জায়গামতো বেমক্কা এক লাথি ঝেড়ে দিয়েছে তরুণী। পাক্কা তিন মিনিট লাগল ঘোলা চোখে দৃষ্টি ফিরে পেতে। মাতালের মতো টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল আরাফাত। অণ্ডকোষ চেপে ধরে গর্জাচ্ছে আহত জন্তুর মতো। সামনে এগোনোর ফাঁকে উচ্চারণ করল চিবিয়ে চিবিয়ে: খাড়া, ছেমরি! ফাটামু তরে আইজকা! …আমারে চিনস না! …আরাফাত! আরাফাত এই বান্দার নাম! আইজ পাশা খেলমু, রে, শাম!
আত্মরক্ষার তাগিদে আবারও লাথি মারতে গেল মেয়েটা।
এবারে সতর্ক ছিল আরাফাত। একটুও মায়া না করে ঘুষি বসিয়ে দিল শিকারের নাকে। এক ঘুষিতেই নিথর হয়ে গেল। মেয়েটা। শিথিল হয়ে পড়ল ওর হাত, পা, সারা দেহ।
মেয়েটাকে ছেড়ে দিল টিপু। আতঙ্কিত গলায় ওগরাল, ড্যামিট! শালীরে মার্ডার কইরা ফেলছস তুই! নাকের ভাঙা হাড় ঢুইকা গেছে মগজে! বলেই আর থাকল না সেখানে। বাস্তব বুদ্ধি টনটনে ওর। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দৌড় দিল গলির আরও ভিতরে। ভয়ার্ত মোল্লাকে গিলে নিল অন্ধকার। ওর ছুটন্ত পদশব্দ ক্রমশ কমতে কমতে হারিয়ে গেল একেবারে।
এতক্ষণে বিপদ টের পেল আরাফাত। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা পর্যন্তই দৌড় ওর। স্বয়ং শয়তান খানিক আগে ভর করেছিল ঘাড়ে… রেপিস্ট পরিচয়ে দাগী হয়ে যেত আরেকটু হলেই। কিন্তু খুন… না, বাবা! অত হিম্মত নেই ওর। রাগের মাথায়…
পড়িমরি করে দৌড় দিল আরাফাত। তবে উলটো দিকে। একদমই কাজ করছে না মাথা। দামি মোটরসাইকেলটা ফেলেই পালাচ্ছে…
গলি থেকে বেরোতেই ধাক্কা খেল একজনের সঙ্গে।
ধাক্কার চোটে পুরো এক শ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল অরণ্য। পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল নিজেকে। কোন হারামজাদা… আরে, আরাফাত না? মহল্লার মাস্তান আরাফাত ওরফে রাফাঁকে চিনতে ভুল হলো না ওর। এই ভাবে ছুটছে। কেন গুণ্ডাটা? ভূতের তাড়া খেয়েছে নাকি?
ভটভট আওয়াজ ভেসে এল অন্ধকার গলিটা থেকে। কিন্তু কাছিয়ে আসার বদলে পিছিয়ে যাচ্ছে আওয়াজটা।
এক ছুটে গলিতে ঢুকল অরণ্য। কয়েক সেকেণ্ডেই বেরিয়ে এল আবার। যা দেখার, দেখে নিয়েছে। বুঝে নিয়েছে, যা বোঝার।
কী করছে, বুঝতে পারছে না ও। নিজের মধ্যে নেই যেন। ভিন্ন এক সত্তা চালিত করছে যেন ওকে। ফিরছিল প্রাইভেট পড়ে। ঝটপট ব্যাগ থেকে বের করে আনল ডায়েরিটা।
সোডিয়াম-আলোয় লেখা হয়ে গেল আরাফাত করিমের মৃত্যু-পরোয়ানা।
দস্তুরমতো হাঁপাচ্ছে অরণ্য। হাঁটু গেড়ে বসে রাস্তার উপরে। হৃৎপিণ্ডের মাঝে টিক-টিক করছে অদৃশ্য কোনও ঘড়ির কাঁটা।
চল্লিশ সেকেণ্ড! চল্লিশ সেকেণ্ড!
