তারপর এক মহেন্দ্রক্ষণে প্রিয় দেশ একদিন স্বাধীন হল। স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন দেশে আমাকে ভর্তি করিয়ে দেয়া হল মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলে। ক্লাশ সেভেনে। কেন জানিনা স্কুলটাকে ভাল লাগাতে পারি নি কিছুতেই। আসলে একটা মানসিক চাপ কাজ করেছে, নানার বাড়িতে তখন আমরা অনেকটা আশ্রিত। যদিও আমাদের মামারা সবাই খুবই ভাল মানুষ। তবে ঐ স্কুলে একজন ভাল বন্ধু পেয়েছিলাম। সে হচ্ছে কামরুল সেও তার এক আত্মীয়য়ের বাসায় আশ্রিত ছিল। তবে খুব বেশীদিন আমাকে ঐ স্কুলে পড়তে হয় নি। পারিবারিক সিদ্ধান্তে আমরা স্বাধীনতার পরের বছরই ঢাকায় চলে আসি।
*
মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলে আমার যতনা স্মৃতি তার চেয়ে বেশী স্মৃতি এই স্কুলের বাইরে, ছোট মামাকে নিয়ে। এ স্কুলের পড়ার সময় আমার ক্লাশের বন্ধু কামরুলের পর সবচে ঘনিষ্ঠ ছিল এক ক্লাশ উপরে পড়া আমার ছোট মামা মাহবুবুন্নবী শেখ। স্কুলে এক সঙ্গে যেতাম আসতাম। এই মামার সঙ্গেই ১৯৭১ সালে একবার আর্মীর হাতে পড়ি। কোন কারণ ছাড়াই। ছোট মামা ছিল আমার চেয়ে লম্বা চওড়া আর সুদর্শন। আমরা যাচ্ছিলাম বাজারে। হঠাৎ একদল মিলিশিয়া আমাদের থামতে বলল। দুজনেই থামলাম। মামাকে আলাদা করে দাঁড় করালো, আমাকেও! ভয়ও পেলাম। মেরে ফেলবে নাকি। হঠাৎ একজন আমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে হাসতে শুরু করল। আমি অপ্রস্তুত! কি হল! এ সময় আরেকটা বয়স্ক মিলিশিয়া হাসতে থাকা তরুণ মিলিশিয়াকে থমক দিয়ে আমাদের চলে যেতে বলল। আমরা দ্রুত পা চালালাম। পিছনে শুনলাম তরুন মিলিশিয়া বলছে, ‘উসকা দোনো কান বহুত বাড়া হ্যায়!’
অর্থাৎ আমার দুই কান অনেক বড়। কথাটা মিথ্যে নয় অবশ্য। কান দুটো আমায় একটু বড়ই!
*
যশোহরের এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে শহরের কিছু কিশোরী, তরুনী তারা ছয়জন সবাই এক বাড়ির নয়। আলাদা আলাদা পরিবার ঘটনা চক্রে তারা এক সাথেই আছে পাশাপাশি বাড়িতে। সবাই আতঙ্কে আছে কখন এই এলাকায় হামলা চালায়। বাড়ীয় গুরুজনরা ঠিক করলো মেলেটারী এই এলাকায় এলে তরুনীরা সব বাড়ির পিছন দিয়ে ছুটে একটু দূরে বিলের ধান ক্ষেতে আশ্রয় নেবে। গার্জেনরা তাদের রাস্তাটা চিনিয়েও দিল। কিভাবে বিলের ধান ক্ষেতে যেতে হবে। তখন অগ্রাহায়ন মাস বিলে পানি নেই। ধান ক্ষেত গজিয়ে উঠেছে। প্রচুর ধান। তখন ফসল হয়েছিল প্রচুর।
