*
এই গল্পটা এক প্রবাসীর কাছে শোনা। তিনি বহুদিন ধরে আমেরিকায় আছেন। আর দেশে ফিরে আসবেন বলে মনে হয় না, তার সাথে পরিচয় হয়েছিল ফেরিঘাটে। চা সিগারেট খেতে খেতে পরিচয় তারপর অনেক গল্প হল তার সাথে। এই গল্পটা সেই সময় তার কাছেই শোনা। তো ঘটনাটা হচ্ছে…
তিনি একদিন ভাড়া করা ট্যাক্সিতে করে যাচ্ছিলেন দূরে কোথাও। তার ট্যাক্সি ড্রাইভার বৃদ্ধ এক পাকিস্তানী। তার কি হল তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলা শুরু করলেন। পাকিস্তানী ড্রাইভার নীরবে শুনে যাচ্ছে। তিনি বললেন ঐ যুদ্ধে তার দুই ভাই শহীদ হয়েছেন মাতৃভূমির জন্য…
হঠাৎ পাকিস্তানী ড্রাইভার হাইওয়েতে এক পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে গেল। তিনি একটু অবাক হলেন। কি হল ড্রাইভারের। তিনিও কি ভেবে নেমে এলেন। নেমে দেখেন পাক ড্রাইভার উপুড় হয়ে বসে হাউ মাউ করে কাঁদছে। তাকে দেখে ছুটে এসে পা চেপে ধরলো পাক ড্রাইভার। উর্দুতে বলল–
“আমাকে ক্ষমা কর। ঐ সময় আমি একজন পাকিস্তানী সোলজার ছিলাম।… আমাকে ক্ষমা কর… আমাকে ক্ষমা কর… এখন বুঝি আমরা একটা ভুল করেছিলাম…।”
ভদ্রলোক অবশ্য তাকে নাকি বলেছিলেন “তুমি একা ক্ষমা চাইলেতো হবে না। পুরো জাতিকে ক্ষমা চাইতে হবে।”
*
‘ডক ইয়ার্ডের উপর ওরা আমার বাবা মাকে হত্যা করে… আমার সামনেই… আরো লোকজন ছিল…’ এইভাবেই তিনি বর্ণনাটা করেছিলেন আমাকে খুব স্বাভাবিক গলায়। বাবাকে দেখলাম বুকে হাত দিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লেন। মা আমার দিকে চেয়ে ছিলেন হাত দিয়ে আমাকে কি একটা ইশারা করছিলেন… পেটে গুলি খেয়ে যখন তিনি আস্তে আস্তে বসে পড়ছিলেন তখনও হাত দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছিলেন মা। আমি তখন বুঝতে পারিনি তিনি ঠিক কি ইশারা করেছেন। একটু পরে পাকিস্তানী আর্মীটা যখন ঘুরে দাঁড়াল আমাদের দিকে (তখনও তার অস্ত্রের নল দিয়ে ধুয়া বেরুচ্ছিল) সেও দেখি ঠিক আমার মায়ের মত হাত দিয়ে ঐ ইশারাটাই করছে… তখন বুঝতে পারলাম আমাদের চলে যেতে বলছে। মা ঠিক ঐ ইশারাটাই করেছিল। আজও চোখ বুজলে মায়ের ইশারাটা দেখি… স্পষ্ট। (এক শহীদের ছেলের কাছে শোনা)
*
আমার পরিচিত এক লোকের খালার ঘটনা। তার মুখেই শুনি..
ঘটনাটা আমার খালার, নোয়াখালি এলাকার ঘটনা। আর্মী এক গৃহস্থ বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আমার খালা তখন বটিতে মাছ কুটছিলেন। তার কি হল হঠাৎ ঘরের ভিতর পুরুষ মানুষ দেখে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তিনি বুঝতে পারেন নি যে এরা পাকিস্তানী আর্মী। তিনি মাছ কাটার বটি নিয়ে তেড়ে উঠেন। আর্মীও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে পড়ে।
একটু পড়ে ফের আসে গুলি করতে করতে। তখন খালা চালের ডুলির পিছনে লুকিয়ে পড়েন। পাকিস্তানী আর্মীরা যখন ঘরে ঢুকলো… হয়ত খালাকে খুঁজছে তখন কোত্থেকে এক বিশাল বাস্তু সাপ বেরিয়ে আসে! ভয় পেয়ে আর্মীরা সরে পড়ে। পরে খালা খালু অবাক হন ঘরের ভিতর বাস্তু সাপ এল কোত্থেকে। ঘরে কার্বলিক এসিড দেয়া থাকে সাপ আসার কথা নয়। তবে আশেপাশের প্রতিবেশীদের ধারণা জ্বীন নাকি সাপের বেশ ধরে খালাকে রক্ষা করেছে!