আচমকা তীব্র এক আওয়াজে চিন্তার জাল ছিন্ন হলো ওর। শুনল উৎকর্ণ হয়ে। ভারি কোনও গাড়ির চাকা স্কিড করার শব্দ। উঠে দৌড় লাগাল ও আওয়াজটা লক্ষ্য করে।
বেশি দূর যেতে হলো না। পাঁচ টনী ট্রাকটা তখন। ভাগবার পায়তারা করছে। ও ওখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে পগারপার।
হঠাৎ করেই ব্রেক কষল অরণ্য। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে দু হাত রাখল হাঁটুতে। খুব জোরে ছুটে আসায় খিল ধরে গেছে পেটে। শ্বাস ফেলছে ফেস-ফোঁস করে। বাজে একটা গন্ধ ভক করে ধাক্কা মারল ওর নাকে।
হাইওয়ের সঙ্গে মিশে গেছে আরাফাত করিম! রক্ত, মাংস, হাড় আর মগজের একটা দলা।
ঘুরেই হড়হড় করে বমি করে দিল অরণ্য।
দশ
ধীরে ধীরে বসা অবস্থা থেকে সিধে হলো মূর্তিটা। তবে ঘাড়টা এখনও ঝুঁকে রয়েছে সামনে। স্থির দৃষ্টি বহু নিচের গহ্বরে।
অস্বাভাবিক লম্বা সে। প্রায় নয় ফুট। তেমন মাংস না থাকায় হাঁটু, কোমর ও পাঁজরের হাড়গুলোকে এক-একটা ধাপ বলে মনে হয় মইয়ের। রোমের নিশানা নেই সারা শরীরের কোথাও।
নাকটা যেন ঈগলের চঞ্চ। ঠোঁটের দুই প্রান্ত এতটাই দূরে যে, তার দিয়ে বেঁধে টেনে ধরা হয়েছে যেন। দীর্ঘ, বাঁকা নখ হাত-পায়ের আঙুলে।
আর দেরি করা যায় না। ঘাড়টা তুলে একবার লাল আকাশটার দিকে চাইল দীর্ঘদেহী। নিচু হলো সামান্য। তারপর সাঁতারুর ডাইভ দেয়ার ভঙ্গিতে লাফ দিল কৃষ্ণগহ্বরে। এ পড়ছে… পড়ছে… আচম্বিতে পিঠ ফুড়ে বিশাল, কালো দুই ডানা বেরোল শরীরের ভিতর থেকে। গুমট বাতাস কেটে সাঁই-সাই ছুটে চলল ওটা নিচের দিকে।
আকাশ আলোকিত করে ঝিলিক দিল বিজলি। প্রকাণ্ড
কোনও দানবের লাল শিরা-উপশিরা সৃষ্টি করেই মিলিয়ে গেল আবার।
এগারো
ধীরে, খুব ধীরে চোখ মেলে তাকাল ও।– কীসের জানি ছুটি আজকে। অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। তবে এ নিয়ে একটুও গ্লানিবোধ নেই মনে। বরঞ্চ অনুভব করছে আশ্চর্য এক তৃপ্তি। এই তৃপ্তির উৎস কী, জানে ও।
ঝকর-ঝকর শব্দ তুলে চলে গেল শেষ দুপুরের ট্রেনটা। খান-খান হয়ে ভেঙে পড়ল পড়ন্ত বেলার নিঝুমতা। সঙ্গে বাতাস চিরে দেয়া বিষণ্ণ হুইসেল। শুনলে কেমন যেন ধক করে ওঠে বুকটা।
দুটো ট্রেন যায় এদিক দিয়ে। দুপুরে আর শেষ রাতে। থামে না কখনওই। আসে দক্ষিণ থেকে। নিশুতি অন্ধকারে সাঁই-সাই ছুটে চলা ট্রেনের গুমগুম আওয়াজটাকে ভারি অদ্ভুত মনে হয় অরণ্যর। কল্পনায় দেখতে পায়, মরচের গন্ধ ভরা চলন্ত কামরাগুলোতে ফ্যাকাসে আলো।
চলে যাওয়া ট্রেনটার ধাতব ঝঙ্কারের রেশ শুনতে শুনতে মনে হলো অরণ্যর: রাত্তির কি এখন? …ঠিক বুঝতে পারছে। না। কেমন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছে মাথার ভিতরটা।
না, তা তো হওয়ার কথা নয়!
এত অন্ধকার কেন তা হলে! ঠিক যেন কালবোশেখী ঝড় আঘাত হানার আগের অবস্থা।