- বইয়ের নামঃ লাল ফুলকির ছড়া
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ ছড়াসমগ্র
আদ্যিকালে
কোথায় যেন গেছে উড়ে
কাপড় জামা সবই।
কাপড় ছাড়া পথে ঘাটে
হাঁটা মজার হবি।
এই দেহটা ঢেকে আমি
পাতায়, গাছের ছালে
ভাবব আহা গেছি চলে
সেই-না আদ্যিকালে।
উভয়সঙ্কট
কোন দিকে গেলে পার পাবে?
ডান দিকে গেলে মার খাবে,
বাম দিকে গেলে মার খাবে।
কোন দিকে গেলে পার পাবে?
ক্ষুধা
দারুণ এক খিদের তাড়ায়
লোকটা ঘোরে পাড়ায় পাড়ায়।
যা-কিছু সে পাচ্ছে খাবার
চেটেপুটে করছে সাবাড়।
মাংস, পোলাও, কোপ্তা, কাবাব
কাবার করে দিচ্ছে জবাব।
লোকটা বটে পেটের নবাব।
ঘুরছে তবু খিদের জ্বালায়,
দেখলে তাকে সবাই পালায়।
মুরগি, ভেড়া, গোরু, ছাগল
টপ টপা টপ গিলছে কেবল।
পাখির বাসা, কালির ঝুল,
নবাববাড়ি, লোহার পুল,
দেখছি শুধু পুরছে পেটে-
পাটকলটা খাচ্ছে চেটে।
ডাকলে কাছে ভুলেও কভু
ঘেঁষি না তার সামনে তবু।
তফাত থেকেই ঠুকি সেলাম।
পথে যেতে দেখতে পেলাম-
ডি আই টি-টাও হচ্ছে কাবাব;
লোকটা বসে খাচ্ছে খাবার!
ঘরোয়া
গিন্নি বলেন গয়নাগুলি
হতেই হবে জড়োয়া
বলেন হেঁকে পাতি নেতা-
‘কে করে কার পরোয়া?
রাজনীতিটা জমবে ভালো
হোক-না সেটা ঘরোয়া’।
ছাঁটাই
ঢাকা শহর আজব শহর
এই শহরে জবর খবর-
তাক ডুমা ডুম ডুম।
এই শহর মহা ধুমে
ডিম পেড়েছে ঘোড়া ডুমে,
তাক ডুমা ডুম ডুম।
দৌড়ে এলে আমার কিছু,
খবর পাবে আরো কিছু-
তাক ডুমা ডুম ডুম।
বর্ণমালা টেডি হবে,
খিটির মিটির কথা কবে-
তাক ডুমা ডুম ডুম।
কান-ফোকরে গুঁজে তুলো
চালায় কাঁচি দর্জিগুলো,
তাক ডুমা ডুম ডুম।
বর্ণমালার কাপড় ছেঁটে
করবে আঁটো করবে বেঁটে,
তাক ডুমা ডুম ডুম।
আমার মনে চালের মণে
মিল হবে যে মাথার কোণে,
তাক ডুমা ডুম ডুম।
পাক-না হাসি, হোক-না ফানি,
পানি ছেড়ে লিখব ‘হানি’,
তাক ডুমা ডুম ডুম।
ওহে একটু করে ফুঁ দাও,
হবে বর্ণমালা-ই উধাও-
তাক ডুমা ডুম ডুম।
পড়ার পাটটি যাবে চুকে,
বাদ্যি বাজাই তাই তো সুখে-
তাক ডুমা ডুম ডুম।
ছড়া
সবাই করে আহা উহু,
কার কাহিনী কে শোনে?