খালা অবশ্য এসব বিশ্বাস করেননি। হেসেই উড়িয়ে দিয়েছেন।
*
আমাদের পরিবারের পরিচিত একজন। একাত্তর সালে তিনি ছিলেন তরুণ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর থেকে তিনি নিখোঁজ। নিখোঁজ মানে সবাই ধরে নিয়েছিল তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। খুবই বিপ্লবী ধরনের মানুষ ছিলেন তিনি। বছরের মাঝামাঝিতে তাকে হঠাৎ দেখা গেল ফকিরাপুলে প্রকাশ্যে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে। দাড়িমোচ গজিয়ে গেছে, উষ্ণুখু চুল। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে প্রায় রাস্তার মাঝে আইল্যান্ডের পাশে দাঁড়ানো। হঠাৎ তাকে দেখে একজন ছুটে এল।
‘আরে মন্টু ভাই আপনি? এতদিন কোথায় ছিলেন? এখানে দাঁড়িয়ে কেন?
মন্টু ভাই ফিসফিস করে বললেন, ‘আমার সাথে কথা বল না। এখনি সরে পড়।’
ছুটে আসা তরুণ অবাক হয়ে বলল, ‘কেন কি হয়েছে?’
‘বললাম না কথা বল না এখান থেকে পালাও…’ ছুটে আসা তরুণটি কিছু না বুঝে সরে পড়তে গেল ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। সিভিল পোষাকে দুজন পাক আর্মী এসে ধরে ফেলল তরুণকে। বিষয়টি আর কিছু নয়। মন্টু ভাই একজন গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। ধরা পড়েছেন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে। পাক বাহিনীর একটা কৌশল, তাকে প্রকাশ্যে দাঁড় করিয়ে তার সাথে যারা যারা কথা বলতে এসেছে তাদের ধরেছে মুক্তিযোদ্ধা সন্দেহে। বলাই বাহুল্য, তারা কেউই জীবিত ফিরে আসেন নি রক্তস্নাত স্বাধীন বাংলায়!
*
এ গল্পটি শুনেছি পাবনার সাঈদ হাসান দারার কাছে। সাঈদ হাসান দারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসাধারণ কিছু উপন্যাস লিখেছেন। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। ঘটনাটা পাবনার। শহরের বড় একটি হোটেলের মালিকের সুন্দরী দুই মেয়েকে ধরে নিয়ে গেল পাক আর্মীরা তাদের ক্যাম্পে। স্তব্ধ হয়ে গেছেন সেই হিন্দু হোটেল মালিক। কি করবেন তিনি এখন?
মাসখানেক পর তার কাছে এল পাক আর্মীরা এক প্রস্তাব নিয়ে। প্রস্ত বিটা হচ্ছে তার দুই মেয়েকে তারা ছেড়ে দিবে (ইতোমধ্যে আরো অনেক নতুন মেয়েদের ঢুকানো হয়েছে ক্যাম্পে কাজেই যারা পুরানো হয়ে গেছে তাদের ছেড়ে দিয়ে কিছু সুবিধা যদি পাওয়া যায় মন্দ কি!)। বিনিময়ে আমী ক্যাম্পে প্রতিদিন খাওয়া দাওয়া সাপ্লাই করতে হবে। হিন্দু মালিক দৃঢ় স্বরে বললেন ‘না’! অবাক হয়ে গেল আর্মীরা। নিজের মেয়েকে ফিরিয়ে দিবে তারপরও কোন বাবা তাদের কথা শুনবে না! তখন তখনই তাকে প্রকাশ্যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হল। না, এই বীর বাবাকে কোন পদক দেই নি আমরা, যিনি তার দুই মেয়েকে আর নিজেকে উৎসর্গ করেছেন দেশমাতৃকার জন্য। বাংলার মাটি শুধু তার রক্ত শুষে নিয়েছে নীরবে।