরেছে।
কেটলির মুখে পাতলা কাপড় দোপাল্লা করে বাঁধা। ছাঁকনি। রাত একপ্রহর অব্দি চায়ের জল ফোটে কেটলিতে। বিয়ানরাতে একবার মাত্র পদ্মার জল আর চা পাতা ছেড়ে চুলায় ওঠায়। তাতেই রাত একপ্রহর অব্দি চলে।
গাঁও-গ্রামের লোকে আর কত চা খায়। তবুও পুরো এক কেটলি চা শেষ হয় লতিফ ময়রার। আর তিন-চার সের দুধ।
দুধের কড়াইটা থাকে কেটলির পাশেই। দু’মুখী চুলার অন্যটায়। চায়ের গেলাস, চিনির টোফা থাকে লতিফের পায়ের কাছে। চুলার সঙ্গে। গাহাকরা চাওয়ামাত্রই কেটলিটা গেলাসের ওপর একটুখানি কাত করে লতিফ। তারপর গোল চামচে একচামচ দুধ, ছোট্ট চামচে দেড় চামচ চিনি। হাতের মাপ বটে লতিফের। একফোঁটা দুধ এদিক-ওদিক হয় না, এক রোঁয়া চিনি। এসবই অভ্যেস। বহুকালের।
লতিফের দোকানটা ছোট। দোকানের ভেতর মিষ্টির আলমারিটা, কিছু হাঁড়ি-পাতিল, বস্তা আর চৌকিটা ছাড়া অন্য কিছু থোয়ার জায়গা নেই লতিফের। গাহাকরা বসে সব বাইরে। বাইরে, লতিফের দোকানের সামনেটা খোলামেলা। একদিকে লতিফের চুলাচাক্কি আর অন্যদিকে লম্বা একখান টেবিল। পায়া নড়বড় করে তার। টেবিলের দু’পাশে লম্বা দুখানা বেঞ্চি। বেঞ্চির গা ঘেঁষে লতিফের দোকানের দুনম্বর ঝাঁপ ঠিকনা দেয়ার বাঁশটা খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে। অন্যটা চুলার কাছে।
সবই অনেককালের পুরনো জিনিসপত্র। কিছুই বদলানো হয়নি লতিফের। পাই পাই হিসেব করে এই অব্দি এসেছে। সংসারটা ভারী লতিফের। সাতখানা পোলাপান। আর একখান আছে বউর পেটে। মাসদুয়েক বাদে নাজেল হবে। বুড়ি মা আছে। আর একটা ঢ্যাংগা বোন। কুড়ির ওপর বয়েস। বিয়ে দেওয়া হয়নি। টাকা-পয়সার অভাব। ভোর থেকে রাত দশটা অব্দি দোকান চালায় লতিফ। তারপর ক্যাশবাঙ্ খালি করে টাকা-কড়ি বাঁধে তফিলে। দোকানে ভারী চারখান তালা লাগায়। তারপর দেড় মাইল বিল পাড়ি দিয়ে বাড়ি যায়।
জশিলদিয়া থেকে মেদিনীমণ্ডল যেতে মাঝে একবিল। পাক্কা দেড় মাইল। চাঁদনি রাতে সেই বিল পাড়ি দিতে দিতে লতিফ কেবল একটা কথাই ভাবে, এইদিন থাকব না। দোকানের আয়-উন্নতি বাড়ব। টেকা-পয়সার অভাব মাইনষের চিরদিন থাকে না।
এই কথাটা লতিফ ভেবে আসছে, আজ সতেরো-আঠারো বছর। কিন্তু দিন বদলায়নি। আয়-উন্নতি বাড়েনি লতিফের। যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেছে সব। দোকানটা আর লতিফ নিজে। আসলে লতিফ তার জীবনের ঘোরপ্যাঁচটা বোঝে না। আয়-উন্নতি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খরচটাও যে বেড়েছে লতিফ তা বোঝে না। এই দোকান দেওয়ার পরই বিয়ে করেছে লতিফ। মা-বোন ছাড়া আর একটা নতুন মানুষ এসেছে। তাই খাইখরচা। সাধ-আহ্লাদ। তারপর বছর পর বছর আর একজন করে। সাকল্যে মানুষ এখন এগারোজন। আর একজন নাজেল হওয়ার ফিকির করছে।
টাকা-পয়সার মারটা যে এইখানে তা লতিফ বোঝে না। এখনো আশায় আছে এইদিন থাকব না। আয়-উন্নতি বাড়ব। জীবন অন্য রকম অইয়া যাইব।
দু’একখানা বড় গাহাক পেলে ধারণাটা জোর পায় লতিফের। এই যেমন, আজ সকাল বেলা কান্দিপাড়ার মাজেদ খাঁ আধমণ আমৃতির অর্ডার দিয়ে গেছে। কাল সকালে নেবে বাপের চলি্লশার মেজবানি। গরু মারবে একখান। আর আগল আগল ভাত। পয়সা দিয়েছে আল্লায়। আত্মাটাও বড় মাজেদ খাঁর। মাংস ভাতের পর খাওয়াবে আমৃতি। আর অন্যদিকে, সত্তর-আশি টাকার কাজ হয়ে যাবে লতিফের। সেই সুখে বিভোর হয়েছিল লতিফ।
সকালবেলা পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেছে মাজেদ খাঁ। আগাম। টাকাটা হাতে পেয়েই জিনিসপত্র জোগাড় করেছে লতিফ। বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে রাতে ফিরবে না। একলা মানুষ পুষ্যি অনেক। সেই ভয়ে দোকানে কর্মচারী রাখে না লতিফ। একলাই আধমণ আমৃতি বানাতে হবে। আধমণ আমৃতি কি যা-তা কথা! রাত কাবার হয়ে যাবে। জিনিসপত্র জোগাড় করতেই দুপুর পার হয়ে গেছে লতিফের। তারপর একমুখী চুলো দুটো সাজিয়ে, একটায় চিনির সিরা তুলেছে। অন্যটায় তেলের কড়াই। পায়ের কাছে, ক্যাশবাঙ্রে সঙ্গে বড় একটা অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাঁকা-ত্যাড়া গামলায় ময়দার পানি আর কলাই মিশিয়ে হাতে যখন নারকেলের তলা ফুটো আইচা নিয়ে বসেছে, তখন দুপুর পার। বাজার ভেঙে গেছে।
বাজারটা চালু থাকে দুপুর অব্দি। মানুষের হল্লাচিল্লা, দোকানিদের হাঁকডাক, আনাজপাতি, পেঁয়াজ, রসুনের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে। আর পচা মাছের বোঁটকা একটা গন্ধ আসে মাছচালার দিক থেকে। এসবের ওপর আছে বাজারের সম্পূর্ণ আলাদা চিরকালীন গন্ধটা।
সকালের দিকে আজার পায় না লতিফ। বাজার করতে এসে গেরামের গণ্যমান্য লোকেরা লতিফের দোকানে আসে—চা খেতে। বরাত ভালো থাকলে মিষ্টিও খায়। এক-আধসের কিনেও নেয় কেউ কেউ। সেই আয়ে জীবন চলে যাচ্ছে লতিফের। আজ সতেরো-আঠারো বছর।
তারপর দুপুরবেলাটা সব ফাঁকা, নিটাল। জনাসাতেক স্থায়ী দোকানদার ছাড়া বাজারের নেড়িকুত্তাটা আর পবনা পাগলা, সারা জশিলদিয়া বাজারে কেবল এ ক’জনই। জেলেরা যে যার ঝাঁকা মাথায় ফিরে যায়। চারপাশের গেরাম থেকে যেসব গেরস্ত ক্ষেতের আনাজপাতি নিয়ে আসে, গোয়ালারা আসে দুধ নিয়ে, বিক্রি হলে ভালো, না হলে যে যার বস্তু নিয়ে দুপুরের মুখে মুখে ফিরে যায়। বাজারের খোলা চত্বরে তখন পবনা পাগলা, নেড়িকুত্তাটা আর দোকানের ভেতরে আজার দোকানিরা।
বাজারখোলার পাশেই বড় গাঙ, পদ্মা। দুপুরের পর পদ্মার হু হু হাওয়া এসে বাজারের ধুলোবালির সঙ্গে খেলা করে। বাজারখোলার চিরকালীন গন্ধটা একটুখানি উসকে দেয়। তখন বাড়ি থেকে আনা ভাত-পানি খায় লতিফ। তারপর খালি গায়ে, বাবুরহাটের লুঙ্গি পরা, মাজায় বাঁধা একটা লাল গামছা, ক্যাশবাঙ্রে সঙ্গে আয়েশ করে বসে বিড়ি টানে। আজ সেই আজারটা পায়নি লতিফ। ভাতটা এক ফাঁকে খেয়ে নিয়েছে। তারপর বিড়ি টানতে টানতে আধমণ আমৃতির মালসামান ঠিকঠাক করে যখন বসেছে তখন বিকাল হয় হয়।
চার-পাঁচ খোলা আমৃতি তুলে ঝাঁজরের ওপর রেখেছে লতিফ, তখন দু’তিনজন গাহাক এলো। গেরামের যুবক পোলাপান। তাই দেখে এক হাতে আমৃতি আর অন্য হাতে চা বানিয়ে ফেলে লতিফ। তারপর গাহাকদের টেবিলে দিয়ে যখন আবার এসে চুলার পাড়ে বসে তখন টের পায় আমৃতি ভাজার গন্ধে বাজারের হাজার বছরের পুরনো গন্ধটা বেপাত্তা। হু হু হাওয়া বাজারময় বয়ে বেড়াচ্ছে আমৃতি ভাজার মনোহর গন্ধ। সেই গন্ধে সতেরো-আঠারো বছরে যা হয়নি লতিফের আজ তাই হয়। পেটের ভেতরটা চনমন করে ওঠে। একখান আমৃতি খাওয়ার সাধ জাগে।
কিন্তু কাজটা করে না লতিফ। একখান আমৃতির দাম পড়ে এক সিকি। একদিন খেলে যদি লোভটা বেড়ে যায়। লোকসান। লোকসান হলে পুষ্যিরা খাবে কী!
এসব ভাবতে ভাবতে আরেক খোলা আমৃতি তোলে লতিফ। তখন দেখে চুলার ওপারে এসে দাঁড়িয়েছে পবন ঠাকুর। লোকে বলে পবনা পাগলা। চেহারা-সুরত কী—শালার! ধড়খান মরা গয়া গাছের মতো। মাথাভর্তি বাবরি চুল। মুখে কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ। চোখ দুটো গর্তে। তবুও ভাটার মতো দেখতে। হাত-পা মরা ডালপালার মতো পবনার। বুকের পাসলি গোনা যায়। পেটখান দেখলে মনে হয়, ফেন গালার মাইট্টা খাদা উল্টো করে বসানো। তার তলায় টুটাফাঁটা একখান ধুতি। জন্মের পর থেকেই যেন পরে আছে।
মাছচালার মাটিতে শোয় পবনা, মাটিতে বসে। ফলে ধুতিটার রং হয়েছে বাজারে বাইলা মাটির মতো। আর পবনার গায়ের গন্ধটা বটে, বাজারের হাজার বছরের পুরনো গন্ধটাও বাইসানরে বলে পালায়। পবনা হেঁটে গেলে মনে হয়, গেরস্তর আনাজপাতির ক্ষেত থেকে খড় আর বাঁশের মাথায় পোড়া মাটির মালসা বসানো তাড়ুয়াটা হেঁটে যাচ্ছে। গেরস্তর ক্ষেতখোলা পাহারা দেয়। ইঁদুর-বাঁদুড় তাড়ায়।
পবনাকে দেখলে বাজারের লোকজন যায় খেপে। কুত্তা-বেড়াল খেদানোর মতো দূর দূর করে। কিন্তু পবনাও, চিজ একখান। কারো দোকানের সামনে গেলে কিছু না কিছু আদায় করবেই। ঘেঙটি পাড়ার ওস্তাদ! দিনরাত বড়পেট খিদে নিয়ে ঘোরে। দোকানিদের কাছে যায়। এটা নেয়, ওটা নেয়। তারপর মাছচালার ওদিকে নিরালায় বসে আয়েশ করে খায়। সঙ্গে থাকে বাজারের নেড়িকুত্তাটা। জগৎ-সংসারে এই একটাই জীব পবনার বড় বাধুক। পবনা নিজে খাবে যা তার একটু-আধটু কুত্তাটাকেও দেয়। রাতের বেলা পবনা যখন ধুলোবালি গায়ে দিয়ে মাছচালায় শোয়, কুত্তাটাও থাকে পাশে। পাশাপাশি দুটো জীবকে একরকমই দেখায়। খোলাবাজারে যেসব গেরস্ত আনাজপাতি নিয়ে বসে, ভালো বেচাবিক্রি হলে খুশিমনে এক-আধ পয়সা দেয় পবনাকে, পবনা তখন অন্য দোকানিদের কাছ থেকে দু’পয়সায় দু’আনার জিনিস আদায় করে। কতকাল ধরে যে এটা চলে আসছে কেউ জানে না। লতিফও না।
লতিফ এই বাজারে আছে সতেরো-আঠারো বছর। তখন থেকে পবনাকে দেখে। একই রকম। ওই একখান ধুতি পরা, একরকমই চেহারা-সুরত। দিন এলো গেল, কাল বদলাল। পবন ঠাকুর বদলায়নি। আরো কতকাল যে এই সুরত আর ধুতিখান নিয়ে টিকে থাকবে, কে জানে!
পবনাকে দেখে এখন এই কথাটা মনে হলো লতিফের। তারপর একটু মায়া হয়। দূর দূর করে না তাড়িয়ে লতিফ বলল, কিরে পবনা কই আছিলি হারাদিন? আইজ দিহি তরে দেকলাম না?
এই কথায় পবনা খুব খুশি। কেউ নরম গলায় কথা বললে সেখানে লেগে যায় সে। এখনো তাই করে। লতিফের চুলার ওপারে ঝাঁপ ঠিকনা দেওয়ার ত্যাড়া হয়ে দাঁড়ানো বাঁশটার সঙ্গে মাটিতে আসন পিঁড়ি করে বসে। তারপর দাঁত কেলিয়ে হাসে। আপনারে তো হারাদিনঐ দেখলাম কত্তা। বহুৎ কাম করতাছেন।
হ। ম্যালা কাম পইরা গেছে আইজ। হারা রাইতঐ দোকানে থাকতে অইব।
ক্যা?
মাজেদ খাঁর বাপের চলি্লশা কাইল। আদামোণ আমিত্তি বানাইয়া দিতে অইব।
লোকের ভালো খবর শুনলে পবনা খুব খুশি হয়। যেন নিজেরই বিরাট একটা কিছু হয়ে যাচ্ছে এমন গলায় বলল, আ হা হা হা হা। ভালা কতা, বহুৎ ভালা কতা। ভগবান দেউক, আরো দেউক আপনেরে। ঠিক তখনি মাছচালার দিক থেকে ছুটে আসে নেড়িকুত্তাটা। পবনার দোসর।
লতিফের গাহাকরা ওঠে এসবের একটু পরে। পয়সা দিয়ে চলে যাওয়ার পর লতিফ দেখে গেলাসগুলো টেবিলের ওপর পড়ে আছে। তার হাত আজার না। একহাতে আমৃতি পেঁচিয়ে ছাড়ছে তেলের কড়াইয়ে আর অন্য হাতে রসের সিরা থেকে তুলে ঝাঁজরে রাখছে। টেবিল থেকে চায়ের গেলাস আনে কে?
লতিফ বলল, ওই পবনা, গেলাসটা আন।
কেউ কোনো কাজের কথা বললে পবনা খুব খুশি হয়। ছুটে গিয়ে গেলাস এনে দেয়। দুইয়া দিমু? লতিফ ভাবে, পবনার হাতে চা’গেলাস দোয়াইতে দেকলে বদনাম অইয়া যাইব। গেরামের গইণ্যমাইন্য মাইনষে তাইলে আর আমার দোকানে চা খাইতে আইব না। এগারোজন পুষ্যি লইয়া আমি কি তাইলে না খাইয়া মরুম! ইট্টুহানি আয়াশের লাইগা দোকানের বদনাম করুম! লতিফ ব্যবসায়ী মানুষ। মুখে এসব কথা বলে না। পবনা পাগল-ছাগল মানুষ। বাজারের নেড়িকুত্তা। তবুও।
লতিফ কায়দা করে বলল, না থাউক। থুইয়া দে। আইজ আর গাহাক আইব না। আজাইর পাইলে আমিঐ ধুমুনে!
গেলাস কটা লতিফের পায়ের কাছে রেখে দেয় পবনা। তারপর আবার মাটিতে আসন পিঁড়ি করে বসে। একখান আমিত্তি দিবেন কি কত্তা?
শুনে লতিফ একটু বিরক্ত হয়। নারকেলের আইচায় আমৃতির মসলা তেলের কড়াইয়ের ওপর পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছাড়ে। তুই হারাদিন খালি খাওনের প্যাঁচাইল পারচ ক্যা?
এ কথায় পবনা খিকখিক করে একটু হাসে। কী করুম কত্তা, পোড়া পেটখান খালি খাই খাই করে। আর আইজ আপনে যেই আমিত্তি ভাজতাছেন, ঘেরানে গাঙের মাছও উপরে উইট্টা যাইব! আমি তো মানুষঐ। গাঙপার বইয়া আছিলাম। তহন বাজার থনে একখান বাতাস গেল। হায় হায় বাতাসে খালি আমিত্তির ঘেরান, হেই ঘেরান পাইয়া আমি পাগলের লাহান দৌড়াইয়া আইলাম।
লতিফ কোনো কথা বলে না। হাসে। আর মনোযোগ দিয়ে তেলের কড়াইয়ে আমৃতি ছাড়ে, আমৃতি তোলে। পবনা বলল, দেন একখান আমিত্তি। ভগমান আপনের কিরপা করব।
শুনে লতিফ কেন যে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর উদাস গলায় বলে, পবনারে আইজ হারা রাইত আমার আমিত্তি ভাজন লাগব। তুই এই চুলার পারেঐ বইয়া থাকিচ। হারারাইত। বোজচ না, একলা মানুষ হারারাইত বইয়া আমিত্তি ভাজুম। আমার ডর করে। বাজানে কইত আমিত্তি ভাজনের ঘেরানে বলে পরিস্তান থনে জিন-পরিও আইয়া পড়ে।
পবনা বলল, এই যে আপনের এহেনে বইলাম কত্তা, আর উডুম না। তয় একখান কতা কই আপনেরে, আইজ এই বাজারে জিন-পরি আইবই। যেই ঘেরান বাইরাইছে। তামান দুনিয়াঐ এই ঘেরান পাইব!
লতিফ কোনো কথা বলে না। এক কড়াই আমৃতি ছেড়ে ওঠে। তারপর দোকানের ভেতর থেকে দুটো করে আটখান মাটির পাতিল এনে চৌকির কাছে মাটিতে সার করে রাখে। আড়াই সেরি পাতিল একেকখান। নবকুমারের দোকান থেকে দুপুরবেলাই এনে রেখেছে। দেখে পবনা বলল, কয় সেইরা পাইল্লা?
আড়াই সেইরা।
কয়খান?
আষ্টখান। তুই কি নিকাস বুজচ না বেডা? আড়াই সেইরা আষ্টখান পাইল্লা না অইলে আদমোণ আমৃত্তি আডেনি?
পবনা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। হ। তয় একখান কতা কই আপনেরে কত্তা, আমি কইলাম পুরা আড়াই সের আমিত্তি এক বহায় খাইতে পারুম। এক ঢোকও পানি খামু না। ইট্টু উডুম না।
শুনে ধমকে ওঠে লতিফ। বড়ো প্যাঁচাইল পারচ তুই। তর বাপেনি খাইছে কুনোদিন এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি?
মাছচালার দিক থেকে হেঁটে আসছিল আউয়াল। মুদি মনোহারির দোকান চালায়। সারা দিন দোকানে থাকে না আউয়াল। আগে থাকত। নতুন বিয়ে করছে, রাতেরবেলা বউর কাছে না থাকলেনি হয়!
বাড়ি যাওয়ার সময় লতিফের দোকানে একবার আসে আউয়াল। খানিকক্ষণ বসে যায়। গল্পগুজব করে। বেচাবিক্রির আলাপ। হাসি, বিড়ি খাওয়া।
আজ হাসতে হাসতেই আসে আউয়াল। তারপর লতিফের দিকে তাকিয়ে বলে, কী কয়, পাগলায়? লতিফও হাসে। কয় ও বলে এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারব। এক ঢোকও পানি খাইব না, ইট্টু উডব না।
হালায় একটা পাগলঐ। বলে ট্যাঁক থেকে বিড়ি বের করে আউয়াল। লতিফকে দেয় একখান। নিজে নেয়। তারপর বিড়ি ধরিয়ে বেঞ্চে বসে। ওই পাগলার পো, তর বাপেনি খাইছে কুনোদিন এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি!
তারপর আবার হাসে।
আউয়াল মানুষটা মন্দ না। ঠাট্টামশকরা পছন্দ করে। আর হাসতে। এ জন্যে দোকানে গাহাক পড়ে বেশি আউয়ালের। দেখে অন্য দোকানিদের পোদ জ্বলে। হলে হবে কী, কেউ কিছু বলে না।
পবনা বলল, আমার বাপে পারত পাঁচ সের খাইতে। এক বহায়। আমি হেই বাপের পোলা, আড়াই সের পারুম না। দিয়া দেহেন কত্তা কেমনে খাই।
লতিফ বিরক্ত হয়ে বলল, আজাইরা প্যাঁচাইল পারিচ না পবনা। বয়। অন্য কথাবার্তা ক, আমার কাম আউগগাইব।
একথায় পবনা একটু উদাস হয়। ফাঁকা শূন্য চোখে আকাশের দিকে তাকায়। তাকিয়ে থাকে। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, আমার বাপে আছিল ডাকাইত। বিকরামপুরের বুড়া মাইনষের মুখে হোনবেন কেষ্ট ঠাকুরের নামডাক। মাইনষে কইত কেষ্টা ডাকাইত। যাগ বয়েস পাঁচ কুড়ি ছয় কুড়ি। আমার বাপের নামে হেই আমলে গেরস্তরা রাইত্রে গুমাইত না। রাইত্রে বিচনায় হুইয়া পোলাপান কানলে বউ-ঝিরা কইত, কেষ্টা আইল। কেষ্টার নামে পোলাপানেও ডরাইত। কান্দন থামাইত, গুমাইয়া পড়ত। গেরামে গেরামে মাইনষে চকি দিত। দল বাইন্দা। কেষ্টারে ঠেকাও। অইলে অইব কী, কাম অইত না। বাপে আমার ঠিকই মাইনষের মাতায় বাড়ি মারত। সব্বস্বান্ত করত। দিবেননি কত্তা একখান আমিত্তি?
পবনার শেষ কথাটা কেউ গায়ে মাখে না। লতিফ মনোযোগ দিয়ে ঝাঁজরের ওপর আমৃতি তোলে। আউয়াল বিড়ি টানতে টানতে বলে, তর বাপে আছিল ডাকাইত। মাইনষের মাতায় বাড়ি মাইরা টেকা-পয়সা, মাল-সামান লইত আর তুই নেচ বিক্কা কইরা। বলে আবার সেই গাহাক ভোলানো হাসিটা হাসে।
পবনা বলল, এইডা অইল গিয়া কত্তা বরাতের খেইল। ডাকের কথা আছে না, চোর-ডাকাতের গুষ্টির অন্ন জোডে না। আমার অইছে হেই দশা।
তারপর ফুরুক করে মুখের ভেতর লালা টানে পবনা। কত্তা, দিবেন নি একখান! পেট্টা পুইরা গেল!
লতিফ কথা বলে না। বলে আউয়াল, ওই পবনা পারবি তুই আড়াই সের আমিত্তি খাইতে? এক বহায়?
কন কী কত্তা? পারুম, হাচাঐ পারুম। দিয়া দেহেন না!
যুদি না পারচ?
না পারলে আপনেরা বিচার করবেন?
কী বিচার করুম?
যা আপনেগ মনে লয়।
আউয়াল মানুষটা আমুদে। পবনার কথায় হঠাৎ ভারি ফুর্তি হয় তার! যুদি তুই এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারচ, আমিত্তির দাম তো আমি দিমুঐ আবার কাইল থনে আমার দোকানে তর খাওন-থাকন ফিরি। যতদিন তুই বাঁচবি। আর যুদি না পারচ তাইলে এই বাজারে থনে আইজঐ তরে বাইর কইরা দিমু। কুনুদিন এহেনে আর আইতে পারবি না। ক রাজি আছচ নি?
পবনা ফুর্তিতে গর্দান কাত হয়। ফুরুক করে মুখের ভেতর লালা টেনে নেয় আবার। এক বহায় তো খামুঐ। এক ঢোকও পানি খামু না। উডুমও না।
লতিফ এসব কথা খেয়াল করছিল না। আধমণ মিষ্টির অর্ডার, ষাট-সত্তর টাকার কাজ। ওই একটা চিন্তায়ই সে মগ্ন। দিন বুঝি তার বদলায়।
আউয়াল বলল, হুনছনি লতিফ?
লতিফ আনমনে বলল, কী? পবনা যদি এক বহায় আড়াই সের আমিত্তি খাইতে পারে তয় আমিত্তির দাম তো আমি দিমুঐ। আবার কাইল থনে আমার দোকানে অর থাকন-খাওনও ফিরি।
আউয়াল মৃদু হেসে বলল, কী কচ পবনা?
হাচাঐ কই কত্তা। দিয়া দেহেন না।
আউয়ালের কেন যে এত উৎসাহ। বলল, খাড়া মানুষজন ডাক দেই। বলেই চেঁচিয়ে আশপাশের দোকানিদের ডাকে। ও মিয়ারা, আহেন ইদিকে। কাম আছে।
শুনে লতিফ হাসে। আর ভেতরে ভেতরে খুশি হয়। আরো আড়াই সের আমৃত্তি বুঝি বিক্রি হয়ে গেল তার। আরো দশ-বারো টাকার বুঝি কাজ হয়।
আউয়ালের হাঁকডাকে দু’তিনজন আজার দোকানদার এসে জোটে। কী অইল আউয়াল মিয়া? আউয়াল মহা ফুর্তিতে ঘটনাটা বলে, শুনে কাশেম বলল, কী কচ পবনা? হাচাঐ পারবি? নাইলে বুজিচ বাজার ছাড়তে অইব। এহেনে আর কুনুদিন আইতে পারবি না।
পবনা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। কত্তারা আমি কি আপনেগ লগে মশকরা করতাছি নি? এবার কথা বলে লতিফ। বুইজ্জা দেক পবনা, আড়াই সের আমিত্তি এক বহায় খাওন খেলা কতা না।
লতিফ বলল, আবার বোজ?
বুজছি বুজছি, দিয়া দেহেন।
এবার উত্তেজনা বেড়ে যায় আউয়ালের। লতিফ। টেকা আমি দিমু।
লতিফ তো মহাখুশি। তবুও মুখে কিছু একটা বলতে যাবে, তাকে থামায় কাশেম। তোমার কী লতিফ বাই, দেও। ইট্টু কষ্ট কইরা আড়াই সের আমিত্তি বেশি বানাইবা! দাঁড়িপাল্লা হাতে নিয়ে লতিফ বলল, আমার অসুবিদা নাই। মাল-সামান আছে। আদা ঘণ্টার খাটনি। আমি চিন্তা করি পাগলার লেইগা।
পবনা বলল, আমার লেইগা আপনের কুন চিন্তা নাই কত্তা। আপনে আমিত্তি বানান আর দেহেন, পাগলায় কেমনে বেবাকটি খায়।
দু’পাল্লায় সোয়া সের করে গরম আমৃতি মেপে একটা মাটির খাদায় ঢেলে পবনাকে দেয় লতিফ। তারপর হাসে। অহনও টাইম আছে পবনা, বুইজ্জা দেক।
পবনার তখন দিকবিদিকের খেয়াল নেই। হাতের সামনে গরম গরম আড়াই সের আমৃতি। সবই তার। একলা খাবে। কতকালের সাধ। খাওয়ার সাধ পূরণের যে কী সুখ, পবনা ছাড়া পৃথিবীর আর কে তা এই মুহূর্তে জানে!
প্রথম আমৃতিটা মুখে দিয়ে পবনা বলল, আহা কী সোয়াদ গো কত্তা। আইজ রাইতে আপনের দোকানে জিন-পরি আইবঐ।
এ কথায় লতিফ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। বাপের মুখে শুনেছিল, খাঁটি মিষ্টি নিতে পরিস্তান থেকে জিন-পরি আসে গভীর রাতে। দোকানের বেবাক মিষ্টি নিয়ে যায়। যত হাঁড়ি মিষ্টি নেয় টাকা দেয় তত হাঁড়ি। ভাগ্যকুলের কালচাঁদ একরাতে সাত হাঁড়ি টাকা পেয়েছিল। সেই টাকায় কালচাঁদ এখন মহা ধনী। কলিকাতায় শয়ে শয়ে মিষ্টির দোকান তার। বাড়ি, গাড়ি।
লতিফ ভাবে, আইজ রাতে যদি হাচাঐ জিন-পরি আহে আমার দোকানে! যুদি আধামণ আমৃতি লইয়া আধামণ টাকা দেয়! ইস্ তাইলে আর কথা নাই। এই দিন থাকব না। বদলাইয়া যাইব।
গপাগপ দশটা আমৃতি খেয়ে পবনা বলল, বেশি খাওন সামনে থাকলে আমার আবার ইট্টু প্যাঁচাল পারতে অয়, বুজলেননি কত্তারা। আপনেরা আইজ্ঞা করলে কই।
আউয়াল বিড়ি ধরিয়ে বলল, ক। তয় বুজিচ, বেবাক কইলাম খাইতে অইব। ওকাল পাকাল করতে পারবি না।
পবনা হাসে। দেহেন না কত্তা কেমনে খাই।
তারপর আর একটা আমৃতি মুখে দেয়। একবার আমার বাপে গেছে চরে ডাকাতি করতে। আমি তহন পোলাপান। সাত-আষ্ট বচ্ছর বয়েস। আমাগ বাড়ি আছিল কোরাটি গেরামে। পদ্মার পারে। অহন আর কোরাটির নামগন্ধ নাই। পদ্মায় ভাইঙা গেছে। তয় আমি করতাম কী, হারাদিন গাঙপার পইড়া থাকতাম। মায় আমারে গাঙপার থনে দইরা আইন্না বাতপানি খাওয়ায়।
পবনা আর একটি আমৃতি মুখে দেয়।
ততক্ষণে আরো দু’চারজন দোকানদার এসে ভিড় করছে লতিফের দোকানের সামনে। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বেঞ্চে বসে। সবাই হাঁ করে দেখছে পবনাকে। পবনার পাশে কুত্তাটা। আমৃতির লোভ তারও আছে। এর মধ্যেই বার দুয়েক ঘেউ দিয়ে ফেলেছে সে। কী ঠাকুর, আমারে ইট্টু দিবা না! নাকি একলা-একলাই খাইবা! আ? পবনা খেয়াল করেনি। সুখের সময় কে কার কথা মনে রাখে!
আমৃতি চিবাতে চিবাতে পবনা বলল, বাজানে গেছে চরে ডাকাতি করতে। সাত দিন চইলা যায়, ফিরে না। কুনো সম্বাদ নাই। গাঙপার আটতে আটতে আমার খালি বাজানের কথা মনে অয়। কাসার বাসনে বাত বাইরা দিলে মারে আমি জিগাই, বাজানে আহে না ক্যা মা?
মায় কয়, আইব, বড় কামে গেছে।
তয় বাজানে কুনওদিন ডাকাতি করতে গিয়া দুই দিনের বেশি দেরি করত না। হেই কথা ভাইবা মনডা কেমুন করে আমার। অইলে অইব কি, পোলাপান মানুষ, মারে বেশি কতা জিগাইতে পারি না। রাইত-বিরাইত জাইগা হুনি আন্দার গরে মায় জানি কার লগে কতাবার্তা কয়। বিয়ানে কেঐরে দেহি না। মারে জিগাইলে কয়, আমি গুমের তালে কথা কই।
আবার তিন-চারটা আমৃতি খায় পবনা। ততক্ষণে বিকেল ফুরিয়ে গেছে। পদ্মার হাওয়ার সঙ্গে কাশরেণুর মতো উড়ে উড়ে আসছে অন্ধকার। দোকানে দোকানে জ্বলে উঠেছে হারিকেন, হ্যাজাগবাতি। লতিফ ময়রাও যে কোন ফাঁকে পুরনোকালের জংধরা হ্যাজাগটা পাম্প করে, তেল ভরে কাচ পরিষ্কার করে ম্যানটেলে আগুন দিয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। হ্যাজাগটা এখন মিষ্টির আলমারির সঙ্গে বসে জ্বলছে। কী আওয়াজ তার। শোঁ শোঁ। সেই আওয়াজের সঙ্গে মিলেমিশে আসছে আগরবাতির গন্ধ। সন্ধেবেলা দোকানে আগরবাতি জ্বালায় লতিফ। আজ সতেরো-আঠারো বছর। যে ধর্মের যে রীতি। হিন্দুরা দেয় ধূপ, মুসলমানরা আগরবাতি। যাবতীয় সুগন্ধই বুঝি পবিত্র।
হ্যাজাগ জ্বালিয়ে লতিফ আবার বসেছে চুলার পাড়ে। মনোযোগ দিয়ে আমৃতি তুলছে। পবনার চারপাশের ভিড়টা একটুও নড়েনি। দোকানিদের কত কাজ থাকে সন্ধেবেলা, আজ সেসব কাজের কথা কারো মনে নেই।
হ্যাজাগের দিকে তাকিয়ে আবার দু’খান আমৃতি খায় পবনা। ছয় দিনের দিন নিশি রাইতে গুমের তালে আমি হুনি কি, কই জানি বহুৎ দূরে কী একখান পইক ডাকতাছে। কু কু। হুইনা আমার বুকের বিতরে কেমুন জানি করে। পোলাপান মানুষ তো, কিচ্ছু বুঝি না। বিয়ানে উইট্টা দেহি মনে নাই কিছু। পরদিন দুইফর বেলা, আমি আর মায় বইয়া রইছি দাওয়ায়, এমুন টাইমে একজন অচিন মানুষ আইল। মাতায় তার আড়াই সেইরা একখান মাইট্টা পাইলা। নতুন। মুখখান আবার বাঁশকাগজ দিয়া বান্দা। দেকলে মনে হয়, মিষ্টি মাতায় লইয়া বিয়ার চলনে যাইতাছে। আমি চাইয়া চাইয়া মানুষটারে দেহি। হেয় দেহি আমাগ বাইতঐ আহে। দেইক্কা আমি আর আমুদে বাঁচি না। আমাগ কুনো সজন আইলনি। মেলাদিন বাদে আইল দেইক্কা বুঝি মিষ্টি লইয়া আইছে। মিষ্টির মইদ্যে আমিত্তি অইল আমার জানপরান। পাইলা দেইখা আমার লোভ পইরা যায়। আহা আইজ পেট বইরা আমিত্তি খামু। কুনোদিন তো ভরপেট আমিত্তি খাই নাই। দুই চাইরখান খাইছি। পেডের কোনাও ভরে নাই।
আউয়াল বলল, ওই পবনা খাচ না? অহনো তো এক সেরও খাইতে পারচ নাই। বেবাকটি যুদি না পারচ তাইলে বুজিচ। আইজঐ পিডাইয়া বাজার থেকে খেদামু।
লোকে বোঝে, আড়াই সের আমৃতির দাম দিতে অইব। আবার কাইল থনে পবনার থাকন-খাওন। জেদের চোটে কাজটি করেছে আউয়াল। সেই রাগে ভেতরে ভেতরে গজরাচ্ছে এখন। দেখে অন্য দোকানিরা খুশি হয়। ভালা হোগামারানি খাইছে হালায়। পয়সার গরম, বোঝ অহন!
