- বইয়ের নামঃ নয়নার জন্যে গোলাপ
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ ছড়াসমগ্র
কয়েকটি ছড়া
১
বাদলা দিনে বাঁশবাগানে
হাওয়ার রাজা বাজায় বাঁশি!
বাঁশির সুরে ব্যাকুল হয়ে
আমরা সবাই বাইরে আসি।
২
ভকভকিয়ে ভীষণ কালো
ধোঁয়া বেরোয় গলিময়,
বুকের ভেতর চমকে ওঠে
ভূতের মতোই ভূতের ভয়।
৩
রবিবারের রোদের মতো
খুশি মনে ঝরে;
রোগীর গালে রঙ লেগেছে
হাড় কাঁপে না জ্বরে।
গোলাপের উদ্দেশে নয়না
গোলাপ তুমি গাছের ডালে
কেমন ক’রে ফোটো?
ঘুম জড়ানো খুব সকালে
কী করে বোন ওঠো?
জগৎ জোড়া সুনাম তোমার
সত্যি বলে জানি।
সবাই তোমায় ভালোবেসে
ডাকে ফুলের রানী।
তোমার ঘ্রাণে সবার প্রাণে
খুশির দোলা লাগে;
কারো কারো মনে আবার
ছড়ার ছন্দ জাগে।
তোমায় নিয়ে কত কবি
পদ্য লেখেন সুখে,
থাকো তুমি ফুলবাগানে
সদাই হাসিমুখে।
জানি তোমার রূপ পাবো না
শত চেষ্টা করে,
যেন ঘ্রাণের মতোই গুণে
মনটি ওঠে ভরে।
ছড়াগুচ্ছ
১
ফুরফুরে এই ফটিক হাওয়ায়
উড়ছে উড়ুক চুল,
ফুটফুটে সব ফুটপাতে আজ
ফুটুক অচিন ফুল।
২
বর্ষা এলে বৃষ্টি বটে
বুটির মতো পড়ে।
কখনো বা বৃষ্টি ধারা
বর্ষা হয়ে ঝরে।
৩
ভরদুপুরে ফাঁকা ভিটায়
ভুতুম ডাকে নাকি?
ভূতের ভয়ে ভড়কে গেল
ভারিক্কি-এক পাখি।
৪
মাঝরাতে ঐ মেঘের ডুলি
হাওয়ায় নড়ে চড়ে
পরীর মতো মেয়ে নামে
ময়নামতীর চরে।
ডাকাবুকো ছেলেটা
পাশের বাড়ির ডাকাবুকো
সেই ছেলেটা
হরহামেশা পাড়াটাকে মাতায়।
বাপের জামার পকেট থেকে
মাঝে মাঝে
দিনদুপুরে টাকাকড়ি হাতায়।
সেই ছেলেটা লেখাপড়ার
ধার ধারে না,
হিজিবিজি আঁকে শুধু খাতায়।
যখন খুশি হেসে খেলে
কাঁঠাল ভাঙে
পাড়ার যত খেলার সাথীর মাতায়।
ঝম ঝমা ঝম বৃষ্টি এলে
ঘুরে বেড়ায়
ছাতা নিয়ে, হাজার ফুটো ছাতায়!
ধুলো কাঁকর শুকনো পাতা,
ভাঙা চুড়ি
নিয়ে খালি মেতে থাকে যা’তা’য়।
পাখির সাথে, বনবেড়ালের
ভায়ের সাথে
কী সহজে দোস্তি সে-যে পাতায়।
দীপিতার হাতের নিশান
দীপিতা, তুমি যে আজকে তোমার হাতে
উড়িয়ে নিশান ছুটছো সবার সাথে,
বলো, এটা কেন? মন দিয়ে তবে শোনো-
আজ আমাদের বিজয় দিবস জেনো।
ভিনদেশী কিছু শক্র এখানে এসে
করেছে জুলুম আমাদের নিজ দেশে।
সয়েছি আমরা বহুকাল মুখ বুজে,
পরে ঠিক পথ সবাই নিয়েছি খুঁজে।
দীপিতা, বলছি শোনো মন দিয়ে কথা,
সয়েছি আমরা পদে পদে নানা ব্যথা।
বিদেশী শক্র, ঘরের শক্র মিলে
বাঙালির প্রাণ কেড়েছে একটি ঢিলে!
