তারপর আবার সব চুপচাপ। নদীর জল আগের মতোই স্থির হয়ে আছে। সাদা মাটির চর জলের তলায় ওঠে দাঁড়াবার জন্যে উতলা হয়ে আছে। কাশবন অবিরাম ছড়িয়ে যাচ্ছিল উষ্ণতা আর চুটপুটে শব্দ। নদীর পাড়ের ভাঙ্গনের গর্তে বাসা বেঁধে আছে। দুনিয়ার গাঙ শালিক। তাদের উড়াউড়ি আর কিচিরমিচিরের শব্দে নির্জন এলাকাটি ছিল মুখর হয়ে। কিরমান নিবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল সব। পেছনে কাশবনের ছায়া দীর্ঘ করে কখন বিকেল হয়ে যায় টের পায় না সে।
নদীপাড়ের নরম মাটিতে গাঁথা ছুরিটা টেনে তুলে লুঙ্গিতে খুব যত্ন করে মোছে জগু। তারপর বলে, আমার আতে থাকব এই ছুরিডা। আর তুমি লইবা দাওখান। তুমার কিছুই করন লাগব না। যা করনের আমিই করুম। তুমি খালি দাওডা লইয়া আমার সঙ্গে খাড়াইয়া থাকবা।
কিরমান কোনও কথা বলে না। ভেতরে ভেতরে কীরকম একটা লজ্জা খেলা করে তার। হায়রে জীবন! একটা সময় ছিল তখন ডাকাতি করতে গিয়ে কে কীভাবে কাজ করবে তা বুঝিয়ে দিত কিরমান। আর আজ তাকেই উল্টো সব বুঝিয়ে দিচ্ছে জগু।
মনটা কেমন মেন্দা মেরে থাকে কিরমানের। নদীর দিকে তাকিয়ে আবার বিড়ি বের করে।
সন্ধের মুখেমুখে মানুষের শব্দ পেল তারা। দূর থেকে কথা বলতে বলতে আসছিল দুতিনজন। সেই শব্দ পেয়েই ছুরি হাতে ঘাসফড়িংয়ের মতো লাফ দিয়ে ওঠল জগু। ফিসফিস করে বলল, গুরু আইতাছে। মুখে নদীর স্রোতের মতো উত্তেজনা ছিল তার। দেখে কিরমান খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, যা তুই রেকি কইরা আয়।
হ যাইতাছি, বলে শেয়ালের মতো গুঁড়ি মেরে, নিঃশব্দে কাশবনের ভেতর মিলিয়ে যায় জগু। জগু চলে যাওয়ার পর কেমন একটা একাকিত্ব চারদিক থেকে চেপে ধরে কিরমানকে। ডাকাতি করতে এসে এই প্রথম তার বুকের ভেতর রজতরেখার মতো একটা ভয় মাথা ঠেলে উঠতে চায়। হাত-পা কেমন অবশ লাগে। নিজেকে মনে হয় প্রাচীন কালের বটবৃক্ষের মতো। অনন্তকাল ধরে যেন শেকড়বাকড় নামিয়ে দিয়ে এই নদীতীরে বসে আছে। এই সময় চোখেমুখে বিশাল উত্তেজনা নিয়ে ফিরে আসে জগু। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, ওড গুরু। কাম অইয়া গেছে। বেপারি আইতাছে একজন। কোমরের বান্দা তফিলডা পিরনের ফাঁক দিয়া দেহা যায়।
কিরমান ঠাণ্ডা গলায় বলল, একলানি?
