গান শেষ হলে রবিনহুড বলল, এতক্ষণ আমরা আপনাকে ব্ল্যাক নাইট নামেই জেনেছি। কিন্তু এখন আপনি আমাদের দলের মানুষ, আপনার পরিচয় জানার অধিকার এখন আমাদের আছে। বলুন, আপনার নাম কি?
রহস্যময় হাসি হেসে ব্ল্যাক নাইট বললেন, আমার নাম যথাসময়েই তোমরা জানতে পারবে। সেজন্য ব্যস্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
রবিনহুড বলল, বেশ, আমরা সেজন্য অপেক্ষা করব। কিন্তু আমাদের আর একটি সমস্যা আছে; আমরা অত্যন্ত উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন যাপন করছি। আপনি এখন আমাদের দলভুক্ত, অতএব আমাদের সমস্যা সম্পর্কে আপনার অবহিত হওয়া প্রয়োজন। আপনার পরামর্শ ও সাহায্য আমরা দাবি করতে পারি?
অবশ্যই। ব্ল্যাক নাইট বললেন, বল, কি তোমাদের সমস্যা; আমি সাধ্যানুযায়ী তোমাদের সাহায্য করব।
রবিনহুড সংক্ষেপে স্যার স্টিফেনের কিছু কিছু কুকীর্তি ও দুর্গ অবরোধের কথা ব্ল্যাক নাইটকে খুলে বলল। তিনি স্থির হয়ে সব শুনলেন, ধীরে ধীরে তার ললাটে জাগল ভ্রুকুটি-ভয়াল কুঞ্জন-রেখা…
মাস্টার রবিন! ব্ল্যাক নাইট বললেন, স্যার স্টিফেনের বহু অন্যায় ও অপরাধের কথা এর আগেই আমার কানে এসেছে। যে-দুর্গে সে অবরুদ্ধ হয়েছে, সেই দুর্গের অধিপতিকে সে এক বৎসর আগে হত্যা করেছে বলে তুমি অভিযোগ করছ- এখন বল, ওই দুর্গাধিপের নাম কি ছিল। তাকে হত্যা করার কারণ কি?
দুর্গাধিপের নাম আলফ্রেড অব শেরউড। রবিনহুড বলল, তিনি অ্যাংলো-স্যাক্সন হয়েও নমানবংশী স্যার স্টিফেনের আদেশ পালন করেননি, এই অপরাধেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।
–আদেশ পালন করেননি বলে হত্যা করা হয়েছে? আদেশটা কি ছিল?
–স্যার স্টিফেনের মনোমত পাত্রের সঙ্গে আলফ্রেড তাঁর কন্যার বিবাহ দিতে সম্মত হননি। কী! সক্রোধে গর্জন করে উঠলেন ব্ল্যাক নাইট, আলফ্রেড আমার পরিচিত। অ্যাংলো-স্যাক্সন হলেও তিনি ছিলেন রাজা রিচার্ডের অনুগত প্রজা। সামান্য কারণে তাঁকে হত্যা করেছে স্যার স্টিফেন?
