ফাউন্টেন-পেনের লেখা সময়ের আবর্তনে কালো থেকে যেরকম বাদামি হয়ে আসে, কালির রঙটা ঠিক সেরকমই। তুলট কাগজের মতো হলদেটে ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলো।
ইন্টারনেটে দেখা ভিঞ্চির কোডেক্স লেসটারের ছবি ভেসে উঠল অরণ্যর মনের মধ্যে।
কোনও রকম শিরোনাম ছাড়াই শুরু হয়েছে লেখা:
যার নাম একবার লেখা হবে এ-খাতায়, মরণ তার অবধারিত।
হাহ, হাস্যকর ব্যাপার! কোন্ পাগলে বিশ্বাস করে এসব? হয় নাকি এরকম? বিকেলের ভাবনাটাই মাথায় ফের হানা দিল ওর। এ তো দেখছি ফেসবুকের চেইন-পোস্টের মতো: এই পোস্ট যে শেয়ার করবে, সাত দিনের মধ্যে সুসংবাদ পাবে।…এত সোজা?
কেবল নাম লিখলেই কাজ হবে না অবশ্য; যার নাম লেখা হচ্ছে, কল্পনা করতে হবে তার চেহারাটাও। কারণ, একাধিক মানুষ থাকতে পারে একই নামে। থাকেও। ঠিক কোন জনের মৃত্যু চাইছে, সেটা নির্দিষ্ট করার জন্য হতভাগ্যের মুখটা ফুটিয়ে তুলতে হবে লেখকের মনের পরদায়।
ধুস… প্র্যাকটিক্যাল জোক!
কী উপায়ে মারতে চায়, চাইলে সেটাও লিখে দিতে পারে লেখক।
দিলে?
কারও নাম খাতায় তোলার চল্লিশ সেকেণ্ডের মধ্যে মৃত্যুর কারণটা লেখা হলে সেভাবেই মারা যাবে ব্যক্তিটি। যদি নাম ছাড়া অন্য কিছুই লেখা না হয়, মৃত্যু ঘটবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে।
গাঁজা! ভূমিকাটা এখানেই শেষ। পৃষ্ঠা ওলটাল অরণ্য।
এরপর নাম রয়েছে। একটার পর একটা… একটার পর একটা…
আমুর ফাতি। কোন দিশি নাম এটা? ছেলে, না মেয়ে? মিস্টি মাইলস। জেভিয়ার জু। লিং লেসলি। বজ্রপাত। জামাল জ্যারেট। ডোমেনিক ডিলরেনজো। ফুড-পয়জনিং।
ফাল্গুনী মাহতানি। সিঁড়িতে পা পিছলে মৃত্যু। তারেক বিন রফিক (রাজু)। অ্যালার্জিজনিত শ্বাসকষ্টে ভুগে।
সিধু সিং।
অপূর্ব ভট্টাচার্য।
অ্যানা নিকোল স্মিথ। মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে। এহ!
এরপর আরও নাম… আরও নাম… ফালতু! সময় নষ্ট বেহুদা! কিন্তু পনেরো সেকেণ্ডের মাথায় এই অরণ্যকেই দেখা গেল আঙুলের ডগায় বলপয়েন্ট নাচাতে। শেষমেশ লিখল ও… শেষ নামটার শেষে:
নাজিমুদ্দীন হিকমত
কল্পনায় ভাসছে টেলিভিশন-ফুটেজে দেখা চেহারাটা…
সাত
নিজের ঘরের ভেজানো দরজাটা খুলে বাইরে এল অরণ্য। মিষ্টি একটা ঘুম-ঘুম আলস্য ওর দু চোখে। হাই তুলল। চিলতে এক বারান্দা রয়েছে ওদের। পায়ে পায়ে চলে এল সেখানে।
ধূসর গম্ভীর এক ছায়া ঢেকে রেখেছে বাড়িটাকে। ভোরের আবেশের মতো। কিন্তু ভোর নয় এখন। সকাল পেরিয়েছে আটটা। আকাশে কি মেঘ করেছে তবে? না, তা-ও নয়। আসলে, এঁদো এই গলিতে সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না সহজে। সেজন্যই বারান্দার কোনায় রাখা টবের আগ্রাসী শিম গাছের পাতায় হলদে ছোঁয়া। মলিন ইট-কংক্রিটের খাঁচাগুলোর ফাঁক-ফোকর চুঁইয়ে আসা ফুরফুরে বাতাসে ঝিরঝির করছে পাতাগুলো। কার্নিশ থেকে একটা দোয়েল ডেকে উঠল গলায় সবটুকু দরদ ঢেলে।
সদ্য রচিত এক লাইন কবিতা আওড়াল অরণ্য মনে মনে:
ধুলোর শহরে কে পাঠাল সাগরপারের হাওয়া?
মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছে ড্রইং রুম থেকে। কথার। আওয়াজ। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল অরণ্য। পরক্ষণেই খেয়াল হলো, ওর- ও, আজ তো শুক্কুরবার। শুক্রবার সকালে টিভিতে স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রোগ্রাম দেখেন ওর আব্বু।
বারান্দা ছেড়ে ধীর পায়ে বৈঠকখানার দিকে এগোল। অরণ্য।
হার্টের উপরে দর্শকদের ফোনকলের জবাব দিচ্ছেন কার্ডিয়োলজিস্ট- নিশ্চয়ই প্রখ্যাত কেউ হবেন, অনুমান করল। ও
কেমন জানি ব্যাপারটা। এক দিকে হার্ট ভালো রাখার কথা বলা হচ্ছে অনুষ্ঠানে, অন্য দিকে টিভি-স্ক্রিনের নিচের দিকে অটো-স্ক্রল হচ্ছে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ার মতো খবর। …ক্যালিফোরনিয়ায় বাংলাদেশি দম্পতি খুন… কাভার্ড ভ্যান চাপায় দুই পরীক্ষার্থী নিহত… সন্ত্রাসী হামলায় আহত ব্যবসায়ী নৃপেন্দ্রলাল দাশের মৃত্যু… শীতলক্ষ্যায় নৌকাডুবি… আফগানিস্তানে ভূমিকম্প… গাঁজায় মিসাইল হামলা…
এই সব চ্যানেলের কর্তাব্যক্তিদের কমন সেন্স নিয়ে সন্দেহ জাগাটা স্বাভাবিক।
এদিকে আবার নীল টেলপের উপরে স্থির হয়ে আছে লাল একটা ব্যানার। সেখানে লেখা: পুলিস…
হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল অরণ্যর। টলে উঠল খানিকটা। মাথাটা কেমন চক্কর দিচ্ছে। স্পষ্ট শুনতে পেল নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি…
এ হতে পারে না! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে ভরসা। হয় না ওর! অসম্ভব!
আট
পুলিস হেফাজতে নাজিমুদ্দীনের মৃত্যু!
টক অভ দ্য কান্ট্রি এখন এটা, ফেসবুকের নতুন ইস্যু।
এক দল ভাবছে: যাক, ভালোই হলো; সমাজ থেকে নরকের কীট কমল একটা। বিচার-আচার মানেই তো দীর্ঘসূত্রতা, লাল ফিতের দৌরাত্ম। মাসের পর মাস- হয়তো বছরভর ঝুলে থাকবে বিচারকার্য। তার চেয়ে এ-ই ভালো, স্বস্তির শ্বাস ফেলে ভাবছে ওরা, একেবারেই চুকেবুকে গেল সব কিছু। নাজিম হিকমতের মতো ঘৃণ্য অপরাধীদের এই দুনিয়ার আলো-হাওয়ার স্বাদ নেয়ার অধিকার নেই কোনও। ( কিন্তু আরেক দিকে মানবতাবোধ উথলে উঠছে কারও কারও। তাদের বক্তব্য: হোক খুনি, বিচার পাওয়ার অধিকার সকলেরই রয়েছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কাউকে যদি নিকেশ করে ফেলা হয়, কোর্ট-কাছারি-আইনের প্রয়োজন কী হবে? রক্ষকই যদি ভক্ষক হয়… ইত্যাদি-ইত্যাদি।