- বইয়ের নামঃ নয়নার জন্য
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ ছড়াসমগ্র
আষাঢ়
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে,
এল ভেজা আষাঢ় মাস।
ভেজে রাস্তা, বাড়ি-গাড়ি,
ভেজে মাটি, সবুজ ঘাস।
আষাঢ় মাসের পায়ে ঘুঙুর,
ওহো ঝুমুর ঝুমুর বাজে।
হঠাৎ রাঙা সাপের মতো
বিজলি নাচে মেঘের মাঝে।
চুপসে গেছে ভিজে ভিজে
আষাঢ় মাসের বিষ্টিতে কাক
দিনদুপুরে রাতদুপুরে
বৃষ্টি যেন তীরের ঝাঁক।
আষাঢ় মাসে কাগজ দিয়ে
নৌকা বানায় খোকা-খুকি
জল-বিছানো উঠোনে নাও
ভাসতে দেখে বেজায় সুখী।
আষাঢ় মাসের রোদে জলে
হবে খেঁকশেয়ালের বিয়ে।
আমরা ঘুমাই আঁধার ঘরে
গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে।
আষাঢ় মাসে দুপুরবেলা
বৃষ্টি দেখার পাই যে খুশি,
পানির নাচন দেখছে ব’সে
সবার সঙ্গে সফেদ পুষি।
ঝমঝমাঝম আষাঢ় মাসে
ভূতের গল্প শুনতে চাও?
তা হলে ওই ভূত-তাড়ানো
গল্পবুড়োর কাছে যাও।
একালের এক রাজ্যে
একালের এক রাজ্যে আছেন
রূপসী এক রানি।
তাঁর বিষয়ে আমরা সবাই
অনেক কিছুই জানি।
ঘোড়াশালে ঘোড়া আছে,
হাতিশালে হাতি।
রানির সকল দরদালানে
জ্বলে ঘিয়ের বাতি।
রানির রূপের কদর আছে
হাটে ঘাটে মাঠে।
অথচ তার কুশাসনে
দেশ উঠেছে লাটে।
তাঁর হুকুমে সান্ত্রি-সেপাই
জুলুম করে খুবই।
সবাই ভাবে মহারানির
হবে ভরাডুবি।
গরিব প্রজার পেট ভরে না
রূপের ছটা দেখে।
ভাত খেতে দাও, বলছে ওরা-
যাচ্ছে সবাই বেঁকে।
রানি তবু আঁকড়ে থাকেন
সাধের সোনার গদি।
চিন্তা কি তাঁর? যাক-না বয়ে
দেশে খুনের নদী!
কাক
কাক যদিও ধূসর-কালো
কিন্তু আনে ভোরের আলো।
কাক ডাকলে হয় যে ভোর,
নয়না রোজ খোলে দোর।
রোদের কলস উপুড়-করা
দুপুর করে খাঁ খাঁ,
এই শহরের উদাস পাড়ায়
কাক ডাকে কা কা।
কাকপক্ষী চালাক ভারি,
বুদ্ধি খাটায় তাড়াতাড়ি।
এঁটো-কাঁটা, মরা ইঁদুর,
পাউরুটি আর নলেন গুড়,
ডিম, পরোটা, খাশ্তা পাঁপর-
কাকপক্ষী সবই খায়,
মাঝে-মাঝে জট পাকায়।
গাইয়ে পাখি দোয়েল, শ্যামা
আদর কুড়ায়, কুড়াক।
পাতিকাক আর দাঁড়াকাকের
ডাকেও মন জুড়াক।
ভিন্ন স্বরের, ওরাও থাক,
থাক, থাক, থাক,
সবাই থাক।
খোকন দ্যাখে
চাঁদের মতো নৌকা চলে
আকাশ-নদীর জলে।
মেঘমুলুকে মায়াবৃক্ষে
মণি-মুক্তো ফলে।
রাতদুপুরে খোকন দ্যাখে
ডানাঅলা ঘোড়া,
ঘোড়ার শরীর আগাগোড়া
জোছনা দিয়ে মোড়া।
খোকন জানে, সেই ঘোড়াটা
মেঘে বেড়ায় ঘুরে,
তারার ধুলো লেগে থাকে
পখিরাজের খুরে।
পক্ষিরাজে সওয়ার হয়ে
খোকন যাচ্ছে উড়ে,
যায় সে দূরে আকাশছোঁয়া
উঁচু পাহাড়চূড়ে।
সকাল হতেই খোকন দ্যাখে,
আছে সে তো শুয়ে,
সেই ঘোড়াটা গায়ের এখন
যেন কারো ফুঁয়ে।
খোকা এখন
খোকা এখন টোপর বানায়
গাছের পাতা দিয়ে।
টোপর দেখে উঠল নেচে
সবুজ রঙের টিয়ে।
টিয়ে শোনায় মজার গল্প,
খোকন শোনে ব’সে।
হঠাৎ খোকা পক্ষিরাজের
ডানা ধরে ক’ষে।
পাষাণপুরীর বন্ধ দুয়ার,
বাঘের মুখে ঘাস।
বাঘের মুখে মাংস দে রে
খুলতে যদি চাস।
খোকন দ্যাখে দোর খুলে যায়,
এ কী তেলেসমাৎ!
