আজ থেকে বহু বৎসর আগেকার কথা। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে ইংল্যান্ডের বুকে যখন প্রবল বিক্রমে শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছে বিজয়ী নৰ্মান জাতি এবং তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ওই দেশেরই আদিবাসী অ্যাংলো-স্যাক্সন গোষ্ঠী- সেই সময়, অস্ত্রের শাণিত ফলকে রক্তের অক্ষরে লিখিত ইতিহাসের পটভূমিতে আমাদের কাহিনির শুরু…
গল্প আরম্ভ করার আগে তৎকালীন ইংল্যান্ডের বিষয়ে কয়েকটা কথা বলা দরকার। যখনকার কথা বলছি, সেই সময়ে ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন রিচার্ড প্ল্যান্টজেনেট ইতিহাস তাকে সিংহ-হৃদয় রিচার্ড নামে অভিহিত করেছে।
নামটা নিতান্ত বৃথা হয়নি। রিচার্ড ছিলেন সিংহের মতোই পরাক্রমশালী- যাকে বলে, পুরুষসিংহ। শোনা যায় তিনি নাকি তুলোয়ারের এক আঘাতে সওয়ার সমেত একটি ঘোড়াকে দুটুকরো করে ফেলতে পারতেন। হয়তো এটা অতিশয়োক্তি, তবে তিনি যে দেহে-মনে অসাধারণ শক্তিমান ছিলেন সে কথা ইতিহাসও স্বীকার করেছে। বিজয়ী নর্মান ও বিজিত অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি পরস্পরকে ঘৃণা করলেও এই সাহসী রণনিপুণ নৃপতিকে তারা সকলেই শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। কারণ, নর্মান রাজবংশে জন্মগ্রহণ করলেও রিচার্ডের কাছে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব ছিল না।
রিচার্ডের দেহের উচ্চতা ছিল ছয় ফুট চার ইঞ্চি, পরিধি ছিল দৈর্ঘ্যের অনুপাতে বিস্তৃত এবং পেশীর প্রাচুর্যে প্রচণ্ড। তার দেহ ছিল যেমন প্রকাণ্ড, অন্তঃকরণ ছিল তেমই প্রশস্ত, উদার। কয়েকটি স্বার্থান্ধ হীনচেতা মানুষ ছাড়া জাতি নির্বিশেষে সমগ্র ইংল্যান্ডবাসীর কাছে রিচার্ড ছিলেন একান্ত আপনজন, ভালোবাসার মানুষ।
কিন্তু ইংল্যান্ডবাসী তথা অ্যাংলো-স্যাক্সনদের দুর্ভাগ্য–রাজদণ্ড হাতে নিয়ে রাজ্য পরিচালনার চাইতে তরবারি হাতে রণক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনার কাজটাই ছিল রিচার্ডের কাছে অধিকতর প্রিয়। তাই যুদ্ধের সুযোগ পেলেই রাজ্য পরিচালনার ভার প্রতিনিধির হাতে দিয়ে তিনি সসৈন্যে অবতীর্ণ হতেন যুদ্ধের প্রাঙ্গণে। যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে প্যালেস্টাইনে মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের যুদ্ধ চলছিল। রিচার্ড সেই যুদ্ধে যোগদানের সংকল্প করলেন। রাজ্য পরিচালনার ভার ভ্রাতা জন-এর হাতে দিয়ে রিচার্ড সৈন্য নিয়ে চলে গেলেন প্যালেস্টাইনে এবং সেখানে উপস্থিত অন্যান্য খ্রিস্টান রাজাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধে নামলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে।ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে ইতিহাসে খ্যাত পূর্বোক্ত যুদ্ধে রিচার্ড যে অদ্ভুত বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন, তাই নিয়ে বহু কিংবদন্তী রচিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাহিনির পটভূমি হচ্ছে ইংল্যান্ড, অতএব রিচার্ডকে প্যালেস্টাইনে রেখে আমরা ফিরে আসছি আবার ইংল্যান্ডের মাটিতে, যেখানে রিচার্ডের অবর্তমানে রাজদণ্ড ধারণ করেছেন জন।