চায়ের চিনি উধাও হ’ল,
চাল মেলে না রেশনে।
সর্ষে তেলের ঘ্রাণ পাওয়া ভার,
নেইকো ঘরে জ্বালানি।
পণ্যগুলো হচ্ছে লোপাট,
ধন্য চোরচালানি।
ছড়ায় এক ইতিহাস
বাস্রে সে কী একাত্তরে
ফুলবাগানে, খেলাঘরে,
গলির মোড়ে, নদীতীরে,
ফ্ল্যাটে এবং খড়-কুটিরে,
ক্ষেত্রের আলে, ছাঁদনাতলায়,
বাংলাদেশের বুকে গলায়
রাত-দুপুরে অন্ধকারে
খটখটা খট পড়ল হাড়ে
জেনারেলের বুট।
হাজার হাজার সৈন্য এসে
দাগল কামান বাংলাদেশে
মেশিনগানের চ্যাঁচানিতে
পারে না কেউ নিদ্রা দিতে।
মরল মানুষ মাছির মতো
দিনরাত্তির অবিরত,
মরল মানুষ পথে ঘাটে,
বন্ধ ঘরে, খোলা মাঠে-
নয়কো মোটে ঝুট।
দানোর ভয়ে দলে দলে
গ্রাম্য বধূ লুকায় জলে।
খেলা ভুলে শিশুরা হায়
মায়ের বুকে শুধু লুকায়।
শহর শহর সব শহরে
গেরস্তদের পোড়াঘরে,
হাট-বাজারে গঞ্জ-গ্রামে
দিন-দুপুরে খোদার নামে
চলল হরির লুট।
হাজার হাজার মুক্তিসেনা,
কেউ-বা চেনা, কেউ অচেনা-
পড়ল ছেয়ে সারাদেশে
রকমারি ছদ্মবেশে।
রইল মিশে খালের পাশে,
গাছের পাতায় ঘাসে ঘাসে।
তাদের দেখে শক্র যত
ভয়-পাওয়া সব হুলোর মতো
দিল বেজায় ছুট।
ঢ্যাম কুড়কুড়
ঢ্যাম কুড়কুড় বাদ্যি বাজে
বাজে হরেক যন্ত্র।
ঢোলের তালে বদ্যি পড়ে
সাপ-তাড়ানো মন্ত্র।
মন্ত্র শুনে উঠছে কেঁপে
চিতাবাঘের অন্ত্র।
নেকড়ে মশাই খেপে বলেন-
‘মস্ত ষড়যন্ত্র,
পক্ষিরাজের পিঠে চড়ে
আসবে গণতন্ত্র’।
দামাল ছেলে
বাংলাদেশের দামাল ছেলে,
দেশজোড়া তার লাফ।
বলল হেঁকে, ‘দৈত্য-দানো,
সাফ হয়ে যা সাফ’।
যেখানে যায় সঙ্গে ছোটে
মস্ত শহর, গ্রাম।
তার যে নাচেব ছন্দে নাচে
মানুষ, বাড়ি, ট্রাম।
কী জাদু তার গলার স্বরে
দেশ হয়ে যায় গান!
গানের সুরে ভিনদেশী সেই
রাজার কাঁপে প্রাণ।
রাজার সেপাই বাঁধল তাকে,
হ’ল যে তার জেল,
কিন্তু এ কী দেখল সবাই
ভানুমতীর খেল।
বাংলাদেশের দামাল ছেলে
বাজায় এমন বীণ,
তারই সুরে শেকল ছেঁড়ে,
রাত হয়ে যায় দিন!
ফাও
ফাও পেতে চাও? ফাও?
ওয়াসার কাছে চাও।
পানির সঙ্গে পাবে
গুবরেপোকার ছা-ও।
বর্গি-তাড়ানো গান
ছেলে ঘুমায় না, পাড়া জুড়ায় না,
বর্গিরা এল দেশে।
বর্গি তাড়াবে তাই তো খোকন
সাজল বীরের বেশে।
সূর্যের মুখে দেয় যারা কালি,
আগুন ছড়ায় হাটে-মাঠে খালি,
কেরে নেয় কচি-কাঁচাদের হাসি,
মেঘ থেকে বোমা ছোড়ে রাশি রাশি,
তাদের রুখতে খোকন দাঁড়ায়
কামানের কাঁধ ঘেঁষে।
দত্যি-দানব আসুক না হয়,
রাক্ষস দেখে পায় না সে ভয়।
দেবে না ভাঙতে ঘর-বাড়ি, পুল,
ভায়ের লাটাই, বোনের পুতুল,
মায়ের হাতের চুড়ি সুন্দর-
দেবে না ভাঙতে এই খেলাঘর,
তাই তো খোকন কামান-গোলায়
বুক পেতে দেয় হেসে।
দ্যাখো, দ্যাখো চেয়ে বর্গি পালায়,
খোকনের ওই গোলার জ্বালায়।
প্রাণ নিয়ে দেয় চম্পট ওরা,
কেউ প’ড়ে মরে, কেউ হয় খোঁড়া।
আজকে খোকন তাড়ায় বর্গি
মেঘ হতে মেঘে ভেসে!
