দেশের যখন এই অবস্থা, সেই সময়ে স্যার স্টিফেন নামে এক দুর্ধর্ষ নর্ম্যান যোদ্ধা ঘোষণা করল রবিনহুডকে সে রাজা জনের কাছে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসবে– জীবিত অবস্থায় যদি তাকে আনা সম্ভব না হয়, তবে রবিনহুডের মৃতদেহকেই সে উপস্থিত করবে রাজদরবারে।
রবিনহুড সতর্ক হল। স্যার স্টিফেন মানুষ হিসাবে খুবই খারাপ বটে, কিন্তু সে ছিল দুর্জয় যোদ্ধা।
রাজদরবারে দ্বন্দ্বযুদ্ধের যে প্রতিযোগিতা হয়, সেই প্রতিযোগিতায় পর পর ছয়বার জয়লাভ করে সে প্রমাণ করে দিয়েছিল তার সমকক্ষ যোদ্ধা রীবপ্রসবিনী ইংল্যান্ডেও নিতান্ত বিরল।
ওই ভয়ংকর যোদ্ধাকে উপযুক্ত অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত হল রবিনহুড ও তার দস্যুদল, আয়োজনের কোনো ত্রুটি রইল না। স্যার স্টিফেনের নেতৃত্বে বিরাট নমানবাহিনী শেরউড বনে ঢুকে অনুসন্ধান শুরু করল। খুব বেশিদিন খোঁজাখুঁজি করবার দরকার হল না; হঠাৎ একদিন বনের আড়াল থেকে ঝক ঝক তির এসে কয়েক জন নর্মান সেনাকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। নম্যান তিরন্দাজরাও ধনুর্বাণ ব্যবহার করতে লাগল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের লক্ষ্য হল ব্যর্থ। স্যার স্টিফেনের মৃত্যু ছিল অবধারিত শুধু উৎকৃষ্ট স্প্যানিশ বর্মের কল্যাণেই পূর্বোক্ত যোদ্ধা সেবার বেঁচে গেল। দস্যুদের তির ওই স্পেনদেশীয় বর্মের কঠিন আবরণ ভেদ করে স্যার স্টিফেনের দেহ স্পর্শ করতে পারল না।
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ন্ত তিরের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে নর্ম্যান সৈন্যরা হয়তো দিশাহারা হয়ে ছুটতে শুরু করত, আর তাহলেই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দস্যুদল তাদের কচুকাটা করে ফেলতে পারত অনায়াসে। কিন্তু স্যার স্টিফেনের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব নর্ম্যান সেনাদের ছত্রভঙ্গ হতে দিল না– শৃঙ্খলা বজায় রেখে তির ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা পিছিয়ে যেতে শুরু করল..
কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর বনের ভিতর একটা বিধ্বস্ত দুর্গের কাছে এসে পড়ল স্যার স্টিফেন ও তার সৈন্যদল। এক সময় ওই দুর্গটি জনৈক অ্যাংলো-স্যাক্সন জমিদারের অধিকারভুক্ত ছিল। উক্ত জমিদারের মৃত্যু হয়েছিল স্যার স্টিফেনেরই হাতে। হত্যাকাণ্ড সমাধা করে দুর্গটিতে আগুন ধরিয়ে স্যার স্টিফেন স্থানত্যাগ করেছিল। অর্ধদগ্ধ ভগ্নাবশেষ তখনও বিরাজ করছিল শেরউড বনের মধ্যে। দুস্যদের আক্রমণের মুখে পিছিয়ে যেতে যেতে সেই দুর্গটির সামনে এসে পড়ল স্যার স্টিফেন।