জন ছিলেন যেমন স্বার্থপর, তেমনই খল চরিত্রের মানুষ। তার রাজত্বকালে নর্মানরা তাদের অধীন অ্যাংলো-স্যাক্সনদের উপর অত্যাচার শুরু করল। নতুন নতুন কর আর নানারকম অন্যায় দাবির দাপটে অস্থির হয়ে উঠল অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতি। ফলে, বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল কয়েকটি স্থানে। যদিও নর্ম্যানদের প্রচণ্ড তরবারি অধিকাংশ স্থানেই রক্তের স্রোতে সেই আগুনকে নিবিয়ে দিল, তবুও স্ফুলিঙ্গ একেবারে নির্বাপিত হল না। অ্যাংলো-স্যাক্সন গোষ্ঠীর ভিতর থেকে আবির্ভূত হল এক দুর্ধর্ষ যোদ্ধা নাম, রবিনহুড। কিছু দিনের মধ্যেই তার নেতৃত্বে ইংল্যান্ডের বুকে আত্মপ্রকাশ করল এক বিদ্রোহী বাহিনী। রবিনহুডের নেতৃত্বে ওই বাহিনী সুযোগ পেলেই নম্যানদের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করত। নর্মানরা ওই বাহিনীকে দুস্য আখ্যা দিল।
বিভিন্ন অস্ত্রচালনায় সুদক্ষ ওই দস্যুদল নিয়ে রবিনহুড নর্ম্যানদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করল। নম্যানদের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হলে রবিনহুড ও তার দুস্যদলের পরাজয় ছিল অনিবার্য। কিন্তু দস্যুরা আঘাত হানত অতর্কিতে এবং লুণ্ঠন সমাধা করেই গা-ঢাকা দিত শেরউড নামক অরণ্যের অন্তঃপুরে।
নম্যান জমিদার ও শেরিফদের মধ্যে অনেকেই বিপুল বাহিনী নিয়ে রবিনহুডকে শায়েস্তা করতে শেরউড বনের মধ্যে অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। অজানা বনপথের ভিতর দিয়ে অশ্বারোহী নর্মান সেনাদল দ্রুত চলাফেরা করতে পারত না। গাছের আড়াল থেকে নর্ম্যানদের অগোচরে তাদের উপর লক্ষ রাখত রবিনহুডের অনুচরবর্গ- তারপর সুযোগ বুঝে আক্রমণ চালাত শত্রুপক্ষের উপর। আচম্বিতে অরণ্য ভেদ করে ছুটে আসত ঝাঁকে ঝকে তির এবং ব্যাপারটা ভালোভাবে বোধগম্য হওয়ার আগেই তিরবিদ্ধ হয়ে অধিকাংশ নম্যান সৈন্য হত ধরাতলে লম্বমান। তারপর হতচকিত ও ভয়ার্ত নম্যানরা যখন পলায়নের উদ্যোগ করত, তখন তরবারি হাতে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত রবিনহুড তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লড়াই শেষ হতাহত সঙ্গীদের বনের মধ্যে ফেলে রেখে নগরের দিকে পলায়ন করত হতাবশিষ্ট নর্ম্যান সৈন্য।
বারংবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার পর অত্যাচারী নর্মান জমিদার, ধর্মযাজক ও শেরিফের দল সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল আর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাছা বাছা অ্যাংলো-স্যাক্সন যোদ্ধার দল এসে রবিনহুডের দলকে ভারী করে তুলল। ওই দুস্যদল শেরউড বনে সংরক্ষিত হরিণ মেরে ক্ষুধা নিবারণ করত এবং সুযোগ পেলেই ধনী নর্ম্যানদের সম্পত্তি লুঠ করত মহোৎসাহে। বার বার মার খেয়ে শেরউড বনের ভিতর নর্মানরা আর প্রবেশ করতে চাইত না, তাদের কাছে শেরউড বন হয়ে দাঁড়াল মৃত্যুপুরীর মতোই ভয়াবহ।