না, সেই রাজাকারও পরে পার পায়নি। শহীদের সহযোদ্ধারা ধরে ফেলে তাকে তারপর ছিন্নভিন্ন করে সেই স্টেনগানের গুলিতেই।
*
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের পরিবারটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা যেন একেক জন একেক দিকে ছড়িয়ে পড়ি। আমি আমার মা আর তিন বোন কোন রকমে নানার বাড়ি মোহগঞ্জে চলে আসি। তাও দু তিন বারে। বড় দুই বাই তখনো নিখোঁজ। এর মধ্যে বড় ভাইকে আর্মী ধরে নিয়ে গেল। সব মিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা। ছোট ছিলাম বলে ঘটনার ভয়াবহতাটা অতটা ধরতে পারিনি।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি আর আমার ছোট মামা মাহাবুবুন্নবী শেখ (আমারই বয়সি) মোটমোটি বাউণ্ডুলে হয়ে গেলাম যেন। পড়াশুনা নেই। শুধু ঘুরে বেড়ানো। আশপাশের শূন্য হিন্দু বাড়িগুলো ঘুরতাম। বেশীর ভাগ হিন্দুরাই তখন পালিয়ে গেছে ভারতে। এর মধ্যে আমার এক শিক্ষক মামা প্রস্তাব করলেন আমার আর ছোট মামার স্কুলে যাওয়া দরকার। ছোট মামা আগে থেকেই ঐ স্কুলে পড়ে আর আমাকে ভর্তি করানো হবে। আমি তখন আরেক মামার সঙ্গে লবিং করলাম যে এখন স্কুলে যাওয়া মানেতো রাজাকার হওয়া। আমার কি স্কুলে যাওয়া ঠিক হবে মামা? মামা আমার সঙ্গে একমত পোষণ করলেন। তিনি আমার পক্ষ নিয়ে ফাইট দিলেন। আমাকে আর স্কুলে যেতে হল না।
তবে অন্যরকম এক স্কুলে যে শিক্ষা নিতে শুরু করলাম দুই মামা ভাগ্নে। একদিনের ঘটনা মনে আছে; দুজন এক জঙ্গলা পুকুর পারের বিশাল জাম গাছে উঠেছি। জাম গাছ ভর্তি পাকা টসটসে জাম ঝুলছে (তখন সব গাছেই প্রচুর ফল-ফলারী হয়েছিলো খাওয়ার লোক ছিল না) তো আমরা দুজন মগ ডালে উঠে জাম খাচ্ছি হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। মুক্তিবাহিনী থানা এ্যটাক করেছে। তখন প্রায়ই এ্যাটাক হত। নিচে তাকিয়ে দেখি পিল পিল করে আর্মী ছুটছে তখন তারা যদি একবার উপরের দিকে তাকাত তাহলে নির্ঘাত গুলি করে ফেলে দিতো আমাদের। একসময় গোলাগুলি চরম আকার দারণ করল বাতাসে শীষ কেটে গুলি ছুটছে আমরা দুজন জাম গাছে আঠার মত সেটে রয়েছি। সে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। একসময় দেখি আর্মী পিছু হটছে। মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসছে। গাছ থেকে বসে আমরা দুজন পুরো একটু যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করলাম যেন। পরে যুদ্ধ থামলে বাসায় ফিরে এসে এই ঘটনা কাউকে বলিনি।
*
আরেকটা ঘটনা বলা যেতে পারে। এটাও রোমাঞ্চকর। নানার বাড়ির সামনেই ছিল একটা খাল। সেই খালে নানাদের একটা ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকা ছিল। সেই নৌকা করে আমি আর ছোট মামা প্রায়ই এদিক সেদিক বেরিয়ে পড়তাম। একদিন দুজনে বেড়িয়েছি। বহুদূর চলে গেছি কোথাও কেউ নেই। নিরিবিলি নিশ্চুপ প্রকৃতি… হঠাৎ কানের কাছে গম গম করে উঠল মেশিন গানের শব্দ। খুবই কাছে আমাদের ধারণা হল মুক্তি বাহিনী আবার থানা এ্যাটাক করেছে। থানায় তখন আর্মীদের ঘাটি। আমরা দ্রুত নৌকা ঘুরিয়ে বাইতে লাগলাম। তখন আবার জোয়ার শুরু হয়েছে, উল্টো দিকে যেতে হচ্ছে আমাদের। জান দিয়ে বৈঠা মারছি কিন্তু নৌকাতে আগায় না। আর কি কারণে হুর হুর করে পানি উঠছে নৌকায়। সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। মামা বলল, ‘পানিতে লাফ দাও’। দুজনেই লফিয়ে পড়লাম পানিতে, নৌকা উল্টে গেল। সাঁতরে কোন মতে পাড়ে এসে প্রায় ক্রলিং করে (কারণ উপর দিয়ে তখন ক্রস ফায়ার শুরু হয়ে গেছে। নিরাপদ জায়গায় সরে আসলাম। পরে যুদ্ধ থামলে উল্টানো নৌকা উদ্ধার করা হল।
এইতো কিছুদিন আগে আমরা কয়েক ভাইবোন গিয়েছিলাম মোহনগঞ্জে নানাবাড়িতে বেড়াতে। গিয়ে দেখি সেই বিশাল খালটি চুপশে ছোট হয়ে গেছে। আমি লাফ দিয়ে পার হলাম খালটা অথচ কি আশ্চর্য ১৯৭১ সালে এই খাল দিয়ে আমি আর ছোট মামা নৌকা করে এ্যাডভেঞ্চার করে আসছিলাম…মুক্তি বাহিনী আক্রমণ করলে নৌকা ডুবে গেল, সাঁতরে পারে এলাম; সেই খালের এই অবস্থা। কি অদ্ভুত!
*
এই ফাঁকে একটা প্রায় ভৌতিক অভিজ্ঞতার বলা কথা বলা যেতে পারে। আমি আর ছোট মামা যখন পরিত্যক্ত শূন্য হিন্দু বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে বৈড়াতাম তখন একটা ভয়াবহ ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। মামা আর আমি লটকন গাছে চড়ে মিষ্টি পাকা লটকন খেয়ে একটা হিন্দু বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছি। সময়টা দুপুরের কিছু পরে তবে মেঘলা দিন বলে সন্ধ্যা সন্ধ্যা ভাব। আশে পাশে কেউ নেই। মামা আগে আগে হাটছে আমি বেশ খানিকটা পিছে, হঠাৎ একটা খস খস শব্দ চেয়ে দেখি… আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম মানে পা যেন আটকে গেল মাটিতে। দেখি দু পায়ে একটা কুকুর হেঁটে আসছে আমার দিকে তার শরীরের পিছনের অর্ধেকটা নেই। সামনের পা দুটি দিয়ে হেঁটে আসছে অনেকটা মানুষের মত… আমি মামা বলে চিৎকার করলাম। গলা গিয়ে আওয়াজ বেরুল না। মামা কি বুঝলো ছুটে এল, ‘কি হয়েছে?’
কি হয়েছে আমি আর বলতে পারি না। মামা তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরে ছুটল বাড়ির দিকে। আর কি আশ্চর্য ফেরার পথে তখন আর কুকুর টুকুর কিছু দেখলাম না।
পরে অবশ্য রহস্য ভেদ হয়েছিল। ঐ কুকুরটা থানায় ঢুকে পড়লে মিলিটারীরা গুলি করে তার পিছনের অংশ ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। এ অবস্থায় সে অনেকদিন বেঁচে ছিল। সামনের পা দিয়ে হাঁটতো।