- বইয়ের নামঃ নিষাদ
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- সিরিজ বইঃ মিসির আলী
- প্রকাশনাঃ প্রতীকপ্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ ভূতের গল্প, উপন্যাস, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছেন
মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছেন। রোগী লম্বা এক জন মানুষ। মুখ দেখা যাচ্ছে না, কারণ লোকটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই গরমেও ফুল হাতা ফ্লানেলের শার্ট, ফুলপ্যান্টটি চকচকে কাপড়ের তৈরী; ছাঁটের ধরন দেখে মনে হয় সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মার্কেট থেকে কেনা। এ ধরনের ছাঁটের প্যান্ট ঢাকায় এখন চালু নেই। পায়ের জুতা জোড়া ঝকঝকি করছে। মনে হচ্ছে এখানে আসবার আগে জুতা পালিশ করেছে। মিসির আলি লোকটির বয়স আন্দাজ করবার চেষ্টা করলেন। কুড়ি থেকে পাঁচিশের মধ্যে হবার কথা। এই বয়সের যুবকদের চেহারায় এক ধরনের আভা থাকে। যৌবনের আভা। এর তা নেই। অল্প বয়সে চুলও পৌঁকেছে বলে মনে হচ্ছে। কানের পাশে রুপোলি ছোঁয়া। মিসির আলি বললেন, আপনি কি আমার কাছে এসেছেন?
সে জবাব দিতে দেরি করছে। যেন এই প্রশ্নের জবাব তার জানা নেই। মিসির আল মুদ্র করেন, আপনি কি আমার কাছে এসেছেন?
জ্বি।
আপনি মনে হয় আগেও কয়েক বার এসেছিলেন?
জ্বি।
এক বার একটি চিঠি লিখে গিয়েছিলেন, তাই না? লিখেছিলেন-সোমবার সন্ধ্যায় আসব।
জ্বি স্যার।
আমি কিন্তু সোমবার সন্ধ্যায় আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আপনি আসেন নি।
একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল স্যার।
লোকটি খুব সহজেই স্যার বলছে। তার মানে ছোট কোনো চাকরি করে। অফিসের প্রায় সবাইকে বোধহয় স্যার বলতে হয়, যে-কারণে এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। খারাপ অভ্যাস। মিসির আলি বললেন, আপনি কী করেন?
সামান্য একটা কাজ করি। বলার মতো কিছু না।
আসুন। ভেতরে আসুন।
আজ যাই স্যার। আরেক দিন আসব।
মিসির আলি অত্যন্ত অবাক হলেন। এই লোকটি বারবার তাঁর খোঁজে আসছে, চিঠি লিখে যাচ্ছে। আজ দেখা হল, কিন্তু সে থাকতে চাচ্ছে না। মনের ভেতর বড় রকমের কোনো দ্বিধার ভাব আছে, যা সে কাটাতে পারছে না। মিসির আলি বললেন, আপনি চলে যেতে চাচ্ছেন, চলে যাবেন। কিছুক্ষণ বসে যান। আমার কাছে কেন এসেছেন, সেটা বলুন।
অন্য আরেক দিন আসব।
সেদিন হয়তো আমাকে পাবেন না। আমি বাসায় খুব কম থাকি। আমার অনেক ঝামেলা।
লোকটি খুবই অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে ঢুকল। জুতা জোড়া নিয়ে একটু চিন্তা করছে। খুলে ফেলবে কি ফেলবে না। মিসির আলি লক্ষ করলেন, লোকটি নিজেই বসার ঘরের দরজা বন্ধ করছে। ছিটিকিনি লাগানোর চেষ্টা করছে। এটাও হয়তো তার অভ্যাস। সে খুব সম্ভব তার ঘরে ঢুকেই ছিটিকিনি লাগিয়ে দেয়। তাই যদি হয়, তাহলে লোকটি থাকে একা। যে বাড়িতে অনেকগুলি মানুষ থাকে, সে-বাড়ির কেউ ঘরে ঢুকেই ছিটিকিনি লাগানোর অভ্যাস করবে না।
