*
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নানা রকম ভয়ঙ্কর ঘটনা আমাদের কানে আসতো। তার একটা ছিলো এরকম–পাকবাহিনীরা বন্দি মুক্তিযোদ্ধাদের নাকি বাঘের খাঁচায় ছুঁড়ে দিয়েও হত্যা করতো। স্বাধীনতার পরেও সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা আমাদের কানে এসেছে। সেইরকম একটি ঘটনা যেখানে একজন দুর্ধর্ষ। মুক্তিযোদ্ধা বাঘের খাঁচা থেকে জীবিত অবস্থায় বের হয়ে এসেছিলেন।
তার নাম শফিকুল আলম চৌধুরী। পঞ্চগড়ের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। একবার এক পাকসেনা ভুল করে তার এলাকার বাজারে চলে এলে তিনি নিরস্ত্র অবস্থায় একাই পাক আর্মির অস্ত্র ছিনিয়ে নেন। সেই শুরু, তারপর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে বহু সফল অপারেশন করেছেন। ঐ অস্ত্র ছিনতাইয়ের ঘটনায় পাক বাহিনীর একটা ক্ষোভ ছিলো তার ওপর। এবং স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় একদিন তাকে ধরেও ফেললো সে। তারপর শুরু হলো ভয়ানক নির্যাতন। নির্যাতনের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন একটা খাঁচার ভেতর। খাঁচাটা বাঘের, চারটা বাঘ সেই খাঁচায়। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, বাঘ তাকে ছুঁয়েও দেখলো না। উল্টো একটা বাঘ তার গায়ে হেলান দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়লো। এই ঘটনা দেখে রাজাকার আর মিলিটারীরা ভীষণ অবাক হলো। তবে খাঁচা থেকে তাকে বের করলো না। এই ভাবে টানা তিন মাস তিনি বাঘের খাঁচায় রইলেন। বাঘ তাকে স্পর্শও করলো না। তার সামনে প্রায়ই অন্যদের ধরে এনে বাঘের খাঁচায় দেয়া হতো, বাঘ মুহূর্তেই তাদের ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলতো। বাঘের আক্রমনে যারা গুরুতর আহত হতো কিন্তু মারা যেত না, তাদের আবার বাইরে এনে গুলি করে মেরে ফেলা হতো।
পরে তাকে ঠাকুরগাঁও জেল-হাজতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে এক পরিচিতের মাধ্যমে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এখনো তিনি শরীরে অজস্র ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন।
আর আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় এখনো তার কোন নাম নেই!
*
১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগের সময় পাঞ্জাবী আল্লারাখা খান কি মনে করে পাবনা শহরে চলে এসেছিলেন তা আজ আর কারও মনে নেই। তিনি পাবনা শহরেই এক বাঙ্গালী রমনীকে বিয়ে করে স্থায়ী হয়ে যান। তিনি ছিলেন পুলিশের লোক। অস্ত্র চালনা ভালই জানতেন। তার এক ছেলে ছিল শরীফ খান।
তারপর একদিন দেখতে দেখতে চলে এল ১৯৭১ সাল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ।
সেই সময় পঞ্চাশ জন পাক সেনার একটা দল হটাৎ পাবনার শহরে পুলিশ লাইনে হামলা চালাল। পাবনার পুলিশ বাহিনী জনতাকে সাথে নিয়ে তাদেরকে প্রতিরোধ করে ঘিরে ফেলল। শুরু হল যুদ্ধ। আশ্চর্যের ব্যাপার প্রায় ৩৫ জন পাক সেনাকে মেরে ফেলল স্বাধীনতা কামী জনতা আর পুলিশ মিলে। বাকি ১৫ জন পাক সেনা গিয়ে আশ্রয় নিল পাশের টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। ওদিকে খবর পেয়ে পাক বাহিনীর দু’তিনটা কনভয় ছুটে আসছিল পাবনার দিকে। এ খবর