লতিফও মনে মনে হাসে। হোগায় গুঁড়া কিরমি অইলে এমনুঐ অয়।
কথা বলতে বলতে পবনা একটু আনমনা হয়েছিল। আউয়ালের খ্যাঁকানিতে আমৃতির কথা মনে পড়ে। আবার নতুন করে খাওয়ার লোভটা হয়। এক থাবায় দু’তিনটে আমৃতি তোলে পবনা। মুখে দেয়। এইভাবে চার-পাঁচবার। দেখে ভিড়টা হুল্লাচল্লা করে ওঠে। এইবার পবনা ওকাল করব।
শুনে গর্জে ওঠে আউয়াল। লতিফের দোকানের ঝাঁপ ঠিকনা দেওয়ার বাঁশটা আঁকড়ে ধরে। ওকাল করলেই পিডান আরম্ভ করুম।
পবনা সেসব খেয়াল করে না। আমৃতির স্বাদ মুখে নিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসে। চেইতেন না কত্তা। বহেন আর দেহেন। তয় আমারে ইট্টু কতাবার্তা কওনের টেইম দিতে অইব।
পবনা আবার দুটো আমৃতি খায়। মানুষডা করল কী, বুজলেননি কত্তারা, পাইল্লাখান মার পার সামনে নামাইয়া ইট্টু খাড়ায়। খরালিকাল আছিল। কত্তার চুলার লাহান গরম অইয়া গেছে দুনিয়া। মানুষডা গাইম্মা চুইম্মা সারা। মাজায় বান্দা আছিল লাল একখান গামছা। খুইল্লা মোক পোছে। চেহারাখান কী তার, দেকলে ডর করে। মাথায় বাবরি চুল। মোকে খাশির লাহান কালা মোচ, দাড়ি। চক্কু দুইখান শোল মাচের পোনার লাহান লাল। কইল, ওস্তাদ আপনেগ লেইগা মিষ্টি পাডাইছে। হেয় আইব সাত দিন বাদে। হুইনা মায় আমার কুনো কতা কয় না। মানুষডা কুন দিকে যে চইলা যায়, আর দেহি না। তয় আমার তহন কুনওদিকে খেল নাই। মায় যেমুন বইয়া রইছিল, তেমুনঐ বইয়া থাকে দেইখা আমার পরানডা আইঢাই করে। পাইল্লাডা খোলে না ক্যান মায়। বইয়া রইছে ক্যা? মোক দিয়া আবার লোল পড়ে আমার। সইতে না পাইরা কাগজ ছেদা কইরা পাইল্লার ভেতর আত দেই আমি। হায় হায়, আত দিয়া দেহি মিষ্টি কৈ! আতে দেহি বেতকাডার লাহান কী বিন্দে! উক্কি দিয়া দেহি কি, হায় হায় মিষ্টির নামে হারে বাইশ, পাইল্লার মইদ্যে বাজানের কল্লাডা। বাজানের মাথার চুল আছিল কুডিকুডি। বেতকাডার লাহান খাড়াখাড়া। মোক ভরা মোচ, দাড়ি। গায়ের রংখান আছিল চুলার ছাইয়ের লাহান। আন্দারে বাজানের চক্কু দুইডা ছাড়া আর কিছু দেহা যাইত না। পাইল্লার মইদ্যে বাজানের কল্লাডা দেইক্কা, পোলাপান মানুষ কিচ্ছু বুঝি না আমি। কই, মাগো, দেহ পাইল্লাডার মইদ্যে দিহি বাজানের মাতাডা।
কী কচ? মায় আমার পাইল্লার মইধ্যে ফালাইয়া পড়ে। তার বাদে চিক্কার মাইরা অজ্ঞেন। বুঝলেননি কত্তারা, মায় অজ্ঞেন হইয়া গেল। হেয়া দেইক্কা আমি চিক্কইর আরম্ভ করি। আমার চিক্কইরে পশ্বিরা দরাইয়া আহে। ওই পবনা কী অইছে রে? আ?
আমি কিচ্ছু বুঝি না। কী কমু। পশ্বিরা বাজানের কল্লাডা বাইর করে। তার বাদে হারা গেরামের মানুষ আইয়া ওডে আমাগ বাইত। আসলে অইছিল কী, বুজলেননি কত্তারা, চরে ডাকাতি করতে গিয়া ডাকাতির মাল-সামান লইয়া সাকরিদগ লগে কাইজ্জা লাগে বাজানের। হের লগের মাইনষেঐ হেরে মারে। তার বাদে কল্লাডা কাইট্টা আত্মীয় বাইত মিষ্টি পাডানের লাহান আমাগ বাইত পাডাইয়া দেয়।
পবনা আর দু’তিনটে আমৃতি খায়। লোকজন নিজেদের মধ্যে কী কী সব কথাবার্তা কয়, পবনার কথা শোনে কি শোনে, বোঝা যায় না। কেবল পবনা আড়াই সের আমৃতি খেতে পারবে কি, পারবে না, তাই নিয়ে কথা।
আউয়াল দেখে অর্ধেকের বেশি আমৃতি খেয়ে ফেলেছে পবনা। বাকি অর্ধেকও বুঝি খেয়ে ফেলবে! যেভাবে কথা বলে আর খায়, বেজায় লোকসান হয়ে গেল আউয়ালের। কেন যে চালাকি করে আগে সময় বেঁধে দেয়নি। এখন পবনা যদি সারা রাত বসে আস্তে ধীরে খায় আর কথা বলে! এ কথা ভেবে ভাবনায় পড়ে যায় আউয়াল। পবনা যদি সারা রাত বসে খায়, তাহলে তো তারও সারা রাত বসে থাকতে হবে। ওদিকে নতুন বউ বিছানায় শুয়ে সারা রাত এপাশ-ওপাশ করবে। সকালবেলাও বাড়ি ফেরা যাবে না। দোকানে যেতে যেতে কাল সন্ধ্যা। তখন বউ থাকবে মুখ ভার করে। কথাই বলবে না। তার ওপর নতুন শরীরের স্বাদ। আহা দুনিয়ার যাবতীয় মিষ্টিদ্রব্যের চেয়েও মিষ্টি। সেই কথা ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যায় আউয়ালের।
খেঁকিয়ে বলে ওই পবনা হবিরে কর। তর লেইগা কি হারা রাত বইয়া থাকুমনি?
এ কথায় পবনা একটু বেজার হয়। এমুন কলাম কতা নাই কত্তা। আমি কইছি এক বহায় খামু। বান্দা টেইম দেই নাই। আপনি খালি দেকবেন আমি না খাইয়া উডিনি। তাইলে যা মনে লয় করবেন।
লতিফ ততক্ষণে ছয়-সাত সের আমৃতি ভেজে শেষ করেছে। মাটির ঝাঁজরটা এখন আমৃতিতে ভরা। না সরালে খোলা নামাবে কোথায়। এই ভেবে লতিফ তার টিনের দাঁড়িপাল্লা টেনে নেয়। গামছা দিয়ে মোছে। তারপর সোয়া সের ওজনের দু’খান বাটখারা এক পাল্লায়, আরেক পাল্লায় আমৃতি মেপে নতুন পাতিলে রাখতে থাকে। এক-একটায় দু’পাল্লা করে। মাপতে মাপতে বাইরেও চোখ রাখে। বাইরে আড়াই সেরের কারবার। আট ন’টাকার কাজ। কথাটা ভেবে ভেতরে ভেতরে খুশিতে মরে যায় লতিফ। আইজ সব কিছু কেমুন জানি লাগে! বিয়ানে পাইলাম আদামোণ আমিত্তির গাহাক। বিয়ালে আড়াই সের। নিশি রাইতে ভাইগ্যাকুলের কালাচান্দের দোকানের লাহান আমার দোকানে আইজ জিন-পরি আইব নাত! আদামোণ আমিত্তি লইয়া আদামোণ টাকা যুদি দেয়! হায় হায়রে, তাইলে আর কতা নাই। দিন বদলাইয়া যাইব। দিন বদলের চিন্তায় মগ্ন থাকে লতিফ। বাইরে কে কী বলে, পবনা কতটা আমৃতি খায় না খায় খেয়াল করে না।
পবনার কথায় চুপ করে থাকে আউয়াল। নিজের দোষে নিজে ফেঁসেছে। কিছুই বলার নেই। তবুও তেজি গলায় বলে, বাইত যামু না বেডা!
পবনা হাসে। যাইয়েন নে। বহেন, হপায় তো হাজ অইল। তারপর আবার আমৃতি মুখে দেয়। ঘজ ঘজ করে আমৃতি চিবায় আর কথা বলে। বাজানে তো মরল। হেই দুঃখে আমি আর বাইত থনে বাইর অই না। খালি চিন্তা করি, মাইনষে মইরা যায় কই। ফিরত আহে না ক্যা! তয় একখান কতা কী, মারে দেহি আগের চাইয়া যেমন বেশি আশিখুশি। পোলাপান মানুষ তো, বুঝি না, ক্যান! রাইতে আন্দার গরে হুইয়া ফুসুর-ফাসুর মানুষের কতা হুনি। বেডা মাইনষের গলা। কেডা আহে রাইতে আন্দার ঘরে! মায় তার লগে কী এত কতা কয়? অইলে অইব কী, বেছি পুচপাচ করন যায় না। আমি পোলাপান মানুষ জিগাইলে মা কয়, তুই সপন দেহচ। আর নাইলে আমি যে গুমের তালে কতা কই, হেই হুনচ। হায় ভগমান! তার বাদে অইল কী, বুজলেননি কত্তারা। একদিন নিশিরাইতে অইছে কী, আমি গুমের মইদ্যে হুনি কই জানি বহুত দূরে হেই পইকডা আবার ডাকতাছে। কুকু। হেই ডাকে আমার নিদ ছুইটা যায়। ডর করে। আন্দারে আইত্তাই, মা মাগো। মার কুনো হদিস পাই না। এই ঘুডঘুইট্টা আন্দারে মায় গেল কই! তার বাদে মালুম করি পেশাব-পাইখানা ফিরতে গেছে। আইবোনে। আবার গুমাইয়া যাই। এক গুমে রাইত পার। মাইনষে কয় না কালগুম, বুজলেননি কত্তারা। বিয়ানে উইট্টা দেহি মায় তো আমার কুনোহানে নাই। পাড়া বইরা বিচরাই, গেরাম নাই। মায় আমার কুনো হানে নাই। হেষমেশ যাই দাইমার বাড়ি। হেয়ও আমার লগে মারে বিচরায়। নাই। মায় আমার নাই।
দাইমার আছিল এক মাইয়া, হরিদাসী। আমার লাহান বয়েস। দাইমার পতি চিতায় গেছে একখান ঘোড়া রাইখা। সেই ঘোড়াখান বেলদারগ কাছে বর্গা দিয়া, মাইয়া লইয়া দুইবেলার অন্ন জোটে দাইমার। এমুন মানুষ হেয়। আমি আর হরিদাসী মিইল্লা বেবাক জায়গায় মারে বিচরাই। সম্বাত নাই। আমি পোলাপান মানুষ, বিয়াল অইয়া যায়, মারে না দেইক্কা আমি চিক্কইর পারি। হেই দেইক্কা দাইমায় আমারে তাগ বাড়ি লইয়া গেল। বুজলেননি কত্তারা, তার বাদে কতদিন গেল, আইল, মায় আমার আর আইল না। বয়েসকালে বুজি মা’র একখান পিরিতের মানুষ আছিল। রাইতে বাজান থাকত না বাইত, হেই মানুষখান আইয়া মার লগে কতাবাত্তা কইত। বাজানে বাইচা থাকতে হের ডরে নাগরের আত ধইরা পলাইতে পারে নাই মায়। কেষ্টা ডাকাতের গরের বউ লইয়া পালাইব, এমুন ক্ষেমতা কুন মাইনষের আছে! তয় পালাইল, বাজানে মইরা যাওনের পর। আমারে একলা থুইয়া।
পবনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আস্ত একখান আমৃতি মুখে দিয়ে উদাস হয়ে চিবায়। কুত্তাটা কুত্তাদের চিরকালীন ভঙ্গিতে তখনো পবনার পাশে বসা। অবাক হয়ে প্রভুকে দেখছে। প্রভু যে আজ তাকে না দিয়ে একলাই খায়! কী কারণ? মানুষের সব আচরণ বোঝে না সে। মানুষ জাতটা বড় অদ্ভুত। কুত্তাদের মতো না। কুত্তাটা কেবল এই কথা ভাবে।
ততক্ষণে রাত হয়ে গেছে। বাজারের ঠিক ওপরে ফুটে উঠেছে কাটা বাঙির মতো চাঁদ। তার ম্লান একটা জ্যোৎস্না এসে পড়েছে বাজারের সাদা মাটিতে। পদ্মার হাওয়াটা আছেই। বাজারের ওপর ঘুরে ঘুরে আমৃতি ভাজার গন্ধ আর চাঁদের আলোর মিশেল দিচ্ছে এখন।
আমৃতি চিবাইতে চিবাইতে গলা খাঁকারি দেয় পবনা। বুজলেননি কত্তারা, আমি তার বাদে দাইমার বাইতেঐ থাকি। নিজের মাইয়ারে আর আমারে এক রহমঐ সোয়াগ আল্লাদ করে দাইমায়। রাইতে হোয়ায় তার লগে। অইলে অইব কী, মা’র কতা কলাম আমি ভুলি না। যহন তহন মনডা কান্দে। পরানডা কান্দে। আর দিন যায়। শইলখান আমার বাজানের লাহানঐ জুয়ান তাগড়া অইতে থাকে। হেই দেইখা দাইমায় একদিন কয়, অই পবনা জুয়ান মদ্দ তো অইয়া গেলি কামকাইজ কর। বিয়াশাদি কর। আমি আর কয়দিন। আপনা পেডেরডা তো আছেই, তুইও অহন আপনাঐ। তগ বেবস্তা না কইরা চিতায় উডুম কেমনে?
কামকাইজের কতাডা ভালাই, বিয়াশাদির কতা, বুজলেন না কত্তারা, হুইনা আমার লাজ করে। কই, কী করুম? বাজানের লাহান চুরি-ডাকাতি?
হেই হুইনা দাইমায় আমারে মুইরা পিছা লইয়াহে পিডাইতে। চুরি-ডাকাতি করনের লাইগা তরে পালছি, এ্যাঁ গোলামের পো।
দাইমারে আমি বহুত ডরাইতাম। কই, তয় তুমি কও কী কাম করুম।
দাইমায় আর কতা কয় না। পরদিন বেলদারগ থনে ঘোড়াডা ফিরাইয়া আনে। ঘোড়াডার নাম আছিল পঙ্খিরাজ। আইনা দাইমায় কয়, ল এই ঘোড়াডা দিলাম। এইডা লইয়া আডবার গোয়ালীমান্দ্রা যাবি, দিগলী যাবি। ধানচাইল টানবি, গেরস্তর সবজি টানবি। আমরা তিনজন মানুষ, দিন চইলা যাইব। হরিদাসী তহন ডাঙর অইয়া গেছে। জোলাগ কাপড় পিন্দা চলে। আর খালি আসে, খালি আসে। আমারে দেইখাও লাজ করে। হেই দেইকা, বুজলেননি কত্তারা দাইমায় হরিদাসীর লগেঐ আমারে—
কথাটা শেষ করে না পবনা। পাগল-ছাগল মানুষ, তবুও লাজলজ্জা আছে। তাই দেখে লোকজন হাসে। আমৃতি ভাজতে ভাজতে লতিফ বলে, কইয়া হালা পবনা, হরিদাসীর লগে আদম খেলা খেলনের বেবস্তা কইরা দিল।
শুনে হাসির রোল পড়ে যায়। পবনা কথা বলে না। আমৃতির খাদার দিকে তাকায়। তাকিয়ে খুশি হয়। পেরায় খতম অইয়া আইছে। আর তিন সাড়ে তিন গণ্ডা অইব আছে। পেডের তো অহনও কিছু অয় নাই আমার। আহা কী সুখ গো! আউয়াল কত্তায় কইছে কাইল থনে হের দোকানে থাকন-খাওন ফিরি। আমারে আর পায় কোন হালায়! সুখের কথা ভাবে, আর গপাগপ আমৃতি মুখে দেয় পবনা। পঙ্খিরাজ আছিল হরিদাসীর বাপের আমলের। বেলদারগ কাছে বর্গা আছিল। হালায় বেলদারের পোরা জবর খাটাইত পঙ্খিরাজরে। ধানচাইল টানাইতে টানাইতে আমরক্ত বাইর কইরা হালাইত। পঙ্খিরাজরে পয়লা দিন দেইক্কাঐ আমার এমুন মায়া লাগল, কী কমু কত্তারা। বিলে ছাইরা আইট কইরা খাওয়াইলাম কয়দিন। দেহি, হ পঙ্খিরাজ ঝাড়া দিয়া উড়ছে। তার বাদে শুরু করলাম কাম। গোয়ালীমান্দ্রার আডে যাই, দিগলীর আডে যাই। আডবার না থাকলে যাই অইলদার বাজারে, শিমইল্লার বাজারে। আয়-বরকত ভালোই অয়। দিন চইলা যায়। তয় আমি কইলাম কত্তারা, পঙ্খিরাজরে জবর সোয়াগ করতাম। হারাদিন কাম কইরা রাইতে দিতাম বিলে ছাইরা। পঙ্খিরাজ আছিল আমার খুব বাদুক। বিয়ানে রইদ উডনের আগেঐ বাইত আইয়া পড়ত। আবার কামে যাও। পেডের ধান্দা অইল বড় ধান্দা। তয় পঙ্খিরাজরে কলাম হরিদাসী দেখতে পারত না। কইত, এইডা অইল আমার হতিন। এই ফাঁকে আরেকখান কতা কই কত্তারা, যেদিনঐ আডেবাজারে যাইতাম, বাইত আহনের টেইমে আমি কলাম একখান দুইখান আমিত্তি কিন্না খাইতাম। আমিত্তি খাওনের লোবটা আমারে যে কেমুন হেইডা আপনেরা বুজবেন না। বাজানের কল্লাডা যেদিন মিষ্টির পাইল্লার লাহান আমাগো বাইত আইল, ওই দিন যে লোবটা অইছিল, আহা আইজ পেড বইরা আমিত্তি খামু—হেই লোবটা আর যায় নাই। অহনও আছে। মাইনষে কয় না, ভগমান মানুষের বেবাক আশা পূরণ না করলেও দুই-একখান করে। আমার আমিত্তি খাওনের আশাডা কইলাম পূরণ অইয়া গেল। এই যে আইজ। ইচ্ছামতন খাইতাছি। পেড বইরা। বলেই পবনা আবার আমৃতি মুখে দেয়। তাই দেখে আউয়ালের মুখে মরা বটপাতার রং ধরে। আদতেই তো হালায় বেবাকটি খাইয়া হালাইব। আর তো আছে পাঁচ-ছয়খান। ইসরে কী কামডা করলাম। কতডি টেকা লোকসান। আবার কাইল থনে পাগলার থাকন-খাওন দিতে অইব। ঘাইরামি করলে বদনাম।
নিজের ওপর রাগে জ্বলে যায় আউয়াল।
কাশেম বলে, হ বুজছি, বেবাকটিঐ খাইব হালায়।
তারপর পবনাকে বলে, একটানে খাইয়া হালা পবনা। দেইক্যা দোকানে যাই। লতিফ বলে, আর কী দেকবা, যাও। ঐত আর কয়খান।
ধীরেসুস্থে খাউক।
আউয়াল মনে মনে বলে, তোমার কি চোদানির পো। খালি মাইনষের হোগা মারনের তালে থাক।
মুখে এসব কথা বলা যায় না। আউয়াল আবার বিড়ি ধরায়। তারপর চাঁদের ম্লান আলো আর পদ্মার হাওয়ার ওপর ধোঁয়া ছাড়তে শোনে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হরিদাসী গেল পোয়াতী অইয়া। হেই দেইক্কা আমি হারাদিন পঙ্খিরাজরে লইয়া আডবাজারে পইরা থাকি। আমিত্তি খাওন ছাইরা দেই। খাওনের মুখ বাড়তাছে। আয় না বাড়লে কেমনে চলব। দাইমায়ও হেই কতাঐ কয়। ভালা কইরা কামকাইজ কর। পোলাপান অইলে খরচা আছে। খালি হরিদাসী কয়, এত কাম কইর না। নিজের জানপরানডার খেল রাইখ। পবনা আবার একটা আমৃতি মুখে দেয়। মুখে দিয়েই টের পায়, পেটটা কেমন করে। বুকটা কেমন করে। হায় হায় ওকাল পাকাল অইব না তো! তাইলে সব্বনাশ অইয়া যাইব। আউয়াল কত্তায় অহনঐ বাঁশ দিয়া পিডাইব। কাইল থনে এই বাজারে আর থাকন যাইব না। তাইলে আমি যামু কই। যাওনের একখান জাগা আছিল দাইমা। হেয় চিতায় উটছে একযোগে বারো বচ্ছর।
পবনা একটু নড়েচড়ে বসে। তাতে পেটটা একটু আরাম পায়। বুকটা একটু আরাম পায়। একদিন রাইতে হরিদাসীর বেদনা উঠল। বাইত আছিল একখান গর। দাইমায় কইল, ওই পবনা তুই গিয়া গাছতলায় ব। এই টেইমে মরদরা গরে থাকে না।
উডানে আছিল একখান রোয়াইল গাছ। আমি হেই গাছের লগে ঢেলান দিয়া বহি। নিশি রাইত। পঙ্খিরাজ গেছে বিলে। আসমানে চুনাকুমড়ার লাগান গোল একখান চান। চান্নী কী! ফক ফক করে। মাইত্তে ফুঁ দিলে ধুলাবালি উড়তে দেহা যায় এমুন। আমি গাছতলায় বইয়া বইয়া বিড়ি টানি আর হুনি গরের মইদ্যে হরিদাসী আহুইজ্জা বেদনায় কোঁকায়। আমার কেন জানি পরানডা কান্দে। কেমুন যানি লাগে। এমনু টেইমে হুনি কী, বুজলেন নি কত্তারা, কই জানি বহুত দূরে হেই পইকখান ডাকতাছে। কু কু। হুইনা আমার পরানডা কান্দে। কেমুন যানি লাগে। বিয়ান অয় নায়, তখন দাইমায় চিক্কইর দিয়া উঠল। হায় হায় রে, কী সব্বনাশ অইল গো। আমি দউর পাইরা গরে যাই। গিয়া দেহি হরিদাসী নিজে গেছে, পেডেরডাও লইয়া গেছে। দেইক্কা আমার যে মাতার মইদ্যে একখান চক্কর মারল, হেই চক্করডা আর কুনদিন গেল না। অহনও আছে।
পবনা তারপর আর কোনো কথা বলে না। উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী যে দেখে, কী যে ভাবে, কেউ জানে না।
খাদায় তখন একটা মাত্র আমৃতি। দেখে আউয়াল উঠে দাঁড়ায়। মরা বটপাতার মতো মুখটা নিয়ে বলে, খাইয়া হালা পবনা। বাইত যামু।
ম্যালা রাইত অইল।
কাশেম বলল, দেরি করচ ক্যা পবনা? খাইয়া হালা।
পবনার তখন পেটটা কেমন করে, বুকটা কেমন করে। এতকালের পুরনো শরীরটা আর নিজের মনে হয় না। ভাবটা চেপে থাকে পবনা। মুখে খুব বিনীতভাবে বলে, কত্তারা, এইডা না খাইলাম। কুত্তাডা হারাদিন বইয়া রইল, এইডা অরে দেই।
শুনে গর্জে ওঠে আউয়াল। বানড়ামি পাইছ বেডা হালা। খাও। নাইলে অহনঐ পিডামু। পবনার আর কথা বলার মুখ থাকে না। মনে মনে কুত্তাটার কাছে ক্ষমা চায় সে। ভাইরে ক্ষমা কইর।
তারপর শেষ আমৃতিটা মুখে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় পবনা। দাঁড়িয়ে টের পায় এতকালের পুরনো শরীরটা আর তার হাতের মধ্যে নেই। অচেনা হয়ে গেছে।
তখন ভিড়টা ভাঙছে। দোকানিরা পবনার গর্বে বুক ফুলিয়ে ফিরে যাচ্ছে। কত পদের কথা তাদের। সাব্বাস পবনা, বাপের নাম রাখছচ।
পবনা এসবের কিছুই শোনে না। অচিন শরীরখান টেনে টেনে, চাঁদের ম্লান আলো মাথায়, নদীর দিকে হেঁটে যায়। পৃথিবীর দূর কোনো প্রান্তে বসে কি সেই পাখিটা তখন ডাকছিল। কু কু?
পরদিন সকালে মাছচালায় ধুলোবালি থেকে মুখ তুলে নেড়িকুত্তাটা তার প্রভু পবন ঠাকুরকে খোঁজে। নেই।
কুত্তাটা তারপর ওঠে। উঠে বাজারময় চক্কর খায়। প্রভুকে খোঁজে। নেই, প্রভু কোথাও নেই।
কুত্তাটা তারপর মন খারাপ করে নদী তীরে যায়। সেখানে জেলেদের দু’তিনখান নাও ডাঙায় উপুর করে রাখা। মেরামত হবে। আলকাতরা মাইটা তেল খেয়ে আবার জলে নামবে।
কুত্তাটা দেখে দু’খান নাওয়ের মাঝখানে মাটিতে তার প্রভু পবন ঠাকুর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। দেখে কুত্তাটা দু’তিনখান ঘেউ দেয়। পবন ঠাকুর নড়ে না। কুত্তাটা কী বোঝে কে জানে, সে আর ঘেউ দেয় না। একটা নাওয়ের সামনে পা তুলে পেচ্ছাব করে।
ছেলেবেলার গল্প
দশ এগারো বছর বয়সে বয়রা হয়ে গেলেন হাফেজমামা। কানে একদমই শোনেন না। তবু তাঁর দুরন্তপনায় বাড়ির লোক অতিষ্ঠ। মেজোনানা জাহাজের সারেঙ। বাড়িতে পুরুষ বলতে কেউ নেই। হাফেজমামাকে শাসন করার কেউ নেই। তিনি তাঁর মতো দুরন্তপনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মেজোনানা বাড়ি এলেন। ছেলের লক্ষণ দেখে বিরক্ত। এসময় ফকির ফাকরা টাইপের কেউ ভবিষ্যদ্বাণী করল, এই ছেলের মুসলমানি করানো যাবে না। মুসলমানি করালে ছেলের অনিষ্ট হবে। সে জানে বাঁচবে না।
বয়রা কান নিয়েও কথাটা শুনতে পেলেন হাফেজমামা। ভিতরে ভিতরে রাগে ক্রোধে ফেটে পড়লেন। কিয়ের ঘোড়ার আণ্ডা অনিষ্ট হইব আমার? মোসলমানি না হইলে মাইনষে আমারে কইবো কী? আমি কি হিন্দু হইয়া থাকুমনি?
কোত্থেকে গোপনে একটা ব্লেড জোগাড় করলেন। পায়খানা ঘরে ঢুকে সেই ব্লেড দিয়ে নিজের মুসলমানি নিজে করে ফেললেন।
তখনকার দিনে হাফপ্যান্ট পরার রেওয়াজ ছিল না। বাচ্চা ছেলেরাও লুঙ্গি পরতো। রক্তে মাখামাখি হয়ে গেল হাফেজমামার লুঙ্গি। ওই অবস্থায় পায়খানা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। রক্ত মাখা লুঙ্গি দেখে হৈ চৈ পড়ে গেল বাড়িতে। কী হইছে? ও হাফেজ, কী হইছে?
হাফেজমামা কথা বলেন না। মুখ চোখ কঠিন করে রেখেছেন। বাবা এবং সৎমা নানারকমভাবে প্রশ্ন করেন, হাফেজমামা কথা বলেন না। আমার বুজি হচ্ছে তাঁর সবচাইতে প্রিয় মানুষ। শেষ পর্যন্ত বুজি তাঁকে ধরলেন। কথা কছ না ক্যা? ও হাফেজ, কী হইছে? এত রক্ত কিয়ের? অহনও তো রক্ত পড়তাছে!
বুজির কাছে গলা খুললেন হাফেজমামা। চাচী, নিজের মোসলমানি আমি নিজে কইরা হালাইছি।
শুনে মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা বুজির। বললেন, কী করছস? মোসলমানি? নিজের মোসলমানি নিজে করছস? সব্বনাশ! তুই তো মইরা যাবি।
বাড়িতে হাহাকার পড়ে গেল। মেজোনানা কান্নাকাটি শুরু করলেন। হায় হায় আমার এই পোলা তো আর বাচপো না! ফকিরে কইছিল মোসলমানি করাইলে অর অনিষ্ট হইব। সব জাইন্না বুইজ্জা এই কামডা ও কেমতে করল?
কিন্তু হাফেজমামা নির্বিকার। নিজেই ত্যানা দিয়ে মুসলমানি করা জায়গাটা প্যাঁচিয়ে বেঁধেছে। অপরিসীম মনোবলের অধিকারী ছেলে। পাঁচ সাতদিনে দিব্যি সুস্থ। কিসের অনিষ্ট! কিছুই হলো না।
নিজের মুসলমানির দিন হাফেজমামার ঘটনাটা আমার মনে পড়েছিল।
আমাদের তিনভাইয়ের মধ্যে বাদলের মুসলমানি হয়েছিল আগে। তখন সে বেশ ছোট। পেশাব করতে অসুবিধা হতো। সংসার আলী হাজাম দেখে বুজিকে বলল, মোসলমানি করাইয়া দেন। ভাল হইয়া যাইব।
এক বিকালে বাগানের দিকে একটা জলচৌকিতে বসিয়ে সংসার আলী হাজাম মোসলমানি করিয়ে দিল বাদলের। সমস্যাটা মিটে গেল।
বাদলের মুসলমানিতে কোনো উৎসব আনন্দ হয়নি। হয়েছিল আমার আর আজাদের মুসলমানিতে। আজাদ তখন কাজির পাগলা হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ে। আমি পড়ি থ্রিতে।
বিশাল আয়োজন হয়েছিল আমাদের মুসলমানিতে। ধুমধামের অন্ত নেই। সঙ্গে একটা দুর্ঘটনাও ঘটলো। দুপুরের পর পর ফিট হয়ে গেলেন বাবা। বুজি মা আর পুনুআম্মা ভাবলেন বাবা বোধহয় মারা গেছেন। আমরা মরা কান্না জুুুুড়ে দিলাম। মুসলমানির উৎসব আনন্দ ভুলে আমি ছটফট করছি আর কাঁদছি। চিৎকার করে কাঁদছি। বাবার কাছে যেতে চাইছি, লোকজনের ভিড়ে যেতে পারছি না।
বাবাকে আমি কী যে ভালবাসতাম!
কী যে টান বাবার জন্য আমার ছিল! বাবার মুখটা একপলক দেখার জন্য পাগল হয়ে থাকতাম। বাবার গলার আওয়াজ পেলে বুক ভরে যেত গভীর আনন্দে।
বাবাকে আমরা বাবা ডাকতাম না। ডাকতাম আব্বা।
আব্বা ডাকার পিছনে একটা ঘটনা আছে। তখন আমরা তিনটি মাত্র ভাইবোন জন্মেছি। আজাদ মণি আর আমি। আমার হয়তো এক দেড়বছর বয়স। মণির তিন সাড়েতিন। আজাদ পাঁচের ওপর। জিন্দাবাহার থার্ডলেনে থাকি। বাবা চাকরি করেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। ছুটির দিনে বড়ছেলের হাত ধরে কোনো এক কলিগের বাসায় গেছেন। সেই বাসার ছেলেমেয়েরা বাবাকে আব্বা ডাকে। আব্বা ডাকটা বোধহয় তখনকার জন্য আধুনিক। বাসায় ফিরে মাকে বাবা বললেন, তোমার ছেলেমেয়েদেরকে আব্বা ডাক শিখাও। এখন বাবাকে সবাই আব্বা ডাকে।
মা আমাদেরকে বাবার পরিবর্তে আব্বা ডাকতে শিখালেন।
চার পাঁচ বছর বয়সেই আমি নির্বাসনে চলে এলাম মেদিনীমণ্ডল গ্রামে। নানীর কাছে। নানীকে ডাকি বুজি। আজাদ আমি, কখনো কখনো মণিও এসে থাকতো বুজির কাছে।
কিন্তু আমার মন পড়ে থাকতো আব্বার কাছে। মার কথা মনেই পড়তো না। মেদিনীমণ্ডলের একেকটা নির্জন দুপুরে নানাবাড়ির বাগানের দিকটায় তাকিয়ে আমার খুব আব্বার কথা মনে পড়তো। ছোটখাটো রোগা ধরনের মানুষ। মুখটা কী সুন্দর। গলার আওয়াজ মধুমাখা। মাথায় হাত বুলিয়ে কাছে টানলে মনে হতো এরচে’ বড় আনন্দ জীবনে আর কিছু হতে পারে না।
সুন্দর একটা গন্ধ ছিল আব্বার গায়ে।
তখনকার ঈদগুলো হতো শীতকালে। আমরা তখন সাতটি ভাইবোন। আমার পর বাদল আর পলি যমজ। ওরা জন্মে ছিল জিন্দাবাহারের বাসায়। সেবার খুব বন্যা হয়েছিল। জিন্দাবাহারের ওই গলির ভিতর পানি ঢুকে গিয়েছিল। বাড়ির নাম্বার সাত। থার্ডলেন। টইটম্বুর পানিতে মাচা বেঁধে থাকতে হয়েছিল। ওই অবস্থায় যমজ ছেলেমেয়ের বাবা হলেন আব্বা। ওই বাসায় আর একটা মাত্র ভাই হয়েছিল আমাদের। উষার পর। সেই ভাইটিকে আমি দেখিনি। আঠারো দিন বয়সে মারা যায়।
সবার ছোট আসমা জন্মেছিল গেণ্ডারিয়ায়।
গেণ্ডারিয়ার ডিস্টিলারি রোডের পশ্চিম দিকটায়, ধোলাই খালের কাছাকাছি একটা জায়গার নাম মুরগিটোলা। মুরগিটোলায় আফতাব মিয়া নামের এক ঢাকাইয়া ভদ্রলোকের আড়াই তিনকাঠার ওপর একতলা বাড়িতে আমরা তখন থাকি।
ততোদিনে আমার ঢাকার জীবন শুরু হয়ে গেছে।
অঘ্রাণ পৌষমাসের তীব্র শীতে তখন ঈদ হতো। ঈদের সময় ফ্যামিলি নিয়ে গ্রামে আসতেন বাবা। দুইছেলে পড়ে আছে গ্রামে। তাদেরকে নিয়ে, বুজি এবং পুনুআম্মাকে নিয়ে ঈদ করবেন। কেরানীর চাকরি করেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। রুজি রোজগার ভালো। টাকা পয়সা খরচা করতেন অকাতরে।
সদরঘাট থেকে মুন্সিগঞ্জ হয়ে, কখনো চাঁদপুর হয়ে, মেঘনা পদ্মা পাড়ি দিয়ে লঞ্চ যায় লৌহজং মাওয়া তারপর ভাগ্যকূল। অমুক তারিখে বাড়ি আসবেন, চিঠি লিখে জানিয়েছেন আব্বা। তাঁর হাতের লেখা ছিল মুক্তার মতো। মাওয়ার ওদিককার সেহের আলী পিয়ন চিঠি দিয়ে গেছে বাড়িতে। ইনভেলাপের চিঠি না। পোস্টকার্ড। পুনুআম্মা শব্দ করে সেই চিঠি পড়ছেন, বুজি আমি আর আজাদ গভীর আগ্রহ নিয়ে শুনছি।
তারপর শুরু হতো দিনগোনা। কবে আসবে সেই দিন? কবে? কবে হাজামবাড়ির ছেলেদের নিয়ে আমরা দুটিভাই গিয়ে দাঁড়াবো নদীরঘাটে। বিকেল ফুরিয়ে আসা আলোয় লৌহজংয়ের ওদিক থেকে প্রথমে দেখতে পাবো লঞ্চের ধোঁয়া, তারপর আস্তে ধীরে ভেসে উঠবে একটা লঞ্চ। ভটভট শব্দ করে এগিয়ে আসতে থাকবে মাওয়ার দিকে।
লঞ্চ দেখেই নদীর পাড় ধরে দৌড়াতে থাকবো আমি। যেন যতদূর এগিয়ে যেতে পারি। যেন যত আগে আব্বাকে দেখতে পাই আমার কোনো বোনের হাত ধরে লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে আছেন। মুখে মোহন হাসি।
হাজামবাড়ির ছেলেরা ব্যাগ সুটকেস বহন করে আনতো। ছোটবোনগুলোর কেউ কেউ হাঁটতে পারতো না। মাওয়া তখন মেদিনীমণ্ডল থেকে অনেক দূরে। এক দেড়মাইল তো হবেই। এতটা পথ ছোট বাচ্চারা হাঁটবে কেমন করে!