মিসির আলি বললেন, এ-বাড়ির ছিটিকিনি লাগানের একটা বিশেষ কায়দা আছে। আপনি পারবেন না। আপনি বসুন, আমি লাগাচ্ছি।
লোকটি বসল। বসার ভঙ্গি বিনীত। হাত মুঠি করে কোলের উপর রাখা। ঈষৎ কুঁজা হয়ে বসেছে। গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। অতিরিক্ত ফর্সা হবার কারণেই বোধহয় চেহারায় খানিকটা মেয়েলি ভাব চলে এসেছে। অবশ্যি এটা জোড়া ভুরু ও পাতলা ঠোঁটের কারণেও হতে পারে। এই ধরনের ছেলেদেরকেই স্কুলে সবাই মেয়ে বলে খেপায়। এবং উচু ক্লাসের কিছু বখা ছেলে বিশেষ কারণে এদের বন্ধুত্ব কামনা করে।
মিসির আলি বললেন, আপনার নাম কি? লোকটি জবাব দিল না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এখন সে তাকৃচ্ছে জানালা দিয়ে। মিসির আলি অবাক হয়ে శ్యా বলতে কি আপনার আপত্তি আছে?
জ্বি-না।
তাহলে নাম বলুন। নাম দিয়েই শুরু করা যাক।
আমার নাম রইসুদ্দিন।
শুধু রইসুদ্দিন! নাকি রাইসুদিনের সঙ্গে অন্য কিছু আছে?
মোঃ রইসুদ্দিন।
দেখুন ভাই, আপনি কিন্তু ঠিক নামটা বলছেন না। মিথ্যা কথা বলায় যারা অভ্যস্ত নয়, তারা যখন মিথ্যা বলে, তখন তাদের গলা কোঁপে যায়। খুব দ্রুত চোখের পাতা পড়ে এবং খানিকটা ব্লাশ করে। আপনার বেলায় এর সব কটি হয়েছে।
আমার ভালো নাম মুনির ডাক নাম টুলু।
চা খাবেন?
দ্বি স্যার, খাব।
আপনি আরাম করে বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি। ঘরে কাজের কোনো লোক নেই। সব আমাকেই করতে হবে। আপনি আমার কাছে কি জন্যে এসেছেন তা এখন বলবেন? না চা খেয়ে বলবেন?
স্যার আমি খুব বিপদে পড়েছি।
বিপদে পড়লে লোকজন যায় পূরণের কাছে আমার কাছে কেন? আমি তো পুলিশ নই।
অন্য রকম বিপদ। আপনি না শুনলে বুঝবেন না। আগে শুনতে হবে।
বেশ শুনছি, তাতে লাভ হবে কি?
আপনি অনেকের অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন–আমি অনেক কিছু আপনার সম্পর্কে শুনেছি।
শুনেছেন, খুব ভালো কথা। কী শুনেছেন, জানি না। তবে আপনাকে আগেভাগেই বলে রাখি, আমার দৌড় খুব সামান্য। আমি অ্যাবনরমেল সাইকোলজি নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছি–এই পর্যন্তই।
মুনির মাথা নিচু করে বসে আছে। কোনো কথা সে শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। মিসির আলি বললেন, আপনার বাসা কোথায়?
মুনির তার জবাব দিল না। মাথা নিচু করে ফেলল। অর্থাৎ সে তার ঠিকানা জানাতে ইচ্ছুক নয়। মিসির আলি চাবানাতে গেলেন। ঘরে কোনো খাবার নেই। বিঙ্কিটটিঙ্কিটজাতীয় কিছু দিতে পারলে ভালো হত। লোকটি ক্ষুধার্তা। হয়তো অফিস শেষ করে সরাসরি চলে এসেছে। কিছু খাওয়া হয় নি। কিংবা বিকেলে কিছু খাবার মতো সামৰ্থ্য নেই। এটি হওয়াই স্বাভাবিক। নিম্ন আয়ের মানুষরা এ-দেশে পশুর জীবনযাপন করে।