*
এবার আমার নিজের জীবনের কিছু ঘটনা বলি। আমার বয়স এখন ৫২ (২০১০ইং) চলছে। হঠাৎ মরে টরে গেলে এই গল্পগুলো হয়ত কারো জানা হবে না। বরং তরুন পাঠকদের সঙ্গে একটু শেয়ার করি।
এই কিছুদিন আগে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখে চমকে উঠলাম। এতো আমার জীবনের ঘটনা। অ্যাডটা ছিল এরকম… পাক আৰ্মী আক্রমন করেছে সবাই পালাচ্ছে। নদী পার হতে হবে। নৌকায় জায়গা হচ্ছে না বলে ছোটভাইকে রেখে বড়রা সবাই নদী পার হচ্ছে। আর্মীরা আসলে ছোটজনকে নিশ্চয়ই মারবে না… এইরকম একটা ঘটনা নিয়ে কোন একটি মোবাইল ফোন কোম্পানির অ্যাড!
এবার আমার জীবনের ঘটনাটা বলি। ১৯৭১ সালে আমি সিক্সে পড়ি। জায়গাটা ময়মনসিংহের কোন এক জায়গায়। মামা আর আরও কয়েকজনের সঙ্গে যাচ্ছিলাম ভারতের মহেষখালি ক্যাম্পে। হঠাৎ ওই অ্যাডের মত পাক আর্মী গুলি করতে করতে ছুটে আসছিলো। আমরা সবাই ছুটছিলাম। পিছনে গুলির শব্দ আর আমরা সরু একটা পথ ধরে ছুটছি। হঠাৎ সামনে পড়ল একটা বড়সড় খাল। ওটা পার হতে হবে। কোন নৌকা নেই। কি করা? সবাই ভয়ে অস্থির। আমিও প্রচন্ড ভয় পেয়েছি। কি করব আমরা এখন? এদিকে গুলির শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। হঠাৎ আমাদের দলের একজন কোত্থেকে ছোট কলাগাছের একটা ভেলা নিয়ে এল। মুশকিল হচ্ছে ওই ভেলায় তিনজনের বেশী ওঠা যায় না। একজন ভেলা বেয়ে নিয়ে যাবে তারপর ফিরে আসবে আবার দুজনকে নিয়ে যাবে। এই করে পার হতে হবে একে একে। আমি ভয়ের চোটে ভেলায় উঠে পড়লাম সবার আগে। আমাকে নামিয়ে দেয়া হলো। বলা হল “তুমি সবার পড়ে আস তুমি ছোট তোমাকে মারবে না আর্মীরা”। (ওই অ্যাডের মতই!) আমি রইলাম। তিনজন রওনা হয়ে গেল। সময় যেন আর যায় না। তিনবারে তিন গ্রুপ পার হল। ওদিকে গুলির শব্দ আর মানুষের আর্তচিৎকার ক্রমে ক্রমেই এগিয়ে আসছে। জীবনে এত ভয় আর কখনো পাইনি। সবার শেষে এল আমার পালা কোনমতে পার হলাম। তারপর দে ছুট…। পরে শুনেছিলাম আমাদের পিছনের গ্রামে ম্যাসাকার করেছিল ওরা। খাল পর্যন্তও এসেছিল কিন্তু খালটা আর পার হয়নি তারা।
*
হুলার হাট থেকে একটা দোতলা লঞ্চে করে আসছিলাম। ঠিক কোথায় যাচ্ছিলাম এখন আর মনে নেই তবে সম্ভবত ঢাকার দিকেই। সঙ্গে ছিল আমার পিঠাপিঠি বড়বোন শিখু আর এক মামা আর মামী। আমরা তখন পিরোজপুর থেকে ভাগে ভাগে পালাচ্ছিলাম। পিরোজপুরে আমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে তখন হুলিয়া ছিল। আমার বাবাকে পাক আর্মীরা ইতিমধ্যে হত্যা করেছে, আমরা অবশ্য জানতাম না। আমাদের ধারনা ছিল তাকে পাক আমীরা ধরে নিয়ে গেছে। আসলে তাকে ৫মে হত্যা করা হয়। আমাদের গন্তব্য তখন, ময়মনসিংহ নানার বাড়ি। তখন বেশীরভাগ রুটই বন্ধ লঞ্চে করে ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহ যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই।