সোনার খাটে রাজকুমারী
ঘুমায় যে দিন-রাত।
খোকন সোনা রাজার মেয়ের
ঘুম ভাঙাল ওরে
সোনার কাঠি রূপোর কাঠি
অদল-বদল ক’রে।
চক্ষু মেলে খোকা দ্যাখে
নেই সে তেপান্তরে-
শুয়ে আছে কাঠের খাটে
একলা নিজের ঘরে।
ছড়ার হাটে নয়না
নয়না তার খেলাঘরে খেলছে ব’সে
সাথি করে দিদাকে।
রাঙা মেঘে সুয্যি ডোবে, নয়না আজ
জয় করেছে খিদাকে।
সন্ধেবেলা ঝোপের ধারে জ্বলে-নেভে
পাঁচটা-ছ’টা জোনাকি।
আকাশ জুড়ে জমে কত তারার মেলা,
তারা যাবে গোনা কি?
নিশুতরাতে স্বপ্ন ভেঙে গেলে আবার
লাগে তাতে জোড়া কি?
পরীরা সব পরীস্তানে নাচের বাবদ
পাচ্ছে কত খোরাকি?
নয়না ওই তেপান্তরে আজকে পেল
ডানাঅলা ঘোড়া কি?
ঘোড়ার পিঠের টুকটুকে লাল গদিখানা
মেঘ-চাদরে মোড়া কি?
আজ নয়না ছড়ার হাটে এল ছুটে
সঙ্গে নিয়ে ময়না।
ছড়ার হাটে খেলার মতো আর কোথাও
এমন মজা হয় না।
তবুও তিনি রাজা
সারা দেশে সবাই মিলে
বাজা বাদ্যি বাজা-
মাথায় তাঁর ছিল না তাজ,
তবুও তিনি রাজা।
মধুমতী নদীর তীরে
টুঙ্গিপাড়া গাঁয়ে
ঘাসের ডগা খেত চুমো
সেই রাজারই পায়ে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু
সবাই বলে তাঁকে।
ছুটে আসে দেশের মানুষ
মহান নেতার ডাকে।
তাঁর দেখানো পথেই জানি
স্বাধীন হ’ল দেশ,
মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনারা
নাস্তানাবুদ, শেষ।
ঘরের শক্র খুনিরা সব
প্রাণ কেড়েছে তাঁর।
কিন্তু তাঁরই জিত হয়েছে
খুনির হ’ল হার।
কুচক্রীরা ঘোরাক যতই
ইতিহাসের চাকা,
কৃষক-মজুর সবার মনে
তাঁর ছবিটাই আঁকা।
নতুন শতক
নতুন শতক এল দ্যাখো
ময়ূরপঙ্খি নায়ে।
খুশির আবীর ছড়িয়ে পড়ে
শহর এবং গাঁয়ে।
ময়ূরপঙ্খি নায়ের ভেতর
কত্ত কিছু আছে,
তাই-না দেখে মনের সুখে
দোয়েল-শ্যামা নাচে।
আর রবে না অভাব কোনো
দেশ কি দেশান্তরে,
খোকা-খুকির মুখে হাসি
ফুটবে ঘরে-ঘরে।
ভায়ে-ভায়ে হবে না আর
লড়াই কোনোখানে
দিগ্ধিদিক উঠবে ভ’রে
বুক-মেলানো গানে।
খরায় পোড়া বিরান মাঠে
ফলবে ফসল কত,
নতুন শতক জ্বালবে পিদিম
লক্ষ তারার মতো।
এই বোশেখে নতুন শতক
এল খেলাঘরে-
এই-না বলে খোকা-খুকি
