রক্ত হিম করা চিৎকারে চমকে চাইল দুই ভাই। আবছা আবছা কী দেখল, বুঝল না কিছুই। হুটোপুটির শব্দ হচ্ছে ভীষণ!, আর কর্কশ চিৎকারটা তো রয়েছেই।
সারা ঘর জুড়ে শুরু হলো তাণ্ডব। ঝড় উঠল ধুলোর। ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো ছাত। দমকা হাওয়ার ঝাঁপটা লাগছে, ওদের গায়ে। ভয় পেয়ে বাড়ি ছাড়ল কয়েকটা কবুতর।
পকেট হাতড়ে টর্চ বের করল আয়ান। ভাইয়ের দেখাদেখি আয়মানও। আলো জ্বালতেই দেখা গেল বিচিত্র দৃশ্য। সাদা কাপড় পরা দুই প্রেত-নারী হামলে পড়েছে একে অন্যের উপরে! কামড়াচ্ছে… খামচাচ্ছে… অন্ধ রাগে চুল ছিঁড়ছে! একবার নিচে নামছে! একবার উপরে! এ-কোণ থেকে ধেয়ে যাচ্ছে ও-কোনায়! তারপর আচমকা জানালাপথে অদৃশ্য হয়ে গেল বাইরে। দু জনেই। শোনা গেল বুক-চেরা এক চিৎকার। তারপর সব চুপ।– শিকড় গজিয়ে গেছে যেন পায়ে। আতঙ্কে জমে গিয়ে দৃশ্যটা দেখছিল দুই ভাই। ভুলে গিয়েছিল নড়তে। অনেকক্ষণ লাগল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে।
.
যতক্ষণ না ব্রিজ পেরোল ওদের গাড়ি, একটা কথাও বলল না দু জনের কেউ।
কী দেখলাম, বল তো? হতচকিত ভাবটা এখনও কাটেনি আয়মানের।
ক্যাট-ফাইট, আয়ানও ঘোরগ্রস্ত, তার পরও কৌতুক করল।
মেয়েটা কে?
একটা নিঃসন্দেহে আসল মেয়েটা… যার কবলে পড়ে প্রাণ দিয়েছে এতগুলো মানুষ।
আমি অন্যজনের কথা বলছি।
সাশা ছাড়া তো আর কাউকে ভাবতে পারছি না!
কিন্তু কেন?
প্রশ্নটা আমারও। কেন?
ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করল আয়মান পকেট থেকে। ভাঁজ খুলে বাড়িয়ে ধরল ভাইয়ের দিকে। এটা পড়।
কী এটা?
বেনের ডায়েরির একটা পৃষ্ঠা। পড়।
কার্টসি লাইটটা জ্বেলে দিল আয়ান। আলোয় ধরল। পাতাটা।
আগের পৃষ্ঠায় শেষ হয়নি বাক্য। শেষাংশ রয়েছে এটাতে।
…ও যে আর স্বাভাবিক নেই, বুঝতে পারিনি আমরা কেউই। বুঝলাম, যেদিন নিজের হাতে। বাথটাবে চুবিয়ে মারল বাচ্চাটাকে। স্বীকারও করল নিজে এসে।
এই প্রথম ভয় পেলাম, আমি নিজের বউকে। কিন্তু তখনও বড় ভালোবাসি ওকে, যেমনটা বাসি এখনও।
মিথ্যা বললাম পুলিসকে। কিন্তু এতে করেও রক্ষা করতে পারলাম না–ওকে। হয়তো কোনও এক মুহূর্তে চেতনা ফিরেছিল ওর; অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় কী করে বসেছে, উপলব্ধি করতে পেরে সইতে পারেনি। শেষ করে দিয়েছে নিজেকে। আমাকে করে দিয়েছে একা… একদম একা…
কখন জোগাড় করলি এটা?
তুই যখন বাথরুমে ছিলি, উত্তর আয়মানের।
দেখাই যাচ্ছে, ধোয়া তুলসি পাতা না সাশা।
বিষয়টা জানা দরকার না মানুষের?