একটা ঘাটে লঞ্চে কিছু আর্মী উঠল। লঞ্চ চলছে। তারা লঞ্চে টহল দিচ্ছে। সবার হাতে অস্ত্র। লঞ্চের বেশীরভাগ মেয়েরাই বোরখা পরা। আমার বোনের তখন কিশোরী বয়স। সে অবশ্য বোরখা পড়া ছিল না। মামী বোরখা পড়া ছিলেন। আমরা ছিলাম দোতলার ডেকে।
হঠাৎ শুনতে পেলাম নিচতলায় হৈচৈ। তারপর ঝপাৎ পানিতে কিছু পড়ার শব্দ। তার পর গুলির শব্দ… আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। একটু পরে সব জানতে পারলাম…।
নিচে পাক আর্মী টহল দিচ্ছিল। তখন এক বোরখা পরা তরুণীকে উঠতে বলল তারা। তরুণী উঠে দাঁড়ালে তাকে বলল আর্মীদের সাথে তাকে কেবিনে যেতে হবে। তরুণীর বাবা বিপদ বুঝতে পারলেন। প্রথমে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলেন তারপর যা করলেন তা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। তিনি হঠাৎ আর্মীদের ধাক্কা দিয়ে ফেলে তাদের অবাক করে দিয়ে মেয়েকে জাপটে ধরে পানিতে লাফিয়ে পড়লেন। সেই শব্দই আমরা পেয়েছিলাম। আর্মীরা তখন এলোপাথারী গুলি করল পানিতে কিন্তু লাভ হয়নি। সে যাত্রা তারা বেচে গেলেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
অন্ততঃ যারা ওখানে ছিল তারা পরে বলল তারা দেখেছে মেয়ে আর বাবা ভাসতে ভাসতে দূরে সরে গেছেন। লঞ্চ খুব দ্রুত চলছিল বলে রক্ষা। তবে আর্মীরা লঞ্চ থামিয়েছিল, তবুও লাভ হয়নি কিছুই। বাকি রাস্তা আমরা জান হতে নিয়ে চললাম ঢাকার দিকে।
সাহসী সেই বাবা আর মেয়েকে; আজ এত বছর পর গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
*
আমাদের এক আত্মীয়া। লেখালেখি করেন। তার বেশ কিছু বইও আছে। ভাল লিখেন। তিনি অবশ্য মারা গেছেন। ১৯৭০ সালে তারা ছিলেন পাকিস্তানে, তার স্বামী ছিলেন পাকিস্তান পর্যটনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (পরে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের পর্যটনের প্রধান হয়েছিলেন)। তারা তখন ঢাকায় বদলি হয়েছেন। তারা ঠিক করলেন দেশে ফিরবেন জাহাজে। একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে। তারপর এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনে তারা জাহাজে করে রওনা দিলেন। বিশাল পাকিস্তানি জাহাজ। মধ্য সমুদ্রে সেই জাহাজ হঠাৎ ঝড়ে পড়ল। প্রচন্ড ঝড়। জাহাজ এই ডুবে তো ওই ডুবে। জাহাজে তখন এক পাকিস্তানী কর্ণেল ছিল সিভিল ড্রেসে। সে সোজা গিয়ে জাহাজের ক্যাপ্টেনকে হুকুম করল- “যে কোন ভাবেই হোক জাহাজকে আশেপাশের কোন এক দেশের পোর্টে ভিরাও, কারন জাহাজ ভর্তি আর্মস অ্যামুনেশন আছে।” জাহাজের ক্যাপ্টেন হতভম্ব! “কি বলছেন? এটাতো যাত্রীবাহি জাহাজ, এখানে অস্ত্র গোলাবারুদ থাকবে কেন?”