এ পাড়ার জহিরুল ইসলাম মিঠু নামে এক ভদ্রলোকের পোষা ওগুলো। নির্জন বলে প্রায়ই আসে কলেজের এপাশটায়; বুনো ফল, দানা-টানা খায়, পোকা-মাকড়ও রয়েছে বিস্তর। কিন্তু এভাবে তো কোনও দিন উড়াল দেয় না জানালা ঘেঁষে!
ভয় পেয়েছে?
কেন? কীসের?
জুনায়েদের দিকে ঘাড় ফেরাল অরণ্য। হারামিটা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে মোবাইলের দিকে। কী দেখছে, দেখার রুচি হলো না ওর।
না, কিছুই টের পায়নি ও- দেখা দূরে থাক। পাশ দিয়ে ডাইনোসর গেলেও একবার চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিত। ওর এক মাত্র আগ্রহ নিষিদ্ধ জিনিসে।
অরণ্যর খেয়াল হলো এখন, ভোঁতা একটা আওয়াজ শুনেছিল না পাখিগুলো উড়ে যাওয়ার আগে! থ্যাপ করে একটা শব্দ?
দেখতে হয়… কিন্তু জায়গা ছেড়ে ওঠার উপায় নেই এখন।
কবজি উলটে ঘড়ি দেখল ও। আরও অন্তত কুড়ি মিনিট। পর্যাবৃত্তিক গতি পড়াচ্ছেন নঈম স্যর। দু -এক লাইন শুনেই আগ্রহ হারাল অরণ্য। উসখুস ভাব নিয়ে চাইল। জানালার দিকে। সিনেমার ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিকের মতো মনের মধ্যে বেজে উঠল হেমন্তের গান: পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব, মা গো, বলো, কবে শীতল হব… কত দূর… আর কত দূর…।
কিন্তু ম্যারাথন রানারের দৌড়ও শেষ হয় এক সময়। ফিজিকস স্যর দরজার দিকে এগোতেই জানালায় গিয়ে হামলে পড়ল অরণ্য।
পাঁচ
জীর্ণ দালান। হলদে ডিসটেম্পার চটে গেছে কবেই। পশ্চিমের এপাশটায় সচরাচর পা পড়ে না কারও। বড় বড় ঘাস হয়ে গেছে। রোদ আছে, ছায়া আছে। আকাশ ছোঁয়ার নিষ্ফল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মাথা তুলেছে গগন শিরীষ গাছ। বাতাসে মদির গন্ধ।
দোতলা থেকে মনে হচ্ছিল- ডায়েরি। তা-ই মনে হচ্ছে এখনও। খয়েরি রঙের মলাট- চামড়ার? আসল চামড়া, নাকি রেক্সিন- হাতে নিলে বোঝা যাবে।
ঘাসের উপর পড়ে থাকা ডায়েরিটার দিকে এগোতে। এগোতে ঘাড় উঁচু করে তাকাল অরণ্য। ঘষা কাঁচের মতো আকাশ দেখছে।
কোত্থেকে এল জিনিসটা? যেরকম থ্যাপ করে আওয়াজ হলো, মানেটা দাঁড়ায় পড়েছে বেশ উপর থেকেই। কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই এই বিল্ডিং থেকে নয়। ওদের কলেজটা দোতলা। আর দালানের পিছন দিকের শেষ কামরাটাই ওদের। ডায়েরিটা পড়েছে জানালার বাম, ধার দিয়ে।
ছাত থেকে? হালে পানি পাঁয় না। কিন্তু কাছাকাছি আর কোনও উঁচু বাসা-বাড়িও তো নেই!
একটাই অর্থ এর: জিনিসটা পড়েছে আকাশ থেকে।
কীভাবে সম্ভব, সেটা নিয়ে আর ভাবতে চাইল না অরণ্য। দাঁড়িয়ে রয়েছে ডায়েরিটার সামনে। টিপ-বোতাম দিয়ে কাভার আটকানোর ব্যবস্থা রয়েছে ডায়েরিটায়।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঝুঁকল ও। জিনিসটা স্পর্শ করতেই শক খেল যেন বিদ্যুতের! ঝটকা মেরে সরিয়ে আনল হাতটা। কী হচ্ছে এসব! এ কেমন আজব ব্যাপার-স্যাপার!
