পুরোটা কামরায় অলস চোখ জোড়া বুলিয়ে আনল অরণ্য। স্যরকে এড়িয়ে গুজুর-গুজুর, ফুসুর-ফাসুর চলছেই। ওর পাশের বন্ধু সাউণ্ড মিউট করে পর্নো দেখছে মোবাইলে।
স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে সেঁতো হাসি হাসল জুনায়েদ। টিপে দিল ডান চোখটা।
অরণ্যর মনটা ছেয়ে গেল বিতৃষ্ণায়। হতাশ শ্বাস ফেলে ঘাড় ফেরাল বিপরীত দিকে।
জানালা এপাশে। সবচেয়ে পিছনের, দেয়ালের দিকের এই সিটটা এ কারণেই এত প্রিয় ওর। দম বন্ধ করা পরিবেশে সামান্য স্বস্তি।
উজ্জ্বল রোদের পটভূমিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে, জানালার গোবরাট ধরে মার্চ করে চলেছে কালো পিঁপড়ের বাহিনী।
মরচে পড়া মোটা লোহার গরাদে পেরিয়ে দৃষ্টি চলে গেল। বাইরে।
জঙ্গলমতো হয়ে আছে এদিকটায়। কলেজেরই প্রপার্টি। মালি-টালি নেই বলে এ অবস্থা। গোটা শহরতলিটাই এমন। অতি পুরানো এলাকাটা। বিবর্ণ সব দালানকোঠা।
কলেজের ক্ষয়া সীমানা-পাঁচিলের উপরে রোঁয়া ওঠা বাদামি বিড়াল একটা। হুলো। গোশত নেই গায়ে খেতে পায় না বোধ হয়। ইকড়ি-মিকড়ি ছায়ার নিচে নেতিয়ে পড়ে। আছে হতক্লান্ত, ক্ষুধার্তের মতো। ভরদুপুরের গরমে শ্রান্ত। C ইলেকট্রিকের তারে আটকে ঝুলছে একটা কাক অনেক দিন থেকেই। মরে, শুকিয়ে অপরিপুষ্ট লাউয়ের মতো দোল খায় বিষণ্ণ বাতাসে।
পাঁচিলের ওপাশে নির্জন গলি। রাস্তাটার ওদিকে দোকান একটা- এক কালে ছিল আর কী। এখন বহু বছর ধরে শাটার নামানো। ৭ অরণ্য একদিন গিয়েছিল ওই গলিটায়। কৌতূহল, আর কিছু নয়। দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করেছিল রং জ্বলা সাইনবোর্ডটা। Dacca ছাড়া বুঝতে পারেনি কিছুই। আরেকটা জিনিস বুঝেছে। কত আগের চিহ্ন ধারণ করে ঘুমিয়ে গেছে দোকানটা।
গিরিবাজ পায়রার একটা ঝাঁক আচমকা ঝটপট আওয়াজ তুলে উড়াল দিল আকাশে। সেদিকে চেয়ে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরণ্য। আহা, কত না স্বাধীন ওরা! ·
তিন
বড় রাস্তায় পড়ল অরণ্য। কাঁধে ব্যাগ। বাঁ হাতে একটা ডায়েরি। ওটাকে শরীরের পাশে রেখে ফুটপাথ ধরে হেঁটে চলেছে ও। মিনিট পনেরো আর লাগবে বাসায় পৌঁছোতে।
পড়ন্ত দুপুর। ক্লান্তিকর পাঁচটা ক্লাসের পর এনার্জি বলে কিছু থাকার কথা না শরীরে। কিন্তু হয়েছে উলটো। আগের চাইতে তাজা লাগছে ওর নিজেকে। ক্লাসরুম নামের কারাগার থেকে মুক্তির ফল।
লোকজন কম রাস্তায়। গাড়িঘোড়াও নেই তেমন। ফাঁকা রাস্তায় একটা বাস কান ঝালাপালা করা আওয়াজে হর্ন বাজাতে বাজাতে চলে গেল। বিচ্ছিরি! অনর্থক। এই অসময়েও মাইক ফাটিয়ে ওয়াজ হচ্ছে কোথায় জানি। মসজিদে না। সম্ভবত ভ্রাম্যমাণ কোনও ধর্মীয় সিঁড়ি বিক্রেতার ভ্যান-গাড়িতে।
