আর- সহসাই টের পেল ও- এত ঠাণ্ডা! আরিব্বাপ, রে!
কাঁপছে রীতিমতো অরণ্য। মেরু অঞ্চলে রয়েছে যেন। শীত ভীষণ! শুরু হয়েছে দাঁতে দাঁত বাড়ি খাওয়া।
ব্যাপারখানা কী!
মজা লাগছে, তা-ই না? মেঘগম্ভীর একটা কণ্ঠ গমগম করে উঠল ঘরের মধ্যে।
তড়াক করে বিছানায় উঠে বসল অরণ্য। অস্ফুট এক চিৎকার বেরিয়ে এসেছে গলা দিয়ে। উদ্ভ্রান্তের মতো চাইছে এদিক-ওদিক।
কোথাও কেউ নেই! অবশ্য এত অন্ধকারে ঠিক মতো ঠাহর করার উপায়ও নেই।
এদিকে!
ঠিক ওর বাম দিক থেকে এসেছে আওয়াজটা। অথচ প্রথম বার মনে হয়েছিল- ডান থেকে!
কই, কেউ তো নেই ওখানটায়! …না, আছে…– আবছা আঁধারে ফুটে উঠছে একটা অবয়ব! ধীরে ধীরে। এ কী অবাক কাণ্ড!! যেন অদৃশ্য ছিল, দৃশ্যমান হচ্ছে একটু একটু করে!
হলো না পুরোপুরি। শরীর ভেদ করে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে ওপাশটা।
আঁতকে উঠল অরণ্য। প্রায় ছাত-ছোঁয়া তাল গাছটাকে কি মানুষ বলবে ও? কী বীভৎস চেহারা! কামানো মাথা, নাকি চুলই গজায় না? সারা গায়ে তো রয়েছেই, এমন কী চকচকে নির্লোম টাকটাও বাদ পড়েনি আঁকাআঁকি থেকে। জানা নেই।
ওর- উল্কি নয় ওগুলো; নয়-ফুটী খাম্বাটার ত্বকই ওরকম। এ শেয়ালের কানের মতো চোখা ওটার লম্বাটে কানের আগা দুটো। হাড্ডিসার শরীরে নানা রকম গহনা।
ঠাকুরমার ঝুলি থেকে উঠে আসা রাক্ষস যেন!
ক-কে আপনি!? কেউ যেন বালি ঘষে দিয়েছে অরণ্যর গলার ভিতরটায়।
মেঘ ডাকল আবার। আমি মা-উ-ল।
মাউল!
মাউল। মৃত্যুর প্রতিনিধি।
যতটা আতঙ্কিত হওয়ার কথা, ততটা যেন হলো না অরণ্য। এমন কিছু যে ঘটতে পারে, তা যেন জানত ওর অবচেতন মনটা। আরও নিশ্চিত হতে চাইল ও আগন্তুকের পরিচয় সম্বন্ধে।
মানে… যমদূত?
বলতে পারো। মৃত্যুর দেবতার অসংখ্য প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন আমি।
মনে সাহস সঞ্চয় করল অরণ্য। আন্দাজ করতে পারছে, তার পরও জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছেন আমার কাছে?
ভয়াল হাসি হাসল মাউল। গত পাঁচ দিনে অন্তত পাঁচ শ নাম লিখেছ যে-খাতাটায়, আমার জিনিস ওটা।
অনেক কষ্টে ঢোক গিলল একটা অরণ্য। আ… আপনি জানেন?
এবারে শব্দ করে হাসতে লাগল মৃত্যুর প্রতিনিধি।
নির্বোধের মতো প্রশ্ন, বলল হাসি থামলে।
বুকটা দুরুদুরু করছে অরণ্যর। সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনাটাই এল প্রথমে মাথায়।
আ-আপনি কি আমার… জ-জান কবজ করবেন?
হ্যাঁ, জলদগম্ভীর উত্তর।
না! খোদ মৃত্যুর মুখ থেকে সত্যিটা শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল অরণ্যর।
খুকখুক করে আবারও হাসতে লাগল যমদূত। হাসির ফাঁকেই অভয় দিল, ভয় পেয়ো না, বাছা! ঠাট্টা করছিলাম আমি। কোনও ক্ষতিই করব না আমি তোমার। …করতে পারব না আসলে।
খুব সাবধানে স্বস্তির শ্বাস গোপন করল অরণ্য।
নিতে এসেছেন ডায়েরিটা?
