লাল কালি দিয়ে মার্ক করা ঠিকানাটা পড়ল আরেক বার।
১৩৭০ মেরিন ড্রাইভ।
এটাই।
রিভেরা হাউস।
ভাড়া কেমন, কে জানে।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ওর। নভেম্বরের শীতল বাতাসই এর জন্য দায়ী।
পিছনে কারও উপস্থিতি আঁচ করে ঘুরল ও।
ডাইনি!
কালো জ্যাকেট। কালো জিনস। এক মাথা আগুনরাঙা চুল আর সকাল বেলাতেই চোখের উপর কড়া করে দেয়া বেগুনি আইশ্যাডো বাদে আর-সবই কালো। কালো লিপস্টিক। কালো নেইলপালিশ। গলায় কুকুরের বেল্টের মতো কাঁটাঅলা কালো বেল্ট। উয়োম্যান ইন ব্ল্যাক।
গথিক লুক আপাদমস্তক। পিয়ার্সিং করা ঠোঁটের নিচে। আধুনিক ডাইনি বলা যায়। এ-ও কি বাসা খুঁজছে? বাড়ির উপযুক্ত ক্যারেক্টার, ভাবল লামিয়া। খুঁজল কলিং বেলের সুইচ বা ঘণ্টি-জাতীয় কিছু নেই।
বার্নিশ করা কাঠের দরজার মাঝখানে বসানো ব্রাস নকারটায় শব্দ করল ও। দ্বিতীয় বার নক করতেই পায়ের আওয়াজ শোনা গেল বাড়ির ভিতরে। জোরাল হলো। থামল দরজার সামনে এসে। খুলে গেল পাল্লা।
লম্বা। চওড়া কাধ। পেজা তুলোর মতো এলোমেলো সাদা চুল। যেন চিরুনি পড়েনি বহু কাল। গোঁফ-দাড়ি পরিষ্কার করে কামানো। গায়ে লাল ফ্লানেলের শার্ট। গ্যাভার্ডিনের প্যান্টটা ঘিয়ে রঙের।
পরিষ্কার বিরক্তি চোখে। অসময়ে ঘুম ভাঙালে যেরকম বিষদৃষ্টিতে তাকায় লোকে, তেমনই চাউনি। অসংখ্য ভাঁজ ফেলে কুঁচকে আছে ভুরু জোড়া।
কী চাই? গলা তো নয় মনে হলো লামিয়ার সিমেন্টের দেয়ালে সিরিশ-কাগজ ঘষল কেউ। এই লোকই বাড়িঅলা? মেরেছে!
এক্সকিউজ মি। আপনি কি মিস্টার রিভেরা? নার্ভাসনেসের কারণে গলাটা কেঁপে গেল একটু। বুড়োটা ঘাবড়ে দিয়েছে, ওকে।
চুয়াত্তর বছর ধরে রিভেরাই আছি আমি, থাকব মরণের পরেও। লামিয়ার হাতে ধরা পেপারটার উপরে চোখ পড়ল বুড়োর। কী জন্য এসেছ? ঘর ভাড়া নেবে?
নিশ্চয়ই, তাড়াতাড়ি বলল মেয়েটা। যদি পছন্দ হয়।
হুহ! কথাটা বোধহয় পছন্দ হয়নি, তাকাল রিভেরা লামিয়ার কাঁধের উপর দিয়ে। দুজনে একসাথে?
কার কথা বলছে?
ওহ!
কয়েক মুহূর্তের জন্য মেয়েটার কথা ভুলেই গিয়েছিল লামিয়া। চোখাচোখি হলো ঘুরে দাঁড়াতেই।
ভাবছে। বুড়ো কি বন্ধু ভেবেছে ওদের? মনে হয়। তবে একসঙ্গে থাকার ব্যাপারটা ভেবে দেখার মতো। ও তো একলা মানুষ। ক্ষতি কী! সঙ্গীও পাওয়া গেল, টাকাও বাঁচল অনেকগুলো। এ সমস্যা কেবল মেয়েটার বেশভূষা নিয়ে। যাক গে, বাঘ ভালুক তো আর নয়!
কথা হয়ে গেল চোখে চোখে।
কোনও সমস্যা নেই নিশ্চয়ই!