ময়লার ডিপোর কাছাকাছি হতেই নাক কুঁচকে ফেলল অরণ্য। অর্ধেকটা রাস্তা দখল করে ফেলে রাখা হয়েছে বড় বড় চার-পাঁচটা কন্টেইনার। কিন্তু আবর্জনার বেশির ভাগটাই বাইরে। পরিচ্ছন্ন-কর্মীরা প্রফেশনালিজমের পরাকাষ্ঠা দেখাতে গিয়ে লেজে-গোবরে করে রেখেছে, বর্জ্য ঘাটাঘাটি করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার; এদিকে জনগণের প্রাণ যে ওষ্ঠাগত, সেদিকে নজর নেই কারও।
স্যাঁতসেঁতে জায়গাটা পেরোনোর সময় পচা-গলা গন্ধে বমি আসার জোগাড় হলো ওর। শ্বাস চেপে রেখেও রেহাই নেই- এমনই তীব্র দুর্গন্ধ! কয়েকটা কাক নোংরা খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। থেঁতলে যাওয়া মরা একটা বিড়ালের নাড়িভুড়ি নিয়ে হুটোপুটি লাগিয়েছে কতগুলো ঘেয়ো কুকুর। নরক আরও গুলজার করে তুলেছে নীল মাছির ঝাঁক।
পালিয়ে বাঁচল অরণ্য।
একটা মোড় এরপর। একটু এগোতেই টিভির একটা শো-রুম। বিক্রিবাট্টা ভালো- এমনটা কখনওই মনে হয়নি ওর।
দোকানটার পাশ কাটিয়ে গিয়েও কী ভেবে ফিরে এল আবার।
লাস্যময়ী মেয়েটা। কী যেন নাম… ও, তানহা মেহজাবিন। যত বারই দেখেছে ওকে, প্রত্যেক বারই মনে হয়েছে অরণ্যর, আপত্তিকর কিছু আছে এ-মেয়ের চোখে। সারাক্ষণই চোখ হাসছে ওর নষ্টামির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত তাতে। শরীর দেখানোর সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা তো রয়েছেই।
কর্পোরেট বেশ্যা! মনে মনে গাল দিল অরণ্য। ঠিক সেই মুহূর্তে খেয়াল হলো ওর, টিভিতে ব্রেকিং নিউজ পড়ছে তানহা। বুঝতে পারল টিভি-স্ক্রিনে খবরের হেডলাইন দেখে। আরে, ধরা পড়েছে ফারজানা মিতার খুনি!
ডিটেইলস জানার জন্য আঁকুপাঁকু করে উঠল ওর মনটা। কিন্তু উপায় কী! ফুটেজে চলে গেছে চ্যানেল।
…না, আছে উপায়। দোকানের ডিসপ্লেতে উপরে-নিচে সারি দিয়ে রাখা সবগুলো টিভিতেই খবর দেখাচ্ছে। এক একটায় এক-এক চ্যানেল। বাঁচোয়া। এই মাত্র এক পাঠক পড়তে আরম্ভ করেছে নিউজটা…
ছোট বেলায় পড়ে গিয়ে ডান কানে আঘাত পেয়েছিল অরণ্য। বছর খানেক বেশ ভুগেছে এজন্য। কম শুনত কানে। একটাতে কোনও গণ্ডগোল হলে আরেকটাও নাকি কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঠেকায় পড়ে লিপ রিডিং শিখে নিয়েছিল তখন। সেই জ্ঞান কাজে লাগছে এখন। এ মুহূর্তে ওর সমস্ত মনোযোগ সংবাদ পাঠকের ঠোঁটের দিকে। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।
চাঞ্চল্যকর সংবাদ! বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রী ফারজানা মিতার অভিযুক্ত খুনি আজ সকালে পুলিসের হাতে ধরা পড়েছে। শ্রীমঙ্গলের কলেজ রোড এলাকার একটি বাসা থেকে তাকে আটক করা হয়। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সী ফারজানাকে ধর্ষণের পর নৃশংস ভাবে জবাই করে হত্যার অভিযোগে খুনি নাজিমুদ্দীন হিকমতকে পুলিস কাস্টডিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে…
চার
আচ্ছা, কবুতরগুলো উড়ে গেল কেন ওভাবে?