স্যার স্টিফেন অভিজ্ঞ যোদ্ধা- এক নজর দেখেই সে বুঝল দুর্গের প্রাচীর দুই-এক জায়গায় ভেঙে গেছে বটে, তবু সেখানে আশ্রয় নিলে দুস্যদের কবল থেকে সহজেই আত্মরক্ষা করা যাবে। দুর্গ-প্রাকার ও পাষাণ-স্তম্ভের সারি দস্যুদের নিক্ষিপ্ত তিরগুলিকে বিফল করে দেবে, কিন্তু দুর্গ আক্রমণ করতে গেলে সামনের ফাঁকা মাঠের উপর দস্যুরা নর্ম্যান তিরন্দাজদের তিরের মুখে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। অবশ্য দুর্গের ভিতর বেশি দিন আটকে থাকলে খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে সৈন্যরা বিপন্ন হয়ে পড়বে কিন্তু সে তো পরের কথা, এখন প্রাণ বাঁচাতে হলে ওই দুর্গই হচ্ছে একমাত্র আশ্রয়। স্যার স্টিফেন ভেবে দেখল সৈন্যদের সঙ্গে যে খাদ্য ও পানীয় আনা হয়েছে, তাই দিয়ে এখন বেশ কিছুদিন চলবে, পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। অতএব, স্যার স্টিফেন সৈন্য নিয়ে দুর্গের ভিতর প্রবেশ করার উদ্যোগ করল।
রবিনহুড বুঝল স্যার স্টিফেনের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে নর্ম্যান-সেনা নাগালের বাইরে চলে যাবে– সে তাড়াতাড়ি দলবল নিয়ে নর্ম্যানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল; অধিনায়কের নির্দেশে দুস্যরা ধনুর্বান ছেড়ে তরবারি হাতে অবতীর্ণ হল সম্মুখযুদ্ধে।
কিন্তু নানদের বাধা দেওয়া গেল না। তারা বুঝেছিল ওই দুর্গই এখন তাদের প্রাণ বাঁচাতে পারে। প্রাণপণে যুদ্ধ করতে করতে তারা দুর্গের ভিতর ঢুকে পড়ল। সঙ্গেসঙ্গে সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল সিংহদ্বার এবং দুর্গের ভিতর থেকে ছুটে এল এক ঝাক তির দুস্যদের লক্ষ্য করে। হতাহত সঙ্গীদের নিয়ে দুস্যরা আবার বনের আড়ালে গা-ঢাকা দিল। তারপর নজর রাখতে লাগল দুর্গের উপর। দুর্গের চুড়া ও প্রাকার থেকে নান-সৈন্যরাও চারদিকে নজর রাখছিল। বাইরে অরণ্যগর্ভে আত্মগোপন করে দস্যুদলও বসে ছিল অতন্দ্র প্রহরায়। রবিনহুড জানত কিছুদিন পরেই নর্ম্যানদের খাদ্যাভাব ঘটবে, তখন হয় তারা অনশনে মৃত্যুবরণ করবে আর নয়তো বেরিয়ে এসে যুদ্ধ করতে বাধ্য হবে। সুতরাং দুর্গ অবরোধ করে বসে থাকলেই দুস্যদের জয় অনিবার্য।
দুর্গ অবরোধ করে দস্যুরা খুব উল্লসিত হয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু আর একটা ভয়ংকর সম্ভাবনা সম্পর্কে রবিনহুড ছিল অতিশয় সচেতন– কোনো রকমে স্যার স্টিফেনের বিপদের খবর যদি বনের বাইরে নর্ম্যানদের কানে যায়, তাহলে তারা সৈন্যসামন্ত নিয়ে শেরউড বনে হানা দিতে পারে। সেরকম ঘটনা ঘটলে স্যার স্টিফেন তো মুক্তি পাবেই, উপরন্তু দুই দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে দস্যুদের অবস্থা হবে শোচনীয়। অতএব, রবিনহুডের নির্দেশে বিভিন্ন অধিনায়কের নেতৃত্বে ছোটো-ছোটো দল বনের প্রবেশপথগুলির উপর ঘুরে ঘুরে নজর রাখতে লাগল..
দুর্গ অবরোদের পর প্রায় পনেরো দিন কাটল নিরুপদ্রবে। দুর্গের ভিতর থেকে নর্ম্যান-সেনা এবং বনের আড়াল থেকে দস্যুদল পরস্পরের উপর নজর রাখছে- কিন্তু কোনো পক্ষই এগিয়ে এসে তিরের মুখে আত্মপ্রকাশ করতে রাজি নয়। ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত রূপ ধারণ করে তেমনই এক ভয়ংকর স্তব্ধতা বিরাজ করছে শেরউড বনের বুকে…।