গাফফারের দরিদ্র বাবা হতাশ হয়েছিল ছেলের এই বোকামীতে কিন্তু মা নাকি এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলেন নি। গর্বে তার বুকটা ভরে গিয়েছিল। তার বোকা সহজ সরল ছেলেটা মরে গেছে বটে তবে … বীরের মতই একটা কাজ করে মরেছে।
*
চাকরী-বাকরীর মায়া ছেড়ে শহর থেকে পালিয়ে গহীন গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি, সীমান্ত নিতটবর্তী একটা গ্রামে। তিনি যে ঘরে থাকতেন সে ঘর থেকেও বেরুতেন না। প্রচন্ড মৃত্যু ভয়ে সবসময় কাতর থাকতেন। এই মিলিটারী এল… মিলিটারী এল এমন একটা আতঙ্কে থাকতেন তিনি। বিয়ে করেন নি। একা মানুষ … তারপরও তার আতঙ্ক! কোনও কথাও বলতেন না। অন্যরা তার এই ভিতু ভাব নিয়ে হাসাহাসিও করত।
একদিন তাকে সবাই মিলে ধরল—’চল বাজারে চল কিসের এত ভয় তোর?’ এই গ্ৰামতো দূরে… এই গ্রামের আশেপাশের কোন গ্রামে মিলিটারী আসার সম্ভব না নেই। এত ইন্টেরিওর গ্রাম। সবার অনুরোধে একদিন সে গেল বাজারে অন্যদের সঙ্গে। সময়টা ছিল শীতকাল। একটা সবুজ ভারী পুলওভার টাইপের কিছু পড়ে গিয়েছিল সে।
বাজারে গিয়ে মানুষ জন স্বাভাবিক ভাবে চলা ফেরা করছে দেখে তার মত্য ভয়টা একটু কাটলো। বাজারের দোকানে বসে চা খেল সিগারেট খেল। অনেকদিন পর সবার সাথে আড়াই মারল।
হঠাৎ শো শো শব্দ সঙ্গে সঙ্গে বোম্বিং এর বিকট শব্দ! কি ব্যাপার? ঐ বাজারের লোকজন হতচকিত হয়ে আবিস্কার করল তাদের ওখানেই সরাসরি একটা চায়ের দোকানের উপর বোম্বিং হয়েছে হটাৎ করে। পাক বিমান থেকে হটাৎ কোন কারণ ছারা বোম্বিং… তিনজন গুরুতর আহত, মারা গেছে সবুজ পুলওভার পরা সেই লোকটি যে সবসময় মৃত্যু ভয়ে কাতর থাকত ঘর থেকে বেরুতে চাইতো …এই বাজারেও আসতে চায় নি।
ধ্বংস স্তূপ থেকে যখন তাকে উদ্ধার করা হল। দেখা গেল ঝলসে গিয়ে তার সবুজ পুলওভারটা গায়ের চামড়ার সাথে সুন্দর ভাবে সেটে আছে। যেন সবুজ চামড়ার একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে সবুজ বাংলায়!
*
‘কোন স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চায় না’ কথাটি বলেছিলেন ভারতের মাটিতে ১৯৭১ সালে গেরিলা ট্রেনিং দেয়ার সময় মেজর খালেদ মোশররফ।
স্বাধীনতার পর অনেক গেরিলাই ফিরে এসেছিলেন কিন্তু কেউ কেউ আর ফিরে আসেন নি। তাদেরই একজন তার কোন ছবি নেই। শখ করে একটি মাত্র ছবি স্টুডিওতে তোলা গালে হাত দিয়ে। কিন্তু ছবিটি তিনি ডেলিভারী নেন নি পয়সার অভাবে। পরে তার এক আত্মীয় (যিনি ঘটনাটি বলেছিলেন) সেই ছবিটি উদ্ধার করেন। আশ্চর্যজনক হচ্ছে কবি সুকান্তের সঙ্গে কি মিল ছবি তোলায় ব্যাপারটির কবি সুকান্তও এরকম গালে হাত দিয়ে ছবি তুলেছিলেন একটি মাত্র ছবি তার, আমরা দেখি এখন। তিনি পয়সার অভাবে নিজের ছবিটি ডেলিভারী নিতে পারেন নি।
সুকান্তর ছবিটি আছে কিন্তু সেই নাম না জানা গেরিলার ছবিটিও আজ আর নেই! না থাক তার আত্মত্যাগ লেখা আছে বাংলাদেশের রক্তিম পতাকায় তিনি সুকান্তের ভাষায় যেন বলে গেছেন।
…বাংলার মাটি
দুর্জয় ঘাটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত!
