*
মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুর রহমান খানের রনাঙ্গনের জীবনের আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা। তারা তখন ছোট্ট একটা দল নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। উদ্দেশ্য পাক বাহনীর উপর আক্রমন করা। পথে একটা পরিত্যাক্ত বাড়িতে রাত্রি যাপনের জন্য আশ্রয় নিলেন। অন্ধকার সাত সাতে বাড়ি! ঘরের ভিতর কোন আসবাব পত্র নেই শুধু শত শত টিন গাদা করা। তারই উপরেই ক্লান্ত শ্রান্ত মুক্তি যোদ্ধারা শুয়ে পড়লেন। এবং শোয়া মাত্র ঘুম … হটাৎ গভীর রাতে ফোঁস ফোঁস শব্দ! তিনি সহ কয়েকজন লাফিয়ে উঠলেন। দেখেন গোখরো সাপ, টিনের নিচ থেকে বেরুচ্ছে একের পর এক…। সঙ্গে সঙ্গে সবাই উঠে পড়লেন। পরে দেখা গেল প্রতিটা টিনের নিচে চারটা পাঁচটা করে বিশাল বিশাল সব গোখরো সাপ ঘাপটি মেরে আছে। তারা সঙ্গে সঙ্গে বুট পরে যতগুলোকে পাড়া গেল পাড়িয়ে মারলেন। মোট ৯৮টা গোখরো সাপ মেরেছিলেন তারা। আর পালিয়ে গিয়েছিল কত গুলো তার কোন হিসেব নেই।
*
এই ঘটনাটা এক মুক্তি যোদ্ধার কাছে শুনেছিলাম, হাসতে হাসতেই ঘটনাটা বলেছিলেন তিনি। একবার তাদের এক শক্ত ঘাটিতে পাক বাহিনী গভীর রাতে এ্যাটাক করে বসল। সারা রাত যুদ্ধ হল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার পাক বাহিনীর একটা গুলি বা শেলও এসে তাদের ঘাটিতে পরল না। পর দিন সকালে পাক বাহিনী সুবিধা করতে না পেরে সরে গেলে পরে… মুক্তি বাহিনীর দল বিষয়টা সরেজমিনে তদারক করতে গিয়ে অবাক হলেন হাসিও পেল তাদের। পাক বাহিনী একটা বড় পুকুরের পারে পজিশন নিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে তারা টের পায় নি, পুকুরের অন্যপারটা ছিল অনেকটা উঁচু ফলে তাদের সমস্ত শেল বা গুলি সব এসে পড়েছে পুকুরের অন্য পারে। পুকুরের অন্যপার বিধ্বস্ত বাংলার মটিই তাদের প্রতিরোধ করেছে তারা টের পায় নি। পাক বাহিনী নাকি পৃথিবীর সেরা বাহিনীর একটি!!
*
দুই ভাই শহরে চাকরী করে। বিপদ বুঝে পরিবার পরিজন নিয়ে চলে এসেছে গ্রামে। গ্রাম থেকেই দুই ভাই প্রতিদিন অফিস করে। দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোন কথা বলে না। খুব সকালে দুই ভাই বাসে করে অফিস চলে যায় সন্ধ্যার পরে ফিরে আসে। এই চলছিল। একবার ফেরার পথে আর্মীরা তাদের বাস থামাল। সবার ব্যাগ চেক করা হবে। দুই ভাই পাশাপাশি বসে। বসা অবস্থায় চেকিং চলছে। বাসে খুব বেশী যাত্রীও নেই। বড় ভাইয়ের ব্যাগ চেক করল এবার ছোট ভাই, ছোট ভাই নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকলো। তার ব্যাগে পাওয়া গেল ছটা তাজা গ্রেনেড। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে নিয়ে গেল আর্মীরা ছোট ভাই ফিরেও তাকাল না হতভম্ব হয়ে বসে থাকা বড় ভাইয়ের দিকে, যেন চিনেই না। চিনলেই বিপদ তাই চিনেনি সে। তারপর একদিন দেশ স্বাধীন হল। বীরের মত ফিরে এল কত নাম নাজানা সব মুক্তিযোদ্ধা… শুধু ছোট ভাই ফিরে এল না। কি করে ফিরবে? দেশ মাতৃকার জন্য কাউকে কাউকেতো ফিরে আসলে চলে না!
