এদিক-ওদিক ঘুরল ও কিছুক্ষণ। দোকানে-দোকানে ঘুরে ঘুরে বিক্রিবাট্টা দেখল।
অনেক কিছুই বেচাকেনা হচ্ছে। মাছ। ফল। আনাজপাতি। শেকড়বাকড়। টোটকা ওষুধ। গিরগিটির ছাল। সাপের চামড়া।
নিজেদের ভাষায় কথা বলছে ক্রেতা-বিক্রেতা। এক বর্ণও বুঝল না লামিয়া। কিচিরমিচির মনে হলো ওর কাছে।
কিছু কিনল না ও।
এসে দাঁড়াল বড় এক চাদোয়ার নিচে।
চুড়ির মতো দেখতে কাঠের কিছু চাকতি ঝুলছে দড়ি থেকে। আকারে চুড়ি থেকে বড়। মাকড়সার মতো সুতো দিয়ে জাল বোনা হয়েছে চাকতিগুলোর মাঝখানটায়। এক একটা জালে এক-এক রকম জ্যামিতিক নকশা। আর জালের গিঁটগুলোতে বসানো হয়েছে পুঁতি। গোলকগুলোর নিচের অংশে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে পাখির পালক। কোনও কোনওটায় পালকের বদলে ঝুলছে চামড়ার ফালি।
জিনিসটা চিনতে পারল না লামিয়া।
এক্সকিউজ মি, দোকানে বসা মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল ও। কী জিনিস এগুলো?
মৃদু হাসল নীল চিয়াংসাম পরা তরুণী।
ড্রিমক্যাচার, ম্যাম, বলল ইংরেজিতে। স্বপ্নভুক।
তার পরও অথই জলে লামিয়া।
ড্রিমক্যাচারটা কী জিনিস?
দুঃস্বপ্ন তাড়ায়। ঘরের মধ্যে ঝুলিয়ে দেবেন- ব্যস, আজেবাজে স্বপ্ন দেখবেন না আর।
আসলেই?
প্রশান্ত হাসি ছড়িয়ে পড়ল মেয়েটার মুখে। আমরা বিশ্বাস করি, ম্যাডাম।
ও। এসবে বিশ্বাস না করলেও প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান কিংবা মূল্যবোধের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না কখনও লামিয়া। ইতিহাসের ছাত্রী বলেই হয়তো।
নিয়ে যান, ম্যাডাম, বলল তরুণী। চোখের নিচে কালি আপনার। নিশ্চয়ই ভালো ঘুম হয় না রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন কি? একটা ড্রিমক্যাচার নিয়ে যান। অনেক উপকারে আসবে।
ফিক করে হেসে ফেলল লামিয়া। রাতে আমি মড়ার মতো ঘুমাই। সারাটা দিন এত ধকল যায় যে শরীরের উপর দিয়ে, রাত দুটো-তিনটের সময় বালিশে মাথা রাখা মাত্রই ঘুমিয়ে পড়ি। দুঃস্বপ্ন তো দূরের কথা, স্বপ্নই দেখি না কোনও। চোখের নিচে কালি পড়েছে আসলে অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করার কারণে।
এতটুকু বিব্রত হলো না মেয়েটা। নির্মল হাসিটাও মলিন হলো না এক বিন্দু। তার পরও নিতে পারেন, ম্যাডাম। স্বপ্নের কথা তো বলা যায় না কিছু।
লামিয়াও ভাবছিল নেয়ার কথা। মেয়েটার সারল্য ভালো লেগেছে ওর।
ঠিক আছে, দিন তা হলে, বলল। এত করে বলছেন যখন।
কোন্টা দেব, ম্যাডাম?
আপনিই একটা পছন্দ করে দিন না!
.
