তা হলে?
অতৃপ্ত আত্মা হয়ে আটকা পড়ে গেছে পৃথিবীতে। অনন্ত, কালের জন্য!
হাসল মাউল। তোমার ভবিতব্য কিন্তু নির্ধারিত হয়ে গেছে, খোকা!
ঠক-ঠক ঠক!
ছোটখাটো লাফ মারল একটা অরণ্যর হৃৎপিণ্ডটা। টোকাটা যেন দরজায় নয়, পড়েছে ওর বুকের মধ্যে।
মাউলের দিকে তাকাল ও।
সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকাল মৃত্যুর দূত। খোলো দরজাটা।
চোখের ইশারায় বলতে চাইল অরণ্য: চোখের আড়ালে থাকুন আপনি।
ধীর কদমে হেঁটে দরজার কাছে গেল ও। একটা হাত রাখল পাল্লার উপরে। দরজার কাছাকাছি নিয়ে এল কান।
কে?
দরজাটা খোল, খোকা! ওপাশ থেকে বললেন মিসেস মালিক- অরণ্যর আম্মু।
খুলল ও। সাবধানে। তবে পুরোপুরি উন্মুক্ত করল না কবাটটা। দাঁড়িয়ে রইল পাল্লাটা ধরে।
কী, মা?
আপেল খাবি? ফল সহ ডান হাতটা ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন মিসেস মালিক। আপেল এনেছে তোর বাবা। খেয়ে দেখ… দারুণ মিষ্টি!
বড়সড় লাল আপেলটা হাতে নিয়ে খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল মিসেস মালিকের ছেলে।
ধুয়ে এনেছি…
উঁ?
যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লেন মহিলা। উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করছেন অরণ্যর ঘাড়ের উপর দিয়ে। অ্যাই, এত অন্ধকার কেন তোর ঘরটা? চোখ খারাপ হয়ে যাবে তো!
চট করে এক নজর ভিতরে চাইল ছেলে। আড়ালে দূরে থাক, ওর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে মাউল- আম্মুর একেবারে চোখের সামনে! ভীত চোখে তাকাল ও মিসেস মালিকের দিকে।
মাঝবয়সী মহিলার দৃষ্টিতে ভাবান্তর নেই।
কী ব্যাপার! আম্মা কি দেখতে পাচ্ছে না লোক -টাকে?
আলো জ্বাল তাড়াতাড়ি…
এই তো, মা… জ্বালছি!
তাড়াতাড়ি করে দরজাটা লাগিয়ে দিল অরণ্য। প্রশ্ন চোখে চাইল মৃত্যুর দিকে।
আম্মা কি…?
দেখেননি, বলল মাউল মাথা নেড়ে। খাতাটা তো আমার আসলে, আমার জিনিস ব্যবহার করছ তুমি, সেজন্য এক মাত্র তুমিই দেখতে পাচ্ছ আমাকে… তুমিই শুধু শুনতে পাচ্ছ আমার কথা…
আপেল খাবেন?
দাও! লোভীর মতো হাত বাড়াল মাউল।
আলগোছে ছুঁড়ে দিল ওটা অরণ্য।
খপ করে লুফে নিল মৃত্যুর প্রতিনিধি। ওঁর বিরাট হাতে ছোট্টটি দেখাচ্ছে আপেলখানা। বাদামের মতো ছুঁড়ে চালান করে দিল মুখের ভিতরে।
শব্দ হচ্ছে কচর-মচর।
আম… স্বাদু! এখানে আসাটা সার্থক হলো আমার।
স্কুল এই রসিকতায় হাসি পেল না অরণ্যর। বুকে হাত বেঁধে বলল ও, ক টা প্রশ্নের জবাব দেবেন?
নির্দ্বিধায়।
আমার প্রথম প্রশ্ন: আমাকেই কেন? হোয়াই মি?
প্রশ্নটা কিন্তু পরিষ্কার হলো না…
বলতে চাইছিঃ আমাকেই কেন বেছে নিলেন আপনি? আর কি কেউ ছিল না ডায়েরিটা দেয়ার মতো?