দীপিতা, যখন তুমি হবে বড় বেশ,
বুঝবে কী করে স্বাধীন হয়েছে দেশ।
জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধা যারা,
তোমার হাতের নিশান এনেছে তারা।
নয়নার কিছু কথা
মাটির ঘোড়া, কাঠের ঘোড়া
গড়তে আমার ভালো লাগে।
নানা রঙের পরীর কথা
পড়তে আমার ভালো লাগে।
মনে মনে পাখির মতো
উড়তে আমার ভালো লাগে।
তেপান্তরের ধুধু মাঠে
ঘুরতে আমার ভালো লাগে।
নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে কথা
বলতে আমার ভালো লাগে,
জ্যোৎস্নারাতে পথে একা
চলতে আমার ভালো লাগে।
দোয়েল পাখির মধুর ধ্বনি
শুনতে আমার ভালো লাগে,
শুয়ে-শুয়ে রাতের তারা
গুনতে আমার ভালো লাগে।
দিদার সাথে রাতের বেলা
থাকতে আমার ভালো লাগে।
ফুলের ছবি, বকের ছবি
আঁকতে আমার ভালো লাগে।
বই থেকে রোজ অনেক কিছু
শিখতে আমার ভালো লাগে,
দাদাভায়ের মতো ছড়া
লিখতে আমার ভালো লাগে।
বাপী কাহিনী
এক যে আছে এই শহরে
বাপী নামের ছেলে।
বলতে পারি তুলনা তার
সহজে না মেলে।
পড়াশোনা করতো খুবই
লিখতো ছড়া কত।
ছড়াগুলো গান শোনাতো
ভোরের পাখির মতো।
স্বপ্নে-দেখা ঘোড়া উড়ে
আসতো বাপীর কাছে,
উঠোন জুড়ে ঝরতো আলো
পক্ষ্মীরাজের নাচে।
হঠাৎ কারা দিলো ছেঁটে
সেই ঘোড়াটার পাখা।
সেই ঘোড়াটা আর আসে না
বাপীর উঠোন ফাঁকা।
বাপীর সাধের স্বপ্নগুলো
থেঁতলে দিলো যারা,
লোকের পাঁজর গুঁড়িয়ে দিয়ে
মোটর হাঁকায় তারা।
বাপী এখন রোগের সাথে
লড়ছে সারাক্ষণ।
তারই জন্যে ছড়া কাটেন
আজকে কবিগণ।
বাড়ি
বাড়ি করছেন,
আশমান-ছোঁয়া
বাড়ি করছেন!
উনি করছেন,
তিনি করছেন,
দোতলা তেতলা
বাড়ি করছেন।
লেনে বাইলেনে
রাস্তার ধারে,
পুকুরে পাড়ে,
বাড়ি করছেন।
বগর বাজিয়ে
কেমন গাজিয়ে
বাড়ি করছেন।
খোকা খুকুমণি
বাজাও এখুনি
বাজাও হে তালি।
হাত বড় টান,
তবু আলিশান
বাড়ি করছেন
মীর করমালি।
মেরে কিছু মাছি
এ শহরে আছি।
সাত তাড়াতাড়ি
এখনো গড়তে
পারিনিতো বাড়ি।
তবু সান্ত্বনা
আছে এক কণা।
মেঘ-মুল্লুকে
আমি মহাসুখে
গড়েছি মহল!
করিনি খরচ
এক কানাকড়ি।
আমার মহল
বিনি আলোতেই
করে ঝ
সেখানে নিত্য
খুব সুন্দরী
লাল নীল পরী
দিচ্ছে টহল।
বৃষ্টি পড়ে
বৃষ্টি পড়ে ঝমঝমিয়ে আকাশ ফেটে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
শুকনো জমি ফোঁটাগুলো খাচ্ছে চেটে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে পাড়াতলীর ধুধু চরে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে গরিব চাষির কুঁড়েঘরে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে চিকন সবুজ ডুমুর পাতায়,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে খইয়ের মতো, জুঁইয়ের মতো,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে অষ্টপ্রহর অবিরত,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে আঁধার ঢাকা ছোট্র গাঁয়ে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে ঘাটে-বাঁধা ডিঙি নায়ে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে হারান মাঝির উঠোন জুড়ে,
বৃষ্টি পড়ে,বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে কাজী বাড়ির তাল পুকুরে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে, দিচ্ছে উঁকি ছেলেবেলা,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে চলছে দুলে সাধের ভেলা,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে এই শহরে গলির মোড়ে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে আজিমপুরের নতুন গোরে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে ফ্ল্যাট বাড়ির খোলা ছাদে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
খোলার ঘরে কালো মেয়ে খোঁপা বাঁধে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে ঘুমের ভেতর গহীন গাঙে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে মধ্যরাতে স্বপ্ন ভাঙে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে ময়ূরপঙ্খী নায়ের দাঁড়ে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে মায়াপুরীর সিংহদ্বারে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে অনেক দূরের পাহাড়পুরে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
বৃষ্টি পড়ে একলা কবির ছাপরা কুঁড়ে,
বৃষ্টি পড়ে, বৃষ্টি পড়ে।
সাত সাগরের বুড়ো
সেই যে কবে চাপলো কাঁধে
সাত সাগরের বুড়ো,
হিসেব কষে দেখছি হলো
হাজার বছর পুরো।
দুধ আনো হে, তামাক আনো’,
বলে কাঁধের বুড়ো,
জলদি আনো কড়াই থেকে
মাছের ল্যাজা মুড়ো।
নইলে বাছা লাথির চোটে
করবো পাঁজর গুঁড়ো।
তোমরা খেয়ো মাঝে মাঝে
মজা খুদের কুঁড়ো।
‘কাঁধ ছেড়ে আর নামছি না তো
নেইকো তাড়াহুড়ো।
মাথায় নিয়ে নাচো সবাই,
গানটি সাথে জুড়ো’।
এই না বলে তুলতে থাকে
সাত সাগরের বুড়ো,
হিসেব কষে দেখছি হলো
হাজার বছর পুরো।