*
ঢাকা শহরের নভেম্বর মাস। শান্তিবাহিনী, রাজাকার আলবদররা এস সৃষ্টি করেছে। বাবা মা শিশু কন্যাকে নিয়ে পালাতে পারেননি। সারাদিন রাত এমন নিঃশব্দে থাকতেন যেন মনে হয় বাড়িতে কেউ নেই। শিশুটি সারাদিন চুপচাপ থাকলেও রাত্রে কাঁদতো। তাদের চিৎকার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পাশে শিশু কন্যাটি কেঁদে ওঠে আর রাজাকাররা টের পায় তাই মা বাচ্চাকে দুধের সাথে মিশিয়ে ঘুমের অষুধ খাইয়ে দিয়েছিলেন। অষুধের ডোজ বেশী হয়ে গিয়েছিলো মেয়েটির ঘুম আর ভাঙ্গেনি।
*
বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছে এক গ্রামীণ নববধূ আর তার সদ্য বিবাহিত স্বামী। স্বামীর হাতে রংচংয়ে টিনের ট্রাঙ্ক। তারা বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। হয়ত বাসে করে তারা যাবে দূরে কোথাও… তাদের নতুন সংসারে। স্বামী শক্ত করে একহাতে ধরে রেখেছে প্রিয়তমা স্ত্রীর হাত। দুজনের চোখেই আগামী দিনের স্বপ্ন!
কিন্তু বাস এলো না, এল একটা মিলিটারী কনভয়। সেখান থেকে লাফিয়ে নামলো কিছু মিলিটারী। নতুন স্বামী স্ত্রী দেখে কিছুক্ষণ তারা তাদের ভাষায় মোটা দাগে ঠাট্টা তামাশা করল। তার কিছুই বুঝলো না গ্রাম্য সহজ সরল স্বামী-স্ত্রী।
তারপর ঘটল সবচে ভয়ংকর ঘটনা। নেমে আসা মিলিটারীরা নববধূকে টেনে নিয়ে তুলে ফেলল কনভয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব স্বামী দাঁড়িয়ে রইল রংচংয়ে ট্রাঙ্ক হাতে… মূর্তির মত। একটা মিলিটারি তখনও কনভয়ে উঠতে পারেনি। হঠাৎ যেন খেপে গেল স্বামিটি। একটা থান ইট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই মিলিটারিটির উপর। মুহূর্তে পাক আমীর হেলমেট পড়া মাথাটা হেলমেট সহই ছেচে ফেলল সে, তারপর সেই থান ইট হাতে কনভয়ে উঠতে গেল… যেন সবগুলোকে সে ঐ ভাবে হত্যা করবে, তার আগেই কনভয় থেকে গুলি… ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল তরুন স্বামীটি। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার নব বধূ স্ত্রী… কি ভেবেছিল সে তখন…? না সেই নববধূকেও আমরা আর ফিরে পাইনি এই স্বাধীন দেশে। দেশমাতৃকার জন্য একটা ছোট্ট স্বপ্ন কি ভংয়কর প্রতিশোধের দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল কেউ জানলো পেল না।
*
এই গল্পটিও আমি লেখক সাঈদ হাসান দারার কাছে শুনেছি। এটাও পাবনার ঘটনা। অদ্ভুত এক মানবিক ঘটনা। পাবনার পাঁচ ভাই। পাঁচ ভাই-ই ভয়ানক মুক্তিযোদ্ধা। সবার বড়ভাই পাক আর্মীদের কলজে কাঁপানো কমান্ডার। যুদ্ধ তখন প্রায় শেষের দিকে। ক্রমে ক্রমে দেশ স্বাধীন হচ্ছে। পাক আর্মীরা পালাচ্ছে। এই সময় তাদের সবচেয়ে ছোট ভাই বাবুল শহীদ হয়ে গেল। তারা তখন পলাতক এক আর্মী দলকে ধাওয়া করে এক পাকিস্ত নী ক্যাপ্টেনকে ধরে ফেললেন। তাকে জীবিত অবস্থায় মায়ের কাছে নিয়ে এল চার ভাই। উদ্দেশ্য মায়ের সামনে তাকে জবাই করে ছোট ভাই বাবুলের হত্যার প্রতিশোধ নেবে, তাতে যদি মায়ের কষ্ট একটু লাঘব হয়।