পঙ্খিরাজে চড়ে।
পঙ্খিরাজের ডানায় আছে
কত্ত ছড়া লেখা।
নতুন যুগের নতুন ছড়া
আজকে যাবে শেখা।
নয়না আজ
নয়না আজ হেসে বেড়ায়,
হালকা হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়,
মনে খুশির ঢেউ।
যতই হাসুক, যতই নাচুক,
বকবে নাকো কেউ।
নয়না আজ দিন কাটাবে
খুশির বালুচরে,
মাঝে-মাঝে দেবে উঁকি
দাদুর পড়ার ঘরে।
নয়না আজ দেবে যে তার
পুতুল-ছেলের বিয়ে।
সেই বিয়েতে ঢোল বাজাবে
সাতটি সবুজ টিয়ে।
নয়না আজ দাদুর মুখে
সেমাই দেবে পুরে।
তাই-না দেখে প্রজাপতি
আসবে হঠাৎ উড়ে।
নয়না ও হলদে পাখি
নয়না এক ছোট্র মেয়ে,
দেখতে ওকে চাও?
তবে এসো ভাসিয়ে তুমি
ময়ূরপঙ্খি নাও।
হলদে পাখি, হলদে পাখি
কোথায় তুমি যাও?
নয়না আজ মুড়কি দেবে,
পেটটি ভরে খাও।
হলদে পাখি, হলদে পাখি,
একটু জিরিয়ে নাও,
নয়না সুর ছড়িয়ে দেবে
বনের গানটি গাও।
হলদে পাখি, হলদে পাখি,
কোথায় তোমার ছাও?
জলদি তুমি তাকে এনে
নয়নাকে দাও।
নয়না ওই বাচ্চাটাকে
বলবে, ‘মধু খাও’।
দেবে ওকে ছোলা, মোয়া,
দেবে পুতুলটাও।
হলদে পাখি, হলদে পাখি,
কোথায় তোমার গাঁও?
নয়না খুব ডাকছে তোমায়,
তার কাছেই যাও।
নয়নার চাওয়াগুলো
নয়না চায় এই গলিতে
যাক বয়ে যাক একটি নদী।
এক পলকে বইছে নদী
নয়নাদের ঘর অবধি।
নয়না চায় আকাশ থেকে
ঝরুক তারা বাগানে তার,
বাগান জুড়ে তারার মেলা,
দেখছে সবাই চমৎকার।
নয়না চায় তাদের ঘরে
আসুক দোয়েল, কোয়েল, টিয়ে
এক নিমেষে নয়না এই
খেলছে ব’সে ওদের নিয়ে।
নয়না চায় ভিড়ুক দোরে
মনপবনের সোনালি নাও,
চোখের পাতা কাঁপার সাথেই
নায়ের পালে লাগছে বাও।
নয়নার এই চাওয়াগুলো ফলছে কেমন
ক’রে, জানো?
কিছু তুলি, রঙের বাক্সো
দোকান থেকে কিনে আনো।
এনে সেসব ইচ্ছেমতো
কাগজ জুড়ে আঁকো ছবি,
দেখবে তুমি চাইছ যা যা
একে একে হচ্ছে সবই।
ভোট
ছোট্রে সবাই ছোট,
হেসে-খেলে
শান্ত থেকে
দলে দলে
ছোট্রে সবাই ছোট।
দিতে হবে ভোট।
ভোট পাওয়ার জন্যে
কারা বাঁধে জোট?
কারা পাকায় ঘোঁট?
ভোট কেনার জন্যে
কারা হল হন্যে?
এদিক ওদিক
রাতবিরেতে
কারা ছড়ায় নোট?