কিভাবে পেয়ে গেলেন আল্লারাখা খান, তিনি তার তরুন ছেলে শরীফ খান আর তৃতীয় একজনকে নিয়ে মাত্র তিনটি রাইফেল নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন, সার্কিট হাউজের পাশের একটা টয়লেটের জানালা দিয়ে তিনি গুলি শুরু করলেন। তার সঙ্গের লোকটি নাকি রাইফেল চালাতেই জানতো না। তিনি ছেলে কে গুলি করতে দিয়ে সঙ্গের লোকটিকে তখন তখনই শিখিয়ে দিয়ে গুলি করতে বলেন। ধুন্ধুমার গুলি চালিয়ে যেতে লাগলেন তারা তিনজন। তাদের এই অতর্কিত আক্রমনে বেশ কয়েকজন পাক সেনা মারাও গেল। সে যাত্রা তাদের ঠেকিয়েই দিলেন আল্লারাখা খান আর তার ছোট্ট দলটি। এই গোপন প্রতিরোধ খুব বেশী মানুষ জানল না। কিন্তু পাক বাহিনী ঠিকই মনে রাখল।
মাস খানেক পরে প্রতিরোধ ভেঙে পাক বাহিনী পাবনা শহরে ঢুকলো। তখন তরুনরা সব ছুটছে মুক্তিযযাদ্ধার ট্রেনিং নিতে ভারতে, সেই দলের সঙ্গে আল্লারাখা খানও রওনা দিলেন। কিন্তু তাকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। উর্দুভাষি বলে তাকে পাকিস্তানী চর’ সন্দেহে তাকে নেয়াতো হলই না উল্টো মেরে ফেলার হুমকিও দেয়া হল। তবে পরিচিত কয়েকজনের হস্ত ক্ষেপে সন্দেহ দূর হলেও তিনি সেই দলের সঙ্গে ভারত যেতে পারলেন না। ফিরে এলেন পাবনায়… এবং ধরা পরলেন পাক বাহিনীর হাতে। তার ছেলে এবং আরও কয়েকজন ধরা পড়ল তার সাথে। পাক বাহিনী সেই প্রতিরোধের সূত্র ধরেই তাকে ধরেছে।
তখন আল্লারাখা খান পাক বাহিনীর কাছে সব স্বীকার করলেন যে তিনিই সেই পাঞ্জাবী ( তাদের ভাষায় গাদ্দার ) সেই দিন একক ভাবে তাদের ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি পাক বাহিনীকে বললেন মাত্র তিনটি রাইফেল নিয়ে তিনি একাই সুবিধা জনক স্থান থেকে তাদের প্রতিহত করেছিলেন। তার সঙ্গে আর কেউ ছিল না। পাকবাহিনী তাদের স্বজাতী বলেই হয়ত তাকে বিশ্বাস করল এবং তার ছেলে আর সঙ্গের কয়েকজন কে ছেড়ে দিয়ে আল্লারাখা খানকে আরো অন্য সাত জনের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করল। না আল্লারাখা খান কোন পদক পান নি। তাকে আমরা মনেও রাখিনি। হয়তো বাংলার মাটি তাকে মনে রেখেছে।
*
দুধর্ষ মুক্তি যোদ্ধা হাফিজুর রহমান খানের ঘটনা। তার কাছেই শোনা। তখন তিনি চুয়াডাঙ্গা পিলখানায়। কয়েকদিন ধরেই ইপিআরের বাঙালী অবাঙালী অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বাঙালী অফিসাররা সবাইকে (সৈনিকসহ) অস্ত্র হাতে রাখার গোপন নির্দেশ দিয়েছিলো, তিনিও সসস্ত্র ছিলেন তখন। তার রুমমেট ছিলো একজন পাকিস্তানী। ঘটনার দিন দুইজন একসাথে রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে অনেক রাত পর্যন্ত কার্ড খেলে-টেলে ঘুমিয়ে গেলেন। গভীর রাতে হঠাৎ প্রচন্ড গুলীর শব্দে ঘুম থেকে উঠে কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই পিস্তল দিয়ে পাকিস্তানী রুমমেটকে গুলী করে বসেন তিনি। পরে আলো জ্বেলে দেখেন তার রুমমেটের হাতেও পিস্তল। তার গুলী মিস হলে তাকেই মরতে হতো। পরে রুম থেকে বের হয়ে বাঙালী অফিসার ও সৈনিকদের সাথে নিয়ে বিহারী সৈনিক ও অফিসারদের গ্রেপ্তার করেন তিনি এবং যশো, মেহেরপুর হয়ে ইন্ডিয়াতে সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দেন। তাদের নিয়েই ‘ফার্স্ট বেঙল রেজিমেন্ট’ গঠন করা হয়।