কাউকে কাউকে কোলে করে আনতে হতো।
আব্বা বাড়ি এলে কী যে উৎসব শুরু হতো! ঈদের আগের সন্ধ্যায়ই যেন ঈদ শুরু হয়ে যেত। হয়তো খানিক আগে বারবাড়ির ওদিকটায় দাঁড়িয়ে, বিলের বাড়ির শিমুলগাছটির মাথার ওপর মিষ্টি কুমড়ার ফালির মতো চাঁদটা একটুখানি দেখা গেছে, তারপরই যেন শুরু হয়ে গেছে ঈদ।
কোনো কোনো বছর শীতের বিকেলে বিলের দিকে জমে ওঠা কুয়াশায় চাঁদ দেখা যেত না। দেশ গ্রামের মানুষ পড়ে যেত ধন্দে। কাল কি ঈদ হবে?
সে বছর আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য স্পঞ্জের স্যান্ডেল কিনে নিয়ে গেছেন আব্বা। আর কেরোলিনের হাফশার্ট। স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর কেরোলিনের শার্ট তখন বিরাট ফ্যাশান। সঙ্গে আছে ইংলিশ প্যান্ট। আমার শার্টটা ছিল হালকা আকাশি রংয়ের। আজাদেরটা হালকা সবুজ। আগের রাতে উত্তেজনায় আমার ঘুম আসে না। কখন, কখন সকাল হবে, কখন গোসল করে স্পঞ্জের স্যান্ডেল আর কেরোলিনের শার্ট পরবো। কুয়াশার জন্য চাঁদ দেখা যায়নি। তাতে কি? ঈদ তো কাল হবেই।
গ্রামে তখন রেডিও নেই। ঈদের খবর শোনার কোনো উপায় নেই। ঊনত্রিশ রোজার পরই ঈদ হবে, নাকি রোজা হবে পুরা ত্রিশটা কে জানে! ‘খাইগ’ বাড়ির মাঠে প্রতিবছরের মতো ঈদের জামাত হবে এটা তো সবাই জানে।
আনন্দ উত্তেজনায় ‘বিয়াইন্না রাইতেই’ উঠে গেছি আমরা। বাইরে তখনো আলো ফোটেনি। কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে দেশগ্রাম। মা আম্মা আর বুজি কুপি হাতে চলে গেছেন ‘রান্ধন’ ঘরে। ক্ষির সেউই রাঁধতে বসবেন। রান্নাবান্নায় তাদেরকে সাহায্য করতে হাজামবাড়ি থেকে আসবে অজুফা। পারু নামে একটা যুবতী মেয়ে আছে বাড়িতে। কোন দিককার দূরসম্পর্কের আত্মীয় পারু আমি জানি না। সে থাকতো আমাদের বাড়িতে। কাজের মেয়ে হিসাবেই থাকতো।
আমরা ‘কেফিনে’ বসে, বারান্দা কিংবা ‘খাটালে’ বসে অপেক্ষা করছি কখন আলো ফুটবে, কখন ঘর থেকে বেরুবো। পুকুরঘাটে গিয়ে এই শীতে গোসল করবো। তারপর নতুন জামাকাপড় পরে ঈদ শুরু করে দেবো। ‘বম’ ফুটাবো।
‘বম’ মানে পটকা। লাল নীল নানা বর্ণের কাগজে জড়ানো গোল একটা জিনিস। কবুতরের ডিম সাইজের। মাওয়া কিংবা কাজির পাগলা বাজার থেকে কিনে আনা হয়েছে। আজাদ হচ্ছে এসবের ওস্তাদ। ছানা সেন্টুর সঙ্গে গিয়ে দুতিনদিন আগেই কিনে এনে রেখেছে। মাটিতে জোরে আছাড় মারলেই ফটাস করে শব্দ হয়।
মোমবাতি সাইজের একরকম ‘বম’ও আছে। মুখের কাছে একটা ‘সলতা’। ম্যাচের কাঠি জ্বেলে সলতায় আগুন ধরিয়ে ছুঁড়ে মারতে হয়। বোমার মতো শব্দ হবে। বিয়েবাড়ি ঈদ মুসলমানির উৎসবে খুব ‘বম ফুটানো’ হতো তখন।
আমি ছেলেবেলা থেকেই ভিতু টাইপের। মাটিতে আছড়ে মারা বম দুয়েকবার ফুটিয়েছি। কিন্তু ওই আগুন দিয়ে ধরানোটা কখনও ফুটাইনি। কেউ ফুটাচ্ছে দেখলেই ভয়ে মুখ শুকিয়ে যেত। দুকানে আঙুল দিতাম।
তখন হয়তো একটু একটু করে আলো ফুটছে। গাঢ় হয়ে জমে থাকা ‘খুয়া’ কাটতে শুরু করেছে। বাগানের দিকে ডাকাডাকি করছে কাউয়া শালিক, দইকুলি। হামিদমামা ননীমামারা বমটম ফুটাচ্ছে। হাজামবাড়ির ছেলেরা অনেকেই এসে পড়েছে। আইজ্জাদাও আছে তাদের সঙ্গে। ঈদ শুরু হয়ে গেছে।
আমরা লাফাতে লাফাতে ঘর থেকে বেরুলাম। হৈ চৈ বম ফুটাফুটি। কেউ কেউ গামছা বদনা হাতে চলে যাচ্ছে পুকুরঘাটে। পৌষ মাঘমাস। আর তখনকার দিনে শীতও পড়তো। দেশগ্রামের লোকে বলতো, ‘মাঘের শীত বাঘের গায়।’ তার মানে মাঘ মাসের শীতে বাঘও কাবু হয়ে যায়।
সেই শীত আমরা তোয়াক্কা করছি না। পুকুরঘাটে চলে যাচ্ছি।
বড় পুকুরটা ভরা থাকতো কচুরিতে। লম্বা লম্বা, ঠাসা কচুরি। বেগুনী ফুলে চমৎকার দেখাতো। প্রত্যেক শরিকের নিজের সীমানায় একটা করে ঘাট। অল্প একটু জায়গার কচুরি সরিয়ে পুকুরের ভিতর দিকে চার পাঁচহাত পর্যন্ত হাত দেড়েক চওড়া একটা তক্তা ফেলা। আসলে একটা অসমাপ্ত সাঁকো। ওই ঘাটে বসে পুকুর থেকে লোটা বদনা ভরে পানি তুলে তুলে গোসল করা।
আল্লাহ রে! পানি যা ঠাণ্ডা।
পানির রং কাউয়ার চোখের মতন। তার ওপর ধোঁয়ার মতো ভাসছে কুয়াশা। প্রথম বদনা ঢালবার আগেই হি হি করে কাঁপতো সবাই। কোনো রকমে এক বদনা ঢেলে ফেলার পর একটু সয়ে আসতো শীত। তারপর তিনচার বদনা ঢেলে গোসল শেষ। নতুন জামাকাপড় পরার উত্তেজনায় বাঘের শীতও তোয়াক্কা করছি না।
হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে কোনো রকমে শরীর মোছা। মুছিয়ে দিচ্ছেন পুনুআম্মা। আমার সমস্ত তদারকি তাঁর। মা আমাকে কখনো ধরেও দেখেন না। মায়ের আদর সব পাই আমি পুনুআম্মার কাছে।
তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ধপধপে সাদা ইংলিশ প্যান্ট, আকাশি রংয়ের কেরোলিনের শার্ট, পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। মুহূর্তে রাজপুত্র হয়ে গেলাম আমি।
কিন্তু আব্বাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।
গনিমামাও সেবার বাড়িতে। গনিমামা হামিদমামা ননীমামা, গেল কোথায় সবাই! নামাজের সময় হয়ে এলো। ক্ষির সেউই খেয়ে খাইগ বাড়ির মাঠে যাব ঈদের নামাজ পড়তে। তারপর বাড়ি ফিরে এবাড়ি ওবাড়ি যাব। দুপুরবেলা মুরগির গোস, পোলাও খাবো। ক্ষির সেউইয়ের ওপর দিয়ে রাখা কিসমিস বেছে বেছে খাব।
আগের রাতে মুঠো মুঠো কিসমিস চিনেমাটির গামলা আকৃতির পেয়ালায় ভিজিয়ে রেখেছেন বুজি। খুরমাগুলো চিউলি চিউলি করে কেটে ভিজিয়ে রেখেছেন। ক্ষির সেউইর ওপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেই মহার্ঘ্য বস্তু। খেতে যে কী মজা!
আব্বাকে খুঁজতে আমিনুল মামাদের বাড়ির ওদিকটায় গেছি। বাড়ির পুবদিককার নামায় মিয়াদের সেই দুটো হিজলগাছ শীতে জবুথবু হয়ে আছে। দূরে হালটের লাগোয়া জাহিদ খাঁর সীমানায় দাঁড়ানো হিজলগাছটার তলায় দেখি বেশ একটা জটলা। আব্বাও আছেন সেখানে। কী কী বিষয়ে খুব কথাবার্তা তর্ক বিতর্ক চলছে। জাহিদ খাঁর ছেলেরা, মতলেব মামা মাতাব আলী মোতাহারদা ওহাবদা, লতিফখাঁ আমিন মুন্সি সাহেব। গনিমামা হামিদমামারাও আছেন। হাজামবাড়ির আবদুলদাকেও দেখলাম।
একসময় আমাদের বাড়ির দলটা ফিরে এলো আব্বার সঙ্গে। আমাকে দেখে আব্বা বললেন, আইজ ঈদ হইব না বাজান। ঈদ হইব কাইল।
আমি বিষণœ মুখে বাড়ি ফিরে এলাম। মুহূর্তে সারাবাড়ি জেনে গেল আজ ঈদ হচ্ছে না। কারণ গতকাল চাঁদ দেখা যায়নি।
কেরোলিনের শার্ট, সাদা হাফপ্যান্ট আর স্পঞ্জের স্যান্ডেল মন খারাপ করে খুলে রাখি আমি। কাল আবার পরবো।
কিন্তু আজ পরে ফেলেছি, ঈদের জামা পুরনো হয়ে গেল। এই মনোকষ্টে সারাদিন বিষণœ হয়ে থাকি।
ঈদের দুতিনদিন পর স্ত্রী কন্যাদেরকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন আব্বা।
নাকি মণিকেও রেখে গেলেন সেবার! আর রেখে গেলেন বাদলকে। জন্ম থেকেই বাদল খুব রোগা। পেটের অসুখ লেগেই আছে। বুজি খুব আদর করেন বাদলকে। বাদলকে তিনি রেখে দিলেন। মা একলা এতগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কেমন করে সামলাবেন!
বিক্রমপুরের ভাষায় ছোট ছেলেমেয়েকে বলে ‘এন্দা গেন্দা’।
এন্দা গেন্দার দল নিয়ে মা আর আব্বা চলে যাচ্ছেন ঢাকায়। যাওয়ার পথটা ভিন্ন। মাওয়া হয়ে যাওয়ার ঝামেলা অনেক। গোয়ালন্দ থেকে ভাগ্যকূল হয়ে লঞ্চ আসে দুপুরের পর। সেই লঞ্চে চড়লে ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে গভীর রাত। অতরাত্রে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে জিন্দাবাহার যাওয়া মুশকিল। যদিও সদরঘাট থেকে খুবই কাছে জিন্দাবাহার। পাটুয়াটুলির দক্ষিণ মুখ দিয়ে ঢুকে হাতের বাঁদিকে নোয়াববাড়ি। নোয়াববাড়ির মাঠের ভিতর দিয়ে বেশ কাছে জিন্দাবাহার থার্ডলেন। আটানা দশআনায় ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায়।
অতরাত্রে ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া মুশকিল। এজন্য অন্যপথে রওনা দিতেন আব্বা।
তখনকার দিনে শীতকালেও তালুকদার বাড়ির খাল, মানে সীতারামপুরের খাল ভরা পানি। বেলদাররা কেরায়া নৌকা বাইতো। হাজামবাড়ির মজিদ গিয়ে আগের সন্ধ্যায় নৌকা ঠিক করে রেখেছে। কোনো কোনো বছর হযরতদের বাড়ির লাগোয়া খালের বাঁশ কাঠের নড়বড়ে পুলটার তলায় এসেও ভোরের আলো ফুটে উঠবার আগ থেকেই নৌকা নিয়ে বসে থাকতো বেলদার মাঝি। বাড়ি থেকে চট করেই সেখানে গিয়ে নৌকায় উঠতো সবাই। ওদিকটায় পানি কম থাকলে যেতে হতো তালুকদার বাড়ির ঘাটে। সীতারামপুরের খালে।
ওখান থেকে কাজির পাগলা বাজার ডানহাতে রেখে নৌকা চলে যেত গোয়ালিমান্দ্রা হলদিয়ার খালে। ডানহাতে বেশ কিছুটা দূরে গোয়ালিমান্দ্রার হাট রেখে উত্তর দিকে চলতে থাকতো। উত্তর দিকে শ্রীনগর। শ্রীনগরের ঘাটে ভিড়ে থাকতো ঢাকার লঞ্চ। সেই লঞ্চে সকাল দশটা এগারোটার দিকে চড়লে বিকাল তিনটা চারটায় সৈয়দপুর ফতুল্লা হয়ে ঢাকা।
কত সুন্দর সুন্দর নামের জায়গায় যে ভিড়তো লঞ্চ। যাত্রী তুলতো, যাত্রী নামাতো। ষোলঘর, আলমপুর, রাজানগর, শেখরনগর। কুচিয়ামোড়া নামে একটা ঘাট ছিল। লোকে বলতো ‘কুইচ্চামারা’।
‘কুইচ্চা’ জিনিসটা হচ্ছে বাইন মাছের মতো একটা জীব। গাঢ় খয়েরি রংয়ের। তেলতেলে। বহুদিন পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল জায়গাটার নাম ‘কুইচ্চামারা’ হয়েছে বোধহয় ওই জীবটির নাম থেকে। এই এলাকায় বোধহয় ‘কুইচ্চা’ জন্মায় অকাতরে। লোকে সেগুলো বেধড়ক মারে বলে নাম হয়েছে ‘কুইচ্চামারা’।
ওই ঘাট থেকে লঞ্চের ডেকে উঠতো শুধু দুধ।
এলাকাটা ঘোষদের। লোহার চকচকে বিশাল পাত্র ভরা দুধ লঞ্চে তুলতো দুজন করে লোক। লোহার পাত্রটার দুদিকে শক্ত হ্যান্ডেল। দুজন দুদিক থেকে ধরে সেই দুধভর্তি ওজনদার পাত্র তুলতো। দুধের মধ্যে ফেলে রাখা হতো ছোবড়া ছাড়া কচুরি।
কেন যে কচুরি ফেলে রাখা হতো কাঁচা দুধে, সেই রহস্য আমার কোনোদিন জানা হয়নি।
ওই ঘাট থেকে প্রচুর ছানাও তোলা হতো লঞ্চে।
ছানা গিঁট দিয়ে বাঁধা থাকত ধোয়া কিংবা নতুন গামছায়। চার পাঁচসের করে ছানা হবে একেকটা গামছায়। পার থেকে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে ছানার বোঝা নিয়ে লঞ্চে উঠতো, খালি গায়ের, লুঙ্গি কাছামারা কিছু লোক। থকথকে গামছা বাঁধা ছানা ধপ ধপ করে ফেলতো লঞ্চের ডেকে। ঢাকা পর্যন্ত দুধ ছানার কাঁচা গন্ধে ম ম করতো লঞ্চের ডেক।
ফতুল্লার আগে ছিল একটা ইটখোলা।
দূর থেকে ইটখোলার চিমনি দেখে বুঝে যেতাম, এই তো ঢাকায় এসে পড়েছি। ফতুল্লা মানেই তো ঢাকা।
ফতুল্লা থেকে ঢাকায় আসতে তখন ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। সেই একটা ঘণ্টা আর কাটতে চাইতো না।
চলে যাওয়ার দিন আব্বা আমাকে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে খুব আদর করতেন। গোপনে একআনা দুআনা পয়সা দিতেন। আব্বার সঙ্গে সীতারামপুর ঘাট পর্যন্ত যেতাম। নৌকা ছেড়ে দিতো। মা বোনদের জন্য না, আমার মন খারাপ হতো আব্বার জন্য। নৌকার পিছন দিককার গলুইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আব্বা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, খালপাড়ে দাঁড়ানো আমি তাকিয়ে আছি আব্বার দিকে। আব্বার চোখ ছলছল করছে, আর আমি নিঃশব্দে চোখ মুছছি। মা আছেন নৌকায়। তাঁর কোলে হয়তো তখন পর্যন্ত সবার ছোট সন্তানটি। তিনি কোলের সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। আমার দিকে তাকাবার সময়ই নেই। আমিও তাকাচ্ছি না মায়ের দিকে।
তারপর থেকে সবকিছু ফাঁকা। বুজি পুনুআম্মা আজাদ মণি বাদল এতগুলো মানুষ বাড়িতে। বাঁধা কামলা আছে আলফু, কাজের মেয়ে আছে পারু, ফতির মাও আছে। তারপও আমি যেন একা। সম্পূর্ণ একা।
হাজামবাড়ির পুকুরটায় তেমন মাছ ছিল না। তারপরও ফাল্গুন চৈত্রমাসে ঘটা করে একদিন ঝাঁকিজাল পলো নিয়ে নামা হতো পুকুর। বেজায় মাছ ধরার নেশা ছিল আজাদের। তখনও সে ছোট। পলো ‘চাবাতে’ পারে না। সংসারে উপযুক্ত বয়সের পুরুষমানুষ মানে আলফু। আলফু অতি সরল, নির্বোধ টাইপের। তার গলার আওয়াজ আমি কোনোদিন শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তবে তামাক খেত প্রচুর। লুঙ্গি সব সময় কাছা মারা। শার্ট গেঞ্জি কোনোদিন পরতে দেখিনি। ‘নিমা’ নামের ফতুয়ার মতো নীল রংয়ের একটা জিনিস ছিল তার। দেশে, অর্থাৎ চরে যাওয়ার দিন সেটা সে পরত। কাঁধে লুঙ্গি দিয়ে বাঁধা ‘গাট্টি’। মাছ টাছ তেমন ধরতে পারতো না। ক্ষেতখোলা আর বাড়ির কাজ করতো।
হাজামবাড়ির পুকুরে সেবার মাছ ধরা হচ্ছে। দুপুরের দিকে জাল পলো নিয়ে নেমেছে লোকে। বড় ক্ষেতের কাজ সেরে এসে রান্ধনঘরের ‘ছেমায়’ বসে তামাক খাচ্ছে আলফু। রান্ধনঘর থেকে বুজি ডাকল, ও আলফু।
তামাক খেতে খেতে সাড়া দিল আলফু। উঁ।
আজাম বাড়ির পুকঐরে যাও।
ক্যা?
বাইত্তে মাছ নাই। পলো লইয়া যাও। চাবাইয়া দেহ কিছু পাওনি।
আইচ্ছা।
গভীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুরনো পলোটা হাতে নিয়ে আমিনুল মামাদের বাড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা দিল আলফু। আমি গেলাম তার পিছু পিছু। অতিশয় বিরক্ত মুখে পুকুরে নামলো আলফু। পলো চাবাতে লাগল। ভঙ্গিটা এমন, যেন মালিক বলেছে বলে কাজটা করছে। মাছ পাওয়া না পাওয়ায় কিছু যায় আসে না।
মিয়াদের জোড়া হিজলতলায় দাঁড়িয়ে লোকজনের মাছ ধরা দেখছি আমি।
আশ্চর্য ব্যাপার, কেউ তেমন কিছু পেলো না, আলফু একটা মাঝারি সাইজের বোয়াল মাছ পেলো। দুই সোয়া দুইহাত লম্বা। বেশ মোটাতাজা বোয়াল। কিন্তু বিল পুকুরের বোয়ালের রং না মাছটার। বিল পুকুরের বোয়াল হয় হলুদ, এই মাছটা ধপধপে সাদা।
বাড়ি নিয়ে আসার পর মাছ নিয়ে নানা রকমের গুঞ্জন শুরু হলো। এটা কি আসল বোয়াল মাছ নাকি বোয়াল মাছের রূপে অন্যকিছু।
নানাবাড়ির বড় পুকুরটায় বিশাল বিশাল গজার মাছ ছিল। সেইসব গজার মাছ নিয়ে নানা ধরনের ভৌতিক গল্প ছিল। এক ধরনের গজার মাছ আছে যাদের কপালে নাকি সিঁদুরের ফোঁটা থাকে। সেগুলো নাকি মাছ না, মাছের রূপে ‘শকশো’। ওরকম গজার মাছ ভুলিয়ে ভালিয়ে মানুষকে পানিতে নামায়। মাছ ধরবার প্ররোচনা দেয়। তারপর পানিতে ডুবিয়ে মারে।
আলফুর ধরা বোয়াল মাছটাও তেমন কিছু কি না কে জানে।
বুজি বলল, আলফু, এই মাছ হালাইয়া দেও। এই মাছ আমরা খামু না।
আলফু বলল, আপনেরা কেউ না খাইলে আমি খামুনে।
না না তোমার খাওনও ঠিক হইব না।
ঠিক হইব আম্মা। কোনো অসুবিদা হইব না। আমরা গাঙপারের মানুষ। সাদা বোয়াল বহুত দেখছি, বহুত খাইছি। গাঙ্গের বোয়াল সাদা হয়। এইডা হইল গাঙ্গের বোয়াল। বাইষ্যাকালে গাঙ্গের পানির লগে গেরামে ঢুইক্কা গেছে। হাজামবাড়ির পুকুঐরে আটকা পড়ছিল।
আলফুর কথা পাত্তা দিলেন না বুজি। বললেন, না না এই মাছ খাওন ঠিক হইব না।
কইলাম তো আপনেরা খাইয়েন না। আমি খামুনে।
খাইলে খাও গিয়া। তয় মাছটা কোডবো কে? রানবো কে?
আমি নিজেই কুডুমনে, নিজেই রান্ধুমনে।
যা ইচ্ছা করো গা।
বাগানে বসে সেই মাছ নিজে কুটলো আলফু, নিজে রান্না করলো, আমরা অতি উৎসাহ নিয়ে দেখলাম। আট দশদিন ধরে সেই মাছ গরম করে আলফু আর খায়। মাছের স্বাদ নাকি অসাধারণ।
তারপর পাঁচ সাতদিনের জন্য দেশে গেল আলফু। আমাদের বড় ক্ষেতটা তখন চষা হচ্ছে। তারেক নামে একটা লোক আছে, হুমাদের বাড়ির পুবের ভিটায় ঘর। লোকে ডাকে তারিক্কা। একজোড়া হালের বলদ আছে তার, লাঙল আছে। রোজ দরে অন্যের জমি চষে দেয়। আমাদের ক্ষেত চাষ দিতে নেমে গেছে। চাষ দেয়া হলে মাটির বড় বড় চাকাগুলো শুকিয়ে পাথরের মতো হবে। ইটামুগুর দিয়ে সেই চাকা ভেঙে গুঁড়িয়ে তারপর ছড়াতে হবে ধান। ততোদিনে বৃৃষ্টি বাদলা শুরু হবে। বৃষ্টির পানি পেয়ে ধানচারা বেরুতে থাকবে মাটি ফুঁড়ে।
বুজিকে আলফু বলে গেল, পাঁচ সাতদিন পর ফিরে এসে ইটামুগুর নিয়ে ক্ষেতে নামবে। যথাসময়ে সব কাজ শেষ করবে।
পাঁচদিন গেল, দশদিন গেল। পনেরো দিন গেল, আলফু আর আসে না। আমাদের চষা ক্ষেত বড় বড় মাটির চাকা বুকে নিয়ে ফাল্গুন চৈত্রমাসের তীব্র রোদে উজবুকের মতো পড়ে আছে। আলফুর অপেক্ষায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। বুজি আর পুনুআম্মা সারাক্ষণ আলফুর চিন্তায় অস্থির। এবার কি ধানটা তাহলে বোনাই হবে না? নাকি অন্যলোক জোগাড় করে কাজ শুরু করে দেবে?
আলফু ফিরে এলো একুশ দিন পর। চেহারা সুরত একদম অন্যরকম। মুখটা শুকিয়ে এই এতটুক হয়ে গেছে। চোখ দুটো ইঞ্চিখানেক গর্তে। দৃষ্টি একেবারেই নির্বিকার। পাঁচটা কথা জিজ্ঞেস করলে হুঁ হাঁ করে একটার জবাব দেয়।
বহু চেষ্টায় জানা গেল বাড়ি যাওয়ার পর তার খুব জ্বর হয়েছিল। জ্বরে ভুগে এই দশা। এজন্য এতদিন আসতে পারেনি।
কথাবার্তা যেটুকু বলে তাতে কেমন একটা উ™£ান্ত ভাব। নাওয়া খাওয়ায় মন নেই। বারান্দায় শুয়ে সারারাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাতে বোধহয় ঘুমায় না।
বুজি আর পুনুআম্মা আলফুকে নিয়ে খুবই চিন্তিত হয়ে গেলেন।
পরদিন থেকে ইটামুগুর নিয়ে ক্ষেতে নামলো আলফু। বুজি আর পুনুআম্মাকে দেখি বড়ঘরের পশ্চিম কোনার ফজলি আমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে বড়ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে আলফুকে দেখেন। পাঁচ সাত মিনিট কাজ করেই ক্ষেতের মাটিতে লেছড়ে পেছড়ে বসে পড়ে আলফু। ইটামুগুর ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের দিকে হাত তুলে কী কী যেন বলে।
দিনে দিনে অস্বাভাবিক হতে লাগল লোকটা। খায় না, গোসল করে না। থম ধরে বসে থাকে। তার অতিপ্রিয় তামাকে আগের মতো মন নেই। আগে সারারাত ফোস ফোস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলতো, এখন কদিন ধরে রাতভর করুণ মিহি সুরে গুণ গুণ করে কাঁদে। বুজি আর পুনুআম্মা কোনো কোনো রাতে উঠে জিজ্ঞেস করে, ও আলফু, কী হইছে? কান্দো ক্যান?
আলফু কথা বলে না।
তারপর আলফু একদিন উধাও হয়ে গেল। তার লুঙ্গি নিমা সব পড়ে আছে বারান্দায়, আলফু নেই। নেই তো নেইই। কোথায় উধাও হয়ে গেছে কে জানে।
সারাগ্রাম তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো আলফুকে। মইজ্জাদা আইজ্জাদা, রব হাইপ্পা এমনকি পারু আর ফতির মা পর্যন্ত এবাড়ি ওবাড়ি খুঁজল।
না আলফু কোথাও নেই।
একদিন গেল।
দুদিন গেল।
দিন যেতে লাগল, আলফু আর ফিরল না।
তার চরের বাড়িতে খবর পাঠানো হলো। না, আলফু সেখানেও যায়নি।
বুজি বলাবলি শুরু করলো, এইডা ওই সাদা বোয়াল মাছ খাওনের ফল। ওইডা তো মাছ আছিলো না। ওইডা আছিলো ‘শকশো’। আমি না করছি, তাও আলফু শকশো খাইছে। শকশো তো খাওন যায় না, তারা হইতাছে নিরাকার। বোয়াল মাছের রূপ ধইরা আলফুরে ভুলাইছে। আমরা দেখছি আলফু ওই মাছ খাইতাছে। আলফুও খাওনের সময় মাছের স্বাদ পাইছে। আসলে ভুল, সবই ভুল। ও শকশো খাইবো কী, শকশোতেই অরে খাইছে। কোন বিল বাউরে নিয়া মাইরা কেদা পানির ভিতরে গুইজ্জা রাখছে কে জানে!
সত্যি সত্যি এই জীবনে আলফুর আর কোনো হদিশ আমরা পাইনি। কোন রহস্যে উধাও হয়ে গিয়েছিল, কে জানে।
জীবনের প্রতিটা বাঁকে মানুষ প্রেমে পড়তে পারে
ইমদাদুল হক মিলন। জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক। প্রেমই তার উপন্যাসের মূল উপজীব্য। লিখেছেন ভিন্নধারার রচনাও। দীর্ঘদিন প্রেমের উপন্যাস লেখা এই লেখক এবার বিশ্লেষণ করেছেন প্রেম ভালোবাসার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জব্বার হোসেন ও রোকন উদ্দিন
সাপ্তাহিক : আপনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয়তম লেখকদের একজন। যাবজ্জীবন, পরাধীনতা, মহাযুদ্ধের মতো সিরিয়াস উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু প্রেমের উপন্যাসের লেখক হিসেবেই পাঠকের কাছে আপনার পরিচিতি বেশি কেন?
ইমদাদুল হক মিলন : যখন লিখতে শুরু করলাম, তখন আসলে কোনো পরিকল্পনা নিয়ে লেখা শুরু করিনি। ১৯৭৩ সালে হঠাৎ একটা কাগজে লেখা পাঠালাম, বাচ্চাদের গল্প। সেটা ছাপা হলো। ছাপা হওয়ার পর আমার মনে হলো, এটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে গেছে। আমার মতো উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রের লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে! তারপর থেকে দীর্ঘদিন আমার নাম ছাপার অক্ষরে দেখার লোভে লিখেছি। সাহিত্য কী, সাহিত্য কেন করতে হয় এই ব্যাপারগুলো আমার মাথায় ছিল না। তখন আমি ভাবলাম, কী ধরনের লেখা লিখলে মানুষের কাছে খুব দ্রুত পৌঁছানো সম্ভব? আমি চিন্তা করলাম, কোন শ্রেণীর কাছে আমি গ্রহণযোগ্য হতে চাই এবং কোন শ্রেণীটা বেশি বই পড়ে? আমার নিজস্ব হিসাব আমাকে বলল যে, ছাত্র শ্রেণী বা তরুণ সম্প্রদায় বই বেশি পড়ে, যারা একটু প্রেম ভালোবাসা বা আবেগের মধ্যে বেশি থাকে, যারা জীবন, জগৎকে একটু রোমান্টিক দৃষ্টিতে দেখে, তারা ভালোবাসার আবেশের মধ্যে থাকতে খুব ভালোবাসে। এই বয়সী ছেলেমেয়ের কাছে আমাকে পৌঁছতে হবে।
এই ভাবনাটা যখন এলো তখন মনে হলো, এদের মনোযোগ যদি আকর্ষণ করতে হয় তবে আমাকে ভালোবাসা, প্রেম, একটুখানি চুমু, একটু জড়িয়ে ধরা, হালকা একটু যৌনতার ছোঁয়া… ইত্যাদি বিষয় আমার লেখায় নিয়ে আসতে হবে। এই চিন্তা-চেতনা থেকে আমি প্রেমের গল্প, ওই বয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে গল্প লেখা শুরু করলাম।
সাপ্তাহিক : প্রেম ভালোবাসা, এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক আবেগের বিষয় নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখেছেন। প্রেমটা আসলে কী আপনার কাছ থেকে জানতে চাই।
মিলন : প্রেমের ব্যাখ্যাটা তো আসলে খুব বিস্তৃত। অনেকদিন আগে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর একটা কবিতা পড়েছিলাম। একটা লাইন আমাকে খুব আলোড়িত করেছিলÑ ভালোবাসা থাকলে সব হয়। কবিতাটার থিমটা এ রকমÑ একজন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে বলছে, তুমি যদি আমার হাতটা ধরো তবে তুমি দেখবে যে, আমাদের একটা ছোট ঘর হয়েছে, একটা নিকানো উঠোন হয়েছে, বাড়ির সামনে একটা পুকুর হয়েছে। আমাদের সব হবে। ভালোবাসা থাকলে সব হয়। এটা পড়ে আমার মনে হলো যে, আমি যে কাজটাই করি, আমি যদি ভালোবাসা নিয়ে করি, আমার যদি কাজের মধ্যে প্রেম থাকে, তাহলে আমি হয়ত দাঁড়াতে পারব। ধরুন একটি শিশু জন্মের পর প্রথম প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির প্রেমে পড়ে। পৃথিবীটাকে সে দেখতে শুরু করে। তার পর সে তার মায়ের মুখটা দেখে। দেখবেন বাচ্চারা সব সময় তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন থাকে? সে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে দেখে এবং তার প্রতি প্রেমটা জন্মাতে থাকে।
এটি হলো একটি দিক। প্রেম বলতে মূলত যে বিষয়গুলো ধরতে যাই তা হলো, আমরা প্রেম ও ভালোবাসাকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে এসেছি। তা হলো নারী-পুরুষের সম্পর্ক। নারী-পুরুষের মনোদৈহিক সম্পর্ক। যেখানে মনও আছে, শরীরও আছে। এই ব্যাপারটাকে আমরা আসলে সাহিত্যে স্পর্শ করার চেষ্টা করি। কিন্তু প্রেম ভালোবাসাকে বহুভাবে ভাগ করা যায়।
সাপ্তাহিক : প্রেমের ক্ষেত্রে শরীর কতটা অনিবার্য?
মিলন : একটা পর্যায়ে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে শব্দটি আমি আগে বলেছিলাম ‘মনোদৈহিক সম্পর্ক’। একটি বিশেষ বয়সের নারী-পুরুষের প্রেমের ক্ষেত্রে এটি অনেক বড় একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ধরুন রাধা-কৃষ্ণের সম্পর্কের কথা বললাম। সেখানে কিন্তু সম্পর্কটা এ রকমই ছিল। আমার বিশ্বাস যদি প্রাপ্তবয়স্ক দুজন নারী-পুরুষ প্রেম করে তাহলে সেখানে কখনো না কখনো শরীরী ব্যাপারটা একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। শারীরিক প্রেমও প্রেম। মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরও প্রভাবিত হবে। মন শরীরকে প্রভাবিত করবে। মনের আকর্ষণের মাধ্যমে শরীরও আকর্ষিত হবে, এটাই প্রকৃতি।
সাপ্তাহিক : আমরা একটু সামাজিক পরিবর্তনের দিকে যাই। আপনি যখন শুরু করেছিলেন তখনকার প্রেমটা কেমন ছিল এবং আজকে কী রকম দেখছেন?
