যে মুহূর্তে উপলব্ধি করল অফিসার, রক্তমাখা ছবিগুলো দেখে ফেলবে মেয়েটা, সামলাতে পারল না নিজেকে। আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হলো, বেরোও! যাও, বলছি!
ফোলানো একটা বেলুন ঠুস করে চুপসে গেল যেন। ছোট্ট মেয়েটার মুখের হাসি নিভে গেল দপ করে। কাঁচের হৃদয়, ঠুনকো বড় ভেঙে চুরমার। নত হতে হতে বুকের সঙ্গে লেগে গেল চিবুকটা।
ঝড়ো বেগে ঘুরে দাঁড়াল বাচ্চাটা। ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের উপর। একটা পা জড়িয়ে ধরে মুখ গুজল উরুতে। ফোঁপানির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।
এই মাত্র উদয় হয়েছে মহিলা। সুশ্রী। ব্যক্তিত্বসম্পন্না। কোঁকড়া, বাদামি চুলে ভরা আত্মজার মাথাটা চেপে ধরল গায়ের সঙ্গে। কটমট চোখে চাইল সাবেক স্বামীর দিকে।
তুমি কি মানুষ, লি! নগ্ন ভর্ৎসনা। তোমাকে দেখার জন্য খেপার মতো হয়ে ছিল মেয়েটা। সারাক্ষণ এক কথা: শুক্রবার কবে আসবে। বলল চিবিয়ে চিবিয়ে, আর তুমি!
ক্রন্দনরত মেয়েকে কোলে তুলে নিল ওর মা। চুকচুক শব্দ করল মুখ দিয়ে। চলো, আম্মু। এই আব্বুটা না পচা একদম!
গটমট করে কামরা ছাড়ল ভদ্রমহিলা।
পস্তাচ্ছে লি। ভীষণ বিব্রত। চট করে তাকাল জনের দিকে।
গো! চাপা গলায় হুঙ্কার দিল জন।
জিনা! জিনা! ডাক পাড়তে পাড়তে বউ-বাচ্চার পশ্চাদ্ধাবন করল অ্যারেনবার্গ।
বেশি দূর যায়নি মহিলা। হলওয়ে থেকে ওদের টুকরো টাকরা কথা কানে এল জনের। কল্পনায় দেখল, বাপের কোলে এখন পুঁচকি মেয়েটা। জড়িয়ে ধরে রেখেছে পচা আব্লুটার গলা। বাচ্চার মন- রাগ, ক্ষোভ, অভিমান মুহূর্তেই উধাও।
…তোমাদের না চারটায় আসার কথা!
…কী করব! জেদ ধরল রেনিটা। ও নাকি সারপ্রাইজ দেবে তোমাকে।
…রেনি আবার কী!
…ও-ই হলো। অত বড় নাম আওড়ানো যায় নাকি!
…দেখো, রেনির মা–
…এই যে… তুমিও বললে।
…ভুল করে বলেছি… স্লিপ অভ টাং।
…বাবা, জানো, আমাদের ক্লাসে না ছেলে আছে একটা। নাম হচ্ছে- ওমাং। আমরা বলি- ওরাংওটাং। হি-হি!
…ছি-ছি, মা! বলতে নেই এসব। যিশু আঙ্কেল রাগ করবে।
মুচকি একটু হাসল জন। চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে গেল ডিসপ্লে-বোর্ডের দিকে। এক-এক করে নামিয়ে ফেলল সবগুলো ছবি।
নয়
দস্তয়েভস্কির একটা কথা আছে। নিভৃত জীবনের চাইতে দুঃখময় আর কিছু নেই। বন্ধু নেই, স্বজন নেই। কারও যেন কিছু এসে যায় না হতভাগ্য মানুষটির নিঃসঙ্গতায়।
সিরিয়াল কিলাররা নিঃসঙ্গ। এই লোকও তার ব্যতিক্রম নয়। ভিকটিমের উপর যেভাবে আক্রোশ দেখিয়েছে, সেটা তার পুঞ্জীভূত রাগেরই বহিঃপ্রকাশ।
কেন এই ক্ষোভ? একাকী বলে? নিজের ঘৃণা তাকে প্ররোচিত করছে বাইরের জগত্তার উপর নিষ্ঠুর হতে। তবে কি ওর একাকীত্বের জন্য সভ্য জগতের কেউই দায়ী? কোনও মেয়ে? প্রতারণা, প্রত্যাখ্যান, বিশ্বাসঘাতকতা? নাকি চাকরিচ্যুতি, অবমূল্যায়ন, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা? …মহিলা বস?
