স্বাধীনতার পর সেই তরুন মুক্তিযোদ্ধা আর ফিরে আসেনি। তাকে তখন তখনি হত্যা করা হয়েছিল কিন্তু জিমিকে কে বোঝাবে? সে নাকি মাঝে মাঝেই সেই রাস্তায় ধারের হিজল তলায় গিয়ে দাঁড়াতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতো বাঁক নেয়া রাস্তায় দিকে যেখানে ঘটনাটি ঘটেছিল… তারপর হঠাৎ চিৎকার করে উঠতো ঘেউ ঘেউ করে… কে জানে সে কি বলতে চায়…!!
*
ঘটনা বরিশালের। পাক আর্মীদের ডাব খাওয়ার শখ হল। তিনজন পাক আর্মী এক তরুনকে পাকড়াও করলো তাকে নারকেল গাছে উঠে ডাব পেড়ে দিতে হবে। সেই তরুন সাহস করে বলল তার গায়ে জ্বর। কে শোনে কার কথা বন্দুকের বাট দিয়ে বাড়ি দিল পাক আর্মী। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল তরুনের, কিন্তু কি আর করে তর তর কের গাছে উঠে গেল। বরিশালের গ্রাম গঞ্জের সবাই নারকেল গাছে উঠতে এক্সপার্ট। গাছে উঠে তার মনে হল সে দা ছাড়াই উঠেছে এখন ডাব পাড়বে কি ভাবে? আর তখনই তার নজরে পড়ল বিশাল এক বল্লার চাকের উপর! চট করে তার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এল। সে খুব সাবধানে বল্লার চাকটা ভাঙ্গলো, তারপর ছুঁড়ে মারল তিন পাক আর্মির উপর আর নিজে লাফ দিল নারকেল গাছটার পাশের পুকুরটায়। তারপর আরকি পুকুর থেকে ভুস করে ভেসে উঠে সাতরে পাগারপার। পিছনে তিন পাক আৰ্মী তখন ‘মারডালে’ ‘মারডালে’ বলে চেঁচাচ্ছিল বল্লার ভয়াবহ কামড়ে!
পরে নাকি ঐ গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল পাক আর্মীরা। ঐ তরুনকেও অনেক খুঁজেছে তাকে কি আর পায়।
তরুণকে কি আর পায়? সে তখন সীমান্তের ঐ পারে ট্রেনিং নিতে ব্যস্ত। ফিরে এসে বল্লা দিয়ে নয় সত্যি কারের বুলেটে ওদের দেশ ছাড়া করতে হবে যে!
*
কুকুর নিয়ে আরেকটি ঘটনা আছে। আমি আর ছোট মামা (এই মামা এখন মোহগঞ্জের মেয়র) তখন প্রায়ই ঘুরে বেড়াতাম হিন্দু পাড়ায়। হিন্দুরা তখন বাড়ি ঘর ছেড়ে চলে গেছে। তাদের খা খা শূন্য ঘরে আমরা দুজন ঘুরে বেড়াতাম, কিছু করার নেই। স্কুল নেই পড়াশুনা নেই ঘুরে বেড়ানোটাই তখন এক মাত্র কাজ। একদিন একটা বাড়িতে দেখি একটা কাঠের সিন্দুক পড়ে আছে খুলে দেখি তাতে কিছু নেই তবে একটা বই পড়ে আছে। আমি নেমে বইটা উদ্ধার করলাম। বইটার সামনে পিছনে কোন পাতা নেই। তবে উল্টে পাল্টে যা বুঝলাম বইটা ভূতের। আমি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলাম রাতে বইটা পড়া যাবে। তখন পড়ার মতো বই-টই তেমন ছিলো না। কাজেই এই বইটা পেয়ে আমি খুবই উত্তেজিত। মামা তখন তাড়া দিল চল চল বাড়ি ফেরা যাক। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তখনই একটা ঘটনা ঘটল হঠাৎ দেখি আমার সামনে একটা কুকুর বেশ বড় আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে! ধূসর রঙের কুকুরটা চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে… আমি প্রচন্ড ভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম চিৎকার করে মামাকে ডাকলাম কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না আমার ধারনা ছিল মামা আমার সামনে কিন্তু মামা ছিল পিছনে। হঠাৎ পিছন থেকে মামা এসে বলল ‘কি হল?’