মিলন : বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের বুদ্ধিমত্তা বাড়ে। মানুষ সমাজ, দর্শন ধীরে ধীরে অর্জন করে। যখন শুরু করেছিলাম তখন আমার কাছে এই জীবন, এর প্রেমের ব্যাখ্যা এতটা গভীর ছিল না। সে সময় আমার মনে হয়েছে যে, আমি একজন মানুষকে দেখছি, তার মুখটা দেখে আমার ভালো লাগছে, তার সঙ্গে কথা বলে আমার ভালো লাগছে। আমি তার জন্য রাতে ঘুমাতে পারছি না, তাকে নিয়ে আমি রাতে স্বপ্ন দেখছি। কোথাও বেড়াতে গিয়ে গোপনে হলেও আমি তার হাতটা একটু ছুঁয়ে দিতে চাই। তার হাতটা ধরে আমি একটু নির্জন জায়গায় দাঁড়াতে চাই। এই যে অনুভবটা, এই অনুভবটা পর্যন্ত আমি থাকতে চেয়েছি।
পরবর্তী সময়ে এসে আমার মধ্যে ভাবনাটা এ রকম জাগল যে, আমি যাকে স্পর্শ করতে পারব তাকে আমি সম্পূর্ণভাবে চাই। তাকে আমি আমার স্বপ্নে চাই, তাকে আমি আমার বাস্তবে চাই। তার সঙ্গে আমি একটি নিভৃত নির্জন ঘরে সময় কাটাতে চাই। তাকে আমি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ করে পেতে চাই। আমার কাছে পরবর্তী সময়ে এ রকম একটি ব্যাখ্যা এসে দাঁড়াল।
সাপ্তাহিক : এখনকার প্রেম, সম্পর্ক অনেক বেশি অস্থির। ভাঙন বেশি। ব্যাখ্যা করবেন কেন?
মিলন : এখন যে জিনিসগুলো আমরা দেখি, সমাজ আধুনিক হওয়ার ফলে সম্পর্ক দ্রুত হচ্ছে, মানুষ দ্রুত প্রেমে পড়ছে, দ্রুত প্রেম ভেঙেও যাচ্ছে, দ্রুত বিয়ে হচ্ছে, বিয়েও ভেঙে যাচ্ছে। নির্দ্বিধায় একজন একজনের সঙ্গে ছয় মাস বা এক বছর প্রেম করার পরে দেখল যে, তার সঙ্গে অনেক কিছুই মিলছে না, তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকজনের সঙ্গে প্রেম হয়ে গেল। এই যে তাৎক্ষণিক পর্যায়ে চলে আসছে প্রেমের ব্যাপারটি, এই অবস্থাটা কিন্তু বাঙালি জাতির কখনো ছিল না। পশ্চিমা সংস্কৃতি যত আমাদের মধ্যে এসে ঢুকেছে, মানুষ যত বেশি আধুনিকতার দিকে গেছে, যত বেশি ইউরোপ আমেরিকার প্রভাব পড়েছে, প্রেমের ক্ষেত্রেও এই প্রজন্মকে সেই প্রভাবটি তত বেশি সেদিকে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এখনকার প্রেমের স্থায়িত্ব নিয়ে আমার অনেক বেশি সন্দেহ আছে। যখন-তখন এই প্রেমটি ভাঙতে পারে। আবার এটাও আমি পাশাপাশি বলব, এর মধ্যে একশ জন প্রেমিকের মধ্যে হয়ত দশ জন টিকেও গেছে। সেটাই বা কম কী?
সাপ্তাহিক : এই যে অস্থিরতা এতে কী পুঁজি এবং পাশ্চাত্য বড় একটা ফ্যাক্টর?
মিলন : আবেগ যে কমে গেছে সেটা আমি একশবার স্বীকার করি। আবেগ স্থায়ী হচ্ছে না। কিন্তু যেই মুহূর্তে এক জোড়া ছেলেমেয়ে প্রেমে পড়ছে সেই মুহূর্তের আবেগটা ঠিক আছে। তার পরেই যখন মেয়েটি তার নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছে। এখন সে তুলনা করছে যে, সে যে ছেলেটিকে পছন্দ করেছে সে কতটা তার উপযুক্ত? বাস্তব চিন্তা প্রেমের আবেগটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। এখনকার সময়টা হয়ে গেছে এ রকম। আমি বারবারই বলছি যে, এই জিনিসগুলো বাঙালি প্রেমের মধ্যে কখনই ছিল না। বাঙালির প্রেম হয় এ রকম যে, মেয়েটি নির্দ্বিধায় ছেলেটির হাত ধরে বলছে, আমি আমার সবকিছু ছেড়ে তোমার সঙ্গে গাছতলায়ও থাকতে রাজি আছি। এই ছিল বাঙালির প্রেম। এটি এখন আর নেই।
সাপ্তাহিক : এখন আবার দেখা যাচ্ছে যে, নেটওয়ার্কিং লাভ। যেটাকে বলে পলিয়ামুরিয়া। দেখা যাচ্ছে একজন ছেলে তার পাঁচজন গার্ল ফ্রেন্ড। আবার সেই পাঁচজনের প্রত্যেকের ওরকম পাঁচজন করে সম্পর্ক রয়েছে। এ রকম নেটওয়ার্কিং লাভ তৈরি হচ্ছে। এগুলো কি অস্থিরতা তৈরি করবে না?
মিলন : এটা এক ধরনের অসুস্থতা। এটা তো ভয়ঙ্কর একটা জায়গায় নিয়ে যাবে মানবজাতিকে। এই প্রবণতাগুলোকে আমি প্রেম বলি না। আমি মনে করি অনাদিকাল থেকে মানুষ যখন মানুষের শরীরকে বুঝতে শিখেছে, মনকে বুঝতে শিখেছে এবং যতদিন পর্যন্ত নারী-পুরুষ থাকবে ততদিন পর্যন্ত শরীর এবং মনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কোনো না কোনোভাবে থাকবে। হয়ত পদ্ধতিটা বদলাবে। কিন্তু যে প্রেমের কথা আপনি বললেন, তা ভয়ঙ্কর ও বিকৃত।
সাপ্তাহিক : আসলে বিয়েটা কী? প্রেমের পরিণতিই কি বিয়ে?
মিলন : এটা কেবল আমাদের দেশেই। আমাদের দেশেই মেয়েরা বা ছেলেরা একটা বিশ্বাস নিয়ে থাকে যে, ভালোবাসলে বিয়ে করব। ছেলেটা না চাইলেও মেয়েটা টার্গেট করে যে আমি যেহেতু তাকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করব। আমাদের এই উপমহাদেশের মেয়েরা প্রেম করলে তারা মনে করে আমি তাকে বিয়ে করব, সে আমার স্বামী হবে। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কটা বাঙালি বা এই উপমহাদেশের মানুষ পছন্দ করে না। এই প্রজন্ম হয়ত পছন্দ করছে। কেন করছে তা আমি আগেই বলেছি। কিন্তু আপনি যদি সামগ্রিক জনসমষ্টির দিকে তাকান তাহলে দেখবেন আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এখনো প্রেম করে বিয়ের কথাটা ভাবে। এটা আমি মনে করি।
সাপ্তাহিক : অনেকেই বলেন প্রেম জীবনে একবারই আসে। আসলেই কি তাই?
মিলন : না, জীবনের প্রতিটা বাঁকে এসে মানুষ প্রেমে পড়তে পারে। এটাই মানুষের নিয়তি। এক প্রেমিকা বা এক স্থির প্রেমেও মানুষ হাজার বার পড়তে পারে। আবার দশজন ভিন্ন মানুষের প্রেমেও মানুষ পড়তে পারেন এটাই মানুষের নিয়তি। এখানে কিছু করার নেই।
জেলাটির নাম করন করা হউক মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর জেলা
ইমদাদুল হক মিলন৷ বাংলা সাহিত্যে জীবন কিংবদনী একটি নাম৷ বাংলার আকাশে উজ্জল নক্ষত্র৷ জন্ম ৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ সালে বিক্রমপুরের মেদিনীমন্ডল নামক গ্রামে৷ প্রথম রচনা গল্প (ছোটদের) ”বন্ধু” ১৯৭৩ সালে৷ তারপরে একে একে অসংখ্য৷ তার উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির মধ্যে যাবজ্জীবন, পরাধীনতা, ভূমিপুত্র, নদী উপাখ্যান, র্রপনগর, কালো ঘোড়া, রাজাকারতন্ত্র, কালাকাল, ও রাধা ও কৃষ্ণ, দুঃখ কষ্ট, উপনায়ক, নুরজাহান প্রধান৷
১৯৮৭ সালে ইকো সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯২ সালে হুমায়ুন কাদির সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে বিশ্ব জ্যোতিষ পুরস্কার, ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে নাট্যসভা পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে প রবী পদক, ১৯৯৪ সালে বিজয় পদক, ১৯৯৫ সালে মনু থিয়েটার পদক, ১৯৯৫ সালে যায় যায় দিন পত্রিকা পুরস্কার, ১৯৯৫ সালে টেনাশিনাস পদক, ১৯৯৮ সালে মাদার তেরেসা পদক, ১৯৯৯ সালে এস এম সুুলতান পদক, ২০০০ সালে অতীশ দিপংকর হৃণ_পদক, ২০০১ সালে চোখ সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা), ২০০২ সালে ট্রাব অ্যাওয়াররড, ২০০২ সালে টেলিভিশন দর্শক ফোরাম পুরস্কার, ২০০২ বাচসাস পুরস্কার, ২০০৪ সালে ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার সহ অসংখ্য পদক লাভকারী বিক্রমপুরের এই কৃতি সন্তান বহু দেশ ভ্রমন করেছেন৷ এক সময় নিজেও (১৯৭৯-১৯৮১) প্রবাস জীবন যাপন করেছেন৷ বর্তমানে তিনি জাপান কালচারাল ( JBCF) এবং মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সোসাইটি, জাপান এর আমন্ত্রনে জাপান ভ্রমন করছেন৷ জাপান প্রবাসী ও মুন্সীগঞ্জ.কমের কনট্রিভিউটর রাহমান মনি এ সময় তার সাক্ষাত্কারটি গ্রহণ করেন Munshigonj.com এর জন্য৷ নিচে সাক্ষাত্কারটি তুলে ধরা হল৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : জাপানে আপনার তৃতীয় সফর৷ তিনবার সফরকালীন সময়ে বিভিন্ন পরিবেশে একাধিক প্রবাসীদের সাথে মিলিত হবার সুযোগ হয়েছে, তাদের কায_ক্রম পয_বেক্ষন করেছেন৷ এর মধ্যে কি কোন ভিন্নতা লক্ষ্য করেছেন? করে থাকলে সেটা কি রকম?
মিলন : আমি দেখছি যতোই দিন যাচ্ছে প্রবাসীরা ততোই দেশের কথা বেশী বেশী ভাবছে৷ দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করছে আপ্রান চেষ্টায় দেশকে পরিচিত করে তুলছে৷ জাপানের কথাই ধরা যাক, প্রবাসীরা সমবেত হয়ে টোকিও বৈশাখী মেলা নামে বাংলা নববর্ষ উত্সবকে জাপানে ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তুলছে৷ জাপান প্রবাসীরা শহীদ মিনার স্থাপিত করেছে৷ বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠনের নামে সমবেত হেছ৷ এতে করে নিজ এলাকায় উন্নয়নে কাজ করার পরিকল্পনা করছে৷ বিনিয়োগ বাড়ােছ৷ নিজ এলাকায় উন্নয়ন মানেই তো দেশের উন্নয়ন৷
আমি এর আগে ২০০৫ সালে বিবেক বার্তার আমন্ত্রনে বৈশাখী মেলায় এসেছিলাম৷ ২০০৬ সালে জাপান ফাউন্ডেশন এর আমন্ত্রনে এসেছিলাম তবে ঐ সফরটি ছিল জাপানীদের সাথে সংশ্লিষ্ট৷ চারটি আনজ_াতিক সেন্টারে লেকচার দিয়েছি৷ টোকিওতে মান্যবর রাষ্ট্রদুতও উপস্থিত ছিলেন৷
এবারের আমন্ত্রন অবশ্য প্রবাসীদের কাছ থেকেই আসে৷ ওআইঊ এখানে “বাংলামেলা” নামে একটি মেলার আয়োজন করে৷ গত ২ এবং ৩ আগষ্ট টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়৷ তারপর মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সোসাইটি, জাপান এর অভিষেক অনুষ্ঠানেও আমন্ত্রিত হই৷ সব মিলিয়ে প্রবাসীদের দেশ প্রেম আমাকে খুবই মুগ্ধ করেছে৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : প্রবাসে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে৷ আছে তার বিভিন্ন কার্যক্রম, এর প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
মিলন : অবশ্যই এর প্রয়োজনীয়তা আছে৷ আমিতো মনে করি এটি খুবই গুর্বত্বপূর্ণ৷ একত্রিত হয়ে নিজ অঞ্চলের জন্য কাজ করবে৷ আর নিজ অঞ্চল তো বাংলাদেশেরই একটি অংশ৷ দেশেরই উন্নয়ন৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : আঞ্চলিক সংগঠনগুলির কি জাতীয় কর্মসূচী গ্রহণ করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
মিলন : এলাকার শিক্ষা এবং হৃাস্থখাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহযোগিতার হাত বাড়ানো উচিত বলে মনে করি৷ শিক্ষার আলো না থাকিলে একটি জাতি উন্নতির চরম শিখরে পেুৗছতে পারে না৷ ছোট ছোট কলকারখানা গড়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উত্সাহিত করলে ভালো হয়৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরবাসী আপনাকে নিয়ে গর্ব করে৷ বিক্রমপুরের সনান হিসেবে আপনার অনুভূতি কি?
মিলন : দেশের বাইরে আমাকে যদি কেহ প্রশ্ন করে তুমি কোন দেশী? আমি খবু গৌরব সহকারে প্রথমেই বলি আমি বাংলাদেশী৷ এই গৌরব করার মতো অনেক ইতিহাস আছে৷ তারপরই বিক্রমপুরের সন্মান হিসেবে পরিচয় দিতে সম্মান বোধ করি৷ এরও অনেক কারণ আছে৷ বিক্রমপুর ছিল ভারত উপমহাদেশের একটি অতীব গুর্বত্বপূর্ণ ও প্রসিদ্ধ স্থান৷ তার কারণ হচ্ বিক্রমপুরে বহু গুণী মনীষি জন্ম নিয়েছেন৷ শ্রীজ্ঞান অতীশ দিপংকর জন্মেছেন আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে এই বিক্রমপুরের ব্রজযোগীনি গ্রামে৷ স্যার জগদীশ চন্দ্র যিনি বিজ্ঞানে সারা পৃথিবী কাপিয়ে দিয়েছেলেন তিনিও জন্মেছিলেন এই বিক্রমপুরে৷ চিত্তরঞ্জন দাশ, সরোজিনি নাইডু কিংবা ব্রজেন দাস জন্মেছেন এই প্রসিদ্ধ স্থানে৷ এই রকম আরো অনেক কৃতি সনান জন্মেছিলেন এই বিক্রমপুরে৷ যেহেতু আমি সাহিত্যের মানুষ তাই সাহিত্যের কথাই বলব৷ বাংলা সাহিত্যকে যারা সম্মৃদ্ধ করেছেন তাদের অনেকেরই জন্ম বিক্রমপুরে৷ যেমন: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মানব দিয়া গ্রামে তার জন্ম৷ গাওদিয়ায় পুতুল নাচের উপর তিনি একটি কালজয়ী উপন্যাস লিখে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন৷ সমরেশ বসু, বুদ্ধদেব বসু, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এই রকম অনেক কৃতিমান সাহিত্যিক জন্মেছেন এই বিক্রমপুরে৷ তাছাড়া জীবনানন্দ দাস এবং অমর্ত্য সেনের মায়ের বাড়ী ও এই বিক্রমপুরে৷ এই যে এত বড় বড় মানুষগুলি জন্মেছেন এই বিক্রমপুরে আমিও জন্মেছি এই বিক্রমপুরে এইটা আমার কাছে খুব গর্বের এবং গুর্বত্বপূর্ণ বলে মনে করি৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : সাহিত্যাঙ্গনের প্রায় সব কয়টি পুরস্কারই আপনি অর্জন করেছেন দেশ বিদেশে আপনি বিভিন্ন সম্মামনা পুরস্কার সহ অনেক সম্মান পেয়েছেন৷ এবার জাপানে আপনাকে নিজ জেলার সংগঠন থেকে ক্রেষ্ট সহ সম্মামনা সনদ দেওয়া হয়৷ আপনার অনুভূতি কি?
মিলন : আমাকে জাপানে মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সোসাইটি রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড নামে একটি পুরস্কার দিয়েছে৷ মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সোসাইটি আমাকে এই যে পুরস্কারটি দিল তা আমার কাছে একটু বিশেষ গুর্বত্বপূর্ণ এই কারণে যে, আমরা একজন মানুষ সারা পৃথিবী জয় করে এসে ঘরে ঢুকে এবং ঘরে তার মা, বাবা, ভাই বোন, কিংবা প্রিয়তমা সী অথবা তার সনান, এমন কি পাড়া পড়শী তাকে বরন করে বলে যে, তুমি আমাদের সনান, তুমি একটি ভালো কাজ করেছ এই জন্য তোমাকে আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি৷ এই পুরস্কারটি আমার কাছে ওই রকমই লেগেছে৷ দেশের বাইরে এই প্রথম আমার নিজ এলাকার লোকজন বা সংগঠন আমাকে এইভাবে সম্মানিত করলো এইটা আমার কাছে অন্যরকম একটা অনুভূতি৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : প্রবাসীদের কল্যানে প্রবাসীকল্যান মন্ত্রনালয় করা হয়েছে৷ তারপরও প্রবাসীরা বিমান বন্দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হেছ৷ প্রবাসী মন্ত্রনালয় সঠিক কাজ করছে বলে মনে করেন কি?
মিলন : সঠিক কি বেঠিক জানি না৷ বাংলাদেশেটা এখন কিন্তু দাড়িয়ে আছে প্রবাসে আমাদের প্রায় ৮০ লাখ প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্সের উপর৷ সুতরাং তাদের কল্যানেই তো বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগনের একযোগে কাজ করা উচিত৷ কিনু আমাদের নীতিনির্ধারক হয়ে যারা মাথার উপর বসে আছেন৷ তারা প্রবাসীদের কথা চিন্তা করেন বলে মনে হয় না৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসীদের শারীরিক নির্যাতন সহ যেভাবে দেশে ফেরত্ পাঠাচ্ছে তাতে দেশের এর বিরূপ প্রভাব ফেলবে কি?
মিলন : অবশ্যই বিরূপ প্রভাব ফেলবে৷ অর্থনৈতিক, পারিবারিক এবং সামাজিক সব ক্ষেত্রেই এর বির্বপ প্রভাব প্রতিফলিত হবে৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : সরকারের ব্যর্থতা কি এক্ষেত্রে কাজ করেছে?
মিলন : আমি মনে করি এই ব্যাপারটি যদি কুটনৈতিকভাবে হ্যান্ডেল করা বা এর সাথে জড়িত বিভাগ যদি সঠিক সময়ে দ্রুত এবং সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিত তা হলে আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না৷ রাষ্ট্র যদি উদ্যোগ নিত তাহলে কোন বা কোন ভাবে এর সুরাহা হত৷ তারা সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ নেয়নি৷ যার জন্য আমাদের লোকগুলিকে অমানবিকভাবে ফেরত্ আসতে হচ্ছে৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : এই ক্ষেত্রে প্রবাসীদের কি করনীয় আছে বলে মনে করেন?
মিলন : আমাদের যে সব ভাইয়েরা প্রবাসে রহিয়াছেন তাদের সকলের উচিত সেই সেই দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রচলিত আইন মেনে চলা৷ এখন তুমি জাপান থাকো, তোমার উচিত হবে জাপানের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : প্রবাসীদের ভোটাধিকার আজও দেওয়া হেছ না৷ কি কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন?
মিলন : কোন কারণই থাকা উচিত নয়৷ ভোটাধিকার অবশ্যই থাকতে হবে৷ প্রবাসীরা ও বাংলাদেশী৷ এমন কি যৌথ নাগরিক প্রাপ্তদের বেলায়ও৷ প্রবাসীদের কে অবশ্যই অবশ্যই ভোটাধিকার দিতে হবে৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : রেমিট্যান্সের টাকা বাংলাদেশে পৌছুতে সময় লাগে প্রচুর অথচ অন্যান্য দেশে খুব দ্রুত সময়ে পেুৗছে যায়৷ কি পদক্ষেপ নিলে সহজতর হবে মনে করেন?
মিলন : আমি বা আমরা তো আমাদের ভাবনার কথাগুলি বলতে পারব৷ কিনু কাজ কতটুকু হবে? পৃথিবীর এমন কোন দেশ আছে বলে আমার জানা নেই যেখানে জাপান, আমেরিকা কিংবা অন্যান্য উন্নত দেশগুলি থেকে রেমিট্যান্স পাঠালে এতো সময় লাগে পেুৗছতে৷ বর্তমান অত্যাধুনিক উন্নত প্রযুক্তির যুগে এতোটা সময় লাগাটা তো একেবারেই অযৌক্তিক৷ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই হওয়া বাঞ্চনীয়৷ অনলাইন ব্যাংকিং এর যুগে টাকা জমা দেওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যে কর্তৃপক্ষ জানতে পারে পেুৗছেছে কিনা৷ এখনকার পৃথিবী হচ্ছে কমপিউটারাইজড৷ সব কিছু হাতের মুঠোয়৷ কাজেই কোন মতেই এতোটা সময় লাগা উচিত্ নয়৷ এই সেক্টরে যারা কাজ করছেন তারা আসলে এই সব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না৷ আমাদের নীতি নির্ধারকদের অযোগ্যতার জন্য সারা পৃথিবীর সাথে তাল মিলাতে পারছে না৷ আমরা সেই আগের স্থানেই রয়ে গেছি৷ এটা আমাদের দুর্ভাগ্য৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : Munshigonj.com নামে অত্যন জনপ্রিয় একটি ওয়েব সাইট আছে, যেখানে সমস মুন্সীগঞ্জকে জানা যাবে মাত্র একটি ক্লিকের মাধ্যমে৷ এমনকি আপনাকেও৷ আপনি সাইটির কথা জানেন?
মিলন : আমি আসলে যন্ত্র (আধুনিক প্রযুক্তি) থেকে একটু দুরে থাকা মানুষ৷ এখনো সেই আগের আমলের হাতে লিখালিখি করি৷ এই যে আমার মোবাইল সেট দেখছো, আমি কেবল ফোন রিসিভ এবং ফোন করা ছাড়া আর কোন ব্যবহারই জানি না৷ অথচ আমি জানি আধুনিক প্রযুক্তির সব সুবিধাই এখানে দেওয়া আছে৷ আমার মাথায় ঢুকাতে পারি না৷ তবে আমি জানি যে, কাজগুলি হচ্ছে৷ কেউ না কেউ করছে৷ শুনতেও পাই৷ আজ তোমার এখানে এসে দেখলাম৷ এরপর থেকে নিয়মিত দেখার চেষ্টা করবো৷
আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজ এলাকাকে পরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যারা কাজ করে তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইল৷ এই কাজটি করার জন্য কমপিউটার এবং ওয়েব সাইটের কোন তুলনা নেই৷ আমি উদ্যোক্তাদের বিশেষ করে শেখ তৈয়বকে তোমার মাধ্যমে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর বাসীর প্রতি আপনার অনুরোধ থাকবে কি কি?
মিলন : আমি যেটা অনুরোধ করতে চাই তা হল মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুরের লোকজন বেশ ধনী৷ এককভাবে কিছু না করে যৌথভাবে যদি করা যায় সেটা বিক্রমপুর বাসীর জন্য কাজে আসবে৷ একসময় অত্র এলাকা শিক্ষিতের হার খুব ভালো ছিল৷ এখন অনেক কম৷ ভালো স্কুল, কলেজ এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে৷ মানুষের কল্যানে কাজ করবে যেমন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে৷
বর্তমান পৃথিবীতে তথ্য প্রযুক্তির খাত খুব শক্তিশালী৷ এই খাতে দক্ষ শ্রমিকের প্রচুর চাহিদা৷ বিদেশ থেকে প্রযুক্তি এবং বিনিয়োগকারী এনে এখানে আইটি ভিলেজ প্রতিষ্ঠা করে লোকজনকে দক্ষ করে তুলে বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ অদুর ভবিষ্যতে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে৷
মুন্সীগঞ্জ.কম : বিক্রমপুরবাসী হিসেবে সরকারের প্রতি আপনার কি অনুরোধ থাকবে?
মিলন : বিক্রমপুর নামটি কেবল মুখে মুখেই আছে৷ মানচিত্রে বা সরকারী নথিপত্রে কোথাও নেই৷ এমন কি নামেও৷ এই বিক্রমপুর নামটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমি কিছু লিখালিখি করেছিলাম৷ অনতপক্ষে জেলাটির নাম করন করা হউক মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর জেলা৷
যেই চিনা চেতনার মধ্য থেকে জাপানে মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সোসাইটি নামকরণ করা হয়েছে সেই একই চেতনা থেকে জেলাটির নাম মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর জেলা করা হউক৷ অন্তত সরকারী নথিপত্রের একটি স্থানে হলেও বিক্রমপুরের নাম থাকবে৷
প্রবাসী বিক্রমপুর বাসীদের পক্ষ থেকে ও জোর দাবী করা উচিত৷ কারণ প্রবাসীদের টাকায় দেশ চলে৷ প্রবাসীদের একটা বড় অংশ বিক্রমপুরের লোকজন৷ বর্তমান প্রেসিডেন্ট, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর সহ বহু উচ পদস্থ কর্মকর্তা বিক্রমপুরের কৃতি সন্তান৷ বিক্রমপুরবাসীদের এই ন্যায্য দাবীটুকুর প্রতি তারা সম্মান প্রদর্শন করবেন এটাই আমার অনুরোধ৷
দুর্গাপূজার দিনগুলো
ঈদের ব্যস্ততার কারণে বুঝতেই পারিনি আশ্বিন মাস এসে গেছে। এখন শরৎকাল। কয়েক দিন পরই দুর্গাপূজা। খবরটা পড়ে মন অন্য রকম হয়ে গেল। শরৎকালের আকাশটা খুব দেখতে ইচ্ছে হলো। সকালবেলায় শরতের আকাশ আজ কেমন হয়েছে!