যৌন-হতাশা থেকে যে খুনগুলো করেনি, এটা তো পরিষ্কার। যৌন-নির্যাতনের কোনও চিহ্নই নেই মৃতার দেহে।
ভাবো, জন, ভাবো।
পোস্টমর্টেম বলছে: ডাক্ট টেপের কারণে মৃত্যু হয়নি ভিকটিমের। নাকের ফুটো ছিল উন্মুক্ত। শুধু মুখ আর চোখ বন্ধ করাই যদি উদ্দেশ্য হয়, সারা মুখে টেপ পেঁচানোর কারণ কী? লোকটা কি কোনও ইঙ্গিত দিতে চাইছে যে, আমার কোনও মুখ নেই! পোস্ট অফিসের ডেড লেটারের মতো জীবন আমার। গন্তব্যহীন। বেঁচে থেকেও মৃত। সম্ভবত বলতে চাইছে, ওর কোনও পরিচয় নেই। বড় ধরনের কোনও অন্যায়ের শিকার? ভাতা বন্ধ? ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে? সব রকম লাইসেন্স বাতিল? কোনটা? নাকি সবগুলোই?।
ডেয়ার-ডেভিল, সন্দেহ নেই। আলামত রেখে যাচ্ছে। পরোয়া করছে না কোনও কিছুর। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ধরা পড়বে না যেন।
কিন্তু আমরা জানি, অহঙ্কার পতনের মূল।
দশ
আণ্ডারগ্রাউণ্ড পার্কিং গ্যারাজ। সেন্ট জোসেফস হসপিটাল। পোর্টল্যাণ্ড, অরেগন।
নার্সের পোশাকটা গা থেকে খোলেনি ক্যারোলিন। ভীষণ টায়ার্ড। একেবারে বাসায় গিয়েই খুলবে। টানা ডিউটির ধকল সামলানো কি চাট্টিখানি কথা! তার উপর করতে হয়েছে
ওভারটাইম। ও সাদা ড্রেসটার উপরে বোতাম খোলা কার্ডিগান চড়িয়েছে মেয়েটা। সবুজ রং- বটল-গ্রিন। ডান কাঁধে ব্যাগ। চাবির রিং ঝুলছে আঙুল থেকে। আরেক হাত অ্যাপ্রনের পকেটে।
দাঁড়িয়ে গেল হাঁটতে হাঁটতে।
পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। বুটের মচমচ। বিশাল পার্কিং লেভেলের থমথমে পরিবেশের কারণে জোরাল।
ঘুরে দাঁড়াতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওর তীব্র আলোয়। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ আড়াল করল স্বর্ণকেশী ক্যারল। ঘাড় কাত।
কে যায়? শুধাল টর্চধারী।
কে? লোকটার চেহারা দেখতে পাচ্ছে না নার্স। প্রদীপের নিচে অন্ধকার।
সিকিউরিটি।
আলো সরান! বিরক্তি মিশ্রিত সুরে বলল ক্যারোলিন। কুঁচকে রেখেছে চোখ দুটো।
মালটা ভালো, মনে মনে মন্তব্য করল প্রহরী। মুখের কাটিংটা জোস। মোম-তেলতেলে নাক। মরাল গ্রীবা। ম্যাট লিপস্টিক দেয়া আকর্ষণীয় ঠোঁটের ফাঁকে চকচকে সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে অল্প একটু। ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে লাগল আলোটা। উঁচু বুক। নামটা পড়ল নেমপ্লেট থেকে। …নির্লোম পা। হলিউডে যায় না কেন এই মেয়ে, ভাবল সে। গলার আওয়াজটাও ভারি ভালো মেয়েটার।