গাড়িতে কে? আয়মানের প্রশ্ন করার কারণটা সঙ্গত। তীব্র আলো ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে চোখে। বোঝার উপায় নেই, কে বসা গাড়ির ভিতরে।
খোদার কসম, আমি না, এরকম সময়েও কৌতুক করতে ছাড়ল না আয়ান, যদিও কপালে ওর চিন্তার ভাঁজ। ঝাঁকি খেয়ে সচল হলো গাড়ি। সোজা ছুটে আসছে ওদের দিকে। বাড়ছে গতি। প্রতি মুহূর্তেই।
ক্ষণিকের জন্য স্ট্যাচ হয়ে গেল দুই তরুণ। রিগর মরটিসের মতো অবস্থা। কিন্তু বাঁচার তাগিদেই সচল হলো আবার হাত-পা। দৌড় দিল উলটো ঘুরে। নাহ। সম্ভব না। গাড়ির গতি ওদের চাইতে বেশি। প্রায় ধরে ফেলল বলে! তারপর? পিষে মারারই মতলব মনে হচ্ছে।
ধাক্কা লাগে লাগে, এরকম অবস্থায় লাফ দে! বলে চিৎকার দিয়ে নিজেকেও রেলিং-এর ওপারে ছুঁড়ে দিল আয়ান।
থেমে, স্কিড করে স্থির হলো ব্যর্থ ইমপালা।
সাত
ভাই লাফ দেয়ার মুহূর্ত পরেই ডাইভ দিয়েছিল আয়মান। ব্রিজের কিনারা ধরে ঝুলছে ও।
মিনিট খানেকের কসরতে নিজেকে টেনে তুলল উপরে। প্রথমেই তাকাল গাড়িটার দিকে।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পিছন থেকে, কেউ নেই ভিতরে! তা হলে…
পরেও ভাবা যাবে ওসব। আগের কাজ আগে।
আয়ান! কালো জলের মধ্যে আয়মানের ব্যাকুল চোখ : খুঁজছে ভাইকে। শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে।
আয়ান!
জিন্দা! বাতাসে ভর করে ভেসে এল অস্পষ্ট উত্তরটা।
এবারে খুঁজে পেল আয়মান।
অল্প দূরেই চড়া। সদ্য পানি ছেড়ে তীরে উঠেছে ওর ভাই। কাদা মেখে ভূত। হাঁপাচ্ছে চার হাত-পায়ে মাটিতে ভর দিয়ে। স্বস্তির হাসি হাসল আয়মান।
ভ্রাতোহ! সব কটা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে ওর। স্বাদ কেমন ময়লা পানির?
আট
কুঁতকুঁতে চোখে তাকিয়ে আছে লোকটা। দৃষ্টিতে রাজ্যের সন্দেহ। তার পরও উঠে দাঁড়াতে হলো তাকে প্রফেশনালিজমের খাতিরে। আগন্তুকদ্বয় কাছে আসতে জিজ্ঞেস করতে হলো, গুড ইভনিং, স্যরস। কোনও সাহায্যে আসতে পারি আপনাদের?
একটা রুম, প্লিজ।
চাহিদা শুনে ভাবান্তর হলো না কোনও মাঝবয়সী ক্লার্কের চেহারায়। খুলল না চেক-ইন ডেস্কে রাখা লেজারটা। বক্তার পাশের লোকটার দিকে মনোযোগ। কুঁচকে রেখেছে নাকটা। তেমনি সন্দেহপ্রবণ চাউনি। পা দেখা যাচ্ছে না ডেস্কের ওপাশে দাঁড়ানো যুবকের; সেজন্য নিরীখ করছে আপেটমস্তক।
গুয়ের গন্ধ ছুটছে গা থেকে। অপ্রীতিকর দৃষ্টির সামনে মরমে মরে যাওয়ার অবস্থা হলো কর্মচর্চিত আয়ানের। কিন্তু এমন ভাব ঝুলিয়ে রাখল চেহারায়, কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া লেটেস্ট ট্রেণ্ড যেন। দুষ্টি উপর-নিচ করে সে-ও দেখছে ম্যানেজারকে।
মোটুরাম। পুরো মাথা জুড়ে গোল টাক, কেবল কান আর ঘাড়ের উপরে অল্প কিছু পাতলা ফুরফুরে চুল বাদে। নিখুঁত ইস্তিরি করা সাদা শার্ট আর টাই-এ ধুরন্ধর মাল্টিলেভেল মার্কেটিং এজেন্টের মতো লাগছে লোকটাকে।
সরি, রুম নেই। কথাটা বলে পৈশাচিক আনন্দ পেল ক্লার্ক। তবে সেটা ভিতরে ভিতরে। বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে। পেশাদারিত্ব- মেকি, মাপা দুঃখবোধ।
নিরাশ হলো না ওরা। এমনটাই আশা করেছিল।
কটেজগুলোতে? বাতলে দিল আয়ান।
তাচ্ছিল্যের চাউনি উপহার দিল ওকে মোটা ম্যানেজার। না, দুঃখিত। খালি নেই ওগুলোও।
কথা না বাড়িয়ে অ্যাবাউট-টার্ন করল ওরা।
মিছে বলছে ব্যাটা! মোটেল-লবি থেকে বেরিয়ে সখেদ মন্তব্য আয়ানের।
কী করে বুঝলি?