বাদ দে। মেয়েটা যদি জীবিত থাকত, তা হলে একটা কথা ছিল। পাপ সে করেছে, জীবন দিয়ে প্রায়শ্চিত্তও করেছে- ব্যস, কাটাকাটি। তা ছাড়া অসুস্থ ছিল মেয়েটা। অসুস্থ অবস্থায় কী করেছে, না করেছে, সেসব ধরলে অন্যায়ই করা হবে ওর প্রতি।
কিন্তু ও পাগল হলো কেন?
তার আমি কী জানি? এক হাজার একটা সম্ভাবনার কথা বলা যায়। ধরা যাক, ডিলন লোকটা আগে থেকেই প্রেত পিশাচের পাগল। সারাক্ষণ পড়ে থাকে এই নিয়ে। এদিকে তার বউয়ের হয়তো পছন্দ না এসব বিষয়। কিন্তু চোখের সামনে অদ্ভুত-অদ্ভুত জিনিস দেখছে প্রতিনিয়ত… বিচিত্র সব বিষয়ের উপরে বইপত্র… ছবি-টবি… সুস্থ মানুষকে পাগল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট।
এবার তা হলে,…
এখানেই যতি দিই। কী বলিস?
রহস্যের পুরোটা না জেনে ফিরে যাবি?
কেন জানি মনে হচ্ছে, এরপর আর এগোনোটা ঠিক হবে না। মনে কর, মস্ত এক ফাড়া কাটল আজকে। প্রাচীন ওই ভূতটা মনে হয় হামলে পড়তে যাচ্ছিল আমাদের উপরে…
তা-ই যদি হয়, তা হলে তো বলতে হবে, সাশা আমাদের বাঁচিয়েছে।
হ্যাঁ, তা-ই।
আবারও প্রশ্ন: কেন?
কোনও উত্তর নেই… অনুমান আছে।
বল, শুনি।
নিজের অগোচরে হোক, যে পাপ ও করেছে, সেটার প্রায়শ্চিত্ত মরার পরেও শেষ হয়নি। মর-জগতে গিয়ে তাই উপকার করার চেষ্টা করছে জীবিত মানুষের। শুনতে কি হাস্যকর লাগছে?
না, লাগছে না। শেকসপিয়র তো বলেই দিয়েছে: স্বর্গ মর্তে এমন অনেক কিছুই রয়েছে, যা আমাদের জানার বাইরে। …তবে অশরীরী দুটোর কী হলো, জানতে পারলে ভালো হতো, রে! তোর কী মনে হয়? কী হতে পারে?
আপাতত চোখ রাখব পত্রিকার পাতায়। দেখব, এই এলাকায় আর কোনও রহস্যময় খুন হয় কি না। যদি না হয়, বুঝব, ভূতটার দফারফা করে দিয়েছে সাশা।
আর যদি হয়?
কিছু করার নেই।
তা হলে চলতেই থাকবে একের পর এক খুন?
কিছু করার নেই।
ভূতটা সাশার কোনও ক্ষতি না করলেই হয়!
টেনশন হচ্ছে? প্রেমে পড়েছিস নাকি?
প্রেম না। মমতা। দীর্ঘশ্বাস পড়ল একটা। …তা হলে ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন?।
সোজা।
ভয় লাগছে না তোর?
কীসের?
আম্মিকে ফেস করবি কেমন করে? দুপুরে জরুরি কাজে আটকা পড়েছি বলে সেই যে ফোন অফ করলাম, এখন তো খুলতেও ভয় করছে!
খুলিস না! আমিও খুলছি না! একেবারে সরাসরি সামনে গিয়ে পড়ব।
তুই আগে যাবি! তোর পিছে থাকব আমি! এহ! চড়-থাপ্পড়গুলো একাই খাব নাকি আমি?
তোর জন্য টার্কির মাংস মিস করলাম। মাশুল তো দিতেই হবে।
দুম করে কিল মারল আয়ান আয়মানের বাহুতে। শালা ঘরের শত্রু বিভীষণ!
রক্তের দোষ
হাঁটছে লিটা। শশব্যস্ত।
তাড়া আছে ওর। আজকে দেরি হয়ে গেছে বাসা থেকে বেরোতে। তার উপর বৃষ্টি। মড়ার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো পথে গাড়িঘোড়া একদম নেই।