সময় লাগল ধাতস্থ হতে। ফের ধরবে কি ধরবে না, ভাবনার ঝড় চলছে। শেষমেশ জয় হলো কৌতূহলেরই।
কাঁপা হাত বাড়াল অরণ্য। সতর্ক এবারে। ভয়ও লাগছে কিছুটা।
আঙুল ছুঁইয়েই সরিয়ে নিল ঝট করে। কই, এবার তো হলো না কিছু!
সাহস পেয়ে হাতে তুলে নিল ডায়েরিটা। সঙ্গে সঙ্গে বিচিত্র এক শিহরণ বয়ে গেল ওর গোটা দেহ জুড়ে। ঝিমঝিম করে উঠল মাথাটা। ফেলে দিতে গিয়েও আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরে রাখল জিনিসটা।
ডায়েরিটা খসখসে, আবার রোমশ ভাবও রয়েছে যেন। কী প্রাণীর চামড়া, বুঝতে পারল না অরণ্য। গাছের পাতার গায়ে যেরকম সূক্ষ্ম শিরা-উপশিরা থাকে, এখানেও তা-ই। …অদ্ভুত!
।দেখল উলটে-পালটে। মোটাসোটা বেশ। সাধারণত ডায়েরির উপরে যেসব কথা লেখা থাকে- সাল কিংবা কোম্পানির নাম- সেরকম কিছুই নেই। সোনালি ধাতব ক্যাপ দিয়ে মুড়ে দেয়া কোনাগুলো।…বিশেষ অর্ডার দিয়ে বানানো নয় তো? ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তৈরি?
বোতামটায় আঙুল বোলাচ্ছে অরণ্য। মসৃণ, সাদাটে জিনিসটা কীসের তৈরি? হাড়?
আটকানো নয় বোতামটা। ভিতরে কী দেখবে, ভাবতে ভাবতে ডায়েরিটা খুলল ও কম্পিত হস্তে।
.
টিভির শো-রুমের সামনে থেকে সরে এল অরণ্য। শক্ত করে। চেপে ধরেছে ডায়েরিটা।
ছয়
প্রায় আধ হাত সমান রক্তলাল জিভটা বাতাস চাটছে লকলক করে, এবারে সেটা সুড়ৎ করে ঢুকে পড়ল মুখের মধ্যে। গলার ভিতর থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ বের করল পিশাচী।
তীব্র সে আওয়াজে জেগে উঠে ধড়মড় করে উঠে বসল অরণ্য।
ঝনঝন করছে মগজটা। চিত্তারের রেশ এখনও রয়ে গেছে মনের মধ্যে। মুহূর্ত পরে উপলব্ধি করল, চিৎকারটা আসলে নাইটগার্ডের বাঁশি।
কত হলো রাত?
সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেল জবাবটা। ওর দাদার আমলের পেণ্ডুলাম-ঘড়ি ঢং-ঢং শব্দে জানিয়ে দিল- দুটো।
অস্থিরতা। সেই যে বিকেল থেকে শুরু হয়েছে, কাটবার নাম নেই এখনও। বাড়ছেই বরং উত্তরোত্তর। …সহজে দূর হচ্ছেও না এ অস্থিরতা… যদি না… যদি না কয়েকটা প্রশ্নের জবাব মেলে।
হাতড়ে মিনারেল ওঅটরের বোতলে রাখা, পানি খেল। অরণ্য। তারপর দৃষ্টিহীনের মতো আঁধারে হাতড়াতে হাতড়াতে এসে ঠেকল পড়ার টেবিলটার কিনারে।
ক্লিক শব্দের সঙ্গে জ্বলে উঠল রিডিং ল্যাম্প।
ব্যাগের ভিতর থেকে ডায়েরিটা বের করল অরণ্য। চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল টেবিলে।
অন্ধকারের মাঝে, এক চিলতে আলোর নিচে উন্মুক্ত হলো রহস্যময় দিনলিপি।
না, সাধারণ ডায়েরির মতো কোনও দিনপঞ্জি নয় এটা। নেই আগে-পিছে কোনও ধরনের ইনডেক্স। একেবারে প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শুরু হয়েছে লেখা- এমন কী লাইন-টানাও নয় পাতাগুলো, তার পরও আঁকাবাঁকা হয়নি একটুও। ডায়েরির মতো দেখালেও আসলে খাতা এটা।