পরে জানা গেল জাহাজের প্রায় সব যাত্রীই ছিল সিভিল ড্রেসে পাকিস্তানী আর্মী। যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান। ষড়যন্ত্রের শুরু…!
*
এই গল্পটাও এক মুক্তিযোদ্ধার কাছে শুনেছিলাম। তিনি তখন মাত্র ইন্টার পাশ করেছেন। চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধে। অনেক সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। একবার এক যুদ্ধে তারা জীবিত অবস্থায় চারজন পাকআর্মী ধরে ফেললেন। ঠিক করা হলো এদের সবাইকে জবাই করে মারা হবে। কারণ গুলি নষ্ট করে লাভ নেই, এমনিতেই গোলাবারুদ কম। এক জঙ্গলের ভেতর ওদের লাইন করে দাঁড় করানো হলো। একজন একজন করে ডাকা হলো। প্রথম তিনজন বেশ সাহসীকতার সাথে এগিয়ে এসে গলা পেতে দিল, তাদের জবাই করা হল। কিন্তু চতুর্থজন যথেষ্ট তরুণ এবং প্রচন্ড ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার একটু থমকে গেলেন তার কান্নাকাটিতে। তিনি তখন এক অদ্ভুত প্রস্তাব করলেন- “ঠিক আছে যাও, দশ পর্যন্ত গুনব এর মধ্যে তুমি দৌড়ে যদি আমাদের গুলির রেঞ্জ থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারো তাহলে বেঁচে যাবে।”
তিনি বললেন–“এক…”। তরুণ পাক আর্মী ছুটতে লাগল… মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আর দুই বললেন না। তাকে পালাতে দিলেন।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে প্রচন্ড যুদ্ধের মধ্যেও মাঝে মাঝে মানবিক আচরন এটা তার জ্বলন্ত উদাহরন।
*
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কথা আমরা সবাই জানি। মাত্র সতেরো বছরের এই তরুণ (কিশোরই বলা উচিৎ) দেশ মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। নিজ হাতে দুটি গ্রেনেড ছুঁড়ে দিয়ে পাকিস্তানীদের দুটি মেশিনগান পয়েন্ট উড়িয়ে দিয়ে সেই মেশিনগানের গুলিতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন নিজে। বলা হয়ে থাকে তিনিই পৃথিবীর সবচেয়ে কম বয়সী সবচেয়ে বড় পদক পাওয়া দেশের জন্য আত্মউৎসর্গীকৃত প্রাণ। তার একটি ঘটনা আমরা অনেকেই জানিনা। যেটা আমি জানতে পেরেছিলাম তার উপর মুক্তিযুদ্ধের কমিকস করতে গিয়ে লেঃ কর্ণেল (অবঃ) বীর প্রতিক সাজ্জাদ জহীরের কাছ থেকে। যে ঘটনাটি হামিদুরকে দেশ মাতৃকার জন্য উজ্জীবিত করেছিলো প্রথম।
হামিদুর তখন চট্টগ্রামে বিডিআরের ট্রেনিং ক্যাম্পে (ইবিআরসি) ছিলেন। একপর্যায়ে পাকিস্তানীদের হামলায় তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তখন তাদের হাতে কোন অস্ত্র ছিলোনা। ঘুমিয়ে ছিলেন সবাই। সেই সময় হামলা করে বর্বর পাক আর্মি। হামিদুরও অন্য কয়েকজনের সঙ্গে পালাচ্ছিলেন। তখন ভোর হয়ে আসছিলো। হঠাৎ দেখেন পাঁচিলের ধারে একটা ড্রেনে তাদেরই একজন (তিনি চিনতে পারেননি) একটা স্টেনগান হাতে লুকিয়ে আছে। এই সময় একদল পাক আর্মি এগিয়ে আসছিলো। আর কি আশ্চর্য সেই নাম না জানা তরুণ হঠাৎ স্টেনগান হাতে ড্রেন থেকে লাফিয়ে উঠে ওদের লক্ষ্য করে গুলি করতে লাগলেন। হামিদুর দেখলেন ততক্ষনাৎ ছয়জন পাক আর্মি মাটিতে পড়ে গেলো। আর বাকিরা উপায় না দেখে ছুটে আসতে লাগলো সেই বিক্ষুব্ধ রাগী তরুণের দিকে। তরুণের স্টেনগানের গুলি তখন শেষ। তারা ঘিরে ফেরলো তাকে। এরপর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারলো হামিদুরের চোখের সামনে। হামিদুর আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলেন সেই তরুণের মুখটি, একবিন্দু ভয় সেখানে ছিলো না। এই ঘটনাটিই সেই মুহূর্তে তার ভিতরে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয়… তিনি ছুটে যান রণক্ষেত্রে… দেশ মাতৃকার জন্য প্রাণ দিতে।
*
২০১১ এর বইমেলায় চা কর্নারে দাঁড়িয়ে বিকেলের দিকে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি একটু দূরে মিতিল আপা দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছেন একা একা। আমার সঙ্গে এই প্রজন্মের কয়েকজন তরুণ-তরুণী ছিলেন, তাদের বললাম “উনাকে চেন?”
— কাকে?
— ঐ যে নীল শাড়ি পরা মহিলা চা খাচ্ছেন?
— না উনি কে?
— উনাকে দেখে কি মনে হয়?
— আর দশটা সাধারণ বাঙালী মহিলা যেমন হয়, তাই… হয়তো বই কিনতে এসেছেন…
আমি খেয়াল করলাম তরুণদের গলায় তেমন কোনো আগ্রহ নেই ঐ দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক সামান্য নারীর জন্য। আমি তখন বোম ফাটালাম। বললাম- “উনি সামান্য কোন নারী নন। অসাধারণ এক মহিয়সী নারী। ১৯৭১ এ ছেলেদের মতো করে চুল কেটে ছেলেদের ড্রেস পরে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, কেউ বুঝতেই পারেনি।”
— ‘বলেন কি?’ আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে সবগুলো তরুণ তখনই ছুটে গেলো তার কাছে অটোগ্রাফ নিতে। আমি দূর থেকে লক্ষ্য করলাম মিতিল আপা বিব্রত ভঙ্গিতে কঁপা হাতে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তার কেমন লাগছিলো জানিনা। আমার ভালো লাগছিলো তরুণদের এই তাৎক্ষনিক আবেগটা। তারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা একজন অসাধারণ মুক্তিযযাদ্ধাকে পেল তাইবা ক’জন পায়! (মিতিল আপার ছোট বোন সুচী আপা আমার বোনের বান্ধবী সেই সূত্রে তাকে চিনি)
*
দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযযাদ্ধারা ফিরে আসছে নিজ নিজ এলাকায়। এক মুক্তিযোদ্ধা দলছুট হয়ে নিজের গ্রামের পথ ধরেছে। বাড়ির কাছে চলে এসেছে প্রায়। কতদিন পর বাড়ি ফেরা বাড়ির কাছে ছিলো ছোট একটা খাল। কি মনে করে কাঁধের স্টেনগানটা নামিয়ে রেখে নেমে গেলো খালে। হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে মুখ ধুলো। হয়তো খুব ভালো লাগছিলো, ছেলেবেলায় কত না সাঁতরেছিলো এই খালে। কিছুক্ষণ বাদে উঠে এলো। কিন্তু একি… তার অস্ত্র কোথায়? যেখানে স্টেনগানটা রেখেছিলো সেখানে সেটা নেই। তাকিয়ে দেখে তার অস্ত্র তার দিকেই তাক করে আছে এক লোক। সে চিনতে পারলো এই এলাকার রাজাকার…।