*
আমাদের এক আত্মীয় ভয়ঙ্কর মুক্তিযোদ্ধা তিনি গেলেন এক অপারেশনে। এক রাজাকারকে মারতে হবে। এই রাজাকারও নাকি ভয়ঙ্কর। তার বিশাল একটা ভয়ঙ্কর দর্শন কুকুর আছে সব সময় সেই কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। জায়গাটা সম্ভবত আট পাড়ার কোন এলাকা।
তো এক রাতে তিনি তার দল নিয়ে হাজির হলেন সেই রাজাকারের বাড়িতে গিয়ে দেখেন দোতলা এক দূর্গ কোন দরজা জানালা নেই। এক্সপ্লোসিভ দিয়ে দেয়াল উড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় গেলেন। তারা খবর পেয়েছেন সে দোতলায় থাকে।
কিন্তু গিয়ে অবাক কেউ নেই শুধু তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। বিশাল এক কুকুর। কুকুরটা উনাদের দেখেও এক চুল পরিমান নড়লো না। তারা ভয়ঙ্কর কুকুরটাকে মেরে চলে এলেন কিন্তু তারা জানতেন না ঐ কুকুরের নিচেই লুকিয়ে ছিল সেই রাজাকার। প্রভুভক্ত কুকুর জীবন দিয়ে তার রাজাকার প্রভুকে রক্ষা করল।
সেই দুঃসময়ে কিন্তু আর্মীদের বোকামী নিয়ে অনেক জোকসও আমাদের কানে আসত তখন। স্মৃতি থেকে ধার করে তারই কিছু এখানে পরিবেশন করা যাক …
*
আর্মীরা তখন আইডি কার্ড চেক করতো। এক লোককে থামাল
— আইডি কার্ড নিকালো।
ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন রেশন তুলতে। তার কাছে রেশন কার্ড ছিল। আইডি কার্ড ছিল না। তিনি কি ভেবে রেশন কার্ড বের করেই দেখালেন। মুখ পাক আর্মী ভাবল বাপরে এত বড় আইডি কার্ড নিশ্চই হোমড়া চোমরা কেউ ঠকাস করে সেলুট মারল। ভদ্রলোক সে যাত্রা রক্ষা পেলেন।
*
পাক আর্মীরা খুলনায় হিন্দু এলাকায় ঘাটি গেড়েছে। একের পর এক গরু মেরে খাচ্ছে হিন্দুদের। তখন স্থানীয় মুসলমানরা চটের উপর ‘ইহা মুসলমানের গরু খাইবেন না’ লিখে নিজেদের গরুর উপর ফেলে রাখত পোষাকের মতো। এত দুঃখেও এই ঘটনা হাসির উদ্রেক করেছিল সেই সময়।
*
এটা জোক না সত্যি ঘটনা। এটাও জোকের পর্যায়েই পরে বলে লিখছি।
আমাদের নানা বাড়িতে এক লোক ছিল। তার নাম আমান উল্লাহ। সে ছিল পেশায় কুলি। অসম্ভব শক্তি শালি একজন মানুষ। আমার সাথে খুব খাতির ছিল। সে আর্মীদের প্রচন্ড ঘৃনা করত কিন্তু রহস্যময় কারনে আবার তাদের সাথে সাথেই ঘুরতো। আমি তাকে বলতাম।
— তুমি ওদের ঘৃনা কর তো বাজারে ওদের পিছে পিছে ঘুরো কেন? সে এর উত্তর দিত না মুচকি মুচকি হাসত। একদিন এক ঘটনা ঘটল।