বাংলার বাঘ
বাংলার বাঘ
মনে রেখে দাগ
গেলেন যেদিন,
আমরা সেদিন
শতকোটি লোক
মুছলাম চোখ।
ঘুরছে বছর,
বাড়ছে খবর।
জনমানবের
রং-বেরঙের
অনেক পুতুল
হয়েছেন ধুল।
তবু দেখি আজ
তিনি মহারাজ
কোটি মানুষের
তাজা হৃদয়েরঃ
আমাদের মন
তাঁর রাজাসন!
বিকল্প
কাফন ছাড়াই লাশগুলো সব
করছ দাফন কি?
ছেঁড়া কাঁথা কলার পাতা
মন্দ কাফন কী!
বিবেচনা
ঠগ বেছো না, ঠগ বেছো না,
এ-গাঁয়ে ভাই ঠগ বাছাটা বারণ।
এক নিমেষে উজাড় হওয়ার
ভয়টা হ’ল ঠগ না বাছার কারণ।
বেচাকেনা
বিকোচ্ছে তো অনেক কিছু
এই শহরে, দূরের গ্রামে।
কত্ত দামে? কত্ত দামে?
অল্প দামে, জলের দামে।
হাঁড়িকুড়ি, কলসি, ঘটি,
আলমারি আর চৌকি, চুলো
হর-হামেশা কিনছে সবাই
কিনছে তুলো, কিনছে কুলো।
মাছের ঝাঁকা, ফুলের ঝুড়ি,
দাঁড়ের পাখি, ফুলের চারা
এক নিমেষে হচ্ছে উধাও-
হচ্ছে খালি বাজার-পাড়া।
এই নিয়ে যাও পুতুল জোড়া,
কাঠের ঘোড়া তোমার নামে।
কত্ত দামে? কত্ত দামে?
অল্প দামে, জলের দামে।
ডজন চারেক কিনবে গুণী?
বিকোন তাঁরা ডানে-বামে।
কত্ত দামে? কত্ত দামে?
অল্প দামে, জলের দামে।
ভিয়েতনাম
দিন-দুপুরে ওমা!
ফেললে কারা বোমা?
মেকং নদীর দেশে
হুট করে ভাই এসে
গোল বাধাল কারা?
বর্গি নাকি তারা?
ফসল হল ধুলো,
পুড়ছে শহরগুলো-
কী যে তাদের নাম?
কোথায় ওদের ধাম?
পুড়ছে ভিয়েতনাম।
বাজপাখিদের মতো
উড়ছে বিমান শত
শহর এবং গ্রামে,
উড়ছে ভিয়েতনামে।
বাজপাখিরা জেনো
পণ করেছে যেন
ঝাপটা মেরে জোরে
তেড়ে এসে ওরে
ডানে কিংবা বাঁয়ে
তীক্ষ্ম নখের ঘায়ে
উপড়ে নেবে গ্রাম,
পুড়ছে ভিয়েতনাম।
বর্গি বটে তারা।
দিন-দুপুরে যারা
করছে রাহাজানি,
তাদের কাছে জানি
নেই মানুষের দাম।
পুড়ছে ভিয়েতনাম।
জ্বলছে অবিরত
বারুদ জ্বলার মতো,
জ্বলছে ভিয়েতনাম।
মিনতি
ইঁদুর ইঁদুর ইঁদুর
পায়ে পড়ি,
তড়ি ঘড়ি
চাল খেয়ো না, ডাল খেয়ো না,
মাথায় দেব সিঁদুর।
রূপকথা
আজব দেশের ধন্য রাজা
দেশজোড়া তাঁর নাম।
বসলে বলেন ‘হাঁট রে তোরা’,
চললে বলেন, ‘থাম।
রাজ্যে ছিল সান্ত্রি-সিপাই
মন্ত্রী কয়েক জোড়া।
হাতিশালে হাতি ছিল
ঘোড়াশালে ঘোড়া।
গাছের ডালে শুক-সারিদের
গল্প ছিল কত,
গল্পে তাদের রাজার কথা
ফুটত খইয়ের মতো।
চাষির মাঠে ধান ফলে না,
ফসল গেল কই?