চারতলার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। চারদিকের উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের ফাঁকফোকর দিয়ে একটুখানি চোখে পড়ে আকাশ। কী স্বচ্ছ, কী নীল পরিচ্ছন্ন আকাশ! কাশফুলের মতো সাদা মেঘ দাঁড়িয়ে আছে নীল আকাশের তলায়।
এটুকু আকাশ দেখে আমার মন চলে যায় পেছনে ফেলে আসা এক জীবনে। ছেলেবেলায়। বিশাল এক আকাশের তলায় নির্জনে পড়ে থাকা কাশবনের ভেতর দিয়ে, সকালবেলার আলোয় ছুটতে দেখি নিজেকে। পরনে হাফপ্যান্ট, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। দুটোই পুরোনো। প্যান্টটা একটু ঢলঢলে হয়ে গেছে। ওই ধরনের প্যান্টকে বলা হতো ইংলিশ প্যান্ট। সামনের দিকে বোতাম, পেছনের দিকে ইলাস্টিক। বোতাম ঠিক আছে, কিন্তু ইলাস্টিক ঢিলা হয়ে গেছে প্যান্টের। দৌড়ের তালে বারবার নেমে যাচ্ছে কোমর বেয়ে। এক হাতে সে প্যান্ট ধরে ছুটছি। আজ সকালেই গ্রাম মুখরিত হয়েছে ঢাকের শব্দে। তালুকদারবাড়ির দিকে বাজতে শুরু করেছে ঢাক। সে শব্দ এসে লাগছে বুকে। বুক ভরে যাচ্ছে আনন্দ-উত্তেজনায়। পূজা এসে গেছে। দুর্গাপূজা। এখন চারদিকে বইবে আনন্দের জোয়ার।
বিক্রমপুর ছিল হিন্দুপ্রধান এলাকা। জেলা ঢাকা, মহকুমা মুন্সিগঞ্জ। এখন মহকুমাই জেলা হয়ে গেছে। মুন্সিগঞ্জ জেলা। আর বিক্রমপুর নামটাই প্রকৃত অর্থে কোথাও নেই। সরকারি নথিপত্র থেকে মুছে গেছে। যেটুকু আছে তা মানুষের মুখে মুখে। মিষ্টান্ন ভান্ডার আর বস্ত্রালয়ের নামে। আর আছে বিক্রমপুর অঞ্চলের মানুষের হূদয়জুড়ে।
ছেলেবেলায় দেখেছি বিক্রমপুরের প্রতিটি গ্রামেই হিন্দু-মুসলমান গলাগলি করে আছে। দেশভাগের পর পূর্ববাংলা খালি করে দলে দলে হিন্দুরা চলে গেছে পশ্চিম বাংলায়। বিক্রমপুর থেকেও চলে গিয়েছিল অনেকে। আবার অনেকে থেকেও গিয়েছিল। আমি যে গ্রামে বড় হয়েছি, সেই গ্রামের নাম মেদিনীমন্ডল। বিশাল গ্রাম। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা বলে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছিল গ্রামটিকে−উত্তর মেদিনীমন্ডল, দক্ষিণ মেদিনীমন্ডল। আমার নানাবাড়ি দক্ষিণ মেদিনীমন্ডলে। বারো বছর বয়স পর্যন্ত এ গ্রামে জীবন কেটেছে আমার। মেদিনীমন্ডলের চারপাশে কত সুন্দর সুন্দর নামের গ্রাম। দক্ষিণে−পদ্মার পারে−মাওয়া, কুমারভোগ। উত্তরে দোগাছী। পশ্চিমে কান্দিপাড়া, জশলদিয়া। পুবে সীতারামপুর, কাজির পাগলা।
নানাবাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা বাড়ির পর ছিল মনীন্দ্র ঠাকুরের বাড়ি। মনীন্দ্র ঠাকুর ছিলেন দেবতার মতো একজন মানুষ। পাস করা চিকিৎসক নন, তবু চিকিৎসক হিসেবে অসাধারণ। তাঁর চেহারা দেখে আর কথা শুনে ভালো হয়ে যেত অর্ধেক রোগী। দেশগ্রামের লোক মাথায় করে রাখে তাঁকে। হিন্দু-মুসলমান সব শ্রেণীর, সব বয়সের মানুষ তাঁকে ডাকে ‘ঠাকুরদা’। বিরাট মানী লোক। দুর্গাপূজার সময় ঠাকুরবাড়িতে ঝাঁকা বোঝাই লাড্ডু আর আমৃতি। যে যাচ্ছে সে-ই খাচ্ছে। হাসিমুখে মনীন্দ্র ঠাকুর মিষ্টি বিলাতেন।
পুব দিকে কামারবাড়ি। পুব-উত্তর দিকে তালুকদারবাড়ি। তালুকদাররা ছিল এলাকার জমিদার। এই বাড়ির এক মহান বিদ্যানুরাগী শ্রী অভয় তালুকদার মহাশয় কাজির পাগলা গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাজির পাগলা এ টি ইনস্টিটিউশন। সেই স্কুলের বয়স এখন এক শ দশ বছর। রাজকাপুরের ক্যামেরাম্যান রাধু কর্মকার ছিলেন এই স্কুলের ছাত্র। এখনো অভয় তালুকদার মহাশয়ের নামেই চলছে স্কুল। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত এই স্কুলে পড়েছি আমি।
বিক্রমপুর নিম্নাঞ্চল। এখন রাস্তাঘাট হয়ে যাওয়ার ফলে বিক্রমপুর আর সেই বিক্রমপুর নেই। অনেকটাই যেন শহর। পদ্মার সেই উন্নত্ত চেহারাও নেই। একটার পর একটা চর পড়ে পদ্মা এখন শীর্ণ, দুর্বল। তাই আগের মতো বর্ষাকাল বিক্রমপুরে আর দেখা যায় না। এখনো বর্ষায় মাঠঘাট ভাসে, কিন্তু আমার ছেলেবেলার মতো না। ওই সব দিনে বিক্রমপুরের বর্ষা মানে মাঠঘাটে আট-দশ হাত পানি। একেকটা বাড়ি হয়ে যেত একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যেতে নৌকা ছাড়া উপায় নেই। কোনো কোনো বর্ষায় পানির জোর একটু বেশি হলে বাড়ির উঠোন-আঙিনা ডুবে যেত। উঠোন-আঙিনা ডুবিয়ে পানি ঢুকে যেত ঘরের ভেতর।
আমার নানা ছিলেন জাহাজের সারেং। অবস্থাপন্ন মানুষ। বাড়িতে বিশাল বিশাল টিনের ঘর। আমার জন্েনর বহুকাল আগে তিনি গত হয়েছেন। সচ্ছলতায় একটু ভাটা পড়েছে। কিন্তু বাড়ির বিশাল ঘরগুলো তখনো রয়ে গেছে। কোনো কোনো বর্ষায় ওই সব টিনের ঘরেও ঢুকে গেছে পানি। উঁচু পালঙ্কে বসে ঘরের মেঝেতে দেখছি মাছের চলাচল। সময় কাটানোর জন্য নানি আমাকে ছোট্ট একটা ছিপ দিয়েছে। আগের রাতে রান্না করা শক্ত-শক্ত ভাত দিয়েছে একমুঠ। সেই ভাত ছোট্ট বড়শিতে গেঁথে মাছের টোপ করেছি। পালঙ্কে বসে ঘরের মেঝেতে ফেলছি বড়শি, টানে টানে উঠছে পুঁটি-টেংরা, বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষায় ‘এলাইং’ নামের এক রকম ছোট মাছ।
আর কী লম্বা একেকটা বর্ষাকাল! চার-সাড়ে চার মাস কেটে যায়, শেষ হতেই চায় না। শুরু হয় জষ্ঠির মাঝামাঝি, আশ্বিনেও শেষ হয় না। শরৎকালেও যেন থেকে যেত কিছুটা বর্ষা। মাঠঘাট-ক্ষেতখোলায় তখনো রয়ে গেছে কাদাপানি। আমন ধানে পাকন লেগেছে। সকালবেলার আলোর মতোই রং পাকা ধানের। রোদ আর ধানের আলোয় সোনার মতো ঝলমল করছে চারদিক। বর্ষাজলের তলা থেকে জেগে ওঠা পুকুরপাড় আর আলপথ, সড়ক কিংবা মাঠের ধারে কাশবন সাদা হয়েছে ফুলে ফুলে। মাথার ওপর শরতের আকাশ, তলায় সোনালি ধানের মাঠ আর কাশবন, মনের ভেতর এখনো বাঁধা আছে সেই ছবি।
তালুকদারবাড়ির ঢাকের শব্দে হঠাৎ করেই যেন ফুরিয়ে গেছে বর্ষাকাল, হঠাৎ করেই যেন শেষ হয়েছে দুঃসহ লম্বা এক রাত। ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে পুরো গ্রাম। হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নেই। প্রতিটি বাড়িতেই লেগেছে আনন্দের ছোঁয়া। আমার বয়সী ছেলেমেয়ে সব ছুটতে ছুটতে বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। পায়ের তলার কাদাপানি উপেক্ষা করে ছুটছে তালুকদারবাড়ির দিকে। কত বড় দুর্গাপ্রতিমা হয়েছে এবার, কত সুন্দর হয়েছে! কবে প্রতিমা গড়তে শুরু করেছিল প্রতিমা শিল্পীরা! কবে শেষ করেছে! নাকি শেষ হয়নি এখনো! মহালয়ার আগের দিন শেষ হবে! না কি শেষ হয়ে গেছে! এখনই দেখতে দেবে না কাউকে! বিশাল সাদা কাপড়ে ঢেকে রেখেছে! কত কৌতুহল। কত কৌতুহলে ছুটে গেছি তালুকদারবাড়িতে।
এ রকম ছিল একেবারেই ছেলেবেলার দুর্গাপূজা। তারপর শুরু হলো ঢাকার জীবন। ঢাকায় আমাদের বাসা ছিল জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। ওখান থেকে পুব দিকে চার-পাঁচ মিনিট হেঁটে গেলে শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার। বিশাল আয়োজনে দুর্গাপূজা হয় এ দুই বাজারে। ওই পাড়ায় মুসলমান নেই। সবাই হিন্দু। বিশাল এলাকাজুড়ে মন্ডপের পর মন্ডপ। দুর্গাপ্রতিমার পর দুর্গাপ্রতিমা। পূজার দিনগুলোয় কী যে আনন্দ পুরো এলাকায়! আমি আর আমার বড় ভাই দিনে কতবার যে যাচ্ছি প্রতিমা দেখতে! একই প্রতিমা বহুবার দেখেও যেন সাধ মেটে না। মন খুব খারাপ হতো বিসর্জনের দিন। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার; ওদিকে শ্যামবাজার, সুত্রাপুর ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন; চারদিক থেকে ট্রাক ভরে আসছে প্রতিমা। বিসর্জনের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বুড়িগঙ্গার তীরে। পাটুয়াটুলির ওদিক দিয়ে আমিও যাচ্ছি দলের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে। মেদিনীমন্ডল গ্রামে থাকার সময় বিসর্জন দেখেছি পদ্মায়, ঢাকায় এসে দেখছি বুড়িগঙ্গায়। আমারও মন বেদনায় ভরে গেছে দেবী দুর্গার বিসর্জন দেখে। আমার মতোই ম্লান হয়েছে সারা শহর।
এখনো এমন করেই হয় পূজার আনন্দ। আমার ওই বয়সে আছে যারা, তারা নিশ্চয় অমন করেই কাটায় পূজার দিনগুলো। আমি অনেক পেছনে ফেলে এসেছি সেই জীবন। এই জীবনের অনেক পরে দীনেন্দ্রকুমার রায়ের পল্লীচিত্র বইয়ে অসাধারণ বর্ণনা পড়লাম দুর্গাপূজার।
“নদীজলে অনেক দুর পর্যন্ত মশালের আলো প্রতিফলিত হইতেছে। প্রতিমার নৌকার একপ্রান্তে দেওয়ানজী গললগ্নীকৃতবাসে কৃতাঞ্জলিপুটে গম্ভীরভাবে দন্ডায়মান। পুরোহিত ঠাকুর দক্ষিণ হস্তে পঞ্চপ্রদীপ ও বাম হস্তে ঘণ্টা নাড়িয়া ঠাকুরের আরতি করিতেছেন, দর্শকবৃন্দ নির্র্ণিমেষ নেত্রে চাহিয়া আছে। শরতের ধুসর সন্ধ্যায় পল্লীপ্রান্তবাহিনী তরঙ্গিনীবক্ষে এক অপূর্ব দৃশ্য।
“অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিলে ক্রমে ক্রমে প্রতিমাগুলিকে জোড়া নৌকার উপর হইতে ধীরে ধীরে নদীর জলে নামাইয়া দেওয়া হইল; দর্শকগণ উচ্চৈঃস্বরে ‘হরিবোল’ দিতে লাগিল। যাহারা জলের ধারে ছিল, তাহারা অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিয়া মাথার উপর ছড়াইয়া দিল। প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে অনেক লোক নৌকা হতে জলে নামিয়া পড়িল। কেহ অবগাহন করিতে লাগিল; কেহ কেহ ডুব দিয়া রাংতা কুড়াইতে লাগিল। বিসর্জন দেখিয়া দর্শকগণ নদীতীর হইতে গৃহমুখে প্রত্যাবর্তন করিল।
“পূজা-বাড়িতে বাদ্যধ্বনি থামিয়া গিয়াছে। এই কয় দিন যে বেদীর উপর দুর্গাপ্রতিমা অলৌকিক গৌরবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন−আজ চন্ডীমন্ডপে সেই বেদী শুন্য পড়িয়া আছে; নিকটে একটি ক্ষুদ্র মৃৎপ্রদীপ জ্বলিতেছে, তাহাতে গৃহের অন্ধকার দুর হইতেছে না! যেন আনন্দময়ী কন্যাকে দীর্ঘকালের জন্য বিদায়দানের পর পিতৃগৃহের সুগভীর নিরানন্দভাব ও মাতৃহূদয়ের সুতীব্র বিরহ বেদনা উৎসবনিবৃত্ত কর্মশ্রান্ত অবসাদ-শিথিল ক্ষোভবিহ্বল বঙ্গগৃহের সেই ম্লান দীপালোকে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে।”
কিশোর বয়সে জিন্দাবাহার ছেড়ে চলে এলাম গেন্ডারিয়ায়। গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে পড়ি। আমাদের হেডমাস্টার সুধীর বাবু। গেন্ডারিয়ায় তো আছেই, চারপাশেও রয়ে গেছে বহু হিন্দু পরিবার। দীননাথ সেন রোডে মানবেন্দ্রদের বাড়ি। সাধনা ঔষধালয়ের মূল কারখানার ঠিক উল্টো দিককার বিশাল বাড়ি। মানবেন্দ্র আমার সঙ্গে পড়ে। আমার বন্ধু। সুত্রাপুরের শংকর, ঋষিকেশ দাস লেনের সুভাষ আচার্য আর সুভাষ মন্ডল−পূজার সময় দিনরাত পড়ে থাকি ওই সব বন্ধুর বাড়ি। দুর্গাপ্রতিমা দেখতে যাই মিলব্যারাক মাঠের পাশে, সুত্রাপুর, শ্যামবাজার। আর একটু বড় হয়ে গেছি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে, রামকৃষ্ণ মিশনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার তো ছিলই। বন্ধুরা দলবেঁধে গেছি দুর্গাপ্রতিমা দেখতে।
কয়েক বছর আগে চিটাগাংয়ে গেছি এক সাহিত্যের অনুষ্ঠানে। আমার সঙ্গে আছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা, লেখক আমজাদ হোসেন। রাতের বেলা সরকারি ডাকবাংলোয় বসে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎই দেবীপ্রতিমা দেখতে আসা মানুষজনের উদ্দেশে কী কী ঘোষণা হতে লাগল মাইকে। দুর্গাপূজার সময়। আমাদের বাংলোর খুব কাছে পূজামন্ডপ। আমজাদ ভাইকে বললাম, ‘চলুন, আমজাদ ভাই, প্রতিমা দেখে আসি।’
তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। রাত তখন এগারোটার ওপর। মন্ডপে গিয়ে দেখি তখনো শয়ে শয়ে লোক। নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী। গানবাজনা হচ্ছে, আরতি হচ্ছে। খুবই উৎসবমুখর পরিবেশ। আমাদের চিনে ফেললেন পূজা কমিটির কর্তাব্যক্তিরা। আমজাদ ভাই এত সুন্দর করে আরতি দিলেন দেবীর সামনে! দেখে আমি অবাক। পরে তিনি আমাকে বলেছেন, তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে জামালপুরে। পূজার সময় হিন্দু বন্ধুদের সঙ্গে তিনি আরতি করেছেন। এখনো মনে রয়ে গেছে কীভাবে আরতি করতে হয়। নারায়ণগঞ্জে থাকত আমার বন্ধু লুৎফর। দুর্গাপূজার সময় লুৎফর আমাকে দাওয়াত দিত, ‘নারায়ণগঞ্জে আয়। পূজা দেখে যা।’
পূজার দিনগুলো কাটত এইভাবে। এখন আমার বন্ধু স্বপন দত্তের ফ্ল্যাটে দশমীর দিন একত্র হই আমরা। আমরা দশ-বারোজন বন্ধু, স্ত্রী, বাচ্চাকাচ্চারা। স্বপনের হিন্দু বন্ধু নেই। সব বন্ধুই মুসলমান। সবাই একত্র হয়ে দুর্গাপূজার আনন্দটা করি। বিশাল খাওয়া-দাওয়া, হৈহল্লা, আড্ডা। ঈদের দিন স্বপনও ঠিক ওভাবেই দিনটা কাটায় আমাদের সঙ্গে।
বাংলাদেশে দুর্গাপূজার চেহরাটা এই রকম। হিন্দু-মুসলমান মিলেই উৎসবটা করে। দোকানপাট, বাজারঘাটে ঈদের মতোই বেচাকেনার ধুম লাগে। সরকারি ছুটি থাকে। মিষ্টির দোকানগুলো ভরে যায় লাড্ডু আর আমৃতিতে। চিনির হাতি-ঘোড়া বাঘ-ভালুক তৈরি করা হয় শিশুদের জন্য। হিন্দু, মুসলমান-নির্বিশেষে বাচ্চাদের জন্য কেনে ওই মুখরোচক দ্রব্য। পত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। টিভি চ্যানেলগুলো আয়োজন করে বিশেষ সব অনুষ্ঠানের। কোথাও একবিন্দু কমেনি দুর্গাপূজার আনন্দ, বরং আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে।
আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক যতীন সরকারের একটি লেখা পড়ে দুর্গাপূজার মূল দর্শনটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। ‘গণেশের পাশে দাঁড়ানো কলাবউ’ নামে ছোট্ট একটি রচনায় দুর্গাপূজার চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। গণেশের পাশে দাঁড়ানো গণেশের বউ অথবা কলাবউ নামে লম্বা ঘোমটা দেওয়া বউটি আসলে একটি কলাগাছ। শাড়ি প্যাঁচিয়ে, লম্বা ঘোমটা দিয়ে পল্লীবধুর মতো কলাগাছটি দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বলে ও রকম নাম পড়েছে। তার আসল নাম ‘নবপত্রিকা’। কারণ শুধু কলাগাছ নয়, নয় রকম গাছের পাতা একত্রে জড়িয়ে কলাবউটি তৈরি করা হয়েছে। কলা হলদি ধান কচু মানকচু জয়ন্তী ডালিম অশোক ও বেল−এই কটি উদ্ভিদের পল্লব নিয়েই নবপত্রিকা। নয়টি পল্লবের আবার নয়জন আলাদা আলাদা অধিষ্ঠাত্রী দেবী আছেন। কলার হচ্ছেন ব্রਜ਼াণী, হলদির দুর্গা, ধানের লক্ষ্মী, কচুর কালিকা, মানকচুর চামুন্ডা, জয়ন্তীর কার্তিকী, ডালিমের রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা আর বেলের শিবা। এই নবপত্রিকার পূজাই হচ্ছে দুর্গাপূজার প্রধান অঙ্গ। দুর্গাসহ নবপত্রিকার সব দেবীই উদ্ভিদজগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই এই দেবীরা মূলত কৃষিদেবী। মার্কন্ডেয় পুরাণে দেবী নিজেই বলেছেন, ‘অনন্তর বর্ষাকালে নিজদেহে সমুদ্ভুত প্রাণধারক শাকের সাহায্যে আমি সারা জগতের পুষ্টি সরবরাহ করব। তখন আমি জগতে শাকম্ভরী নামে বিখ্যাত হব।’ যিনি দুর্গা তিনিই শাকম্ভরী। শাকম্ভরীই আবার বিবর্তিত হয়ে রণরঙ্গিনী, মহিষমর্দিনী বরাভয়দায়িনী দেবীতে পরিণত হয়েছেন। আদিযুগের শস্যদেবীই এ যুগের দুর্গাদেবী।
বাঙালির দুর্গোৎসব হচ্ছে শারদীয় উৎসব। ধান যখন পাকতে শুরু করে, পাকা ফসলে যখন গৃহস্েথর গোলা ভরে ওঠার সময়, সেই শরৎকালেই বাঙালির দুর্গোৎসব। একদা কৃষি-উৎসব ছিল বলেই ফসল ওঠার সময় উৎসবটা হয়।
শ্রীশ্রী চন্ডী গ্রন্েথর মধ্যমচরিতে বলা হয়েছে, ‘শতবর্ষব্যাপী দেবতা এবং অসুরদের যুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধে দেবগণ পরাভুত হয়ে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত। ব্রਜ਼া, বিষ্ণু, শিব এই তিন মহান দেবতার নিকট দেবগণ স্বর্গভ্রষ্টতার কাহিনী করুণভাবে বর্ণনা করে এর প্রতিকার প্রার্থনা করেন। অসুরদের হাতে দেবতাদের নির্যাতনের কাহিনী শুনে দেবগণের প্রচন্ড ক্রোধ জন্েন। ক্রোধ থেকে তেজ আর ওই তেজরাশি মিলিত হয়ে এক নারীমূর্তির আবির্ভাব ঘটাল। সেই নারীমূর্তিই হলেন দুর্গা। অত্যাচারী ভোগলিপ্সু মহিষাসুরের সঙ্গে দেবীর ভীষণ যুদ্ধ ও দেবশক্তির বিজয়, অসুরদের বিনাশ। অসুর শক্তির বিনাশে দেবগণ উল্লসিত এবং দেবীর প্রতি তাঁরা স্তুতি নিবেদন করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। হে দেবী, আমাদের প্রতি আপনি প্রসন্ন হোন। সম্প্রতি অসুরনাশ করে আমাদেরকে যেরূপ রক্ষা করলেন, ভবিষ্যতেও আপনি আমাদেরকে শত্রুভয় থেকে রক্ষা করবেন। হে দেবী, আপনি কৃপা করে দুর্ভিক্ষ মহামারি প্রভৃতি উপদ্রব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন।’ (সুত্র: দুর্গাপূজা: ঐতিহ্য ও সাম্প্রতিক ভাবনা। ড. পরেশচন্দ্র মন্ডল)
আজকের এই পৃথিবী এক সংকটময় পৃথিবী। অকল্যাণ, অকর্ম আর মঙ্গলহীনতায় ভরে গেছে পৃথিবী। মানুষ কাটাচ্ছে এক অসহনীয় সময়। এই অসময়ের জন্য, আজকের পৃথিবীর জন্য দুর্গাপূজার দর্শন মানবজীবনকে এক কল্যাণকর পৃথিবীতে নিয়ে যেতে পারে। মানুষকে দেখাতে পারে শুভ এবং আলোকিত পথ।
নাটক আর লেখালেখি নিয়েই থাকতে চাই
আজ আরটিভিতে আপনার রচনায় এবং পরিচালনায় প্রাচারিত হবে ধারাবাহিক ‘মেয়েটি এখন কোথায় যাবে’ এ সম্পর্কে কিছু বলুন?
অনেক বছর আগে ‘মেয়েটি এখন কোথায় যাবে’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। পরে সেটি উরিয়া ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। সেই উপন্যাসটাকেই নাট্যরূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। হুবহু না তবে উপন্যাসের আদলে অনেক চরিত্র ইন আউট করে নির্মাণ করেছি নাটকটা। ইতিমধ্যে বেশ কয়েক পর্ব প্রচারিতও হয়েছে। অনেক সাড়া পাচ্ছি। তবে ৫২ পর্ব মানে নাটকের শেষে আরো আলোচিত হবে। নাটকের নাম ‘মেয়েটি এখন কোথায় যাবে’ কেন?
নাটকের নাম থেকেই বোঝা যায় যে, একটা মেয়েকে নিয়েই নাটকের কাহিনী। সেখানে দেখা যায় একটা মাস্তান টাইপের ছেলে একটা মেয়েকে আটক করে রাখে। পরে মেয়েটি ছেলের বিদেশ ফেরত চাচার সাহায্যে কৌশলে মুক্তি পায়। কিন্তু বাড়ি ফিরে আসলে মেয়ের বাবা তাকে আর গ্রহণ করে না। তার পরের উক্তিটিই হচ্ছে ‘মেয়েটি এখন কোথায় যাবে’। বর্তমানে আর কি নিয়ে ব্যস্ত?
বর্তমানে বেশ কয়েকটি নাটক এবং টেলিফিল্ম নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি। চ্যানেল ওয়ানের জন্য ১০৪ পর্বের ‘মা, বাবা ভাইবোন’ নামের একটি ধারাবাহিকের শুটিং চলছে। এ ছাড়া চ্যানেল আইয়ের জন্য একটি নাটক বানাচ্ছি। বন্ধু মোহন খানকে অপহরণের পর নামে একটি গল্প দিলাম। এবং দেশ টিভির উদ্বোধন উপলক্ষে একটা টেলিফিল্ম বানাচ্ছি এই তো। এখনকার নাটক এবং আগেরকার নাটকের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?
হ্যাঁ, পার্থক্য তো অনেকই খুঁজে পাই। তবে একটা ব্যাপার আমার মধ্যে খুব কাজ করে আর সেটা হলো বর্তমানকালের নাটক বর্তমান কালের মতোই নির্মাণ হচ্ছে, এটাকে আমি শুভ লক্ষণই বলবো। তবে সঙ্গে সঙ্গে মন্দ জিনিসও আসছে। ভালো জিনিসের সঙ্গে মন্দ জিনিস তো থাকবেই। তবে ভালোর জোয়ারে মন্দ জিনিস অবশ্যই ভেসে যাবে। আর আগের নাটকের গল্প ভালো ছিল। মানুষও মনে রাখতো অনেক দিন। এখন আর তা লক্ষ্য করা যায় না। গল্প, উপন্যাস নাটক লেখা সামলান কিভাবে?
আসলে সময় কবে নিতে হয়। মানুষের জীবনে ব্যস্ততা তো থাকবেই। তারপরও আসল কাজ তো করতেই হবে। নাটক নির্মাণ করে আর লেখালেখি নিয়েই থাকতে চাই।
ফরীদি উপাখ্যান
হুমায়ূন ফরীদির সঙ্গে পরিচয় হলো বাহাত্তর সালে।
স্বাধীনতার পরের বছর। বছরের বোধহয় শেষ দিকে। আমি তখনও লেখক হইনি, ফরীদি তখনও অভিনেতা হয়নি।
লেখা উচিত ‘হননি’। ফরীদিকে আপনি করে লিখতে কি রকম যেন লাগছে। সে আমার এত প্রিয় বন্ধু, ফরীদির মতো বন্ধুকে কেমন করে আপনি বলি!
আমি তখন থাকি গেন্ডারিয়াতে।
গেন্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের একটা বাসায় ভাড়া থাকি। আব্বা মারা গেলেন একাত্তর সালের অক্টোবরে। দশটা ছেলেমেয়ে নিয়ে মা আছেন অতি কষ্টে। বড় ভাই ইন্টারমিডিয়েট পাস করে নাইটে জগন্নাথে বিকম পড়ে, টঙ্গীর ওদিকে একটা চাকরি করে। আব্বা চাকরি করতেন মিউনিসিপ্যালিটিতে। আব্বার জায়গায় বড় ভাইয়ের চাকরি হলো। আমি আর আমার বড় বোন একাত্তর সালে এসএসসির ক্যান্ডিডেট। যুদ্ধের জন্য পরীক্ষা দেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর পর পরীক্ষা দিলাম। বাহাত্তর সালে আমি জগন্নাথ কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র।
রজনী চৌধুরী রোডের সেই গলিতে, আমাদের বাসার ঠিক উল্টোদিকের বাড়িটা হলো বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার হামিদ ভাইয়ের বাড়ি। তার ঠিক লাগোয়া দক্ষিণ দিককার বাড়িটি সালেহদের। সেই বাড়ির নিচতলার ভাড়াটের আত্মীয় হচ্ছে একটি ক্ষেপাটে ধরনের এক যুবক। আত্মীয়ের বাসায় থেকে জগন্নাথ কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ে। লেখে বাহাতে। হাতের লেখা খুবই সুন্দর। সে একজন তরুণ কবি। নাম মাহমুদ শফিক। ওই বয়সেই তার একটা কবিতার বই বেরিয়েছে। বইয়ের নাম ‘ছবি প্রকাশিত হলে’। নিজ খরচেই বইটা শফিক বের করেছে। কবিতাগুলো বেশ কঠিন। একটা কবিতার লাইন আমার এখনও মনে আছে,
সখী আজ নীল শাড়ি পরো
নির্বাণে চলো যাই।
শফিকের সঙ্গে অনেক তরুণ কবির যোগাযোগ। বড় পত্রিকা থেকে শুরু করে অনেক ছোটখাটো পত্রিকারও যোগাযোগ। মাসিক, ত্রৈমাসিক। পরিচিত, কম পরিচিত অনেক পত্রিকা।
নারায়ণগঞ্জ থেকে তখন একটা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা বেরুত। পত্রিকার নাম ‘কালের পাতা’। সম্পাদক সিরাজুল হক। তিনি একজন লেখক। সিরাজুল হক সাহেবের বড় ছেলে মুজিবুল হক কবীর একজন তরুণ কবি। জগন্নাথে শফিকের সঙ্গে পড়ে। ভাল বন্ধুত্ব দু’জনার। ‘কালের পাতা’য় শফিক এবং কবীর দু’জনারই কবিতা ছাপা হয়। গেন্ডারিয়া থেকে প্রায়ই দুপুরের পর নারায়ণগঞ্জে রওনা দেয় শফিক। লোহারপুলের দক্ষিণ দিককার ঢাল থেকে বাসে চড়ে, নারায়ণগঞ্জের বোস কেবিনের অদূরে গিয়ে নামে।
এই ধরনের বাসগুলোর একটা ডাকনাম ছিল। মুড়ির টিন। আসল নাম ‘টাউন সার্ভিস’। ছ আনা বা আট আনায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ। গুলিস্তান থেকে ছাড়ত, ভিক্টোরিয়া পার্কের ওদিক থেকে ছাড়ত। ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম ততোদিনে ‘বাহাদূর শাহ পার্ক’ হয়ে গেছে। সেই পার্কের দক্ষিণ দিকে রাস্তার ওপাশে ‘মিউজিক্যাল মার্ট’ নামে একটা স্টুডিও ছিল। বিখ্যাত লোকজনরা গিয়ে ছবি তুলত সেই স্টুডিওতে। নারায়ণগঞ্জের বাস ছাড়ত ওই স্টুডিওর সামনে থেকে।
আমার বিকালগুলো কাটে তখন টিউশনি করে। কখনও বা দীননাথ সেন রোডের ওদিককার পাঠাগার ‘সীমান্ত গ্রন্থাগার’-এ বই পড়ে।
আমি ছোটবেলা থেকেই অপদার্থ টাইপের। কোনো খেলাধুলা পারতাম না। এমনকি সাইকেল পর্যন্ত চালাতে শিখিনি। বন্ধুরা ধুপখোলা মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে, আমি খেলতে পারি না। খেলা একটাই একটু পারি, সেটা ব্যাডমিন্টন। শীতকালে মানবেন্দ্রদের বাড়ির লনে আমি মুকুল মোহাম্মদ আলী মানবেন্দ্র ব্যাডমিন্টন খেলতাম। কোনো কোনোদিন বেলালও খেলতে যেত।
বেলাল ছাড়া আমরা সবাই ছিলাম গেন্ডারিয়া হাইস্কুলের ছাত্র।
মাহমুদ শফিকের সঙ্গে কেমন করে আমার একটা ভাব হলো। আমি একটু বইটই পড়ি, পত্রপত্রিকা এবং সাহিত্যের খোঁজখবর রাখি। শফিক ভাবলো, এই তো একজন পাওয়া গেছে। দিনরাত অবিরাম কবিতা লেখে সে, অবিরাম আমাকে পড়ে শোনায়। আমি বুঝি আর না বুঝি মুগ্ধ হওয়ার ভান করি। কবিতার শব্দ ব্যবহার, ছন্দ এবং ভেতরকার রহস্যময়তা নিয়ে শফিক তখন টগবগ করে ফুটছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান এদের প্রত্যেকের কবিতা নিয়েই কথা বলে। আমি কবিতার কিছুই বুঝি না, তবু শফিকের কথায় তাল দিয়ে যাই।
শফিক আমাকে একদিন নারায়ণগঞ্জে নিয়ে গেল।
‘কালের পাতা’র অফিস ছিল সিরাজুল হক সাহেবের বাসায়। দেওভোগের ওদিকে। খালের ওপর কাঠের একটা ব্রিজ। সেই ব্রিজ পেরিয়ে হাতের বাঁদিকে টিনের বাড়ি। লম্বা মতন পাটাতন করা একটা ঘরে থাকেন সিরাজুল হক সাহেব। বিকালের মুখে সেই বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছি আমি আর শফিক। লম্বা ঘরটির মাঝখানে পার্টিশান দিয়ে দুটো রুম করা হয়েছে। খোলা দরজা দিয়ে একটা রুম দেখা যাচ্ছে। খাটে লম্বা মতোন একজন মানুষ দরজার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে আছেন। পরনে লুঙ্গি, গায়ে আর কিছু নেই। তার সাদা পিঠ চকচক করছে।
শফিক ফিসফিস করে বলল, ওই যে ওই ভদ্রলোকই হচ্ছেন সিরাজুল হক।
সেই প্রথম একজন লেখক এবং সম্পাদককে দেখলাম আমি।
তার আগে, ছেলেবেলায় আব্বা আমাকে একজন লেখক দেখিয়ে দিলেন। আমরা তখন থাকি জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। বাড়ির নম্বর ছিল সাত। বাষট্টি-তিষট্টি সালের কথা। সংসার বড় হচ্ছে দেখে মা আমাকে রেখেছিলেন বিক্রমপুরে, আমার নানির কাছে। মাঝে মাঝে ঢাকায় আসতাম। ঢাকায় আমাদের তখন বেড়াবার জায়গা মানে সদরঘাট। জিন্দাবাহার থার্ড লেন থেকে বেরুলেই আহসান মঞ্জিলের উত্তরদিকের গেট। আমরা বলতাম, নোয়াববাড়ি। নোয়াববাড়ির সেই গেট দিয়ে ঢুকলে সোজাসুজি বুড়িগঙ্গার তীরে আহসান মঞ্জিল, পশ্চিম পাশে একটা মসজিদ, পুবপাশে বিশাল খেলার মাঠ। সেই মাঠের মাঝখান দিয়ে পুবদিকে আর একটা বিশাল উঁচু গেট। ওই গেট দিয়ে বেরিয়ে, ওয়াইজ ঘাটের ওদিক দিয়ে সদরঘাটে চলে যাই আমরা।
সদরঘাটে তখনও টার্মিনাল হয়নি। বাকল্যান্ড বাঁধের মাঝখান দিয়ে পায়েচলা পথ নেমে গেছে বুড়িগঙ্গার দিকে। বালিয়াড়ির ওপর পড়ে থাকে সাগরকলার খোসা, ডাবের খোসা। আর লঞ্চগুলো দাঁড়িয়ে থাকে নদীতীরে। কাঠের লম্বা সিঁড়ি নেমে গেছে বালিয়াড়িতে। অদূরে বজরার মতো অনেক নৌকা। সেই সব নৌকার কোনোটায় লেখা ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, কোনোটায় লেখা ‘পাইস হোটেল’।
এই বালিয়াড়ির ওপর এক বিকেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম এক ভদ্রলোককে। পরনে সাদা পায়জামা আর খদ্দরের ধূসর পাঞ্জাবি। কাঁধে একটা ঝোলা। মুখে দাড়িগোফ, চোখে চশমা, পায়ে চপ্পল।
আব্বা আমাকে বেড়াতে নিয়ে গেছেন সদরঘাটে। হাঁটতে হাঁটতে ওদিকটায় গেছি আমরা। ভদ্রলোককে দেখিয়ে আব্বা বললেন, ওই ভদ্রলোক একজন লেখক। বই লেখেন।
কি ধরনের বই লেখেন, কি নাম সেসবও বলেছিলেন কি-না মনে নেই। তবে ওই প্রথম আমি একজন লেখককে দেখি।
কিন্তু লেখক এবং সম্পাদক, একজন মানুষই যে দু দুটো ক্ষেত্রে কৃতি, সেটা দেখলাম সিরাজুল হক সাহেবকে। তাও মুখটা দেখতে পেলাম না। দেখলাম পিঠটা।
মুজিবুল হক কবীরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো শফিকের মাধ্যমে।
সেই বিকালে আমরা আর কবীরদের বাসায় বসিনি। প্রথমে গেলাম ‘বোস কেবিনে’। কবীরের বন্ধুবান্ধব কাউকে সেখানে পাওয়া গেল না। চাষাড়ার ওদিকে ‘সুধীজন পাঠাগার’ নামে একটা পাঠাগার হয়েছে। বিকালবেলা ওই পাঠাগারে বসে বই পত্রপত্রিকা পড়ে কবীরের বন্ধুরা। পাঠাগার পর্যন্ত যেতে হলো না। পাঠাগারের একটু আগে ‘আলম কেবিন’ নামে নতুন একটা রেস্টুরেন্ট হয়েছে। সেই রেস্টুরেন্টের সামনের ফুটপাতে তিন-চারজন যুবক বসে আছে। প্রত্যেকের পোশাক-আশাক এলোমেলো। মাথায় লম্বা চুল। কারও কারও হাতে সিগারেট। একজন বেশ উচু লম্বা, মোটা ধাঁচের। কবীর পরিচয় করিয়ে দিল, ওর নাম মুহসিন। আরেকজন যুবক একটু বেটে খাটো, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। মাথার চুল বাদামি। চেহারা খুবই সুন্দর। তার নাম মাহবুব কামরান। সে ছবি আঁকে, কবিতা লেখে। দুষ্টের শিরোমনি বলতে যা বুঝায়, তাই (কামরান সম্পর্কে এই তথ্য জেনেছি পরে)।
মুহসিন বিশাল ধনী পরিবারের ছেলে। নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত ‘জামাল সোপ ফ্যাক্টরি’ হচ্ছে মুহসিনদের।
তৃতীয় যে যুবকটি সেদিন আলম কেবিনের ফুটপাথে বসেছিল তার নাম হুমায়ূন ফরীদি। পরনে সাদা ঢলঢলে একটা শার্ট, কালো প্যান্ট। দুটোই অতি ময়লা। ফরীদির পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল। ফুকফুক করে সিগারেট টানছিল। মাথায় লম্বা লম্বা চুল। চেহারায় তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। মুহসিন আর কামরান হাসি ঠাট্টা করছিল, মজা করছিল। কবীর পরিচয় করিয়ে দেয়ার পরও
ফাতেমা আক্তার ও আলী আহম্মদদের কথা একটু ভাবুন
এসএসসির রেজাল্টের পর খবরের কাগজগুলোতে শহরের বিখ্যাত স্কুলগুলোর আর তাদের ছাত্রছাত্রীদের কৃতিত্বের কথা যেমন বিস্তারিত লেখা হয় তেমন করেই লেখা হয় দেশের গ্রামগঞ্জে অতিকষ্টে পড়াশুনা করে ভালো রেজাল্ট করা ছেলেমেয়েদের কথা। তেমন দুজন ছেলেমেয়ের কথা পড়লাম ‘ভোরের কাগজ’ এর ১ জুন ২০০৯ সংখ্যায়। মফস্বল পাতায় ছাপা হয়েছে রংপুরের ফাতেমা আক্তারের কথা আর মাদারীপুরের আলী আহম্মদের কথা। আসুন, আগে তাদের দুজন সম্পর্কে জানি।
‘মাহফুজার রহমান, বদরগঞ্জ (রংপুর) থেকে : এবারের এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলার মোমিনপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেয়েছে ফাতেমা আক্তার। শখ ভালো কলেজে পড়ার, কিন্তু বিধবা মায়ের সামর্থ্য না থাকায় হয়তো অঙ্কুরেই ঝরে যাবে এই অদম্য মেধীবী ফাতেমা আক্তার।
অজ পাড়াগাঁ দক্ষিণ মোমিনপুর স্কুলপাড়া। সে গ্রামেই বাস করেন পিতৃহীনা হতভাগ্য ফাতেমা আক্তার। আড়াই বছর আগে ৮ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় মারা গেছেন তার বাবা আয়নাল হক। আবাদি জমি মাত্র দেড় বিঘা। এ জমির ফসল দিয়েই চলে ফাতেমাদের সংসার। স্বামী মারা যাওয়ার পর খেয়ে না খেয়ে ৫ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ বহন করছেন ফাতেমার মা তরিফোন নেছা। বড়মেয়ে ডিগ্রিতে, ছোটমেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী, একছেলে ৭ম শ্রেণীতে লেখাপড়া করে। এসএসসির ফলাফল বের হওয়ার পর মানুষের মুখে মেয়ের ভালো ফলাফলের কথা শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা তরিফোন নেছা।
কথা হচ্ছিল ফাতেমাদের উঠোনে বসে। ছবি তুলবো বলে জামা পরে আসতে বলায় ঘরে ঢুকে মা-মেয়ে যে জামা ও শাড়ি পরে এলেন তা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা বাড়িতেও পরে না। ভবিষ্যতে কী হতে চাও, প্রশ্ন করতেই কান্না ছলছল চোখে ফাতেমা জবাব দেয়, কলেজে পড়ার সামর্থ্যই যেখানে নেই, সেখানে বড় কিছু হতে চাওয়ার আশা করি কী করে?।
ফাতেমার মা তরিফোন নেছা মেয়ের লেখাপড়ার খরচ বহনের জন্য সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা চাইলেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বদিউজ্জামান, শিক্ষক নাজমা খাতুন ও সভাপতি ডা. মানিক ফাতেমার ফলাফলে খুবই খুশি এবং তার সুন্দর ভবিষ্যৎ কামনা করলেন।’
প্রদ্যুৎ কুমার সরকার, শিবচর (মাদারীপুর) থেকে : প্রায় ১০ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবার পঙ্গুত্বের পর বড়ভাই সংসারের হাল ধরেন। ৪ বছর আগে সেই ভ্যানচালক বড়ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার গড়েন। সেই থেকে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকেই পঙ্গু বাবা ইউনুছ মিয়া, মা ও দুই বোনসহ পরিবারের সব দায়িত্ব বহন করে অনাহারে-অর্ধাহারে জিপিএ ৫ পেয়েছে উপজেলার উমেদপুর অফিজা রবিউল্লাহ লাইসিয়াম উ”চ বিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র আলী আহম্মদ। এই সাফল্যগাথা ও গৌরবের ফলাফলের কথা শুনতে গিয়ে আলী আহম্মদ ও তার মায়ের অশ্রুসিক্ত বর্ণনা উপস্থিত সকলের চোখে পানি আনে।
আলী আহম্মদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, মাটির মেঝে, পাটকাঠির ভাঙাচোরা একটি মাত্র ঘরে বসত হতদরিদ্র পরিবারটির। বাঁশের মাচায় তৈরি বিছানায় নেই কোনো চাদর। ছেঁড়াফোঁড়া কাপড়ের তৈরি চাদরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ঘরটিতে। বোনরা বড় হয়ে যা”েছ।
তাই মাটির মেঝেতে বা অন্যের ঘরের বারান্দায় ঘুমিয়েই কেটেছে আলীর ১৬টি বছর। মায়ের সঙ্গে ভাইবোনরা বাঁশের সামগ্রী য়োড়া তৈরি করেই চালিয়েছেন সংসার জীবন। জুটেছে মরিচ পান্তা কিংবা কখনো গরম ভাতের সঙ্গে শাক। মাছ কোনো মাসে জুটেছে কিন্তু মাংস কখনোই জোটেনি।
অভাবের তাড়নায় ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ বার লেখাপড়া বন্ধের উপক্রম হয়েছিল আলীর। কিন্তু প্রতিবারই মায়ের ইচ্ছা, নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও একাগ্রতায় লেখাপড়া চালিয়ে গেছে সে। মায়াবী ও সুশ্রী মুখমণ্ডল দেখে বোঝারই উপায় নেই, দারিদ্র্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত আলীর সংগ্রামী জীবন। আলী জানায়, অল্প বয়সেই পরিবারের দায়িত্ব নেয়ায় সপ্তাহে সর্বাধিক ২ দিন ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছে সে।
খাতা কেনার ভয়ে মুখস্ত পড়ে ও ধার করা বই দিয়েই চলেছে শিক্ষাজীবন। হাটের দিনে বাঁশের তৈরি য়োড়ার কদর থাকায় শুক্রবার, সোমবার ও মঙ্গলবার রাতদিন কাজ করতে হয়েছে। ফলে এই তিনদিন কখনোই পড়ার সুযোগ এমনকি বই ধরারও সুযোগ পায়নি আলী। শিক্ষকদের সহযোগিতায় স্কুলে টাকা দিতে হয়নি। পরিধানের জন্য সর্বসাকল্যে শার্ট একটি। প্যান্টও একটি তাও ছেঁড়া।
অদম্য মেধাবী আলীকে নিয়ে এখন বিস্ময় এলাকাজুড়ে। স্কুলের শিক্ষার্থীসহ পরিচিত অপরিচিতরা দেখতে আসছেন আলীকে। তাকে নিয়ে এলাকায় উচ্ছাস বয়ে গেলেও কোনো অনুভূতি বা উচ্ছাসই ছুঁতে পারেনি আলীকে। মন দিয়ে মাকে নিয়ে বাঁশের য়োড়া বানিয়ে যাচ্ছে এই অদম্য মেধাবী।
বন্ধুর ফলাফলের মিষ্টি খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে আলীকে। পাড়া প্রতিবেশী বা পরিবারের কাউকেই এখনো মিষ্টি খাওয়াতে পারেনি ঋণে জর্জরিত পরিবারটি। ফলাফলের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে ক্ষুধার কাছে। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন জিজ্ঞাসা করলে আলী বলেছে, ‘কোনো স্বপ্ন নেই। স্বপ্ন দেখার সুযোগ পাই না। প্রথমে মা বাবা ও বোনদের শাক পাতা খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এরপর লেখাপড়া। জানি না কী করবো? প্রতি সপ্তাহে পুরোনো ঋণের বড় অংকের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। না হলে ঘরটিও যাবে।’ এলাকাবাসী জানান, আলীকে পরীক্ষার মধ্যেও কাজ করতে হয়েছে। না হলে ওর মা বাবা ও বোনদের না খেয়ে থাকতে হতো। ওর জিপিএ ৫ পাওয়াটাই তাই একটা আশ্চর্যের ব্যাপার।
মা শিমুলা বেগম বলেন, ‘আলীর বাবা দুর্ঘটনার পর থেকে কাজ করতে পারেন না। তাকে বাঁচাতেই প্রায় দেড় দুলাখ টাকা ঋণ হয়েছে। আলীই সংসার চালায়। বই খাতাতো দূরে থাক, কোনো দিন ওরে পেট ভইরা খাওয়াইতেও পারি নাই। এরপর কলেজের এতো খরচ দিয়া আলীর লেখাপড়া কেমনে করামু জানি না।’
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এতো কঠোর পরিশ্রমের পর আলীর জিপিএ ৫ প্রাপ্তি একটা বিস্ময়। সুযোগ পেলে ও প্রমাণ করতে পারবে নিজেকে। ওর মতো মেধাবীদের সুযোগ পাওয়া উচিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ওকে এতো বড় সংসার চালাতে হয়। সবাই এগিয়ে না এলে বড়ভাইয়ের মতো আলীকেও ভ্যান অথবা কামলা দিতে হবে। তাই আলীর উচ্চ শিক্ষায় সহায়তার হাত বাড়াতে নিজের মোবাইল ০১৭১২৪৩১৫৬৬ নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য সকলকে অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান শিক্ষক।’
মাত্র দুজনের কথা আমি লিখলাম। এরকম কতো মেধাবী ছেলেমেয়ে অবহেলায় পড়ে আছে আমাদের গ্রামগঞ্জে। তাদের খবরও আমরা রাখি না। তাদের কথা কেউ ভাবি না। রেজাল্টের পর পর খবরের কাগজে এই অসহায় মেধাবীদের কথা লেখা হয়। তারপর তাদের আর কোনো খবর আমরা রাখি না বা পাই না।
কী হয় এইসব ছাত্রছাত্রীর? তারা কি চালিয়ে যেতে পারে পড়াশুনা? তারা কি পৌঁছাতে পারে তাদের স্বপ্নের কাছাকাছি? সমাজের মানুষ কি সাহায্য সহযোগিতা করেন তাদেরকে?