ট্যাপটা বন্ধ করে দিল লামিয়া। ভরে এসেছে পোরসেলিনের প্রকাণ্ড বাথটাবটা।
লিকুইড সোপের বোতল থেকে অকৃপণ ভাবে গোলাপগন্ধী সাবান ঢালল ঈষদুষ্ণ পানিতে। ক্রমাগত হাত নেড়ে পুরু আস্তর তৈরি করল ফেনার। তারপর পরনের সমস্ত কাপড় খুলে ফেলল একে একে। প্রথমে বাঁ পায়ের আঙুল। ছোঁয়াল পানিতে, তারপর নামল টাবে। গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে দিল শরীর। তরল আদর ছড়িয়ে পড়ল ওর দেহ-মনে। আরামদায়ক উষ্ণতার মাঝে শিরশিরে অনুভূতি ছড়াতে লাগল বুদ্বুদ।
জ্বালেনি আলোটা।
ভেজানো ঘুলঘুলি সিলিং-এর কাছে। বড়। আয়তাকার। বিকেলের ফিকে আলো আসছে ঘষা কাঁচ ভেদ করে। ভুতুড়ে করে তুলেছে বাথরুমের ভিতরটা।
প্রথম দিনের স্মৃতি ভেসে উঠল ওর মনের পরদায়।
যার-পর-নাই খুশি হয়ে উঠেছিল বাথরুমটা দেখে। বিশাল সাইজে। প্রমাণ সাইজের আয়না। এত কম ভাড়ায়
এমন একটা বাসা! এ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস দরকার যাদের, তারাই কেবল সিট পায় ভার্সিটির হলগুলোতে। বাকিরা বাসাবাড়ি ভাড়া করে থাকে। ইউনিভার্সিটি অবশ্য অনাবাসিক ছাত্রদের ভাড়া পরিশোধ করে দেয়। তবে যে টাকা দেয়, করুণ ধরনের বাসাই পাওয়া যায় তাতে।
লামিয়া আবার পরিবেশ ভালো না হলে মন দিতে পারে না পড়ায়। মাথা গোঁজার একটা ঠাই করে নিয়েছিল, কিন্তু পারছিল না মানিয়ে উঠতে। সেজন্য চোখ রাখছিল কাগজের হাউস রেন্টবিজ্ঞাপনগুলোতে।
এভাবে এক দিন খোঁজ পেল রিভেরা হাউসের। ভাড়ার অঙ্কটা শুনে অবাক হয়েছিল- এত কম!
ভয় ছিল শুরুতে। বদমেজাজি বুড়োকে নিয়ে না আবার অশান্তি হয় কোনও! কিছু দিন যেতেই বুঝেছে, ভয়টা অমূলক। ওর। বিরক্ত না করলে নিজের জগতেই থাকে রিভেরা।
এমন কী বারটেণ্ডার মেয়েটারও দেখা পাওয়া যায় না খুব একটা।
তামারা নাম মেয়েটার। তামারা ব্রাইস। আইরিশ।
আজব চরিত্র একটা।
রিভেরার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে যখন বাসা দেখছিল; অনেক দিনের বদ্ধ ঘরের ভাপসা, সোঁদা গন্ধের সঙ্গে ঝাঁঝাল একটা কটু গন্ধও পেয়েছিল লামিয়া। পরিচিত ঠেকছিল গন্ধটা। ধরতে পারছিল না, কীসের। বুঝতে পারল জানালার তাকে রাখা রসুনগুলো দেখে। সবগুলো জানালাতেই রসুনের কোয়া ছড়ানো। জানালার কাঁচে ঘোলা দাগ দেখে সন্দেহ করল, শার্সিতেও ঘষে দেয়া হয়েছে রসুন।
কীসের ভয়ে? ড্রাকুলা? পেল্লায় এই আধুনিক শহরে!
তাকিয়ে দেখে, ওর দিকেই তাকিয়ে আছে তামারা। ওর চোখেও পড়েছে ব্যাপারটা। বুড়োর অলক্ষে, চোখ পাকিয়ে বোঝাল, মাথাটা গেছে রিভেরার।
হাসতে গিয়েও হাসেনি লামিয়া। মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ওর কেন জানি।
সেদিনই রিভেরা হাউসে উঠেছিল ওরা।
সেদিনই কাঁচের গায়ে ক্লিনার স্প্রে করে টিসু পেপার দিয়ে ঘষে ঘষে দাগ তুলেছে তামারা।
লামিয়ার কাছে অদ্ভুত লেগেছে বিষয়টা। ওর ধারণা ছিল, গথিক চরিত্রের লোকজন বেশ ভক্তি করে অকাল্ট ব্যাপার স্যাপারগুলোয়।