আমি বলি ‘কুকুর’
–কই কুকুর?
তাকিয়ে দেখি সামনে কোন কুকুর নেই। আশ্চর্য! বিষয়টা তখন আমরা দুজন আলোচনা করছিলাম। সেখানে একটু দেরীও হল আমাদের পরে যখন পথ ধরে এগুলাম একটু আগে ভয়ঙ্কর মিলিশিয়ার একটা দল সামনের রাস্তা দিয়ে পার হয়েছে তারই চিহ্ন চারদিকে! এই রকম নিরিবিলতে হঠাৎ আমাদের দেখলে নির্ঘাৎ মেরেই ফেলত এই কারণেই সেই প্রেত কুকুর আমাদের বাঁচিয়ে দিল? কে জানে!
পশু-পাখির কারণে মানুষ পাক আর্মীর কারণে বেঁচে গেছে এরকম অনেক ঘটনা কানে এসেছিল সেই সময়। তারাও আমাদের পাশে ছিল।
*
এক তরুণ ভালবাসে এক তরুণীকে। গভীর প্রেম। হঠাৎ কি হল সামান্য ঘটনায় তরুণী বেঁকে বসল! ফিরিয়ে দিল তরুণকে। প্রচণ্ড কষ্ট পেল তরুণ। ঠিক করল আত্মহত্যাই করব তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বন্ধুরা বোঝাল, ‘গাধা একজন মেয়ের জন্য আত্মহত্যা করবি? এরচে আমাদের সাথে চল দেশ জননীর জন্য প্রান দিবি।’ তাই হল তরুণটি বন্ধুদের সঙ্গে যুদ্ধে চলে গেল।
ওদিকে ঐ তরুণীর বিয়ে হয়ে গেছে। (তখন সুন্দরী মেয়েদের ঘরে রাখাই মুশকিল ছিল) বাসর রাতে মেয়েটি বউ সেজে বসে আছে। বর ঢুকলো, বর ঢুকেই বলল।
–খবর শুনেছ?
–কি খবর?
–তোমাদের পাড়ার বিখ্যাত কমাণ্ডার আজ একটা অপারেশনে শহীদ হয়েছেন।
— কোন কমাণ্ডার?
বর নাম বল্লেন। হায় এতো তার সেই অভিমানী প্রেমিকের নাম। স্তব্ধ হয়ে বসের রইল সেই বধু। চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রুর ধারা! …শহীদের এক ফোঁটা রক্তের কাছে প্রেমিকার হাজার অশ্রু আজ যেন মূল্যহীন…
*
এই রকমই আরেকটি ঘটনা। এক্ষেত্রে প্রেমিক প্রেমিকার বিচ্ছেদ ঘটেনি। প্রেমিক প্রেমিকার কাছে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছে। খুব নামও করেছে কমাণ্ডার হিসেবে।
একদিন কি মনে করে সেই প্রেমিকা রেডিও অন করল… আর কি আশ্চর্য শুনে স্বাধীন বাংলায় রেডিওতে তার প্রেমিকের নাম বলছে! নাম শোনা যায় না ভাল করে নব ঘুরিয়ে যা শুনলো… তা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল প্রেমিকা, তার বীর প্রেমিক শহীদ হয়েছে এক সম্মুখ যুদ্ধে।
যে বীর
তোমাকে ছেড়ে গেছে,
সে আসলে যায়নি!
সে ছিল শুধু তোমার হৃদয়ে
এখন, সবার…
*
পাক আর্মীরা এক বাড়িতে ঢুকে পড়েছে। খালি বাড়িতে তরুনী মা তার এক মাত্র কোলের সন্তানকে নিয়ে আলমারির পিছনে লুকালেন। দম বন্ধ করে আছেন। আর্মীরা ঐ ঘরেই ঢুকেছে, এই সময় কোলের বাচ্চা ফুঁপিয়ে উঠে কাঁদতে যাবে তিনি মুখ চেপে ধরলেন বাচ্চার যেন শব্দ বের না হয়। বাচ্চা ছটফট করছে… ওদিকে আর্মীরা ঘরে এটা সেটা ঘটছে। এক সময় চলেও গেল। মা সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চার মুখ থেকে হাত সরালেন কিন্তু হায় বাচ্চা মৃত। দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে তার আদরের সন্তান।