এইসব দরিদ্র, অসহায় মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য সরকার কি বিশেষ কোনো উদ্যোগ নিতে পারে না? কোনো বিশেষ ব্যবস্থায় কি এইসব ছাত্রছাত্রী আর তাদের পরিবারকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে না? আমাদের এইসব লেখালেখি কতোটা মনোযোগ আকর্ষণ করে সরকারের কিংবা কতোটা গুরুত্ব দেয়া হয়, কিংবা আদৌ কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় কিনা আমি জানি না। তবু লেখালেখি ছাড়া আমাদের উপায় কী? সরকারকে আমাদের কথা জানাবার আর কোনো মাধ্যম তো নেই।
বন্ধুবান্ধব
আফজালকে প্রথম কবে দেখি! দিনটির কথা পরিষ্কার মনে আছে। তিয়াত্তর সালের শেষ দিককার কথা। অবজারভার ভবনের দোতলায় ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকার অফিস। পূর্বদেশের ছোটদের পাতার নাম ‘চাঁদের হাট’। সেই পাতা ঘিরে একটি সাহিত্যের অনুষ্ঠান। হাতে লেখা পোস্টার ফেস্টুনে ছেয়ে আছে চারদিক। আমার বয়সী বহু ছেলেমেয়ে ভিড় করে আছে দোতলার হলরুমে। হলরুমটা পুবে পশ্চিমে লম্বা। পশ্চিম দিককার দেয়াল ঘিরে স্টেজ। উঁচু স্টেজ না। মেঝেতে ফরাশ বিছানো, পেছনে দেয়ালের সঙ্গে টাঙানো হয়েছে ব্যানার। তাতে কী লেখা ছিল সে কথা আমার আর এখন মনে নেই।
মনে আছে আফজালের কথা।
তার আগে আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে চাঁদের হাটের পাতায়। গল্পের নাম ‘বন্ধু’। ডাকে পাঠিয়েছিলাম। যে সপ্তাহে পাঠিয়েছি তার পরের সপ্তাহেই ছাপা হয়ে গেছে। গল্পের ইলাসট্রেশন করেছিলেন কাজী হাসান হাবিব। পরবর্তীকালে হাবিবের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয় আমার। কিন্তু আমার নামের বানানটা ভুল করেছিল হাবিব। ই এর পরে ম এর জায়গায় হাবিব লিখেছিল ক।
তাতে কী!
গল্প ছাপা হয়েছে, এই খুশিতে আমি পাগল। অন্যান্য পত্রিকার ছোটদের পাতা দেখি বা না দেখি পূর্বদেশের ‘চাঁদের হাট’ দেখিই। এই পাতায় সাহিত্যবিষয়ক অনুষ্ঠানের সংবাদটা বেরিয়েছিল। চাঁদের হাটে যাঁরা লেখালেখি করেন সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি তখন থাকি গেণ্ডারিয়াতে। গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের একটা বাড়িতে। সেখান থেকে সদরঘাট গিয়ে বাসে চড়লাম। গুলিস্থানে নেমে হেঁটে গেলাম অবজারভার হাউসে।
কিন্তু আমাকে কেউ চেনে না।
লম্বা মতন এক ভদ্র্রলোককে ঘিরে আমার বয়সী বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে। ভদ্রলোকের মাথায় লম্বা চুল। পরনে কালো প্যান্ট আর সাদা ফুলহাতা শার্ট। মুখে পান আছে। পান চিবাতে চিবাতে তিনি ছেলেমেয়েগুলোকে নানা রকম কাজের অর্ডার দিচ্ছিলেন। তাঁর অর্ডারে বর্তে যাচ্ছিল সবাই। যেন তাঁকে খুশি করতে পারলেই হলো।
এদের মধ্যে ছোটখাটো একজন আমাকে খেয়াল করল। আমার বয়সী অথবা আমার চেয়ে বছর খানেকের ছোট হবে। আকৃতিতে ছোট কিন্তু তার গলার আওয়াজ বেশ ভারি, চালচলনে কেউকেটা ভাব। গায়ের রং শ্যামলা। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা। মাথায় অতি ঘন চুল। জিজ্ঞেস করল, তুমি কোত্থেকে আসছ?
বললাম।
নাম কী?
বললাম।
নাম বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে চিনল। ও তোমার গল্প তো চাঁদের হাটে ছাপা হয়েছে। ‘বন্ধু’ না গল্পের নাম?
হ্যাঁ।
আরে আসো আসো।
প্রথমে সে আমাকে নিয়ে গেল পান চিবানো ভদ্রলোকের কাছে। দাদুভাই, এ হচ্ছে বন্ধু।
অনুষ্ঠানের কাজে মহাব্যস্ত ভদ্রলোক। তবু আমার দিকে তাকালেন। বন্ধু মানে?
কিছুদিন আগে নতুন একটা ছেলের গল্প ছাপলেন না! গল্পের নাম ছিল…
বুঝেছি বুঝেছি।
শুধু ওটুকুই। ব্যস্তভঙ্গিতে অন্যদিকে চলে গেলেন তিনি।
ছেলেটি আমাকে বলল, ইনিই চাঁদের হাট পাতা দেখেন। বিরাট ছড়াকার। নাম রফিকুল হক। আমরা সবাই দাদুভাই ডাকি। ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচা’র পাতা চালান আরেক ছড়াকার, রোকনুজ্জামান খান। তাঁকে সবাই দাদাভাই ডাকে। তিনি দাদাভাই, আর ইনি দাদুভাই।
বলে মিষ্টি করে হাসল।
টের পেয়ে গেলাম ছেলেটির কথায়, আচরণে মজার একটা ভঙ্গি আছে। তার রসবোধ চমৎকার।
কিন্তু তখনও পর্যন্ত তার নাম আমি জানি না।
আমি জগন্নাথ কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। চেহারা সুবিধার না। গুণ্ডা গুণ্ডাভাব আছে। শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে আমার চেহারাটা ঠিক যায় না। দাদুভাই বোধহয় এজন্য আমাকে তেমন পাত্তা দিলেন না। আমার অবশ্য ওসব তখন খেয়াল করার সময় নেই। ছেলেটির আচরণ আমার ভালো লাগছে। খুবই আন্তরিকভাবে কথা বলছে। খানিক আগেই যে পরিচয় হয়েছে মনেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে আমার বহুদিনের পরিচিত। বহুদিনের পুরনো বন্ধু।
এই ছেলেটির নাম আবদুর রহমান।
আজকের বিখ্যাত আবদুর রহমান। অসাধারণ ছড়া লিখত, মুখে মুখে দুর্দান্ত সব ছড়া বানাত। কিন্তু তার কোনও বই নেই। এত ভালো লেখে, কিন্তু লেখালেখিতে আগ্রহ নেই। ওই বয়সেই চমৎকার বক্তৃতা দিত রহমান, সাংগঠনিক দক্ষতা অতুলনীয়। পরবর্তী জীবনে অনেক কিছু করেছে। মতিঝিলে নার্সারি এবং বীজের দোকান রহমানদের। ঢাকা সীড স্টোর। দৈনিক বাংলা থেকে গভর্নর হাউসে যাওয়ার রাস্তায়। সেই দোকানের জায়গায় এখন চৌদ্দতলা বিল্ডিং রহমানদের। কিন্তু নিচতলায় দোকানটা আছে। রহমানের বাবা বসেন। আমাদের খুবই প্রিয় মানুষ তিনি।
এই দোকানের পাশে ছোট্ট একটা দোকান নিল রহমান। সাতাত্তর আটাত্তর সালের কথা। তাজাফুলের দোকান দিল। ঢাকায় তখনও ফুলের দোকানের কনসেপসান আসেনি। রহমানের মাথা থেকে এলো। উৎসব আনন্দ বিয়ে এবং জন্মদিনে তাজাফুল কিনে নিয়ে উপহার দেবে লোকে। আমরা রহমানের দোকানে বসে তুমুল আড্ডা দেই। চা সিঙারা খাই। রহমান সারাদিনে যত টাকার ফুল বিক্রি করে তার চেয়ে অনেক বেশি খেয়ে ফেলি। বাকি টাকা বাবার কাছ থেকে নিয়ে আসে রহমান। বন্ধুদের জন্য ভর্তুকি দেয়।
কিন্তু কতদিন?
নির্বিকার ভঙ্গিতে রহমান একদিন দোকানে তালা ঝুলিয়ে দিল। কত টাকা লস হলো কোনও হিসাবই নেই। আমার ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’ উপন্যাসে এই দোকানের কথা আছে।
তারপর রহমান হয়ে গেল চিত্রসাংবাদিক, চলচ্চিত্র সাংবাদিক। অবজারভার হাউসের বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘চিত্রালী’। রহমান কন্ট্রিবিউটর হিসেবে ‘চিত্রালী’তে ববিতা শাবানা এইসব বিখ্যাত নায়িকাদের নিয়ে লেখে। ববিতার বোন চম্পার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব। চম্পা তখনও নায়িকা হয়নি। রোজিনা নামে একজন নায়িকা এসেছে তখন, রহমানের সঙ্গে তাঁরও বন্ধুত্ব। আমরা তখন যাদের কাছে পৌঁছাবার কথা ভাবতেই পারি না, রহমান কেমন কেমন করে তাদের কাছে পৌঁছে যায়, বন্ধুত্ব করে ফেলে। বিরাট বিরাট নায়িকাদের তুই-তোকারি করে। ঘরের মানুষের মতো কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলে। আমরা জুল জুল করে রহমানের দিকে তাকিয়ে থাকি।
এই সেই রহমান!
এই সেই ছেলেটি, চাঁদের হাটের অনুষ্ঠানে যার সঙ্গে আমার পরিচয়। পরিচয়ের কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধুত্ব।
ভাবতে ভালো লাগছে, আমার প্রথম গল্পের নাম ‘বন্ধু’। সেই গল্পের সুবাদে চাঁদের হাটে গিয়ে আমি পেয়ে গেলাম আমার পরবর্তী পুরো জীবনের প্রিয় সব বন্ধুকে। প্রথম বন্ধু রহমান। রহমানের কল্যাণে অন্যরা।
রহমানের অন্যান্য কীর্তির কথা পরে বলি। আগে সেই প্রথম দিনটির কথা বলি। আফজালের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বলি।
দাদুভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের পর রহমান আমাকে নিয়ে গেল গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেয়া কয়েকজন ছেলেমেয়ের সামনে। এই, এই যে দেখ। এ হচ্ছে বন্ধু।
মানে আমার গল্পের নাম দিয়েই রহমান আমাকে পরিচয় করাচ্ছে।
সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে চিনল অনেকে। একটি ছেলে কোমরে হাত দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু জোরে জোরে কথা বলার স্বভাব। রহমান পরিচয় করিয়ে দিল, ওর নাম গোলাম মাওলা শাহজাদা। ছড়া কবিতা গল্প সব লেখে। আমার গল্পটা সে পড়েছে। হৈ হৈ করে সেকথা বলল।
প্রিয় পাঠক, এই গোলাম মাওলা শাহজাদা কে জানেন? আজকের বাংলাদেশের, বাংলাভাষার বিখ্যাত কবি হাসান হাফিজ। বাংলা কবিতায় নিজের দক্ষতা পুরোপুরি প্রমাণ করেছেন তিনি। শিশুসাহিত্যে তাঁর অবদান যথেষ্ট। কৃতী সাংবাদিক হিসেবে তিনি শ্রদ্ধেয়। খেলাধুলায় আগ্রহী, পরিবেশ নিয়ে কাজ করেছেন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে। বহু কাব্যগ্রন্থ এবং শিশুতোষগ্রন্থের পাশাপাশি ম্যারাডোনাকে নিয়ে বই লিখেছেন, পরিবেশ নিয়ে বেশ স্বাস্থ্যবান বই সম্পাদনা করেছেন। যেসব বন্ধুর পরিচয় দিতে আমি গৌরববোধ করি, শাহজাদা মানে হাসান হাফিজ তাদের একজন। সে নারায়ণগঞ্জের ছেলে। একবার মুন্সিগঞ্জের এক সাহিত্য সম্মেলনে গেছি তার সঙ্গে। উদ্যোক্তাদের একজনের বাড়িতে আমাদের দুজনকে রাতে থাকতে দেয়া হয়েছে। খেয়ে-দেয়ে শুয়েছি আমরা, শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বোধহয় তিরিশ সেকেন্ডও লাগেনি, ঘুমিয়ে গেল শাহজাদা। তাও হালকা পাতলা ঘুম না। গভীর ঘুম। মৃদু নাকও ডাকাচ্ছে।
আমি অবাক।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে এইভাবে ঘুমিয়ে পড়তে পারে মানুষ!
আমি পাতলা ঘুমের মানুষ। ছেলেবেলা থেকেই, বিছানায় শোয়ার অনেক পরে আমার ঘুম আসে। নতুন জায়গা হলে ঘুম সহজে আসতেই চায় না। একা রুমে থাকতে পারি না। আমার একটু ভূতের ভয়ও আছে। একা রুমে থাকলেই মনে হয়, ওই তো, কে একজন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একটু যেন বেশিই লম্বা। মাথাটা ছাদের সিলিংয়ে গিয়ে ঠেকেছে না! কখনও মনে হয় নিঃশব্দ পায়ে কে যেন হাঁটছে রুমে। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো, ‘প্রেম এসেছিল নিঃশব্দ চরণে’। আমার মনে হয় ভূত এসেছে নিঃশব্দ চরণে।
পায়ের পাতা দুটো লেপ কম্বল কিংবা চাদরের বাইরে রেখে শোয়ার অভ্যাস আমার। কখনও কখনও মনে হয় পায়ের তলায় কে যেন সুড়সুড়ি দিচ্ছে।
এইসব কারণে বিদেশে গেলে বেশ একটা ফাপরে পড়ি। হোটেলের রুমে ফকফকা লাইট জ্বালিয়ে রাখি। বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে থাকলেও একই কাজ। তারপরও ঘুম পুরোপুরি হয় না। রাত কাটে আধো ঘুমে আধো জাগরণে।
অথচ শোয়ার তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে গভীর ঘুমে ডুবে যায় শাহজাদা!
আফজালের স্বভাবও এই রকম। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে তো বটেই, যখন চাইবে তখনই ঘুমাতে পারবে সে। আবার তিন চার রাত একনাগাড়ে জেগেও থাকতে পারবে। মুখ দেখে বোঝা যাবে না তিন চার রাত ঘুমায়নি সে।
এ এক ঐশ্বরিক ক্ষমতা।
শাহজাদার পাশে সেদিন দাঁড়িয়ে ছিল তেল চকচকে এক যুবক। উত্তম কুমার টাইপের ব্যাক ব্রাশ করা চুল। শ্যামলা রঙের মুখে আমার মতোই মোচ রেখেছে। পরনে কালো প্যান্ট আর নীল রঙের শার্ট। ফুলি ভ শার্টের হাতা তখন অনেকেই গুটিয়ে রাখে। সে রাখেনি। কব্জির বোতাম লাগানো। পায়ে স্যান্ডেল। অর্থাৎ নিপাট ভদ্রলোক।
রহমান পরিচয় করিয়ে দিল। আলীমুজ্জামান হারু।
আমরা খুব কাছের বন্ধু যারা তারা ছাড়া হারুকে কেউ আর এখন হারু ডাকে না। জুনিয়ররা ডাকে জামানভাই, কলিগরা ডাকে আলীমুজ্জামান সাহেব। হারু সাংবাদিকতা করে। যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে আছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বাংলায় মাস্টার্স করেছে। দিদার, স্বপন, হারু ওরা একই ব্যাচের।
সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে দিদার ছিল না। দিদারের সঙ্গে আমার পরিচয় আরও পরে। দিদারের পুরো নাম দিদারুল আলম। এখন শিক্ষাভবনের ঊর্ধ্বতন একজন। খুবই প্রিয়বন্ধু আমার। দিদারের সঙ্গে অনেক ঘটনা, অনেক মধুর স্মৃতি। সেইসব স্মৃতির কথা অবশ্যই এই লেখায় লিখব। পর্যায়ক্রমে লিখব। আগে সেই প্রথম দিনটির কথা বলি।
ফরিদুর রেজা সাগরের মা যে বাংলাভাষার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক রাবেয়া খাতুন এই তথ্য আমি জেনেছি সাগরের সঙ্গে পরিচয়ের অনেক পরে। সাগরের বাবা ফজলুল হক সাহেব প্রথম চলচ্চিত্রবিষয়ক পত্রিকা বের করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। সমগ্র পাকিস্তানের প্রথম ছোটদের চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ তৈরি করেছিলেন, যে ছবির নায়ক কিশোর ফরিদুর রেজা সাগর।
সাগর যে দেখতে কী সুন্দর ছিল!
টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ। গোলগাল মিষ্টিমুখ। একটু মোটা ধাঁচের শরীর। তখনও সাদা পাঞ্জাবি পাজামা ধরেনি সাগর। সুন্দর হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট পরা। পায়ে স্যান্ডেল সু। চেহারায় আশ্চর্য রকমের বনেদিআনা। নিচুগলায় সুন্দর করে কথা বলে। লেখে খুব ভালো। চাঁদের হাটের পাতায় সাগরের লেখা আমি পড়েছি। ছোটদের উপযোগী একটা মুক্তিযুদ্ধের গল্পের কথা আমার এখনও মনে আছে। সাগরের হয়তো নিজেরও মনে নেই সেই গল্পের কথা। কোনও বইতেও দেয়নি। কোথায় হারিয়ে গেছে সাগর জানেও না। ছোট্ট একটা রাখাল ছেলে গ্রামের বিলবাওড়ে গরু চড়ায়। দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে সে খবর রাখে না। একদিন নির্জন বিলে চার মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে তার দেখা। মুক্তিযোদ্ধাদের কাঁধে রাইফেল, মাথায় চুল লম্বা, চোখ লাল। বালক বিস্ময়ভরা চোখে তাঁদেরকে দেখে। গভীর কৌতূহল নিয়ে জানতে চায় তাঁরা কারা। এই বালকের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। অতিসরল ভাষায় কেন তাঁরা যুদ্ধ করছেন, কেন তারা এই দেশটিকে স্বাধীন করতে চান সেই বালককে তা বোঝান। সব শুনে বুঝে সেই বালকের ভেতর তৈরি হয় গভীর দেশাত্মবোধ। সেও তৈরি হয় শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য। তার ছোট্ট শরীর এবং হাতের লাঠিটি নিয়ে তৈরি হয়।
তখন এতটা বুঝিনি।
এখন ভাবলে মনে হয়, কী দুর্দান্ত আইডিয়ার গল্প। হয়তো কাঁচা হাতে লিখেছিল সাগর। কিন্তু আইডিয়াটা অসাধারণ। ওই বয়সে এরকম একটা গল্পের আইডিয়া যার মাথায় আসে সে যে বড় ক্রিয়েটার তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
সাগরের পরবর্তী জীবনের দিকে তাকালে তার বহু ক্রিয়েটিভিটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। যেমন ‘খাবার দাবার পিঠাঘর’। যেমন ‘চ্যানেল আই’। সাগর যেখানে হাত দিয়েছে, অতিযতেœ সেখানে সোনা ফলিয়েছে। এমন কি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের চেহারাটাও সে বদলে দিয়েছে। আর শিশুসাহিত্যে সাগর যোগ করেছে এক দুর্দান্ত চরিত্র ‘ছোটকাকু’।
একজন মানুষ কোন মন্ত্রবলে, মাত্র দুটো হাত নিয়ে এত কাজ করতে পারে ঠিক বুঝতে পারি না। সাগরকে দেখে আমি বিস্মিত হই, আফজালকে দেখে আমি বিস্মিত হই। এদের দুজনের কাউকেই আমার একজন মানুষ মনে হয় না। মনে হয় ফরিদুর রেজা সাগর নামে আট-দশজন অতি মেধাবী মানুষ কাজ করছে, আফজাল হোসেন নামে আট-দশজন অতি মেধাবী মানুষ কাজ করছে। কোথায় সেদিনকার সেই সাগর, আর কোথায় আজকের সাগর। মেধা এবং শ্রম একজন মানুষকে কোথায় নিয়ে আসতে পারে সাগর এবং আফজাল তার প্রমাণ।
প্রথম দিনই সাগরকে আমার খুব ভালো লেগেছিল।
রহমান পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর সাগর তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে দুয়েকটা কথা বলেছিল। সে তো বরাবরই কথা বলে কম। অতি মেধাবী কাজের মানুষরা কথায় বিশ্বাসী নন, বিশ্বাসী কাজে। শুরু থেকেই সাগরের মধ্যে এই ব্যাপারটা ছিল।
সাগরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল শাহানা বেগম। নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছে। গল্প লেখে। স্মার্ট সুন্দর মেয়ে। পরবর্তীকালে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাবলিক এডমিনিসট্রেশনে, নাকি কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স করল। বিখ্যাত সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর সঙ্গে বিয়ে হলো। আমাদের খুবই প্রিয়বন্ধু।
শাহানা এখন কানাডায়। কিছুদিন আগে দেশে এসেছিল মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে। আমার সঙ্গে দেখা হয়নি।
এই লেখা লিখতে বসে কত প্রিয়বন্ধুর কথা যে মনে পড়ছে।
সাগরকে ঘিরেই সেদিন মেয়েদের ভিড়।
লিজি নামে ছবির মতো সুন্দর এক মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাগর আর শাহানার মাঝখানে। একটু ডাকাবুকো টাইপের একটা মেয়ে প্রায় ভিড় ঠেলে ঢুকে গেল। কী কথায় খিলখিল করে হাসতে লাগল।
রহমান বলল, ওর নাম শুশুমণি। কাদের সিদ্দিকীর ছোটবোন।
শুনেই আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কাদের সিদ্দিকীর বোন!
কাদের সিদ্দিকী তখন আমাদের হিরো। বিশাল মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অতুলনীয়। তাঁর কাদেরীয়া বাহিনী পাকিস্তান আর্মির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন বহুবার তাঁর নাম এবং কৃতিত্বের কথা প্রচারিত হতো। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক কিংবদন্তির নাম কাদের সিদ্দিকী। তাঁকে প্রথম দেখেছি আমাদের জগন্নাথ কলেজে। কলেজের কোনও একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা, লম্বা ি ম একজন বাঙালি। মুখভর্তি দাড়ি। কলেজের মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলছিলেন তিনি। হাজার হাজার ছাত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি তাঁকে দেখছিলাম। সেদিনের পর, বেশ অনেক বছর পর তাঁর দুখণ্ডে লেখা বই ‘স্বাধীনতা ’৭১’ হাতে এলো। কলকাতার ‘দে’জ’ প্রকাশন সংস্থা বের করেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়লাম সেই বই। দুয়েকটি অনুষ্ঠানে এই মহান বীরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। এত সুন্দর করে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেন। ভাবতে ভালো লাগে, গৌরববোধ করি। কাদের সিদ্দিকীর ছোটবোন আমার বন্ধু।
সেই বন্ধুকে প্রথম চিনিয়েছিল রহমান।
কাদের সিদ্দিকীর ছোটবোন শুনে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সরাসরি তাকানো যাবে তো এই মেয়ের দিকে? রেগে যাবে না তো? ভাইয়ের কাছে গিয়ে বিচার দেবে না তো?
শুশুর দিকে আমি খুবই সমীহের চোখে তাকিয়েছিলাম।
চাঁদের হাটের দিনগুলোতে শুশুর সঙ্গে আমার তেমন দেখা হয়নি। দু চার বার যাও দেখা হয়েছে তেমন কথাবার্তা হয়নি। দেখেছি শুশু তুমুল আড্ডা দেয় বন্ধুদের সঙ্গে। হৈ হল্লা হাসি আনন্দে মেতে থাকা অতি প্রাণবন্ত মেয়ে। খুবই ঠাট্টাপ্রিয়, শুশুর রসবোধ তীব্র।
শুশুর সঙ্গে বহু বহু বছর পর দেখা হলো চ্যানেল আইতে, সাগরের রুমে। শুশুর চেহারা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। সাগর বলল, দেখো তো চেন কি না!
চিনতে পারিনি।
সেই কিশোর বয়সের মতো শুশু আমার বাহুর কাছে একটা ধাক্কা দিল। বড় লেখক হয়ে গেছ! বন্ধুদের চিনতে পারো না। আমি শুশু।
শুশুর এই আচরণে আমি মুহূর্তে ফিরে গেলাম তিয়াত্তর সালের সেই দিনে।
আহা রে! কত কতগুলো দিন চলে গেছে আমাদের জীবন থেকে। সেই দিনকার বন্ধুদের মুখ দেখলে দিনগুলো ফিরে পাই।
শুশুকে পেয়ে সাগর খুব উচ্ছ্বসিত। তৃতীয় মাত্রার জিল্লুরকে বলল, শুশু আর মিলনকে তৃতীয় মাত্রায় আনো। ওরা বন্ধুত্ব ইত্যাদি নিয়ে কথা বলবে, দুজনেই প্রবাসে জীবন কাটিয়েছে, প্রবাস জীবন নিয়ে কথা বলবে।
মিডিলইস্টের অনেক দেশ ঘুরে শুশু এখন কানাডায় সেটেলড। আর আমি বহু বছর আগে দুবছর জার্মানিতে ছিলাম।
আমরা দুই বন্ধু তারপর তৃতীয় মাত্রায় হাজির হলাম। শুশু কথা বলতে শুরু করল। শুশুর কথাবার্তা শুনে আমি মুগ্ধ। কী সুন্দর উচ্চারণ, কী সুন্দর বাচনভঙ্গি, কী সুন্দর যুক্তি দিয়ে কথা বলে।
আমি শুশুর কাছে ম্লান হয়ে গেলাম।
আরে শুশু এত সুন্দর করে কথা বলতে শিখল কবে? কোথাও কোনও জড়তা নেই, কোনও দ্বিধা নেই। যা বিশ্বাস করে তাই স্পষ্ট উচ্চারণে বলে!
সাগর বলল, মিডিলইস্টে থাকার সময় শুশু নিয়মিত রেডিও প্রোগ্রাম করত।
শুনে এত ভালো লাগল। তার মানে আমার বন্ধুরা যে যেখানে আছে সেটুকু জায়গা আলোকিত করেই আছে!