বাড়ির উঠানে সেই ক্যাপ্টেনকে শোয়ানো হল জবাই করা হবে, মাকেও ডাকা হল। বড় ভাইয়ের হাতে ধারালো গরু জবাইয়ের ছুরি। এই সময় মা ছুটে এসে সবাইকে হতবাক করে পাক ক্যাপ্টেনকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন “আজ থেকে এই আমার বাবুল।” সবাই হতভম্ব! সেই পাক আর্মী হাউ মাউ করে করে কেঁদে ফেলল। এক আশ্চর্য মানবিক নাটক যেন সেই বাড়ির উঠোনে ঘটলো। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা মায়ের এই আবেগকে মেনে নিল। ক্ষমা করল পাক ক্যাপ্টেনকে। মেনে নিল ছোট ভাই বাবুল হিসেবে।
এরপরের গল্প আরো নাটকীয়। সেই পাক ক্যাপ্টেন সেই গ্রামেই সেই মায়ের আশ্রয়েই থেকে গেল। সেই গ্রামেই বিয়ে করল। সংসার পাতল। পরবর্তীতে সে বিরাট শিল্পপতি হয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আন্দোলনে ভুমিকা রেখেছে। এখনো সে নাকি পাবনাতেই আছে।
*
বরিশালের ঘটনা। একটা পরিবার একটু গোড়া পরিবারই বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অত মাথা ব্যাথা নেই তাদের। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে কিন্তু তাদের বড় ছেলে নিখোঁজ। এনিয়েও তাদের বিশেষ মাথা ব্যাথা নেই, তাদের বড় ছেলে একটু পাগলাটে আছে তবে ছেলে আর যেখানেই যাক মুক্তিযুদ্ধে যে যাবে না এতে তারা মোটামোটি নিশ্চিত। কিন্তু বাবা-মার ভাবনায় একটু গলদ ছিল বড় ছেলে তখন রীতিমত মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। এ খবর স্থানীয় রাজাকাররা পর্যন্ত জানে কিন্তু বাবা-মার দৃঢ় বিশ্বাস তার ছেলে ‘ঐ রকম নয়। ছেলে একটু পাগলাটে বটে হুটহাট করে এদিক ওদিক চলে যায় এর বেশি কিছু নয়। তারপর হঠাৎ এক গভীর রাতে ছেলে এসে হাজির। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
–কিরে তুই কই ছিলি?
–একটু ঘুরতে গিয়েছিলাম। তাও ভাল বাবা মা নিশ্চিত। ছেলে রাতে ঘুমাল। দিনে ঘরে বসে নাস্তা করল। দুপুরে বলল
–মা গোসল করব কর
–না মানে পুকুর থেকে এক বালতি পানি এনে দাও ঘরে
–কেন, পুকুর থেকে পানি আনতে হবে কেন? তুই বাইরে পুকুরে যেয়ে গোসল করতে পারিস না?
ছেলে কেমন যেন বাইরে পুকুরে যেতে চায় না। মা একরকম ঠেলে ইলেই পাঠালেন বাইরের পুকুরে। ব্যাস। রাজাকাররা নজর রেখেছিল তক্কে তক্কে ছিল। বাড়ির ভিতরের কেউ জানল না পুকুর ঘাট থেকে নিঃশব্দে ধরে নিয়ে গেল তাকে। আর ফিরে এল না সেই তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধা। পরে মা সব জানতে পেরে হাউ মাউ করে কাঁদলেন আর চেঁচাতে লাগলেন ‘আমিই খুনি… আমিই খুনি, বলে…’