ভুল ভাবছ। আমি বেছে নিইনি তোমাকে। কী জন্য নেব? আছে কোনও কারণ? তুমি তো চালাক-চতুর নও তেমন… গোবেচারা গোছের। কাউকে দেয়ার ইচ্ছে থাকলে অসংখ্য বিকল্প ছিল আমার সামনে।
সত্যি কথাটা জানতে চেয়েছিল অরণ্য। কিন্তু শোনা মাত্র তেতো হয়ে গেল ওর মুখটা। কারই বা ভালো লাগে অপ্রিয় সত্য!
…না, যা ভাবছ তুমি, তা নয়, কথার রেশ টানছে।–মাউল। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আসলে…
দুর্ঘটনা!
হুম। খাতাটা স্রেফ পড়ে গেছে আমার হাত থেকে। আর তমি সেটা কুড়িয়ে নিয়েছ। এই হলো গে আসল ব্যাপার।
পড়ে গেছে! চড়ে গেছে অরণ্যর গলা। ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না, দুঃখিত! এ-জাতীয় ভুল করা তো মানায় না আপনাদের! মানুষ হলেও একটা কথা ছিল!
আবারও নিঃশব্দ হাসিতে উদ্ভাসিত হলো মাউলের চেহারাটা।
নাহ… যতটা ভাবছিলাম, ততটা বোকা নও তুমি! পারলাম না ফাঁকি দিতে…
তার মানে…
সত্যি কথাটা বলছি এবার… আমিই ফেলে দিয়েছি ওটা!
কেন?
জবাব দিতে এক মুহূর্ত দেরি করল আরেক ভুবনের প্রতিনিধি। আসলে… হাঁপিয়ে গেছি আমি!
অবাক হলো অরণ্য। হাঁপিয়ে গেছেন?
হ্যাঁ। ধারণাও করতে পারবে না তুমি, কী রকম একঘেয়ে আমাদের জীবনটা! তেমন কিছু নেই করার শুধু নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করা ছাড়া। সেজন্য খুব হাঁপ ধরে যায় মাঝে মাঝে। বিনোদন নেই… কিছু নেই। সেজন্যই বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলেছি খাতাটা। পরে খেয়াল হলো, ওটা ফিরে পাওয়ার জন্য হলেও পৃথিবীতে নেমে আসতে হবে আমাকে। হাসল মাউল। ভালো হলো না? একঘেয়েমি দূর করার সুযোগটা তো পাচ্ছি এখন।
কী বলবে, বুঝে পেল না অরণ্য।
হঠাৎ একটা কথা মনে হতে মুখ খুলল আবার।
আরেকটা কোশ্চেন ছিল…
বলো।
রাফা… মানে, আরাফাত… মানে…
চিনি। প্রশ্নটা কী?
খটকা লাগছে। ডায়েরির লেখা অনুযায়ী, হার্টফেল করে মরার কথা ওই ব্যাটার… কিন্তু…
তা-ই তো হয়েছে।
না, হয়নি। ট্রাকের তলে চাপা পড়েছে ও।
উঁহু… মরেছে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়েই। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিল ছোকরা… আতঙ্কে, উত্তেজনায়… বুঝতে পারছ? মারা গিয়েছিল মহাসড়কে ওঠার সাথে সাথেই। তার পরই ভারি যানটা চাপা দেয় ওকে।
ও, তা-ই! এই সম্ভাবনাটার কথা একদমই মাথায় আসেনি আমার।
কাস্তেটা হাতে নিয়ে শান পরীক্ষা করছে মাউল। বলল, প্রশ্নগুলোর জবাব তো পেলে। এবার আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও, দেখি। খেলছেটা কী তোমার মাথায়? প্রথমটায় তো বিশ্বাসই করোনি… এখন যে একের পর এক নরহত্যা করছ!
বিশ্বাস করিনি, কারণ, ডায়েরির কথাগুলো ইংরেজিতে লেখা। হিব্রু বা ল্যাটিন হলেও বুঝতাম যে
ইংরেজি নয়। এমন এক ভাষায় লেখা ওটা, পৃথিবীর কোনও মানুষেরই তরজমা করার সাধ্য নেই।