ব্যাটার চেহারা দেখে।
বাহ। ফেস-রিডিংও পারিস, দেখছি।
ঠাট্টা করছিলাম।
আমিও।
তবে ব্যাটা কিন্তু মিছে কথাই বলছে।
জানি তো।
কীভাবে?
ফেস-রিডিং শব্দটা মুখে এসে গিয়েছিল প্রায়, সামলে নিয়ে বলল আয়মান, বোঝা তো যায়!
প্রমাণ দেখাচ্ছি। ওই দেখ।
কী?
পাতার ছাউনি দেয়া মোটেল-অফিসটার বাঁয়ে লম্বা এক নিচু একতলা বাড়ি। প্রতিটা ঘরের সামনে একটা করে পাম গাছ লাগানো। ডানে রয়েছে এক সারি কটেজ। মোট এগারোটা, সব একই রকম দেখতে। অফিস-বাড়িটার মতো ওগুলোরও পাতার ছাউনি।
কী দেখাতে চাইছে, বুঝতে পারল না আয়মান। কটেজ সারির দিকে চোখ আয়ানের। কী দেখছে ও?
কী? আবারও বলল আয়মান।
ওই ঘরগুলো… একই রকম, না? একটা কিন্তু আলাদা। বল তো, কোনটা?
কোনটা? কুইজ খেলার ঝামেলায় গেল না আয়মান।
ডান দিক থেকে আট নম্বরটা। বলতে পারবি, কেন?
গুনে গুনে আট নম্বর কটেজটা দেখল আয়মান। ধরতে পারল না। বাকিগুলোতেও চোখ বোলাল একবার করে। তা-ও বুঝতে পারল না কিছু।
আই কুইট, হাল ছেড়ে দিল।
গাধা! তিরস্কার করল আয়ান। একটা অন্ধকার।
বুঝল এবারে। আট নাম্বারটা বাদে অন্যগুলোতে আলো কিংবা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে। নিশ্চিত ভাবেই তোক রয়েছে ওগুলোতে, যদি না কোনও কারণে জ্বালানো থাকে বাতি।
তুই গাধা! পালটা বলল আয়মান। ঘুমিয়েও তো পড়তে পারে লোকটা।
ঘুমিয়েছে কি না, সেটাই দেখি, আয়। বলে আর দাঁড়াল আয়ান। পা চালাল কটেজুটার উদ্দেশে।
অগত্যা পিছু নিতে হলো আয়মানকে।
ঘুরছে না নব। ঘুরবে যে, আশাও করেনি আয়ান। হিপ পকেট থেকে বের করল ওঅলেটটা। মানিব্যাগের কোনা থেকে বেরোল একটা জেমস ক্লিপ।
করছিস কী! চাপা গলায় বলল আয়মান। মাথা খারাপ হয়েছে তোর? চুরি করে ঢুকছিস! জেগে গেলে লোকটা?
ঘাবড়াও মাত। নেই কেউ।
শিয়োর হচ্ছিস কী করে?
ইন্সটিঙ্কট।
টেনে লম্বা করল আয়ান ক্লিপটা। বিশেষ একটা ডিজাইনে বাঁকাল সেটা আবার। তারপর চাবির ফুটোয় ঢুকিয়ে ব্যস্ত হলো কেরামতি দেখাতে।