শুশু তিয়াত্তর সালের সেই দিনটির কথা কি তোমার মনে আছে? আমার একদম পরিষ্কার মনে আছে। ওই একটি দিনেই জীবনের অনেক বন্ধুকে আমি একত্রে পেয়েছিলাম। আমার জীবনের সবচাইতে বড় অর্জনের দিন সেটি।
‘তৃতীয় মাত্রা’ নিয়ে আর একটা মজার স্মৃতি আছে। রবীন্দ্র জন্মদিবস। সাগর প্ল্যান করল আমরা তিন বন্ধু মিলে অনুষ্ঠান করব। সাগর উপস্থাপক, আমি আর আফজাল আলোচক। যথাসময়ে সেটে হাজির আমরা। সাগর মাঝখানে আমি আর আফজাল দুইপাশে। সাগর শুরু করল মজাদার এক চমক দিয়ে। ‘আমরা তিন বন্ধু আজ একত্রিত হয়েছি আমাদের আরেকজন বন্ধু সম্পর্কে কথা বলার জন্য। প্রিয়দর্শক, আমাদের সেই বন্ধুর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’।
আমি আর আফজাল চমকিত।
আবার ফিরি উনিশশ’ তিয়াত্তরের সেই দিনে।
অনুষ্ঠান শুরুর সময় ঘনিয়ে আসছে। কখন কোন ফাঁকে ভরে গেছে হল। এই ভিড়ের একপাশে দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর পোস্টার পেপার ফেলে খুবই মনোযোগ দিয়ে কী কী লিখছে এক যুবক। লম্বা টিং টিংয়ে। খয়েরি রংয়ের প্যান্টের ওপর গেরুয়া খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা। দেখে মনে হচ্ছে একটি বাঁশের গায়ে প্যান্ট পাঞ্জাবি পরানো হয়েছে। যুবকের মাথার চুল ঘাড় ছাড়িয়ে নেমেছে। গায়ের রং মাজা মাজা। মুখের প্যাটার্ন রেডইন্ডিয়ানদের মতো। চোখ দুটো বড় বড়। চোখে এক ধরনের নিরীহ এবং কৌতূহলী দৃষ্টি।
রহমান আমাকে সেই যুবকের কাছে নিয়ে গেল। পরিচয় করিয়ে দিল। আজকের বিখ্যাত আফজাল হোসেনের সঙ্গে এই আমার পরিচয়। সাতক্ষীরার ছেলে। আমার দুবছরের সিনিয়র। আর্ট কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। তখন কে জানত এই নরম নিরীহ যুবকটি শিল্পের যে শাখায় হাত দেবে সেখানেই সোনা ফলবে! তার একার আলোয় অনেকখানি আলোকিত হবে আমাদের সময়।
চাঁদের হাটের সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে তখনকার পাঁচজন বিখ্যাত তরুণ লেখককে দেখলাম। আলী ইমাম, সালেহ আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, মুনা মালতি এবং ফিউরি খোন্দকার। সালেহ আহমেদ শুধুই ছোটদের লেখা লেখেন। চাঁদের হাট, কচিকাঁচার মেলা, সাতভাই চম্পা, এসব পাতায় তো তাঁর লেখাই বেরোয়ই, এখলাসউদ্দিন আহমেদ সম্পাদিত ‘টাপুর টুপুর’ পত্রিকাতেও বেরোয়। রহমানকে দেখলাম লেখক হিসেবে খুবই সমীহ করে তাঁকে।
সালেহ আহমেদ বক্তৃতা করলেন। সাহিত্য নিয়ে ভালো ভালো কথা বললেন। তারপর বক্তৃতা দিল সিরাজুল ইসলাম। সিরাজ তখন বড়দের গল্পও লেখে। দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব সিরাজের লেখা খুবই পছন্দ করেন। সিরাজ তখন বুয়েটের ছাত্র। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। পুরনো ঢাকার বেগমগঞ্জের ছেলে। আমাদের গেণ্ডারিয়ার কাছে বেগমগঞ্জ। গেণ্ডারিয়া এবং বেগমগঞ্জের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে ধোলাইখাল। সিরাজ ছোটখাটো মানুষ, রহমান আকৃতির। অতি রোগা। পরনে ঢলঢলে শার্টপ্যান্ট, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখে মোটা কাচের চশমা। কথা খুবই কম বলে, হাসে বেশি। ঘন ঘন সিগ্রেট খায়।
সিরাজের সঙ্গে পরে গভীর বন্ধুত্ব হয় আমার।
জীবনের অনেকগুলো বছর প্রতিটা দিন আমার সিরাজের সঙ্গে কেটেছে। চাঁদের হাটের বাইরে আমাদের পাঁচ বন্ধুর একটা দল হয়েছিল। কাজী হাসান হাবিব, সিরাজুল ইসলাম, মুহম্মদ জুবায়ের, ফিরোজ সারোয়ার এবং আমি। কী যে উন্মাদনার দিন আমাদের তখন। প্রতিদিনই পাঁচজন একসঙ্গে হচ্ছি। তুমুল আড্ডা, হৈ চৈ। একত্রে রাত্রিযাপন। আমাদের মধ্যে তখন শুধুমাত্র হাবিবই বিবাহিত।
তেরো বছর আগে হাবিব আমাদের দলটা ভেঙে দিল।
চার বন্ধুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল হাবিব। সিরাজ আমি জুবায়ের সারোয়ার চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছিলাম হাবিবকে। হাবিব কোনও কিছুই তোয়াক্কা করল না, চারজনের মাঝখান থেকে উধাও হয়ে গেল। হাবিবকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল ক্যান্সার।
হাবিবের কথা ভাবলেই ছেলেবেলার একটা খেলার কথা মনে পড়ে আমার। পাঁচজনের খেলা। হাতে হাত ধরে চারজন ঘেরাও করে রাখবে একজনকে। চারজনেরই চোখ বন্ধ থাকবে। মাঝখানের খেলোয়াড় এই চারজনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাবে। এমন ভাবে বেরুবে, কারও গায়ে ছোঁয়া লাগতে পারবে না। কেউ টের পাবে না কোনদিক দিয়ে বেরিয়েছে। তারপর সে প্রশ্ন করবে, বলো তো আমি কোনদিক দিয়ে বেরিয়েছি? যার উত্তর সঠিক হবে সে জিতবে খেলায়।
হাবিব ছিল আমাদের চারজনের মাঝখানকার সেই খেলোয়াড়।
হাবিব বেঁচে থাকতেই জুবায়ের চলে গিয়েছিল আমেরিকায়। স্ত্রী শাহিন, দুই সন্তান ডোরা এবং অর্নবকে নিয়ে তার সংসার। ডালাসের এলেন এলাকায় সুন্দর বাড়ি জুবায়েরের। বছর পাঁচেক আগে জুবায়েরের কাছে গিয়ে আমি দশদিন ছিলাম। কী যে আনন্দের দিন সেসব, কী যে ভালোবাসার দিন।
জুবায়েরের ছেলে অর্নব তখন বেশ ছোট। তার একমাত্র নেশা ডাইনোসর। যত রকমের পুতুল ডাইনোসর পাওয়া যায় সব তার আছে। অর্নবের এইম ইন লাইফ হচ্ছে, বড় হয়ে সে ডাইনোসর হবে।
ফিউরি খোন্দকার তখন দুহাতে লেখে। ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। যেমন ছোটদের গল্প, তেমন বড়দের গল্প। সাহিত্য মহলে ফিউরি তখন বেশ পরিচিত। সিরাজের সঙ্গে তার স্বভাবের খুব মিল। সেও কথা বলে কম, হাসে বেশি। ফিউরির হাসি একটু লাজুক টাইপের, মিষ্টি। কথা বলতে গিয়ে সামান্য তোতলায়।
এইসব লেখককে দাদুভাই সেদিন হাজির করেছিলেন আমাদের মতো যারা লেখালেখিতে আগ্রহী তাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য। সাহিত্য নিয়ে তাঁদের চিন্তা ভাবনা, তাঁদের পড়াশোনা কিংবা কীভাবে লেখালেখি করেন তাঁরা, তাঁদের মুখ থেকে এসব শোনাবার জন্য।
পাঁচজনের একজন মুনা মালতি। অসাধারণ সুন্দরী। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্সে পড়ে। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। ছোটদের লেখায় চমৎকার হাত। রেডিও টেলিভিশনে প্রোগ্রাম করে। এত সুন্দর করে কথা বলল! মুনা কথা বলবার সময় কোথাও কোনও শব্দ ছিল না। পিন পড়লে শব্দ হবে না, এমন নিঃশব্দ।
মুনার সঙ্গে সেদিনই রহমান আমার পরিচয় করিয়ে দিল। কিন্তু মুনা আমাকে তেমন পাত্তা দিল না। পাত্তা দেয়ার কোনও কারণও নেই। আমি তখন কে? অবশ্য সুন্দরী মেয়েদের একটা ভাবও থাকে। পরিচয়ের মুহূর্তে অনেকের দিকেই তারা এমন করে তাকায়, যেন খুবই দয়া করে তাকাচ্ছে।
মুনার সেদিনকার তাকানো অনেকটাই ওরকম।
ডালাসে গিয়েছি ফোবানা সম্মেলনে। ওই যে জুবায়েরের ওখানে যেবার দশদিন থাকলাম, সেবারের কথা। মুনা মালতির সঙ্গে দেখা হলো। সে আমেরিকাতেই থাকে। কোন স্টেটে থাকে মনে করতে পারছি না। আমেরিকার কোনো এক ইউনিভার্সিটির টিচার মুনা। মাইক্রোটেল ইন নামে এক হোটেলে উঠেছে। আমিও সেই হোটেলেই উঠেছি। পরে জুবায়ের আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। ওই হোটেল লাউঞ্জে বসে এক দুপুরে মুনার সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম। প্রথম দিন মুনাকে দেখার স্মৃতিচারণ করলাম। মুনা যে আমার দিকে তাকায়নি বা পাত্তা দেয়নি, শুনে মুনা এত হাসলো!
বন্ধুদের মিষ্টি হাসির রেশ সবসময় আমার কানে লেগে থাকে। মুনার হাসির রেশও লেগে আছে।
যে মানুষটি আমাকে সেদিন সবচাইতে বেশি মুগ্ধ করেছিল তাঁর নাম আলী ইমাম। এত সুন্দর বক্তৃতা সেদিন দিলেন আলী ইমাম। শুধু আমাকে কেন, সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেললেন। আলী ইমাম লেখেন ভালো, তখন থেকেই ছোটদের খুবই প্রিয় লেখক তিনি। লেখা পড়ে আমিও তাঁর ভক্ত। সেদিন কথা শুনেও ভক্ত হয়ে গেলাম। যে মানুষ এত সুন্দর লেখেন সেই মানুষ এত সুন্দর কথাও বলেন!
বক্তৃতা শেষ করে বসতে পারেন না আলী ইমাম, ছেলেমেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়ল অটোগ্রাফের জন্য।
সেই প্রথম একজন লেখককে অটোগ্রাফ দিতে দেখলাম আমি।
আলী ইমামের ডাকনাম হেলাল। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আমার হেলাল ভাই হয়ে গেলেন। এখনও আমি তাঁকে হেলাল ভাই বলেই ডাকি।
ঠাঁটারি বাজারে হেলাল ভাইদের বাড়ি। অন্য একটি দিক দিয়েও তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। আমার বাবা চাকরি করতেন ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে। বাবা মারা গেছেন একাত্তর সালে। বাবাকে খুবই ভালো চিনতেন হেলাল ভাইয়ের বাবা। কারণ তিনিও মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকরি করেন। বাবার জায়গায় চাকরি হয়েছে আমার বড়ভাইয়ের। হেলাল ভাইয়ের বাবা আমার বড়ভাইকেও চেনেন।
আমার সঙ্গেও একদিন পরিচয় হয়ে গেল।
শেকড়ের টান মীর সাব্বির
আমি এ লেখাটা যখন লিখতে শুরু করি তখন একটা নাটকে অন্ধের চরিত্রে অভিনয় করছিলাম। জীবনে প্রথম এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করছি। অন্ধ মানুষ কেমন হয় আমি জানি না। তারা কীভাবে কথা বলে, কীভাবে অনুভূতিগুলো শেয়ার করে কোনো ধারণাই আমার ছিল না। কিন্তু দীর্ঘসময় চোখ বন্ধ করে শুধু ফিল করার চেষ্টা করেছি। আমি দেখলাম সবকিছুই কেমন অন্ধকার আর সেই অন্ধকারের মাঝেই কেমন অদ্ভুত চিকচিক করছে আলো। আমি চোখ খুলে ফেলি। পাঁচ মিনিট অন্ধকার সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। মনে মনে ভাবলাম, অন্ধকার আসলে কী? অন্ধকারেই কী আলো থাকে? বিশ্বাস থেকে একটা জায়গায় নিজেকে স্থির করলাম সেটা হলো ‘চেনা পৃথিবীতে অচেনা মানুষ আমি’।
যখন আমার চোখ বন্ধ হয় সব অচেনা লাগে যখন আমার চোখ খুলে যায় সব চেনা মানুষদের ভিড়। হঠাৎ ভাবলাম তাহলে মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায়? যারা নেই পৃথিবীতে তাদের সাথে যদি ৫ মিনিট কথা বলতে পারতাম? আচ্ছা এমন কী হয় না যদি সৃষ্টিকর্তা মৃত্যুর ১ দিন পর ৫ মিনিট অথবা ১০ মিনিট সময় দিতেন তাহলে কত মজা হতো? সব মানুষগুলোকে কত রকমভাবে দেখা যেত। মৃত্যুর পর কে খুশি হলো কিংবা কে কষ্ট পেল অথবা মৃত্যুর কারণে কারো কিছু কী আসল? কী গেল? জানি না। কত কিছু দেখা যেত? চেনা পৃথিবীতে আবার কিছু অচেনা মানুষকে সুন্দরভাবে দেখা যেত তাই না?
আচ্ছা এই প্রশ্ন যে করছি আমি, কাকে করছি? সত্যিই কাকে করলাম? নিজেই নিজের প্রশ্নকর্তা আবার নিজেই উত্তরদাতা। মনে হচ্ছে আমি কোনো এক স্কুলের শিক্ষানবিশ শিক্ষক। শিক্ষকের কথাই যখন এলো তাহলে একটা ঘটনা বলি- আমি যে স্কুলে ছোটবেলায় পড়াশোনা করেছি হঠাৎ করেই সেই স্কুলে বেড়াতে গেলাম। বরগুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা রাজিয়া আপা তিনি আমাকে দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে গেলেন। আমরা ছোটবেলায় দেখতাম বিভাগীয় কমিশনার কিংবা ডিসি সাহেব শিক্ষকদের নিয়ে যেভাবে রুমে রুমে ঘুরতেন, প্রশ্ন করতেন ঠিক সেভাবে রাজিয়া আপা আমাকে নিয়ে প্রতিটি ক্লাসে ঘুরলেন কিন্তু রাজিয়া আপাকে কেউ মানছে না। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। সব ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা এক হয়ে হলরুমে গেল, কারণ বিভাগীয় কমিশনারদের মতো ঘোরার কোনো উপায় আমার নেই। কী আর করা। রাজিয়া আপা আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে আর আমি মনে মনে ভাবছি আপা কত যে কাঠের স্কেলের মার আমাকে দিয়েছেন বৃত্তি পরীক্ষার আগে। আপার প্রতিটি স্কেলের মার এক একটা আশীর্বাদ হয়ে ধরা দিয়েছিল যখন ক্লাস ফাইভে আমি বৃত্তি পেলাম। সব কৃতিত্ব রাজিয়া আপার। এখন আমি সেই আপার পাশে দাঁড়িয়ে। আমার চেনা সেই স্কুলের হলরুমের ভেতর কয়েকশ ছাত্রছাত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি কত কিছু ভাবনার ভেতর চলে গেলাম। আমার কানে ভাসছে বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি, শোরগোলের শব্দ আর মনে ভাসছে এই স্কুলে আসার প্রথমদিনের রাস্তার কথা। স্কুলের সামনে সেই দোকানটার কথা যেখানে আটআনা দিয়ে চৌকা বিস্কুট খেতাম, স্কুলের পেছনে ছোট রাস্তার কথা, যেখান থেকে অনেকদিন স্কুল ফাঁকি দিয়েছিলাম। সেই জায়গাগুলো নেই ঠিক সেইমতো কিন্তু স্মৃতিগুলো সবই আছে। স্মৃতি ভেঙে গেল একজনের প্রশ্নে আচ্ছা আপনি অভিনয়ে ঢুকলেন কীভাবে? আমি বললাম লঞ্চে করে সোজা ঢাকা গেলাম তারপর স্কুটারে করে গেলাম বিটিভিতে। তারপর কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়। কত মানুষের ভিড়, কত পরিচালক, প্রযোজক, নায়ক, নায়িকা। আস্তে আস্তে এরাই সবাই আমার কেমন যেন আপন হয়ে গেল। কিন্তু স্কুলের সেই মানুষগুলো, রাস্তাঘাটগুলো, সবাই কেমন যেন অচেনা হয়ে গেল। জীবন কী এরকমই? একদল মানুষ হারিয়ে যায় আর আরেকদল মানুষ আপন হয়। কিন্তু সবকিছু কী হারিয়ে যায়?
প্রথম যেদিন প্লেনে উঠলাম সেদিনও মনে হলো আমার বোধহয় শেষ। একবার যদি পাখায় আগুন লাগে তাহলে কী হবে? আমার আব্বা, আম্মু, ভাইবোন কারও সাথে কোনো কথা হলো না। কিন্তু ভাগ্য ভালো কিছুই হয়নি।
প্লেনে বসে যখন জানালা দিয়ে তাকালাম দেখি সাদা মেঘের ভেলা। কী অদ্ভুত কী সুন্দর সে দৃশ্য। মনে হতে লাগল একটু লাফ দিয়ে জায়গাটা যদি দেখে আসতে পারতাম? কিন্তু পারলাম না। মনে মনে ভাবি পাখি হলেই বোধহয় ভালো হতো। উড়ে উড়ে ভেসে যেতাম মেঘের দেশে। একটু সময় থেকে আবার চলে আসতাম নিজের বাড়িতে।
আমার শৈশব-কৈশোর সব কেটেছে বরগুনাতে। আমি প্রায়ই সেখানে যাই। খুব বেশি ঘোরাঘুরি করি না। কিছু বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেই আর বিকেল হলে নদীর পাড়ে ঘুরতে যাই। আমার ভীষণ ভালো লাগে। ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে আমার বউকে নিয়ে দু’বার গিয়েছি বিয়ের পর। আর বউ ছাড়া তিনবার। আমাকে আমার বউ জিজ্ঞেস করে আচ্ছা এই যে বরগুনাতে যাও বাবা, মা, ভাইবোন কেউ থাকে না। একা গিয়ে কী মজা পাও? আমি মুচকি হাসি দিয়ে চলে যাই, উত্তর দেই না। মনে মনে বলি ‘শেকড় বড় মারাত্মক’। এর টানে সব ভুলে যাই। আমি শিকড়ের টানে বরগুনাতে যাই। আমার বাচ্চা হবার পর এখনো ওকে নিয়ে যেতে পারিনি। আমি না যেতে পারলেও আমার বাচ্চা একদিন ঠিকই যাবে। কারণ শেকড় বড় বিস্ময়কর মায়া। আমি ঘ্রাণ নেই আমার হেঁটে যাওয়া সব রাস্তার ঘাসের উপর আমি মজা করে দেখি আমার প্রিয় সব জায়গাগুলো। বাতাসের কি অদ্ভুত চেনা ঘ্রাণ আমি পাই। সে ঘ্রাণ অনেক দামি ফরাসি পারফিউম-এ আমি পাই না। আমার বউকে এ কথাটি কে বোঝাবে বলুন? শুধু একটি কথা বলেছি- তোমার গ্রামে যখন যাও কেমন লাগে? একটু চোরা দৃষ্টি দিয়ে বলে ভালোই। আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে যাই।
একবার শমী কায়সার বরগুনাতে বেড়াতে গেলেন। খেলাঘর আসরের সম্মেলন উপলক্ষে। সম্ভবত ৮৯/৯০-এর দিকে। ‘যত দূরে যাই’ খ্যাত শমী কায়সার বরগুনাতে আসবেন, এক ধরনের উৎসব আমেজ। উনি লঞ্চে করে আসছেন। আমরা বিকেল ৩টা থেকে অপেক্ষা করছি শমী কায়সারকে দেখব বলে। দীর্ঘ লাইন হলো। পান্না কায়সার এবং শমী কায়সারকে ফুল ছেটানোর জন্য। আমি অনেক গাঁদা ফুলের পাপড়ি হাতের মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। যাই হোক তারা পৌঁছানোর পর শমী কায়সারের ভক্তকুল তাকে একনজর দেখার জন্য পাগল হয়ে গেল। তাকে উৎসুক জনতার মাঝখান থেকে আমিও উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলাম। তারা বরগুনাতে ২ দিন ছিলেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন। ঘুরলেন ফিরলেন এবং অবশেষে ঢাকায় ফিরে গেলেন।
কিন্তু আমার মনে শমী কায়সার হয়ে রইলেন স্বপ্নের দেবী। উনি চলে আসার পর আমি শয়নে-স্বপনে শমী কায়সারকে দেখি। তার ভিউকার্ড জোগাড় করি, তার নাটক থাকলে সন্ধ্যার পড়াশোনা বন্ধ করি। মোটামুটি উন্মাদ হয়ে গেলাম। খেলাঘরের সেক্রেটারি চিত্তদার কাছ থেকে পান্না কায়সারের বাসার ঠিকানা জোগাড় করলাম। তারপর যেটা করলাম সেটা একেবারেই সিনেমা। চার পাতার একটি চিঠি লিখলাম শমী কায়সারকে। শুরুটা ছিল এমন-
শ্রদ্ধেয় শমী আপু, পত্রে আমার সালাম নিবেন। আশাকরি আম্মুকে নিয়ে ভালোই আছেন। আমার নাম সাব্বির। ঐ যে টাউন হলের নিচে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে কথা হয়েছিল। আমার গায়ে নীল রঙের শার্ট পরা ছিল। আপনি বলছিলেন ঢাকায় এসে যোগাযোগ করতে…
শেষটা যতদূর মনে পড়ে…
আপু আমি আপনার ছোট ভাই। যদি আমাকে আপনি ছোটভাই হিসেবে গ্রহণ করেন তাহলে ১ পাতার একটা চিঠির উত্তর দিয়েন। আমি সারাজীবন আপনার কথা মনে রাখব। আমি আপনার উত্তরের আশায় আগামী তিনদিন পর থেকে পোস্ট অফিসে যোগাযোগ করতে শুরু করব। ইতি আপনার প্রাণপ্রিয় ছোটভাই খেলাঘরের বন্ধু সাব্বির।
এরপর থেকে স্কুলে যাওয়া আসার পথে আমাদের পোস্ট অফিসে পোস্টমাস্টার কালাম ভাইকে বললাম ঢাকা থেকে শমী কায়সারের চিঠি আসবে। আমি বাসায় না থাকলে আপনার কাছে রেখে দিয়েন। বাসার মুরব্বিদের কাছে আবার দিয়েন না, একটু সমস্যা আছে। কালাম ভাই বলল ঠিক আছে। দিন যায় মাস যায় বছর যায় ইস্কাটন থেকে কোনো চিঠি আর আসেনি। শমী কায়সার বুকের গহীনেই রয়ে গেল। মাঝে মাঝে এখনও ভাবি শমী কায়সার যদি ২ লাইনের কোনো একটি চিঠিও দিত খুব ভালো লাগত।
কত চেনা কত কাছের একজন মানুষ শমী কায়সার। কতবার তার সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে কিন্তু কথাগুলো বলা হয়নি। চেনা মানুষ আপন মানুষ অথচ অচেনা কত দূরের। মাঝে মাঝে ভাবি একটা নাটকে যদি একসাথে কাজ করতে পারতাম? তাহলে ২০ বছর পর আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে আনন্দ আলোতে আর একটা লেখা লিখতে পারতাম।
সবাই বলে জীবন খুব অল্প সময়ের। এই এক জীবনে দেখার কত কী আছে। আবার অনেকে বলে কিছুই দেখতে পারলাম না। কত কিছুই করার ছিল? শুধু পাওয়া আর না পাওয়ার দোলাচল। আমি বাস্তববাদী, আবার অনেকটা স্মৃতিকাতর। চলার পথে কত স্মৃতি যে মাথায় ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। ভাবি যেটা মনে পড়বে সেটাই লিখে ফেলব। অনেক উদ্যম, অনেক উৎসাহ নিয়ে ভাবি কিছু একটা করব। কিন্তু কিসের কি? সব ভুলে যাই। জীবন বোধহয় এমনই, ভুলে যাওয়া আবার মনে পড়া।
যেমন এখন আমার খুব দাদা-দাদীর কথা মনে পড়ছে। আমার বটগাছ ছিল আমার দাদা দাদী। কত মার যে খেয়েছি আমার বাবার। সব দাদা উদ্ধার করত। এমনও হয়েছে দাদা পারলে আমার আব্বাকে মারে। আমার আব্বার অনেক রাগ ছিল। এখন নেই। এখন মাঝে মাঝে আব্বাকে দেখে মনে হয় আমার দাদা। আমার ছেলেকে আমি মারব না কখনও কিন্তু আমার বাবা কেন জানি মনে হয় আমার সন্তানকে সবসময় আগলে রাখবে, উদ্ধার করবে ভালোবাসা দিয়ে। দান প্রতিদানের মতো।
একবার হঠাৎ ইচ্ছে হলো বাঁশের বাঁশি বাজানো শিখব। সুর যে কীভাবে আমাকে টানে আমি জানি না। অনেক কষ্টে বাশি জোগাড় করলাম। বরগুনার মনোয়ার ভাই, মিঠুদা এদের কাছে বাঁশি বাজানো শিখতে শুরু করলাম। সেকি প্রাণান্ত চেষ্টা। আমার দাদা দেখেছে। কিন্তু আব্বা দেখেনি। কারণ আব্বা বাসায় থাকলে জীবনেও এ চেষ্টা আমি চালাইনি। কারণ বাঁশ আমার পিঠ ভেদ করে সুর হয়ে যেত। রক্তাক্ত সুর। আমার মা ‘নো প্রবলেম’ যত কিছুই করি কোনো কিছুই বলে না। শুধু বলত পড়াশোনাটা ঠিকমতো করো কারণ তাদের আশা আমি অনেক বড় ডাক্তার হব। কেননা আমি সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করি। আমার সায়েন্স যে কী সেটা তো কেবল আমিই জানতাম। সুর, গান, নাটক, কবিতা এই সায়েন্স ছাড়া কোনো কিছুই মাথায় ঢোকে না। আমি প্রতিদিন সকাল বিকাল চান্স পেলেই বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছি। ভাবখানা এমন আমার বাঁশির সুরে অনেক মেয়ে পাগল হয়ে আমার পেছনে ঘুরবে। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো অনেক ইঁদুর আমার পেছনে দৌড়াবে। আমার কত ভাব হবে। যাই হোক আমার দাদা একদিন এমন এক আশীর্বাদ দিলেন আমি ভড়কে গেলাম। দাদা বললেন, ‘তুমি যা বাজাইন্যার চেষ্টা করতে আছো হেইডা না বাজাইয়া চুঙ্গা ফুয়া। তাইলে তোর মার কষ্ট কোমবে। চুলায় ধারে যাইয়া চুঙ্গা ফুয়া।’
বাঁশি বাজানোর সমস্ত আশা-ভরসা মাটিতে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেল। অনেক কষ্টে আমি বাঁশি বাজানোর চেষ্টা কমিয়ে দিলাম। ওভাবে ফুঁ ফা করতাম না কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে চেষ্টা করতাম।
আজ আমার দাদা বেঁচে নেই। আমার অভিনয় তিনি দেখেননি। আমার টুকটাক বাঁশি বাজানোও তিনি দেখেননি। দেখতে পারলে আমার আজ অনেক ভালো লাগত। আনন্দে হয়তো চোখ ভিজে যেত। জীবনে প্রথম ঢাকায় যখন আসি বয়স তখন ৬/৭। দাদার হাত ধরেই এসেছিলাম। আরিচা ফেরিতে বসে দাদা আমাকে ৮টা ডিম খাইয়ে ছিলেন। ডাব খেয়েছি ৩/৪টা। যা খেতে চেয়েছি দাদা সব খাইয়েছেন। আরিচা ঘাট পার হলেই দাদার কথা মনে পড়ে। শিশুপার্কের সামনে গেলে দাদাকে মনে পড়ে। আজ আমার দাদা বেঁচে থাকলে তাকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে ঘুরতে পারতাম। তার অজানা অনেক জায়গায় আমি নিয়ে যেতে পারতাম। তিনি যা খেতে চাইতেন তাই খাওয়াতাম। আসলে জীবন এটাই- যা ভাবি তা হয় না, যা ভাবি না তাই হয়।
আমার প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে ঠিক করলাম মালয়েশিয়া যাব। গেলাম মালয়েশিয়া। প্রায় ১৪ দিন আমরা ঘুরব বলে ঠিক করলাম। সময়মতো আমরা গেলাম, অনেক মজা করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম। কুয়ালালামপুর, বোনাং, লাংকাউ এরকম কয়েকটি জায়গায় আমরা ঘুরলাম। লাংকাউতে আমার অনেক ভালো লাগল কারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এত সুন্দর হতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। অনেক বাংলাদেশী মানুষের সাথে দেখা হলো, কথা হলো। আমরা অজানা অচেনা অনেক মানুষের সাথে কথা বললাম। দাওয়াত খেলাম। বিদেশে বসে দেশী মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম আমরা। আমার বউ আমাকে বলল, নাটক করে যে অনেক মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যায় সেটা তোমার সাথে ঘুরতে না আসলে বুঝতাম না। অপরিচিত জায়গা অনেক পরিচিত হয়ে গেল দেশী মানুষের সহযোগিতায়। বাসে ঘুরলাম, ট্রেনে ঘুরলাম, কত কম টাকায় যা এই সহযোগিতা ছাড়া হতো না। একদিন আমরা কয়েকটি দ্বীপ ঘোরার জন্য মনস্থির করলাম। ৫ ঘণ্টার ঘোরাঘুরি। প্রতিটি দ্বীপে ঘুরেফিরে বিশ্রাম নিয়ে বেশ মজাতেই দিনটা কাটছিল। সুন্দর একটা দ্বীপে ঘুরছি, তখন চুমকি বলল চলো কোক খাই। দ্বীপের মাঝখানে ছোট্ট একটি দোকান। সবাই ভিড় করে খাবার দাবার কিনছে। আমরাও কোক কিনে যখন দাম দিতে যাব তখন তামিল চেহারার একজন মানুষ যিনি বিক্রি করছিলেন তিনি টাকাটা না নিয়ে ইশারায় বললেন একটা জায়গায় গিয়ে বসতে। একটু অবাকই হলাম। সবাই টাকা দিচ্ছে লোকটি নিচ্ছে কিন্তু আমরা দিলাম আমাদেরটা নিল না। আমরা কি কোনো অপরাধ করলাম?
কিছুক্ষণ পর লোকটি এলো। অবাক বিস্ময় নিয়ে লোকটির দিকে তাকালাম কারণ লোকটি বাংলায় আমাদেরকে বলল, সাব্বির ভাই কেমন আছেন? আমরা অবাক হলাম, বিস্মিত হলাম কারণ লোকটি অবিকল শ্রীলংকানদের মতো দেখতে। ১০ মিনিটের মাথায় লোকটির সাথে খুব খাতির হলো এবং তিনি বললেন, দেশী মানুষের কাছ থেকে কী করে টাকা নেই বলেন? আপনিতো অতিথি। আমি একটু লজ্জাই পেলাম কারণ লোকটি অনেক বিনয়ী, ভদ্র এবং আবেগপ্রবণ। লোকটিকে বললাম, ভাই দেশে যাবেন কবে? বলল যেতে তো চাই কিন্তু অনেক খরচ। সবাই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে আমার তো অনেক টাকা। কিন্তু এই দেশে অনেক খরচ। দেশে ২ মাস অন্তর টাকা পাঠাই। একবার ঘুরতে গেলে অনেক খরচ হয়। ৫ বছর হয় দেশে যাই না। তারপর যে ঘটনাটি ঘটল সেটি একদমই অপ্রত্যাশিত। লোকটি হাউমাউ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বলল, ভাই মাকে খুব মনে পড়ে। কতদিন মাকে দেখি না। আমাকে জড়িয়ে ধরল। তখন আমার চোখ জলে ভিজে উঠল। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। আড়চোখে দেখি চুমকি ওর আইলেশ ঠিক করছে। আমি ভাবি, ও কি আসলে আইলেশ ঠিক করছিল নাকি আমার মতোই চোখের পানি সরিয়ে দিচ্ছিল? প্রশ্নটা কোনোদিন ওকে করিনি।
লাংকাউয়ের একটা ছোট্ট দ্বীপ সেদিনের সেই স্মৃতি আজও আমাকে ভাবায়। মনে করিয়ে দেয় অজানা অচেনা জায়গায় একজন মানুষের সাথে পরিচয়ের পরও লোকটিকে অচেনা মনে হয়নি। মানুষ পৃথিবীতে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যে কাজটি পারে সেটা হলো ভুলে যেতে। আমিও ভুলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। কারণ মাকে ভুলে যাওয়া যায় না। অচেনা অনেক মানুষের ভিড়ে একজন মানুষকে ঠিকই চেনা যায়। মাকে চেনা যায়। আমি লেখার শুরুতে বলেছিলাম মৃত্যুর ১ দিন পর যদি বিধাতা ৫ মিনিট সময় দিত তাহলে কত মজা হতো? আমি মজা করতে চাই না আমি ৫ মিনিট কথা বলতে চাই। আমার মায়ের সাথে কথা বলতে চাই।
কত জায়গায় যাই, কত মানুষের সাথে মিশি, কত যে দৃশ্য চোখে ভাসে, রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ভাবি কাল সকালে আর যদি উঠতে না পারি আমার চাওয়াটা কী সত্যি হবে। কত কত মানুষের ভিড়ে নিজেকে আবার হারিয়ে ফেলব না তো? সত্যি এত প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজে পাই না। অচেনা দেশে এক অচেনা মানুষ হয়ে আমি ঘুরে বেড়াই। স্মৃতি আমাকে ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে শেখায়। আমার সন্তানের আঙুল ধরে অনেক দূর হেঁটে যেতে চাই মাইলের পর মাইল।
সন্তানের কথাই যখন এলো আরেকটি ঘটনা বলি- আমার সন্তানের জন্মদিন ১১ নভেম্বর ২০০৬। তখন দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ। চারিদিকে মিছিল-মিটিং, হরতাল, অবরোধ কত কী। অবরোধের মধ্যেই পৃথিবীতে এলো আমার সন্তান। আমার বাবা-মা চুমকির মা, ভাইবোন সবাই হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। আমিও সেদিন প্রচণ্ড পেটের ব্যথা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছি। আমার অ্যাপেন্ডিসের ব্যথা। পরে অপারেশন হয়েছিল। লাক্স-চ্যানেল আই-র দুবাই যাওয়ার কথা সেটাও হলো না। ঈশিতার সাথে একটা নাচের রিহার্সেলও করেছিলাম। ঈশিতা খুব মন খারাপ করেছিল। পরে আবার মন ভালো হয়েছিল আমার সন্তান হবার খবর পাবার পর। যাই হোক হাসপাতালে আমি প্রচণ্ড টেনশন নিয়ে, যখন দৌড়াদৌড়ি করছি তখন অপারেশন থিয়েটারের সামনে আমার সমস্ত আত্মীয়-স্বজন অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমি ভয়ে সেখানে যাই না। কিসের ভয়, কেন ভয় আমি জানি না। সন্তান পৃথিবীতে আসার আগে বাবাদের কী এই ধরনের ভয় হয়? আমি ঠিক জানি না। আমি ভীত হয়ে দূরে বসে আছি। কিছুক্ষণ পর দূরে শুনলাম, সিস্টার মীর সাব্বিরকে ডাকছে। আমি কাছে যাই না। আমার বড়বোন দীবা আপু চিৎকার করে বলছে- সাব্বির তোর ছেলে হয়েছে, ছেলে হয়েছে। আমি অনেক ভয়ে কেমন যেন কুঁকড়ে গেলাম। সবাই আমার সন্তানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে গোল হয়ে। একটু পেছনে দু’পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে দূর থেকে আমার সন্তানকে দেখতে লাগলাম। তারপর কি পরম ভালো লাগায় সিস্টার আমার সন্তানকে আমার কোলে তুলে দিলেন। বুকের ভেতরে নিয়ে যখন ওকে জড়িয়ে ধরলাম আমার সমস্ত ভয় শেষ হয়ে গেল। দুচোখে অনুভব করলাম কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। আমি কি কাঁদছিলাম তখন? জানি না, তবে সাহসী বীর মনে হলো আবার, আমাকে।
আমার ছেলে আর আমি। যুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমরা দুজন আর পৃথিবীর অন্যরা সবাই একসাথে ‘নো প্রবলেম। ’আমি মনে মনে একথা যখন ভাবছি তখন দেখলাম আমার আব্বা আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার সন্তান আমার বুকের মধ্যে, আর পেছনে আমার বাবা। আমার মনে হলো আমি আরও অনেক বেশি শক্তিশালী, অনেক বেশি সাহসী। কারণ আমার সামনে আমার সন্তান, মাঝখানে আমি আর পেছনে আমার বাবা। এর চেয়ে বড় সত্য আর কী হতে পারে? এর চেয়ে বড় সাহস আর কী হতে পারে?
‘শেকড়ের টান বড় মারাত্মক,
শেকড়ের টান বড় ভয়ঙ্কর মায়া।’
ব্লেড সস্তা বলে দাড়ি নেই
ভালোবাসা কারে কয়?
–যদি আবার প্রেমে পড়া যেত, তাহলে বলা যেত ভালোবাসা কারে কয়। সময় সময় ভালোবাসার অর্থ বদলায়। তবে জ্যামিতিকভাবে ভালোবাসার সংজ্ঞা হতে পারে−একটি ছেলে ও একটি মেয়ের হাতের রেখা যদি পরস্পর একদিকে যায়, তবে তারা পরস্পর যে বিন্দুতে ছেদ করে, তাকেই ভালোবাসা বলে।
আপনাকে যদি ভ্যালেন্টাইনস ডেতে কোনো মেয়ে প্রেম নিবেদন করে, আপনি তাকে কী বলবেন?
–তাকে বুদ্ধিমতী হওয়ার পরামর্শ দেব।
আপনাকে এ শহরের মেয়র নির্বাচন করা হলে আপনি সর্বপ্রথম কী করবেন?
–এ শহরে প্রেমের কোনো আলাদা জায়গা নেই। প্রেমের জায়গা তৈরি করব। সর্বোপরি শহরটাকে এমন করব, যেন শহরে পা দেওয়া মাত্র মনে হয়, এ শহরে একজন ‘মেয়র’ আছেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ কী বলে মনে হয়?
–অনেকে ভাবেন বুঝি, প্রেমিকার মন জয় করা। আসলে কিন্তু না। মন জয় করা প্রাথমিক একটি ধাপ কেবল। কঠিন হচ্ছে মন জয়ের পর তাকে ঠিকঠাক রাখা। ঝঃধনষব রাখা আরকি!
আপনার জীবনে সবচেয়ে রোমান্টিক মুহুর্ত কী ছিল?
–একজন আমাকে বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে জীবনের এতগুলো দিন কেটে গেছে, ভাবাই যায় না।’ এটাই আমার কাছে এখন অবধি শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক মুহুর্ত।
সবচেয়ে বেশি ভয় পান কাকে?
–স্বামীমাত্রই যাকে ভয় পায়।
আপনার দাড়ি নেই কেন?
–ব্লেড তো এখনো বাজারে বেশ সস্তা!
প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান থাকে। আপনার ক্ষেত্রে তিনি কে?
–বলাটা তো খুব রিস্ক। আপনার কাছে দাবিদারদের কোনো তালিকা আছে?
বাংলাদেশ টেলিভিশন কথা বলে…।
–সাউন্ড অন থাকলে…।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আপনার মন কী চায়?
–ফাঁকা টয়লেট।
আপনার কাছে ভালোবাসা কী?
