পাত্তা দিল না অ্যারেনবার্গ। পিছনে রেখেছেন নিশ্চয়ই? জিজ্ঞেস করল ও। নামতে হবে না আপনার। নিজেই বের করে নিচ্ছি। মাত্র পাঁচ মিনিটের মামলা।
দাঁড়ান! ছিটকে বাস থেকে বেরোল ড্রাইভার। খপ করে ধরল টরাস চালকের এক হাতের কবজি।
কী পাগলামো… আরে! আমি না সরলে বেরোবেন কীভাবে? কঠিন হাসছে অ্যারেনবার্গ। দৃষ্টি বলছে: বার-বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান। এই বার পেয়েছি তোমাকে! খোলা হাত দিয়ে মাইক্রোবাসের স্লাইডিং ডোরটা ঠেলে দিল টেনে। বাধা দিয়েও রুখতে পারল না চশমাধারী।
ভক করে একটা বোটকা পচা গন্ধ ধাক্কা মারল অ্যারেনবার্গের নাকে। নাকে হাত চাপা দিতে বাধ্য হলো ও। ডাক্ট টেপের বড় একটা রোল বাইরে পড়ল খোলা দরজা দিয়ে। গড়িয়ে চলে গেল অন্ধকারের দিকে। চেয়ে চেয়ে ওটার চলে যাওয়া দেখল, দুজনে। তারপর তাকাল। পরস্পরের দিকে। এরপর গাড়ির ভিতরে।
আধো অন্ধকারেও ঝিলিক মারছে করাত, কুড়াল, ক্লিপার…। গাড়িময় লেগে থাকা কালচে দাগগুলো যে রক্তের, সেটা আর বলতে!
চোয়ালে বিরাশি সিক্কা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল অ্যারেনবার্গ। চশমাধারী লোকটা ঝাঁপ দিল গাড়ির ভিতরে।
ঝটকা দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বেরোল জন। চরম মুহূর্ত হাজির হয়েছে এসে। মাইক্রোফোনের কল্যাণে কিছুই অজানা নেই ওদের।
ছুটছে, যত জোরে পারে। কলেজ স্পোর্টসের পর এত জোরে আর ছুটেছে বলে মনে হয় না।
ও লম্বা একটা স্কু-ড্রাইভার নিয়ে অ্যারেনবার্গের উপরে চড়াও হয়েছে কিলার। গেলে দিতে চাইছে চোখ দুটো। মগজ ঘোলা, তা-ও প্রাণপণ চেষ্টায় ঠেকিয়ে রেখেছে অ্যারেনবার্গ। কিন্তু কতক্ষণ পারবে, বলা মুশকিল।
আরেকটা ঘুষিতে নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল ওর। এক পাশে কাত হয়ে গেছে মাথাটা। স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙে পড়ল প্রতিরক্ষা।
ওকে পরাস্ত হতে দেখে বুনো উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল খুনি। দু হাতে মুঠো করে ধরে মাথার উপরে তুলল ধাতব। শলাকাটা।
পৌঁছে গেছে জন। গুলি করল। সিগ সাওয়ারের তপ্ত বুলেট মৃত্যুচুম্বন এঁকে দিল নোংরা হৃৎপিণ্ডে।
গায়ের উপর থেকে ভারি বস্তাটা খসে যেতেই লোভীর মতো হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল অ্যারেনবার্গ। আহ, শান্তি!
