*
একাত্তর পাবলিক বাস যাচ্ছিল। হঠাৎ পাকিস্তানী আর্মী চেকপোস্টে থামানো হলো বাসটি। যাত্রীদের সবাইকে নামালো। অবশ্য তখন যাত্রীও খুব বেশী ছিল না। সবাইকে রাস্তার অন্যপাশে পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো হল। এক লোকের কোলে ছিল একটা দুধের বাচ্চা। বাচ্চাটি একটু পর পর না বুঝে দাঁতহীন মারি বের করে হাসছিল। পাক আমীর এক অফিসার সোলজারকে ডেকে কি বলল। সোলজারটি বাচ্চা কোলে লোকটিকে সরিয়ে দিল। তারপর কি আশ্চর্য সারি বদ্ধ লোকগুলো অবাক হওয়ারও সময় পেল না। গুলি শুরু হয়ে গেল। মুহূর্তে সবাই শেষ। বাচ্চা কোলের লোকটি ভাবল সে কি তবে তার বাচ্চার মিষ্টি হাসির কারনে বেঁচে গেল?
না, ঘটনা আরও বাকি ছিল। এর পর লোকটির কোল থেকে বাচ্চাটিকে কেড়ে নিয়ে নেয়া হল। লোকটিকে মারা হল বেয়নেট চার্জ করে আর বাচ্চাটিকে? … না এটা লেখার ভাষা আমার নেই। শুধু একটা ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সেগুন বাগিচা মুক্তিযুদ্ধ যাদু ঘরে একটা ছোট বাচ্চার পোশাক আছে (আমি যে বাচ্চাটির কথা লিখেছি সেই বাচ্চার পোষাক এটি নয়) সেই ছোট্ট শিশুটিকে পাক আর্মীরা কিভাবে হত্যা করেছিল তার বর্ণনা সেখানে আছে…!
*
এ ঘটনাটি শুনেছি দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা কচি ভাইয়ের কাছে। গত বছর (২০০৯ইং) তিনি মারা গেছেন। খুব ভালো একজন মানুষ ছিলেন। তিনি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা তা কখনওই বড় গলা করে বলতেন না। আশ্চর্য এক মানুষ। তার কাছেই শুনেছি ঘটনাটি। তবুও’র পাঠকের সাথে শেয়ার করি…
সম্মুখ যুদ্ধে হঠাৎ একজন মুক্তিযোদ্ধা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। পাক আর্মীরাও তার দিকে তেড়ে এল দল বেঁধে। মুক্তিযোদ্ধা কোন উপায় করতে না পেরে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। পাক আর্মীরা ঘিরে ফেলল সেই বাড়িটি। এখন উপায় কি? বাড়ির মালিক এক বৃদ্ধ মা আর তার বোবা অসুস্থ্য পুত্র। মা যে কাজটি করলেন তা শুধু বাংলাদেশের একজন দেশপ্রেমিক সাহসী মায়ের পক্ষেই সম্ভব। তিনি মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে অস্ত্রটি কেড়ে নিয়ে তার বোবা ছেলের হাতে ধরিয়ে ঠেলে বের করে দিলেন বাসা থেকে। পাক আর্মীরা তার বোবা ছেলেকে অস্তহাতে দেখে মুক্তিযোদ্ধা ভেবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করে মারে। শুধুমাত্র একটি ভুখন্ডের, একজন অচেনা অজানা মুক্তিযোদ্ধার জন্য, একজন মায়ের কি অসাধারণ আত্মত্যাগ।
*
আমার বড় ভাই হুমায়ুন আহমেদ-কে পাকিস্তানী মিলিটারীরা ধরে নিয়ে গিয়ে ভয়াবহ টর্চার করেছিলো। সেটা ছিলো ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস। পারিবারিক আড্ডায় আমরা ভাইবোনরা নানারকম গল্প করি কিন্তু সে এই ব্যাপারটা মোটেই বলতে চায়না। একবার অবশ্য সে এটা নিয়ে তার কোন একটা লেখায় একটু লিখেছিলো সেটাও খুব বিস্তারিত নয়। অনেক পরে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় (শাহাদাৎ চৌধুরী সম্পাদিত) আমার বন্ধু সাংবাদিক মোস্তাক হোসেন পাক বাহিনীর বন্দি শিবিরে’ নামে একটা কভার স্টোরী করে। সেটা সে সময় খুব আলোড়ন তোলে। সেখানে অনেক বিখ্যাত লোকের পাক বাহিনীর বন্দি শিবিরের ভয়াবহ নির্যাতনের কাহিনী ছিলো (তবে হুমায়ুন আহমেদেরটা ছিলো না)। তখন আমার নিজের একটা প্রকাশনী ছিলো, নাম ছিলো দিনরাত্রি প্রকাশনী। আমি মোস্তাকের ঐ বইটার একটা পেপারব্যাক সংকলন বের করি আমার প্রকাশনী থেকে। সেই বইয়ে মোস্তাক হুমায়ুন আহমেদের অভিজ্ঞতাটা অন্তর্ভূক্ত করে। সেটা ১৯৮৯ সালের কথা। সেই বই এখন আর নেই। হঠাৎ করে পুরনো বই ঘাটতে ঘাটতে সেই বইটা পেয়ে গেলাম। মাসুক হেলালের প্রচ্ছদ আঁকা বইটা উল্টে-পাল্টে মনে হলো তবুও’র পাঠকদের সাথে বড় ভাইয়ের এই ঘটনাটা তবুও’র এই সংখ্যায় শেয়ার করা যাক। দাদাভাইয়ের (আমরা তাকে দাদাভাই ডাকি) নিজের মুখের এই কাহিনীটা এরকম…