রাজা বলে খাওগে সবাই
রাঙাধানের খই।
রাঙাধানের খই পাব কই,
বলল দেশের প্রজা,
খই ফুরুল, দই ফুরুল,
নেইকো পিঠের মজা।
‘আর কটা দিন সবুর করো’
রাজা বলেন হেসে,
‘ফলবে মেওয়া, সোনা-দানায়
রাজ্যি যাবে ভেসে।
এই-না বলে স্বপ্নে রাজা
দেখেন সোনার ঘোড়া।
প্রজা দেখে রাজার মুকুট
কাগজ দিয়ে গড়া!
শব্দ
শব্দ সে তো জোছনা-নাওয়া নদীর
তীর,
শব্দ সে তো সন্ধেবেলার মেলার ভিড়।
শব্দ সে তো ভর-দুপুরে শঙ্খচিল,
শব্দ সে তো টলটলে ওই পদ্মা বিল।
শব্দ সে তো রাখালছেলের ডাগর চোখ,
শব্দ সে তো চলতি পথে হাটের লোক।
শব্দ সে তো খোকনসোনার চিকন ছিপ,
শব্দ সে তো লক্ষ্মী-মেয়ের লালচে
টিপ।
শব্দ সে তো আয়না-জোড়া নানির মুখ,
শব্দ সে তো নকশি পিঠে খাওয়ার সুখ।
শব্দ সে তো ভরা গাঙের মাঝির হাঁক,
শব্দ সে তো ধর্মঘটের ব্যস্ত ডাক।
শব্দ সে তো পিঠে-বাঁধা নতুন তূণ,
শব্দ সে তো বীর শহিদের তাজা খুন।
শব্দ সে তো দুঃখভরা পথের শেষ,
শব্দ সে তো রৌদ্রমাখা বাংলাদেশ।
সম্পর্ক
রাতারাতি লাল হয়ে যায়
কালোবাজারি
শুনলে পরে হবে ওরা
কয়েক হাজারই।
আইনে বলে, হ্যাঁ গো, কাজটা
ওদের সাজারই।
কিন্তু ওদের সাজা দিলে
রুই কাতলা সবাই মিলে
রেগেমেগে করবে মিটিং
করবে মুখ ব্যাজার-ই।
সেই যে যিনি
সেই যি যিনি বাংলাদেশে পদ্য লিখে
এনেছিলেন বান,
বলতে পার কাদের জন্যে তাঁর
সে-লেখা
প্রাণ-জুড়োনো গান?
বলতে পার কাদের তিনি? বিশেষ করে
কাদের তিনি আজ?
সত্যি বলি, এই কথাটা বলতে পারা
নয়কো সহজ কাজ।
ওই যে দ্যাখো আকাশ জুড়ে সূর্য
থাকেন
আদ্যিকালের বুড়ো-
বিশেষ করে কাদের জন্যে দিন-দুপুরে
ছড়ান আলোর গুঁড়ো?
লাটের বাড়ি, চাষির কুটির-যেখানে
যাও,
সূর্য ওঠে হেসে।
তখন জানি শুধায় না কেউ, তার
ঠিকানা
কোন সে অচিন দেশে?
এপার ওপার সবখানেতে একই রূপে
সূর্য বিলোন আলো।
তার সে আলোর রং ওপারে হলদে হলে
এপারে নয় কালো।
সেই যে যিনি ছিলেন কবি, তাঁর
কবিতার
পাই যে আজো রেশ।
সেই কবিকে ভূগোল দিয়ে যায় না
বাঁধা,
সবখানে তাঁর দেশ।
হাঘরে
দালান ভরা এই শহরে
এক যে ছিল হাঘরে।
সারি সারি বাড়ির দিকে
থাকত চেয়ে হাঁ করে।
থাকার মতো ঘর ছিল না
ঘুরত পথে আহা রে!
ভাবত ব’সে যায় না থাকা
বনে কিংবা পাহাড়ে?
এই শহরে সবাই বলে
‘এখান থেকে হটো রে’।
তাই বুঝি সে থাকতে গেল
গাছের ফাঁকা কোটরে।