সামান্য কারণে নয়, রবিনহুড বলল, স্যার স্টিফেনের নির্বাচিত পাত্রটি ছিল তারই ভ্রাতুস্পুত্র। ওই বিবাহ সম্পন্ন হলে আলফ্রডের সমুদয় সম্পত্তি হত স্যার স্টিফেনের হস্তগত।
ব্ল্যাক নাইট বললেন, স্যার স্টিফেনের পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। এইভাবে অনির্দিষ্ট কাল দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকতে আমি রাজি নই। আর সময়ের মূল্য আছে। কালই আমি পাপীর দণ্ডবিধান করব স্বহস্তে।
কিন্তু কেমন করে?রবিনহুড বলল, দুর্গের ভিতর প্রবেশ করা অসম্ভব। সেই চেষ্টা করতে গেলে আমার দলের বহু লোক প্রাণ হারাবে। আমি দলের লোকের অপমৃত্যু দেখতে চাই না।
ব্ল্যাক নাইট বললেন, স্যার স্টিফেন অত্যন্ত দাম্ভিক যোদ্ধা। তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলে সে নিশ্চয়ই যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।
বিমর্ষকণ্ঠে রবিনহুড বলল, তা ঠিক। কিন্তু তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করার ক্ষমতা আমাদের মধ্যে কারও নেই। ছয়-ছয়বার সে রাজদরবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়েছে। মনে রাখবেন, ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা ওই প্রতিযোগিতাগুলিতে অংশগ্রহণ করেছিল। সমগ্র ইংল্যান্ডে তার সমকক্ষ যোদ্ধা এখন একটিও নেই।
আমি প্রমাণ করে দেব তোমার ধারণা ভুল, ব্ল্যাক নাইট দৃঢ়স্বরে বললেন, ছয়বার সে জয়ী হয়েছে বটে, কিন্তু এইবার সে পরাজিত হবে। মাস্টার রবিন! তোমাদের কারুকে যুদ্ধ করতে হবে না। আমি স্বয়ং তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করব।
.
০৩. দ্বৈরথ
দুর্গের উপর দণ্ডায়মান প্রহরীরা দেখল বনের ভিতর থেকে সাদা নিশান হাতে এগিয়ে আসছে দুটি মানুষ। সাদা নিশান হচ্ছে শান্তির প্রতীক, তাই প্রহরীরা তির না চালিয়ে প্রশ্ন করল, কি চাও? নিশানধারী মানুষ দুটি আমাদের পরিচিত– রবিনহুড ও লিটল জন। রবিনহুড বলল, আমরা স্যার স্টিফেনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
সংবাদ পেয়ে দুর্গের ছাতে উপস্থিত হল স্যার স্টিফেন। হাঁক দিয়ে বলল, কি বলতে চাও তোমরা?
রবিনহুড বলল, আমি তোমার কাছে একটি প্রস্তাব জানাতে এসেছি। আমাদের দলভুক্ত এক ব্যক্তি তোমার সঙ্গে কথা কইতে চান। তার সঙ্গে আলোচনা করলে হয়তো তোমার হতে পারে।
উদ্ধত স্বরে স্যার স্টিফেন বলল, কোনো দস্যুর সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই না।
যিনি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান তিনি দস্যু নন। রবিনহুড বলল, তোমার সামনে এখন তিনটি পথ খোলা আছে। দুর্গের ভিতর বসে থেকে অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে পার, বাইরে বেরিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে লড়াই করতে পার, আর সম্মানজনক শর্তে মুক্তিলাভের উপায় সম্পর্কে আমাদের নির্বাচিত ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনা করতে পার। বলল, কি করবে?
স্বীকার করতে বাধা নেই যে, দুর্গে খাদ্যাভাব ঘটেছে, স্যার স্টিফেন বলল, তবুও একটা কথা জেনে রাখো। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে একটি প্রাণও বেঁচে থাকবে, ততক্ষণ তোমরা দুর্গের ভিতর প্রবেশ করতে পারবেনা। আমরা কিছুতেই আত্মসমর্পণ করবনা, শেষ পর্যন্ত লড়াই করব।
তার দরকার হবে না, রবিনহুড বলল, আমাদের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করলে হয়তো তোমাদের সম্মানজনক শর্তে মুক্তিলাভের উপায় হতে পারে।
বেশ, স্যার স্টিফেন বলল, আমি তোমাদের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা কইতে রাজি আছি।
রবিনহুড তার কটিবন্ধে আবন্ধ শিঙা তুলে নিয়ে ফুঁ দিল। শিঙার আওয়াজের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই স্যার স্টিফেনের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে অরণ্য ভেদ করে আবির্ভূত হল প্রকাণ্ড এক কালো ঘোড়ার পিঠে আপাদমস্তক বর্মাবৃত এক যোদ্ধা। যোদ্ধার বর্মের রং তার বাহনের মতোই কুচকুচে কালো। বলাই বাহুল্য, এই ঘোড়সওয়ার আমাদের পূর্ব-পরিচিত ব্ল্যাক নাইট।