আমার বাবা পাক মিলিটারীর হাতে মৃত্যুবরণ করলেন ৫ মে, ১৯৭১। তখন আমি মা ও ভাইবোনকে নিয়ে বরিশালের গ্রামে পালিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে অনেক কষ্টে নানার বাড়ি ময়মনসিংহের মোহনগঞ্জে উপস্থিত হলাম। জুলাই মাসের দিকে সেখানে থাকাও বিপজ্জনক হয়ে উঠলো। মিলিটারীরা তখন যুবক ছেলেপুলেদের খুঁজছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গ্রামে লুকিয়ে আছে মানেই অন্যকিছু। কাজেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে আমি আমার ছোটভাই জাফর ইকবালকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলাম। সে উঠলো যাত্রাবাড়িতে এক আত্মীয়ের বাসায়, আমি মহসিন হলে। হলগুলি তখন নিরাপদ জায়গা হিসেবে চিহ্নিত। মিলিটারীরা তখন দেখাতে চেষ্টা করছে সব স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় খোলা, হল খোলা। তখন রোজার মাস। এক দুপুরে মিলিটারী হল ঘেরাও করলো। হল থেকে আমাকে এবং আমার সঙ্গে আমার আরও দুজন ছাত্র ও একজন দারোয়ানকে ধরে নিয়ে গেলো। ইতিহাসের শিক্ষক গিয়াসুদ্দিন সাহেবও (আমার হাউস টিউটর) ধরা পড়েন। পরে তিনি আলবদরদের হাতে শাহাদাৎ বরণ করেন। মনে হয় হলের ভেতর থেকেই পাক বাহিনীর কোন চর আমাদের ধরিয়ে দিয়েছিলো, কারণ মহসিন হলে সে সময় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ জনের মতো ছাত্র ছিলো। ছাত্রদের সবাইকে একটা দরজা জানালা বন্ধ গাড়ির চারপাশে ঘুরানো হচ্ছিলো। গাড়ির ভেতর থেকে কেউ আমাদের চিহ্নিত করে। আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কিন্তু তার কথা শুনতে পারছিলাম। আমি যখন গাড়ির চারদিকে ঘুরছি তখন ভেতর থেকে বলা হলো- “এই সে।” আমার ধারণা সে হলেরই কেউ, তবে ধারণা ভুলও হতে পারে। আমাদের ধরে নিয়ে প্রাথমিক ইন্টারোগেশন হয় আনবিক শক্তি কমিশনের একতলায়। সেখানে আমাদের দোষী সাব্যস্ত করে দরজা জানালা বন্ধ একটা গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের কোন একটা থানায় বা পুলিশ ব্যারাকে। তবে জায়গাটার নাম সঠিক মনে করতে পারছি না। আমাদের রাখা হয়েছিলো। লম্বা একটা ঘরে। বেশীর ভাগ বন্দি ঘরে শুয়ে বা বসে থাকতেন। ঘরে গোটা ছয়েক দড়ির চারপাই এবং কয়েকটা চৌকি ছিলো। প্রতিটিতে বেশ কয়েকজন বন্দি ছিলেন। কেউ কেউ জড়াজড়ি করে বসে ছিলেন। আমরা ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম অনেকেই সেখানে অনেকদিন ধরে আছেন। ভোর বেলা কাউকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়, তারা আর ফিরে আসেনা। আমাদের মধ্যে একজন মৌলানা ছিলেন। তিনি সারাক্ষণই উচ্চস্বরে কোরান পড়তেন। বন্দি শিবিরে নামাজের ইমামতি করতেন। দু’জন অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত চেহারার হিন্দু বৃদ্ধও ছিলেন। এই দু’জন খাদ্য ও পানীয় গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এদের দু’জনকে কিছুই খেতে দেখিনি। এরা অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেছেন। এদের কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। জানি না তারা বেঁচে আছেন কিনা। মিলিটারীদের মুখের ওপর ‘আমরা তোমাদের অন্নজল গ্রহণ করবো না’ বলা সহজ কথা না। বন্দি শিবিরে নির্যাতনের বর্ণনা দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। জীবনের এই অংশটা আমি ভুলে থাকতে চাই। আমাদের বন্দি শিবিরে নির্যাতনের দায়িত্বে ছিলো তিনজন। এদের একজন শ্বেতী রোগগ্রস্থ। সে মানুষ নয়, দোজখ থেকে উঠে আসা কোন শয়তান। আমি এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে ঐ লোকটাকে দেখি। নির্যাতনের বর্ণনা আমি দিচ্ছি না, তবে একটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। এ থেকে নির্যাতন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা হবে। আমার একজন সঙ্গী ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোহাম্মদ হোসেন। মিলিটারীর হাত থেকে মুক্তি পাবার পর সে সাময়িকভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। রাতে ঘুমুতে পারতো না। বিকট চিৎকার করতো। কয়েকজন মিলে তাকে ধরে রাখতে হতো। আমার অন্য সঙ্গী কবি রফিক কায়সারের জীবনেও এই নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া নানানভাবে তীব্রভাব ফেলে বলে আমার ধারণা। আমি আগেই বলেছি মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্নে আমি শ্বেতরোগগ্রস্থ ঐ লোকটাকে দেখি। ঘুম ভেঙে যাবার পর বাকি রাত আমার ঘুম হয় না। আমি এই সব কথা মনে করতে চাই না- ভুলে যেতে চাই।