তারপর হঠাৎ একদিন খবর এল মেলেটারী এসেছে। ছয় তরুনী ছুটলো তাদের চিনিয়ে দেয়া পথে। ছুটতে ছুটতে এক সময় গিয়ে আশ্রয় নিল সেই ধান ক্ষেতে। মিলিটারী গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এদিক ওদিক আগুন ধরিয়ে চলে গেল। তারা কেন এল কেন গেল ঠিক বোঝা গেল না। তবে প্রচুর আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে গেল। বিপদ যখন কেটে গেছে তখন বাড়ির গার্জেনরা একট নির্দিষ্ট আওয়াজ করল যেটা শুনে তরুনীরা বুঝবে আর বিপদ নেই, ফিরে আসা যায়। তারা ফিরে আসবে। আওয়াজ শুনে তারা ফিরেও এল। আবার সব স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ তারা আবিষ্কার করল তারা ফিরে এসেছে পাঁচ জন। একজন মিসিং! বয়সে সবচে ছোট যে কিশোরী সে নেই, সে ধান ক্ষেত থেকে ফিরে আসেনি! সবাই ছুটলো তার খোঁজে। কোথাও সে নেই! সবাই পাগলের মতো তাকে খুঁজছে, নেইতো নেই। শেষ পর্যন্ত পাওয়াই গেল না তাকে। তারপরও সবাই হারিকেন টর্চ দিয়ে খুঁজছে। রাত তিনটার দিকে পাওয়া গেল তাকে অন্য একটা ধান ক্ষেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সে আসলে আতঙ্কে ভয়ে দল ছুট হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। আহা বেচারী।
তার কিছু দিন পরই ঐ এলাকায় মিলিটারী এসে সব তছনছ করে দেয়। তবে তরুণীরা রক্ষা পায়। পরে তাদের মধ্যে একজন লেখিকা হিসেবে বেশ নাম করে।
*
এক তরুন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। হঠাৎ শখ হল এক ফাঁকে বাবা-মা ভাই-বোনদেরকে দেখে এলে কেমন হয়? কমান্ডার ছুটি দিলেন। কিছুদিন আগে একটা বড় অপারেশন করে এসেছে সে এখন তাকে ছুটি দেয়া যায়। ছুটি মঞ্জুর হল চারদিনের জন্য।
তরুন যোদ্ধা গভীর রাতে ফিরে এল। সবার আগে টের পেল তার প্রিয় পালা কুকুর ‘জিমি’। জিমি প্রভুর হঠাৎ আগমনে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করল। সেটাই হল সর্বনাশের কারণ। আশে পাশের রাজাকররা তক্কে তক্কে ছিল তারা জানে এই বাড়ির এক ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। তারা চোখ রেখেছিল বাড়ির উপর। কুকুরের চিৎকারে কিছু একটা টের পেল যেন।
পরদিন সকালে বাড়ি ঘিরে ফেলল আর্মী। ধরা পড়ল তরুন মুক্তিযোদ্ধা। হতবাক বাব-মা, ভাই- বোনকে ফেলে তাকে উঠতে হল একটা খোলা পিক আপে। পিক আপে দুজন রাজাকার চারজন আর্মি বসা সেখানে হাত পিছমোড় করে বেধে তাকে ভোলা হল। গাড়ি ছেড়ে দিল। কিন্তু জিমি যেন ক্ষেপে গেল। বিকট চিৎকার করে ছুটতে লাগল পিক আপের পিছনে পিছনে তরুন মুক্তিযোদ্ধা তাকিয়ে দেখছে ছুটে আসা জিমিকে। আর তখন এক রাজাকার তার হাতের থ্রি নট থ্রি রাইফেল তাক করল ছুটে আসা জিমির দিকে গুলি করবে। ট্রিগার চাপ দিতে যাবে তখনই তরুন মুক্তিযোদ্ধা দুপায়ে লাথি হাকাল রাজাকারের দিকে। প্রচন্ড শব্দে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে লাগলো পিক আপের কোনায় বসা মেলিটারীর গায়ে, সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু। জিমি ছুটতে ছুটতে অবাক হয়ে দেখল তার প্রভুর সেই শেষ যুদ্ধ, তার জন্য।