জবাব এল না কথাটার। মনে হলো লামিয়ার, পাগল ছাগলকে ঘর ভাড়া দিই না, বলতে পারলে খুশি হতো বুড়ো।
কী করা হয়? ওকে নয়, জিজ্ঞেস করল ডাইনিটাকে। এমন ভাবে তাকিয়ে আছে, যেন ঘিনঘিনে গুঁয়োপোকা দেখছে একটা।
মেয়েটাও সচেতন এই তাচ্ছিল্য সম্পর্কে। নিমিষে ওর চেহারায়। ড্যাম কেয়ার ধরনের একটা বর্ম চলে এল।
নাইটক্লাবে কাজ করি, জবাব দিল। বার সামলাই।
সুন্দর! ব্যঙ্গের সুর। দেখো, বাপু, বাজার বসিয়ে দিয়ে যেন আবার। নাচা-গানা, চিল্লাফাল্লা বন্ধ একদম। শান্তিপ্রিয় মানুষ আমি। কোনও রকম অশান্তি না করলে ভালো লাগবে আমার। বোঝা গেছে?
প্রমাদ গুনল লামিয়া। যা ভাবভঙ্গি বুড়োর, মানিয়ে চলা যাবে তো! দেখল, চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে মেয়েটার। তেড়ে-মেরে কিছু একটা বলার আগেই প্রসঙ্গটা ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল ও। ঘরটা একবার দেখতে চাই, মিস্টার রিভেরা।
কিছু নেই দেখার, মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়ার মতো ঠাস করে বলে বসল বুড়ো। তবে দেখবে বইকি!
.
মধ্য এপ্রিল। অপরাহু।
লাইবেরি থেকে বাসায় ফিরছে লামিয়া।
অন্য দিনের চাইতে একটু তাড়াতাড়িই বেরিয়েছে আজ।
সকাল থেকেই ম্যাজম্যাজ করছে গা-টা। তার উপর সারাটা দিন রেফারেন্স বই দেখে দেখে অন্ধকার হয়ে গেছে। চোখ দুটো।
বলতে গেলে, সবে শুরু হলো কানাডার জীবন। অন্তত চার কি পাঁচ বছরের ধাক্কা। সব কিছু মনের মতো হলে কথা ছিল না। মুশকিল হয়েছে প্রফেসর রিচার্ডসনকে নিয়ে। দু চার পাতা লেখে, আর কয়েক দিন পর-পর গিয়ে অধ্যাপককে দেখায় লামিয়া। কিন্তু গ্রাহাম রিচার্ডসন মুখ-চোখ কুঁচকে একটা কথাই বলেন প্রতিবার: ইতিহাস না, পাতিহাঁস হয়েছে এটা।
জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় লামিয়ার, ইতিহাসের সঙ্গে পাতিহাঁসের সম্পর্কটা কোথায়। বলে না কিছুই। বললে বিশ্বাবদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দরখাস্ত করে ওর গাইড পদ থেকে ইস্তফা চাইবেন ভদ্রলোক, আর ও অন্য গাইড জোগাড় করে পিএইচ.ডি. করতে করতে হাড়বুড়ি হয়ে যাবে।
পেণ্ডার স্ট্রিট হয়ে বাসায় ফিরতে হয় ওকে। কানাডার সবচাইতে বড় চায়নাটাউনটা এখানে।
চিনে শহরটার প্রবেশপথ মিলেনিয়াম গেটের পাশ দিয়ে অনেক বার গেলেও ভিতরে ঢোকেনি ও কোনও দিন। অজানা একটা ভয় দায়ী এর জন্য।
সাপ-ব্যাঙ খাওয়া চৈনিকদের সম্পর্কে অদ্ভুত কিছু গল্প শুনেছে কিনা! অবশ্য সত্যি, না মিথ্যে, কে জানে।
কিছু চিনে সম্প্রদায়ের লোকজন নাকি জ্যান্ত বানরের খুলি ফাটিয়ে মগজ খেতে পছন্দ করে। আয়ু নাকি বাড়ে এতে!
তেরো লাখেরও বেশি চাইনিজ বাস করে কানাডায়। চীন, হং কং, ম্যাকাও থেকে এসেছে। এদেরও ভাগ রয়েছে। আবার। ক্যান্টনিজ। হাইনানিজ। হোক্কাইন। টিও চিউ। হাক্কা। আছে ভিন্ন-ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি। চিনা সহপাঠিদের কাছ থেকে জেনেছে এসব লামিয়া।