হাসি-হাসি মুখটা কি একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল?
উপায় নেই!
জি?
যে মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রবেশ করেছে খাতাটা, তখন থেকেই পৃথিবীর অংশ হয়ে গেছে ওটা। আর খাতাটা স্পর্শ করে তুমিও হয়ে গেছ ওটার অংশ। বুঝতে পারছ, কী বলছি? আমি নই, অরণ্য, তুমিই এখন ওটার মালিক!
সত্যি! অদম্য আবেগ টের পেল ও বুকের মধ্যে।
খুশি লাগছে বুঝি?
না… মানে…
অদ্ভুত!
জি?
তোমরা… মানে, বড়ই অদ্ভুত এই মানব জাতিটা! কোথায় আমার পরিচয় পেয়ে ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়ে ফিরিয়ে দেবে খাতাটা, তা না! অন্য কিছু ভাবছ!
আপনি চাইলে…
উঁহু! আমি চাইলে তো হবে না, বাছা! তুমি চাও কি না, সেটাই হলো প্রথম কথা। ফেরত দিতে চাও খাতাটা?
ইতস্তত করছে অরণ্য। না দিলে কি…
না। জোর খাটাতে পারব না আমি তোমার উপরে। নিজ থেকে নিয়ে নেয়ার তো প্রশ্নই আসে না। ওটা এমন কী ছুঁতেও পারছি না, যতক্ষণ না তুমি নিজ থেকে দিচ্ছ। আমাকে।
চুপচাপ কী যেন ভাবল অরণ্য। যদি না দিই কখনও?
কৌতুকের ছাপ ফুটে উঠল মাউলের চোখেমুখে। সেটাই মতলব বুঝি?
বিব্রত ভঙ্গিতে হাসল অরণ্য।
কিন্তু পরক্ষণেই সিরিয়াস হয়ে উঠল মৃত্যুদূতের চেহারা। ভাঁজ পড়েছে কপালে। থুতনি ডলতে ডলতে স্বগতোক্তি করল, তা তুমি পারো, বৎস… তা তুমি পারো!
বলছেন, ডায়েরিটা ইচ্ছামতো ব্যবহার করতে পারব আমি, আর এর জন্য কোনও রকম শাস্তি-টাস্তি পেতে হবে না আমাকে?
মাথা নাড়ল দূত। না। যত দিন আমাকে বা আর কাউকে না দিচ্ছ খাতাটা… আরও স্পষ্ট করে বললে, স্পর্শ করতে না দাও যদি, তত দিন তোমারই থাকবে ওটা। তবে তুমি যদি মালিকানা ত্যাগ করো খাতাটার, আমাকে তখন ওটার স্মৃতি মুছে ফেলতে হবে তোমার মগজ থেকে।
জি… বুঝতে পেরেছি।
আরও কয়েকটা ব্যাপারে জানা থাকা দরকার তোমার… খাতাটা রাখতে চাইছ যখন…
বলুন…
বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হবে… ভয়… যন্ত্রণা… আগে যারা-যারা মালিক ছিল খাতাটার, তাদের চিন্তার সাথে পরিচিত হবে তুমি…
আমি ছাড়াও আরও কেউ পেয়েছিল এটা?
কয়েক জন। দূর-অতীতের কথা সেসব।
আচ্ছা… তারপর?
যত দিন তোমার কাছে থাকবে খাতাটা, অপঘাতে মৃত্যু হবে না তোমার। স্বাভাবিক মৃত্যুই ঘটবে। তুমি মারা গেলে, আপনা-আপনিই চলে আসবে ওটা আমার কাছে।
স্বাভাবিক মৃত্যু হবে শুনে প্রশান্তির একটা ছায়া ফুটে উঠছিল অরণ্যর মুখের চেহারায়- সেটা লক্ষ করে বাগড়া দিল মাউল। অত খুশি হোয়ো না, বৎস। মৃত্যুর খাতা একই সাথে আশীর্বাদ এবং অভিশাপ।
কী রকম?
এর আগে যারাই ব্যবহার করেছে ওটা, কেউই কিন্তু স্বর্গ কিংবা নরকে প্রবেশ করেনি…