কোলাহলমুখর হয়ে উঠল পুরো চত্বরটা। এস্ত পায়ের ছুটোছুটি, টর্চের আলো, সাইরেনের শব্দে ভরে গেল চারদিক। অ্যামবুলেন্স থেকে দৌড়ে এল ডাক্তার আর তার সহকারী।
খেলা শেষ, ভাবল জন।
দি এণ্ড।
অশনি সঙ্কেত
দেখে মনে হবে, গোধূলি। আসলে, তা নয়। থোকা থোকা মেঘে ভারাক্রান্ত মনে হয় আকাশটাকে। চিরস্থায়ী লাল রং ওখানে। নিচের জমিনে আকাশের সেই লালেরই প্রতিফলন। কেমন অপ্রাকৃত রং। যেন পশু জবাই করে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে রক্ত চরাচর জুড়ে।
পাহাড়ি অঞ্চল। লালচে-কালো অসুস্থ চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে এবড়ো-খেবড়ো, চোখা আকৃতির অসংখ্য পাহাড় যত দূর চোখ যায়। নিচের উপত্যকায় অশুভ অন্ধকার। না হলে দেখা যেত, লাল ধুলো ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে নাম না জানা বিশালাকার প্রাণীর সাদা হাড়, করোটি, বক্ষপিঞ্জর। হাঁ। হয়ে থাকা মুখে সারি সারি দাঁত দেখে মনে হবে, কুটিল হাসি হাসছে মৃত প্রাণীগুলো।
আর… সর্বত্র চোখে পড়ে চলমান ছায়া। অন্ধকারের জীব ওগুলো।
হু-হুঁ করে বাতাস বইছে। বিচিত্র সুর তুলেছে পাহাড়ে পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে। জোরাল মন্ত্রোচ্চারণের মতো ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সে-আওয়াজ।
কে জানি কাঁদছে কোথায়। ইনিয়ে-বিনিয়ে কান্না, সুরটা নাকি।
দীর্ঘ এক মূর্তি হাঁটু গেড়ে বসে পাথুরে এক মালভূমির চূড়ায়। কিনারার কাছে দু হাতে ভর রেখে ঝুঁকে আছে। সামনে। নিচে অতল খাদ।
চওড়া, ঢালু কপাল ছায়ামূর্তির। যেন পাথর কুঁদে বের করে আনা হয়েছে। চুল নেই। ভুরু নেই। কানে বড় বড় মাকড়ি। লম্বাটে গ্রীবা থেকে ঝুলছে হাড়ের মালা। সামনের দিকে বাঁক নেয়া চিবুকটা চেহারাটাকে ভয়াবহ করে তুলেছে আরও। বাঁকা চাঁদের মতো কাস্তে গোঁজা কোমরে। উদোম গায়ে আঁকিবুকি।
রক্তগোধূলির ছটায় জ্বলজ্বল করছে কাস্তেধারীর অস্বাভাবিক বড় চোখ জোড়া।
দুই
বড্ড আওয়াজ করে এই ফ্যানগুলো- ঘটাং-ঘট… ঘটাং-ঘট…
চার-চারখানা বৈদ্যুতিক পাখাতেও দূর হয় না চৈত্রের ভাপসা দিনের গুমট। একঘেয়ে ঢিমে-তানে ক্লান্তি বরং জমাট বাঁধে আরও।
পুরানো এই দালানটার মতোই পুরানো এই ফ্যানগুলো। কদ্দিন পরিষ্কার করা হয় না, কে জানে। ব্লেডে সাত জনমের ধুলো।
কিচ্ছু নেই… কালিঝুলি মাখা নিরানন্দ এই ক্লাসরুমগুলোতে একটা কিছু উপকরণ নেই মন ভালো হওয়ার।
মনটা পালাই-পালাই করছে অরণ্যর। সবারই বোধ হয় করে। লাঞ্চ-টাইমের পরের পিরিয়ডগুলো শেষ যেন হতেই চায় না! তার উপর রয়েছে দায়সারা গোছের বোরিং লেকচার। ঝিমুনি এসে যায় শুনতে শুনতে। চোখ জ্বালা করে ওঠে। চেয়ার-টেবিলের সস্তা কাঠ নিবিষ্ট মনে চিবোতে থাকে ঘুণ পোকা।
ইচ্ছা করলে ফাঁকি দেয়া যেত- একে অখ্যাত কলেজ, তায় সরকারি- কিন্তু এমন জায়গাতেও কীভাবে-কীভাবে যেন জুটে যায় দু -একজন, ডিসিপ্লিনের নামে যারা ছাত্র-ছাত্রীদের জান একেবারে ভাজা-ভাজা করে ফেলে। পড়ানোর বেলায়। লবডঙ্কা, কিন্তু নিয়মকানুন কড়া ওদের। ক্লাসে মনোযোগ না দাও- থোড়াই কেয়ার খবর আছে, যদি অ্যাটেণ্ড্যান্সের খাতায় লাল কালির দাগ পড়ে!