না লগে আর দুইজন আছে। আরে হেতে কী! তুমার চেহারা আর আমার ছুরি দেকলে দেইখোনে বেপারিরে হালাইয়া কেমতে আর দুইজন দৌড় দেয়।
কিরমান দুহাতে মাটি ভর দিয়ে দাঁড়ায়। তারপর দাটা হাতে নিয়ে পা টেনে টেনে জগুর পেছনে হাঁটে।
চিরল পথটার কাছাকাছি এসে কাশবনের আড়ালে নিঃশব্দে ওঁৎ পাতে দুজন মানুষ। জগু ফিসফিস করে বলল, আমি পয়লা গিয়ে সামনে খাড়ামু। তারবাদে তুমি।
কিরমান কথা বলে না। শুধু মাথাটা একবার নাড়ে।
লোকগুলো কাছাকাছি চলে এলে গরু জবাই করার আধহাত লম্বা ছুরিটা হাতে লাফ দিয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল জগু, যা আছে দিয়া দেও। চিইক্কর মারবা না।
কিরমান আড়ালেই দাঁড়িয়েছিল। হাত-পা কেমন অসাড় লাগছে তার। নড়াচড়া করবে, শরীরে বল পায় না কিরমান। কাশবনের ফাঁকফোকর দিয়ে তাকিয়ে দেখে তিনজন লোক উদ্যত ছুরি হাতে জগুকে সামনে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বেপারির মতন লোকটা দুহাতে চেপে ধরেছে তার কোমরে বাধা তহবিলটা।
জগু আবার বলল, দেও। হবিরে দেও নাইলে ছুরি হান্দাইয়া দিমু। বলে বেপারি মতন লোকটার কোমরের দিকে একটা হাত বাড়িয়েছে সঙ্গে সঙ্গে দুপাশের দুজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। মুহূর্তে জগুর হাতের ছুরিটা ছিটকে পড়ল মাটিতে। লোক দুটো কায়দা করে ফেলল জগুকে। দেখে বেপারি মতন লোকটা পাল খাওয়ার অপেক্ষায় থাকা গরুর মতন গলা খুলে চেঁচাতে লাগল, ডাকাইতে ধরছে, ডাকাইতে ধরছে। আউগগারে ডাকাত ধরছে। জগুকে নিয়ে অন্য দুজন তখন মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কিরমান বুঝতে পারল সুবিধা করতে পারছে না জগু। এখন তার সামনে গিয়ে। দাঁড়ানো উচিত। দা হাতে ঐ চেহারার আরেকজনকে দেখলে লোকগুলো কাবু হয়ে যাবে।
কিন্তু কিরমানের পা চলে না। শরীরটা অবশ লাগে। বুকের ভেতর কেমন কেমন করে। তখন হঠাই বাইন মাছের মতো পিছলে গেল জগু। তারপর লাফিয়ে ওঠে কাশবন পাথালে ছুটতে শুরু করলো। ঐ ডাকাইত যায়, ধর ধর বলে লোক তিনটেও ছুটতে শুরু করে জগুর পেছন পেছন। দা হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে কিরমান। বুক কাঁপিয়ে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার।
খরা কিংবা বৃষ্টির পরে
তারপর একদিন বৃষ্টি নামল। বিকেলবেলা। দুপুরের পর সারা আকাশ জন্ডিস রোগীর চোখের রঙ ধারণ করেছিল। মাটি থেকে আকাশসীমা পর্যন্ত জমেছিল কুয়াশার মতো পাতলা ধুলার একটা রেখা। গাছের পাতায় কাঁপন তোলার মতো হাওয়া ছিল না। কোথাও। দেশজুড়ে চলছে প্রচণ্ড খরা। শীতকাল শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছে। এখন জুন মাস যায়, তবুও প্রতিদিন সূর্যের তেজ বেড়ে চলেছে। গুলি খাওয়া বাঘের মতো রোদ গোত্তা খেয়ে বেড়ায় সারা দেশে। উত্তরবঙ্গে মাইল মাইল শস্যের মাঠ রোদে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে আসছে খরায় শস্যনাশের খবর। খবরের কাগজগুলো হুমড়ি খেয়ে লিড হেডিঙে ছেপে দিচ্ছে সেই খবর। দেখে দেশবাসীর মাথায় প্রতিদিন একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছে তীব্র রোদ। উষ্ণতায় হাঁসফাঁস করছে মানুষ। তবু বেঁচে থাকার নেশায় দিগ্বিদিক ছুটছে।