–শৈশবে বাবা-মা আর খেলনা; কৈশোরে শচীন টেন্ডুলকার, ব্রিটনি স্পিয়ার্স, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি; যৌবনে মনের মানুষ, মাঝবয়সে স্ত্রী, সন্তান; শেষ বয়সে নিজের জীবন আর এই পৃথিবীটা।
নিজের লেখা বই কাকে উৎসর্গ করে সবচেয়ে আনন্দিত হয়েছিলেন?
–নিজেকে। উপনায়ক উপন্যাস নিজেকে নিজেই উৎসর্গ করেছিলাম।
আপনি প্রধানমন্ত্রী হলে প্রেমের জন্য কী সুযোগ দিতেন?
–১৪ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে প্রেমভাতা চালু করতাম।
ঝামেলা মনে হয়…।
–মাঝেমধ্যে যখন সত্যি কথা বলতে হয়।
ভাবতে ভালোই লাগে…।
–তাকে এখনো ভালোবাসি।
মিলন হবে কত দিনে…?
–আমি তো হয়েই আছি। যে আসবে তার ওপর। আমার দিক থেকে কোনো বাধা নেই।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: জিনাত রিপা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
মানুষ কেমন করে বদলায়
গল্পটা বলেছিল হাজামবাড়ির মজিদ।
গল্পকে সে বলত কিচ্ছা। আমার কিশোরবেলার কথা। গ্রামে নানির কাছে একা একা থাকি। সন্ধ্যাবেলা মজিদ মাঝে মাঝে আমাকে কিচ্ছা শোনাতে আসত। রাক্ষস খোক্ষস, জিন পরী, দেও দানব, ভুত পেতনি আর রাজরাজার কিচ্ছা।
এই কিচ্ছাটা ছিল ডাকাতের।
এক দুর্ধর্ষ ডাকাত রামদা হাতে বনোপথে দাঁড়িয়ে থাকে। সেই পথে টাকা-পয়সা সোনাদানা নিয়ে যে যায় রামদায়ের এক কোপে ধর থেকে তার মুন্ডুটা আলগা করে দেয় সে। তারপর তার টাকা-পয়সা সোনাদানা নিয়ে বাড়ি যায়। সংসারে বউ ছেলেমেয়ে আছে। তারা খুবই আরাম আয়েশে জীবন কাটায়।
একদিন সেই বনোপথ ধরে এক সাধু আসছিল। ডাকাত তার সামনে রামদা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধু বললেন, আমাকে তুমি খুন করতে চাও কেন?
তোমার কাছে যা আছে সেসব ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য।
সেটা তো তুমি আমাকে খুন না করেও নিতে পার?
তা পারি, কিন্তু মানুষ খুন করা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এ পর্যন্ত ১০০টি খুন করেছি, তোমাকে খুন করলে খুনের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০১।
আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?
পারো।
ডাকাতির টাকা-পয়সা সোনাদানা দিয়ে তুমি কী করো?
কী আর করব। সংসার চালাই। বউ-ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ করি।
কিন্তু ডাকাতি আর মানুষ খুন করে তুমি যে পাপ করছ এই পাপের দায়ভার কি তোমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরা নেবে?
ডাকাত একটু চিন্তিত হলো। তা তো জানি না।
কোনো দিন কি জানার চেষ্টা করেছ?
না।
এখন গিয়ে জেনে আসো।
আর তুমি?
আমি এখানে তোমার অপেক্ষায় বসে থাকব।
ডাকাত হাসল। তুমি কি আমাকে এতই বোকা মনে করো? আমি তোমাকে এখানে বসিয়ে রেখে ওসব কথা জানতে যাই আর সেই ফাঁকে তুমি পালাও। ওটি হবে না বাপধন।
তাহলে এক কাজ করো। আমাকে এই গাছের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখে যাও, যাতে আমি পালাতে না পারি।
হ্যাঁ, এটা হতে পারে।
তাহলে তা-ই করো।
সাধুকে একটি গাছের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে বাড়ি গেল ডাকাত। গিয়ে স্ত্রীকে প্রথমে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, এই যে আমি ডাকাতি করে, মানুষ খুন করে টাকা-পয়সা রোজগার করে তোমার ভরণপোষণ করি, তাতে যে আমার পাপ হয়, এই পাপের অর্ধেক দায়ভার কি তুমি নেবে?
স্ত্রী অবাক। কেন তোমার পাপের দায়ভার আমি নেব?
যেহেতু তুমি আমার স্ত্রী। আমার অর্ধাঙ্গিনী।
স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী যা-ই বলো আমার ভরণপোষণ এবং সংসার পরিচালনার দায় তোমার। তুমি কীভাবে কোন পদ্ধতিতে রোজগার করে সংসার চালাচ্ছ সেটা আমার দেখার ব্যাপার না। আমি শুধু দেখব তুমি আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারছ কি না। অন্য কিছুই আমার দেখার ব্যাপার না। রোজগার করতে গিয়ে তোমার যদি কোনো পাপ হয় সেই পাপের দায়ভার তোমার। পৃথিবীতে কারও পাপের দায়ভার অন্য কেউ নিতে পারে না।
ডাকাত চিন্তিত হলো।
গেল ছেলের কাছে। ছেলেও একই কথা বলল। পিতা হিসেবে আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তোমার। সেই দায়িত্বের জন্য তুমি খুন করছ না ডাকাতি করছ তা আমি ভাবতে যাব কেন? তোমার পাপের ভার আমি নিতে যাব কেন? তোমার পাপ তোমার।
ডাকাত গেল মেয়ের কাছে। মেয়েরও একই কথা।
দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ডাকাত ফিরে এল বনে। এসে দেখে যে গাছের সঙ্গে সাধুকে বেঁধে রেখে গিয়েছিল সাধু সেই গাছের তলায়ই বসে আছেন কিন্তু তাঁর শরীরে কোনো বাঁধন নেই। মোটা মোটা দড়ি পড়ে আছে সাধুর পায়ের কাছে।
ডাকাত হতভম্ব। এ কী করে সম্ভব? এত শক্ত বাঁধন তুমি কী করে খুলেছ?
সাধু বললেন, আমি খুলিনি। আপনা আপনিই খুলে গেছে।
ডাকাত বুঝে গেল সাধু ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই সাধু বললেন, এবার বলো যে কথা জানতে তুমি গিয়েছিলে সে কথা জেনেছ কি না?
ডাকাত মাথা নিচু করে বলল, জেনেছি।
তোমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে কী বলল? তারা কি নেবে তোমার পাপের দায়ভার?
না কেউ নেবে না। তিনজনই পরিষ্ককার বলে দিয়েছে আমার পাপের যাবতীয় দায়ভার আমার। আমার পাপ অন্য কেউ ভাগ করে নেবে না।
তাহলে বোঝো। যাদের ভরণপোষণের জন্য ডাকাতি করছ তুমি, মানুষ খুন করার মতো ভয়াবহ পাপ করছ তারা কেউ তোমার পাপের দায়ভার নেবে না। তোমার পাপ শুধুই তোমার। তাহলে কি লাভ এই পাপ করে?
ডাকাত হাতের রামদা ছুড়ে ফেলে দিল। তাই তো। তারপর সাধুর পা জড়িয়ে ধরল। সাধুবাবা, আমি এখন কী করব? এই ১০০টি খুনের পাপ আমি কীভাবে মোচন করব? ডাকাতি করে যে পাপ করেছি সেই পাপ কী করে মোচন করব?
সাধু বললেন, ওই যে মরা গাছটা দেখছ, এক্ষুনি গিয়ে ওই গাছের তলায় বসো। বসে ভগবানকে ডাকতে থাকো। ভগবান, আমার পাপ মোচন করো। আমার পাপ মোচন করো। যেদিন দেখবে মরা গাছে সবুজ পাতা গজিয়েছে সেদিন বুঝবে ভগবান তোমার পাপ মোচন করেছেন। তোমার জন্য স্বর্গের দরজা খুলে যাবে।
সাধুর কথায় ওই মুহুর্তেই বদলে গেল ডাকাত। জগৎ সংসার ভুলে, স্ত্রী-সন্তান ভুলে মরা গাছের তলায় গিয়ে বসল। ভগবানকে ডাকতে শুরু করল।
দিন যায়, রাত যায়। ডাকাত শুধু ভগবানকেই ডাকে।
মাস যায়, বছর যায়। ডাকাত শুধু ভগবানকেই ডাকে।
কিন্তু তার পাপ মোচন হয় না। মরা গাছে গজায় না সবুজ পাতা।
একদিন ডাকাত দেখে বনের ধারে একজন কাউকে কবর দিয়ে যাচ্ছে কিছু লোক। সন্ধ্যার দিকে তারা কাজ সেরে চলে যাওয়ার পর বিশাল চাঁদ উঠল আকাশে। ফুটফুটে জ্যোৎস্মায় ভরে গেল চারদিক। ডাকাত উদাস চোখে জ্যোৎস্মা দেখছে আর মনে মনে ভগবানকে ডাকছে। এ সময় দেখা গেল একটি লোক কোদাল হাতে সেই কবরটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কোদাল চালিয়ে মাটি খুঁড়ল সে, লাশ তুলে আনল। লাশের শরীর থেকে কাফনের কাপড় সরানোর পর এতটা দুর থেকেও ডাকাত দেখতে পেল, লাশটি খুব সুন্দরী একটি মেয়ের। লোকটি তারপর সেই লাশের ওপর নিজের বদমতলব হাসিল করার প্রস্তুতি নিল। এই দেখে ভগবানকে ডাকতে ভুলে গেল ডাকাত। তক্ষুনি ছুটে গেল সেখানে। কোদালের কোপে হত্যা করল লোকটিকে। মেয়েটির লাশ সসম্মানে, সযত্নে কবরে শুইয়ে দিল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে যতটা যত্ন সম্ভব ততটা যত্নে কবরের ওপর মাটিচাপা দিল। এসব কাজ শেষ করে সে যখন তার আগের জায়গায়, মরা গাছটির তলায় ফিরে এসেছে, এসে দ্যাখে চাঁদের আলোয় চকচক করছে মরা গাছের ডালপালা। সবুজ পাতায় ভরে গেছে মরাগাছ। অর্থাৎ ডাকাতের পাপ মোচন হয়েছে। ঈশ্বর তার পাপ ক্ষমা করেছেন।
মানুষ আসলে এভাবে বদলায়। বদলের মন্ত্রটা তাকে দিয়ে দিতে হয়। তার প্রাণে গেঁথে দিতে হয়, তুমি এইভাবে বদলাও। আমাদের মায়েরা, স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা, সন্তানেরা চিরকাল খারাপ পথ থেকে প্রিয় মানুষটিকে ফেরানোর মন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে খুবই সহজ একটা অস্ত্র। ছেলে খারাপ কাজ করছে, খারাপ পথে চলছে, মা ছেলেকে শপথ করিয়েছেন, আমার মাথায় হাত দিয়ে বল, খারাপ কাজ তুই আর করবি না। খারাপ পথে তুই আর চলবি না।
মায়ের মাথায় হাত দিয়ে শপথ করা ছেলে খারাপ কাজটি আর করতে পারেনি। খারাপ পথে আর চলতে পারেনি। মায়ের সঙ্গে করা প্রতিজ্ঞা সে ভাঙবে না। ভাঙলে যদি মায়ের কোনো অনিষ্ট হয়? মায়ের মরা মুখ যদি দেখতে হয়?
প্রিয়তমা স্ত্রী কিংবা প্রেমিকা নেশাভাঙ করা প্রিয় মানুষটিকেও ওই একই কায়দায় ফিরিয়েছে। প্রতিজ্ঞা করো আর নেশা করবে না। করলে আমার মরা মুখ দেখবে।
নেশার সোনালি জগৎ থেকে ফিরে এসেছে মানুষটি।
কিছুতেই সিগারেট ছাড়তে পারছে না সংসারের কর্তা। তার আদরের সন্তানটি বলল, তুমি সিগারেট না ছাড়লে আমি তোমার সামনে যাব না, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। যদি আমার চেয়ে সিগারেট তোমার বেশি প্রিয় হয় তাহলে তুমি সিগারেট নিয়েই থাক।
ভদ্রলোক সিগারেট ছেড়ে দিলেন।
আমি এক ভদ্রলোককে চিনি। এমন একটা জায়গায় চাকরি করেন, প্রতিদিন ১০-২০ হাজার টাকা ঘুষ খাওয়া তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই না। ভদ্রলোক একটি পয়সাও ছুঁয়ে দেখেন না। বেতনের টাকায় অতিকষ্টে ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার চালান। তাঁর সহকর্মীরা সবাই বাড়িগাড়ি করে ফেলেছে।
ভদ্রলোক কেন ঘুষ খান না?
চাকরিতে ঢোকার আগে বাবা তাঁকে শপথ করিয়েছিলেন, কোনো দিন একটি পয়সাও ঘুষ খাবে না। সেই শপথ মেনে চলছেন তিনি। সত্যিকার শপথের এমন এক শক্তি থাকে, পৃথিবীর কোনো প্রলোভনই সেই শক্তির সঙ্গে পেরে ওঠে না।
মানুষ বদলায় নিজের শপথে। অন্যকে বদলে দেয় তার ভেতরে শপথের শক্তি তৈরি করে। বিবেককে জাগ্রত করিয়ে।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিষ্টি পছন্দ করতেন। মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। একদিন এক সাহাবি আসছেন তাঁর কাছে। হুজুর, আমার খুবই মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস। আমি মিষ্টি খাওয়া ছাড়তে চাই। আপনি আমাকে পথ দেখান।
মহানবী (সা.) বললেন, আপনি সাত দিন পর আসবেন। তখন আমি আপনাকে বলব কীভাবে মিষ্টি ছাড়বেন।
সাহাবি সাত দিন পর এলেন। মহানবী (সা.) তাঁকে পথ দেখালেন। আপনি যদি প্রতিদিন চারটি মিষ্টি খান, তাহলে আজ খাবেন তিনটি। কাল খাবেন দুটো। তারপর দিন একটি। এভাবে চেষ্টা করলে অল্প দিনের মধ্যেই আপনি মিষ্টি ছাড়তে পারবেন।
সাহাবি খুব খুশি। জি হুজুর। আমি এভাবেই চেষ্টা করব। কিন্তু হুজুর, এই পরামর্শ দেওয়ার জন্য আপনি সাত দিন সময় নিলেন কেন? কারণটা জানার খুব কৌতুহল হচ্ছে।
মহানবী (সা.) বললেন, আমার নিজেরও মিষ্টি খাওয়ার অভ্যাস ছিল। এই সাত দিনে সেই অভ্যাস আমি পরিত্যাগ করতে পেরেছি। নিজের অভ্যাস না বদলে সেই বিষয়ে আপনাকে আমি কী করে পরামর্শ দেব?
এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না। এই ঘটনার অর্থই হচ্ছে, বদলে যাও বদলে দাও। আগে নিজে বদলাও, তারপর অন্যকে বদলে দাও।
যেভাবে বেড়ে উঠি
জীবনের শুরুতে কারা আপনার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিলেন ?
জীবনের শুরুর প্রভাবটা ফেলেছিলেন আমার বাবা৷ বাবাকে আমি খুবই ভালোবাসতাম৷ সবসময় মনে হতো যে আমার বাবার মতো এরকম মানুষ বোধহয় আমার চারপাশে আর কেউ নেই৷ আমি বিক্রমপুর, গ্রামে নানীর কাছে থাকতাম৷ বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন৷ আমাক দেখতে যেতেন৷ বাবা মারা গেলেন চুয়ালি শ বছর বয়সে একাত্তর সালে৷ তারপর প্রভাব ফেলেছিলেন আমার নানী৷ পরবতর্ীতে আমার মা৷ আরও অনেকেই৷
জীবনের কোন্ ঘটনা আপনার বিশ্বাস গঠনে প্রভাব ফেলেছে?
একাত্তর সালে আমার এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের জন্য পরীক্ষাটা পরের বছর হল৷ আমরা গেন্ডারিয়ায় থাকতাম৷ আর্থিক অবস্থা অসচ্ছল ছিল আমাদের৷ তার মধ্যে বাবা মারা গেলেন৷ আমরা একেবারেই অসহায় হয়ে গেলাম৷ একদিকে দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে৷ দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছে মুক্তিযোদ্ধারা৷ অন্যদিকে আমার ‘মা’ এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে আরেক রকম একটা যুদ্ধ করছে৷
একদিন দুপুরে নির্জন বিশাল ধূপখোলা মাঠের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম৷ মুক্তিযুদ্ধ চলছে৷ আর্মিদের ভয়ে অনেক মানুষ শহর ছেড়ে চলে গেছে৷ দেখলাম দেশটা যেন কেমন হয়ে গেছে৷ পুরো অঞ্চলটাই ফাঁকা হয়ে গেছে৷ আব্বার মৃতু্যর ফলে আমাদের সংসার বা জীবনটা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে৷ কিন্তু এই নির্জনতা নিশ্চয়ই একদিন কেটে যাবে৷ নিশ্চয়ই আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব৷ পরিবারটিকে রক্ষা করতে পারব৷
আমি ওই নির্জনতার মধ্যে আবিষ্কার করলাম যে এই অসময় কেটে যাবে৷ সুসময়ে সামনে আসবে৷ নিশ্চয়ই জীবন অন্য রকম হবে৷ বাসায় ফিরে আসতে আসতে আমি আমার মনের একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম৷ খুব সচেতনভাবে৷ মুক্তিযুদ্ধ বাবার মৃতু্য এবং ওই নির্জনতা আমার বিশ্বাস গঠনে প্রভাব ফেলেছিল৷
জীবিত অথবা মৃত কোন ব্যক্তিকে আপনি বেশি পছন্দ করেন এবং কেন?
আমার বাবাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতাম৷ তারপর নানী এবং ‘মা’কে৷ তিনজনের ভূমিকা তিন রকম৷ আসলে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন রকমের ভূমিকা পালন করে৷ শুধু একজন মানুষের ভূমিকায় একজন মানুষের জীবন দাঁড়ায় না৷ জীবিতদের মধ্যে আমার স্ত্রী৷ আমার মেয়ে দুটির ভূমিকা অনেক৷ ওরা আমাকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করে৷
কোন কোন বই, কোন কোন লেখক আপনার বিশ্বাসকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে, কেন?
এই মুহূর্তে ‘রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে’ এই রবীন্দ্র সঙ্গীতটি৷ চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী৷ নাটক সেলিম আল-দীনের বিনোদিনী৷ উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ এবং তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি৷’
একটি গান, একটি চলচ্চিত্র, একটি নাটক, একটি বই অথবা তার অংশ বিশেষের উলে খ করুন- যা আপনি অন্যকে শুনতে, দেখতে বা পড়তে উত্সাহিত করবেন?
আমার স্ত্রীর, দুই কন্যা এবং আমার বন্ধুর৷ তার মধ্যে কেউ কেউ অত্যন্ত প্রিয়৷ সেই বন্ধুটির কাছে আমি নানা রকমভাবে কৃতজ্ঞ৷ আমাকে সে এ জায়গাটায় আসতে সাহায্য করেছে৷ তার প্রত্যেকটা মতামতই আমার কাছে গুরুপূর্ণ৷ আমার জীবনে তার বিশাল প্রভাব আছে৷ আমার পরিবারের যে রকম ভূমিকা, তার ভূমিকাও আমার জীবনের আমার পরিবারের চেয়ে কোন অংশে কম নয়৷ আমার, বন্ধুর এবং পরিবারের মতামতের ভিত্তিতেই একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি আমার, কাজটি করি৷
জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আপনি নিজের মত ছাড়া অন্য কার মতামতকে গুরুত্ব দেন?
প্রিয় উদ্ধৃতি ‘জীবন এত ছোট কেন?’ এবং রবীন্দ্রনাথর গানের মতো ‘জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ৷’ আমি মনে করি যে মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, যতটা সময় বেঁচে থাকবে, সে যেন গভীর আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকে৷
আপনার পছন্দের প্রিয় উদ্ধৃতি কোনটি?
ব্যক্তির স্বাধীনতা ব্যক্তি নিজে কিছুটা অর্জন করে নেয়৷ রাষ্ট্র তাকে কিছুটা সহায়তা করে৷ আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে ব্যক্তি স্বাধীনতা অনেক ক্ষেত্রেই খর্ব হয়৷ স্বাধীনতাটা মানুষ উপভোগ করতে পারে না৷ অথচ মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন৷ স্বাধীনভাবে চলার স্বাধীনতাটা মানুষের আছে৷
মানুষের মুক্তির পথটা হচ্ছে তার নিজের কাছে৷ একজন মানুষ যদি মনে করে যে, বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে, কর্মের মধ্য দিয়ে আমি আমার মুক্তির পথ খুঁজছি৷ স্বাধীনতার পথ খুঁজছি৷ মানুষ তার কাজের মধ্য দিয়ে তার মনের স্বাধীনতা তৈরি করে যতক্ষণ বেঁচে থাকবে ততক্ষণ সে মুক্তির স্বাদ পাবে৷ বেঁচে থাকার স্বাদ পাবে৷
আপনার মতে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা কোনটি?
আমার নিজে আইন প্রণয়ন করার মতো সাধ্য, যোগ্যতা নেই৷ দেশের যে প্রচলিত আইন আছে সেগুলো মানুষের কল্যাণের জন্য তৈরি করা হয়েছে৷ আমরা যদি সে আইনগুলো মেনে চলি তাহলে দেশ একটি কল্যাণমুখী দেশ হবে৷ মানুষ কল্যাণকর জীবনের দিকে যেতে পারবে৷ দেশের প্রচলিত আইনগুলোর প্রতি আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল৷ আমি চাই প্রচলিত আইনগুলো দেশের মানুষও মেনে চলুক৷
আপনি যদি একজন আইনপ্রণেতা হতেন তাহলে সবার আগে কোন আইনটি প্রণয়ন করতেন?
প্রথমতো জন্ম শাসনটা করা উচিত্ গভীরভাবে৷ আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিটা আমাদের চূড়ান্ত ক্ষতির দিকে নিয়ে যাবে! মানুষের স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষাটা অত্যন্ত জরুরি৷ এই তিনটি কাজ যদি আমরা করতে পারি তাহলে দেশটিকে আমরা একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারব৷ আমরা যদি আমাদের এক কোটি মানুষকে বিভিন্ন কাজের জন্য ট্রেন্ড করে বিদেশে পাঠাতে পারি তাহলে এ দেশের চেহারাটা ঘুরে যাবে৷
আপনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় বছর কোনটি? কেন সেটা স্মরণীয়?
১৯৭১ সাল৷ সে বছর মুক্তিযুদ্ধ হল৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হল৷ সে বছরেই আমি বাবাকে হারালাম এবং এক দুপুরে, আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম যে, আমাকে এখন থেকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনটার দিকে তাকাতে হবে৷ নিজের জীবনটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে চাই৷ এই সিদ্ধান্তটার কারণে, দেশের স্বাধীনতার কারণে, বাবার মৃতু্যর কারণে_ সব মিলিয়ে ১৯৭১ আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্মরণীয় বছর৷
আপনার জীবনদর্শন কি? সংক্ষেপে বলুন৷
আমার জীবনদর্শন হচ্ছে আমি মানুষ ভালোবাসি৷ মানুষের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ, মমত্ববোধ আছে৷ অর্থাত্ যতগুলো মৌলিক বিষয় মানুষের মধ্যে থাকে মানুষ সংক্রান্ত, আমি সেই বিষয়গুলো মানুষের উপর প্রয়োগ করি৷ আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে জয় করতে চাই৷ মানুষকে ভালো রাখতে চাই৷
সকালবেলার আলো
রবিকে দেখে আমার খুব ভালো লাগল।
উঠোনের কোণে মাঝারি সাইজের মাদুর বিছিয়েছে। মাদুরের ওপর রেখেছে একটা জলচৌকি। জলচৌকিতে বই রেখে দুলে দুলে পড়ছে। মাদুরে বেশ গুছিয়ে রাখা তার অন্যান্য বই-খাতা। সকালবেলার রোদ পড়েছে রবির পিঠের দিকে।
নভেম্বর মাস। গ্রাম এলাকায় বেশ শীত। রবিদের বাড়ির পশ্চিম দিকে বিশাল পুকুর। পুকুরের ওপার থেকে শুরু হয়েছে শস্যের মাঠ। কিছুক্ষণ আগেও চারদিকে ছড়িয়ে ছিল ধোঁয়ার মতো হালকা কুয়াশা। রোদ ওঠার ফলে কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে।
রবি আমার মামাতো ভাইয়ের ছেলে। দুই দিন আগে তার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এবার ক্লাস টেনে উঠবে। পরীক্ষার দুই দিন পর অনেক ছেলেমেয়েই বই নিয়ে বসে না। রেস্ট নেয়, খেলাধুলা করে, বেড়াতে যায়। অনেকে অযথাই ঘুরে বেড়ায়, ঘুমায়। রবি একেবারেই সে রকম না।
গতকাল বিকেলে আমি এ বাড়িতে এসেছি। গ্রামে এলে শৈশব-কৈশোরের অনেক কথা মনে পড়ে। অনেক স্নৃতি, অনেক ভালো লাগা, অনেক দৃশ্য ভেসে ওঠে চোখে। শীতের সকালে উঠোনের রোদে মাদুর বিছিয়ে, মাদুরের ওপর জলচৌকি নিয়ে পড়তে বসা রবির মতো করে আমিও তো বসেছি একদিন।
হাঁটতে হাঁটতে রবির কাছে গিয়েছি। পড়তে পড়তে রবি এক পলক আমার দিকে তাকাল, মিষ্টি করে হাসল কিন্তু কথা বলল না। বিড়বিড় করে পড়া মুখস্থ করছে। রবির পাশে বসে আমি তার বইপত্র ঘাঁটতে লাগলাম। মাধ্যমিক সাধারণ বিজ্ঞান বইটা হাতে নিয়েছি। নরম ধরনের কাগজে ছাপা বই। কাভার ছিঁড়ে গেছে, পেছন দিককার কয়েকটা পৃষ্ঠা খুলে গেছে। মোটা সুতো দিয়ে এই বই সেলাই করে নিয়েছে রবি। কারণ, বইটা তাকে আরও এক বছর দু-তিন মাস পড়তে হবে। তত দিনে বইটির যে কী অবস্থা হবে! যে বই যত বেশি পড়া হয় সেই বই তত বেশি নড়বড়ে হয়। সাধারণ বিজ্ঞান বইটির অনেক চ্যাপ্টারের অনেক লাইন মার্কার দিয়ে দাগিয়ে রেখেছে রবি। আমাদের ছেলেবেলায় মার্কারের নামই আমরা শুনিনি। ইমপরট্যান্ট লাইনের তলায় কাঠপেনসিল দিয়ে দাগ দিয়ে রাখতাম। আমাদের সময়ের সঙ্গে রবিদের সময়ের কত ব্যবধান!
রবির সাধারণ বিজ্ঞান বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই মনে হলো মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাক্রমে এইচআইভি এইডস বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেখি তো কীভাবে, কোন পদ্ধতিতে ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘দুরারোগ্য রোগ’ শিরোনামে শুরু হয়েছে বিষয়টি। বেশ সহজ-সরল ভঙ্গিতেই লেখা হয়েছে। ১৬ নম্বর পৃষ্ঠার পর বাকি অংশ জাম্প করে গেছে ২৫৭ নম্বর পৃষ্ঠায়। কেন, বুঝতেই পারলাম না। [পুনর্মুদ্রণ: ডিসেম্বর ২০০৬] যা-ই হোক, এ চ্যাপ্টারেও অনেক লাইন মার্কার দিয়ে দাগিয়ে রেখেছে রবি। যেমন, “এইচআইভি এইডস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ‘না’ বলা একটি বড় কৌশল। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা প্রায়ই আবেগ দ্বারা চালিত হয়, যুক্তি দ্বারা নয়। জীবনের সমস্যা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে অনেক সময় অনেককেই ‘না’ বলার প্রয়োজন হয় এবং নিজমত প্রতিষ্ঠা করতে হয়, যা অল্প বয়সীদের জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ।
এমন হতে পারে যে একজন শিক্ষার্থী তার সহপাঠী বা প্রিয়বন্ধুর একটি প্রস্তাব পেল, যা তাকে যৌন আচরণ করতে প্ররোচিত অথবা মাদকে আসক্ত হতে প্রভাবিত করতে পারে। শিক্ষার্থী কিছুতেই এই প্রস্তাব মানতে চায় না। এমন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে ‘না’ বলতেই হবে। একবার এবং বারবার। সহপাঠী বন্ধুটি এবং অন্যরা তাকে জোর করতে পারে। এ ক্ষেত্রে দৃঢ়চেতা হতে হবে।”
তারপর আমি বিষয়টি নিয়ে রবির সঙ্গে কিছু কথা বললাম। রবি, এই লাইনগুলো কি তুমি দাগিয়ে রেখেছ, নাকি তোমার টিচার বলেছেন?
রবি হাসল। আমিই দাগিয়েছি। বিজ্ঞান স্যার তো এই চ্যাপ্টারটা পড়ানই না।
কেন, পড়ান না কেন? এই চ্যাপ্টার থেকে প্রশ্ন আসে না?
হ্যাঁ আসে। কিন্তু স্যার পড়ান না। আমাদের বলে দিয়েছেন, এই চ্যাপ্টারটা তোমরা নিজেরা পড়ে নেবে!
কারণ কী?
তা জানি না।
আমার তারপর ইচ্ছে হলো রবিদের বিজ্ঞান টিচারের সঙ্গে কথা বলি। রবিকে বললাম, তোমাদের বিজ্ঞান টিচারের সঙ্গে কথা বলা যাবে রবি?
বলা যাবে। বিজ্ঞান স্যারের বাড়ি আমাদের গ্রামেই। আমি তোমাকে স্যারের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি।
বিকেলবেলা রবির সঙ্গে তার বিজ্ঞান স্যারের বাড়িতে গেলাম। ভদ্রলোকের নাম নজরুল ইসলাম। মধ্যবয়সী বিনয়ী ধরনের মানুষ। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি একটু ব্যস্তই হলেন। এ কথা সে কথার পর আসল প্রসঙ্গটা তুললাম। ‘স্যার, শুনলাম রবিদের বিজ্ঞান বইয়ের প্রতিটি চ্যাপ্টারই আপনি পড়ান শুধু এইচআইভি এইডস চ্যাপ্টারটা পড়ান না। কারণ কী বলুন তো?’
এইচআইভি এইডস শব্দটি শুনেই ভদ্রলোকের চেহারা কেমন পাল্টে গেল। যেন খুবই অশোভন, অশ্লীল কোনো শব্দ তিনি শুনছেন এমনভাবে একবার আমার মুখের দিকে তাকালেন, তারপর মুখ নিচু করে বললেন, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের এসব পড়ানো যায় নাকি, বলুন? কেন যে পাঠ্য বইয়ে এসব ছাপা হয়? ক্লাস সিক্সের বই থেকেই শুরু হয়েছে। এসব জানা উচিত প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর।
ভদ্রলোকের কথাবার্তা শুনে আমি বিস্িনত। কী বলছেন স্যার? আজকের পৃথিবী ভয়ঙ্করভাবে আক্রান্ত হচ্ছে এইচআইভি এইডসে। পৃথিবীর কোনো কোনো দেশে মহামারি আকারে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ আছে ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। ১৫ থেকে ২৫ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এইচআইভি এইডস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। সারা পৃথিবী এ বিষয়টি নিয়ে সচেতন। পৃথিবীজুড়ে প্রচার-প্রচারণা চলছে, এ বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত এবং সচেতন করার কাজ চলছে। ক্লাস সিক্স থেকে পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিশোর বয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা যাতে বিষয়টি নিয়ে ভাবে, জানে এবং সচেতন হয়। আপনি নিশ্চয় জানেন, এইডস এক ভয়ঙ্কর ব্যাধি। এইডস প্রতিরোধের জন্য সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ, শিক্ষক মানুষ, আপনার দায়িত্ব হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের বিষয়টি নিয়ে সচেতন করা। ছাত্রছাত্রীদের কাছে শিক্ষকদের কথা বেদবাক্যের মতো। আপনিই যদি বিষয়টি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকেন, তাহলে?
ভদ্রলোকে ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর নড়েচড়ে উঠলেন। ঠিকই তো বলেছেন! আমি তো এত দিন ভুল ধারণা নিয়ে ছিলাম। আমার মতো অনেক শিক্ষকই এ রকম ভুল ধারণা নিয়ে আছেন। এ ধারণা ভাঙতে হবে। শুধু ছাত্রছাত্রী কেন, সমাজের প্রতিটি স্তরের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে এইচআইভি এইডস নিয়ে কথা বলতে হবে। রোগটির ভয়াবহতা তুলে ধরতে হবে, মানুষকে সচেতন করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে যত কথা বলা হবে ততই মানুষ জানবে, ততই সচেতন হবে। এত সহজে ভদ্রলোককে বোঝাতে পেরেছি ভেবে আমার খুব ভালো লাগল।
রবিদের বাড়ির পাশে মসজিদ। মসজিদের ইমাম হাফিজুল ইসলাম সাহেবের বয়স চল্লিশের কোঠায়। মানুষটিকে দেখলেই ভালো লাগে। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগে আছে। আমার খুব ইচ্ছে হলো ইমাম সাহেবের সঙ্গে একটু কথা বলি। এইচআইভি এইডস বিষয়টিকে তিনি কীভাবে দেখছেন একটু বোঝার চেষ্টা করি। আবার একটু ভয়ও লাগল। এসব নিয়ে কথা বললে তিনি আবার কিছু মনে করেন কি না!
আশ্চর্য ব্যাপার, ইমাম সাহেবকে দেখলাম এইচআইভি এইডস নিয়ে বেশ ভালো খোঁজখবর রাখেন। অনেকক্ষণ ধরে বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন। ধর্মীয় অনুশাসনের কথা বললেন, মানুষকে সচেতন করার কথা বললেন। জুমার নামাজের আগে খুতবার সময় তিনি নিয়মিত এইচআইভি এইডস নিয়ে কথা বলেন। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি করেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁর সচেতনতা সৃষ্টির একটি পদ্ধতি আমার খুব ভালো লাগল। তিনি প্রত্যেক মানুষকে বলে দিচ্ছেন, আপনার চারপাশের প্রতিটি পরিচিত মানুষকে এইচআইভি এইডস সম্পর্কে সচেতন করুন এবং প্রত্যেককে বলে দিন, তারা যেন প্রত্যেকে অন্তত একজন মানুষকে সচেতন করে এবং সেই মানুষকে অনুরোধ করে তার পরিচিত আরেকজনকে সচেতন করতে। এভাবে একজন থেকে আরেকজনে, আরেকজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে যাবে সচেতনতা। এ পদ্ধতিতে এগোলে অতি অল্পসময়ের মধ্যে দেখা যাবে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এইচআইভি এইডস সম্পর্কে জানছে এবং সচেতন হচ্ছে। জাতি সচেতন হলে এই ভয়ঙ্কর ব্যাধি কিছুতেই আমাদের আক্রমণ করতে পারবে না।
ইমাম সাহেবের কথা শুনে আমি মুগ্ধ। বাংলাদেশের মানুষ শিক্ষকদের কথা শোনে, বাংলাদেশের মানুষ ইমাম সাহেবদের কথা শোনে। এই দুই শ্রেণীর শ্রদ্ধেয়জনেরা যদি এইচআইভি এইডস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার ব্রত গ্রহণ করেন, তাহলে সকালবেলার আলোয় যেভাবে কেটে যায় শীতের কুয়াশা, ঠিক সেভাবে আমাদের চারপাশ থেকে কেটে যাবে যাবতীয় অকল্যাণের ছায়া।