লোভের ফাঁদে
কেউ দিয়ো না পা।
খোলা মনে
নাচো তা ধিন তা।
ছোট্রে সবাই ছোট
ঠিক লোককে
দিতে হবে ভোট।
চাই না কোনো কাড়াকাড়ি,
মারামারি,
কাতারবন্দি ভায়েরা কেউ
বোনেরা কেউ
পায় না যেন চোটা।
শান্তভাবে ভদ্রভাবে
দিয়ো সবাই ভোট।
মাছ-শিকারি পানকৌড়ি
কুচকুকে এক কালো পাখি,
পানকৌড়ি তাকেই ডাকি’।
চুপ, চুপ, চুপ
পানিতে এই শব্দ কিসের
ঝুপ, ঝুপ, ঝুপ?
গাঁয়ের বিলে দাঁড় বাইছে কেউ কি?
মাটিভাঙা ঢেউ কি?
চুপ, চুপ, চুপ,
পানকৌড়ি এই দিয়েছে ডুব।
বিলের তলে ঠাণ্ডা জলে
কেন এই কসরত?
জল কি আর শরবত?
তবে বলো কী করতে?
মাছ ধরতে।
চুপ, চুপ, চুপ,
মাছ-শিকারি পানকৌড়ি এই দিয়েছে
ডুব।
জেনে রাখো পানকৌড়ি
মাছের ভক্ত খুব।
দেখতে দেখতে দিন ফুরাল,
সুয্যি ডোবে ডোবে।
ব্যাঙ ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর
বিয়ে খাবার লোভে।
দুলা-টিয়ে আসবে কখন?
পালকি গেল কই?
কোথায় গেল মণ্ডা মিঠাই,
গামছা-পাতা দই?
টিয়ে-কনে কখন থেকে
ব’সে আছে সেজে,
ফিঙেগুলো রং মেখেছে
শেয়ালভায়ার লেজে।
টিয়ে-কনে ক্লান্ত হয়ে
ঘুমে পড়ে ঢ’লে;
বর আসে না দেখে শেষে
নয়না যায় চ’লে।
ময়না, শালিক
ময়না-শালিক বন্ধু দু’জন,
সকল সময় থাকে অনেক কাছে।
ময়না যখন সুরে মাতে,
শালিক তখন মনের সুখে নাচে।
ময়না-শালিক বন্ধু দু’জন,
রৌদ্র-ছায়ায় ঝগড়া তাদের নেই।
বিপদ এলে লুকায় তারা
একই সাথে এক আস্তানাতেই।
ওদের খুশি দেখে হঠাৎ
হিংসুটে এক কাদা রঙের পাখি
ওদের মাঝে উড়ে এসে
কড়া স্বরে জুড়ল ডাকাকাডি।
কী যে হ’ল, ময়না-শালিক
ঝগড়া করে ভীষণ দিল আড়ি-
কেউ কারুর মুখ দ্যাখে না,
আগের মতো যায় না কারো বাড়ি।
লাঠি
সোনার জাদুর হাতে আছে
লাঠির মতো লাঠি
সেই লাঠিটা অনেক বছর
তেল খেয়েছে খাঁটি।
তার ঘুমানোর জন্যে লাগে
মস্ত শীতল পাটি।
সেই লাঠিটা কখনো হয়
সোনা-রূপার কাঠি।
সোনার জাদুর লাঠির বলে
বুক ফুলিয়ে হাঁটি।
ঘুরলে লাঠি যায় গুঁড়িয়ে
দৈত্যদানোর ঘাঁটি।
লাঠি খসায় বারো ভূতের
পুতের দাঁতের পাটি।
সেই লাঠিটা ফসল বাঁচায়
বাঁচায় দেশের মাটি।
লালন সাঁই
ছেউড়িয়াতে ছিলেন এক বাউল কবি,
নামটি যে তাঁর লালন সাঁই।
গান বেঁধে তাঁর দিন কেটেছে রাত কেটেছে,
এই ভুবনে তুলনা তাঁর নাই।
থাকত হাতে দোতারা তাঁর, বাজত সুরে
মেঠো পথে, গাছতলাতে ভাই;
গানের কথা শুনে লোকে বলত নেচে
আমরা সবাই এমনতরোই চাই।
লালন ফকির বড় মাপের মানুষ
ছিলেন,
তাঁরই গানে হয় যে মন রোশনাই।
লালন বলেন সবচে’ দামি মানুষ
রতন-
চলো আমরা ছেউড়িয়াতে যাই।