*
১৯৭১ সেপ্টেম্বর মাস। এক মুক্তিযোদ্ধা গোপনে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এল গভীর রাতে। রাজাকাররা টের পেয়ে বাড়ি ঘিরে ফেলল। বাড়ির সবাই পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে সাহায্য করল তাদের যোদ্ধা ছেলেকে। রাজাকাররা তাকে না পেয়ে ধরে নিয়ে গেল অন্য দুই ভাইকে। পরদিন আর্মী ক্যাম্পে আত্মসমর্পন করল যোদ্ধা ভাই, ছোট দুই ভাইয়ের মুক্তির বিনিময়ে। তারপরের ইতিহাস নির্মম। নির্মম ভাবে বেয়নেটে খুচিয়ে হত্যা করা হল তাকে। টর্চার সেলের শক্ত কংক্রিটের উপর গড়িয়ে গেল তার গাঢ় রক্তের ধারাবাংলার সবুজ ঘাসের দিকে!
*
বড় বোন তেমন সুন্দরী নয়। শ্যামলা গড়ন ছোট খাট। কিন্তু ছোট বোনটা অপরূপ সুন্দরী। নজর পড়ল রাজাকারদের তার উপর। বড় বোন আর ঝুঁকি নিল না। তার প্রেমিককে রাজী করাল তার ছোট বোনকে বিয়ে করতে। একটি প্রগাঢ় প্রেমের সমাধী হল। রাজাকারদের হাত থেকে বেঁচে গেল ছোট বোন। বড় বোন আর বাকি জীবন বিয়েই করল না।
*
লোহাগড়া গ্রামের ঘটনা। আর্মী ঢুকেছে গ্রামে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলিয়ে দিচ্ছে। সবাই পালাচ্ছে। এক মা তার শিশু কণ্যাকে কাথায় জড়িয়ে পালাল। নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে কথা খুলে দেখে সে ভুল করে কোলবালিশ প্যাচানো কাথা নিয়ে চলে এসেছে। পাগলের মত ছুটে গলে তার বাড়িতে। বাড়ি তখন দাউ দাউ করে জ্বলছে! পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার তিন মাসের শিশু কন্যা। হায় মায়ের হাহাকারে…. কেঁপে উঠল অগ্নি দগ্ধ গ্রাম।
*
১৯৭১ এর ছাব্বিশে মার্চ। শহর ছেড়ে সবাই পাগলের মত পালাচ্ছে। কিন্তু কিভাবে পালাবে? কোন যানবাহন নেই। এই সময় দেখা গেল একটা পুরোনো বেডফোর্ড গাড়ি নিয়ে এসে হাজির এক বৃদ্ধ। সবাই উঠে গেল সেই বাসে বিশেষ করে নারী আর শিশুরা। বাস ছুটলো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। পৌঁছে দিল সেই বৃদ্ধ। কিন্তু ঐ এলাকার লোকজন চিনে ফেলল সেই বৃদ্ধ ড্রাইভারকে ‘আরে এতো নান্টু বিহারী!’ তাকে মেরে ফেলা হোক। কিন্তু না নারী আর শিশুরা তাকে রক্ষা করল। সেই বৃদ্ধ নান্টু বিহারী এরপরও কয়েক ট্রিপ বাঙালী নারী শিশুকে পৌঁছে দিয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ে!
*
আড়পাড়া গ্রামের রাস্তার মোড়ে বসে থাকতেন দু’জন তরুণ। রাস্তাটি যশোর শহর থেকে ঢাকা পর্যন্ত গেছে। যারাই ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন তাদেরকে এক গ্লাস পানি আর মুড়ি কিংবা ভিজানো ছোলা খেতে দিতেন তারা। শিশুদের জন্য জোগাড় করে আনতেন দুধ। তাদের বাবা মা অনুমতি দেননি মুক্তিযুদ্ধে যেতে কিন্তু স্বাধীনতার দিন পর্যন্ত তারা দুজন এভাবেই সেবা করেছেন সাধারণ মানুষকে। এরা দু’জন কি কোন একজন অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধার চাইতে কম?